শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ১৩

১৩.

কাচের চোখের মত নিষ্প্রাণ দুটো চোখ। কালচে ঠোঁটে স্থির হয়ে আছে রক্ত পানি করা অস্বাভাবিক হাসি। নিচের ঠোঁটের ওপর নেমে এসেছে ওপরের পাটির একটা মাত্র দাঁত। ওই একটাই। মুখে আর কোন দাঁতই নেই। কপালে আর গালে গভীর কাটা দাগ। হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা।

চিত হয়ে আছে লাশটা। স্তব্ধ। নিথর।

চিৎকারটা বেরোয়নি মুসার মুখ থেকে। নিজে নিজেই বন্ধ করেছে না অতিরিক্ত ভয়ে আটকে গেছে, বলতে পারবে না।

জানালার কাছ থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, মুসা, কি হয়েছে?

এ-একটা…লা-লা-লাশ, কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল মুসা। কফিনের দিকে আঙুল তুলল।

বললাম না ও ভয় পাবে, হারল্ডের কণ্ঠ কানে এল তার। চেঁচিয়ে গলা ফাটাবে।

তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিকৃত হাসি হাসতে লাগল তার বন্ধুরা।

কডি বলল, আমি শিওর, এইমাত্র যে লাশটা আনল, ওটাই রেখে গেছে ওই কফিনে।

আবার হেসে উঠল ওরা।

অত হাসির কি হলো? ধমকে উঠল মুসা। এখানে একটা মানুষের লাশ রয়েছে। মৃতদেহ। এতে হাসির কি দেখলে? দেখি আলোটা নামাও নিচের দিকে।

পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে তার। গলাটা এমন শক্ত হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস ফেলার সময় চাপা শিসের মত শব্দ বেরোচ্ছে।

টর্চের আলো নিচে নামল। কিন্তু কফিনের গায়ে পড়ছে আলো, ভেতরে ঢুকতে পারছে না। কোনমতেই চেহারাটা স্পষ্ট হচ্ছে না।

ভয় পাচ্ছ নাকি? জিজ্ঞেস করল টাকি।

ও পারবে না, ঘোষণা করে দিল হ্যারল্ড।

তারমানে আমরা জিতে গেলাম, বলল কডি। দুশো ডলার!

গায়ের জোরের জেতা নাকি? কাজই শেষ হলো না এখনও, কর্কশ শোনাল কিশোরের কণ্ঠ। মাথাটা ঠেলে দিল জানালার ভেতরে। মুসা, ঢুকে পড়ো। শুয়ে পড়ো লাশটার ওপর। ও কিছু না। পারবে তুমি।…ও, দেখতে পাচ্ছো না? …এই, আলোগুলো ঠিকমত ফেলো তোমরা। না দেখলে কোথায় ঢুকবে?

লাশের ওপর শোব?

 কি হবে? এক বিছানায় শোয় না দুজন মানুষ? তফাৎ শুধু বিছানার জায়গায় বাক্স, আর গরমের জায়গায় ঠাণ্ডা লাগবে স্পর্শটা। তোমার যে একবিন্দু ভয় লাগছে না, বুঝতে পারছি আমি।

ভয় না-মুনে মনে বলল মুসা, লাগছে আতঙ্ক!

 যাও, ওঠো! কিশোর বলল।

কফিনটার দিকে ঘুরল মুসা। জানালার বাইরে চুপ হয়ে গেল সবাই। অস্পষ্ট আলোতে আরেকবার লাশটার দিকে তাকাল সে। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে চেপে ধরল কফিনের কিনার।

ফরমালডিহাইডের তীব্র গন্ধ যেন পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। অসুস্থ বোধ করছে মুসা। বমি ঠেলে আসতে লাগল।

কফিনের ওপর ঝুঁকল সে। পারবে তো?

 নাহ, পারবে না!  

কফিনের কিনার ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসতে গেল।

কানে এল গোঙানির শব্দ।

ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেল তার।

অস্পষ্ট আলোতে একটা নড়াচড়া লক্ষ করল।

পরক্ষণে ঝটকা দিয়ে উঠে এল হাতটা। লাশের হাত। খামচে ধরল তার পারকা।

চিৎকার করার জন্যে আবার মুখ খুলল সে। এবারেও কোন শব্দ বেরোল না।

হাতের মুঠিটা শক্ত হলো।

থাবা মারল অন্য হাতটা।

হ্যাঁচকা টানে মুসাকে কফিনের মধ্যে উপুড় করে ফেলল।

না! বলে চিৎকার দিয়ে টানাটানি করে সরে আসতে চাইল মুসা।

 উঠে বসল লাশটা। পারকা ছাড়ল না। টানছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে কাছে।

 কাঁচের মত চোখজোড়া তাকিয়ে আছে নিষ্পলক।

গাল আর কপালের কাটা দাগটা অনেক গভীর আর স্পষ্ট লাগছে এখন।

ছাড়ো, ছাড়ো! বলে লাশের কব্জি চেপে ধরল মুসা। ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল।

ঝাড়া দিয়ে একটা হাত ছাড়িয়ে নিল লাশটা। গলা পেঁচিয়ে ধরল মুসার। কায়দা মত ধরতে পেরেছে এবার। টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল কফিনের মধ্যে।

মুখটা লাশের বুকে চেপে বসতে দেরি নেই। গায়ের জোরে এক ঝাড়া মারল মুসা। একই সঙ্গে মুক্ত হাতটা দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল বুকে।

ছুটে গেল লাশের হাত। হঠাৎ ছুটে যাওয়ায় তাল সামলাতে না পেরে মেঝের ওপর পড়ে গেল মুসা।

ভারী একটা দেহ লাফ দিয়ে এসে পড়ল তার গায়ের ওপর। হুক করে বাতাস বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। আপনা-আপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা, খাইছে! পরক্ষণে চিৎকার করে উঠল, সরো, সরো ওপর থেকে, শয়তান কোথাকার!  

কিন্তু সরল না জ্যান্ত হয়ে ওঠা লাশ। ওটার সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করল মুসা। গড়িয়ে সরে আসতে চাইল নিচ থেকে। দুই হাত বুকে ঠেকিয়ে ধাক্কা মারতে লাগল।

কিন্তু লাশের গায়ে শক্তি কম না। দুই হাতে মুসার বাহু খামচে ধরে পেটের ওপর বসে রইল ওটা।

চলল ধস্তাধস্তি। টানাটানি। গোঙানো। বুকের পাঁজর ব্যথা করছে মুসার। মাথা ঘুরছে। ভূতের সঙ্গে লড়াই করে আর কতক্ষণ টিকবে, বুঝতে পারছে না।

আচমকা ঝটকা দিয়ে উঠে গেল তার ডান হাতটা। দুর্বল জায়গা মনে করে লাশের চুল চেপে ধরে মারল হ্যাঁচকা টান।

একটানে খুলে নিয়ে এল মাথাটা!