১৪.
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত বোকা হয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। ওটা যে মাথা নয় বুঝতে সময় লাগল। কাটা দাগগুলো কুচকে গেছে। বেরিয়ে থাকা একমাত্র দাঁতটা সহ ধসে পড়েছে ঠোঁট দুটো। একটা মুখোশ। রবারের মুখোশ।
বড় করে ঢোক গিলে লাশের মুখের দিকে তাকাল সে। শুঁটকি টেরি!
টেরি? কফিনের মধ্যে ঢুকে শুয়েছিল? আগেই সন্দেহ করা উচিত ছিল তার। যখন দেখেছে, দলের সঙ্গে টেরি নেই। তারপর ও ঢোকার জন্যে এগিয়ে যেতেই ভেতরে ঢুকল ভ্যানটা, যেন আর সময় পেল না। ভ্যানের লোকগুলোকে ঠিক করে রেখেছিল টেরি, সময় মত লাশ ভরার ব্যাগে করে টেরিকে এনে কফিনে রেখে গেছে ওরা। সেজন্যেই বার বার বলে দিয়েছিল টাকি, সামনে যে প্রথম কফিনটা পড়বে, সেটাতে ঢুকতে। তারপরেও আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে টর্চের আলো ফেলে দেখিয়ে দিয়েছে।
ইস, আমি একটা গাধা! মনে মনে নিজেকে গাল দিল মুসা। মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। কিন্তু ওর চুল এতই ছোট করে ছাঁটা, কোকড়া হয়ে তারের জালের মত বসে আছে, ধরাই যায় না। তাই আপাতত ছেঁড়ার হাত থেকে বেঁচে গেল চুলগুলো। ছুঁড়ে ফেলল হাতের মুখোশটা।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে। মুখ ফাঁক। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। দম নিতে ব্যস্ত।
মুসা ভাবছে, এখুনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াবে টেরি। হাসতে হাসতে নিজের বিজয় ঘোষণা করবে। কারণ, মুসা ভয় পেয়ে চিৎকার করেছে। সবাই শুনেছে সেটা।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বিমূঢ়ের মত মাথা নাড়তে লাগল টেরি। কি করে বুঝলে তুমি, ওর মধ্যে আমি আছি?
জ্বলে উঠল ছাতে লাগানো আলো। উজ্জ্বল আলোয় চোখ মিটমিট করতে করতে ফিরে তাকাল মুসা। দেখল, জানালা গলে ঘরে ঢুকেছে টাকি। বাকি সবাইও ঢুকছে।
এগিয়ে এসে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলা মুখোশটা তুলে নিল টাকি। হাতে পেঁচাতে শুরু করল নরম রবারে তৈরি জিনিসটা।
রবিন আর কিশোর এসে দুদিক থেকে ধরে মুসাকে টেনে দাঁড় করাল।
বিমূঢ়তা কাটেনি টেরির। মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করল, আমি, সেটা কি করে জানলে?
জবাব দিল না মুসা। সে নিজেও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। টেরি রয়েছে, কল্পনাই করেনি। সত্যিকারের লাশ ভেবেছে।
ঘটনাটা যে কাকতালীয়ভাবে মুসার পক্ষে চলে এসেছে, কিশোরও অনুমান করে নিয়েছে সেটা। মুসা সত্যি কথাটা ফাস করে দেয়ার আগেই। সুযোগটা কাজে লাগাল, মুসাকে বোকা বানানো তোমার কর্ম নয়, টেরি, সে তো আগেই বলেছি। নইলে কি আর এত টাকা বাজি ধরতাম।
আমার মাথায়ই ঢুকছে না, মেঝেতে পা ছড়িয়ে দিয়ে, দুই হাত পেছনে নিয়ে গিয়ে তাতে ভর দিয়ে শরীরটা উঁচু করে রেখেছে টেরি। আমি ভেবেছি, দেখামাত্র লেজ তুলে দৌড় দেবে তুমি। কিংবা বাবাগো-মাগো চিৎকার দিয়ে ভিরমি খেয়ে পড়বে।
খলখল করে হেসে উঠল কিশোর। তাহলেই বোঝো, শুঁটকি, তোমার ক্ষমতা। হাত বাড়াল, আজ আর মাপ করছি না। টাকাটা দিয়ে দাও। তোমরা হেরেছ।
কিন্তু কথা যেন কানেই ঢুকছে না টেরির। শক পাওয়া মানুষের মত বিড়বিড় করেই চলল, তুমি টেনে আমার মুখোশ খুলে নিলে! জানো বলেই নিয়েছ। কি করে জানলে? কি করে?
মুসার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল কিশোর। মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝাল-বোলো না, খবরদার!
চুপ করে রইল মুসা। সে যে ভয় পেয়েছে, আতঙ্কে আরেকটু হলে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল–জানতে পারলেই আবার পেয়ে বসবে টেরির দল।
শুঁটকি না হলে এ রকম ছাগুলে বুদ্ধি কেউ করে? তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কিশোর। ছ্যাহ! মুখোশ পরে মরা লাশ সাজে। মুসা আমান তো বিরাট ব্যাপার, একটা দুধের বাচ্চাও ধরে ফেলতে পারত এটা। আসল লাশকেই যে ভয় করে না, সে তোমাকে ভয় পাবে ভাবলে কি করে?
এতক্ষণে যেন সংবিত ফিরল টেরির। উঠে দাঁড়াল। তাই নাকি?
লজ্জা থাকলে আবার তাই নাকি বলছ। তুমি তো জ্যান্ত মানুষ, সত্যিকারের মরা লাশ থাকলেও কফিনে ঢুকতে পারবে মুসা, ঘোষণা করে দিল কিশোর। সামান্যতম বুক কাঁপবে না ওর। একবার মর্গে ঢুকে আমি আর রবিন ভয়ে দিলাম দৌড়, হাসতে হাসতে গিয়ে লাশের গালে গাল ঘষতে লাগল সে।
কিশোর, দোহাই তোমার! চুপ করো! আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠল মুসা। মুঠো শক্ত হয়ে গেছে তার। এই জঘন্য খেলা…
দেখলে, কি বিনয়? প্রশংসা পর্যন্ত সইতে পারছে না।
চোখের পাতা সরু হয়ে এল টেরির। মুসার কাঁধ থেকে টোকা দিয়ে লাশ বাধা দড়ির একটা টুকরো ফেলল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আসল লাশকেও তাহলে ভয় পাও না?
ইয়ে… বলতে গেল মুসা।
না, পায় না, মুসাকে কথা বলতে দিল না কিশোর।
ওর দিকে ঘুরল টেরি। বেশ। একটা শেষ বাজি। মুসার সর্বশেষ পরীক্ষা…।
তুমি ওর পরীক্ষা নেয়ার কে? রেগে উঠল রবিন।
বেশ, পরীক্ষা নয়, হাসল টেরি, ফাইন্যাল চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ, শব্দটা এমন ভঙ্গিতে বলল টেরি, ভয় পেয়ে গেল মুসা।
পাঁচশো ডলার বাজি, কিশোরকে বলে মুসার দিকে তাকাল টেরি। সহসাই আবার দেখা হবে আমাদের, মু-ম্মুসা। খুব শীঘ্রি। এখানে। এই ঘরে।
হাত বাড়াল কিশোর, টাকাটা! মাপ চাইলে অবশ্য মাপ করে দিতে পারি।
দ্বিধা করল টেরি। তারপর পকেটে হাত ঢোকাল। বের করে আনল শূন্য হাতটা। আনতে ভুলে গেছি। একবারেই নিও।