০৬.
সত্যি, মাকড়সার বয়ামে যে ভাবে হাতটা ঢুকিয়েছিলে তুমি, কিশোর বলল, আমি পারতাম না।
আর আমি হলে ঢোকাতামই না, রবিন বলল। ভীতু, কাপুরুষ, যা খুশি বলে বলুকগে আমাকে টেরি।
রোজ রোজ ওসব শোনার চেয়ে সাহস দেখিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিলেই কি ভাল না?
ঘুষি মেরে ওর নাক ফাটিয়ে দিতাম আমি…
টেরি তো একলা নয়। কজনের ফাটাবে?
মাকড়সার বয়ামে হাত ঢোকানোর পরের আরেক শনিবার। কিশোরদের বাড়িতেই আড্ডা দিচ্ছে তিন গোয়েন্দা। সেদিনও কিশোরের চাচা-চাচী বাড়িতে নেই।
গত শনিবারের মত বৃষ্টি হচ্ছে না। আকাশ পরিষ্কার। তবে ঠাণ্ডা পড়েছে বেশ।
কিশোর আর রবিনের তর্কে যোগ দিতে পারল না মুসা। মানসিক অশান্তিতে রয়েছে সে। ভয়ানক দুশ্চিন্তা। পুরোটা সপ্তাহ ধরে তাকে ভয় দেখিয়েছে টেরি, কালটু-আমান, এবার দেখব কেমন তোমার সাহস। এমন প্ল্যান করেছি, তোতলাতেও ভুলে যাবে।
কি করতে যাচ্ছে, জানতে চেয়েছে মুসা।
মুচকে হেসেছে টেরি, ভঙ্গি করেছে সিনেমার দুষ্ট ভিলেনের মত। আগেই বলব কেন…
জানালার কাঁচে শব্দ হতে ধড়াস করে উঠল মুসার বুক। ভাবল টেরিরা এসে গেছে।
কিন্তু না, বারান্দার নয়, বাইরের দিকের জানালায় শব্দ হয়েছে। বোধহয় ডালটাল বাড়ি খেয়েছে।
কিশোর আর রবিনের তর্ক তুঙ্গে উঠেছে, এই সময় ফোন বাজল। উঠে গিয়ে ধরল কিশোর। মিনিটখানেক কথা বলে ফিরে এল হাসিমুখে, টেরিরা আসছে।
আঁতকে উঠল মুসা, মানা করে দিলে না কেন?
মানা করব কেন? ও ব্যাটাদের কাছে হারব নাকি?
কি বলল?
জানতে চাইল, তুমি আছো নাকি। বাড়িতে অন্য কেউ আছে কিনা।
আমি যাই, উঠে দাঁড়াল মুসা।
আরে কি করছ! হাত ধরে টেনে ওকে বসিয়ে দিল কিশোর। মুখে চুনকালি মাখাবে নাকি শেষে! কোনও দিন আর স্কুলে গিয়ে শান্তি পাবে মনে করেছ?
আ-আ-আমি বাবাকে বলে অন্য শহরে চলে যাব। অন্য স্কুলে ভ-ভ ভর্তি হব…
তাতে লাভটা কি? ওখানে গিয়েও তো ভূ-ভই করবে। মূল জিনিসটা না উপড়াতে পারলে শান্তি পাবে না কোনখানে গিয়েই।
উড়ে চলে এল যেন টেরিরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেল বাজল।
মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল মুসার। আমি বাথরূম থেকে আসি!
কেন?
মাথায় পানি দেব।
দরকার নেই, বসে থাকো। ওরা বুঝে যাবে তুমি ভয় পেয়েছ। দরজা খুলে দিতে চলল কিশোর। যেটা তুমি নও, সেটা মানুষকে বোঝাতে যাও কেন?
কিশোর, তুমি বুঝতে পারছ না, অনুরোধের সুরে বলল মুসা, আমার সাহস সত্যি নেই। আগে যা-ও বা ছিল, মাকড়সাটা কামড়ে দেবার পর আর ছিটেফোঁটাও নেই…
আবার বেল বাজল। অস্থির হয়ে গেছে টেরির দল।
দরজা খুলে দিল কিশোর।
খুলতে এত দেরি কেন? মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিল টেরি। প্যান্ট বদলাচ্ছে নাকি মু-ম্মুসা! খিকখিক করে হাসল সে।
কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল কিশোর, প্যান্ট বদলাবে কেন?
ভয়ে খারাপ করে ফেলেছে হয়তো…
ওই তো সোফায় বসে আছে। কেন, সেদিন মাকড়সা নিয়ে এসে শিক্ষা হয়নি? কথা কম বলো, হুমকি দিল কিশোর। নইলে বাজিটা অন্য রকম হবে বলে দিলাম।
কি রকম? টাকা বাড়াবে? পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল টাকি।
না। হেরে গেলে গায়ের কাপড় খুলে রেখে বাড়ি যেতে হবে তোমাদের।
কডি বলল, না না, টাকাই ভাল…।
কেন, নিজেরাই ঘাবড়ে গেলে? ভুরু নাচিয়ে হাসল কিশোর।
অ্যাই, তুমি চুপ থাকো! ধমক লাগাল কডিকে টেরি। কিশোরের দিকে তাকাল, তাহলে বাজিটা এখনও বহাল আছে শিওর হতে এলাম। ওটা গিয়ে নিয়ে আসতে হবে তো আমাদের। বাজি যদি না-ই থাকে শুধু শুধু ঝামেলা…
তোমরা কি, বলো তো? রেগে উঠল কিশোর। ফোনেই তো বলে দিলাম যা বলার…
কিন্তু প্ল্যান বদলেছি আমরা।
বদলেছ মানে?
প্রথম যে জিনিসটা আনার কথা ছিল, সেটা আনিনি।
সেটা কি ছিল?
আনতে চাই না যখন, শুনে আর কি করবে?
তাহলে এখন কি আনতে চাও?
ফিরে তাকাল টেরি। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করল, কি, আগেই বলে দেব?
বলল, টাকি বলল। জেনেশুনে আগে থেকে মনের জোর বাড়িয়ে রাখুক মু-ম্মুসা। অত নির্দয় যে নই আমরা, সেটাও বুঝুক।
মাথা ঝাঁকিয়ে কিশোরের দিকে ফিরল আবার টেরি।
উত্তর্ণ হয়ে আছে মুসা। টেরি কি বলে শোনার জন্যে। রবিনেরও কান খাড়া।
টেরি বলল, একটা সাপ আনব। বড়। বিষাক্ত। ওটার মুখে চুমু খেতে হবে তোমাদের তোতলা মু-ম্মুসাকে। পারবে নাকি জিজ্ঞেস করো।
বলে কি! হাঁ হয়ে গেল মুসার মুখ।
কিন্তু কিশোরের হাসি এক বিন্দু মলিন হলো না। দূর! ভেবে ভেবে শেষে এই জিনিস বের করেছ? হায়রে কপাল, এই না হলে শুঁটকির বুদ্ধি! এ তো মাকড়সার চেয়েও সোজা!
বলছ!
তো আর কি বলব? জানো, কত সাপ ঘেঁটেছে মুসা? এক ভারতীয় বেদের সঙ্গে ভাব হয়ে গিয়েছিল মুসার, গ্রীনহিলসে থাকতে, নির্বিকার কণ্ঠে বলে চলল কিশোর। সাপ খেলানো শিখেছে তার কাছে। তারপর থেকে তো মুসার জয়-জয়কার। মেলা হলেই সার্কাসের লোকের ডাক আসত তার কাছে। ডেকে নিয়ে যেত। কত যে প্রশংসা আর পুরস্কার পেয়েছে সে।
তাই নাকি? সন্দেহ দেখা দিল টেরির চোখে।
কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না?
নিনা তো সাপ খেলানোর কথা কিছু বলল না?
ও তোমার বোন। তোমার মতই চরিত্র। ও কি আর কারও ভালটা বলতে যাবে?
দমে গেল মনে হলো শুঁটকি। ফিরে তাকাল বন্ধুদের দিকে। আবার ফিরল কিশোরের দিকে। হাসি ফোঁটাল মুখে। ও তুমি যা-ই বলো, নিজের চোখে না দেখে বিশ্বাস করছি না আমি। বারান্দায় বেরিয়ে গেল সে। সহকারীদের বলল, অ্যাই, চলো হে, নিয়ে আসিগে।
কিশোরের মিথ্যের বহর শুনে রবিনও হতবাক। কিশোর দরজা লাগিয়ে ফিরে আসতেই বলে উঠল, এ সব বাহাদুরি না করলে কি চলত না?
না, চলত না। শঠে শাঠ্যং। ওরা যেমন, ওদের ওভাবেই জবাব দিতে হবে।
কি-কি-কিন্তু কেউটে আনে না র্যাটল আনে, মুসা বলল, ঠিক আছে কিছু সাপের মুখে চুমু খাব কি করে!
খাবে। তাতে অসুবিধে কি? মুচকি হাসল কিশোর।
তোমার কি হয়েছে বলো তো, কিশোর! তুমি আমাকে কায়দা করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাইছ নাকি? খুনের মোটিভটা কি? কি করেছি আমি? আমার তো কোন টাকা-পয়সা জমানো নেই, ইনশুরেন্স-ফিনশুরেন্সও নেই…
চুপ করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকো। সাপ ওরা আনবে না।
যদি আনে?
যদি আনে, তখন দেখা যাবে। তবে আমার এত কথার পর সাপ ওরা আনবে না, লিখে রাখতে পারো। ওদের ধারণা হয়ে গেছে, সাপকে তুমি ভয় পাও না। এনে লাভ হবে না।
কিন্তু শুঁটকি টেরিকে বিশ্বাস নেই। নিশ্চিন্ত হতে পারল না মুসা।
*
বার বার ঘড়ি দেখছে কিশোর। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, টেরিরা গেছে, এখনও আসার নাম নেই।
রবিন বলল, আসবে না নাকি?
না এলেই তো ভাল, মুসা বলল। আসছে না দেখে তুমিও মনে হয় হতাশ! তোমরা কি আমাকে পাগল পেয়েছ…
কথা শেষ হলো না মুসার। দরজার বাইরে থেকে ভেসে এল আতঙ্কিত চিৎকার, কিশোর, দরজাটা খোলো তো, ভাই! জলদি
লাফ দিয়ে উঠে ছুটে গেল কিশোর। হাতল ঘুরিয়ে হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল দরজা।
দরজায় দাঁড়ানো টাকি। চিৎকার দিয়ে উঠল, জলদি এসো! সর্বনাশ হয়ে গেছে!
বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।
কডির পেছনে হ্যারল্ড আর নিটুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মুসা। তারপর দেখতে পেল টেরিকে।
দুই হাত দিয়ে দুই চোখ চেপে ধরে রেখেছে টেরি। টকটকে লাল রক্ত গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে।
তাকে ধরে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকল নিটু আর হ্যারল্ড।
তোমার চাচা-চাচী বাড়ি আছে, কিশোর? চিৎকার করে বলল কডি। আমাদের সাহায্য দরকার!
না। কি হয়েছে? জানতে চাইল কিশোর।
একটা বড় বিষাক্ত সাপ নিয়ে এসেছিলাম আমরা, টাকি জানাল। ঝাপির ঢাকনা তুলতেই পালাল ওটা। টেরি ছুটল ওটার পেছনে। জঞ্জালের মধ্যে ঢুকে পড়ল সাপটা। দৌড়ে ধরতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে লোহা-লক্কড়ের মধ্যে পড়ে দেখো কি অবস্থা হয়েছে ওর!
শিকের খোঁচা লেগে একটা চোখ গলে বেরিয়ে চলে এসেছে, আবার চিৎকার করে উঠল কডি।
আহ্! গুঙিয়ে উঠল টেরি।
ধীরে ধীরে ডান হাতটা নামাল চোখের ওপর থেকে। হাতের তালু মেলে দেখাল।
খুলে চলে আসা রক্তাক্ত বিশাল চোখটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।
আহ, আমাকে…আমাকে বাঁচাও, মুসা! গোঙাতে গোঙাতে বলল টেরি। তোমার অভিশাপেই অমন হয়েছে। প্লীজ, কিছু একটা করো!
ডাক্তার ডাকো, ডাক্তার! চিৎকার করে বলল কডি। অ্যামবুলেন্স!
আহ…বাচাও আমাকে…কি যন্ত্রণা…মাগোহ! ক্রমাগত গোঙাচ্ছে টেরি।
ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে খুলে আসা চোখটা। পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে মুসার। মুখে হাত চাপা দিল বমি ঠেকানোর জন্যে।
অস্ফুট শব্দ করে উঠল কিশোর।
রবিনও তাকাতে পারছে না চোখটার দিকে। মুসা তাকিয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে আছো কেন তোমরা… ককাতে ককাতে টেরি বলল। কিছু একটা করো না!…উফ, কি ব্যথা!
চোখটার দিকে তাকিয়েই আছে মুসা। ছুটে গেল হঠাৎ। টেরির হাত থেকে এক থাবায় চোখটা তুলে নিয়ে লজেন্সের মত ছুঁড়ে দিল মুখের মধ্যে। চুষতে শুরু করল।