০২.
তৃতীয়বারের চেষ্টায় ধরে ফেলল হাতলটা। শক্ত হয়ে চেপে বসল আঙুলগুলো। ছাড়ল না কোনমতেই। গাড়ির পাশে পাশে দৌড়াচ্ছে। একই সঙ্গে টেনে খোলার চেষ্টা করছে দরজাটা।
খুলে গেল দরজা।
মাথা নিচু করে ডাইভ দিল সে। গীয়ে পড়ল সীটের ওপর।
হাত ছুঁড়ছে আর চিৎকার করছে বাচ্চাটা। জড়সড় হয়ে আছে পেছনের সীটে।
সেদিকে তাকানোর সময় নেই। গাড়ির মধ্যে নিজেকে ঠেলেঠুলে সোজা করল মুসা। পা নেমে গেল নিচের দিকে। ব্রেক প্যাডালটা ছুঁতে চাইছে।
পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেপে ধরল ওটা।
দুলে উঠল গাড়ি। হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ভয়াবহ ঝাঁকুনি।
ড্যাশবোর্ডে ঠুকে গেল মুসার কপাল। তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরে। যন্ত্রণায় আপনাআপনি চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে। বুজে গেল চোখের পাতা।
গাড়ির প্রচণ্ড ঝাঁকুনি থামিয়ে দিয়েছে বাচ্চাটার চিৎকারও। সীটবেল্ট না থাকলে উড়ে এসে পড়ত সামনের দিকে। যত চিৎকার-চেঁচামেচি এখন গাড়ির বাইরে। কারও মুখ বন্ধ নেই।
আনন্দ আর স্বস্তি জুড়িয়ে দিল যেন মুসার শরীর। পেরেছে সে! সময়মত থামাতে পেরেছে গাড়িটা!
সারা গায়ে ব্যথা। কপাল দপদপ করছে। মাথা ঘুরছে বনবন করে। তুলে রাখতে পারছে না। চোখের সামনে সব যেন উজ্জ্বল লাল। লাল বদলে। সাদা হলো। সাদা আলোটা হাতুড়ির মত বাড়ি মারছে যেন মাথার মধ্যে।
বেহুশ হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারল।
মায়ের চিৎকার চমকে দিল তাকে। চোখের সামনে থেকে সাদা পর্দার মত সরে গেল বিচিত্র আলোটা। কানের পেছনে চিৎকার করে উঠেছেন মা, আমার খোকা! আমার খোকা!
টের পাচ্ছে মুসা, ঝটকা দিয়ে খুলে গেল পেছনের দরজা। গাড়িতে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছেন মহিলা। বাচ্চার সীট-বেল্ট খুলে নিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুসা, যাতে বেহুঁশ না হয়। শরীর কাঁপছে থরথর করে।
অবশেষে মাথা সোজা করল সে। হ্যান্ডব্রেক তুলে দিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। টলে উঠল। মাথা ঘুরছে এখনও। কপালে হাত বোলাল।
গাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে ছেলেমেয়েরা। একযোগে কলরব করছে সবাই। সবার চোখ মুসার দিকে।
বাচ্চাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ছুটে এলেন মা।
এত সাহসী ছেলে জীবনে দেখিনি আমি! বাচ্চার গা থেকে একটা হাত সরিয়ে এনে সে-হাতে জড়িয়ে ধরলেন মুসাকে। তোমার মত সাহস দুনিয়ায় আর কারও নেই! ঘোষণা করে দিলেন তিনি। কি নাম তোমার, বাবা?
মুসা আমান! কোনমতে বলল মুসা। উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় কান গরম হয়ে যাচ্ছে তার।
এগিয়ে এল স্কুলের ছেলেমেয়েরা। কেউ প্রশংসা করতে লাগল, কেউ বা চাপড়ে দিল পিঠ।
দুই গাল বেয়ে পানির ধারা নেমেছে মায়ের। গাড়ি থেকে নেমে একটা চিঠি পোস্ট করতে গিয়েছিলাম, জানালেন তিনি। হ্যান্ডব্রেকটা তুলে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম হয়তো। কি মনে হতে ফিরে তাকিয়ে দেখি গাড়িটা নেমে যাচ্ছে…শুধু আমার ছেলেটাকেই না, কতজনকে যে তুমি আজ বাঁচিয়ে দিলে, মুসা!
তাই কি! বিড়বিড় করল মুসা। প্রচণ্ড শকটা হজম করতে সময় নিচ্ছে। মাথা ঘোরা সারেনি এখনও। পায়ের নিচে যেন মাটি নেই। শূন্যে ভাসছে সে।
মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাকে বুকের এক পাশ থেকে আরেক পাশে সরালেন মা। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মুসা করলটা কি দেখলে তোমরা? সাইকেল থেকে চলন্ত গাড়িতে ঝাঁপ-এমন দৃশ্য কেবল সিনেমাতেই দেখা যায়।
না না, ঠিক বলেননি আপনি!-বলতে চাইল মুসা, ঘটনাটা ঠিক এ ভাবে ঘটেনি। কিন্তু কথা বেরোল না মুখ দিয়ে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রশংসা করছে। পিঠ আর কাঁধ চাপড়ানোর ধুম পড়ে গেছে। প্রতিবাদ করারও সুযোগ পেল না সে।
আরেকটু হলে নিজেই মরত! বলে চলেছেন মুহিলা। কিন্তু অন্যকে বাঁচানোর জন্যে প্রাণের পরোয়া করেনি। অত সাহস জীবনে দেখিনি আমি!
মহিলার কথা সমর্থন করে সম্মিলিত চিৎকার উঠল।
দুই হাত জিনসের পকেটে ঢুকিয়ে দিল মুসা। দেহের কাঁপুনি থামানোর চেষ্টা করছে।
নিজেকে ওর অত সাহসী লাগছে না। হিরো মনে হচ্ছে না। কারণ ঘটনাটা ঘটেছে অন্যভাবে। লাফ দিয়ে সাইকেল থেকে গাড়ির ওপর পড়েনি। বরং সাইকেল থেকে পড়ার পর গাড়িটাকে ছুটে আসতে দেখে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে লাফিয়ে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পেছনের সীটে অসহায় বাচ্চাটাকে দেখে কি যেন কি হয়ে গিয়েছিল, ছুটতে শুরু করেছিল পেছন পেছন…ব্যস, ওই পর্যন্তই।
চিৎকার-চেঁচামেচি, স্বাগত জানানোর পালা চলছেই। কেউ থামতে চাইছে না।
মুখ বন্ধ রেখেছে মুসা। কপাল ব্যথা সত্ত্বেও মুখে হালকা একটা হাসি ফোঁটাতে বাধ্য হলো। সবাই এখন তাকে ছেড়ে সরে গেলে বাঁচে। স্বস্তিতে দম নিতে পারে।
কিন্তু আবার তাকে জড়িয়ে ধরলেন মহিলা। আরেকবার কতজ্ঞতা জানালেন। তারপর গাড়ির দিকে এগোলেন। বাচ্চাকে আবার পেছনের সীটে বসিয়ে সীট-বেল্ট আটকে দিতে লাগলেন।
কাঁধের ওপর আরেকটা হাত পড়ল। চাপ বাড়ল আঙুলগুলোর। কানের কাছে শুনতে পেল পরিচিত কণ্ঠস্বর, মুসা!
ফিরে তাকাল মুসা। হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর পাশা।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা।
টেনে তাকে ভিড়ের ভেতর থেকে সরিয়ে নিয়ে চলল কিশোর। এদিক ওদিক তাকিয়ে ডাক দিল, রবিন, এসো তো এদিকে! ওকে ধরো! কিভাবে টলছে দেখো,। পড়ে যাবে।
গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসে ফিরে তাকালেন মহিলা। কিশোরর কথা কানে গেছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারের কাছে নেয়া লাগবে?
না না, লাগবে না! তাড়াতাড়ি জবাব দিল মুসা। বসলেই ঠিক হয়ে যাবে।
রাস্তার পাশে মুসাকে নিয়ে এল কিশোর আর রবিন।
সামনে এসে দাঁড়াল দুটো ছেলে। একজন ঢ্যাঙা, গায়ে মাংস বলতে নেই। মুখে প্রচুর তিল। পরনে নীল শার্ট, ফেড জিনস, দুই হাঁটুর কাছে ইচ্ছে করে ছিঁড়ে রাখা-স্মার্টনেস-যা দুচোখে দেখতে পারে না মুসা; ভিখিরি মানসিকতা মনে হয়। খোঁচা খোঁচা চুল। এক কান ফুটো করে তাতে একটা রূপার রিঙ পরেছে।
সঙ্গের ছেলেটা খাটো, মোটা, লম্বা লম্বা চুল। নাকের ওপর মস্ত এক আঁচিল। চোখের পাতা সরু সরু করে মুসাকে জিজ্ঞেস করল, হিরোগিরি দেখানোর নেশা আছে মনে হয় তোমার?
টেরা কথা শুনে চোখ গরম করে তাকাল মুসা, কে তুমি?
খিকখিক করে হাসল সঙ্গের ঢ্যাঙা ছেলেটা। হাসিটা শুনলে রাগ লাগে। সঙ্গীকে ধমক দিয়ে বলল, আই, টাকি, থামো তো তুমি! মুসার দিকে তাকাল, ও একটু বেশি কথা বলে। ওর কথায় কিছু মনে কোরো না। হাত বাড়িয়ে দিল, আমি টেরিয়ার ডুয়েল।
হাতটা ধরল মুসা। পাশে তাকিয়ে দেখল কিশোর আর রবিন গম্ভীর।
টেরির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল কিশোর, কেন ওকে নিয়ে টানাটানি করছ, শুঁটকি দেখছ না ওর শরীর খারাপ লাগছে?
তুমি আবার এর মধ্যে কথা বলতে আসো কেন, টেটনা শার্লক? মুসাকে দেখিয়ে বলল, হিরোদের আমার পছন্দ। কারণ আমি নিজেও একজন হিরো তো। অবশ্যই ওকে আমার দলে নিয়ে নেব। মুসার দিকে তাকাল, আজই স্কুলে প্রথম যাচ্ছ, তাই না?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
হাসিমুখে টেরিকে বলল কিশোর, তোমার অবগতির জন্যে জানানো দরকার, শুঁটকি, মুসা আমান আমার অনেক পুরানো বন্ধু। গ্রীনহিলস থেকে এসেছে ও। বিশ্বাস না হলে রবিনকে জিজ্ঞেস করে দেখো।
রবিনের দিকে তাকাল টেরি।
মাথা ঝাঁকাল রবিন, হ্যাঁ।
মুখের আলো দপ করে নিভে গেল টেরির। হাসি উধাও। আঙুল ঢিল হয়ে গেল টেরির। খসে পড়ে গেল মুসার হাতটা। বড়ই হতাশ। ভেবেছিল, মুসার মত একজনকে দলে টেনে নিতে পারলে তার দলের সুনাম বাড়বে, শক্তিশালী হবে দল। কিন্তু টেটনা শার্লকটা যে আগেই ওকে বগলদাবা করে বসে আছে, কে জানত!
মুহূর্তে কিশোর আর রবিনের মত মুসাও টেরির শত্রু হয়ে গেল। চোখের পাতা সরু সরু করে মুসার দিকে তাকাল সে। বলল, হিরো না ছাই! মহিলাটা একটা ইয়ে। এমন সাহস নাকি আর জীবনে দেখেনি! আহা!
মুসাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর, কেন, চোখের সামনেই তো দেখলে কি কাণ্ডটা করল! এরপরেও অবিশ্বাস? তোমার দলের সমস্ত ছুঁচোগুলোর সাহস এক করলেও মুসার সমান হবে না, তা জানো?
তাই নাকি? খিকখিক করে হাসল টেরি। ভাল জমবে মনে হচ্ছে। এবার!
চ্যালেঞ্জ করছ?
করছি।
সাহস নেই, সাফ বলে দিল টাকি।
অ্যাই, তুমি থামো, টাকিমাছ!
বাংলা শব্দটা বোঝে না টাকি। গর্জে উঠল, রোজই ট্যাকিমাছ ট্যাকিমাছ করো! পেয়েছ কি? কোন্দেশী গালি এটা? আজ তোমাকে বলতেই হবে! কি মানে এর?
গালি নয়, বাংলাদেশী একটা অতি লোভনীয় খাবারের নাম এটা, হেসে জানিয়ে দিল রবিন। টাকি হলো এক ধরনের মাছ, মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তা করে খেতে নাকি খুব টেস্ট। ঠিক আছে, বাংলা পছন্দ না হলে ইংরেজিতেই ডাকা হবে তোমাকে। ট্যাকি-ফিশ! কি, এবার ভাল লাগছে নামটা!
বিকৃত হয়ে গেল টাকির মুখ। দেখিয়ে ছাড়ব একদিন কে কাকে ভর্তা বানিয়ে খায় …
আহা, তোমরা এমন ঝগড়া শুরু করলে কেন… কথা শেষ না করেই বিকট এক চিৎকার দিয়ে উঠল মুসা। থাবা মারল পায়ে। সুড়সুড়ির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখল, লম্বা একটা ঘাসের ডগা লেগেছিল পায়ে। লজ্জা পেয়ে হাসল। আমি মনে করেছিলাম শুয়াপোকা…।
ভুরু কুঁচকে গেছে টেরির। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মুসার দিকে। ধীরে ধীরে পাতলা হাসি ফুটল ঠোঁটে। কিশোরের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কই, ভয় নাকি পায় না?
এটাকে কি ভয় বলে?
তাহলে কি বলে?
চমকে যাওয়া, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। পায়ে সুড়সুড় করলে তুমিও থাপ্পড় মারবে।
মারব, কিন্তু চিৎকার করব না।
দেখাব পায়ে লাগিয়ে? রবিন, ওই ফুল গাছটাতে দেখলাম কালো কালো শুয়াপোকায় ভরে গেছে। কিলবিল করছে। এত বড় বড় লোম। যাও তো, কাঠিতে করে নিয়ে এসো তো একটা।
রবিন যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই হাত তুলল টেরি, থামো, থামো…দাঁড়াও! কিশোরের দিকে তাকাল। গাল চুলকাল এক আঙুলে। তারমানে তোমার দোস্ত ভয় পায় না বলতে চাও?
হ্যাঁ, চাই। মনে মনে মুসার মুণ্ডপাত করছে কিশোর। প্রথম পরিচয়েই দিয়েছে নিজের দুর্বলতা টেরির কাছে ফাঁস করে।
টাকি বলল, প্রমাণ দিতে পারবে?
উত্তেজনায় টেরির গালের তিলগুলো যেন ঝিকমিক করে উঠল লাল কালো তারার মত। মুহূর্তে শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল ওর কুটিল মগজে। ঠিক, ঠিক, প্রমাণ! বাজি হয়ে যাক একটা!
বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভেবে আবার থামাতে গেল মুসা, না না, প্লীজ…
তুমি থামো! মুসাকে কথাই বলতে দিল না কিশোর। তুমি এখানকার হালচাল কিছু জানো না। যা বলার আমি বলছি। টেরির দিকে তাকাল, কত টাকা?
টাকির দিকে তাকাল টেরি। দুজনের মুখেই কুটিল হাসি। ঘড়ি দেখল টেরি। কিশোরের দিকে মুখ তুলল, তোমার যত ইচ্ছে। ভয় পেলে বাজিতে হারবে কালটু-আমান। টাকাটা কার পকেট থেকে দেবে সেটা তোমাদের মাথাব্যথা।…এই টাকি, চলো। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।