শেরা মন্দিরের সিংহ মানুষ – ১

বিরাট মূর্তিটার দিকে বিস্মিতভাবে তাকিয়েছিল সুদীপ্ত। ইতিহাস বইয়ের এ মূর্তির ছবি সে বহুবার দেখেছে। বিশালাকার এক মূর্তি সামনের দুটো থাবা মেলে বসে আছে দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমির মধ্যে। তার দেহটা সিংহের, আর মাথাটা মানুষের। সিংহ-মানুষ বা স্ফিংস। হাজার হাজার বছর ধরে একইভাবে বসে সে যেন পাহারা দিচ্ছে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডগুলোকে। নীল নদের উপত্যকায় পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার একমাত্র সাক্ষী এই সিংহ-মানুষ। কত মরু-ঝড় বয়ে গেছে এই মূর্তির ওপর দিয়ে, তবু সে আজও জেগে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো। হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘জানো, ঠিক আমরা যেভাবে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক এমনি-ভাবেই এই মূর্তির সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়নের মতো মহাবীররা! মহাকাল তাঁদের সবাইকে গ্রাস করে নিলেও এখনও এই মূর্তিটা স্বমহিমায় বিরাজমান। সত্যি, মানুষের জীবন কত তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর!’

সুদীপ্ত মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্রাচীন মিশরীয়দের কল্পনাশক্তি খুব বেশি ছিল, নইলে এমন এমন মূর্তি কেউ বানাতে পারে না। আমাদের দেশে অবশ্য এক গল্প আছে। ভগবান বিষ্ণু নাকি একবার সিংহ-মানুষ বা নরসিংহরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁর ভক্ত প্রহ্লাদকে বাঁচাতে। তাঁর মাথাটা ছিল সিংহের।’

হেরম্যান বললেন, ‘তাই নাকি? তবে আজ হোটেলের ঘরে খবরের কাগজে একটা অদ্ভুত খবর দেখলাম।’

‘কী খবর?’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘সিংহ-মানুষের। আফ্রিকার বহু মানুষ এই সিংহ-মানুষের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। তাদের ধারণা, স্থানীয় ওঝা বা জাদুকর মারা যাবার পর তাদের প্রেতাত্মারা সিংহ-মানুষের রূপ নিয়ে মানুষের রক্তপান করে। তুমি হয়তো জানো যে সাহারা মরুভূমির কিছু অংশে সংখ্যায় অল্প হলেও সিংহ পাওয়া যায়। এই মিশরের সুদান সীমান্তে একটা গ্রামে নাকি সিংহ-মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। তার পায়ের ছাপ মিলেছে। দুজন মানুষকে ইতিমধ্যে হত্যাও করেছে সে। স্থানীয় মানুষের অভিমত তাই। খবরের কাগজে তাই লিখেছে।’

সুদীপ্ত বলল, ‘এমন তো হতে পারে যে, কোনো সিংহই আসলে সে মানুষগুলোকে

মেরেছে?’

হেরম্যান বললেন, ‘তা পারে। কিন্তু সিংহের পায়ের ছাপ যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে মানুষের যে অন্য হাত-পায়ের ছাপ মিলেছে, তা মৃত মানুষের নয়।’—এরপর হেরম্যান রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে দেরি হয়ে গেল! শো মনে হয় শেষ হয়ে গেল! চলো চলো!’

কাছেই ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসে ট্যুরিস্টদের জন্য একটা স্লাইড শোর টিকিট এখানে আসার পরই কেটে রেখেছিল সুদীপ্তরা। হেরম্যানের কথা শোনার পরই আশেপাশের ট্যুরিস্টদের ভিড় ঠেলে দুজনে ছুটল সেদিকে।

ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের ঘরটায় শো চলছে, তারা যখন সেখানে ঢুকে চেয়ারে বসল তখন শো প্রায় শেষের পথে। ছোট্ট হলঘরটা অন্ধকার। পর্দায় প্রজেক্টরের মাধ্যমে ফুটে উঠছে নানা ছবি। আর একজন ভদ্রলোক মাইক্রোফোন হাতে বলে যাচ্ছেন সেই ছবিগুলো সম্বন্ধে, মিশরের ইতিহাস সম্বন্ধে। সুদীপ্তরা দেখতে লাগল সেই ছবি।

একসময় পর্দায় ফুটে উঠল মিশরীয় দেবতাদের সার সার ছবি। নানা প্রাচীন দেবদেবীর অদ্ভুত সব মূর্তি! যে ভদ্রলোক বিবরণ দিচ্ছিলেন, তিনি এবার বললেন, ‘ছবিগুলো আপনারা ভালো করে লক্ষ করুন। অন্য দেশের দেবদেরীদের সঙ্গে প্রাচীন মিশরীয় দেবদেবীর বিশেষ পার্থক্য আছে। আপনারা স্ফিংস দেখেছেন। তার দেহটা সিংহের, মুখটা মানুষ বা ফারাওয়ের। তেমনই মিশরের প্রায় প্রত্যেক দেবদেবীর মাথা অথবা দেহ কোনো-না-কোনো পশুপাখির। মানুষের মাথা, আর ভেড়ার দেহ, যে মূর্তি আপনারা পর্দায় দেখতে পাচ্ছেন, তা হল সূর্যদেবতা ‘হ্যাথরের’ মূর্তি। মানুষের দেহ আর বাজপাখির মাথাঅলা মূর্তি হল, আকাশদেব ‘হোরাসের’। বাঁকানো ঠোঁটের পাখির মাথাঅলা মূর্তি হল বিচারের দেবতা ‘কা’-এর। ওই যে, কুকুরের মাথাঅলা দেবতা তো আপনাদের অনেকেরই পরিচিত—‘মৃত্যুর দেবতা অনুবিস।’ আর এই সারসের মাথাঅলা দেবী হলেন, প্রাচীন মিশরীয়দের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও চিকিৎসার দেবী ‘থট’ বা ‘থথ্’। সে যুগে মিশরবাসী নানা পশুপাখি পুষতেন। ষাঁড়, বিড়াল, বাজপাখি এদের দেবতা জ্ঞানে পুজোও করা হত। অনুমান করা হয় সেজন্যই এ ধরনের দেবদেবীর মূর্তি কল্পনা করা হত…।’

তাঁর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে কে হো হো করে হেসে উঠল!

হাসিটা শুনে মুহূর্তের জন্য থামলেন ভাষ্যকার। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, প্রাচীন মিশরীয়রা এসব কল্পিত মূর্তি বানিয়েছিলেন…।’ ‘হা, হা, হা!’ আবারও হাসির শব্দ! এবার আরও জোরে। দর্শকরা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করতে লাগল হাসির উৎস কোথায় ?

ঘোষক এবার স্পষ্ট বিব্রত হয়ে বললেন, ‘সাইলেন্স প্লিজ! হাসবার মতো কোনো ব্যাপার ঘটেনি।’

হাসি আর শোনা গেল না। ঘোষক আবার বলতে শুরু করলেন। অবশ্য আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শো শেষ হয়ে গেল। জ্বলে উঠল প্রেক্ষাগৃহের আলো। আসন ছেড়ে উঠে সবাই বাইরে বেরোবার জন্য এগোল। সুদীপ্তরাও বাইরে বেরোতে যাচ্ছিল, ঠিক এই সময় তারা দেখতে পেল একজনকে। গলা থেকে পা পর্যন্ত সাদা আলখাল্লায় মুড়ে হুইল চেয়ারে বসে আছেন এক মুণ্ডিতমস্তক মিশরীয় ভদ্রলোক। আর হুইল চেয়ারটাকে ধীরে ধীরে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে একজন দীর্ঘদেহী কাফ্রি। বেরোবার সময় হঠাৎ সেই লোকটার সঙ্গে ঘোষকের চোখাচোখি হতেই সেই ঘোষক হুইল চেয়ারে বসা লোকটার উদ্দেশে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ‘ও ডক্টর টিউনিস আপনি! তাই ভাবছিলাম কে হাসে!’

টিউনিস বলে লোকটা বললেন, ‘তুমি হাসার মতো কথা বললে হাসব না? তুমি কী করে জানলে ওই মূর্তিগুলো সব কল্পিত? ওসব প্রাণীর বাস্তবে অস্তিত্ব কোনোদিন ছিল না? হয়তো অমন প্রাণী ছিল সে সময়?’ প্রথমজন এবার তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘মরুভূমির অশিক্ষিত লোকজনের সঙ্গে থাকতে থাকতে আপনার মাথাটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেছে দেখছি। খবরের কাগজে পড়লাম, আপনি যেখানে থাকেন সেখানে নাকি সিংহ-মানুষ বেরিয়েছে! আপনার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে নাকি? তবে তার সঙ্গে একটা ছবি তুলে পাঠাবেন। স্লাইড শো-তে দেখাব।’ বিদ্রুপের স্পষ্ট সুর শোনা গেল তাঁর গলায়।

মুণ্ডিতমস্তক হুইল চেয়ারে বসা লোকটা বক্তার উদ্দেশে একটা ছোট্ট মন্তব্য করলেন—‘মূর্খ!’ কাফ্রিটা এরপর তাঁকে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। সে বাইরে যেতেই একজন ট্যুরিস্ট কৌতূহলবশত ঘোষককে জিজ্ঞেস করল, ‘এ লোকটা কে?’

ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘লোকটা ইজিপ্টোম্যানিয়াক। উনি অধ্যাপনা করতেন। পাগলামির জন্য সেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। সভ্য সমাজ ছেড়ে এখন অনেক দূরে দিন কাটান। মিশরের ইতিহাস নিয়ে অনেক উদ্ভট চিন্তা আছে ওঁর ! ইজিপ্টোম্যানিয়াক মানে ইজিপ্ট নিয়ে গবেষণা করতে করতে যাঁরা আধপাগল হন।’

সুদীপ্তরা এসব কথোপকথন শুনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘চলো তো, একবার বাইরে বেরিয়ে ওই হুইল চেয়ারে বসা লোকটার সঙ্গে কথা বলা যাক। খবরের কাগজের সিংহ-মানুষের ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। যদি লোকটা ও ব্যাপারে কিছু বলতে পারে।

সুদীপ্ত তাঁর কথা শুনে হেসে বলল, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে!’ হেরম্যান বললেন, ‘তবে আমরা যে ক্রিপটিড বা গল্পকথার প্রাণী নিয়ে অনুসন্ধান করি সে কথা বলার প্রয়োজন নেই লোকটাকে। আমরা ট্যুরিস্ট হিসাবেই নিজেদের পরিচয় দেব।’

সুদীপ্ত বলল, ‘ঠিক আছে চলুন।’

বাইরে বেরিয়ে এল তারা। চারপাশে তাকিয়ে তারা দেখতে পেল লোকটাকে নিয়ে হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলেছে তাঁর অনুচর।