শিবলাল
আমহার্স্ট স্ট্রীট দিয়ে মানিকতলা বাজারের দিকে যাচ্ছি। সিটি কলেজের কাছে এসে দেখি লোকারণ্য, দু—তিন লালপাগড়ি পুলিসও রয়েছে। ভিড় থেকে একটি ছেলে এগিয়ে এল। তার ব্যাজ নেই তবু ভঙ্গী দেখে বোঝা যায় যে সে একজন স্বেচ্ছাসেবক। হাত নেড়ে আমাকে বলল, যাতয়াত বন্ধ, এইখানে সবুর করুন।
জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে? এত ভিড় কিসের?
—দেখুন না কি হচ্ছে। শিবলাল ভার্সস লোহারাম।
কিছুই বুঝলাম না। ছেলেটি ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে অন্যত্র গেল। একজন কনস্টেবলকে দেখে বললাম, ক্যা হুআ জমাদারজী?
দাঁত বার করে জমাদারজী বললেন, আরে কুছু নহি বাবু।
পুলিসের হাসি দুর্লভ। বুঝলাম দুর্ঘটনা নয়, কোনও তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু এত ভিড় কিসের জন্যে? যাতায়াত বন্ধ কেন? লোকে উদগ্রীব হয়ে কি দেখছে? কুস্তি হচ্ছে নাকি?
একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক অতি কষ্টে ভিড় ভেদ করে উলটো দিক থেকে আসছেন। ছেলেরা তাঁকে বাধা দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি জোর করে চলে এলেন। আমার কাছে পৌঁছতেই বললাম, কি হয়েছে মশায়?
এই সময় ভিড়ের মধ্য থেকে হাততালির শব্দ উঠল, সঙ্গে সঙ্গে জনকতক ধমক দিল—চোপ, চোপ, গোল করবে না।
চুপি চুপি আবার প্রশ্ন করলাম, কি হয়েছে মশায়?
ভদ্রলোক বললেন, হয়েছে আমার মাথা। বেলা সাড়ে চারটের মধ্যে শ্যামবাবুর বাড়িতে পৌঁছুবার কথা তা দেখুন না, ব্যাটারা পথ বন্ধ করে খামকা দেরি করিয়ে দিল।
একজন সৌম্যদর্শন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আমার কাছে এলেন। তাঁর মাথায় টিকি, কপালে বিভূতির ত্রিপুণ্ড্রক, মুখে প্রসন্ন হাসি। আমাকে বললেন, কি হয়েছে জানতে চান? আসুন আমার সঙ্গে। ও তিনু, ও কেষ্ট, একটু পথ করে দাও তো বাবারা।
তিনু আর কেষ্ট দুই স্বেচ্ছাসেবক কনুই এর গুঁতো দিয়ে পথ করে দিল, আমরা এগিয়ে গেলাম। সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম হরদয়াল মুখুজ্যে, এই পাড়াতেই বাস। মশায়ের নাম?
—রামেশ্বর বসু। আমিও কাছাকাছি থাকি বাদুড়বাগানে।
ভিড় ঠেলে আরও কিছু দূর আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে হরদয়ালবাবু আঙুল বাড়িয়ে বললেন,দেখতে পাচ্ছেন?
দেখলাম দুটো ষাঁড় লড়াই করছে। গর্জন নেই, নড়ন চড়ন নেই, কিন্তু শীতল সমর বলা যায় না, নীরব উষ্মা দুই যোদ্ধারই বিলক্ষণ আছে। একটি ষাঁড় প্রকান্ড, দেখেই বোঝা যায় বয়স হয়েছে, ঝুঁটি আর শিং খুব বড়, গলা থেকে থলথলে ঝালর নেমে প্রায় মাটিতে ঠেকেছে। অন্যটি মাঝারি আকারের, বয়সে তরুণ হলেও বেশ হৃষ্টপুষ্ট আর তেজস্বী। দুই ষাঁড় শিং জড়াজড়ি করে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে পরস্পরকে ঠেলে ফেলবার চেষ্টা করছে। টগ—ওভ—ওআরের উলটো, টানাটানির বদলে ঠেলাঠেলি।
হরদয়াল বললেন, প্রায় এক ঘণ্টা এই দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছে। প্রবীণ ষাঁড়টির নাম শিবলাল, আর তরুণটির নাম লোহারাম। স্বয়ং শিব কর্তৃক লালিত সেজন্য শিবলাল নাম। লোহারাম হচ্ছে এই পাড়ার ষাঁড়, লোহাওয়ালারা ওকে খেতে দেয়। লড়াই শুরু হতেই ওরা ওর ওপর বাজি ধরেছে। ওদের বিশ্বাস, ওই নওজওআন লোহারামের সঙ্গে বুডঢা শিবলাল পেরে উঠবেন না। কিন্তু পাড়ার বাঙালীরা জানে যে শেষ পর্যন্ত শিবলালেরই জয় হবে।
গান্ধী টুপি আর লম্বা কোট পরা এক ভদ্রলোক হরদয়ালের কথা শুনছিলেন। তিনি একটু ভাঙা বাংলায় বললেন, এ হরদয়ালবাবু, এর ভিতর প্রাদেশিকতা আনবেন না। এই লড়াই বিহার আর বঙ্গালের মধ্যে হচ্ছে না।
হরদয়াল বললেন, নিশ্চয়ই নয়। লোহারাম এই পাড়ার ষাঁড়, বিহারী কালোয়াররা ওকে খেতে দেয়,সেজন্য লোহারামকে বিহারী বলা যেতে পারে । কিন্তু শিবলাল বাঙালী নন, সর্বভারতীয় কস্মপলিটন ষণ্ড। এঁর জন্মভূমি কোথায় তা কেউ জানে না। তবে এঁর সম্বন্ধে আমার একটা থিওরি আছে, এঁর ইতিহাসও আমি কিছু কিছু জানি।
টুপিধারী লোকটি একটু অবজ্ঞার হাসি হেসে চলে গেলেন। আমি বললাম, ইতিহাসটি বলুন না হরদয়ালবাবু।
হরদয়াল বললেন, সবুর করুন। লড়াইটা চুকে যাক, তারপর আমার বাড়িতে আসবেন, চা খাবেন, শিবলালের কথাও শুনবেন।
লড়াই শেষ হতে দেরি হল না। শিবলাল হঠাৎ একটি প্রকান্ড গুঁতো লাগাল। লোহারাম ছিটকে সরে গেল, তারপর ল্যাজ উঁচু করে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে পালাল। দর্শকরা চিৎকার করে বলতে লাগল, শিবলালজী কি জয়! লোহারাম দুও।
প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিতাড়িত করে শিবলাল গজেন্দ্রগমনে হেলে দুলে চলল, না জানি কি জানি হয় পরিণাম দেখবার জন্যে আমরাও তার পিছু নিলাম। একটা বাঙালী ময়রার দোকানের সামনে পিতলের থালায় শিঙাড়া আর নিমকি সাজানো রয়েছে। শিবলাল তাতে মুখ দিল। ত্রস্ত হয়ে ময়রা হাঁ হাঁ করে উঠল। দর্শকেরা ধমক দিয়ে বলল, খবরদার, বাধা দিও না, পেট ভরে খেতে দাও, তোমার চোদ্দ পুরুষের ভাগ্যি যে এমন অতিথি পেয়েছ। দু থালা নিঃশেষ করে শিবলাল এদিক ওদিক তাকাচ্ছে দেখে একজন ভলাণ্টিয়ার তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, এগিয়ে এসো বাবা।
পাশেই একটি হিন্দুস্থানী হালুইকরের দোকান। সামনের বারকোশে সদ্য ভাজা দালপুরির স্তুপ দেখিয়ে ভলান্টিয়ার বলল, যত খুশি খাও বাবা। আপত্তি নিষ্ফল জেনে হালুইকর চুপ করে রইল। অচিরাৎ দালপুরি শেষ হল। একটি ছেলে দোকানের ভিতরে ঢুকে ছোলার দাল, আলুর দম, আর জিলিপির গামলা টেনে এনে সামনে রাখল। শিবলাল সমস্ত উদরস্থ করে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করতে লাগল। দর্শকরা বলল, আর কি আছে জলদি নিকালো। দোকানদার বিষণ্ণ মুখে বলল, কুছ ভি নহি, সব খা ডালা।
হরদয়ালবাবু হাতে একটু জল নিয়ে শিবলালের গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বললেন, নমঃ শিবায়। শিবলাল ফোঁস ফোঁস শব্দ করে বিবেকানন্দ রোডের দিকে চলে গেল।
হরদয়ালবাবুর বাড়ি কাছেই। কৌতূহলের বসে আমি তাঁর সঙ্গে গেলাম। বাইরের ঘরে ফরাসের উপর আমাকে বসিয়ে হরদয়াল চাকরকে হুকুম করলেন, ওরে, জলদি এঁর জন্যে চা তৈরি করে আন।
আমি বললাম, আপনি ব্যস্ত হবেন না, এ সময় চা খাওয়া আমার অভ্যাস নেই। শুধু শিবলালের ইতিহাস শুনব। আপনার কি একটি থিওরি আছে বলেছিলেন। তাও শুনতে চাই।
হরদয়াল বললেন, সবই বলব। চা খাবেন না তো একটু শরবত আনতে বলি? খুব মাইল্ড সিদ্ধির শরবত? বৃদ্ধ বয়সে একটু খাওয়া ভাল। তাও নয়? সিগারেট?
—ওসব কিছুই দরকার নেই। আপনি শিবলালের কথা বলুন।
—বেশ, তাই বলছি শুনুন। এই যে শিবলালজীকে দেখেছেন, এঁকে সামান্য ষাঁড় মনে করবেন না। মাদাম ব্লাভাৎস্কি বলেছেন, মানবের চাইতেও যেমন বড় আছেন মহামানব বা সুপারম্যান, তেমনি পশুর ওপর আছেন মহাপশু, সুপারবীস্ট। হিমালয়বাসী স্নোম্যান হচ্ছেন সেইরকম প্রাণী। এঁদের বড় একটা দেখা যায় না, কালে ভদ্রে লোকালয়ে আগমন করেন। এই শিবলাল হচ্ছেন একজন সুপারবীস্ট। মহোক্ষ জানেন? সংস্কৃত গ্রন্থে অনেক উল্লেখ আছে। মহোক্ষ মানে মহাষণ্ড, উক্ষ আর ইংরিজী অক্স একই শব্দ। শিবলালের প্রথম আবির্ভাব কোথায় হয়েছিল, বর্তমান বয়স কত, তা কেউ জানে না। আমার পিতামহ ওঁকে কাশীতে দেখেছিলেন। আবার তাঁর পিতামহ ওঁকে হরিদ্বারে দেখেছিলেন। তবেই বুঝুন ওঁর বয়সটা কত। আর, চেহারটি দেখুন, আমাদের বাংলা ষাঁড় কিংবা ভাগলপুর সীতামাড়ি বা হিসারের ষাঁড়, কারও সঙ্গে মিল নেই। মহেঞ্জোদারো আর হরপ্পায় যে সব পোড়া মাটির সীল পাওয়া গেছে তার ছবি দেখেছেন তো? তাতে যে মহাষণ্ডের মূর্তি আছে তার সঙ্গে এই শিবলালের রূপ মিলিয়ে দেখুন। সেই বিশাল বপু সেই উন্নত ককুদ, সেই বৃহৎ শৃঙ্গ, সেই ভূলুন্ঠিত গলকম্বল। প্রাচীন সৈন্ধব জাতি অর্থাৎ ইণ্ডস ভ্যালির লোকরা শৈব ছিলেন। তাঁদের উপাস্য দেবতা শিবের বাহন যে মহোক্ষ, তাঁরই মূর্তি পোড়া মাটির মুদ্রায় অঙ্কিত আছে। আমার থিওরিটা কি জানেন? এই শিবলালাজীই হচ্ছেন পুরাকালীন সৈন্ধব জাতির মহোক্ষ, এখন পর্যন্ত ধরাধামে আছেন। এতটা যদি বিশ্বাস নাও করেন তবে এ কথা মানতে বাধা নেই যে শিবলাল সেই সৈন্ধব মহোক্ষরই বংশধর। কি বলেন আপনি?
—অসম্ভব নয়।
—আচ্ছা, এখন এঁর কীর্তিকলাপ শুনুন। চার বছর আগে ইনি কাশীতে বিশ্বনাথ মন্দিরের নিকটে বিচরণ করতেন। একদিন ভোরবেলা মন্দিরের দরজার সামনে নিদ্রিত ছিলেন, একজন পাণ্ডা এঁকে ঠেলা দিয়া তাড়াবার চেষ্টা করে। যখন কিছুতেই উঠলেন না তখন পাণ্ডা লাথি মারতে লাগল। শিবলাল ক্রুদ্ধ হয়ে শিং দিয়ে পাণ্ডার পেট ফুটো করে দিলেন। তারপর থেকে কাশীধামে ওঁকে আর দেখা গেল না। মাস দুই পরে উনি ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় বৈদ্যনাথের মন্দিরে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে খবর পাওয়া গেল, ঝাঁঝার জঙ্গলে একটা রয়াল বেঙ্গল টাইগারের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, কোনও মহাকায় প্রাণী শিঙের গুঁতোয় তার পেট ফুটো করেছে, পা দিয়ে মাড়িয়ে সর্বাঙ্গ চূর্ণ করে দিয়েছে। এই শিবলালজীরই কর্ম তাতে সন্দেহ নেই। পাণ্ডাদের পরিচর্যায় ওঁর ঘা শীঘ্রই সেরে গেল। কিন্তু কি একটা অসম্মানের জন্যে বিরক্ত হয়ে উনি বৈদ্যনাথধাম ত্যাগ করলেন এবং ঘুরতে ঘুরতে তারকেশ্বরে এলেন। আবার দিন কতক পরে সেখান থেকে চুঁচড়ার ষাঁড়েশ্বর তলায় উপস্থিত হলেন। প্রায় তিন বছর হল সেখান থেকে কালীঘাটে এসে নকুলেশ্বর মন্দিরের কাছে আস্তানা করেছেন। আজকাল সেখানেই রাত্রিযাপন করেন, দিনের বেলায় শহরের নানা স্থানে পর্যটন করে বেড়ান।
আমি বললাম, চমৎকার ইতিহাস। আচ্ছা, বসুন আপনি, আমি এখন উঠি।
হরদয়ালবাবু হাত নেড়ে বললেন, আরে এখনই উঠবেন কি? শিবলালজীর যা শ্রেষ্ঠ কীর্তি, মহত্তম অবদান, তাই বাকী রয়েছে। বলছি শুনুন। কামধেনু ডেয়ারি ফার্মের নাম শুনেছেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। সেখান থেকেই তো আমার বাড়িতে দুধ আসত। শেষকালে ওদের কুবুদ্ধি হল, মোষের দুধ, গুঁড়ো দুধ, জল, এইসব মিশিয়ে খদ্দের ঠকাতে লাগল। তখন তাদের দুধ নেওয়া বন্ধ করলাম।
—প্রায় দু বছর হল কামধেনু ডেয়ারি ফেল হয়েছে। কেন ফেল হল জানেন? ওই বাবা শিবলালের কোপে পড়ে। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। কামধেনু ডেয়ারির তিন শ গরু ছিল, ঢাকুরের ওদিকে বড় বড় গোয়ালে তারা থাকত। সকালে দুধ দোহার পর আট দশ জন রাখাল তাদের গড়ের মাঠে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিত। দিন ভর তারা ঘাস খেত, তারপর বেলা পড়লে রাখালরা তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেত।
সেই সময় শিবলাল চুঁচড়া থেকে কালীঘাটে আগমন করেন। উনি সমস্ত দিন টোটো করে ঘুরতেন সন্ধ্যের কিছু আগে গড়ের মাঠে গিয়ে খানিকক্ষণ নিরিবিলিতে বায়ুসেবন করতেন। একদিন কি খেয়াল হল, বেলা তিনটের সময় মাঠে উপস্থিত হলেন। দেখলেন, একপাল নধর গরু চড়ে বেড়াচ্ছে। শিবলাল প্রীত হয়ে নাসিকা উত্তোলন করে কয়েকবার হর্ষসূচক ঘোঁত ঘোঁত ধ্বনি করলেন। আর যায় কোথা! সেই আহ্বান শুনে কামধেনু ডেয়ারির তিন শ গরু হাম্বা রব করে ছুটে এসে শিবলালকে বেষ্টন করল। রাসমণ্ডলের মধ্যবর্তী গোপিকাবেষ্টিত শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় শিবলাল শোভমান হলেন। ক্ষণকাল পরে তিনি মাঠ ত্যাগ করে সবেগে চললেন, সমস্ত গরু অভিসারিকা হয়ে তাঁর অনুসরণ করল। হেস্টিংস ছাড়িয়ে ডায়মণ্ড হারবার রোড দিয়ে শিবলালের অনুগামিনী ধেনুবাহিনী মার্চ করে চলল, রাখালরা লাঠি নিয়ে পশ্চাদধাবন করল। কিন্তু তিন শ গরু যদি স্বেচ্ছায় একটি ষাঁড়ের সঙ্গে ইলোপ করে তবে তাদের আটকাবে কে? বেগতিক দেখে কয়েক জন রাখাল ফিরে গিয়ে কর্তাদের খবর দিল। তখন তিন জন ডিরেক্টর—গোবরচন্দ্র ঘোষ, গোর্ধনলাল মাথুর, আর হাজী কোরবান আলী মোটরে চড়ে ছুটলেন, একটা লরিতে তাঁদের অনুচরেরাও চলল। মগরাহাটের কাছাকাছি এসে দেখলেন, একটি মাঠে শিবলালজী তাঁর সঙ্গিনীদের সঙ্গে ঘাস খাচ্ছেন। কর্তারা স্থির করলেন, ওই ষাঁড়টিকে কাবু না করলে তাঁদের গোধন উদ্ধার করা যাবে না। তাঁদের হুকুমে জনকতক সাহসী লোক লাঠি নিয়ে শিবলালজীকে আক্রমণ করল। তখন সমস্ত গরু একযোগে শিং বাগিয়ে তেড়ে এল, ডেয়ারির লোকরা ভয় পেয়ে পালাল। কর্তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন, কয়েকজন রাখাল গরুদের ওপর নজর রাখবার জন্যে সেখানে রয়ে গেল।
তারপর ডেয়ারির কর্তারা আরও তিন—চার দিন গরু ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনও ফল হল না। শেষকালে স্থির করলেন যে মগরাহাটের ওই মাঠটা লীজ নিয়ে ওখানেই ডেয়ারির জন্য গোশালা করবেন। ভেজাল দুধ দিয়ে কোনও রকমে খদ্দের ঠেকিয়ে রাখা হল, ওদিকে জমির মালিকের সঙ্গেও কথাবার্তা চলতে লাগল। তখন আর এক বিপদ উপস্থিত। শিবলালজী মুক্ত জীব, বেশী দিন সংসার মায়ায় বন্ধ হয়ে থাকতে পারবেন কেন? সাত দিন পরেই তাঁর গোষ্ঠ লীলার শখ মিটে গেল, রাত্রিযোগে তিনি একাকী কালীঘাটে প্রত্যাবর্তন করলেন।
—গরুগুলোর কি হল? কর্তারা তাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন তো?
—রাম বল, ফেরাবার জো কি? চারদিকের গাঁ থেকে চাষারা এসে সব গরু লুট করে নিয়ে গেল। দেখুন রামেশ্বরবাবু, এই শিবালালজীর মাহাত্ম্য দেশের লোক এখনও বুঝল না। আমি দুগ্ধ মন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলাম—মশায়, ওঁকে হরিণঘাটায় নিয়ে গিয়ে তোয়াজ করুন, আপনাদের গোবংশের অশেষ উন্নতি হবে। এমন পেডিগ্রি—সম্পন্ন মহাকুলীন ষাঁড় আর পাবেন কোথা? কিন্তু মন্ত্রীমশায় কিছুই করলেন না, তিনি শুধু সীতামাড়ি, হরিয়ানা, হিসাব, শর্ট হর্ন, জার্সি— এই সব বোঝেন। আচ্ছা, আজ এখন উঠতে চান? মধ্যে মধ্যে আসবেন দয়া করে, আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়ায় বড় খুশী হলাম রামেশ্বরবাবু। নমস্কার!
১৩৬১ (১৯৫৪)