‘এক্সকিউজ মি।’ লোকটার সামনে গিয়ে হেরম্যান কথাটা বলতেই থেমে গেল হুইল চেয়ার। তাতে বসা ভদ্রলোক, কিছুটা বিস্মিতভাবে তাকালেন সুদীপ্ত আর হেরম্যানের দিকে।
হেরম্যান লোকটার উদ্দেশে বললেন, ‘একটু আগে আমরাও ট্যুরিস্ট সেন্টারে স্নাইড শো দেখছিলাম। বেরোবার সময় আপনার একটা কথা কানে এল। তাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে এলাম।’
‘কোন কথাটা?’ মৃদু সন্দিগ্ধভাবে জানতে চাইলেন ভদ্রলোক।
‘ওই যে আপনি বললেন লোকটাকে যে সে কী করে জানল পশুপাখির দেহঅলা মানুষ কোনোদিন ছিল না? আপনার কি মনে হয় সে সব প্রাণী ছিল?’ জানতে চাইলেন হেরম্যান।
ভদ্রলোক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা কে?’
হেরম্যান নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমার নাম হেরম্যান। জার্মানির লোক। আর এ হল সুদীপ্ত। ইন্ডিয়ান। আমরা দুই বন্ধু পৃথিবী ঘুরে বেড়াই। ইজিপ্ট বেড়াতে এসেছি।’
ভদ্রলোক শুনে হুইল চেয়ার থেকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমার নাম ডক্টর টিউনিস। ইজিপ্টেরই লোক। চলুন ওই ছায়ায় গিয়ে কথা বলি।’
কিছুদূরে বালির মধ্যে একটা প্রাচীন স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়াল সবাই। একটু চুপ করে থেকে টিউনিস বললেন, ‘হ্যাঁ, এ কথাটা আমি বিশ্বাস করি। নইলে এ কল্পনা মিশরের প্রাচীন মানুষদের মনে এল কীভাবে? সবই কি নিছক কল্পনা? এখানে প্রায় সর্বত্রই এ ধরনের মূর্তির ছবি পাওয়া গেছে। এসনার মন্দিরে ছবিতে সিংহ-মানুষের ছবি আছে। রানি শেবার মন্দিরে ছবি আছে যে রানি সিংহাসনে বসে আছেন, আর তাঁর হাতের শিকলে বাঁধা আছে দুটো প্রাণী। তাদের দেহ সিংহর, আর মুণ্ডু দুটো বাচ্চা ছেলের। আমি যেখানে থাকি সেখানেও বহু প্রাচীন স্থাপত্যের গায়ে ওই ছবি আছে।’
হেরম্যান বললেন, ‘আজকের খবরের কাগজেও তো সিংহ-মানুষের খবর বেরিয়েছে। মিশর-নুবিয়ান সীমান্তে সিংহ-মানুষ হত্যা করেছে দুজনকে। এ ব্যাপারে আপনার কী মত?’ ডক্টর টিউনিস জবাব দিলেন, ‘আমিও দেখেছি। সত্যি কথা বলতে কি মৃতদেহ দুটোও দেখেছি। ছিন্নভিন্ন ক্ষতবিক্ষত দুটো মৃতদেহ। সিংহর নখ ফালাফালা করে চিরেছে তাদের। বীভৎস ব্যাপার!’
‘আপনার কি মনে হয় সিংহ-মানুষই কাজটা করেছে? ওটা তো সিংহের কীর্তিও হতে পারে?’ প্রশ্ন করল সুদীপ্ত।
ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘তা হতে পারে। এক সময় সাহারা মরুভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে সিংহ দেখা যেত। তাদের কিছু বংশধর এখনও টিকে আছে ও তল্লাটে। কিন্তু বুশম্যানদের অভিমত, সিংহর পায়ের ছাপের পাশে অন্য মানুষের হাত-পায়ের ছাপ মিলেছে। আমার নিজস্ব অভিমত হল যে কাজটা সিংহ-মানুষের কিনা তা শুধুমাত্র সিংহর ছাপের পাশে অন্য ছাপ দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তবে এক সময় ও ধরনের মানুষ বা প্রাণী নিশ্চয়ই ছিল, নইলে ওই যে ফিংসের মূর্তি, ওর ধারণা মানুষ কোথা থেকে পেল? প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপি বা হিয়ারোগ্লিফিকেও এ ব্যাপারে ইঙ্গিত আছে। আমার এ সব নিয়ে কিছুটা চৰ্চা আছে।’
হেরম্যান বললেন, ‘বিভিন্ন আফ্রিকান উপকথায় তো সিংহ-মানুষের কথা আছে তাই না?’
ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ, ঠিক তাই। আফ্রিকার উপজাতিদের মধ্যে অনেক জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস প্রেতাত্মারা মৃত্যুর পর রক্তপানের লোভে সিংহ-মানুষের রূপ ধারণ করে। কোনো কোনো সময় জাদুকররাও এ রূপ ধারণ করে। সাধারণত এদের দেহটা সিংহর হয়। তবে ইচ্ছা করলে তারা আবার পরিপূর্ণ মানুষের বা সিংহর রূপ ধারণ করে। এ নিয়ে বেশ কয়েকটা ঘটনাও খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। তার দু-একটা ঘটনার কথা আমার আজও মনে আছে।’
‘যেমন?’ প্রশ্ন করলেন হেরম্যান।
একটু ভেবে নিয়ে টিউনিস বললেন, ‘যেমন বছর কুড়ি আগে একটা ঘটনা সংবাদপত্রে খুব হইচই ফেলে দিয়েছিল। উইলিয়ম নামের এক ইউরোপীয় ‘লেক নাসের’-এ উপস্থিত হয়েছিলেন সিংহ ধরার জন্য। তাঁর কাজ ছিল সার্কাস আর চিড়িয়াখানার জন্য বন্য জন্তু সরবরাহ করা। সে সময় এক বিরাটাকায় সিংহর কথা শোনা যাচ্ছিল ও তল্লাটে। সে খবর শুনেই সেখানে হাজির হয়েছিলেন উইলিয়াম। স্থানীয় বুশম্যানরা তাঁকে সতর্ক করে বলেছিল, ‘সাহেব ওটা আসলে সিম্বা নয়, ও হল জাদুকর মুরুবি। তুমি অন্য সিংহ ধরো।’ উইলিয়াম বিশ্বাস করলেন না সে কথা। শুধু তাই নয়, তিনি সটান গিয়ে হাজির হলেন গ্রামের বাইরে জাদুকর ওঝার ডেরায়। জাদুকর হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, সাহেব, সিংহটা আমি। রাতে সিংহর রূপ ধরি।’ তার কথা শুনে আরও খেপে গেলেন সাহেব। তিনি জাদুকরকে বললেন, ফের যদি সে এসব প্রচার করে নিরীহ গ্রামবাসীদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করে তবে তিনি তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবেন। সে যেন রাতের মধ্যেই সে তল্লাট ছেড়ে চলে যায়।
যাই হোক সে রাত্রেই একটা ভেড়ার টোপ দিয়ে সেই সিংহটার যাত্রাপথে একটা দাঁত ফাঁদ পাতলেন উইলিয়াম। মাঝরাতে সিংহর রক্ত জল করা চিৎকার শুনে বুঝতে পারলেন প্রাণীটা ফাঁদে পড়েছে।
পরদিন ভোরে ফাঁদের কাছে গিয়ে সাহেব দেখতে পেলেন সত্যিই ইস্পাতের দাঁতে আটকে গেছে বিরাট একটা সিংহর পিছনের পা। সিংহ গজরাচ্ছে, ছটফট করছে, কিন্তু কিছুতেই মুক্ত হতে পারছে না। ইস্পাতের দাঁত কেটে বসেছে তার পায়ে। ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে সিংহটাকে কব্জা করে তাকে পোরা হল বিরাট এক কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বানানো বাক্সে। সেই বাক্সে খাবার দেবার জন্য একটাই ছোট ছিদ্র। বাক্সের বাইরে দরজা বন্ধ করার জন্য বিরাট ছিটকিনির বন্দোবস্ত। সিংহটাকে বন্দি করার পর সাহেব খোঁজ নিয়ে জানলেন সেই জাদুকর আর তার কুঁড়েতে নেই। সম্ভবত তার হুমকিতে কাজ হয়েছে। আটক রইল সিংহ। সাহেব এবার লেগে পড়লেন চিতা ধরার কাজে। কিন্তু তৃতীয় দিন ভোরে সাহেব খবর পেলেন সিংহ খাঁচার দরজা খুলে পালিয়েছে। সাহেব হাজির হলেন অকুস্থলে। খাঁচায় সিংহ নেই। দরজা ভাঙা হয়নি, ছিটকানি খোলা হয়েছে। সিংহ কি তবে খাবার দেবার ফুটো দিয়ে থাবা বাড়িয়ে ছিটকানি খুলল? কিন্তু মানুষের হাত ছাড়া তো সিংহর থাবায় ছিটকানি খোলা সম্ভব নয়! কী হল ব্যাপারটা? আর এরপরই সাহেব দেখতে পেলেন কাঠের বাক্সের ভিতর সিংহর দাঁতের লকেটঅলা পাথরের একছড়া হার পড়ে আছে। স্থানীয় লোকেরা মালাটাকে শনাক্ত করল সেই জাদুকরের বলে। এবং তিনদিন পর জাদুকর নাকি আবার তার কুটিরে ফিরে এসেছে বলেও তারা জানাল।’ টানা কথা বলে থামলেন ভদ্রলোক।
সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে সেই জাদুকরই খাঁচার দরজা খুলে সিংহকে মুক্ত করেছিল। তারপর ওই উইলিয়ামকে বিভ্রান্ত করার জন্য তার মালাটা খাঁচায় ফেঁলে দিয়ে গেছিল? খাঁচা খোলার ব্যাপারটা বিপজ্জনক হলেও অসম্ভব নয়।’
টিউনিস মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার গল্প সামান্য একটু এখনও বাকি আছে। হ্যাঁ, উইলিয়ামও আপনার মতোই ভেবেছিলেন। এরপরই তিনি ছুটলেন সেই জাদুকর ওঝা মুরুবির ডেরায়। মুরুবি তাঁকে দেখে হেসে বলল, ‘বুঝলে সাহেব, অমন নধর ভেড়াটা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। তাই তোমার ফাঁদে পড়ে গেছিলাম। কাল হাত বাড়িয়ে ছিটকানি খুলে বাইরে বেরোলাম।’
সাহেব তার কথা শুনে চিৎকার করে বললেন, ‘তুমি একটা মিথ্যাবাদী!’ জাদুকর হেসে বলল, ‘না, মিথ্যাবাদী নই। তবে পায়ের ঘা’টা ক’দিন ভোগাবে। ফাঁদটা জব্বর ছিল তোমার!’
কথাটা শুনে উইলিয়াম চমকে উঠে তাকালেন লোকটার পায়ের দিকে। জাদুকরের বাঁ-পায়ের ওপর আঁকা হয়ে আছে একটা দিন তিনেকের পুরোনো ক্ষতচিহ্ন। সাহেব দেখেই বুঝতে পারলেন সেটা কিসের ক্ষত। ইস্পাতের দাঁতের। ঠিক এমনই ক্ষতচিহ্ন আঁকা হয়ে গেছিল সেই সিংহটার বাঁ পায়ে! বলাবাহুল্য, এরপর উইলিয়ামকে বাধ্য হয়ে গ্রাম ত্যাগ করতে হয়েছিল। কারণ, স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁকে সাহায্য করে আর জাদুকরের কোপে পড়তে রাজি ছিল না। তবে মানুষ বা প্রেতাত্মা সিংহমানুষ হয়, এ ব্যাপারটা আমি ঠিক বিশ্বাস করি না। প্রাচীন মিশরে সিংহমানুষ বলে যা ছিল তা সিংহ-মানুষই বলে আমার অনুমান।’—এই বলে কথা শেষ করলেন ডক্টর টিউনিস। সুদীপ্ত শুনে বলল, ‘বাঃ দারুণ গল্প!’
ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘হ্যাঁ, এমন আরও ঘটনা শোনা যায় সিংহ-মানুষদের ব্যাপারে। তা আপনারা এ দেশে কোথায় কোথায় বেড়ালেন? কোথায় বেড়াবেন?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘আমরা গতকালই এসেছি এখানে। লাক্সর, এসনা এসব জায়গা দেখার ইচ্ছা আছে। নীলনদে রিভার ক্রুজে যাবার ইচ্ছাও আছে। তবে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আপনার কোনো সাজেশন আছে এ ব্যাপারে?’
ভদ্রলোক একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘যদি একটু অন্যরকম জায়গা দেখতে চান তবে আমাদের ওদিকেও যেতে পারেন। ও জায়গা ইজিপ্ট আর সুদানের সীমান্ত অঞ্চল। রানি শিবা বা শেবার প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে সেখানে। কেউ কেউ বলে রানির গুপ্তধন নাকি সেখানে লুকানো আছে। একসময় ভাগ্যান্বেষীরা ওখানে গুপ্তধন খুঁজতে যেত। তবে ট্যুরিস্ট ওখানে খুব একটা যায় না। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের পক্ষে জায়গাটা আদর্শ। এসনা বা লাক্সর তো সবাই দেখে। আর ওখানে গেলে সিংহ-মানুষের দেখা পান বা না পান দুর্লভ সাহারা মরুভূমির সিংহর দেখা পেতে পারেন। কালো ‘কেশরঅলা সাহারার সিংহ এখনও টিকে আছে সেখানে। আর কিছুদিন পর তারাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’
হেরম্যান শুনে বললেন, ‘কীভাবে যেতে হয় সেখানে?’
ডক্টর টিউনিস আবারও যেন একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘ইচ্ছে হলে আমি আপনাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারি। আমার একটা ছোট ফোর সিটার ফকার প্লেন আছে। সেটা নিয়ে আমি ওখান থেকে কায়রো আসা-যাওয়া করি জিনিসপত্র কিনতে ট্রেনে আসতে একরাত লাগে। আপনারা আমার সঙ্গে যেতে পারেন। ট্রেনে ফিরবেন। দশ মাইল দূরে হলেও সেখানে একটা রেলস্টেশন আছে মরুভূমির মধ্যে। আপনারা গেলে আমার বাড়িতেই থাকবেন। আপনাদের সঙ্গলাভ করা যাবে।’
সুদীপ্ত’ একটু বিস্মিতভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘নিজস্ব প্লেন?’
ভদ্রলোক মৃদু হেসে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, নিজস্ব প্লেন। অকশন থেকে সস্তায় কিনেছি। ওর জ্বালানি ভরার জন্যও আমাকে কায়রো আসতে হয়।’
হেরম্যান ডক্টরের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনি ওখানে কী করেন?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘তেমন কিছু নয়। একলা মানুষ, নিজে নিজের মতো থাকি। এই প্রাচীন সভ্যতার নানা বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করি। বিশেষত হিয়ারোগ্লিফিক নিয়ে চর্চা করি। আপনারা গেলে ক’টা দিন গল্প করার, শোনাবার লোক পাব।’ এরপর তিনি বললেন, ‘আমার প্লেনটার সুবিধা হল ওটা ওঠানো-নামানোর জন্য এয়ারপোর্টের দরকার হয় না। স্ফিংসের উত্তরে ওই যে দূরে বালিয়াড়িটা দেখছেন ওর আড়ালে প্লেনটা রাখা আছে। এখন বেলা বারোটা। আমার শহর থেকে কিছু কেনাকাটার দরকার আছে। বিকাল চারটে নাগাদ ফ্লাই করব আমি। ইচ্ছে হলে, ভরসা থাকলে চলে আসুন। আমার এই অ্যাসিস্টেন্ট মোগাবো শুধু হুইল চেয়ার ঠেলে না, প্লেনও চালাতে পারে, এমনকী সিংহ শিকারও করতে পারে।’
ডক্টরের কথা শুনে ধবধবে সাদা দাঁত বার করে হাসল মোগাবো।