শিক্ষক
এখন অনেক শিক্ষকই ছাত্রকে গাধা ডাকতে লজ্জা পান। তিনি আতঙ্কে থাকেন, কখন তার ভেতরের গাধাটি বেরিয়ে পড়ে।
নারী ও গাভীর পর বাংলাদেশে যে-প্রাণীটি সবচেয়ে নিরীহ জীবনযাপন করছে, তার নাম শিক্ষক। সমাজে তিনি আছেন কি নেই, তা আর আমরা আগের মতো টের পাই না।
তার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি গাধা মাছের পোনা। তার বেতন ও নিয়তি আগে আল্লাহর হাতে থাকলেও এখন আছে তার ক্ষমতাবান ছাত্রদের হাতে। ছাত্ররা সচিবালয়ে ঢুকেই এক হাত দেখে নিচ্ছে তাদের গুরুদের।
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তিনি ছাত্রদের খোঁজখবর নেন। পত্রিকাগুলোই তাকে এ সংবাদ জানায়। গতকাল জানতে পেরেছেন, তার ৩২ জন ছাত্র ঘাসের চাষাবাদ শিখতে বিদেশে যাচ্ছে।
কিছুদিন আগে তার এক ছাত্র মন্টু, টেলিভিশনে জানিয়েছে— আমেরিকারও বাংলাদেশ থেকে শেখার আছে। তার আরেক ছাত্র ডক্টর চট্টগ্রাম, ঢাকায় এসে প্রায়ই লস এঞ্জেলস আবিষ্কার করছে।
তিনি এসবের কিছুই বুঝতে পারেন না। শুধু আশায় আশায় থাকেন, একদিন ছাত্ররা তার খোঁজ নিতে আসবে।
শিক্ষক হবো— এই স্বপ্ন এখন আর কেউ দেখে না। চাকরির সব পথ যখন রুদ্ধ হয়ে যায়; ব্যাংক, বিমা, বিসিএস, আর্মি, সব রসগোল্লা যখন বন্ধ হয়ে যায়; ঠিক তখনই একজন বেকারের গন্তব্য হয়ে ওঠে শিক্ষকতা। সরকারি হলে ভালো, অসরকারি হলেও ক্ষতি নেই, একটি ইশকুল দেখে তিনি ঢুকে পড়েন, এবং কিছুদিন পর, দুটি গামছা ও কিছু মুড়ি নিয়ে রওয়ানা হন শহিদ মিনারের দিকে। বেতনের দাবিতে তিনি আমরণ অনশনে বসেন।
কিন্তু বেতন কখনো পান না। পুলিশ এসে এমন বেতন দিয়ে যায় যে, ঘরে ফিরে তার আর মুখ দেখানোর উপায় থাকে না।
বড় শিক্ষকেরা, যারা পড়াচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, মেতে আছেন সাদা ও নীল রং নিয়ে। এক রং গুঁতো দিচ্ছে আরেক রংকে। এই গুঁতোগুঁতিতে পড়ে ছাত্ররা বেছে নিয়েছে মরিচের জীবন।
অ্যারিস্টটল বলতেন— বাবা-মা শুধু জীবনই দেন, কিন্তু ওই জীবন কীভাবে কাটাতে হয় তা শেখান শিক্ষক। তবে বিসিএসের ফলের দিন এ বক্তব্যের কোনো সত্যতা পাওয়া যায় না। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, কাস্টমস, ও পররাষ্ট্রদের ফোন-ফেইসবুক যখন অভিনন্দনে ভরে ওঠে, শিক্ষক তখন একটি ছোটো ‘আলহামদুলিল্লাহ’ লিখে ঘুমিয়ে পড়েন।
শিক্ষকের জীবন আকর্ষণীয় করার কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্র নেবে বলে মনে হয় না। একজন সচিব গাড়ি পেলেও একজন অধ্যাপক গাড়ি পান না। নানা নামের ভাতা থেকেও তিনি বঞ্চিত। ভ্রমণ ও শপিংয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে। যা বেতন পান, তা দিয়ে একটি ভালো বাসা নিলে, তার আর একটি লাউ কেনার টাকাও থাকে না।
তার ক্ষমতা শূন্য বলে সমাজে তার দামও শূন্য। ইশকুলের শিক্ষকদের তো জেলার ডিসিরা চাকর-বাকর মনে করেন। নানা অনুষ্ঠানে, হেডমাস্টারদের চেয়ে থানার মালিকরা এখন বেশি দাওয়াত পান। কলমের আলোর পাশে যে বন্দুকের আলোকে খুব ম্লান দেখায়, এ বিষয়টি সমাজ ভুলে গেছে।