আরও ঘণ্টাখানেক সময় কেটে গেল। সুদীপ্তরা উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে মাথার ওপরের ঘরটাতে কোনো শব্দ শোনা যায় কিনা সেজন্য। বাইরে থেকে আসা সোনার আলোতে চিক্চিক্ করছে দেওয়ালগাত্রে দাঁড়িয়ে থাকা ফিংস মূর্তির আভরণ। সুদীপ্তর মনে হল ওই ছবিগুলোতেও সম্ভবত সোনার পাত বসানো। পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন ফারাওদের অঙ্গ আভরণ আজও ঝলকাচ্ছে চাঁদের আলোতে। ঠোঁটের কোণে তাদের দুর্বোধ্য হাসি!
হেরম্যান একসময় বললেন, ‘রাত দশটা বাজে।’
ঠিক এই সময় আবারও একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল তাদের। আর এবারও সেই শব্দটা আসছে মাথার ওপরের গর্তটার দিক থেকেই। সিংহটা আবার ফিরে এল নাকি! সুদীপ্ত আর হেরম্যান সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে গেল। সুদীপ্ত মাটির ওপর থেকে উঠিয়ে নিল মশালটা। আবার তাহলে সেটাকে জ্বালাতে হবে।
না, সিংহ নয়। এবার ধীরে ধীরে সেই গর্তের ভিতর প্রবেশ করল রাইফেলের একটা নল! তাহলে কী সিংহ পাঠিয়ে ব্যর্থ হয়ে ডক্টর টিউনিস এবার গুলি করে তাদের মারতে চাচ্ছেন! সঙ্গে সঙ্গে হেরম্যান আর সুদীপ্ত ঘরের অন্ধকারতম কোণে আত্মগোপন করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল। যদিও রাইফেলের নলের সামনে ফাঁদে আটকানো ইঁদুরের মতো তাদের অবস্থা। আর তার পরই রাইফেলের নলের সঙ্গে সেই গহ্বরে আত্মপ্রকাশ করল একটা মানুষের মাথা। লোকটা ফোকরে মাথা গলিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল ভূগর্ভস্থ কক্ষের ভিতরটা। আর তার রাইফেলের নল তাগ করে ঘুরে যেতে লাগল ঘরের সর্বত্র। আর কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুদীপ্তরা। রাইফেলের নলটা হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতে সুদীপ্তরা ঘরের যে কোণে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তাগ করে থেমে গেল! এবার কী গুলি চলবে? তবে খরগোশের মতো মরতে হবে তাদের। সেই প্রতীক্ষাই করতে লাগল তারা দুজন। নিস্তব্ধ রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত!
হঠাৎ চাঁদের আলোকে ধরা দিল লোকটার মুখের একপাশ। তাকে দেখে অনেকটা বাহ্যজ্ঞান-শূন্য অবস্থাতেই সুদীপ্ত অন্ধকার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আরে স্মিথ তুমি! তোমাকে না সিংহতে মেরেছে!’
স্মিথের চাপা বিস্মিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল ওপর থেকে—‘তোমরা এখানে! শুধু টিউনিস আর মোগাবোকে যখন এই মন্দিরের বাইরে বেরোতে দেখলাম, কিন্তু তোমাদের দুজনকে দেখলাম না, তখন আমার এমন অনুমান হয়েছিল। কিন্তু তোমরা ওখানে ঢুকলে কীভাবে?’
অন্ধকার ছেড়ে ঘরের মাঝখানে এসে সুদীপ্তর পাশে দাঁড়িয়ে হেরম্যান বললেন, ‘ডক্টর টিউনিস আমাদের এখানে দেখার জিনিস আছে বলে নীচে নামিয়ে মোগাবোর সাহায্যে বাইরে বেরোবার পথ বন্ধ করে দিলেন। এই ঘরটার ঠিক মাথার ওপরের ঘরটাতে একটা পাথরের বেদি আছে, সেটা ঠেললেই এই ঘরের সিঁড়ির মাথাটা ফাঁক হয়ে যায়। ওই বেদির নীচেই এ ঘরের সিঁড়ির মুখটা লুকানো। ওই পথেই এসেছি আমরা।’
স্মিথ বলল, ‘দাঁড়ান দেখছি আপনাদের উদ্ধার করা যায় কিনা?’ স্মিথের মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরে। সুদীপ্তরা মুহূর্ত গুনতে লাগল মুক্তির প্রতীক্ষায়। একটু পর সত্যিই সিঁড়ির মাথার বন্ধ অংশটা ঘড়ঘড় শব্দে ফাঁক হয়ে গেল। ওপর থেকে স্মিথের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘তাড়াতাড়ি ওপরে আসুন।’
যত দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি বেয়ে ফাঁক গলে সেই অন্ধকূপ থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে
এসে দাঁড়াল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। তাদের সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে স্মিথ! কয়েক মিনিটের মধ্যে সুদীপ্ত পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল স্মিথকে। সে শুনে বলল, ‘আজ সকালে তোমাদের চারজনকে আড়াল থেকে এ মন্দিরে ঢুকতে দেখেছি, কিন্তু বেরোতে দেখিনি। সন্দেহ আমার হয়েছিল। আরও আগেই আমি আসতাম, কিন্তু সিংহকে অনুসরণ করছিলাম। শেষে অবশ্য তারই পিছন পিছন হাজির হলাম এখানে। তার এই গর্তের ভিতর ঢোকার আকুলতা দেখে, এবং তার আঘাত পেয়ে ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা দেখে আমি অনুমান করেছিলাম এর নীচে মানুষ আছে। সম্ভবত হয়তো বা আপনারাই। কিন্তু সিংহটা আঘাত পাবার পর কাছেপিঠেই চক্কর কাটছিল বলে ফোকরের ভিতর মাথা দিতে পারিনি।’
হেরম্যান বললেন, ‘তুমি সিংহটাকে লক্ষ করে গুলি চালালে না কেন? গর্তের ভিতর যখন সে মাথা ঢুকিয়েছিল তখনই তো তাকে মারা সহজ হত।’ স্মিথ বলল, ‘তা নিশ্চয়ই হত। কিন্তু গুলি চললেই নিশ্চয়ই টিউনিস সতর্ক হয়ে যেতেন। সেটা আমি চাইনি।’
সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু টিউনিস তো আমাদের জানিয়েছেন তুমি সিংহর আক্রমণে মারা গেছ।’
স্মিথ বলল, ‘ওটা তাকে আমি বোকা বানাবার জন্যই করেছি। একটা শেয়াল মেরে জামা ছিঁড়ে তাতে তার রক্ত মাখিয়ে ফেলে এসেছিলাম। যাতে সে মনে করে সিংহ টেনেছে আমাকে! আমাকে সে কাজের সুবিধার জন্য মৃত ভাবতে পারে। আমাকে সরাবার জন্য গতকাল রাতে মোগাবো একবার আড়াল থেকে গুলি চালিয়েছিল! তা অবশ্য লাগেনি। আমার উপস্থিতি ডক্টর টিউনিসের কাছে অন-অভিপ্রেত। এবং তা এতটাই যে তার জন্য তিনি আমাকে খুন করতে পারেন। অবশ্য ফাঁদটা পাতার জন্য আমি যে জঙ্গলাকীর্ণ এই প্রাচীন নগরীতে রাত কাটাব সেটা নিজেই আপনাদের জানাতে বলেছিলাম টিউনিসকে। আমার অনুমান সেটা আপনারা ঠিক জানিয়েছিলেন তাঁকে। যে কারণে তিনি রক্তমাখা জামা পেয়ে ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন। সেটা অবশ্য কুড়িয়ে পায় মোগাবো। আমার দিক থেকে কোনো অসুবিধা আর আসবে না বুঝতে পেরেই আপনাদের আটক করে তারা।’
সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু আমাদের তারা আটকাল কেন বলো তো? ডক্টর টিউনিস আমাদের বলেছিলেন, তাঁর অনুমান তুমি গুপ্তধন সন্ধানী। তিনি নিজেও হয়তো এখানে কোনো গুপ্তধন আগলে বসে আছেন। পাছে তুমি সেটা পা-ও তাই হয়তো তিনি সরাতে চেয়েছেন তোমাদের, কিন্তু আমাদের বেলা তো সে ব্যাপারটা খাটে না? আমরা গুপ্তধন খুঁজতে আসিনি এখানে।’
স্মিথ বলল, ‘আমি এখানে ঘুরতে ঘুরতে দেবী থথের মন্দিরে বেশ কিছু প্রাচীন চিত্র দেখেছি। আমার অনুমান তোমাদের আটকানোর কারণটা সেই সিংহ-মানুষ ব্যাপারটার সঙ্গে যুক্ত। থথের মন্দিরের ছবি আর সেখানে রাখা কিছু জিনিস দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে।’
‘কী আছে থথের মন্দিরে?’ প্রশ্ন করল সুদীপ্ত।
স্মিথ সম্ভবত তার জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই একটা অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেল বাইরে। চাঁদের আলোতে তারা দেখতে পেল মোগাবো ঢুকছে এ জায়গাতে। তাকে দেখামাত্রই সবাই সতর্ক হয়ে গেল। স্মিথ লাফিয়ে উঠে আত্মগোপন করল মানুষ সমান উঁচু বেদিটার মাথায় খাঁজের মধ্যে। একসময় হয়তো সেখানে মমির আধার বা সে জাতীয় অন্য কিছু থাকত। আর সুদীপ্তরা নিজেদের লুকাল কাছেই দুটো স্ফিংস মূর্তির আড়ালে।
বাইরের ঘরগুলো পেরিয়ে সেই ঘরটাতে প্রবেশ করল মোগাবো। ভিতরে প্রবেশ করে মুহূর্তের জন্য একবার থমকে দাঁড়িয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল, তারপর যেন নিশ্চিন্তে এগোল বেদিটার দিকে। আধো অন্ধকারেও ঝকঝকে করছে তার সাদা দাঁতগুলো। তার কাঁধে বন্দুক, আর সঙ্গে একটা বস্তা। কিন্তু বেদির কাছে গিয়ে সেটা সরানো দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল সে। চট করে বন্দুক খুলে নিয়ে ঘরের চারপাশে বন্দুকের নলটা ঘোরাতে শুরু করল, কান খাড়া করে সে বোঝার চেষ্টা করল আধো অন্ধকার বিরাট ঘরের কোনো কোনা থেকে বা কোনো স্তম্ভ বা মূর্তির আড়াল থেকে কোনো ছায়া নড়ে ওঠে কিনা বা কোনো শব্দ শোনা যায় কিনা তা বোঝার জন্য। পাথরের মূর্তির মতো যে যার জায়গাতে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে সুদীপ্ত আর হেরম্যান। স্মিথের অবস্থা আরও খারাপ। মোগাবোর শ্বাস নেবার শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে, তার গা থেকেও সিংহর মতো একটা জান্তব গন্ধ টের পাচ্ছে স্মিথ। দুজনের মধ্যে এক হাতেরও ব্যবধান নেই। মোগাবো কোনো কারণে যদি পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে বেদির মাথায় উঁকি দেয় তবে সঙ্গে সঙ্গে স্মিথকে পেয়ে যাবে!
সময় যেন থেমে গেছে এ ঘরের মধ্যে। আধো অন্ধকারে মোগাবোর মুখ দেখে মনে হল সে ধন্দে পড়ে গেছে। এখনই সে ছুটে গিয়ে খবরটা জানাবে তার প্রভুকে? নাকি তার আগে নীচে নেমে দেখে নেবে লোক দুটো ভিতরে আছে কিনা? শেষ পর্যন্ত সে দেখার সিদ্ধান্তই নিল। ততক্ষণে সে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছে যে এ ঘরে কেউ নেই। প্রথমে সে তার বন্দুকটা বেদির মাথায় অজান্তেই স্মিথের গায়ের ওপর রাখল, ব্যাগটাও মেঝের ওপর রেখে উবু হয়ে সিঁড়ির মুখটায় বসে সন্তর্পণে দেখার চেষ্টা করল নীচটা। তারপর ব্যাগ থেকে টর্চ বার করে আলো ফেলতে লাগল মাটির তলার ঘরের প্রতিটা কোণে। ঠিক এই সময় একটা অবিশ্বাস্য কাণ্ড করল স্মিথ। নিঃশব্দে উঠে বসল সে। তারপর মোগাবোর রাইফেলটা তুলে নিয়ে ঝুঁকে পড়ে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল মোগাবোর মাথার পিছনে। ‘আঁক!’ করে একটা শব্দ তুলে মোগাবো ছিটকে পড়ল গহ্বরে। সুদীপ্ত হেরম্যান আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে এল, তারপর তিনজন মিলে বেদিটাকে ঠেলে সরিয়ে সিঁড়ির মুখ বন্ধ করে দিল।
কিন্তু অমন প্রচণ্ড আঘাত পেয়েও নিজেকে সামলে নিল মোগাবো। সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে সে নীচ থেকে ঠেলতে লাগল বেদিটা। ওপারে দাঁড়িয়ে তার দানবীয় শক্তির আভাস পেতে লাগল তারা তিনজন। সুদীপ্ত আর হেরম্যান যে পাথরটাকে দুজনে ঠেলে একচুল নড়াতে পারেনি সেই ভারী পাথরটা থরথর করে কাঁপছে মোগাবোর আঘাতে। যেন যে-কোনো মুহূর্তে পাথর-চাপা দানব বাইরে বেরিয়ে আসবে! মোগাবোর ব্যাগ থেকে বেরোল বেশ মোটা দড়ি, একটা ছুরি আর তরলপূর্ণ মুখবন্ধ একটা কাচের জার। তার মুখটা একটু ফাঁক করতেই মিষ্টি একটা গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল সবার।
জারের মুখটা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে স্মিথ বলে উঠল, ‘আরে এ তো ক্লোরোফর্ম! এত ক্লোরোফর্ম! সঙ্গে দড়িও আছে। ওপর থেকে ক্লোরোফর্ম ঢেলে আপনাদের অচেতন করে বেঁধে নিয়ে যাবার মতলব ছিল! ওকে কিছুতেই ওপরে উঠতে দেওয়া যাবে না। এই বেদির নীচে পাথরের পুলি বসানো আছে। প্রাচীন পুলিগুলো ওর চাপে ভেঙে গেলেই দানবটাকে আর রোখা যাবে না। আর গুলি চালালে টিউনিস সতর্ক হয়ে যাবেন। তিনি নিশ্চিয়ই মোগাবোর প্রতীক্ষা করছেন। তিনি কোথায় আমি জানি। মোগাবোর অস্ত্রেই তাঁকে ঘায়েল করতে হবে। হেরম্যান আপনি এখানে রাইফেল পাহারা দিন। মোগাবো যদি বেরিয়ে আসে তখন নিরুপায় হয়ে গুলি চালাবেন। আমি আর সুদীপ্ত এখনই আসছি।’ বেদিটা থরথর করে কাঁপছে। স্মিথ আর সময় নষ্ট করল না, হেরম্যানের হাতে মোগাবোর রাইফেল তুলে দিয়ে, কাচের জারটা সাবধানে ধরে সে সুদীপ্তকে নিয়ে ছুটল বাইরের দিকে।
চাঁদের আলোতে বাইরে বেরিয়ে তারা হাজির হল সেই ফোকরের কাছে। যেখান দিয়ে আলো ঢুকছে মাটির নীচের সেই কুঠুরিতে। সেই গহ্বরের বাইরে মাটিতে তখনও জেগে আছে সিংহর পায়ের দাগ, গহ্বরের গায়ে লেগে আছে সিংহর গোছাগোছা লোম। এখান দিয়ে সুদীপ্তদের ধরার জন্য ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল প্রাণীটা। স্মিথ নিচু হয়ে গহ্বরের মুখটাতে বসল, তারপর জারটা ফোকর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল ঘরের ভিতর। পাথুরে মেঝেতে আছড়ে পড়ে কাচের পাত্রটার চূর্ণ-বিচূর্ণ হবার শব্দ শুনতে পেল সুদীপ্ত। কাজ মিটিয়ে তারা যখন আবার হেরম্যানের কাছে ফিরে এল, তখন নীচ থেকে ধাক্কায় বেদিটা আর কাঁপছে না। ক্লোরোফর্মের প্রভাবে চেতনা লুপ্ত হয়েছে সেই দানবের। হেরম্যান স্মিথকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবার আমাদের কাজ কী?
স্মিথ বলল, ‘এবার আমরা দেবী থথের মন্দিরে যাব। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, জাদুবিদ্যার দেবী থথ। প্রাচীন মিশরীয়দের মতো ডক্টর টিউনিসও দেবী থথের উপাসক। আমি তাঁকে সে মন্দিরে ঢুকতে দেখেছি। তিনি সেখানেই আছেন। তাঁর সঙ্গে শেষ বোঝাপড়া বাকি আছে। আমারও, আর আপনাদেরও। একটা সত্যি কথা বলি, সিংহ শিকারের জন্য আমার এখানে আসা একটা অজুহাত মাত্র। যদিও আমি সত্যিই শিকারি, তবে আমি এখানে এসেছি অন্য এক সত্য অনুসন্ধানে। চলুন এবার সেখানে যাওয়া যাক। পরে সব কথা খুলে বলব আপনাদের।’—এবার যেন স্মিথের কথাগুলোও বেশ রহস্যময় শোনাল সুদীপ্তর কানে। হেরম্যান বললেন, “ঠিক আছে তবে সেখানেই যাওয়া যাক।’
পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন নগরীর মাথায় সোনার থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছে। তার আলো এসে পড়েছে রানি শেবার মন্দিরের স্তম্ভে, এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা খণ্ডহর স্থাপত্য, হাজার বছরের প্রাচীন ফিংস, আনুবিস মূর্তির গায়ে। চাঁদের আলো যেন চারপাশের রহস্যময়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ঘাসবনের মাঝে মাঝে দণ্ডায়মান মূর্তিগুলো যেন বহু হাজার বছর পর ঘুম থেকে জেগে উঠে উঁকি মেরে দেখছে সুদীপ্তদের। যেন যে-কোনো মুহূর্তে নড়ে উঠবে তারা। বিশেষত থামের ওপর সামনে পা ছড়িয়ে বসে থাকা মৃত্যুদেবতা আনুবিসের চোখগুলো চাঁদের আলোতে যেন জ্বলছে। সুদীপ্তর খালি মনে হচ্ছে তাদের নীচ দিয়ে যাবার সময়ই এই বুঝি বেদির ওপর থেকে তাদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা। প্রাচীন এই পবিত্র নগরীতে অনধিকার প্রবেশের জন্য তাদের শাস্তি দেবে মৃত্যুদেবতা আনুবিস।
ঘাসবনের ভিতর দিয়ে সন্তর্পণে এগোতে থাকল সবাই। স্মিথ একবার চাপা স্বরে বলল, ‘সিংহটাও নিশ্চয়ই কাছাকাছি আছে। সাথীহারা, আহত সিংহর প্রতিহিংসা বড় মারাত্মক!’ স্মিথ আর হেরম্যানের হাতে রাইফেল, সুদীপ্তর হাতে মোগাবোর ব্যাগ থেকে পাওয়া ছুরিটা। ক্রমশ থথের মন্দির কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। একসময় থথের মন্দিরের সামনে পৌঁছে গেল তারা।
জ্ঞানের দেবী থথ, বিজ্ঞানের দেবী থথ, প্রাচীন মিশরীয়দের নানা গুপ্তরহস্য, জাদুকরী বিদ্যার দেবী থথ। খণ্ডহর নগরীর ঘাসবনের মধ্যে চন্দ্রালোকে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ মন্দিরটা। শেবার মন্দিরের মতো বড় না হলেও এ মন্দিরটাও বেশ বড়, এবং এখনও মোটামুটি অক্ষতই আছে। মন্দিরের প্রবেশমুখের দু’পাশে ঈষৎ ঝুঁকে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ফারাওদের প্রস্তরমূর্তি। যেন নত মস্তকে তারা শ্রদ্ধা জানাচ্ছে জ্ঞানের দেবীকে। এই প্রথম ফারাওদের এ ধরনের মূর্তি দেখল সুদীপ্তরা। সারা মিশরবাসী মাথা নত করত ফারাওদের সামনে, আর তাঁরা মাথা নত করে আছেন এ জায়গাতে। আর মন্দিরের সদর দরজার ঠিক পাশেই হাতে জাদুদণ্ড নিয়ে বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং দেবী থথ। সারসমুখী বিরাট মূর্তিটা আকাশের দিকে মুখ তুলে যেন তারাদের দিকে চেয়ে আছেন। ওই অনন্ত আকাশের মতোই রহস্যময় দেবী থথ। চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ছে তাঁর গা বেয়ে। এখনই হয়তো দেবী ডানা মেলে উঠে যাবেন নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তার রহস্য সন্ধানে।
সুদীপ্তরা মন্দির চত্বরে উঠে এল। স্মিথ বলল, ‘উক্টর টিউনিস মন্দিরের ভিতরেই আছেন। কোথায় আছেন তা আমি জানি। গত দু’রাতই তিনি এসেছেন এখানে। আমি তাঁকে অনুসরণ করে সে জায়গাতে গেছি। তবে আমরা তিনজন একসঙ্গে তাঁর সামনে হাজির হব না। আমি প্রথমে হাজির হব তাঁর সামনে, তারপর আপনারা। আপনাদের মুক্তির খবর তাঁকে আমি প্রথমে দিতে চাই না। দেখি তিনি প্রথমে আমাকে কী বলেন?’
নিঃশব্দে মার্জারের মতো থথ মন্দিরের বিরাট তোরণ দিয়ে সুদীপ্তরা মন্দিরগর্ভে প্রবেশ করল। মন্দিরের ভিতরটা অন্ধকার। তবে ভাঙা ছাদের ফাটল চুঁইয়ে, উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও আলো ঢুকছে। এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের মূর্তি, স্তম্ভ। ঘরগুলোর দেওয়ালে আঁকা নানা ধরনের চিত্রলিপি, ফারাওদের বিরাট বিরাট ছবি। বাইরে থেকে আসা চাঁদের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে সেগুলো। স্মিথকে অনুসরণ করে সন্তর্পণে একের পর এক ঘর, থামে ঘেরা অলিন্দ, উন্মুক্ত ছোট চত্বর পেরিয়ে চলল সুদীপ্তরা। সেই সব চত্বরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের মূর্তি। থথ তো আছেই তার সঙ্গে হ্যাথোর, আমন, হোরাস, আনুবিস সহ অন্য দেবদেবীর মূর্তি। চলতে চলতে হঠাৎই সেরকম একটা চত্বরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল স্মিথ। দাঁড়িয়ে পড়ল সুদীপ্তরাও। স্মিথ আঙুল তুলে তাদের ইশারা করল কিছুটা তফাতে এক জায়গাতে। সেখানে একটা নিচু বেদিতে সামনের দু-পা ছড়িয়ে পরিচিত ভঙ্গিতে বসে আছেন মৃত্যুদেবতা আনুবিস। প্রাচীন মিশরীয়রা এই দেবতাকেই সব থেকে বেশি ভয় পেতেন। স্মিথের অঙ্গুলি নির্দেশে সুদীপ্তরা ভালো করে তাকাল মূর্তিটার দিকে। আর তারপরই তাদের মনে হল সেই আনুবিসের মূর্তির চোখ দুটো খুব বেশি জীবন্ত। চোখ দুটো জ্বলছে।
আর এরপরই সুদীপ্তদের অবাক করে দিয়ে একদিকে ঘাড় ফেরাল মৃত্যুদেবতা আনুবিস! সুদীপ্তর পা-দুটো কেউ যেন মাটির সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে মনে হল। তাহলে কী দেবী থথের মায়া মন্দিরে মৃত্যুর দেবতা আনুবিস জীবন্ত হয়ে উঠল। স্পষ্ট নড়ছে প্রাণীটা। হেরম্যানও কম আশ্চর্য হননি। নিজের অজান্তেই তিনি রাইফেলের নল ওপরে তুলতে শুরু করলেন। কিন্তু ঠিক এই সময় মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে গেল প্রাণীটা। একটা ছোট্ট লাফে বেদি থেকে নেমে সে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল কাছেই একটা অন্ধকার ঘরে। স্মিথ চাপা স্বরে বলল, ‘শিয়াল! প্রাণীটা আমাকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। একা কেউ এ দৃশ্য দেখলে নিশ্চয়ই হার্টফেল করত!’
সেই চত্বর পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই মন্দিরের ভিতর এক জায়গা থেকে আলোর রেশ ভেসে আসতে লাগল। স্মিথ ইশারায় বুঝিয়ে দিল টিউনিস সেখানেই আছেন। সেই আলোর রেশ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সুদীপ্তরা একসময় পৌঁছে গেল সেই ঘরটার কাছে। থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে তারা উঁকি দিল ঘরের ভিতর। হলঘরের মতো একটা উঁচু ছাদঅলা ঘর। সম্ভবত এটাই ছিল মন্দিরের গর্ভগৃহ। বিরাট বিরাট থাম ধরে রেখেছে ছাদটাকে। ঘরের মধ্যে ছোট ছোট বেশ কটা পাথুরে স্তম্ভের মাথায় বসানো কড়াইয়ের মতো ধাতব পাত্রে মশালের মতো আগুন জ্বলছে। সেই আলোতে আলোকিত ঘরটা। একদিকের দেওয়াল জুড়ে আঁকা আছে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত দেবী থথের বিরাট মূর্তি। মশালের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে সোনার পাত বসানো তার অঙ্গ আভরণ, হাতের জাদুদণ্ড। ঘরের অন্য দু’পাশের দেওয়ালের গায়ে মুণ্ডিত মস্তক প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিতদের ছবি। তাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের শলাকা। আর ঠিক তাদের পায়ের কাছে দেওয়ালের গা ঘেঁষে অপারেশন টেবিলের মতো শ্বেত পাথরের লম্বা লম্বা বেদি। সুদীপ্তরা খেয়াল করল তার একটার ওপর সবুজ চাদর চাপা কী যেন শোয়ানো আছে। ঘরের এককোণে অন্য একটা বেদির ওপর নানা ধরনের শিশি, বোতল, পাত্র, আধুনিক যন্ত্রপাতি রাখা, তারই পাশে একটা অগ্নিকুণ্ডে বিরাট ধাতব পাত্রে কী যেন ফুটছে। সেখান থেকে ওষুধের মতো কোনো কিছুর গন্ধ সুদীপ্তদের নাকে এসে লাগছে। আর এ সবের মধ্যেই দেবী থথের ছবির ঠিক পায়ের কাছে হুইল চেয়ারে বসে আছেন ডক্টর টিউনিস। তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে কোলে রাখা একটা পাথরের লম্বা প্লেট মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। কোনো প্রাচীন হিয়ারোগ্লিফিক হবে হয়তো। মুণ্ডিত মস্তক, গলা থেকে হুইল চেয়ারের প্রান্ত ছোঁয়া টিউনিসকে প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিতের মতোই দেখাচ্ছে। স্মিথ’ ইশারায় দরজার কাছে থামের আড়ালে সুদীপ্তদের আত্মগোপন করতে বলে সটান এগোল ঘরের ভিতর। ডক্টর টিউনিস তার পায়ের শব্দ শুনে মুখ না তুলে তাকে মোগাবো ভেবে মৃদু ভর্ৎসনার স্বরে বললেন, ‘একটা মানুষকে বয়ে আনতে এত সময় লাগল তোমার! রাত যে শেষ হতে চলল!’
তিনি সম্ভবত ধারণাই করতে পারেননি মোগাবো ছাড়া অন্য কেউ এ সময় সেখানে উপস্থিত হতে পারে।
স্মিথ কাছে গিয়ে তাঁর কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে জবাব দিল, ‘আমি স্মিথ, মোগাবো নই। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
ডক্টর টিউনিস কথাটা শুনে চমকে উঠে তাকালেন তার দিকে। তারপর বিস্মিতভাবে বললেন, ‘তুমি! কিন্তু তোমাকে তো সিংহ টেনে নিয়ে গেছিল!’
স্মিথ মৃদু হেসে জবাব দিল, ‘না, সিংহ আমাকে মারতে পারেনি। আর আমিও তাকে মারতে পারিনি। দুজনেই বর্তমান। তবে কাল আমি ফিরে যাচ্ছি, যাবার আগে কিছু কথা জানতে এলাম।’
স্মিথের চলে যাবার কথা শুনে মনে হয় খুশি হলেন টিউনিস। একটু হেসে তিনি বললেন, ‘কী কথা?’
স্মিথ এবার হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘ওই যে, যে দুজন ভদ্রলোক আপনার অতিথি ছিলেন তাঁরা কোথায়?’
প্রশ্ন শুনে ডক্টর টিউনিসের মুখটা মুহূর্তের জন্য গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি যেখানে বসে আছেন তার পাশেই দেওয়ালের গায়ে একটা বড় জানলা মতো আছে, তার মধ্যে দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘তাদের এ জায়গা দেখা হয়ে গেছিল। আজ দুপুরে মোগাবো তাদের স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে। এ কথাটাই কী জানতে এসেছ? কেন?’
স্মিথ জবাব দিল, ‘না, এমনি জানতে চাইলাম। আমার আসল প্রশ্ন অন্য। তার আগে আমার আর একটা পরিচয় বলি, আমার বাবাকে আপনি চিনতেন। তাঁর নাম ছিল ডক্টর স্মল। শল্যবিদ ও মিশর গবেষক ডক্টর স্মল। যিনি কুড়ি বছর আগে এই থথ মন্দিরের বাইরে সিংহর আক্রমণে আহত হয়ে দু-দিনের মধ্যে প্রাণ হারান।’
তার কথা শুনেই হুইল চেয়ারে সোজা হয়ে বসে ডক্টর টিউনিস স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন স্মিথের দিকে। সে এরপর বলল, ‘যতটুকু জানি সে সময় এক ব্রিটিশ পর্যটকদল এখানে এসেছিল। তারা ভোরবেলা আমার বাবার ক্ষতবিক্ষত অচৈতন্য দেহটাকে উদ্ধার করে তাঁকে কায়রো পাঠান। সেখানেই আমি তাঁর বীভৎস দেহটা দেখতে পাই। এ ঘটনার ক’দিন আগেই তিনি বাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন যে তাঁর কাজ শেষ, এবার তিনি বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু তাঁর ফেরা হয়নি।’ ডক্টর টিউনিস জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা তাই। দুর্ঘটনার আগের দিন আমি আবুসিম্বল গেছিলাম। ফিরে এসে ঘটনাটা শুনি। তখন তাঁকে কায়রো পাঠানো হয়ে গেছে। অনেক পুরোনো ঘটনা এসব।’
স্মিথ বলল, ‘হ্যাঁ, পুরোনো ঘটনা। এবার সরাসরি প্রশ্ন করি, আপনারা কি এখানে দুর্মূল্য কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন? যদি পেয়ে থাকেন, তবে সেটা কী?
ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘এই সব প্রাচীন স্থাপত্যের সব কিছুই দুর্মূল্য। দুর্মূল্য বলতে তুমি কি তুতেনখামেনের সমাধির মধ্যে যেমন রত্নপেটিকা পাওয়া গেছিল তেমন কিছু বলছ? না, তেমন কিছু তিনি বা আমি কেউ পাইনি। দেওয়ালের গায়ে সোনার পাত অবশ্য পেয়েছি। তুমি কি এখানে গুপ্তধনের ভাগ নিতে এসেছ?’
‘না, গুপ্তধনে আমার আগ্রহ নেই। আমি সত্য সন্ধানে এসেছি। আমার ধারণা আমার বাবা কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন, যা তাঁর মৃত্যু ডেকে আনে। আমার ধারণা আপনি জানেন সেটা কী? হয়তো সেজন্যই সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূরে এখানে আপনি পড়ে আছেন।’ ডক্টর টিউনিস জানলার বাইরে একবার তাকিয়ে নিয়ে হেসে বললেন, ‘আমি সভ্য সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি প্রাচীন মিশর নিয়ে গবেষণার কাজে। তাই এখানে থাকি। কোনো সম্পদ আগলে রাখার জন্য নয়। তাছাড়া গরিব গ্রামবাসীরাও আমার চিকিৎসায় উপকৃত হয়। তবে তোমার কল্পনাশক্তিকে প্রশংসা জানাতে হয়। কিন্তু তোমার এ ধারণা হল কেন?’
স্মিথ বলল, ‘ধারণার স্পষ্ট কারণ আছে, কারণ তিনি তাঁর শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন যে আপনারা এখানে এমন কিছু খুঁজে পেয়েছেন যা তুতেনখামেনের সমাধি মন্দির আবিষ্কারের চেয়েও চমকপ্রদ। যা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। সেটা কী তিনি অবশ্য বলেননি। সেটাই আমি জানতে চাই আপনার কাছে। আর মৃত্যুর আগে একবার চোখ মেলে তিনি ছোট্ট একটা শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন, ‘থথের মন্দির!’ এ মন্দিরে কী পেয়েছিলেন আপনারা?’
থামের আড়াল থেকে বিস্মিতভাবে দুজনের কথোপকথন শুনতে লাগল সুদীপ্তরা। ডক্টর টিউনিস জবাব দিলেন, ‘তোমায় তো বললাম, আমার এসব ব্যাপারে কিছু জানা নেই। হয়তো তিনি জানতেন, আমাকে জানাননি। আমি মিথ্যা বলি না। আর কিছু প্রশ্ন থাকলে তাড়াতাড়ি বলো, আমায় আর বিরক্ত করো না।’ এই বলে তিনি আবার জানলার দিকে তাকালেন। সম্ভবত তিনি মোগাবোর প্রতীক্ষা করছেন।
স্মিথ হেসে বলল, ‘ও আপনি মিথ্যা বলেন না? একটু আগেই তো আপনি জলজ্যান্ত একটা মিথ্যা বললেন। আপনার বাড়ির অতিথি দুজন ফিরে যাননি। তাঁদের এক পুরোনো মন্দিরের নীচে আটকে রেখেছেন।’
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে টিউনিসের মুখে যেন চাবুক পড়ল। মশালের আলোতে লাল হয়ে উঠল তাঁর মুখ। স্মিথ এবার ঘুরতে শুরু করেছে ঘরের মধ্যে। ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘ওরা প্রাচীন প্রত্নবস্তু চুরি করতে এসেছিল। তাই আটক করেছি। কাল পুলিশে খবর দেব।’
স্মিথ ছোট্ট জবাব দিল, ‘এটাও মিথ্যা কথা। আপনি ওদের নিয়ে কী করবেন বলুন তো?’
ঘরটাতে ঘুরতে ঘুরতে স্মিথ তখন চলে এসেছে দেওয়ালের কাছে সেই টেবিলগুলোর সামনে। হঠাৎ সে এরপর সেই সবুজ চাদর দিয়ে ঢাকা দেওয়া জিনিসটা সরিয়ে ফেলে বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘আরে এ যে সিংহীর দেহ! নিশ্চয়ই যেটা ক’দিন আগে মারা গেছিল সেটার দেহ! যার সঙ্গী সিংহটা এখন নগরীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা নিয়ে কী করছেন আপনি?’
ডক্টর টিউনিস জবাব দিলেন, ‘তুমি হয়তো জান আমি শল্য-চিকিৎসার অধ্যাপক ছিলাম। অ্যানাটমি নিয়ে আগ্রহ আছে আমার। দেহটা তুলে আনার মধ্যে অন্যায় আছে নাকি?’ এবার মৃদু ব্যঙ্গের সুর ডক্টর টিউনিসের গলাতেও ফুটে উঠল।
স্মিথ ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বলল, ‘আমি জানি, আপনি আর আমার বাবা দুজনেই শল্যবিদ ছিলেন। ওটা ছিল আপনাদের পেশা, আর মিশর নিয়ে গবেষণা ছিল নেশা। দুটোতেই সফল ছিলেন আপনারা। প্রাচীন মিশরীয়রা শল্যবিদ্যা, শরীরবিদ্যায় অনেক উন্নত ছিলেন। আচ্ছা, এমনকী কিছু আপনারা খুঁজে পেয়েছিলেন যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত? এ ঘরটা দেখে আমার তেমনই মনে হচ্ছে।’
এরপর সে কাছেই একটা পাত্রর থেকে কয়েকটা সার্জিকাল ক্যালপল বা শল্যচিকিৎসার ছুরি উঠিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরে ছবির পুরোহিতদের হাতে ধরা অস্ত্রগুলোর সঙ্গে এ জিনিসের খুব মিল তো! আর এই বেদিগুলো দেখেও মনে হচ্ছে এ ঘরটা সম্ভবত অপারেশন থিয়েটার ছিল। দেবী থথের এই মন্দিরেই তো বিজ্ঞানচর্চা হত তাই না? যে গোপন বিদ্যাকে লোকে ভাবত জাদুবিদ্যা।’