এভাবে ঘটনাচক্রে যে ডক্টর টিউনিসের সঙ্গে আলাপ হবে, এবং হেরম্যান তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হবেন তা সুদীপ্তর কল্পনায় ছিল না। ডক্টর টিউনিসের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে গীজা থেকে কায়রোর হোটেলে ফিরে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে, খাওয়া সেরে বেলা তিনটে নাগাদ আবার গীজাতে সেই স্ফিংসের সামনে প্রথমে ফিরে এল তারা। তারপর উট নিয়ে যাত্রা শুরু করল যেখানে ডক্টর টিউনিস হেরম্যান আর সুদীপ্তর জন্য অপেক্ষা করছেন সেদিকে। সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল ‘আপনি যে ভদ্রলোকের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন ভাবিনি।’ যেতে যেতে হেরম্যান পাশের উটে বসা সুদীপ্তকে বললেন, ‘আমি একজন ক্রিপটোজ্যুলজিস্ট। ক্রিপটিড বা লোককথা-উপকথার প্রাণী খোঁজা আমার কাজ। তুষারবৃত হিমালয় থেকে কখনো ইন্দোনেশিয়ার সুন্দাদ্বীপ, কখনো বা আফ্রিকার বুরুন্ডিতে তোমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি ইয়েতি, সোনার ড্রাগন বা সবুজ মানুষের সন্ধানে। বলতে গেলে সত্যি তেমন কিছুর সন্ধান পাইনি। কে বলতে পারে এবার হয়তো কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই ‘সিংহ-মানুষের’ দেখা মিলতে পারে। ভাগ্য-দেবতা কখন যে কার প্রতি প্রসন্ন হন তা আগাম বলা যায় না! ডক্টর টিউনিসের সঙ্গে দেখা হবার কোনো কথাই ছিল না। অথচ হল!’
সুদীপ্ত হেসে বলল, ‘আমরা যে ওখানে রানি শেবার গুপ্তধন উদ্ধার করতে যাচ্ছি না তা জানি। তবে তা পেলে মন্দ হয় না।’ উটের পিঠে চেপে বালিয়াড়িটা অতিক্রম করতেই তারা দেখতে পেল এরোপ্লেনটাকে। এক জায়গাতে গঙ্গাফড়িং-এর মতো মাথাটা কিছুটা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাদা রঙের ছোট্ট প্লেনটা। তার কাছাকাছি পৌঁছে উট ছেড়ে দেওয়া হল। একটু হেঁটে প্লেনের কাছে পৌঁছে গেল সুদীপ্তরা। সেই হুইল চেয়ার সমেতই চালকের আসনের পাশে বসে আছেন ডক্টর। কীভাবে তাঁকে সেখানে ওঠানো হল কে জানে! মোগাবো নীচে দাঁড়িয়েছিল। সুদীপ্তদের দেখে ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘নিন, এবার উঠে পড়ুন। এ প্লেনটা একটু পুরোনো হলেও ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আশা করি পৌঁছে যাব।’ আর বাক্যব্যয় না করে মালপত্রসমেত প্লেনে উঠে পড়ল সুদীপ্তরা। মোগাবো নামের লোকটাও উঠে বসল চালকের আসনে। গোঁ গোঁ শব্দে ইঞ্জিন স্টার্ট হল। বালির ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে গড়াতে লাগল তার চাকা। তারপর একসময় ছোট্ট ফকার প্লেনটা ডানা মেলে আকাশে উঠল। সুদীপ্তরা রওনা হল অজানার সন্ধানে সিংহ-মানুষের দেশে।
বেশ নীচ দিয়েই দক্ষিণ দিকে উড়ে চলল প্লেনটা। পায়ের নীচে দিকচিহ্নহীন বালির সমুদ্র, অসংখ্য বালিয়াড়ি, কখনো কখনো সেই বালির সমুদ্রে দেখা যাচ্ছে খণ্ডহর প্রাচীন স্থাপত্যর চিহ্ন। হয়তো কোনো দেওয়াল বা স্তম্ভ বালির স্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে। এক জায়গাতে মরুভূমির ভিতর উটের কাফেলাও চোখে পড়ল। ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘এরা যাযাবর গোষ্ঠীর লোক মরুভূমির এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়।’ এরপর তিনি কী বললেন প্লেনের শব্দে আর তা শোনা গেল না। প্লেনটা এত কাঁপছে যে সুদীপ্তর ভয় লাগছিল প্লেনটা ভেঙে না পড়ে। প্লেনের ভিতরটা মালপত্রে ঠাসা। তার মধ্যে একটা মুরগির ঝুড়িও আছে। হাত-পা নাড়ানো যাচ্ছে না। আকাশ থেকে নীচের দিকে দেখতে দেখতে চলল সুদীপ্তরা। মাঝে মাঝে দু-একটা মরূদ্যান। তার নীচে কয়েকটা ঘর। এত নীচ দিয়ে উড়ে যাওয়া প্লেন দেখে হাত নাড়ছে ছোট ছোট বাচ্চারা। কখনো দিকচক্রবালে ফুটে উঠছে কোনো অজানা শহরের ছবি, হাইরাইজ বিল্ডিং-এর শীর্ষদেশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যও পশ্চিম দিকে ঢলতে শুরু করেছে। রঙের খেলা শুরু হয়েছে আকাশ জুড়ে। বদলে যাচ্ছে বালিয়াড়ির রং। তাদের ঢালে বাতাস এঁকে দিচ্ছে অদ্ভুত আলপনা।
ঘণ্টাখানেক চলার পর সুদীপ্তরা দূর থেকে মাটিতে একটা নীল রঙের চিহ্ন দেখতে পেল। তার গায়ে সবুজের ছাপও যেন আছে। ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘ওটা হল, লেক নাসের’। ওখানেই আসোয়ান বাঁধ। দক্ষিণে আর একটু এগোলেই সুদান। আমরা গন্তব্যর কাছাকাছি চলে এসেছি।’ আর এরপরই প্লেনটা বাঁক নিল পূর্বদিকে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মরুভূমির মধ্যে ফুটে উঠতে লাগল প্রাচীন স্থাপত্যের নানা চিহ্ন। কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে সেসব। সুদীপ্তরা এগিয়ে চলল সেদিকে।
অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক জায়গাতে পৌঁছে চক্রাকারে পাক খেতে লাগল প্লেনটা। তাদের পায়ের নীচে প্রাচীন এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভ, গম্ভুজ, মন্দির, মিনারের চুড়ো তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তার মাঝে বেশ কয়েকটা বিশালাকৃতি পাথরের মূর্তিও চোখে পড়ল তাদের। দিনের শেষ সূর্যালোক এসে পড়েছে সেই প্রাচীন নগরীর ও মূর্তিগুলোর ওপর। কেমন যেন এক অদ্ভুত মায়াময় লাগছে সে জায়গা।
প্লেনটা বেশ কয়েকবার পাক খেয়ে সাঁ করে নামতে লাগল সেই নগরীর দিকে। মূল কাঠামোগুলোর বাইরে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে থামল সুদীপ্তদের প্লেন।
মোগাবো প্রথমে নামল প্লেন থেকে, সুদীপ্তরা নামল তারপর। তাদের ঠিক কিছুটা তফাতেই দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার এক প্রাচীন পাথুরে মূর্তি। সে যেন স্বাগত জানাচ্ছে আগন্তুকদের। আর এরপরই মোগাবো বলে লোকটার অসীম শক্তির পরিচয় পেল সুদীপ্তরা। প্লেন থেকে হুইল চেয়ারসহ ডক্টর টিউনিসকে ওপর থেকে তুলে নীচে নামল সে। নীচে নেমে টিউনিস হেসে বললেন, ‘মালপত্রগুলো মোগাবো আনবে, চলুন আমরা এগোই।’ এই বলে চেয়ারের চাকা ঘোরালেন তিনি।
দু-পাশে অসংখ্য ভাঙা স্থাপত্যের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। নানা ধরনের মূর্তি, স্তম্ভ, ছাদহীন দেওয়াল অবাক হয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে ডক্টর টিউনিসকে অনুসরণ করল তারা। টিউনিস বললেন, ‘অনেক কিছু দেখার আছে এখানে। কাল সকালে শেবার মন্দিরে নিয়ে যাব আপনাদের।’
সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘এখানে তো জঙ্গল নেই! সিংহ কোথায় থাকে?
তিনি জবাব দিলেন, ‘এই প্রাচীন নগরী অনেক বড় জায়গা নিয়ে। ভিতরে না ঢুকলে বুঝবেন না। নগরীর ভিতর ঘাসবন ঘেরা প্রাচীন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ওদের ডেরা। স্থান-মাহাত্ম্যের জন্যই ওর ভিতর এখানও অল্পসংখ্যায় টিকে আছে ওরা। ওখানেই বাচ্চাকাচ্চা দেয়। একসময় বহু হাজার বছর আগে এই সিংহবাহিনী আর সিংহ-মানুষরা নাকি এ নগরী পাহারা দিত। গুপ্তধন অভিলাষী বেশ কিছু মানুষও একসময় সিংহর আক্রমণে মারা পড়েছে।’
কথা বলতে বলতে সুদীপ্তরা এক সময় হাজির হল একটা বাড়ির সামনে। প্রাচীন স্থাপত্যের পাথর খুলে এনে এ বাড়িটা বানানো হয়েছে। ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘দশ বছর আগে ডক্টর স্মল নামে এক প্রত্নবিদ রত্নসন্ধানী এ বাড়িতে থাকতেন। এখন এটা আমার ডেরা।
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, তিনি কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন?’
ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘আমার ব্যাপারটা ঠিক জানা নেই। কিছুকাল এ বাড়িতে আমরা একসঙ্গে ছিলাম ঠিকই, কিন্তু ভদ্রলোক সিংহর আক্রমণে মারা যান। ওঁর মতো বহু পর্যটকই সিংহর হানায় মারা গেছে।’
বাড়ির ভিতর পা রাখল সুদীপ্তরা। প্রথমেই একটা বড় ঘর। ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘এটা আমার কাজের ঘর।’ সারা ঘর জুড়ে দেওয়ালের গা থেকে মেঝেতে ছড়ানো আছে হিয়ারোগ্লিফিক প্লেট। সেগুলো প্রাচীন কোনো স্থাপত্যর অংশ ছিল। সুদীপ্তরা যে ঘরে থাকবে এরপর তাদের সে ঘরে আনলেন ডক্টর টিউনিস। পাথুরে মেঝে, আর লোহার গরাদের জানলা দেওয়া একটা ঘর। তিনি বললেন, ‘আজ আর কথা হবে না আপনাদের সঙ্গে। আমার কিছু কাজ আছে। আর আপনারাও বিশ্রাম নিন।’ আর সামান্য কয়েকটা কথা বলে টিউনিস ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরই বাইরে সেই প্রাচীন নগরীতে অন্ধকার নামল।
রাতে ঘরে এসে খাবার দিয়ে গেছিল মোগাবো। তা খেয়ে শুয়ে পড়েছিল সুদীপ্তরা। মাঝরাতে হঠাৎ হেরম্যানের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে সুদীপ্ত উঠে বসল। হেরম্যান তাকে বললেন, ‘কিছু শুনতে পাচ্ছ?’ ঠিক সেই সময় তার কানে এল বাইরে দূর থেকে ভেসে আসা শব্দটা—‘আহ্-অন্ন্-ন্-ন-ন…।’ সিংহর ডাক!!
এ ডাক এর আগে আফ্রিকা অভিযানের সময় সুদীপ্তর শোনা। সে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, হেরম্যানও তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বাইরে চাঁদের আড়ালে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ। তার ভিতর থেকেই ডাকটা আসছে—‘আ-উ-উ-ং-হ-ন!’
মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে প্রাণীটা। সুদীপ্তদের মনে হল ডাকটা যেন গড়িয়ে গড়িয়ে ভিতর থেকে জঙ্গলের প্রান্তসীমার দিকেই আসছে। ক্রমশ তীব্র হচ্ছে সেই রক্ত জল করা শ্বাপদের গর্জন—হ-ন্-ন্, উ-য়া-ং!’
হেরম্যানের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। তিনি বললেন, ‘ডাক শুনে মনে হচ্ছে প্রাণীটা তার সঙ্গীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।’
ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে ডাক। একসময় ডাকটা খুব কাছে চলে এল। কিছুটা দূরে একটা ভাঙা প্রাচীর আছে। সিংহটা সম্ভবত তার পিছনে চলে এসেছে। রুদ্ধশ্বাসে নিশ্চুপভাবে তার আবির্ভাবের প্রতীক্ষা করতে লাগল সুদীপ্তরা। শেষ একটা ডাক শোনা গেল—‘আ-হ-অ-ন্-ন্!’ আর তারপরই প্রাচীরের আড়াল থেকে আবির্ভূত হল একটা অবয়ব। কিন্তু এ তো সিংহ নয়! চাঁদের অস্পষ্ট আলোতে আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষের অবয়ব! কে ও? মানুষ না সিংহ-মানুষ! সে যেন দূর থেকে এ বাড়িটার দিকেই তাকিয়ে ছ। তার দাঁড়াবার ভঙ্গি যেন তাই বলছে। মিনিট খানেক মাত্র, তারপর সে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাচীরের আড়ালে। এরপর কিছুক্ষণ মাঝে মাঝে সিংহ ডাক শোনা গেল ঠিকই, কিন্তু সুদীপ্তরা বুঝতে পারল সে ডাক ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘চলো আবার শুয়ে পড়ি, কাল একবার ও জায়গায় যাব।’