০১.
ফ্যাশন শোতে যাচ্ছি ভাবতেই দারুণ লাগছে, কিশোর পাশা বন্ধুদের উদ্দেশে বলল। এইমাত্র ওরা ওদের প্রিয় দোকান ফ্যাশন হাউজ -এ প্রবেশ করল।
যে ড্রেস পরে মডেলিং করব সেটা কি ওরা দিয়ে দেবে নাকি? প্রশ্ন করল রবিন মিলফোর্ড।
মাথা নাড়ল মুসা আমান।
রবিন! তোমার ক্লজিটের যেরকম ঠাসাঠাসি অবস্থা, কবে যে দরজাটা ভেঙে যাবে!
রবিন হাসল বন্ধুর দিকে চেয়ে।
গেছে অলরেডি!
ছেলেরা মহা উত্তেজিত। ফ্যাশন হাউজ মস্ত দোকান। ওটার ভিতরেই শো হবে। রকি বীচের বেশ কয়েকজন ছেলে-মেয়ে মডেল। কিশোর আর রবিনও রয়েছে তাদের সঙ্গে।
আরি! সবিস্ময়ে বলে উঠল কিশোর। ফ্যাশন হাউজকে তো কখনোই এমন সাজে দেখিনি।
দোকানটার দিকে দৃষ্টি বুলাল তিন গোয়েন্দা। আগাগোড়া বিশাল এক লাল কার্পেট ফেলা হয়েছে। কার্পেটের দুধারে সারি সারি চেয়ার। প্রত্যেকটা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছে একটা করে রঙিন বেলুন।
কাপড়ের ব্ল্যাকগুলোর উপরে কার্ডবোর্ডে লিখে রাখা হয়েছে: ব্যাক টু স্কুল।
ধ্যাত, বিরক্তি প্রকাশ পেল মুসার কণ্ঠে। গরমের ছুটি শেষ হতে আরও তিন সপ্তা বাকি, অথচ এখনই স্কুলে ফিরে যেতে বলছে!
মুচকি হাসল কিশোর।
ভালই তো, ব্যাক টু স্কুল বলছে, কিন্তু আসলে তো ফ্যাশন শো!
কিশোর, দেখো, বলে উঠল রবিন। দেয়াল ঘড়ির দিকে আঙুল তাক করেছে। একটা বেজে গেছে। শোয়ের আর এক ঘণ্টা বাকি।
স্টোরের মালিক মিরা ব্যস্ততার সঙ্গে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তাকে ও তার সেলসগার্ল রীটাকে চেয়ার গুনতে দেখল ছেলেরা।
মিরার মাথায় খাটো, কালো চুল। চোখজোড়া নীল। কালো প্যান্ট ও চকচকে লাল ব্লাউজ ওর পরনে।
রীটা পরেছে স্ট্রাইপৃড় টি শার্ট ও ট্যান প্যান্ট। বাদামী চুলের মেয়েটির মুখ ভর্তি ফুটকি চিহ্ন।
মিরা আর রীটা আমাদের চেয়ে কম এক্সাইটেড না, বলল গোয়েন্দাপ্রধান।
নার্ভাসও বলতে পারো, যোগ করল রবিন। মুসার দিকে ফিরল। শোতে নাম না দেয়ায় এখন খারাপ লাগছে না তোমার?
মাথা নাড়ল মুসা।
জিন্স আর সকার শার্টের মডেলিং করতে দেবে না, খারাপ লাগবে কেন?
রবিন চোখ নাচাল, কিন্তু হেসে ফেলল কিশোর। রবিন আর মুসার পছন্দ এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে।
আমাদের বরং সুবিধেই হয়েছে, বলল কিশোর। মুসা আমাদের আউটফিট বদলাতে সাহায্য করতে পারবে।
অন্যান্য যেসব ছেলে-মেয়েরা মডেল হবে, তারা আসতে শুরু করেছে। জুলি মরগ্যান আর রুডি মার্শকে দেখতে পেল ওরা। পরমুহূর্তে এমন একজনকে দেখল, ওরা যাকে আশা করেনি।
শুঁটকি টেরিও নাম লিখিয়েছে নাকি? গুঙিয়ে উঠল কিশোর।
ও মনে হয় দুটি প্যান্টের মডেলিং করবে, বলে হেসে ফেলল রবিন।
আমি কিন্তু কথাটা শুনতে পেয়েছি, রবিন মিলফোর্ড! খ্যাক করে উঠল শুঁটকি। তিন গোয়েন্দার কাছে হেঁটে এল। মেয়েদের মত পনিটেইল রেখেছে শখ করে।
গোয়েন্দাদের আবার মডেলিং করার শখ হলো কবে থেকে?
আজকে থেকে, জবাবে বলল গোয়েন্দাপ্রধান।
দাঁতে দাঁত পিষে মাথা নাড়ল টেরি।
তুমি এখানে কেন, টেরি? কিশোর প্রশ্ন করল।
চোখ জ্বলে উঠল টেরির।
ডয়েল নিউজে আর্টিকল লিখছি আমি।
এ আর নতুন কথা কী? মুসা বিড়বিড় করে বলল।
ডয়েল নিউজ শুঁটকির নিজের খবরের কাগজ। বাসায় বসে কম্পিউটারে নিজেই লেখে।
ফ্যাশন শো-র নতুন ড্রেসগুলো সম্পর্কে লিখবে, তাই না? রবিন বলল।
ধূর্ত হাসল টেরি।
না, বলল। গসিপ কলাম লিখব ঠিক করেছি।
কিশোর একদৃষ্টে চেয়ে টেরির দিকে। কী ধরনের গুজব রটাতে চাইছে শুঁটকি?
গসিপ রটানো কি ঠিক, টেরি? বলল অবশেষে। বিশেষ করে মিথ্যে গুজব।
চুলে আঙুল চালাল টেরি।
মিথ্যে গুজব রটা কে বলল তোমাকে?
তুমি তো আগেও অনেক বানোয়াট গপ্পো কেঁদেছ, টেরি, বলল মুসা। আমরা তো চিনি তোমাকে।
রেগে গেল শুঁটকি।
দেখো, বাজে কথা বলবে না। বানাবার কোন দরকারই পড়বে না, বলল। রসাল খবরের অভাব হবে না এখানে।
এই বলে চলে গেল টেরি। এক গাদা সোয়েটার দেখতে লাগল মন দিয়ে।
শুঁটকি যখন এসে হাজির হয়েছে, বলল রবিন। তখন এর চাইতে খারাপ আর কী হতে পারে?
মুসা দরজার দিকে আঙুল দেখাল।
কেন শিপটনের ব্যাপারে কী বলবে?
কিশোর ঘুরে তাকাল। দেখতে পেল কেন শিপটন ঢুকছে। সঙ্গে ওর যমজ দুই ভাই মানি আর পেনি। যমজ বাচ্চা দুটো মডেল হবে।
আমরা শো করব! চেঁচিয়ে উঠল মানি।
আমরা সবার চেয়ে সুন্দর! যোগ করল পেনি।
মুখে আইসক্রীম লেগে আছে, তাও? মুসা বলল।
কোন বিকার হলো না যমজদের। হাসি মুখে পাণ্ডা বার চকোলেট আইসক্রীম খেয়ে চলেছে।
কিশোরের এবার নজর গেল কেনের মাথায় পরা কালো বেরে টুপির দিকে।
তোমার জাদুকরের পোশাকের সঙ্গে মানাবে টুপিটা, বলল ও। ও জানে, কেন বড় হয়ে ম্যাজিশিয়ান হতে চায়।
আমি ঠিক করেছি ম্যাজিশিয়ান হব না, বলল কেন। পকেটে হাত ভরে ভাঁজ করা এক কাগজ বের করল। শিল্পী হব।
কাগজটা তুলে ধরল। সাদা একটা ছোপ ছাড়া আর কিছু ধরা পড়ল না কিশোরের চোখে।
কী পড়েছিল? প্রশ্ন করল মুসা। দুধ?
তুমি গ্রেট আর্টের কিছুই জানো না, কাটখোট্টা গলায় বলল কেন। পেইন্টিংটায় আঙুল রাখল। এটা মেরু ভালুকের ছবি। তুষারঝড়ের মধ্যে পড়েছে।
ঘাড় কাত করল কিশোর। কোথায় মেরু ভালুক আর কোথায়ই বা তুষারঝড়?
এরপর কী আঁকবে ওদেরকে বলো না, ভাইকে বলল মানি।
আমার পরের প্রজেক্ট হচ্ছে, ঘোষণা করল কেন। পোকা-মাকড়দের ছবি আঁকা।
তেলাপোকা? সবিস্ময়ে বলল রবিন।
মাথা ঝাঁকাল কেন।
তবে আঁকব কালো ভেলভেটের ওপর। প্রদর্শনীতে যেমনটা দেখা যায় আর
খাইছে! অত তেলাপোকা পাবে কোথায়? মুসা বলল।
জোগাড় হয়ে গেছে অলরেডি, জানাল কেন। শুধু কালো ভেলভেট এখনও হাতে পাইনি।
মিরা এসময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
যারা ফ্যাশন শোতে অংশ নিচ্ছে, তারা আমার সঙ্গে স্টকরূমে চলো প্লিজ। চলো! উত্তেজিত কণ্ঠে বলল রবিন।
কেন শিপটন পিছনে রয়ে গেল। অন্যরা মিরাকে অনুসরণ করে স্টোরের পিছনদিকের রূমটায় চলে এল। ডাঁই করে রাখা গাদা গাদা বাক্স আর কাপড়ের র্যাক দেখা গেল এখানে।
ওদের জানা আছে কে কোন ড্রেস পরবে। কদিন আগে রিহার্সাল হয়ে গেছে। মিরা যার যার পোশাক বাছাই করে দেবার পর নেমট্যাগ ঝুলিয়ে দিয়েছে।
কিশোরের জন্য বেছে রাখা লাল জ্যাকেটটা ঝুলছে, গোলাপি রঙের প্লাস্টিকের হ্যাঁঙ্গার থেকে।
মিরা এক হাত উঁচিয়ে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
শো চলার সময় তোমরা বাক্সগুলোর পেছনে চেঞ্জ করতে পারবে, জানিয়ে দিল। মেয়েরা ডান দিকে, আর ছেলেরা বাঁ দিকে।
মানি জুলি মরগ্যান ও অন্যান্য মেয়েদের উদ্দেশে বলল, উঁকি দিয়ো না যেন।
পেনি হাতে ধরা পাণ্ডা বার দোলাল।
তাকালে ভাল হবে না কিন্তু!
ছোট বাচ্চাদের লজ্জা-শরম একটু বেশিই থাকে, হাসি চাপল কিশোর।
মানি, পেনি, বলল মিরা। চারদিকে কাপড়-চোপড় রয়েছে, এখানে আইসক্রীম খেয়ো না।
কিন্তু পাণ্ডা বার পকেটে রাখলে তো গলে যাবে, আদুরে আদুরে গলায় বলল মানি।
ওই দেয়ালটার কাছে একটা ছোট ফ্রিজ আছে, আঙুল তাক করে বলল মিরা। ওখানে রেখে দাও।
গজগজ করতে করতে যমজরা ফ্রিজটার দিকে এগিয়ে গেল।
আচ্ছা, এবার বলো, বলল মিরা, ফ্যাশন শো সম্পর্কে তোমাদের কারও কোন প্রশ্ন আছে?
কিশোর হাত তুলল।
এই আগস্ট মাসের গরমে আমরা শীত-পোশাকের মডেলিং করছি কেন?
চমৎকার প্রশ্ন করেছে, কিশোর, সপ্রশংস কণ্ঠে বলল মিরা। মৌসুম আসার আগেই পোশাক প্রদর্শনী করার নিয়ম। লোকে যাতে আগেভাগে কিনে রাখতে পারে।
খাইছে! তারমানে ফেব্রুয়ারী মাসে বেদিং সুট বিক্রি করা হবে? মুসা ঢোক গিলল।
এ সময় রীটাকে হন্তদন্ত হয়ে স্টকরূমে ঢুকতে দেখা গেল। ওর হাতে বড়সড়, চারকোনা একটা বাক্স।
এটা এইমাত্র এসে পৌঁছেছে, মিরা, বলল। প্যারিসের লুলু থেকে।
কোটটা পাঠিয়ে দিয়েছে! মিরার কণ্ঠে উত্তেজনা। বাক্সটা খুলে ফেলল ঝটপট। হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। এত তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব ভাবিনি।
বাক্স থেকে সাবধানে ছেলেদের একটা কোট বের করল মিরা। চকচকে রুপোলী বোতামওয়ালা কালো মখমলের এক কোট।
দুর্দান্ত! কিশোর অস্ফুট মন্তব্য করল।
এক্সকিউজ মি! অপরিচিত এক কণ্ঠ।
সবাই ঘুরে দাঁড়াল কণ্ঠস্বরটা লক্ষ্য করে। রুপোলীচুলো এক মহিলা, সোনার ইয়ারিং পরে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। দামি, সুদৃশ্য এক হ্যান্ডব্যাগ কাঁধ থেকে ঝুলছে।
আপনি কি মিরা নায়ার? প্রশ্ন করলেন।
মিরা আয়ার।
আমি মিসেস হগার্ড, বললেন অচেনা ভদ্রমহিলা। আমার বাচ্চাদের জন্য কিছু হেয়ার ব্যারেট কিনতে চাই।
আপনার মেয়েদের বয়স কত? মিরা জিজ্ঞেস করল।
মিসেস হগার্ড তার হাতব্যাগের ভিতরে হাত ভরে দিলেন। দুটো খুদে ইয়র্কশায়ার টেরিয়ার বের করে আনলেন পরমুহূর্তে। মাত্র তিন বছর।
ডগি! চেঁচিয়ে উঠল মানি।
আদর করি চলো! পাল্টা চেঁচাল পেনি।
মিসেস হগার্ড কুকুর দুটোকে মাটিতে নামিয়ে দিলেন। কোটটার দিকে দৃষ্টি তার। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলেন।
এরকম ব্ল্যাক ভেলভেট সচরাচর দেখা যায় না। আমি এটা কিনব।
এটা তো ছোটদের কোট, মিসেস হগার্ড, বলল মিরা। আপনার গায়ে ফিট করবে না।
আমার জন্যে না তো! ঘোষণা করলেন, মিসেস হগার্ড। আমার সোনামণিদের কোটে নতুন কলার চাই। কালো ভেলভেটটা দারুণ মানাবে?
আপনার কুকুর দুটো কি আগস্টেও কোট পরে নাকি? রুডি মার্শ প্রশ্ন করল।
মাথা ঝাঁকালেন ভদ্রমহিলা।
এয়ারকুলারে ঠাণ্ডা লাগে ওদের।
মিরা মাথা নাড়ল।
সরি। ফ্যাশন শোর জন্য কোটটা আমাদের দরকার। বিক্রি করতে পারছি না।
উঁহ, যত্তসব আদিখ্যেতা, খ্যাক করে উঠলেন মিসেস হগার্ড। তারপর কুকুর দুটোকে তুলে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে চলে গেলেন।
মিসেস হগার্ড রকি বীচের সবচেয়ে বড় বাড়িটায় থাকেন, বন্ধুদের উদ্দেশে ললল কিশোর। চাচার সঙ্গে একদিন হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, তখন দেখিয়েছিলেন।
অত বড় বাড়িতে এত ছোট কুকুর রাখেন? মুসা বলল।
মিরা এসময় কোটটা তুলে ধরল আবার।
কে, বলে সবার উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিল সে। পরবে এটা?
ছেলেরা সবাই হাত তুলল। মিরা কিশোরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল।
আমি? ঢোক গিলে বলল কিশোর।
হ্যাঁ, তুমি, বলল মিরা। কিশোরকে কোটটা পরতে সাহায্য করল। তোমার জ্যাকেটটা অন্য কেউ পরবে।
তোমাকে দারুণ মানিয়েছে, কিশোর, রবিন তারিফ করে বলল।
নিজেকে রাজপুত্র মনে হচ্ছে কিশোরের। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকল না সুখকর অনুভুতিটা। কেননা গর্জে উঠেছে রুডি মার্শ।
এটা অন্যায়! কোটটা আমাকে পরতে দেয়া উচিত!