১২.
পর্দার কোনাগুলো বাতাসে উড়ে এসে পেঁচিয়ে ধরতে গেল যেন মুসার গলা।
প্রথম কফিনটা, মনে করিয়ে দিল টাকি, অন্য কোন কফিনে ঢুকলে কিন্তু হবে না। যাও, নামো। ডালা খুলে ঢুকে পড়ো।
আমরা কিন্তু তাকিয়ে রইলাম, কড়ি বলল।
ইস, আমার ক্যামেরাটা কেন যে আনলাম না, আফসোস করতে লাগল হ্যারল্ড। আতঙ্কে পাগলের মত চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাচ্ছে মুসা আমান-এমন একটা দৃশ্যের ছবি তোলার সুযোগ আর জীবনে পাব না।
থামো! কঠিন স্বরে ধমকে উঠল কিশোর। একদম চুপ! ফাজলেমি মার্কা আর একটা কথা বললে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি!
ওদেরকে ঝগড়ার সুযোগ দিল না মুসা। লাফিয়ে নামল ভেতরে। ধীরে ধীরে সোজা করল শরীরটা।
বাতাসে পর্দা দোলাচ্ছে। একটা পর্দার নিচের অংশ আলতো বাড়ি মারছে তার পিঠে। আরেকটা পর্দার কোনা এসে আবার পেঁচিয়ে ধরতে গেল গলা।
টান দিয়ে গলা থেকে পর্দাটা সরিয়ে সামনে তাকাল সে। অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করল।
কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আলো জ্বালব? কিছু তো দেখছি না।
না, আলো জ্বালানো চলবে না, টাকি বলল। ঠিক আছে, কফিনটা কোনখানে দেখানোর ব্যবস্থা করছি। একটা টর্চ বের করে জানালার ফ্রেমের ওপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে জ্বালল সে। ম্লান একটা গোল আলো গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
কয়েক পা এগিয়ে গেল মুসা। আলোটা স্থির হয়ে আছে এক জায়গায়।
পেছনে আরেকটা টর্চ জ্বলে উঠল। কডি জ্বেলেছে। আলো দুটো খুদে স্পটলাইটের মত ঘুরে বেড়াতে লাগল মেঝেতে।
সেই আলোর আভায় যতটা সম্ভব ঘরটা দেখে নিতে লাগল মুসা। ছাত একেবারেই নিচুতে। ওর মাথার ফুট দুই ওপরে। পাশাপাশি রাখা দুটো ধাতব টেবিল দেখতে পেল। একটা খালি। আরেকটার ওপর লম্বা কোন জিনিস প্ল্যাস্টিকের চাদর দিয়ে ঢাকা। তলায় কি আছে বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর।
একদিকে একটা ডেস্কের ওপর রাখা কাগজ ফড়ফড় করছে বাতাসে। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একসারি ফাইলিং কেবিনেট। নানা রকম কয়েল আর টিউব। হাসপাতালের ঘরের মত। ওগুলোর পাশে নিচু টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা কালো রং করা কফিনের সারি। টর্চের আলোর আভায় চকচক করছে।
খাইছে! ঝুলে পড়ল মুসার নিচের চোয়াল।
ভয় পাচ্ছো, কালটু মিয়া? কড়ি জিজ্ঞেস করল। হাতের আলোটা ঝটকা দিয়ে উঠে এল মুসার মুখের ওপর।
আলো নামাও, গাধা কোথাকার! দেখব কি করে? ধমকে উঠল মুসা।
কফিনগুলো তো দেখলে, টাকি বলল। ওই যে, প্রথম কফিনটা। যাও। টর্চের আলো ফেলে কোন কফিনটাতে ঢুকতে হবে দেখিয়ে দিল সে।
ভয় পাচ্ছে! নিটু বলল। এই, জানালার কাছ থেকে সরে যাও তোমরা। মু-ম্মুসাকে পালানোর পথ করে দাও।
ও পালাবে না, পালাবে না, পালাবে না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। কতবার বলব? তোমাদের মত মুরগীর কলজে নাকি ওর? …যাও, মুসা, এগোও। শুয়ে পড়োগে কফিনটার মধ্যে। টাকা আয়ের খুব সহজ রাস্তা।
সহজ, তবে তোমার জন্যে-মনে মনে বলল মুসা। ঈশপের গল্পের একটা উপমা মনে পড়ল: তোমাদের জন্যে খেলা বটে, আমার জন্যে মরণ! কফিনগুলোর ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবল, সত্যি কি পারবে ঢুকতে? কেমন লাগবে? ভেতরের গন্ধটা কেমন?
বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। জানালার দিকে ফিরল সে। জিজ্ঞেস করল, কফিনে শুয়ে কি ডালা নামিয়ে দিতে হবে?
ঢোকো, অধৈর্য কণ্ঠে টাকি বলল, শুধু ঢুকলেই হবে। আর কিছু করতে হবে না তোমাকে, মু-ম্মুসা! বাকিটা যার করার সে-ই করবে, রহস্যময় শোনাল তার কথা। জলদি করো। বাইরে যা ঠাণ্ডা।…পারবে? না পারলে চলে এসো।
পারবে না মানে? জোরগলায় বলল কিশোর। অবশ্যই পারবে। এ কোন ব্যাপার হলো!
ধীর পায়ে কফিনগুলোর দিকে এগিয়ে চলল মুসা। টর্চের আলো দুটো স্থির হয়ে আছে পেছনের সবুজ দেয়ালে। কফিনের ডালা নামানো।
যাও, মুসা, যাও! ঢুকে পড়ো! ও কোন ব্যাপারই না তোমার জন্যে! জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে মুসাকে অভয় দিল কিশোর। তাতে আরও পিত্তি জ্বলে গেল মুসার। অন্যকে পরামর্শ দেয়া সোজা!
ও এত দেরি করছে কেন? অস্থির হয়ে উঠেছে কডি। মুসার দুর্গতি দেখার জন্যে তর সইছে না যেন আর।
কফিনের ডালার ওপর হাত নামাল মুসা। কাঠের অনুভূতিটা মসৃণ, শীতল। এত জোরে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ডালা তোলো, মুসা-নিজেকে বোঝাল সে। তারপর ঢুকে পড়ো ভেতরে। কি আর হবে? খাট আর চৌকির মত কফিনও কাঠেরই তৈরি। সাধারণ বাক্সের মত। নিচে গদি আছে। বাক্সের ভেতরে শুলে বিছানার মতই লাগবে।
সবুজ দেয়ালে নড়ে উঠল দুটো আলোর একটা। আবার স্থির হলো।
ডালার কিনার চেপে ধরে ভারী দম নিল মুসা। টেনে উঁচু করে ঠেলে দিল ওপর দিকে। পুরোটা খুলে ফেলল। তারপর তাকাল ভেতরে।
তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে আসতে শুরু করল গলার গভীর থেকে।