শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ৩

০৩.

দূর, টিভিতে কিছু নেই, বিরক্ত হয়ে রিমোটটা সোফার ওপর ছুঁড়ে ফেলল কিশোর। কম্পিউটার গেমগুলোও বিরক্তিকর! কি করা যায় বলো তো?

চুপ করে রইল মুসা আর রবিন। কি করলে ভাল লাগবে ওরাও বুঝতে পারছে না।

কিশোরদের লিভিং-রূমে বসে আড্ডা দিচ্ছে তিন গোয়েন্দা।

শনিবারের ধূসর এক বিকেল। ঘরের জানালায় একটানা আঘাত হেনে চলেছে বৃষ্টির ফোঁটা। পেছনের আঙিনায় পুরু হচ্ছে খসে পড়া পাতার আস্তর। প্রবল বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে গাছের ডালগুলো।

চিলেকোঠায় যাবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। জায়গাটা দারুণ। অন্ধকার। ছমছমে। যত দুনিয়ার বাক্স-পেটরা আর পুরানো জিনিসে বোঝাই। প্রচুর বইপত্র-ম্যাগাজিন। এক ধরনের উত্তেজনা আছে চিলেকোঠায়।

না রে, ভাই, আমি ওখানে যাব না, সাফ মানা করে দিল মুসা।

যে কোন অন্ধকার জায়গাকে তার ভয়। সেটা চিলেকোঠাই হোক আর পাতাল-ঘর। আলোকিত ঘরে থাকাটাই তার পছন্দ।

তাহলে আর কি করা! ভিডিওতে সিনেমা দেখি। উঠে ওপাশের দেয়াল ঘেঁষে রাখা আলমারিটার সামনে চলে গেল কিশোর।

প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল বাইরে। কেঁপে উঠল মুসা। ভয় ভয় লাগছে। তার। সাপকে ভয়, মাকড়সাকে ভয়, পোকা-মাকড়, ইঁদুর, অন্ধকার, ভূত, আরও অনেক কিছুকে ভয়। ইদানীং বজ্রপাতকেও ভয় পায়।

আলমারি থেকে কয়েকটা ভিডিও ক্যাসেট বের করে আনল কিশোর।

একটা ক্যাসেট হাতে নিয়ে ওপরে লাগানো ট্যাগটা পড়ল মুসা। সবগুলোই হরর ছবি নাকি?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।

তাহলে আমি দেখব না।

 রবিনের দিকে তাকাল কিশোর, তুমি?

আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মুসা যদি ভয় পায়….একজনকে সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে রেখে ছবি দেখে আমরাও মজা পাব না।

হতাশ হয়ে ক্যাসেটগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিল কিশোর। মুসাকে নিয়ে এক বিরাট সমস্যা হয়েছে। এত ভয় পেলে কি করা! কোন রহস্যের সমাধান করতে গেলেও মনে হচ্ছে আর যোগ দিতে পারবে না মুসা। যা করতে দেয়া হবে তাকে, ভয়ে পিছিয়ে আসবে।

কি করবে ভাবছে, এই সময় চমকে দিল দরজার ঘণ্টা। বেজে উঠল টুং-টাং টুং-টাং করে।

চাচা-চাচী মার্কেট থেকে ফিরল নাকি? না, এত তাড়াতাড়ি তো ফেরার কথা নয়।

ফিরে তাকাল কিশোর।

আই, দরজা খোলো, মু-ম্মুসা! শোনা গেল একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠ। আমরা জানি, তুমি এখানে বসেই আড্ডা দিচ্ছ।

শুঁটকি টেরির গলা। চিনতে পারল তিনজনেই।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। তাকে মু-ম্মুসা বলে ডেকেছে! শুঁটকি জানল কিভাবে?

কিশোরও অবাক। উঠে গেল দরজা খুলে দিতে।

ঘরে ঢুকল টেরি, টাকি এবং আরও তিনজন। হাত দিয়ে রেনকোট থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়তে লাগল টাকি। ভেজা জুতো নিয়েই উঠে আসতে গেল কর্পেটের ওপর। হাতটা বাড়িয়ে ঠেকিয়ে দিল কিশোর। বাড়ি বয়ে এসেছে, শত্রু হলেও অদ্ৰতা করল না। সৌজন্য দেখিয়ে ওদের ভেজা রেনকোট আর ম্যাকিনটশগুলো রেখে এল হ্যাঁঙারে। জুতোর তলা ভালমত মুছিয়ে নিল ডোরম্যাটে। কার্পেটে কাদা-পানি দেখলে কাউকেই আস্ত রাখতেন না মেরিচাচী। সবচেয়ে বেশি বকাটা খেতে কিশোর।

খোঁচা খোঁচা চুল থেকে আঙুল দিয়ে পানি ঝাড়ল টেরি। মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল। মুসার মনে হলো, ইবলিসের হাসি।

মুসার হাতের পপকর্নের বাটি থেকে এক খাবলা পপকর্ন তুলে নিয়ে মুখে পুরল।

হাই, মু-ম্মুসা! ভুরু নাচাল লাল-চুল একটা ছেলে, ওর নাম কডি। তার সঙ্গী বাকি দুজন নিটু আর হ্যারল্ড ফ্যাকফ্যাক করে হাসল।

সব একই ক্লাসে পড়ে, মুসাদের ক্লাসে। হাসি, কথাবার্তা, আচরণে টেরির ফটোকপি একেকটা। সেজন্যেই দোস্ত হতে পেরেছে। টেরি ওদের নেতা হবার যথেষ্ট কারণ আছে। টেরির বাবার অনেক টাকা। টেরি হাত খরচ পায় প্রচুর। সেগুলো দুই হাতে খরচ করে বন্ধুদের পেছনে। নেতা হবার প্রধান কারণ সেটাই।

মু-ম্মুসা ডাক শুনে পেটের মধ্যে খামচে ধরল মুসার। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চাইছে।

আ-আ-আমাকে এ রকম করে ডা-ডা-ডাকছ কেন? রাগ করে বলল মুসা।

যে-যে-যে রকম করে কথা বলছ, সে-সে-সে রকম করেই তো ডাকছি! খিকখিক করে হাসল টেরি। ভেবেছ জানি না? গ্রীনহিলসে যে স্কুলে পড়তে তুমি, সেটাতে পড়ে আমার কাজিন নিনা। আবার পপকর্ন নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল সে।

বাটিটা সামনে বাড়িয়ে দিল মুসা। তাতে কি? চেহারা স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

বাটিটা নিজের হাতে নিয়ে নিল টেরি। কিছুক্ষণ চুপচাপ চিবাল। অপেক্ষা করিয়ে রাখল মুসাকে। তারপর মুচকি হেসে বলল, নিনা আমাকে সব বলে দিয়েছে, মু-ম্মুসা। পোকা-মাকড় থেকে শুরু করে দুনিয়ার তাবৎ জিনিসকে ভয় পাও তুমি। ভয় পেলে তোতলাতে থাকো। নিজের ছায়া দেখলে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেল।

হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মুসা।

নিনা আমাকে বলেছে, গত বছর দুপুরবেলা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলে। রাস্তায় মানুষ ছিল না। নিনা আর তার এক বান্ধবী বনের ভেতর থেকে নাকি স্বরে কথা শুরু করল। তুমি নাকি বেদিশা। পাশের খালে দিলে ঝাঁপ। সাতরে ওপারে উঠে প্রায় বেহুশ। এমন কাণ্ড করেছিলে, তুমি মরে গেছ। ভেবে ভড়কে গিয়ে নিনা আর তার বান্ধবী ঝেড়ে দিয়েছিল দৌড় বাড়ির দিকে।

মুখ কাচুমাচু করে কিছু বলতে যাচ্ছিল মুসা, তাকে থামিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল কিশোর। মিথ্যে বলার আর জায়গা পেলে না! ভূতের ভয়ে পানিতে ঝাঁপ দেবে মুসা আমান? ভূতের ঘাড় মটকে দেবে। কতদিন অমাবস্যার রাতে ভূত খুঁজে বেড়িয়েছে ও। আর তুমিও যেমন, টেরি! তোমার মিথ্যুক বোনটা এসে কি না কি বানিয়ে বলল, আর তুমিও তার কথা বিশ্বাস করলে। অবশ্য তোমার আত্মীয় তো, ভাল আর কোত্থেকে হবে। কিংবা হয়তো নিনা কিছুই বলেনি, তুমি নিজেই বানিয়েছ। মুসাকে হিংসে করো তুমি। ওর মতো দুঃসাহসী তুমি আরও চোদ্দবার জন্মালেও হতে পারবে না।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল টাকি। মুখে হাসি। তাই নাকি? তাহলে স্কুলে তোতলা মুসা খেতাব হয়ে গিয়েছিল কেন? মু-ম্মুসা বলে খেপাত কেন?

টা-টা-টা-ট্টাকির মত শয়তানগুলো সবখানেই আছে বলে।

তোমার সঙ্গে কথা বলছি নাকি? মুসার দিকে তাকাল টাকি। কেন খেপাত, বলো? নাকি এটাও মিথ্যে?

ঘেমে যাচ্ছে মুসা। গ্রীনহিলসে থাকতে শেষ দিকে সহপাঠীদের খেপানোর জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গিয়েছিল তার। ভেবেছিল, রকি বীচে এসে বাঁচল। কিন্তু অত্যাচারটা তো এখানে আরও বেশি হবে মনে হচ্ছে! বলতে গেল, আসলে একদিন একটা মা-মা-মা-মা-মা…

টাকির শয়তানি ভরা হাসিটা চওড়া হলো। কালো চোখের তারায় ঝিলিক। জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। কথা বের করতে পারছ না? আহারে! মোলায়েম কণ্ঠে বলল সে। ঠিক আছে, আপাতত তোমার তোতলামি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমরা। তুমি যে সাহসী সেটা প্রমাণ করে দাও।

হ্যাঁ, প্রমাণ করে দাও, এক সুরে কথা বলে উঠল টেরি। পপকর্নের খালি বাৰ্টিটা ঠাস করে টেবিলে রাখল সে। তুমি যে সাহসী সেটা প্রমাণের জন্যে একটা ছোট্ট পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছি আমরা।

জানালায় বিদ্যুতের আলোর ঝিলিক। ভয়ানক শব্দটা আসছে! অগ্রাহ্য করার জন্যে টেরিকে জিজ্ঞেস করল মুসা, পরীক্ষা? কিসের পরীক্ষা?

গুড়ম করে বিকট শব্দ হলো। নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল সে। আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল চোখের পাতা। চোখ মেলে শুনল, কিশোর বলছে, কি পরীক্ষা?

কডির কাছে আছে, সহকারীর দিকে ফিরল টেরি। এনেছ না?

হ্যাঁ, ঘাড় কাত করল কডি। নিজে ভিজেছি, কিন্তু এগুলোকে ভিজতে দিইনি। জানি, কাজের জিনিস। এক ফোঁটা পানিও লাগেনি গায়ে। জ্যাকেটের নিচ থেকে লম্বা একটা কাঁচের বয়াম টেনে বের করল সে।

কি-কি-কি আছে ওর মধ্যে? নিজের অজান্তেই আবার তোতলানো শুরু করল মুসা।

বয়ামটা টেরির হাতে তুলে দিল কডি।

টেরি সেটা তুলে ধরল মুসার চোখের সামনে।