শিক্ষার রাজনীতিক টুপি

শিক্ষার রাজনীতিক টুপি

১.

আপনাকে শিক্ষিত করার জন্য নয়, শিক্ষার উদ্ভব ঘটেছিলো রাজনীতিক প্রয়োজনে। শিক্ষা একটি রাজনীতিক আবিষ্কার। রাজনীতিকদের আবিষ্কারের সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু এই একটি আবিষ্কারের মাধ্যমেই তারা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে পৃথিবীর সকল আবিষ্কারের। রাজারা বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষা মানুষকে যতোটা না প্রশিক্ষিত করে, তার চেয়েও বেশি করে শৃঙ্খলিত। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুশৃঙ্খল মানুষকে শাসন ও শোষণ করা সহজ হয়। রাজার যেকোনো আদেশ, নিষেধ ও ঘোষণাকে তারা সহজে আমলে নেয়। রাজা কী চান ও কী চান না, তা শিক্ষিত মানুষরা অশিক্ষিত মানুষদের চেয়ে দ্রুত অনুধাবন করতে পারে।

শিক্ষার কাজ কী? শিক্ষার প্রথম কাজ, রাষ্ট্রের হয়ে শিশুদেরকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা। বাবা-মা বা সমাজ নয়, রাষ্ট্রই শিশুদের প্রকৃত অভিভাবক, এ মিথ্যাটিকে সত্য রূপে শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দেশের তরে জীবন দিতে হবে- এ রাজনীতিক ধারণাও শিশুরা শিক্ষা থেকেই প্রথম লাভ করে। যদিও রাজনীতিকরা কৌশলে এটিকে ডাকেন ‘দেশপ্রেম’, তবে এটি একপ্রকার ফাঁদ, যা দুর্যোগে রাজার রক্ষাকবচ হিশেবে কাজ করে।

দেশপ্রেমের যে-রাজনীতিক সংজ্ঞা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করেছে, তার মূলকথা এরকম: দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে সর্বদা প্রস্তত থাকতে হবে। কেউ দেশপ্রেমিক, কিন্তু তিনি দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তত নন- এমনটি রাজনীতিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

সমাজে দেশপ্রেমের কাল্পনিক গুরুত্ব রাজারা নিজেদের স্বার্থেই ছড়ান। এ কাজে মাধ্যম হিশেবে ব্যবহার করা হয় ‘শিক্ষা’-কে। শিক্ষার কারিগররা জানেন, সমাজে কোনো ধারণা দীর্ঘদিন প্রচলিত থাকলে, তা অনেকটা ধর্মের রূপ লাভ করে। ধারণাটি মানুষের জন্য উপকারী না অপকারী, উদ্ভট না সুন্দর, তা এখানে বিচার্য বিষয় নয়। বিচার্য বিষয় হলো, ধারণাটিতে কতোজন মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তা। বিশ্বাসী মানুষদের গুণগত মানও এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। প্রাসঙ্গিক হলো সংখ্যা। সংখ্যাটি বড়ো হলে, অর্থাৎ ‘শিক্ষা’ কর্তৃক প্রচারিত প্রোপাগান্ডায় সমাজের অধিকাংশ মানুষ দীক্ষিত হয়ে গেলে, ধারণাটি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

কোনো ধারণা, তত্ব, বা মতবাদ সমাজে একবার প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে, তার কিছু সামাজিক মূল্য তৈরি হয়। ওই মূল্য পরিশোধ না করে ধারণাটির ব্যাপারে কোনো সন্দেহ পোষণ করা যায় না, এবং যাচাই করা যায় না এর সত্যতা ও রাজনীতিক গুণাবলী। বহু রাষ্ট্রে এ মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে নাগরিকদেরকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষা কী কী উপায়ে শিশুদেরকে দেশপ্রেম ধারণাটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়?

এর অনেকগুলো উপায় আছে বলে মনে করি। জাতীয় সংগীতের কথাই ধরা যাক। বহু দেশে শিক্ষা একটি শিশুকে, দেশপ্রেমের সাথে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে। জাতীয় সংগীত ধারণাটি বিকাশ লাভ করেছে জাতীয়তাবাদ থেকে। আমি ও আমার জাতি শ্রেষ্ঠ- এটি মনে মনে পোষণ ও বিশ্বাস করাই জাতীয়তাবাদ। জাতীয় সংগীত এ বিশ্বাসের একটি আবৃত্তিযোগ্য কাব্যরূপ মাত্র। কাব্যরূপটি মোটেও সংগীত নয়। কিন্তু ইশকুলগুলো সমাজে এটিকে সংগীত হিশেবে প্রচার করেছে, এবং মানুষ তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। রাজনীতিকরা এটিই চান। ছদ্মসত্য ও প্রোপাগান্ডা যারা সহজে বিশ্বাস করে, তারা আদিকাল থেকেই রাজনীতিকদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাদের নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। ভয় ওদের নিয়ে, যারা মুদ্রিত বেদবাক্যকে সন্দেহের চোখে দেখে। গলায় ঝুলতে থাকা ফুলের মালার আসল উদ্দেশ্যটি খতিয়ে দেখতে চাইলে রাজনীতিকরা খুব রুষ্ট হন।

নানা উপলক্ষে জাতীয় সংগীত শিক্ষিত মানুষদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। কোনো কোনো দেশে সংগীতটিকে এতোই মহান করে তোলা হয়েছে যে, সিনেমা দেখানোর সময়ও এটিকে পরিবেশন করা হয়। দর্শকরা দাঁড়িয়ে মুখ ভার করে সেটিকে সম্মান জানান। আমি একবার না দাঁড়ানোয় সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিলো।

শিশুরা ইশকুলে ঢুকেই গানটি গায়। আসলে গায় না, গাইতে বাধ্য হয়। ফলে বলা যায়, এটি আরোপিত সংগীত। এর আবৃত্তি স্বতঃস্ফূর্ত নয়। গানটির সারমর্ম অনেক দেশেই মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত। আমি শিশুদের সাথে মিথ্যে বলার বিরোধী।

রাষ্ট্র তার জাতীয় সংগীতে এমন সব জিনিস বর্ণনা করে, যা কাল্পনিক ও বানোয়াট। তবে এ কল্পনাকে শিশুদের সামনে উপস্থাপন করা হয় বাস্তব রূপে। এই মুহূর্তে বিশ্বে যতোগুলি জাতীয় সংগীত আছে, তাদের প্রায় সবগুলিতেই সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি, যুদ্ধ, ও বীরত্বগাথা- এ চারটি বিষয়ের অবাস্তব উপস্থাপনা রয়েছে। সেনেগালের কথাই ধরুন। দেশটির জাতীয় সংগীতে ‘দি রেড লাইয়োন হ্যাজ রোরড’ বা ‘লাল সিংহ হুঙ্কার দিয়েছে- এরকম একটি লাইন রয়েছে। ক্লাস থ্রি বা ফোরের শিশুর পক্ষে কবিতা বুঝা সম্ভব নয়। মিথ্যাকে মিথ্যা হিশেবে ব্যাখ্যা না করলে শিশুরা মিথ্যাকেই সত্য বলে ধরে নিতে পারে। কল্পনা যে কল্পনা, তা বুঝিয়ে না বললে কল্পনাকেই তারা বাস্তব হিশেবে মেনে নিতে পারে। আমি শৈশবে আলিফ লায়লার জ্বিনকে বাস্তব ভেবে রাতে হাঁটতে ভয় পেতাম

কবিতার লাল সিংহ যে একটি অতিরঞ্জিত রূপক, তা কি সেনেগালের শিশুদের কাছে পরিষ্কার করা হয়? হয় না। ফলে শিশুরা ধরে নেয়, পৃথিবীতে লাল রঙের সিংহ আছে, এবং সিংহদের মধ্যে লাল রঙের সিংহই শ্রেষ্ঠ। শিশুদের মাথায় এটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়- সেনেগালিজরাই বনের ওই লাল সিংহ। জাতি হিশেবে সেনেগালিজরাই সেরা। আর যারা আছেন, ইংরেজ, মার্কিনি, ফরাসি, আরব, বাঙালি, স্প্যানিশ, চায়নিজ, জাপানি- তারা সেরা নয়। ওরা সিংহের রাজ্যে মেষ, খরগোশ, বা বনবিড়াল। সভ্যতায় সেনেগালের অবদান যা-ই থাকুক

অবদান যা-ই থাকুক না কেন, মানুষ হিশেবে সেনেগালের লাল সিংহরাই শ্রেষ্ঠ, এ বিশ্বাস নিয়েই শিশুরা বড়ো হয়।

এ আত্মতুষ্টি শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। কারণ ওরা যখন বড়ো হয়, তখন সেনেগালের সবকিছুকেই তাদের ভালো মনে হয়। সেনেগালের রাজার সকল কর্ম ও সিদ্ধান্তকে তারা উত্তম ও স্বাভাবিক বলে গণ্য করতে শুরু করে। কারণ যে-সিংহ লাল ও শ্রেষ্ঠ, সে-সিংহের পক্ষে কোনো ভুল কাজ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ রাজার ভুল-ত্রুটি অনুসন্ধানের যে-স্পৃহা, সেটিকে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে গোপনে দমন করা হয়।

ফলে বলা যায়, জাতীয় সংগীত ধীরে ধীরে শিশুদের চিন্তা ও প্রতিবাদ করার শক্তি কেড়ে নেয়। ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে, ভালো ও খারাপের মধ্যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে, সঠিক ও ভুলের মধ্যে, তারা তখন সহজে পার্থক্য করতে পারে না। মানুষ হিশেবে তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়ে যায়। এ অবস্থায় রাজনীতিকরা অনায়াসেই যোগাড় করতে পারেন লাখ লাখ অনুগত মেষ।

জাতীয় সঙ্গীতের যে-জাতীয়তাবাদী হুইসেল, তা শিশুদের সৃষ্টিশীলতাকেও বিকৃত করে। কোনো শিশুকে যখন বুঝিয়ে দেয়া হয় যে তার জাতি ইতোমধ্যে শ্রেষ্ঠ, তখন বড় হয়ে সে আর কোনো নতুন জ্ঞান বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করে না। তার জীবন হয়ে ওঠে আত্মপ্রসাদগ্রস্ত বুড়ো মানুষের জীবন, যার একমাত্র স্বপ্ন কবরে ঢুকে জৈবসার হওয়া।

কেউ কেউ অবশ্য নিয়ম ভাঙেন, তবে তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। পৃথিবীতে কোনো দেশেই একটি ভালো লেখা বা ভালো আবিষ্কারের সাথে জাতীয় সংগীতের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে না। জাতীয় সংগীতের সাথে সম্পর্ক আছে বোমা, যুদ্ধ, অহংকার, ও ধ্বংসের। এটি মানুষকে প্রতিশোধপরায়ণ হতে শেখায়।

ব্রিটিশ নৌবাহিনী যখন আমেরিকার ম্যাক-হ্যানরি দুর্গ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলো, তখন ফ্রান্সিস স্কট নামের এক আইনজীবী ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। স্কট কবিতাও লিখতেন। তিনি লিখলেন কবিতা- দি স্টার স্প্যাঙ্গোলড ব্যানার। এ কবিতা একসময় মার্কিন নৌবাহিনীর দাপ্তরিক সংগীতে পরিণত হয়, এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট উইলসন এটিকে আমেরিকার জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেন। স্কট কবিতাটি লিখেছিলেন আবেগতাড়িত হয়ে। বোমাক্রান্ত দুর্গে উড়তে থাকা মার্কিন পতাকা দেখে তিনি আবেগাক্রান্ত হয়েছিলেন। সব ধ্বংস হবে, কিন্তু আমেরিকার পতাকা ধ্বংস হবে না— এটিই ছিলো কবিতার মূলভাব। কবিতাটিতে একটি লাইন আছে এরকম-

“উই উইল কিপ হার ব্রাইট ব্লেইজান ফরেভার আনস্টেইন্ড”

লাইনটি আমেরিকা রাষ্ট্রের ঔদ্ধত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। পৃথিবী ধ্বংস করে হলেও তারা তাদের পতাকার মান রাখবে— এটিই আমেরিকার জাতীয় সংগীত। প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত এরকম ঔদ্ধত্যের স্লোগান। এ সংগীত শিশুদের কেবল অহংকার আর অসারতাই শেখায়। আমি মানুষকে অহংকার ও অসারতা শেখানোর পক্ষে নই।

জাতীয় সংগীতের যে-জাতীয়তাবাদী চেতনা, তা মূলত নিজেকে ফেরেশতা ও অন্যকে শয়তান ভাবার চেতনা। এতে যুদ্ধবিগ্রহ বাড়ে। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে অপছন্দের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর। শত্রু সম্পত্তি হিশেবে দখলে নিতে পারে অন্য রাষ্ট্রের তেল, গ্যাস, ও ভূভাগ। প্রাণ যেতে পারে বহু নিরীহ মানুষের। কারণ এ চেতনা শিশুদের মনে একটি কৃত্রিম পক্ষপাতিত্ব সৃষ্টি করে। ফলে নিজ দেশের মানুষ ছাড়া অন্য যাকেই দেখে, তাকেই সে এলিয়েন ভাবতে শেখে। ভিনদেশিরা যেকোনো সময় আমার দেশের পতাকা মাটিতে নামিয়ে ফেলতে পারে— এমন একটি সুপ্তশঙ্কা তার ভেতর জীবিত থাকে। অনেক দূরের কোনো রাষ্ট্র, আমার রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে- এমন ভাবনাও তাকে রাতদিন বিচলিত করে।

জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার মতো জাতীয়াতাবাদী উপাদানগুলো শিক্ষা থেকে বিলুপ্ত করা গেলে, শিশুরা আরো বড়ো মন নিয়ে বেড়ে উঠতে পারতো। জাতীয়তাবাদ শিশুদের হৃদয়ের চারপাশে একটি বেড়া নির্মাণ করে দেয়। এ বেড়া শিশুটি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখনো থাকে, যদি না পর্যাপ্ত পড়াশোনা ও উপলব্ধি দ্বারা বেড়াটিকে সে উৎপাটন করতে পারে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা পৃথিবী আর প্রকৃত পৃথিবী এক নয়। আমি শিশুদেরকে বেড়ার ভেতরে রাখার বিরোধী।

তবে দেশপ্রেম শেখাতে জাতীয় সংগীত সব দেশে সমান সফলতা অর্জন করে না। অনেক দেশেই এটি জন্ম দেয় ছদ্মদেশপ্রেমের।

এ প্রসঙ্গে ডিস্টোপিয়ার জাতীয় সংগীতের কথা বলা যায়। গানটি লিখেছিলেন বিগ ব্রাদার (বিগ ব্রাদার যা সৃষ্টি করেছিলেন তার পুরোটা নেওয়া হয়নি, নেওয়া হয়েছিলো প্রথম দশ লাইন)। পরবর্তীতে পপ গায়ক ওব্রাইয়েনের ‘আই উইল ফাইন্ড ইউ’ গানের সুর ধার করে এটিকে পরিণত করা হয়েছিলো জাতীয় সংগীতে। গানটির শুরু এভাবে-

“উই উইল নট লেট ইয়ু গো, স্মল ব্রাদার্স, ফ্রম আওয়ার ল্যান্ড অব গোল্ড অ্যান্ড সিলভার”

কোনো শিশু যখন এ লাইনটি গায়, তখন সে এমন একটি দেশ কল্পনা করে, যেটি স্বর্ণ ও রুপা দিয়ে তৈরি, অথবা দেখতে স্বর্ণ ও রুপার মতো। স্বর্ণ একটি মূল্যবান ধাতব পদার্থ। সহজলভ্য ধাতুগুলোর মধ্যে স্বর্ণই শ্রেষ্ঠ, এ খবর শিশুরা রাখে। তারা জানে, তাদের মা লোহার তৈরি জিনিসপত্র তালা মেরে রাখেন না, শুধু স্বর্ণের তৈরি জিনিসগুলোকেই খুব সাবধানে রাখেন। ডিস্টোপিয়ার সমাজে, বিয়ের সময় স্বর্ণ নিয়ে যে ঝগড়া-ঝাঁটি হয়, তা শিশুরা প্রত্যক্ষ করেছে। ফলে ‘ফ্রম আওয়ার ল্যান্ড অব গোল্ড অ্যান্ড সিলভার’ বাক্যটিকে তারা হেঁয়ালির মতো অনুবাদ না করে, অনুবাদ করে নিজস্ব বোধশক্তি দ্বারা। বিগ ব্রাদারের বোধশক্তির সাথে এ বোধশক্তি মিলবে না।

শিশুটি কল্পনা করে, যে-দেশ স্বর্ণ ও রুপার মতো মূল্যবান ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি, বা যে-দেশের সম্মান বিশ্ব দরবারে স্বর্ণের মতো গুরুত্বপূর্ণ, সে- দেশে মানুষের চরিত্র নিশ্চয়ই ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের মতো নিখাদ। তারা হয়তো যাপন করেন সোনার ন্যায় চকচকে জীবন। তাদের রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, এগুলোর মান নিশ্চয়ই স্বর্ণতুল্য। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা ওখানে গোল্ড স্যান্ডার্ড।

শিশুটি বিগ্র ব্রাদারের গানের রূপকল্প বুঝতে পারে না। সে প্রেমে পড়ে যায় ওই স্বর্ণের দেশটির, আর ভালোও বাসতে শুরু করে গানের ওই কাল্পনিক স্বর্ণের দেশটিকেই। কিন্তু দ্রুতই শিশুটির ভুল ভাঙে। সে কল্পনার ডিস্টোপিয়ার সাথে বাস্তবের ডিস্টোপিয়ার কোনো মিল খুঁজে পায় না। ফলে তার পক্ষে আর বাস্তব দেশটিকে ভালোবাসা সম্ভব হয় না। সে হয়ে ওঠে ছদ্মদেশপ্রেমী। তার সমস্ত প্রেম জমা থাকে জাতীয় সংগীতের ওই ‘ল্যান্ড অব গোল্ড অ্যান্ড সিলভার’-এর জন্যে, যার দেখা শিশুরা কখনো পায় না। সম্প্রতি ডিস্টোপিয়ার কিছু ব্যক্তি, তাদের কাঙ্ক্ষিত ইউটোপিয়া রিভেরিকায়, স্বর্ণ পাচার করে ঘরবাড়ি করেছেন বলে জানা গেছে। ডিস্টোপিয়াকে নরক বানিয়ে তারা বাস করতে চান রিভেরিকার স্বর্গে। স্বর্গটির নাম রাখা হয়েছে ‘রাণী পাড়া’।

যদি ইশকুলগুলো শিশুদের কাছে সৎভাবে ব্যাখ্যা করতো যে, বিগ ব্রাদারের গানটি শুধুই গান, বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল নেই, তাহলে অঙ্কুর থেকেই তারা একটি প্রস্তুতি নিয়ে বড়ো হতো। তাদের মধ্যে ছদ্ম নয়, আসল দেশপ্রেমই জন্ম নিতো। মানুষ শৈশবেই জানতে পারতো, কী কী বাধা ও ক্ষুধা তার জন্য সামনে অপেক্ষা করছে। বাঁচার জন্য কী কী কৌশল ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে, তা শিশুকালেই অনুধাবন করতে পারতো। এতে উৎপাদন বাড়তো, অলস ও অকর্মণ্য জনসংখ্যা কমতো, এবং হ্রাস পেতো অপরাধ ও দুর্নীতি।

জাতীয় সংগীত একপ্রকার কাল্পনিক আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তাও সৃষ্টি করে। ফলে উস্কে ওঠে অস্ত্র প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার মর্মে থাকে- কে কতো ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র বানাতে পারে, তা। এ প্রক্রিয়ায় নরখুনের বিস্তৃতি ও স্বাভাবিকীকরণ ঘটে। কার কাছে কী অস্ত্র আছে, এটি দিয়ে নির্ধারিত হতে শুরু করে রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব। উদ্ভাবিত হতে থাকে নানা অপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তি। এমন অনেক দেশ আছে, যাদের অন্য রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই, বা আক্রান্ত হলেও ধ্বংস হয়ে যাবে দশ মিনিটেই; কিন্তু তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয়- কৃষি, শিক্ষা, গবেষণা, ও স্বাস্থ্য খাত থেকে বহুগুণ বেশি।

আমার প্রস্তাব হলো, ইশকুলে যদি শিশুদের কোনো গান বা সংগীত গাইতেই হয়, তাহলে সেটিকে স্বতঃস্ফূর্ত হলে ভালো হয়। রোজ রোজ গানটি গাইতে তাদের বাধ্য করা যাবে না। জাতীয়তাবাদী চেতনার বদলে গানটিতে কী কী সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, তা প্রকাশেই অধিক মনোযোগ দিতে হবে। গানে সৌন্দর্যের বর্ণনা থাকলে, সে-বর্ণনা যেন সৎ হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সৌন্দর্যের অসৎ বর্ণনা শিশুদের সামনে উপস্থাপন করা ঠিক নয়। গানটি যদি রূপকথা হয়, তাহলে সেটি যে রূপকথা, এ ব্যাপারটি শিশুদেরকে ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে। অন্যথায় তারা রূপকথাকেই বিবেচনা করবে বাস্তবতা। কোনো নির্দিষ্ট দেশ নয়, শিশুরা যেন পৃথিবীকে ভালোবাসতে শেখে, এ ব্যাপারে জোর দিতে হবে। যার মাঝে পৃথিবীপ্রেম আছে, দেশপ্রেম তার ভেতর এমনিতেই থাকে। দেশপ্রেম যখন পৃথিবীপ্রেমের অংশ হয়, তখন সেটির স্বাস্থ্যও থাকে ভালো; এবং এ স্বাস্থ্য ধ্বংসাত্মক নয়, সৃষ্টিশীল।

শিক্ষা দেশপ্রেমের যে-রূপটির সাথে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেয়, তা প্রাকৃতিক নয়। এটি দেশপ্রেমের কৃত্রিম রাজনীতিক রূপ, যা দীর্ঘদিন ধরে বিকৃত ও বিবর্তিত হয়ে আকার ধারণ করেছে পবিত্র বিশ্বাসের। এর শুরু খ্রিস্টানদের চার্চে। খ্রিস্টান মোল্লাদের চাওয়া ছিলো, চার্চের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করাই হবে একজন মানুষের প্রধান কাজ। কিন্তু রাজারা এতে বাগড়া বাধালেন। তারা বললেন, চার্চ বা উম্মাহর প্রতি নয়, রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করাই হবে নাগরিকদের প্রধান কাজ।

আধুনিক শিক্ষা রাজাদের এ আশা অনেকাংশেই পূরণ করেছে। পৃথিবীতে যে-যুদ্ধবাহিনীগুলো আছে, তাদের প্রধান স্লোগান এখন- প্ৰাণ দেবো, কিন্তু দেশের মান হারাতে দেবো না। ওয়াশিংটন ডিসিতে যে ভিয়েতনাম ভেটেরান মেমোরিয়ালটি আছে, সেখানে এরকম ৫৮৩২০ জন দেশপ্রেমিক মৃত যোদ্ধার নাম লেখা আছে, যাদের সকলেই ইশকুলে দেশপ্রেম ব্যাপারটির সাথে পরিচিত হয়েছিলেন, এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন।

ভিয়েতনামে তাদের যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। ভিয়েতনামের সাথে আমেরিকার কোনো যুদ্ধও ছিলো না। কিন্তু দেশপ্রেম তাদেরকে ঠেলে দিয়েছিলো ভিয়েতনামের দিকে। ওখানে গিয়ে তারা অস্ত্র ধরেছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনামের খুনিদের পক্ষে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো, উত্তর ভিয়েতনামের হাতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পরাজয় ঠেকানো। এ লক্ষ্যের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি ছিলো না। কেনেডি, নিন, লিন্ডন জনসন— সবাই শুধু অন্ধভাবে আমেরিকার পতাকা বা ঔদ্ধত্যের পক্ষ নিয়েছিলেন, এবং ঢেকে দিয়েছিলেন পুরো এলাকাটিকে বারুদে। কেনেডিকে অনেকেই খুব ভালো প্রেসিডেন্ট ভাবেন, কারণ তারা তার প্রকৃত চরিত্রটি জানেন না। কেনেডির হাতে লেগে আছে যে-বিপুল পরিমাণ রক্ত, তা কোনো বালতিতে নিলে তার প্রতি শ্রদ্ধা দ্রুতই কমে আসবে!

শিক্ষা যে-উপায়ে শিশুদেরকে দেশপ্রেম শেখায়, তা বেশ শঠতাপূর্ণ। এতে দেশপ্রেমের প্রকৃত রূপটি তাদের কাছে উন্মোচিত হয় না। দেশপ্রেমের আড়ালে অহংকার ও জাতিবিদ্বেষই বেশি শেখানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় নিজ দেশের মৃত নেতাদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন কেউ বুঝতে না পারে যে তাঁরা রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন। মৃত দেবতাদের কোনো সমালোচনা শিশুদেরকে পড়তে দেওয়া হয় না (দেবতাদের আবার সমালোচনা কী?)। চীনের কোনো শিশুর পক্ষে মাও জেদুংয়ের প্রকৃত চরিত্র জানা অসম্ভব। তারা পড়বে শুধু মাও জেদুংয়ের প্রশংসা।

এখানে একটি ব্যাপার খুব লক্ষণীয়। শিশুদেরকে খুব কৌশলে বলে দেওয়া হয় যে, তোমাদেরকে অনুসরণ করতে অমুককে, কিন্তু কিছুতেই অমুককে ছাড়িয়ে যাওয়া যাবে না। যেকোনো উপায়ে থাকতে হবে অমুকের চেয়ে ছোটো। কিছুদিন আগে চাঁদের দেশে এক সরকারি কর্মচারীকে এ নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিলো। তিনি ছিলেন একটি অঞ্চলের নির্বাহী প্রধান, এবং আয়োজন করেছিলেন বার্ষিক ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলো ইশকুলের ছোটো ছোটো শিশুরা। প্রতিযোগীরা একজন মহান নেতার ছবি এঁকে জমা দিয়েছিলো আয়োজনকারীর কাছে। কয়েকটি ছবি বাছাই করে ভদ্রলোক পুরস্কার ঘোষণা করলেন, এবং ডেকে আনলেন নিজের জন্য বিপদ। কিছু উন্মাদ দাবি করলো- শিশুরা আমাদের মহান নেতার ছবি বিকৃত করেছে! সম্ভবত এরা ভেবেছিলো, শিশুরা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। তাদের হাত ফটোকপি মেশিন।

আমি বিভিন্ন দেশের শিশুকবিতা, যেগুলোকে আমরা ছড়া বলি, বিশ্লেষণ করে দেখেছি— দেশপ্রেমের নামে এগুলোতে দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করাকেই বেশি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সুকুমার বড়ুয়া লিখেছেন:

“ধন্য সবাই ধন্য
অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করে
মাতৃভূমির জন্য

ধরল যারা জীবন বাজি
হলেন যারা শহীদ গাজি
লোভের টানে হয় নি যারা
ভিনদেশিদের পণ্য”

ছড়াটিতে যুদ্ধে ভিনদেশিদের খুন করা, এবং খুন করতে গিয়ে নিজে খুন হওয়ার গুণগান গাওয়া হয়েছে। অনেকে বলতে পারেন, স্তবকগুলোতে মানুষকে নিজ দেশ রক্ষা করার তাগিদে অস্ত্র ধরার কথা বলা হয়েছে; অন্য কিছু নয়। তাদেরকে জানাতে চাই, আগ্রাসন চালানোর সময় আগ্রাসী রাষ্ট্রগুলোও এমনটিই বলে থাকে। ইসরায়েল প্রতিবার ফিলিস্তিনে হামলা করে এসে বলে, আমরা আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই হামলা চালিয়েছি। বারাক ওবামা তাঁর এক বক্তব্যে (সম্ভবত ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কোনো অনুষ্ঠানে) দাবি করেছিলেন, শুধু সেলফ ডিফেন্স বা আত্মরক্ষার অধিকারই নয়, আমেরিকার প্রি-এম্পটিভ সেলফ ডিফেন্স বা আগাম আত্মরক্ষার অধিকারও আছে। ‘প্রি-এম্পটিভ সেলফ ডিফেন্স’ অত্যন্ত বিপজ্জনক ধারণা। ইরাকে আগ্রাসন চালানোর সময় প্রেসিডেন্ট বুশও এ ধারণাটিকে যুক্তি হিশেবে ব্যবহার করেছিলেন। চাইলেই এ ধারণার আওতায় সবল রাষ্ট্রগুলো দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, এবং দখল করে নিতে পারে ভূভাগ ও সম্পদ।

হুইটম্যান তাঁর ‘আমেরিকা’ কবিতায় লিখেছিলেন:

Centre of equal daughters, equal sons,
All, all alike endear’d, grown, ungrown, young or old,
Strong, ample, fair, enduring, capable, rich,
Perennial with the Earth, with Freedom, Law and Love,
A grand, sane, towering, seated Mother,
Chair’din the adamant of Time.

এখানে আমেরিকার যে-বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা অতিরঞ্জন নয়, কিন্তু ‘Chair’d in the adamant of Time’ পঙক্তিটি যদি পড়ি, তাহলে আমেরিকা রাষ্ট্রটির অহমিকার দিকটিই বেশি নজরে পড়ে। শিক্ষা খুব কৌশলে নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রীয় অহমিকা রক্ষা করতে বলে।

আমি গ্রামের মানুষদের সাথে, শিক্ষার সাথে যাদের খুব বেশি পরিচয় ঘটেনি, বা ঘটলেও এতো আগে ঘটেছে যে ওই সাক্ষাৎ তারা ভুলে গিয়েছে, কথা বলে দেখেছি যে, ‘দেশপ্রেম’ ধারণাটির সাথে তারা পরিচিত নন। বাংলা ‘দেশপ্রেম’ ও ইংরেজি ‘প্যাট্রিওটিজম’- দুটি শব্দই তাদের কাছে অচেনা ও অর্থহীন। দেশ ও দেশের পরিচালকদের প্রতি তারা কোনো প্রেম অনুভব করেন না। তাদের সকল প্রেম ঘর, গ্রাম, পরিবার, স্বজন, ধর্ম, ও চাষের জমি নিয়ে। এ পাঁচটি ব্যাপারে তারা আধুনিক সেনাবাহিনীগুলোর মতোই প্রাণ দিতে প্রস্তত। ঢাকায় কারও গায়ে হাত তুলে আমি হয়তো নির্বিঘ্নে প্রস্থান করতে পারবো, কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো গ্রামে এটি সম্ভব নয়।

শিক্ষা দেশপ্রেম ধারণাটিকে শিশুদের সামনে ধর্মের আকারে উপস্থাপন করে। ধর্মে যেমন শুধু বিশ্বাস করলেই চলে, দেশপ্রেমেও ঠিক তাই। দুটি ডগমাই বিশ্বাস-নির্ভর। ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো প্যাট্রিয়োটিক বিশ্বাসেরও লাভজনক প্রতিক্রিয়া আছে, যার ফসল ভোগ করেন রাজারা। তবে রাজা ভালো হলে এ ফসল প্রজারাও ভোগ করেন। যেমন, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ফসল বহুলাংশেই প্রজারা ভোগ করছেন।

দেশপ্রেম একটি কৌশল, যার মাধ্যমে রাজা ভাগ বসাতে পারেন প্রজার সম্পত্তিতে। পাড়ার ক্লাবের মতো রাজ্য চালাতেও অর্থ লাগে, এ বার্তাটি শিক্ষা, দেশপ্রেমের মাধ্যমে প্রজাদের জানিয়ে দেয়। সংঘের ভাষায় যা বার্ষিক চাঁদা, রাজার ভাষায় তা আয়কর, ভ্যাট, ও আমদানি শুল্ক। শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের মূলে রয়েছে প্রজাদের কাছ থেকে এই অর্থ আহরণ।

রাজার চোখে শিক্ষিত মানুষের গুরুত্ব আর অশিক্ষিত মানুষের গুরুত্ব সমান নয়। শিক্ষিত মানুষকে রাজা ‘নাগরিক’ ভাবেন, আর অশিক্ষিত মানুষকে ভাবেন কেবল ‘মানুষ’। মানুষ ও নাগরিক এক জিনিস নয়। নাগরিক হলেন তারা, যারা শিক্ষার মাধ্যমে রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু মানুষ জংলি ও স্বাধীন, যার ওপর রাষ্ট্রের কার্যত কোনো কর্তৃত্ব নেই (বলপ্রয়োগ বা গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ছাড়া)। বাংলাদেশ, মালি, নাইজেরিয়া, ভারত ও লাইবেরিয়ার গ্রামগুলোতে এরকম মানুষের অস্তিত্ব আছে। এ মানুষজন প্রধানমন্ত্রী, প্রাইম মিনিস্টার, রাষ্ট্রপতি, কিং, প্রেসিডেন্ট, অর্থমন্ত্রী, সাংসদ, সেক্রেটারি, সচিব, কংগ্রেসম্যান, বিধায়ক, সিনেটর- এ শব্দগুলোর সাথে পরিচিত নন। শব্দগুলোর ক্ষমতা সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা নেই। এ ক্ষমতাবান পদগুলো, আর পদগুলোতে আসীন ব্যক্তিগুলো, অ্যানার্কিক মানুষদের কাছে মূল্যহীন।

বাংলাদেশ হয়তো একদিন আমার লেখা পাঠ্যবইয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে শিশুদেরকে তা পড়তে বলতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রটি চাইবে না শিশুরা আমার মতো লেখালেখি করুক। কারণ এতে তার কোনো নগদ প্রাপ্তি নেই। তার চোখে আমার চেয়ে হাকিমপুরী জর্দার মালিকের গুরুত্ব বেশি (যদিও আমি মানুষের ফুসফুস উন্নত করছি, আর হাকিমপুরী ধ্বংস করছেন)। যেকোনো রাজ্যে রাজাদের প্রধান চাওয়া- শিশুরা যেন বড়ো হয়ে হাকিমপুরী জর্দার মালিকের মতো কর পরিশোধ করে, এবং না পারলে, তারা যেন রাজার হয়ে অন্যদের কাছ থেকে কিছু কর আদায় করে। কর আদায়ে রাজারা বইপত্রকেও ছাড় দেয় না। সম্প্রতি লন্ডন থেকে এক লেখকের দুই কার্টন বই (পুরাতন, ব্যক্তিগত পড়ার বই) আফ্রিকার একটি দেশে ঢুকতে চেয়েছিলো। কিন্তু বিনা বাধায় ঢুকতে পারে নি। কর আদায়কারীরা সেগুলো আটকে দিয়েছিলো। তাদের দাবি, কর দিয়েই বই খালাস করতে হবে। ওই লেখকের সাথে এর আগেও এমনটি ঘটেছে, এবং কর পরিশোধ করেই তাকে বই খালাস করতে হয়েছে। সম্ভবত বইপত্রের ওপর আফ্রিকান রাজারা খুব নাখোশ। তাদের চাওয়া, প্রজারা যেন সারাক্ষণ বিদেশ থেকে সাবান, শ্যাম্পু, স্লোয়ের ডিব্বা, মদের বোতল, আতরের শিশি, সেন্টের ক্যান, টেলিভিশন, পেট কমানোর বেল্ট, আর রেঞ্জ রোভার গাড়ি আমদানি করে। বিদেশ থেকে কেউ বই এনে পড়বে- এটি তারা কল্পনাও করতে পারে না।

সেদিক থেকে নাগরিকদের আমি দুই শ্রেণীতে ভাগ করতে চাই। এক শ্রেণীর কাজ কর দেয়া, আরেক শ্রেণীর কাজ কর আদায় করা। শিক্ষা এই দুই শ্রেণীকেই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগ কোনো-না- কোনো উপায়ে কর আদায়ের সাথে যুক্ত। এ প্রসঙ্গে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর কথা একটু উল্লেখ করতে চাই। অনেকে মনে করেন, মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতালের সাথে তো কর আদায়ের কোনো সম্পর্ক নেই; এখানে চিকিৎসার মতো একটি মহৎ কর্ম সম্পাদিত হচ্ছে। কিন্তু আমি বলবো, আপনার চিকিৎসার জন্য নয়, রাজারা মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছেন তাদের করদাতা ও কর আদায়কারী নাগরিকদের বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে।

একজন শিক্ষিত করদাতা নাগরিক রাজার কাছে দুধাল গাভীর মতো গাভী মারা গেলে রাজাকেও মরে যেতে হয়। এ জন্য যেকোনো মূল্যে রাজা তার দুধাল গাভীদের বাঁচিয়ে রাখতে চান। চিকিৎসকদের এতো প্রশংসা করা হয় কেন? কারণ রাজারা সব পারেন, শুধু চিকিৎসার কাজটি পারেন না। জ্বর হলেই রাজাকে ছুটে যেতে হয় ডাক্তারের কাছে। সামান্য অসুখেই তুচ্ছ হয়ে উঠতে পারে রাজসিংহাসন। এ জন্য রাষ্ট্র কিছু মানুষকে ভুলিয়ে- ভালিয়ে মেডিক্যাল কলেজে পাঠায়, যারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন চিকিৎসাবিদ্যায়। রাজারা যে তাদের শুধু মিথ্যা প্রশংসাই করেন, তার প্রমাণ দেখতে আমরা তাকাতে পারি ‘কালেক্টর জেনারেল’ ও ‘চিফ সার্জন’- এ দুটি পদের দিকে। দুজনই আফ্রিকার একটি রাষ্ট্রের জন্য কর আহরণ করে থাকেন। প্রথম জন কাজটি করেন সরাসরি, কিন্তু দ্বিতীয়জন কাজটি করেন পরোক্ষভাবে- করদাতা ও কর আদায়কারীর জীবন বাঁচিয়ে। ‘কালেক্টর জেনারেল’ হলেন দেশটির প্রশাসনিক পুলিশিংয়ের অংশ, ‘চিফ সার্জন’ হলেন নাগরিকদের অসুখ পুলিশিংয়ের অংশ। তবে কালেক্টর জেনারেল যাপন করেন বিলাসবহুল গুরুত্বপূর্ণ জীবন, আর চিফ সার্জন, যিনি একজন ডাক্তার, যাপন করেন অবহেলাময় অগুরুত্বপূর্ণ জীবন।

কোনো কোনো এলাকায় শিক্ষা শিশুদেরকে যে-প্রক্রিয়ায় শিক্ষিত করে, তার সাথে মিল আছে কুরবানি ও পাঁঠাবলির। বলি দেয়ার সময় আমরা যেমন পশুর মতামত নিই না, শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার সময়ও রাষ্ট্র শিশুদের কোনো মতামত নেয় না। যাদের জন্য শিক্ষানীতি, তাদের কোনো কণ্ঠস্বরই এ নীতিতে প্রতিফলিত হয় না। নীতিগুলো যারা প্রণয়ন করেন, তাদের ধারণা, শিশুরাও তাদের মতোই ধাড়ি বুড়ো মানুষ। পশুবলিতে বলিদাতার ইচ্ছাই সব, শিক্ষানীতি প্রণয়নেও রাজার ইচ্ছাই সব। রাজা এ কাজে ভাড়া করেন কিছু বুড়ো শয়তানকে, যারা কবরে যাওয়ার আগে অভিনয় করেন জল্লাদের চরিত্রে।

জল্লাদেরা মাস ও বছরব্যাপী পরিকল্পনা করেন, কীভাবে শিশুদেরকে পিছমোড়া করে বেঁধে, ইশকুলে পাঠিয়ে, নির্বিঘ্নে বলি দেওয়া যায় শিক্ষার মন্দিরে। শিশুরা কী চায় ও কী চায় না, কী ভালোবাসে ও কী ভালোবাসে না, কী ঘৃণা করে ও কী পূজো করে- এ খবর জল্লাদেরা রাখেন না। রাখার কোনো প্রয়োজনও বোধ করেন না। শিশুদের হয়তো ক্ষমতা আছে বছরে তিনটি বই পড়ার, কিন্তু বুড়োরা কুড়াল হাতে নিয়ে বলে- তোমাদেরকে পড়তে হবে বারোটি বই! কোনো শিশুর পক্ষে কি সম্ভব বারোটি বইকে ভালোবাসা? সম্ভব নয়। ইশকুলগুলো বুড়োদের প্রেসক্রিপশনে শিশুদেরকে এ অসম্ভব কাজটিই প্রতিদিন করতে বলে।

শিশুদেরকে কোনো প্রশ্নও করতে দেয়া হয় না। কোনো শিশু কৌতূহলী হয়ে উঠলে শিক্ষক তাকে সর্বশক্তি দিয়ে নিবৃত্ত করেন, এবং এ কাজে মগজের কোনো শক্তি তিনি ব্যবহার করেন না। শিশুদেরকে হাঁটতে হয় রাজার নির্দেশিত পথে। পুরোনো ভাঙা পথ ছাড়া ইশকুলে একটি শিশুর সামনে আর কোনো পথ থাকে না। নতুন প্রস্থান, নতুন দিগন্ত, নতুন চিন্তার বন তাদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়। যে-আকাশের নিচে তারা বেড়ে ওঠে, তা তাদের স্বপ্নের আকাশ নয়। যে-স্বপ্নকে তারা অনুসরণ করে, তা তাদের নিজস্ব স্বপ্ন নয়। রাষ্ট্রের স্বপ্ন, সমাজের স্বপ্ন, বাবা-মা’র স্বপ্ন, ধর্মের স্বপ্ন- এরকম হাজারো অন্যের স্বপ্ন শিশুদের ঘাড়ে ভূতের মতো বসে থাকে। মৃত্যু ছাড়া এ ভূতের কবল থেকে শিশুদেরকে আর কেউ মুক্তি দিতে পারে না।

নারী ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে অনেককেই কথা বলতে দেখি, কিন্তু শিশুদের অধিকার নিয়ে কাউকে কথা বলতে দেখি না। এর কারণ, শিশুরা লিখতে জানে না। শিশুদের হাতে কোনো মাইক নেই। কোনো পত্রিকা ও টেলিভিশনের মালিক শিশু— এরকমটি শোনা যায় না। রাষ্ট্র যারা চালায়, তারা মনে করে- শিশুদের কোনো অধিকারই নেই। শিশুদের আবার অধিকার কী? তাদের ধারণা, শিশুরা অবুঝ। শিশুর কণ্ঠ পাগলের কণ্ঠ। পাগলদের রাখতে হবে খোঁয়াড়ে, রেখে রেখে করে তুলতে হবে সুস্থ। রাষ্ট্র যেহেতু বুড়োরা চালাচ্ছে, তাই রাষ্ট্র ভাবে, একমাত্র বুড়োরাই সুস্থ। বাকিরা অসুস্থ।

বুড়োরা এই খোঁয়াড়ের নামই রেখেছে ইশকুল। ইশকুল একপ্রকার বিনিয়োগ। চাইলে এটিকে আমি কল-কারখানার সাথে তুলনা করতে পারি, যেরকম ‘জিপিএ ফাইভ ও জুতোর ফ্যাক্টোরি’ প্রবন্ধে ইতোমধ্যে দেখিয়েছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে জুতোর ফ্যাক্টোরির কী চমৎকার সাদৃশ্য রয়েছে।

রাজার চোখে শিশুরা মূলত ভবিষ্যতের খাজনাদাতা, বা খাজনা আদায়কারী। এ জন্য বদরাষ্ট্রসমূহে শিক্ষানীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যেন শিশুদের পেছনে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বিফলে না যায়। শিশুদের মাথায় এমনভাবে বই, পরীক্ষা ও আদেশ-নিষেধ চাপানো হয়, যেন তারা আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকাতে না পারে।

মানুষের মস্তিষ্কের অবারিত বিকাশ শিক্ষার লক্ষ্য নয়। শিক্ষার লক্ষ্য হলো, আমাদের বুদ্ধি বিকাশের পথগুলো সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া। এথেন্সের ইশকুলগুলোতে শিশুদের প্রধান কাজ ছিলো হোমারের পুঁথি মুখস্থ করা। এর কারণ কী? পিথাগোরাসের চেয়ে হোমার কেন মুখ্য হয়ে উঠেছিলেন?

এর কারণ, আমার মনে হয়েছে, এথেন্সের সাথে স্পার্টা ও অন্যান্য শহরের যুদ্ধবিগ্রহ। এথেন্সের শাসকরা তাদের শিক্ষানীতি তৈরি করেছিলেন যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে। একজন এথেনীয়কে যুদ্ধের জন্য প্রস্তত করাই ছিলো তাদের মূল লক্ষ্য। তবে যুদ্ধে শুধু অংশগ্রহণ করলে চলবে না, প্রয়োজনে হাসতে হাসতে জীবন দিতে হবে- এমন রটনা প্রচার করাও ছিলো শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। হোমারের ইলিয়াডে অ্যাকিলিস ও হেক্টরের যে-বীরত্ব রচিত হয়েছে, তা পড়ে যেকোনো শিশুরই যুদ্ধে প্রাণ দিতে আগ্রহ জাগার কথা। এ প্রাণ দেয়ার ব্যাপারটিকেই এথেনীয়রা শিক্ষার মাধ্যমে মহিমান্বিত করেছিলো।

ইলিয়াডের মাধ্যমে শিশুদের তারা জানিয়ে দিয়েছিলো- জীবিত প্রাণের চেয়ে মৃত প্রাণ বেশি আরাধ্য। জীবিত অ্যাকিলিসের চেয়ে মৃত অ্যাকিলিসই অধিক সম্মানের। এথেনীয়দের এ ধারণা পরবর্তীতে ধার করেছিলো বিভিন্ন ধর্মের জঙ্গিরা।

শিশুরা কৌতূহলী। কিন্তু খুব কম রাষ্ট্রই পারে শিশুদের এ কৌতূহল জ্ঞানযোগে নিবৃত্ত করতে। বহু রাষ্ট্রেই শিশুদের কৌতূহলকে জ্ঞানযোগে নিবারণ না করে দমন করা হয় বলপূর্বক। ভারতে যদি কোনো শিশু গরুভক্তি নিয়ে কৌতূহল দেখায়, তাহলে নিজের জন্য সে ডেকে আনতে পারে মর্মান্তিক পরিণতি। বাংলাদেশী শিশুরা ইসলামী কোনো প্রথাকে সন্দেহের চোখে দেখবে, এমনটি ভাবাও যায় না। প্রতিষ্ঠিত কোনো সামাজিক মতামতকে উপেক্ষা করার সাধ্য তাদের নেই। সমাজ ও রাষ্ট্র যখন কোনো শিশুর কৌতূহল নির্দিষ্ট করে দেয়, তখন শিশুটির আচরণে বিকৃতি আসতে বাধ্য। তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে মারাত্মকভাবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত- শিশুদের এ কৌতূহলকে জ্ঞানযোগে শাণিত করা, এবং না পারলে, কৌতূহলগুলোকে আরো উস্কে দেয়া। কারও জিজ্ঞাসু মনকে ভয় ও লাঠিযোগে দমন করা ঠিক নয়।

ইশকুলগুলো পাঠদানে শিশুদের এ কৌতূহলকে কাজে লাগাতে পারতো চমৎকারভাবে; যদি রাষ্ট্রগুলো তাদের শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় এ ব্যাপারটি মাথায় রাখতো। কিন্তু তারা তা করবে না। তাদের আশঙ্কা, শিশুরা কৌতূহলী হয়ে উঠলে, বড়ো হয়ে রাষ্ট্রের নানা বিষয় নিয়েও তারা মাথা ঘামানো শুরু করবে। এটি রাষ্ট্র যারা চালায়, তাদের জন্য আত্মঘাতী ও বিপর্যয়কর। এ জন্য বদরাষ্ট্রগুলো, শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের ভার এমন সব মানুষদের হাতে দেয়, যারা নিজেরাই কৌতূহলী নন।

সভ্যতার দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো, যে-দেশগুলো শিশুদের পরিচর্যা ঠিকমতো করেছে, কেবল সে-দেশগুলোই এগিয়ে গেছে ভবিষ্যতের দিকে। কারণ তারা জানে, রাষ্ট্র একদিন শিশুরাই চালাবে। সুতরাং শিশুদের সাথে লুকোচুরি খেলে লাভ নেই। বুড়োরা বর্তমানের মালিক, কিন্তু ভবিষ্যতের মালিক শিশুরা- এ সত্য তারা অনুধাবন করতে পেরেছে। এ জন্য শিক্ষাকে শিশুদের সামনে বিষের বোতলের মতো উপস্থাপন না করে, করেছে উপাদেয় খাদ্য হিশেবে। শিশুরা এ খাদ্য খেয়ে পুষ্ট হয়েছে, যার ফলাফল ভোগ করছে রাষ্ট্র ও তার জনগণ

কিন্তু আমরা কি শিশুদেরকে দিতে পারছি এমন উপাদেয় খাবার? পাঠ্যবইয়ের কথাই ধরা যাক। এই মুহূর্তে ইশকুল ও মাদ্রাসায় যে-বইগুলো পড়ানো হচ্ছে, সেগুলো কতোখানি বই? এ খাবারগুলো তৈরিতে পর্যাপ্ত যত্ন নেয়া হয়েছিলো কি না? উদাহরণ হিশেবে ‘বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’-এর কথা এখানে বলতে চাই। তারা পঞ্চম শ্রেণীর ‘আমার বাংলা বই’ নামক খাদ্যটির ‘প্রসঙ্গ কথা’-য় লিখেছেন:

“শিশু এক অপার বিস্ময়। তার সেই বিস্ময়ের জগৎ নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, শিশুবিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানীসহ অসংখ্য বিজ্ঞজন শিশুকে নিয়ে ভেবেছেন, ভাবছেন। তাঁদের সেই ভাবনার আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ নির্ধারিত হয় শিশু-শিক্ষার মৌল আদর্শ। শিশুর অপার বিস্ময়বোধ, অসীম কৌতূহল, অফুরন্ত আনন্দ ও উদ্যমের মতো মানবিক বৃত্তির সুষ্ঠু বিকাশ সাধনের সেই মৌল পটভূমিতে পরিমার্জিত হয় প্রাথমিক শিক্ষাক্রম। ২০১১ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুনঃনির্ধারিত হয় শিশুর সার্বিক বিকাশের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে সামনে রেখে।”

লক্ষ করুন, এরা প্রথম বাক্যে বলেছেন ‘শিশু এক অপার বিস্ময়’, অর্থাৎ শিশুটি নিজেই বিস্ময়, আবার দ্বিতীয় বাক্যে বলেছেন ‘তার সেই বিস্ময়ের জগৎ নিয়ে’, অর্থাৎ শিশুটি নিজে বিস্ময় নয়, তার আলাদা একটি বিস্ময়ের জগৎ আছে। দ্বিতীয় বাক্যটি আমলে নিলে প্রথম বাক্যটি নিরর্থক হয়ে যায়, আবার প্রথম বাক্যটিকে আমলে নিলে দ্বিতীয় বাক্যটি নিরর্থক হয়ে পড়ে। আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক পড়াশোনা জানা মানুষ, অথচ আমি নিজেই তাদের এই দুই বাক্যের অর্থ উদ্ধার করতে পারছি না। পঞ্চম শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা কী উদ্ধার করবে? কাণ্ডারিরা পরস্পরবিরোধী দুটি বক্তব্য নিরর্থক ও ব্যর্থভাবে দুটি বাক্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, এবং শিশুদের জন্য তাদের ভালোবাসার পরিচয় প্রকাশ করেছেন।

চতুর্থ বাক্যে তারা বলেছেন ‘তাদের সেই ভাবনার আলোকে…’। এই ‘তাদের’ পরিচয় দিতে গিয়ে এর আগের বাক্যে বলা হয়েছে ‘শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, শিশুবিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানীসহ অসংখ্য বিজ্ঞজন…’। বোর্ড এ বিজ্ঞজনদের নাম প্রকাশ করেনি, কিন্তু বইটি পড়ে ‘তাদের’ উচ্চতা সম্পর্কে আমি কিছুটা ধারণা পেয়েছি। এ দেশে যে কাণ্ডারিগণ এতো এতো ডক্টর আর্নোল্ড, মন্টেসোরি, কান্ট, রুশো, ও রাসেল খুঁজে পেয়েছেন, এবং ‘তাঁদের ভাবনার আলোকে’ বই ছাপিয়েছেন, তা জেনে শিশুরা বিস্মিত হয়েছে কি না জানি না, তবে আমি খুব বিস্মিত হয়েছি।

একই বাক্যে তারা বলেছেন, ‘… জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ নির্ধারিত হয় শিশু-শিক্ষার মৌল আদর্শ’।

শিশুরা কী শিখবে ও কী শিখবে না, তার ‘মৌল আদর্শ” নির্ধারিত হয়ে গেছে? বোর্ডের কর্তারা আমাদের জানাননি— কী সেই মৌল আদর্শ, আর ওই মৌল আদর্শের মৌল ভিত্তিই বা কী! তবে তারা না জানালেও, ওই মৌল আদর্শ যে কী, তা বাংলাদেশের বর্তমান গতিবিধি হিশেব করে সহজেই অনুমান করতে পারি।

‘প্রসঙ্গ-কথা’র পঞ্চম বাক্যটি নিয়ে এখানে আলোচনা করতে চাই না। ওই বাক্যে যে-শব্দগুলি তারা ব্যবহার করেছেন, তা আলোচনা করতে গেলে আমাকে খাদে নামতে হবে। কিন্তু আমি থাকতে চাই খাদের পাড়ে। এ জন্য চলে যাচ্ছি ষষ্ঠ বাক্যটিতে। এ বাক্যে তারা বলেছেন, ‘২০১১ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুনঃনির্ধারিত হয় শিশুর সার্বিক বিকাশের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে সামনে রেখে’

২০১১ সালের আগে তাহলে ‘শিশুর সার্বিক বিকাশের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে সামনে রেখে শিক্ষাক্রম পরিচালিত হয়নি? আমি যখন ইশকুলে ছিলাম, তখন কি রাষ্ট্র ও এনসিটিবি আমার সার্বিক বিকাশের ব্যাপারে মনোযোগী ছিলো না? সার্বিক বিকাশ কী? কী কী করলে ও পড়লে সাধিত হয় একটি শিশুর সার্বিক বিকাশ? সার্বিক বিকাশের জন্য একটি শিশুকে আর কতোটি দোজখ পাড়ি দিতে হবে, তা স্পষ্ট করা উচিত ছিলো।

অবশ্য ভদ্রলোকদের যে-প্রতিভার পরিচয় ‘প্রসঙ্গ কথা’-টিতে পেয়েছি, তা নজিরবিহীন। মহোদয়গণ এক জায়গায় লিখেছেন :

“বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। শিক্ষার সকল ক্ষেত্রে বাংলা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে….এদিক থেকে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষায় শোনা, বলা, পড়া ও লেখার দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য।”

বাংলা ভাষার এতো গুণগান গাওয়া বোর্ড, ওই ‘প্রসঙ্গ কথায় লেখকের নাম লেখার সময় লিখেছেন:

“প্রফেসর অমুক”!

‘প্রফেসর’ বুঝি খুব বাংলা শব্দ!

অবাক করা বিষয়- বোর্ড কর্তৃপক্ষ একই ‘প্রসঙ্গ কথা’ হুবহু এক রেখে প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইয়েও ছাপিয়ে দিয়েছেন! যে-কথা তারা পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদেরকে বলছেন, সে-একই কথা, কোনো শব্দ না পাল্টিয়ে প্রথম শ্রেণীর শিশুদেরকেও বলছেন! এ কী করে সম্ভব? আরো অবাক করা বিষয়- বাংলা বইয়ের ‘প্রসঙ্গ কথা’ আর গণিত বইয়ের ‘প্রসঙ্গ কথা’ একই, শুধু মাঝখানের কয়েকটি বাক্য পরিবর্তন করা হয়েছে! এখানেই শেষ নয়, একই ‘প্রসঙ্গ কথা’ তারা মাদ্রাসার ইবতেদায়ি শ্রেণীর বইয়েও ঢুকিয়ে দিয়েছেন (হুবহু)! সম্ভবত শিশুদের জন্য এরা একটি কুমিরের রচনা লিখে রেখেছিলেন, এবং সুযোগ পেয়ে সব বইয়ে সাঁটিয়ে দিয়েছেন (কুমিরের রচনাও এর চেয়ে উৎকৃষ্ট হয়)। এগুলো প্রমাণ করে, আমরা শিশুদের দায়িত্ব যাদের কাঁধে দিয়ে রেখেছি, তারা মোটেও ‘শিশু’ বিষয়টিকে বুঝেন না। শিশুদের পাঠ্য বইয়ে একটি ভালো মানের ‘প্রসঙ্গ কথা’ ছাপানোর সামর্থ্যও তাদের নেই। বাংলা বইয়ের ‘প্রসঙ্গ কথা’ যে বিজ্ঞানের বইয়ে প্রাসঙ্গিক নয়, এ সাধারণ বোধটুকুও উনাদের নেই। সম্ভবত মহোদয়গণের উদ্দেশ্য কেবল বই ছাপানো। কারণ এতে ব্যবসা আছে।

‘প্রসঙ্গ কথা’র ব্যাপারটি উল্লেখ করেছি মূলত ভাতের হাঁড়ির একটি ভাতে টিপ দেওয়ার জন্য। আমার দুর্ভাগ্য কি না জানি না, প্রথম ভাতটিই ভালো পড়েনি। এ ভাত আমি শিশুদের খাওয়াতে রাজি নই। বাংলাদেশ যদি ভবিষ্যৎ নিয়ে সামান্যও উদ্বিগ্ন থাকতো, তাহলে এ অভক্ষণযোগ্য ভাত শিশুদের সামনে দিতো না, আর আমাকেও এ লেখাটি লিখতে হতো না। ত্রাতাগণ শিশুদের কতোটা অবহেলা করেছেন, সে প্রমাণ বইয়ের প্রচ্ছদেও আছে। প্রচ্ছদ তৈরিতে তারা কোনো প্রচ্ছদশিল্পী ব্যবহার করেন নি, টঙ দোকানের ভিজিটিং কার্ড শিল্পী দিয়েই কাজ সেরে ফেলেছেন। প্রথম ও পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ প্রায় হুবহু এক! শুধু মাঝখানের ছবিটি ভিন্ন। বাংলাবাজারে যারা বুক-কাভার তৈরি করেন, তারা এডোব ইলাস্ট্রেটর সফটওয়্যারে এরকম নানা টেমপ্লেট বানিয়ে রাখেন, যা দিয়ে কিছু ছবি ও লেখা এদিক সেদিক করে, প্রায় বিনা পরিশ্রমে, বাণিজ্যিক নোট-গাইডের প্রচ্ছদ উৎপাদন করেন। যে-শিশুদের পেছনে জনগণ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে, রাষ্ট্র তাদের বইয়ের জন্য একটি শিল্পসম্মত প্রচ্ছদ তৈরি করতে পারলো না, এটি সমাজে কী বার্তা দেয়? আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হতে পারে, তাই আমি দুটি প্রচ্ছদ একটু তুলনা করে দেখাচ্ছি—

প্রথম শ্রেণীর বই: শিরোনাম ‘আমার বাংলা বই’।

পঞ্চম শ্রেণীর বই: শিরোনাম ‘আমার বাংলা বই’।

প্রথম শ্রেণীর বই: ডান পাশে একটি বৃত্ত, বৃত্তের ভেতরে লেখা ‘প্ৰথম শ্রেণি’।

পঞ্চম শ্রেণীর বই: ডান পাশে একটি বৃত্ত, বৃত্তের ভেতরে লেখা ‘পঞ্চম শ্রেণি’।

প্রথম শ্রেণীর বই: উপরের দিকে একটি পর্বতাকার ঢেউয়ের রেখা। পঞ্চম শ্রেণীর বই: উপরের দিকে একটি পর্বতাকার ঢেউয়ের রেখা।

(যারা গণিত জানেন, তারা সাইন-কোসাইন গ্রাফ আঁকার সময় এ ধরনের কার্ভ বা ঢেউ দেখে থাকবেন)

প্রচ্ছদে আরো একটি বিষয় নজরে পড়েছিলো, যা এখানে আলোচনা করা ঝুঁকিপূর্ণ

দুটি আলাদা শ্রেণীর বাংলা বইয়ের নাম কি ভিন্ন ভিন্ন রাখা যেতো না? যে-নাম শিশুরা প্রথম শ্রেণীতে পড়ে এসেছে, সে একই নাম পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তে কি একঘেয়ে লাগবে না? যদি প্রথম শ্রেণীর বইটির নাম রাখা হতো ‘আমার বাংলা ঘর’ আর পঞ্চম শ্রেণীর বইটির নাম রাখা হতো ‘সাহিত্যের চশমা’, তাহলে কী ঘটতো? ‘ঘর’ শব্দটি পড়ে শিশুরা ভাবতো, বই কীভাবে ঘর হয়? বাংলা ঘর তো মেহমান থাকার ঘর, এটি তো বই হওয়ার কথা নয়। শিশুটি তখন কৌতূহলী হয়ে উঠতো, এবং বইটি পড়ে একদিন বুঝতো- ঘর মানে শুধু ঘরবাড়ি নয়, ঘর মানে জগৎ। তখন ‘আমার বাংলা ঘর’-এর অর্থ সে করতো- ‘আমার বাংলা ভাষার জগৎ’। ‘সাহিত্যের চশমা’ নামটি পড়েও সে ধাক্কা খেতো। শিক্ষায় এই ধাক্কা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে-শিক্ষা চিন্তাকে ধাক্কা দিতে পারে না, সে-শিক্ষা ব্যর্থ শিক্ষা। গরুর জাবর কাটার সাথে তার কোনো পার্থক্য থাকে না। শিশুরা বইটি পেয়েই চশমার খোঁজে পাতার পর পাতা ওল্টাতো, এবং কিছুদিন পর বুঝতো, কীভাবে চারপাশের পৃথিবীকে দেখতে হয় সাহিত্যের চশমা দিয়ে।

অনেকে বলতে পারেন, প্রচ্ছদ কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু? হ্যাঁ, শিশুদের বইয়ের জন্য প্রচ্ছদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটিকে সাংসদ ও ছাত্রলীগের ধান কাটার ঘটনার সাথে মেলালে চলবে না। শিশুদের বইয়ের প্রচ্ছদ এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন শিশুরা বইটি হাতে নিয়েই চঞ্চল হয়ে ওঠে। এ চঞ্চলতা বইয়ের ভেতরটিকে ঘুরে দেখার চঞ্চলতা। বইটির বিষয়বস্ত কী, বইটি পাঠ করা কেন জরুরি, তার একটি বিমূর্ত হাতছানি প্রচ্ছদে থাকা দরকার। বই দেখে যেন কোনো শিশু বিরক্ত না হয়, একঘেয়েমির মেদ যেন তাকে কাবু না করে, এ ব্যাপারটি প্রচ্ছদের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। তবে বাংলাদেশ এ কাজে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

২.

শিক্ষার দ্বিতীয় কাজ ভয় সৃষ্টি করা। শিক্ষিত মানুষ ভীতু হয়। ভয়ের জন্ম সচেতনতা থেকে। শিক্ষা মানুষকে তার স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। রাষ্ট্র নাগরিকদেরকে নিশ্চয়তা দেয় যে, তোমার স্বার্থ রাষ্ট্র রক্ষা করবে, যদি তুমিও রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করো। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রণয়ন করে আইন। আইন শিক্ষিত মানুষদের জানিয়ে দেয়, কী কী করা যাবে ও কী কী করা যাবে না, তা। রাষ্ট্র খারাপ হলে, আইন এমনভাবে প্রণয়ন করে, যেন আইন না ভেঙে কেউ চলাফেরা করতে পারে। বদরাষ্ট্রগুলোর চাওয়া, যেকোনো সময় যেকোনো নাগরিককে যেন আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায়। এ আইনগুলোকে আমি বলি নাজি আইন, এবং নাজি আইন কোনো আইন নয়। এগুলোর খসড়া এমনভাবে তৈরি করা হয়, পড়লে মনে হবে— সবই করা যাবে, আবার কিছুই করা যাবে না। অপরাধকে এসব আইনে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। এমন এমন শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা হয়, যেন আইনটি প্রকৃত অর্থেই মাছ ধরার জাল হয়ে ওঠে।

এ জালের মাধ্যমেই রাষ্ট্র শিক্ষিত মানুষদের মনে ভয়ের সঞ্চার করে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যখন পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়েছিলো, তখন অস্ত্র হাতে যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। শিক্ষিত মানুষরা, জহির রায়হান আমাদেরকে জানিয়েছেন, বেশিরভাগই ভয়ে কলকাতা পালিয়ে গিয়েছিলো। কেউ কেউ দেশেই নানা স্থানে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। অনেকে প্রভাবশালী আমলা ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। এক অধ্যাপক ও লেখক, স্কটল্যান্ড থেকে পত্রিকায় যুদ্ধের খবর নিতেন, কিন্তু দেশে আসেননি (অবশ্য ওই সময় দেশে আসা সম্ভব ছিলো না, এবং সম্ভব হলেও তিনি আসতেন না বলেই মনে করি)। শিক্ষিত এক (ভদ্রলোক এখন মারে ছাত্র সেজেছেন), শিক্ষিত দুই (তিনি এক ভক্ত রেখে গেছেন, যিনি টেলিভিশনে ক প্রশ্নের উত্তরে খ প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন), শিক্ষিত তিন (তিনি ছিলেন মাঝারি মানের এক কবি), শিক্ষিত চার (তিনি নিহত হয়েছিলেন, কিন্তু যুদ্ধ করেননি), শিক্ষিত পাঁচ (অসুখপাঠ্য কিছু প্রবন্ধ লিখে গেছেন, যা গুরুত্বপূর্ণ তো নয়ই, বরং কাগজের অপচয়), শিক্ষিত ছয় (এই মুহূর্তে মরহুম, তবে মারা যাওয়ার আগে বাংলা ভাষাকে প্রচুর মারধর করেছেন), শিক্ষিত সাত (তিনি এখন আমাদেরকে খুব বইপত্র পড়াচ্ছেন), শিক্ষিত আট (শিক্ষিত তিনের চেয়ে তিনি কয়েক ইঞ্চি বড়ো কবি ছিলেন), এবং পূর্ব পাকিস্তানের আরো লাখ লাখ শিক্ষিত সিভিলিয়ান মানুষ, অস্ত্র হাতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করেননি। গত কয়েক বছরে আমি প্রায় একশোটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়েছি, কিন্তু কোনো গল্পেই স্যুট-টাই পরা কাউকে পাইনি। পুরস্কার হোসেন, বানিয়ে-বুনিয়ে একটি অত্যন্ত নিম্নমানের মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখে ইশকুলের পাঠ্য বইয়ে ঢুকিয়ে দিলেও নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি (যদিও তার জন্ম ১৯৫০ সালের আগে)। এর কারণ, সচেতনতা ও ভয়। শিক্ষার মাধ্যমে পাকিস্তান তাদের জানিয়ে দিয়েছিলো, রাষ্ট্রদ্রোহের পরিণাম কী হতে পারে। কিছু ব্যতিক্রম আছে, তবে তা আমার আলোচনার বিষয়বস্ত নয়।

কিন্তু অশিক্ষিত মানুষরা রাষ্ট্রদ্রোহ শব্দটির সাথে পরিচিত ছিলেন না। এখনো গ্রামের কোটি কোটি মানুষ, যারা শিক্ষিত নয়, তারা জানেন না রাষ্ট্রদ্রোহ কী। এই মুহূর্তে সিলেট যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, এবং বাংলাদেশের সাথে সিলেটবাসীর যদি যুদ্ধ বাধে, তাহলে সিলেটের পক্ষে আমার যুদ্ধ করার সম্ভাবনা কম। কারণ শিক্ষা আমাকে ভীতু করে দিয়েছে। কিন্তু গ্রামের অশিক্ষিত মানুষজন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

শেখ হাসিনা এক সভায় প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তার বাবার লাশটি বাড়ির সিঁড়িতে এতো সময় পড়ে ছিলো? কেন আওয়ামী লীগের মতো এতো বড়ো একটি দলের কোনো নেতা তার বাবার পক্ষে এগিয়ে আসেননি? এর অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তবে আমার ব্যাখ্যাটি হলো, তখন শেখ মুজিবের চারপাশে যারা ঘুরঘুর করতেন, তাদের সকলেই শিক্ষিত নাগরিক ছিলেন। শিক্ষিতরা স্বার্থপর হয়। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে যারা ঘিরে রেখেছেন, তাদের প্রায় সবাই শিক্ষিত নাগরিক, এবং কোনো দুর্যোগে, এদের কাউকে পাশে পাওয়া যাবে না।

তবে রাষ্ট্র ভালো হলে, শিক্ষিত মানুষরাই বেশি সাহসী হয়; কারণ তখন শিক্ষার উদ্দেশ্য থাকে- নাগরিকদের মনে ভয়ের বদলে সাহসের সঞ্চার করা। এ জন্য প্রয়োজন আইনের সংখ্যা কমানো। কোনো রাষ্ট্রে আইনের সংখ্যা যতো বেশি হয়, সে-রাষ্ট্রের নাগরিকরা ততো বেশি ভীতু ও অপরাধপ্রবণ হয়। আইনের প্রতি ভয় তাদেরকে নপুংসক করে তোলে। যা করার কথা প্রকাশ্যে, তা তারা করতে শুরু করে লুকিয়ে। ভালো রাষ্ট্রে বেশি আইন থাকে না। ওখানে আইন থাকে অল্প, এবং আইনের ভাষা থাকে পরিষ্কার। এ জন্য আইনকে শক্তিশালী করতে হলে, প্রথমেই এর সংখ্যা কমাতে হবে। কোনো রাষ্ট্র ভালো কি না, তা বুঝার জন্য আমি প্রথমেই দেখি- রাষ্ট্রটিতে আইন ও জেলখানার সংখ্যা কেমন। যদি টের পাই, আইন ও জেলখানার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তাহলে ধরে নিই, রাষ্ট্রটি অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে।

শিক্ষা যে-স্বার্থসচেতনতা সৃষ্টি করে, তার সাথে সম্পর্ক আছে লোভের। এ লোভ সম্পত্তি রক্ষার লোভ। লোভে পড়েই একজন নাগরিক পা দেন রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ফাঁদে, কারণ রাজা পুলিশ দিয়ে নাগরিকের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব নেন। বিনিময়ে নাগরিক, রাষ্ট্রকে আয়কর, ভ্যাট, আমদানি শুল্ক ইত্যাদি পরিশোধ করে থাকেন।

৩.

শিক্ষার তৃতীয় কাজ উৎপাদন বাড়ানো। প্রয়োজনীয় উৎপাদন নয়, অপ্রয়োজনীয় উৎপাদন। যদি একজন কৃষক কেবল ততোটুকুই উৎপাদন করেন, যতোটুকু জীবন ধারণের জন্য দরকার, এবং আর কোনো অতিরিক্ত উৎপাদন না করেন, তাহলে খাওয়ার জন্য রাষ্ট্রচালকদের কিছু থাকবে না। কারণ ক্ষমতা ও সিংহাসন লোভনীয় হলেও ভক্ষণযোগ্য নয়। এ জন্য শিক্ষার মাধ্যমে তারা এমন একটি জনগোষ্ঠী তৈরি করেন, যারা নিজেরা কৃষিকাজ করবে না, কিন্তু মিথ্যে প্রশংসা করবে কৃষিকাজের (যেমন একটু আগে আমি দেখিয়েছি, কীভাবে নিজেরা মুক্তিযুদ্ধ না করেও খুব ভালো প্রশংসা করা যায় মুক্তিযুদ্ধের)। চারদিকে যে কৃষকদের এতো প্রশংসা শোনা যায়, এর কারণ হলো এই। প্রশংসা দিয়েই কৃষকদের ভুলিয়ে রাখা হয় কাজে। কৃষকরা ভাবেন, কৃষিকাজ খুব মহান কাজ। কিন্তু এর মূলে যে একটি অসৎ চালাকি রয়েছে, তা কৃষকরা ধরতে পারেন না।

শিক্ষা যে-অনুৎপাদনশীল ভোক্তা শ্রেণীটি তৈরি করে, তারা কৃষক ও শ্রমিকদের এই অতিরিক্ত উৎপাদন কিনে নেন, এবং লিপ্ত হন ভোগ ও বিক্রয়কর্মে। এ ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া থেকে যে-কর আহরিত হয়, তা দিয়েই রাষ্ট্র চলে।

শিক্ষিত মানুষজন খুব কমই সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এ লেখাটি আমার কোনো উপকারে আসবে না, যদি অশিক্ষিতরা আগামীকাল থেকে বন্ধ করে দেয় অপ্রয়োজনীয় উৎপাদন, কারণ লেখাটি খেয়ে আমার পেট ভরবে না। সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, ও ধর্মচর্চার জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত উৎপাদনের চাকাটি সচল রাখা। যদি অশিক্ষিতরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন না করতো, তাহলে নিউটনকে হালচাষ করে দিন কাটাতে হতো। আইনস্টাইন জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে ভাবার সময়ই পেতেন না। সক্রেটিসও বেঁচে যেতেন, তাঁকে হেমলক পান করে মরতে হতো না। প্লেটো কাউকে ছুরি মারতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হতেন, আর আমি হয়তো গ্রামের ওই মাঠটিতে এখনো গোবর কুড়াতাম।

রাজা-বাদশাহরা নয়, জনগণই অমর, এরকম মিষ্টি কথা স্তালিন বলতে পারতেন না, যদি রুশ প্রলেতারিয়েতরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন না করতো। ট্রটস্কি তাঁর ‘হিস্ট্রি অব রাশিয়ান রেভল্যুশন’ লিখতে পারতেন না, যদি অশিক্ষিত রুশরা তাঁর আহারের সংস্থান না করতো। লেনিন শ্রমিকদের এতো প্রশংসা করতেন না, যদি তিনি নিজে শ্রমিক হতেন। মার্ভ তাঁর ওই মোটা জস ক্যাপিটাল আর ছোট্ট ম্যানিফেস্তোটি রচনা করতে পারতেন না, যদি কোনো সুয়েটার ফ্যাক্টরিতে তাঁকে কাজ করতে হতো। রবীন্দ্রনাথ যদি জমিদার না হয়ে তিউনিশিয়ার বাওয়াজিজি হতেন, তাহলে ‘গীতাঞ্জলি’ লেখার অবসর তিনি পেতেন না। জীবনানন্দ কলেজে মাস্টারি না করে যদি কুলিগিরি করতেন, তাহলে এলান পো’র ‘টু হেলেন’ ও বায়রনের শি ওয়াকস ইন বিউটি’ তাঁর পড়া হতো না, এবং রচনা করতে পারতেন না- চুল তার কবেকার অন্ধকার পাগলের নিশা।

আমি বলছি না যে পৃথিবীতে শিক্ষিত কৃষক ও শিক্ষিত শ্রমিক নেই, কিন্তু যারা শিক্ষার ভেতর দিয়ে যান, তাদের একটি হায়ারার্কি আছে। এ হায়ারার্কিতে যারা তলানির দিকে থাকে, কেবল তাদের ঘাড়েই ন্যস্ত হয় উৎপাদনের মূল কাজ। অন্যরা শুধু ‘হুকুম’ ও ‘দিক-নির্দেশনা দেন। পৃথিবীতে যখন ‘হুকুম’ ও ‘দিক-নির্দেশনা’ ছিলো না, তখন নিজের খাবারের সংস্থান নিজেকে করতে হতো। শিক্ষা, ‘হুকুম’ ও ‘দিক-নির্দেশনা’র উছিলায় অনেক অথর্বের মুখে খাদ্য তুলে দিচ্ছে।

৪.

শিক্ষার চতুর্থ কাজ কুসংস্কারকে সত্য রূপে প্রতিষ্ঠা করা। বহু মিথ্যা ও রটনা, যার সত্যতা কারও পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয়, তা পাঠ্যবইয়ে ঢুকিয়ে উপস্থাপন করা হয় সত্য রূপে। বহু বিতর্কিত বিষয়, যেগুলোর পক্ষে ও বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন অনেকে, সেগুলোকে পাঠ্যবই একটি শিশুর সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেন শিশুটি কোনোভাবেই টের না পায় যে বিষয়টির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ প্রক্রিয়াটিকে আমি তুলনা করতে পারি বড়শির সাথে। বিষয়টি গেলার অনেক দিন পর, বড়শিতে আটকা মাছের মতো, শিশুটি বুঝতে পারে যে ইশকুল তার সাথে প্রতারণা করেছে। পাঠ্যবই শুধু ওই বক্তব্যগুলো বেছে নিয়েছে, যেগুলোকে ইশকুলের চালকরা সুবিধাজনক ভেবেছেন। অসুবিধাজনক কোনো ভিন্নমতকে ইশকুল গ্রহণ করেনি। স্তালিন তাঁর ইশকুলে ট্রটস্কিকে উপস্থাপন করেছিলেন শয়তান রূপে। মাও জেদুং শিশুদের সামনে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন, যেন চিয়াং কাই শেককে তাঁর সামনে পোকামাকড়ের চেয়ে বড়ো মনে না হয়। কুর্দিদের কোনো কথা সাদ্দাম তাঁর ইশকুলে পড়াতে দেননি। সুন্নিদের মাদ্রাসায় শিয়াদের কাফের বলা হয় আর শিয়াদের মাদ্রাসায় সুন্নিদেরও তাই বলা হয়। এক মাওলানাকে বলতে শুনেছি, একমাত্র তার আকিদার মানুষরাই বেহেশতে যাবে।

তুরস্কের এরদোগানের ধারণা, শিশুরা তাঁর হাঁস-মুরগি। তিনি বই- পুস্তকে যা খেতে দেবেন, শিশুদেরকে তা-ই খেতে হবে। নরেন্দ্র মোদীর ইশকুলগুলো চেষ্টা করছে, কীভাবে ছাত্রদের বুঝানো যায় যে- ভারত হলো হিন্দুস্তান; কেবল হিন্দুরাই ভারতের প্রকৃত নাগরিক। এমন চিত্র বাংলাদেশেও প্রত্যক্ষ করেছি। এক রাজনীতিক দল আরেক রাজনীতিক দলকে, পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে শিশুদের সামনে দেশবিরোধী হিশেবে উপস্থাপন করছে। সম্প্রতি ইশকুলগুলোতে, ছাত্রদেরকে প্রতিদিন একটি বিশেষ শপথ পাঠ করানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরকম শপথ শিক্ষার রাজনীতিক টুপিরই অংশ।

দুটি ভিন্নমত পড়ে যেকোনো একটিকে বেছে নেবে, বা উভয়টিকেই প্রত্যাখ্যান করবে, এ সুযোগ ইশকুলগুলো শিশুদের দেয় না। কিন্তু আমি তাদেরকে এ সুযোগ দিতে চাই। এটি শুধু শিশুদের জন্যই ভালো, এমন নয়; এটি রাষ্ট্রচালকদের জন্যও ভালো। সামাজিক ও রাজনীতিক অস্থিরতা এতে কমে আসবে। ফলে পুলিশের পরিশ্রমও কমে যাবে। সুতরাং ছদ্মসত্যের সাথে নয়, শিশুদেরকে ছোটোবেলা থেকেই পরিচয় করিয়ে দিতে হবে প্রকৃত সত্যের সাথে। কোনো বিষয়ের সাথে কীভাবে দ্বিমত পোষণ ও প্রকাশ করতে হয়, তা শিশুদেরকে ইশকুলেই শেখাতে হবে। যারা কথা ও লেখার মাধ্যমে দ্বিমত প্রকাশ করতে জানে, তাদেরকে রাস্তায় খুনোখুনি করে বা আগুন লাগিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করতে হয় না।

যদি শিশুদের দ্বিমত প্রকাশের জায়গা সংকুচিত করা হয়, বা ওদেরকে ভয় পাইয়ে দেয়া হয় কোনোভাবে, তাহলে তাদের মানসিক বিকাশ বিকৃতভাবে ঘটে। এ প্রসঙ্গে কুৎসার কথা বলা যায়। আমি বহু ছাত্র পেয়েছি, যারা গোপনে ও আড়ালে, শিক্ষক, রাজনীতিক, আমলা, রাষ্ট্রপতি, লেখক, বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী, ও মৃত ফেরেশতাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও গালমন্দ করে। সমাজ এগুলোকে বলে কুৎসা। কুৎসা সত্য হতে পারে, আবার মিথ্যাও হতে পারে। এমনকি কথার কথাও হতে পারে। যদি ছাত্ররা প্রকাশ্যে দ্বিমত প্রকাশ করার সুযোগ পেতো, এবং তাদের দ্বিমত প্রকাশের অভ্যাসকে রাষ্ট্র উৎসাহিত করতো, তাহলে কুৎসার জন্ম হতো না। কারণ তখন আড়ালে বলার মতো কোনো কথা ছাত্রদের থাকতো না।

ইশকুলগুলো ছাত্রদের কিছুটা বিজ্ঞান শেখায়, কিন্তু একই সাথে বিজ্ঞানকে তাচ্ছিল্য করাও শেখায়। যেহেতু বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়িয়ে তেমন রাজনীতিক সুবিধা পাওয়া যায় না, তাই ইশকুল-মালিকরা তাদের সিলেবাসে বিজ্ঞানকে রাখেন কেবল অবৈজ্ঞানিক বিষয়াদি ঢেকে রাখার জন্যে। মাছ ঢাকতে তারা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেন শাক হিশেবে। বদরাষ্ট্রগুলো খুব সচেতনভাবেই শিশুদেরকে বিজ্ঞানের গভীরে ঢোকা থেকে বিরত রাখে। যারা সিলেবাস প্রণয়ন করেন, তাদের কাছে বিজ্ঞান শিক্ষার চাইতে জাতীয় সংগীত গাওয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তারা জানেন, শিশুরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিন্তা করা শিখে গেলে, তা রাষ্ট্রের চালকদের জন্য বুমেরাং হবে। বিজ্ঞান প্রশ্ন করতে শেখায়, আর প্রশ্ন করা, আমি আগেই বলেছি, বুড়োদের একদম পছন্দ নয়। প্রশ্ন করে, সত্য খুঁজে, বুড়োদের কেউ বিব্রত করবে, এটি শিক্ষার চালকরা চান না। এ জন্য কোনো খারাপ রাষ্ট্রে, বিজ্ঞান-শিক্ষা এমনভাবে সাজানো হয়, যেন একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের মূল কার্যপ্রণালিটিই বুঝতে না পারে।

আমি এ পদ্ধতির বিরোধী। আমি চাই শিক্ষাকে সকল রাজনীতিক কর্তৃত্বের বাইরে রাখতে। বহু দেশেই রাজনীতিকরা নিজেরা শিক্ষিত নন, কিন্তু নাগরিকদের শিক্ষিত করার জন্য তারা খুব উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগের মূলে যে অনেক অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, তা ইতোমধ্যে উপরে স্পষ্ট করেছি। রাজনীতিকরা নানা এজেন্ডা নিয়ে কাজ করেন। এসব এজেন্ডার অধিকাংশের সাথেই জনস্বার্থের কোনো সম্পর্ক থাকে না। জনস্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ নিয়েই তারা অধিক তৎপর থাকেন। অবশ্য হঠাৎ হঠাৎ নিজেদের স্বার্থের সাথে জনস্বার্থও মিলে যায়, যা নিছক কাকতাল ও দুর্ঘটনা। সবসময় এমনটি ঘটে না। এ জন্য বলি, শিক্ষাকে রাজনীতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার না করাই ভালো। ইশকুলগুলো ভোটার তৈরির কারখানা হওয়া উচিত নয়। ইশকুলকে হতে হবে কৌতূহলী মানুষ তৈরির কারখানা। সিলেবাস এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যেন বই বহন করার চেয়ে বই পড়তে অধিক আগ্রহ জাগে। শিশুরা বই দেখে যেন ভয় না পায়, বইয়ের ওপর তারা যেন বিরক্ত না হয়, এটি নিশ্চিত করতে হবে। বইয়ের ভেতরের জঙ্গলগুলি পরিষ্কার করে সৃষ্টি করতে হবে নতুন উদ্যান। পাঠ্যবইকে হতে হবে জলের মতো স্বচ্ছ ও সুপেয়। পোড়ালে আলো পাওয়া যাবে, কিন্তু পড়লে কোনো আলো পাওয়া যাবে না- এরকম পাঠ্যবই আমি চাই না।

বাংলাদেশে পাঠ্যবই এখন ঢাকার বস্তির রূপ ধারণ করেছে। বস্তিতে যেমন ঘরের সংখ্যা বেশি থাকে, এবং ঢুকলেই দম বন্ধ হয়ে আসে, ইশকুলগুলোও তেমনি আখড়া হয়ে উঠেছে বদ্ধবায়ুর। প্রতিটি শ্রেণীতে বইয়ের সংখ্যা প্রতিযোগিতা করছে কড়াইল বস্তির ঘরের সংখ্যার সাথে। যেন বই নয়, ছাত্ররা বহন করে চলেছে স্তূপ। বই পাঠ করা যায়, কিন্তু স্তূপ পাঠ করা যায় না। স্তূপে শুধু লাগানো যেতে পারে আগুন।

শিশুদেরকে বুড়োদের লেখা বই পড়ানো বন্ধ করতে হবে। বই সংকলন করাতে হবে এমন মানুষদের দিয়ে, যাদেরকে এখনো বার্ধক্য আক্রমণ করেনি। যাদের চুলে পাকন ধরেছে, কিন্তু মনে পচন ধরেনি। পচা, বাতিল, ও অন্ধ বুড়োদের কোনো লেখা পাঠ্যবইয়ে রাখা যাবে না। সাহিত্যের বইয়ে ছদ্মসাহিত্য, ইতিহাসের বইয়ে ছদ্মইতিহাস, বিজ্ঞানের বইয়ে ছদ্মবিজ্ঞান ঢুকানো বন্ধ করা দরকার। শিশুরা যেন নির্ভয়ে শয়তানকে শয়তান ও ফেরেশতাকে ফেরেশতা বলতে পারে, এ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের ইউএনও, ডিসি, ও সাংসদদের কব্জা থেকে মুক্ত করতে হবে। শিক্ষার দেখভালের জন্য প্রতিটি জেলায় স্থাপন করতে হবে আলাদা দপ্তর। বর্তমান জেলা শিক্ষা অফিসটিকেই হালনাগাদ করে এটি করা যেতে পারে। এ অফিসের প্রধান হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, যার কোনো রাজনীতিক উচ্চাভিলাষ নেই। তবে এমন লোক দেশে আছেন কি না সন্দেহ!

এখানে আমি আরেকটি প্রস্তাব করতে চাই। প্রস্তাবটি কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং সারা বিশ্বের জন্য:

শিক্ষা যেহেতু প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে, সেহেতু রাষ্ট্রগুলোর উচিত ছাত্রদেরকে বেতন দেয়া। শিক্ষা গ্রহণ করাকে আর দশটি চাকরির মতোই মনে করতে চাই। শিক্ষার্থীরা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় শিক্ষা গ্রহণের পেছনে ব্যয় করে থাকে. কিন্তু এ জন্য তারা কোনো পারিশ্রমিক পায় না। বছরের পর বছর ধরে বিনা বেতনে রাষ্ট্রের দেয়া প্রশিক্ষণ তারা গ্রহণ করছে। এটি অবৈতনিক হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রগুলোকে ছাত্রদের জন্য বেতন স্কেল ঘোষণা করতে হবে, এবং এটি দায়সারা গোছের হলে চলবে না। কোনো নাগরিক যদি ছাত্র অবস্থায় মারা যান, তাহলে তার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। ছাত্রের পরিবারের সদস্যগণ রাষ্ট্র থেকে এ ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করবেন।

টিউশন-ফী-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ উঠিয়ে দিতে হবে। সবাইকে স্নাতক হতে হবে- এমন ধারণা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাকে মহিমান্বিত করার কোনো কারণ নেই। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে বিচরণ করছে লাখ লাখ শিক্ষিত মানুষ, যাদের সৃষ্টিকর্ম ও উৎপাদনের পরিমাণ একজন অশিক্ষিত কৃষকের তুলনায় নগণ্য। গণহারে বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়ানো ঠিক নয়। যিনি মনে করবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তার পক্ষে বিশেষ কোনো দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব, কেবল তিনিই ওখানে যাবেন। অন্যরা এ প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি নেবেন, এবং মনোযোগ দেবেন অন্য কাজে, যে-কাজে শিক্ষার খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। কে কতোটুকু শিক্ষালাভ করবে, এটি নির্ধারণ করা জরুরি। অনেকেই সমাজ ও সম্মানের ফাঁদে পড়ে গ্রহণ করেন নানা অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা। এমন অনেক ডিগ্রি তারা নেন, যেগুলো না নিলে কারও কোনো ক্ষতি হতো না। বরং উপকৃত হতো সমাজ। এসব অপ্রয়োজনীয় ডিগ্রি নিতে গিয়ে মানুষ নষ্ট করছে জীবনের মূল্যবান সময়। ঢাকার বুড়ো মানুষরা এখন কবরে ঢোকার আগে নিচ্ছেন ভারী ভারী ডিগ্রি। এর কোনো অর্থ হয় না। এ নিরর্থক কাজে যে-অসাধারণ সময় ও টাকা তারা খরচ করেন, তা ব্যয় করা যেতো পারিবারিক সুখের পেছনে।

কেউ কেউ শিক্ষালাভ করাকে মনে করছেন সামাজিক মর্যাদা লাভের হাতিয়ার। ডিগ্রি ও সার্টিফিকেটযোগে তারা ফুঁ দিচ্ছেন ‘সোশ্যাল স্ট্যাটাস’ নামক বেলুনে। এ বেলুনে ঝুলে বানরেরা উড়ে বেড়াচ্ছে নিজ নিজ কাল্পনিক আকাশে। এটি একপ্রকার রোগ। বলা যায়, ডিগ্রিরোগ। রোগটির চিকিৎসা ডাক্তারিবিদ্যায় আছে বলে মনে হয় না। তবে চাইলে, নিজের টিউমারে নিজে চাকু চালিয়ে এ রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো যেতে পারে।