সৈনিকের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা
শয়তানের ফাঁদ
প্রথম পরিচ্ছেদ – অর্ধেক মানব আর অর্ধেক দানব
প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি নামক মিত্রপক্ষের জনৈক সেনাধ্যক্ষ আফ্রিকা মহাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে উদযোগী হন। ওই কাজে তার প্রধান সহায় ছিল তার দুই বন্ধু প্রফেসর ও বিল। প্রথমোক্ত ব্যক্তি ফরাসি বৈজ্ঞানিক, দ্বিতীয় মানুষটি হচ্ছে আমেরিকার এক অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় দুঃসাহসী যুবক। বন্ধু দুটিকে নিয়ে যে অঞ্চলে প্রথম পদার্পণ করলেন আত্তিলিও, সেই জায়গাটি হল আফ্রিকার অন্তর্গত উত্তর রোডেশিয়া। পূর্বোক্ত স্থানে কায়না নামে এক ভয়াবহ মৃত্যুগহ্বরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে অভিযাত্রীরা স্থানীয় সরকারকে অবাক করে দিয়েছিলেন। কায়নার গহ্বর থেকে অসংখ্য নরকঙ্কাল, করোটি, পাথরের গয়না এবং জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। ওইসব জিনিস উপহার হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম নীচে দেওয়া হল :
গভর্নমেন্ট অব নর্দার্ন রোডেশিয়া, আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি, আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়, রয়্যাল অ্যানথ্রোপলজিক্যাল মিউজিয়াম অব ফ্লোরেন্স এবং জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারসর্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
উত্তর রোডেশিয়াতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্মে সাফল্য অর্জন করার ফলে অভিযাত্রীদের সামনে দক্ষিণ রোডেশিয়ার রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। দক্ষিণ রোডেশিয়া সরকার সাধারণত বিদেশিদের প্রবেশ করার অনুমতি দেন না, কিন্তু অভিযাত্রীদের বিভিন্ন গবেষণাকার্যের সাফল্যে খুশি হয়েই পূর্বোক্ত গভর্নমেন্ট নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও বিবরণ পাঠকদের কাছে নীরস লাগবে বলে আত্তিলিও ওইসব বিজ্ঞান-বিষয়ক তথ্য ও তত্ত্ব এখানে পরিবেশন করেননি, লিপিবদ্ধ করেছেন তার অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চকর কাহিনি।
দক্ষিণ রোডেশিয়াতে ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন আত্তিলিও। তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, সেখানে গিয়ে এক বিপজ্জজনক নাটকের মধ্যে তাকে অংশগ্রহণ করতে হবে।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে ভয়াবহ নাটকের স্মৃতি আত্তিলিওর মানসপটে দুঃস্বপ্নের মতো জেগে থাকবে। সেই বন্য-নাটকে একাধিক ভিলেন বা খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল প্রকাণ্ড এক নরখাদক সিংহ, এক শয়তান জাদুকর এবং ক্রোধে উন্মত্ত এক-শো জুলুযোদ্ধা!
নায়কের ভূমিকায় ছিল পেশিবহুল বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী এক সুদর্শন জুলুযোদ্ধা, নায়িকার স্থান নিয়েছিল এক ষোড়শী জুলুবালিকা।
উল্লিখিত প্রধান চরিত্রগুলো ছাড়া কিছু কিছু এক্সট্রা অর্থাৎ অতিরিক্ত চরিত্রের উপস্থিতি নাটকটিকে জমিয়ে তুলেছিল, যেমন–প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জুলু সর্দার, নরমাংস-লোলুপ শত শত সিংহ, এবং আত্তিলিও, বিল, প্রফেসর প্রভৃতি অনিচ্ছুক অভিনেতার দল।
মূল নাটকে আত্তিলিওর ভূমিকা ছিল খুবই ছোটো, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুটি মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করছিল তার অভিনয়ের সাফল্যের উপর; এবং ওই দুটি মানুষের একজন হলেন স্বয়ং আত্তিলিও! তবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও তিনি ঘাবড়ে যাননি, বেশ ভালো হয়েছিল তার অভিনয়। না, ভালো বললে কিছুই বলা হয় না–এমন চমৎকার, এমন মর্মস্পর্শী হয়েছিল তার অভিনয় যে, সমস্ত ঘটনা শোনার পর মনে হল সৈনিকের পেশা গ্রহণ না-করে পেশাদার অভিনেতার বৃত্তি অবলম্বন করলে অনেক বেশি যশ ও খ্যাতির অধিকারী হতে পারতেন কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি।
কমান্ডার সাহেব প্রথমে তার অভ্যাস অনুযায়ী রাইফেল হাতেই আসরে নেমেছিলেন, কিন্তু নাটকের প্রয়োজনে অস্ত্রত্যাগ করে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন জাদুকরের ভূমিকায় রাইফেলের পরিবর্তে তখন তার হাতে ম্যাজিকের বাক্স! সেসব ঘটনার বিবরণ যথাস্থানে দেওয়া হবে।
পূর্বোক্ত নাটকের বিবরণী দেওয়ার আগে যখন এত কথাই বললাম, তখন যে পটভূমির উপর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল সেই রঙ্গমঞ্চটি সম্বন্ধেও পাঠককে অবহিত করা প্রয়োজন।
মঞ্চটি ছিল ওই অভিনব নাটকেরই উপযুক্ত–আয়তনে বিশাল এবং চমকপ্রদ দৃশ্যসজ্জায় সুশোভিত। জুলুল্যান্ডের উত্তর অংশে বিরাজমান ইনিয়াতি পর্বতমালার অরণ্যসজ্জিত বিপুল বিস্তৃতি নিয়ে গঠিত হয়েছিল উল্লিখিত নাটকের স্টেজ বা মঞ্চ।
উত্তর রোডেশিয়া ত্যাগ করে এগারোজন নিগ্রো অনুচর নিয়ে অভিযাত্রীরা ইনিয়াতি পর্বতমালার দিকে অগ্রসর হলেন। পূর্বোক্ত নিগ্রোদের সংগ্রহ করেছিল জামানি নামক আত্তিলিওর বিশ্বস্ত অনুচর ও রাঁধুনি। সকলেই জানত যে, তাদের গন্তব্যস্থল হচ্ছে জুলুল্যান্ড।
জামানি জুলুল্যান্ডের অধিবাসী, অতএব স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেলে তার পক্ষে খুশি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা ভয়ানক সমস্যা তাকে এমনভাবে বিব্রত করে তুলেছিল যে দেশে ফেরার আনন্দ সে প্রথমে উপভোগ করতে পারেনি। সমস্যাটা হচ্ছে এই :
আত্তিলিওকে কায়নার ভয়াবহ গহ্বর থেকে উঠতে দেখেছিল জামানি, আর তৎক্ষণাৎ বুঝে নিয়েছিল প্রভুর মতো দেখতে ওই জীবটি হচ্ছে প্রভুর প্রেতাত্মা; কারণ, একটা নিঃসঙ্গ মানুষ মৃত্যুগহ্বরের অন্ধকার গর্ভে প্রবেশ করে আবার জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারে, এমন অসম্ভব কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়… কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার জামানির মনে খটকা লাগল–একটা আস্ত ভূতের পক্ষে নিরেট রক্তমাংসের দেহ নিয়ে সবসময় চলাফেরা কি সম্ভব? আবার ঘর্মাক্ত হল জামানির মস্তিষ্ক… অবশেষে বিস্তর চিন্তা করে, বিস্তর মাথা ঘামিয়ে, আসল ব্যাপারটা সে ধরে ফেলল–আত্তিলিও হচ্ছেন, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক প্রেত! না হলে, কায়নার মতো ভয়াবহ মৃত্যুগহ্বরের ভিতর থেকে একটা আস্ত মানুষ কি কখনো জ্যান্ত অবস্থায় ফিরতে পারে?…
যাই হোক, প্রেত-মানুষ যে তার প্রতি অত্যন্ত সদয় হয়ে তাকে মাতৃভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে এই চমকপ্রদ তথ্যটি আবিষ্কার করার পরই মনের মেঘ কেটে গেল, উৎফুল্ল হয়ে উঠল জামানি।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – জুলুদের দেশে আত্তিলিও
আত্তিলিও তার অভিযাত্রীদল নিয়ে জুলুল্যান্ডের ভিতর এসে পৌঁছোলেন। তিনি জানতেন দলের নেতা হিসেবে দলীয় নিরাপত্তার গুরুদায়িত্ব এখন থেকে তাঁকেই বহন করতে হবে। শ্বেতাঙ্গ সরকার অভিযাত্রীদের জুলুল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতি দিলেও তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে অসম্মত। সরকার স্পষ্ট জানিয়েছিলেন অভিযাত্রীরা জুলুল্যান্ডে প্রবেশ করার ফলে যদি কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাহলে সেজন্য অভিযাত্রীরাই দায়ী হবেন–স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট জুলুদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কিছুতেই হস্তক্ষেপ করবেন না, অবশ্য বিদ্রোহ কিংবা গণহত্যা সংঘটিত হলে আলাদা কথা।
ওসব কথা শুনে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্র নন আত্তিলিও। তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন জাতির মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারতেন; জুলুদের ভাষা তিনি এমনভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে, ওই ভাষা বলতে বা বুঝতে তার কিছুমাত্র অসুবিধা হত না। আত্তিলিও তার জুলু-অনুচর জামানির কাছে যা শুনেছিলেন, তা থেকে জুলুদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তাঁর মোটামুটি একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল। তিনি বুঝেছিলেন যে জাত্যভিমানে গর্বিত জুলুজাতি অতিশয় সাহসী ও সহজ-সরল আধুনিক জীবনযাত্রার পদ্ধতি তাদের পছন্দ নয়, তারা অনুসরণ করে পূর্বপুরুষদের প্রচলিত রীতিনীতি। আফ্রিকার প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত জাতিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জুলুজাতি।
সব কিছু শুনে আত্তিলিওর মনে হয়েছিল জুলুল্যান্ডে তাদের বিশেষ কিছু অসুবিধা হবে না। নিশ্চিন্ত মনে দলবল নিয়ে তিনি একটা বৃত্তাকার পর্বতচূড়ার দিকে অগ্রসর হলেন। উক্ত পাহাড়ের উপর অবস্থান করছিল অনেকগুলো কুটির। সেই কুটিরগুলোই ছিল আত্তিলিওর লক্ষ্যস্থল। এখানে বাস করে জুলুদের সর্বাধিনায়ক জিপোসো। শ্বেতাঙ্গ সরকার কখনো তার কথার উপর কথা বলেন না; স্থানীয় ব্যাপারে জিপোসো হচ্ছে জুলুরাজ্যের মুকুটহীন রাজা।
দেখো, প্রফেসর বললেন, সর্দারের নিশ্চয়ই চল্লিশটি বউ আছে।
ঠিকই বলেছেন প্রফেসর। তবে সর্দার-পত্নীদের সঠিক সংখ্যা অনুমান করার জন্য প্রফেসরকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করলে ভুল হবে জুলুজাতির সামাজিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে যারা অবহিত, তাদের পক্ষে যেকোনো জুলু-পুরুষের আস্তানার সম্মুখীন হয়ে উক্ত ব্যক্তির স্ত্রীর সংখ্যা বলে দেওয়া খুবই সহজ। জুলুরা গ্রামবাসী নয়; প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তার বউদের নিয়ে স্বতন্ত্রভাব বাস করে সবচেয়ে বড়ো কুটিরটাতে বাস করে কর্তা স্বয়ং এবং গোরু রাখার জন্য যে বিস্তীর্ণ স্থানটিকে বেড়ার সাহায্যে ঘিরে ফেলা হয়, সেই ঘেরা-জায়গার চারপাশে মালিকের স্ত্রীদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট থাকে একটি করে কুটির। পূর্বোক্ত পত্নীরা তাদের নিজস্ব সন্তানসন্ততি নিয়ে ওইসব কুটিরে বাস করে। অতএব বৃহত্তম কুটিরটির আশেপাশে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র কুটিরগুলোর সংখ্যা দেখে অনায়াসেই আস্তানার মালিকের স্ত্রীর সংখ্যা নির্ণয় করা যায়। বহু কুটির নিয়ে গঠিত জুলুদের এই আস্তানাকে বলে ক্রাল। একটি ক্রাল থেকে আর একটি ক্রালের দূরত্ব খুব কম নয়। বেশ কয়েক মাইল দূরে দূরে অবস্থিত কাল প্রায়ই দেখা যায় জুলুদের দেশে।
প্রফেসর বললেন, দেখো, ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
হ্যাঁ, ওরা অপেক্ষা করছিল। পুরুষদের নিয়ে গঠিত এক বৃহৎ জুলু জনতা নির্বাক হয়ে অপেক্ষা করছিল। তাদের চারপাশে দণ্ডায়মান জুলু মেয়েরা কলকণ্ঠে উত্তেজনা প্রকাশ করলেও পুরুষরা ছিল প্রস্তরমূর্তির মতো নিশ্চল, নীরব।
জিপোসোর নিজস্ব গুপ্তচর বিভাগ যে অতিশয় সক্রিয়, এই ঘটনা থেকেই তা বোঝা যায়। কারণ জিপোসোর আস্তানা বা ক্রালের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে অভিযাত্রীরা কোনো মানুষকে দেখতে পাননি, অথবা ঢাকের আওয়াজও তাদের শ্রুতিগোচর হয়নি–অথচ যথাস্থানে পৌঁছেই দেখলাম তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক বিপুল জনতা। জুলুরা কীভাবে বাস করে সে-কথা আগেই বলেছি, কাজেই দূরদূরান্তে অবস্থিত বিভিন্ন কাল থেকে যে ওইসব মানুষকে যথাসময়ে ডেকে আনা হয়েছে, এ-কথা অনুমান করা কঠিন নয়।
ভিড়ের মধ্যে জুলুদের অধিনায়ক জিপোসো দাঁড়িয়েছিল জনতার ঠিক মাঝখানে। তার অঙ্গ বেষ্টন করে ঝুলছিল একটা লেপার্ডের চামড়া। কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য জানোয়ারের লেজ ওই লেপার্ড চর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জুলুসর্দারের অঙ্গের শোভা বর্ধন করছিল। তার কেশশূন্য মস্তকে উষ্ণীষের অভাব পূরণ করেছিল অনেকগুলো রঙিন পাখির পালক। বহু বর্ণে রঞ্জিত ওই পালকগুলো বাতাসের ধাক্কায় দুলছিল, আর সঙ্গেসঙ্গে প্রখর সূর্যালোকে জ্বলে জ্বলে উঠছিল দোদুল্যমান রামধনুর রঙিন সমারোহ।
জিপোসোর গায়ের রং কালো নয়–হালকা বাদামি। সেই বাদামি দেহের অপূর্ব ভঙ্গি, উন্নত মস্তক ও কালো দুই চোখের তীব্র উদ্ধত চাহনি যেন নীরব ভাষায় এক প্রচণ্ড পুরুষের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করতে চাইছে–প্রথম দর্শনেই মনে হয়–হ্যাঁ, একটা পুরুষের মতো পুরুষ বটে সর্দার জিপোসো।
সালাগালে, আত্তিলিও বললেন, তুমি শান্তিতে থাক।
স্যাগাবোনা, জা বাব, স্মিতহাস্যে উজ্জ্বল হল জুলুসর্দারের মুখমণ্ডল, ফদার, তুমি শান্তিপ্রিয় মানুষ।
জার্মানি হাঁটু পেতে বসে সর্দারের সামনের ভূমিতে ললাট স্পর্শ করল। জিপোসো একবার তার দিকে তাকিয়ে জামানির অভিবাদন গ্রহণ করল, তারপর আত্তিলিওর দিকে ফিরল, আমি শুনেছি তুমি ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছ।
মুহূর্তের মধ্যে আত্তিলিও অনুভব করলেন প্রবল প্রতাপশালী এই জুলুসদারের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়েছে। জনতার প্রবল হর্ষধ্বনি থেকে বোঝা গেল, জুলুরাও অভিযাত্রীদের পছন্দ হয়েছে। আত্তিলিওর অনুচর জামানি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে করমর্দন করল। যোদ্ধাদের হাতে বর্শাগুলো আনন্দের আবেগে শূন্যে দুলে উঠল বারংবার, সঙ্গেসঙ্গে সমবেত নারীকণ্ঠে জাগল তীব্র উল্লাসধ্বনি!
তারপর সর্দার জিপোসোর আদেশে মহামান্য অতিথিদের জন্য এল মেহগনি কাঠের আসন, খাদ্য, পানীয়। সকলে মিলে একসঙ্গে পানভোজন করতে করতে গল্পগুজব আরম্ভ করলেন।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রফেসরের কীর্তি
জামানি কাজের লোক। অভিযাত্রীরা যেদিন জুলুদের দেশে পদার্পণ করলেন, সেইদিনই রাতের দিকে তাদের বসবাসের উপযুক্ত একটা সুন্দর উপত্যকা আবিষ্কার করে ফেলল জামানি। এক সপ্তাহ লাগল সব গুছিয়ে ঠিকঠাক করতে, ইতিমধ্যে কুলির সাহায্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসার ব্যবস্থাও হয়েছিল–তারপর স্থায়ীভাবে একটা তাঁবু খাঁটিয়ে বেশ কিছুদিন জুলুদের দেশে থাকার বন্দোবস্ত করলেন অভিযাত্রীরা।
স্থায়ী আস্তানা পেতে ফেলার পরই ম্যাজিক, জাদুবিদ্যা, ডাকিনী-তন্ত্র প্রভৃতি অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে অভিযাত্রীদের পরিচয় হতে লাগল প্রতিদিন। জুলুরা অলৌকিক কার্যকলাপে বিশ্বাসী। তাদের ধারণা প্রতিদিনে ছোটোখাটো ব্যাপার থেকে শুরু করে যাবতীয় আকস্মিক ঘটনা বা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পূর্বপুরুষের প্রেতাত্মার দল। প্রেতাত্মার রোষ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন জাদুকরের সাহায্যপ্রার্থী হয়। জুলুদের উপর তাই জাদুকরদের প্রভাব খুব বেশি।
আত্তিলিও এবং তার দুই বন্ধু আফ্রিকার বিভিন্ন জাতির মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ সম্বন্ধে গবেষণা করতে এসেছিলেন, তাই জুলুজাতির গড়পড়তা দৈহিক পরিমাপ দরকার ছিল। মাপ দেওয়ার আগে প্রত্যেক জুলু তার পছন্দসই জাদুকরের কাছ থেকে কবচ বা তাবিজ সংগ্রহ করেছিল–ওই কবচ নাকি তাদের সাদা মানুষের ম্যাজিক থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু মাপ নেওয়া ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর অভিযাত্রীদের কাছ থেকে তামার তার, টম্বাকো (তামাক), দেশলাই, ছোরা প্রভৃতি উপহার পেয়ে তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। জিনিসগুলো তাদের যে সত্যি সত্যি দিয়ে দেওয়া হল, সে-কথা তারা প্রথমে বুঝতে পারল না–এমন মূল্যবান সব উপহার কেন তাদের দেওয়া হচ্ছে? তারা তো সাদা মানুষদের জন্য কিছুই করেনি! তবে?… অবশেয়ে যখন তারা বুঝল ওইসব জিনিস তাদের উপহার দেওয়া হয়েছে এবং এগুলো আর ফেরত নেওয়া হবে না, তখন তারা ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল। বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই জাগল আনন্দের প্রবল উচ্ছ্বাস। উত্তেজিত আনন্দিত জুলুদের সশব্দ হাস্যধ্বনি শুনে অভিযাত্রীরাও খুশি।
কিন্তু অভিযাত্রীরা যখন প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে মুখের ছাপ নেবার চেষ্টা করলেন, তখন তারা দেখলেন এই ব্যাপারটা আগের মতো সহজে হওয়ার নয়। প্যারিস প্লাস্টারের ছাপ তোলার হাঙ্গামা যথেষ্ট। ঘন আঠার মতো অর্ধতরল জিনিসটা যখন ব্যক্তিবিশেষের মুখের উপর মাখানো হয়, তখন সেই লোকটির নাকের দুই ফুটো দিয়ে দুটি বড়ো খড় চালিয়ে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয় এবং পূর্বোক্ত তরল প্লাস্টার শুকিয়ে শক্ত না হওয়া পর্যন্ত ওই লোকটির একটুও নড়াচড়া করার উপায় থাকে না। মুখের গোঁফদাড়ি প্রভৃতি ছাপ তোলার আগে তেল দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হয়; কিন্তু তেলের পরিমাণ কম হলে প্লাস্টারের ছাঁচ বা মুখোশ টেনে নেওয়ার সময় মুখের গোঁফদাড়ি ছিঁড়ে মুখের ছাপের সঙ্গে উঠে আসে! ব্যাপারটা মোটেই আরামদায়ক নয়।
তবে এইসব অসুবিধা সহ্য করতে জুলুদের বিশেষ আপত্তি ছিল না। তাদের আপত্তির কারণ অন্য। জুলুদের সামনেই অভিযাত্রীরা জামানির মুখের ছাপ নিলেন। জুলুরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটা দেখল, কিন্তু একজন মুখের ছাপ দিতে রাজি হল না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে ওই ছাপ তুলতে দিলে তাদের দ্বিতীয় মুখ সাদা মানুষদের সঙ্গে থেকে যাবে এবং কোনো শত্রু যদি উক্ত দুই নম্বর মুখ-এ আঘাত করে তবে মুখের প্রকৃত অধিকারীর উপর সেই আঘাত এসে পড়বে। অতএব বহু মূল্যবান উপহারের বিনিময়েও তারা মুখের ছাপ তুলতে দিতে রাজি নয়।
কয়েকজন জাদুকর গম্ভীরভাবে জানাল, জাদুবিদ্যার সাহায্যে এমন অভিনব দুর্ঘটনা থেকে জুলুদের রক্ষা করার ক্ষমতা তাদের নেই। ব্যস! হয়ে গেল! জাদুকর যেখানে ভয় পায়, সেখানে এগিয়ে যাওয়ার সাহস আছে কার?…ইতিপূর্বেও কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের প্রচেষ্টা সংস্কার-অন্ধ মানুষের কাছে পরাজিত হয়েছে, মনে হল আত্তিলিওর দলও কুসংস্কারের কাছে পরাজিত হবে। কিন্তু অভিযাত্রীরা জানতেন কুসংস্কারকে পরাস্ত করতে হলে তার বিরুদ্ধে অন্ধ-সংস্কারকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হয় অবশ্য যদি সে-রকম সুযোগ পাওয়া যায়।
সুযোগ এল অপ্রত্যাশিতভাবে।
বহু দূরবর্তী এক ক্রাল থেকে জনৈক জুলুযোদ্ধা অভিযাত্রীদের তাঁবু পরিদর্শন করতে এল। তার বাঁ-দিকের গাল ফুলেছে দেখে আত্তিলিও কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল বেচারা দাঁতের ব্যথায় ভুগছে, খারাপ দাঁতের জন্যই তার গণ্ডদেশের ওই দুরবস্থা। সিগারেট উপহার দিয়ে আত্তিলিও তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন, তারপর দাঁতের চিকিৎসা করার জন্য এগিয়ে এলেন প্রফেসর।
লোকটিকে হাঁ করতে বলে প্রফেসর তার মুখের ভিতর একটা ক্ষতযুক্ত গর্ত দেখতে পেলেন। লবঙ্গ দিয়ে তৈরি একরকম চটচটে আঠার মতো ঘন পদার্থ দিয়ে ক্ষতটাকে ঢেকে দিলেন প্রফেসর। ওই অদ্ভুত চটচটে পদার্থটি প্রফেসরের নিজস্ব আবিষ্কার। যাতনাদায়ক দাঁতের রোগে ওই বস্তু ছিল অব্যর্থ ঔষধ। কিছুক্ষণের মধ্যে চটচটে জিনিসটা জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যায়, আর তৎক্ষণাৎ দাঁত ব্যথার উপশম হয় মন্ত্রের মতো। লোকটাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুজনে মিলে তাকে ক্যানভাসের উপর শুইয়ে ফেলে মুখে প্যারিস প্ল্যাস্টারের প্রলেপ লাগাতে শুরু করলেন। হঠাৎ দাঁতের যন্ত্রণা কমে যাওয়ায় লোকটাও অবাক হয়ে গিয়েছিল, বাদ-প্রতিবাদ না-করে সে প্রফেসর আর আত্তিলিওর হাতে আত্মসমর্পণ করল। কিছুক্ষণ পরে কাজ শেষ হয়ে যেতেই অভিযাত্রীরা তার মুখের উপর থেকে শক্ত প্লাস্টারের ছাপ, অর্থাৎ লোকটার মুখের ছাপ তুলে ফেললেন।
জুলুযোদ্ধা হতভম্ব হয়ে একবার গালের উপর হাত বুলিয়ে নিল, একবার হাঁ করল, তারপর আবার মুখটা বন্ধ করল। তার ভয়ানক দাঁতের ব্যথা এমন চটপট সেরে যাওয়ায় সে যে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। অভিযাত্রীরা তাকে কিছু উপহার দেবেন বলে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে প্রফেসরের হাতে একটা আসাগাই (বর্শা) গুঁজে দিল।–ডাক্তারের ফি।
পরক্ষণেই দেখা গেল দারুণ আনন্দে চিৎকার করতে করতে জুলুযোদ্ধা তিরবেগে ছুটছে! অসহ্য যন্ত্রণা থেকে এমন আকস্মিকভাবে মুক্তি পেয়ে তার উল্লাস যেন ফেটে পড়তে চাইছে…
পরের দিন অভিযাত্রীরা দেখলেন দ্বিতীয় মুখ সম্বন্ধে জুলুদের ভয় ভেঙে গেছে একদিনের মধ্যেই। স্ত্রী-পুরুষ নিয়ে সর্বসমেত উশটি জুলু এসে অভিযাত্রীদের জানাল, দাঁতের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুখের ছাপ তুলে চিকিৎসা করাতে তাদের আর আপত্তি নেই। আরোগ্যলাভ করতে পারলেই তারা খুশি, দ্বিতীয় মুখ নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে চায় না!…
চিকিৎসার ফল হল অতীব সন্তোষজনক। জুলুরা নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র, হাতে তৈরি সুন্দর সুন্দর কাঠের জিনিস ও আসন অভিযাত্রীদের উপহার দিল। ইতিপূর্বে ওইসব জিনিস দাম দিয়েও কিনতে পারেননি অভিযাত্রীরা বিনীতভাবে, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে অসম্মতি জানিয়েছিল জুলুরা। এখন সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই ওইসব বস্তু উপহার দিয়ে রোগমুক্ত জুলুরা অভিযাত্রীদের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। অভিযাত্রীরা যে শুধু নানারকম ভালো ভালো উপহারই পেয়েছিলেন তা নয়, শতাধিক স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল। এইজন্য অবশ্য প্রফেসরকেই ধন্যবাদ দিতে হয় তাঁর দাঁতের রোগের অব্যর্থ দাওয়াই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্ত্রাস ও বিভীষিকা
জুলুদের দেশে বৃষ্টিপাত একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বৃষ্টিপাতের ফলে বিস্তীর্ণ প্রান্তরগুলো হয়ে ওঠে সবুজ ঘাসের রাজত্ব এবং ওই ঘাসজমি থেকে আহার্য সংগ্রহ করে জুলুদের গৃহপালিত গোরুর পাল মনের আনন্দে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। গোরু হচ্ছে জুলুদের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। গোরুর বিনিময়ে তারা পত্নী সংগ্রহ করতে পারে, তা ছাড়া গোমাংস ও গোদুগ্ধ তাদের উদরের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতেও সাহায্য করে।
বর্ষার জল যে শুধু জুলুদের গো-সম্পদ বৃদ্ধি করে তা নয়, অবিশ্রান্ত ধারাপাত দেশের শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখে। বৃষ্টিপাতের ফলে শ্যাম-সবুজ অরণ্যের বুক থেকে আহার্য সংগ্রহ করে তৃণভোজী জেব্রা, অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি জন্তু বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয় এবং ওইসব পশুর মাংসে জীবনধারণ করে জুলুল্যান্ডের অগণিত সিংহের দল। কিন্তু বৃষ্টি না হলে বন্য পশুরা শুষ্ক বনভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়, আর ক্ষুধার্ত সিংহরা আকৃষ্ট হয় গোমাংস ও নরমাংসের প্রতি ফলে জুলুল্যান্ডের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ধ্বংস করে শুরু হয় ভয়াবহ বিভীষিকার রক্তাক্ত তাণ্ডব।
অনাবৃষ্টি যে জুলুদের পক্ষে কতখানি ক্ষতিকর, কতখানি প্রাণঘাতী সর্বনাশ যে ডেকে আনতে পারে বৃষ্টিবিহীন খরার জ্বলন্ত অভিশাপ–তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছিলেন অভিযাত্রীরা…
আত্তিলিও এবং তার দলবল জুলুল্যান্ডে পদার্পণ করার কয়েক মাস পরেই সেখানে অনাবৃষ্টির সূত্রপাত হয়। শুষ্ক বনভূমি থেকে আহার্য সংগ্রহ করতে না-পেরে বহু তৃণভোজী পশু মৃত্যুবরণ করল। যারা বাঁচল তারা অন্যত্র যাত্রা করল তৃণশ্যামল অরণ্যের সন্ধানে। দক্ষিণ দিকের পথে ছুটল ইম্পালা, অরিক্স, ইল্যান্ড,, জেব্রা, অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি তৃণভোজী পশু। ধাবমান পশুদের খুরে খুরে ধুলো উড়ে দিগন্তকে আচ্ছন্ন করে দিল। পাহাড়ের চূড়ার বিভিন্ন আস্তানা থেকে জুলুরা সেই ধুলোর মেঘ লক্ষ করতে লাগল উদবিগ্ন চিত্তে। অনাবৃষ্টির দ্বিতীয় মাসের মাঝামাঝি সময়ে অদৃশ্য হল সেই ধুলোর মেঘ। সেইসঙ্গে অন্তর্ধান করল তৃণভোজী পশুর দল। বলিষ্ঠ সিংহের দলও তৃণভোজীদের সঙ্গে স্থান ত্যাগ করেছিল, কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক জন্তুগুলো থেকে গেল জুলুল্যান্ডের শুষ্ক অরণ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক একদল তরুণ সিংহ, অভিজ্ঞতার অভাবে যারা বেপরোয়া; বৃদ্ধ সিংহ, দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে যারা অশক্ত, কিন্তু অভিজ্ঞ শিকারির কৌশল ও চাতুর্যে যারা ভয়ংকর; এবং শাবক সমেত সিংহীর দল, যারা বাচ্চার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।
ক্ষুধার্ত সিংহরা এইবার জুলুদের গোরুদের দিকে নজর দিল। বর্শাধারী জুলুযোদ্ধার দল সতর্কভাবে তাদের গোরু রক্ষা করতে সচেষ্ট হল। সিংহরা তখন মানুষের উপর হামলা শুরু করল। কয়েকবার নরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করে জন্তুগুলো খেপে গেল। দলবদ্ধ নেকড়ের মতোই তারা মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, কুটিরের দরজা বন্ধ করেও কেউ আর নিরাপদ বোধ করে না–দরজা ভেঙে নরখাদক সিংহের দল মানুষ ধরতে আরম্ভ করল। সিংহের এমন অদ্ভুত ভয়ংকর আচরণ ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি।
এককভাবে চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল। জুলুরা দল বেঁধে অস্ত্র হাতে ভ্রমণ করত। কাটাগাছের বেড়া দিয়ে জুলুল্যান্ডের ক্রালগুলোকে ঘিরে ফেলা হল। ওইসব ক্রালের চারপাশে সারারাত আগুন জ্বলত। দৈবাৎ আগুন নিভে গেলেই হানা দেবে নরভুক শ্বাপদ। তাই শয্যা আশ্রয় করার আগে প্রত্যেক জুলু কুটিরের বহির্ভাগে অবস্থিত অগ্নিকুণ্ডে সারারাত জ্বলবার মতো কাঠ আছে। কি না দেখে নিত, ওইসঙ্গে কাটার বেড়ার মধ্যেও ফাঁক আছে কি নেই দেখতে তাদের ভুল হত না।
এত সতর্ক হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন ঢাকের আওয়াজে দুর্ঘটনার সংবাদ ভেসে আসতে লাগল। দিনে-রাতে, যেখানে সেখানে, যখন-তখন সিংহরা আক্রমণ চালাতে শুরু করল। নিরস্ত্র বালিকা থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ অস্ত্রধারী যোদ্ধা পর্যন্ত কোনো মানুষকেই রেয়াত করত না হিংস্র শ্বাপদ। দলবদ্ধ সিংহের সঙ্গে বর্শা হাতেই লড়াই করে প্রাণ দিল বহু জুলুযোদ্ধা। তাদের সাহস ও বীরত্বের তুলনা হয় না, কিন্তু ক্ষিপ্ত সিংহদের নিরস্ত করা গেল না কিছুতেই সমগ্র জুলুল্যান্ডের উপর মাংসলোলুপ শ্বাপদের নখদন্তে সৃষ্ট হল সন্ত্রাস ও বিভীষিকার রাজত্ব।
অভিযাত্রীদের কাজকর্মও ব্যাহত হল। জুলুদের পক্ষে দূরদূরান্তের ক্রাল থেকে এখন আর অভিযাত্রীদের তাবুতে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু অভিযাত্রীরা জুলুদের সাহায্য করতে প্রস্তুত হলেন। প্রফেসর বিলকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সিংহের কবল থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত মুষ্টিমেয় হতভাগ্যের চিকিৎসা করতে শুরু করলেন। অনেকে তাঁর চিকিৎসার গুণে বেঁচে গিয়েছিল।
আত্তিলিও গত্তি চিকিৎসার বিষয়ে একেবারে আনাড়ি। কিন্তু তিনিও জুলুদের সাহায্য করতে সচেষ্ট হলেন। তবে ঔষধপত্র বা শল্যচিকিৎসকের ছুরির পরিবর্তে তার হাতে ছিল গুলিভরা রাইফেল। বিলকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন প্রফেসর তার চিকিৎসা কার্যে সাহায্য করার জন্য, সুতরাং সম্পূর্ণ এককভাবেই সিংহ-নিধনে নিযুক্ত হলেন আত্তিলিও। খরার তৃতীয় মাসের মধ্যেই তার রাইফেলের অগ্নিবর্ষী মহিমায় স্তব্ধ হয়ে গেল তিরিশটা সিংহের গর্জিত কণ্ঠ।
কিন্তু তারপরই বিপদ এল অতর্কিতে।
এক শয়তানের চক্রান্তে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন আত্তিলিও।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – দুয়ারে মৃত্যুর ছায়া
টোয়াবেনি ছিল জুলুল্যান্ডের আতঙ্ক। কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে চাইত না। সে নিজেও লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার আগ্রহ প্রকাশ করত না। অভিযাত্রীরা অনেকবার জামানিকে পাঠিয়ে উক্ত ব্যক্তিকে তাদের তাঁবুতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, কিন্তু টোয়াবেনি সাড়া দেয়নি। দুর্দান্ত প্রতাপশালী জিপোসা সর্দার পর্যন্ত টোয়াবেনিকে এড়িয়ে চলত। আত্তিলিও যখন নিজেই এগিয়ে গিয়ে টোয়াবেনির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন তখন তাঁর সঙ্গী হল জুলুদের সর্বাধিনায়ক জিপোসো স্বয়ং। স্পষ্টই বোঝা যায় টোয়াবেনির আস্তানার মধ্যে আত্তিলিওর নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে বলেই জিপোসো তার সঙ্গে গিয়েছিল।
আত্তিলিও একটা কম্বল নিয়ে গিয়েছিলেন টোয়াবেনিকে উপহার দেবার জন্যে। টোয়াবেনি একবার আত্তিলিওর দিকে দৃষ্টিপাত করল, পরক্ষণেই কম্বলটা টান মেরে ছিনিয়ে নিয়ে সে সবচেয়ে বড়ো কুঁড়েঘরটার ভিতর ঢুকে গেল। একটু পরেই অবশ্য কুটিরের বাইরে এসে আত্তিলিওকে উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিল টোয়াবেনি। সেইসঙ্গে ভদ্রতা করে একথাও জানালে যে, তার ক্রাল সর্বদাই আত্তিলিওকে অভ্যর্থনা করতে প্রস্তুত। ইচ্ছে হলেই তিনি যেন তার আস্তানায় চলে আসেন।
টোয়াবেনির ব্যবহার ছিল বেশ স্বাভাবিক ও ভদ্র, কিন্তু আত্তিলিওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ওই লোকটির সম্বন্ধে বার বার সাবধান করে দিল–অন্তরের অন্তস্থলে তিনি অনুভব করলেন টোয়াবেনি তাকে পছন্দ করছে না, সুযোগ পেলেই সে শত্রুতা করবে। অবশ্য প্রথম সাক্ষাৎকারের পর বেশ কয়েকবার আত্তিলিও তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তবে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি। দুটি মানুষের মধ্যে বার বার দেখাসাক্ষাৎ ঘটলে সাধারণত ঘনিষ্ঠতা হয়, কিন্তু নিস্পৃহ ঔদাসীন্যে টোয়াবেনি নিজেকে সর্বদাই স্বতন্ত্র করে রেখেছে, মন খুলে কখনো সে কথা বলেনি আত্তিলিওর সঙ্গে।
চোদ্দোটি স্ত্রীর স্বামী এবং তিরিশটি কন্যার পিতা ছিল টোয়াবেনি। তার পরিবারবর্গের মধ্যে কারো সঙ্গেই আত্তিলিওর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল না, কিন্তু টোয়াবেনির ষোলো বছরের মেয়ে দাবুলি আত্তিলিওর প্রতি আকৃষ্ট হল। খুব সম্ভব বনবালা মদাবুলি তার সহজাত সংস্কার দিয়ে আত্তিলিওর মধ্যে এক সহানুভূতিসম্পন্ন বন্ধুকে আবিষ্কার করেছিলেন। মেয়েটির জীবনে যে একটি সত্যিকারের বন্ধুর দরকার হয়েছিল, পরবর্তী ঘটনাস্রোত থেকে আমরা শীঘ্রই তা জানতে পারব।
একদিন মধ্যাহ্নে জলন্ত আফ্রিকার সূর্য যখন আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে সেইসময় রাইফেল হাতে আত্তিলিও এলেন টোয়াবেনির ক্রালে। সিংহের আক্রমণ থেকে তার ক্রালকে নিরাপদ রাখার জন্য টোয়াবেনি কী ব্যবস্থা করেছে সেইটা দেখাই ছিল আত্তিলিওর উদ্দেশ্য। টোয়াবেনির আস্তানার সামনে গিয়ে আত্তিলিও অবাক হয়ে গেলেন–ক্রালটাকে বেষ্টন করে বিরাজ করছে কণ্টকসজ্জিত গাছপালার এক বিরাট দুর্ভেদ্য ন্যূহ, এবং ব্যুহের চারপাশ ঘিরে সারারাত ধরে জ্বলবার জন্যে সংগৃহীত হয়েছে রাশি রাশি শুকনো কাঠ–একবার তাকিয়েই বোঝা যায় শতাধিক লোকের সাহায্য ছাড়া এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
আত্তিলিও আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন দিনদুপুরে লোকজন, গোরুবাছুর এমনভাবে বেড়ার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে কেন? সিংহগুলো কি এখানে প্রখর দিবালোকের মধ্যেই হানা দিতে শুরু করেছে?… পানীয় জল আনতে গোরুবাছুর চরাতে মানুষজন নিশ্চয়ই বেড়ার বাইরে যাতায়াত করে কিন্তু কোন পথে? কণ্টক-শোভিত ব্যুহের কোথাও তো এতটুকু কঁক দেখা যাচ্ছে না।…
একটা পথের রেখা পাওয়া গেল। আত্তিলিওর মনে হল ওই পথেই লোক চলাচল করে। সন্ধিগ্ধ চিত্তে সেই পথ ধরে বেড়ার দিকে অগ্রসর হলেন আত্তিলিও, আর হঠাৎ তার সামনে প্রায় দশ ফুট জায়গা ফাঁক হয়ে গেল এবং বিভক্ত ফাঁকে আত্মপ্রকাশ করল স্বয়ং টোয়াবেনি!
জা বাব, ভিতরে এসো টোয়াবেনি বলল, তাড়াতাড়ি করো। চারপাশে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে সিংহরা। আমরা ওদের দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু ওরা আমাদের লক্ষ করছে।
আত্তিলিও ভিতরে প্রবেশ করলেন। এমন চমৎকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং বিস্ময়কর দ্বারপথের আবিষ্কার করার জন্য টোয়াবেনির বুদ্ধির তারিফ করলেন আত্তিলিও।
প্রশংসা শুনে খুশি হলেন টোয়াবেনি। এতদিনের মধ্যে সেইদিনই শুধু তার কণ্ঠস্বরে বন্ধুত্বের আভাস পাওয়া গেল–দেখো, কত সহজে কোনো শব্দ না-করে এটা খোলা যায় আর বন্ধ করা যায়।
আত্তিলিও দেখলেন দুটি দড়ির সাহায্যে টোয়াবেনি তার নিরাপদ আশ্রয়ের ভিতর থেকেই কুটিরের ভিতর অবস্থিত দরজাকে ইচ্ছানুযায়ী খুলতে পারে। প্রতিরোধের এমন কৌশল যার মগজ থেকে উৎপন্ন হয়, সেই মগজের অধিকারী যে অতিশয় বুদ্ধিমান সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। টোয়াবেনি জানাল একটু আগেই দরজাটা আর একবার ব্যবহার করার দরকার হয়েছিল। আত্তিলিও ঘটনার বিশদ বিবরণ শুনতে চাইলেন।
আমার গোরুর দল মাঠে ঘাস খাচ্ছিল, হঠাৎ সিংহ তাদের আক্রমণ করল, টোয়াবেনি বলতে লাগল আমি ঘরের ভিতর থেকে দড়ি টেনে দরজা খুলে দিতেই আমার ছেলেরা গোরুগুলোকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দুটো বাছুর এর মধ্যেই সিংহের আক্রমণে মারা পড়েছিল। সিংহেরা যখন বাছুর দুটোর মাংস খেতে ব্যস্ত, সেই সময়টুকুর সুযোগ নিয়েই আমার ছেলেরা ভিতরে ঢুকতে পেরেছিল–আর তারা ভিতরে আসামাত্রই আমি আমার দড়ি টেনে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঠিক সময়মতোই দরজাটা আমি বন্ধ করেছিলাম। কারণ, খিদের প্রথম ঝোঁক কেটে গেলেই সিংহগুলো ভিতরে আসার চেষ্টা করত। ওই পাহাড়টার ওপারে আমার ভাই-এর আস্তানায় ছেলেরা এখন চলে গেছে। ভাই-এর ক্রালটাকে ঘিরে এইরকম একটা বেড়া দেওয়া দরকার, তাকে সাহায্য করবার জন্যই রওনা হয়েছে আমার ছেলেরা।
কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল টোয়াবেনি। তার মুখের উপর ফুটে উঠল। নিস্পৃহ ঔদাসীন্যের পরিচিত ভঙ্গি আর একটি কথাও না-বলে সে হঠাৎ পিছন ফিরে অদৃশ্য হল তার নিজস্ব কুটিরের ভিতরে।
সঙ্গেসঙ্গে বেড়ার সবচেয়ে নিকটে অবস্থিত কুটিরের ভিতর থেকে একটা মুখ বাইরে উঁকি দিল।
মদাবুলি!
আত্তিলিও দেখলেন জুলু বালিকার মুখে আজ আনন্দের চিহ্ন নেই। বিষণ্ণভাবে সে আত্তিলিওকে তার কুটিরের ভিতরে আসতে ইঙ্গিত করল।
আত্তিলিও ভিতরে ঢুকলেন। মদাবুলি জানাল তার মা গেছে সপত্নীদের সঙ্গে গল্প করতে অন্য কুটিরে। মায়ের অনুপস্থিতিতে শিষ্টাচারের ত্রুটি হতে দেয়নি মেয়ে বসবার জন্য অতিথিকে একটা কাঠের আসন এনে দিল মদাবুলি।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর আত্তিলিও জানালেন মদাবুলির মুখে বিষাদের মেঘ তার ভালো লাগে না, তিনি তার হাসিমুখ দেখতে চান।
মদাবুলির মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা দিল। কিন্তু শুধু এক মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই দু-হাতে মুখ ঢেকে সে কেঁদে উঠল। তারপরই মেঝের উপর শুয়ে পড়ে সে ফোঁপাতে লাগল। কান্নার আবেগে তার দেহটা কাঁপতে লাগল থরথর করে।
আত্তিলিও হয়ে গেলেন হতভম্ব। টোয়াবেনি যদি এই কান্নার শব্দ শোনে তাহলে সে কী মনে করবে? …কথাটা চিন্তা করতেই আত্তিলিওর খারাপ লাগল। তিনি মনে মনে কামনা করলেন এই মুহূর্তে যেন কেউ এসে পড়ে, তাহলে এই অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতি থেকে তিনিও পরিত্রাণ পেতে পারেন। এই কথা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই দ্রুত ধাবমান পদশব্দ তার কানে এল। কিন্তু না–কেউ এল না। খুব সম্ভব আত্তিলিও ভুল শুনেছেন। একটা মোরগ ক্রুদ্ধস্বরে ডেকে উঠল, গোয়ালের বেষ্টনী থেকে ভেসে এল গোবৎসের করুণ কণ্ঠধ্বনি–তারপর আবার সব চুপচাপ।–কান্নার প্রথম আবেগ সামলে নিল মদাবুলি, দুএকবার ফুঁপিয়ে সে আত্মসংবরণ করল। অবশেষে মমর্যাতনার তীব্র উচ্ছ্বাস কেটে গেল, শান্ত সংযত স্বরে কথা বলতে পারল জুলু বালিকা, টোয়াবেনি ওকে খুন করবে কিংবা আমাকে।
আমাকে অর্থাৎ মদাবুলিকে খুন করা টোয়াবেনির মতো বাপের পক্ষে খুব অসম্ভব নয়, কিন্তু আত্তিলিওর জিজ্ঞাস্য হল এই ও কে?
ধীরে ধীরে সব কিছুই জানতে পারলেন আত্তিলিও। ও হচ্ছে এক তরুণ জুলুযোদ্ধা, নাম নগো। উক্ত জুলু যুবকের সঙ্গে আত্তিলিও ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন। মদাবুলি অসংকোচে জানাল সে আর নগো পরস্পরকে বিবাহ করতে চায়। টোয়াবেনিকে তিরিশটা গোরু কন্যাপণ হিসেবে দিতে চেয়েছিল গো, কিন্তু টোয়াবেনি তার সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিতে রাজি হয়নি।
এতগুলো গোরুর বিনিময়েও টোয়াবেনি কন্যাদান করতে রাজি হয়নি শুনে অবাক হয়ে গেলেন আত্তিলিও! নগোকে তিনি খুব ভালো করেই জানেন, পাত্র হিসাবে সে চমৎকার ছেলে তবে টোয়াবেনির রাজি না-হওয়ার কারণ কী?
তার প্রশ্নের উত্তরে বালিকা জানাল টোয়াবেনি একসময়ে প্রভাবশালী জাদুকর ছিল। টোয়াবেনির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার করে সর্দার জিপোসো এবং ইনডানাদের সভা (জ্ঞানী ব্যাক্তিদের সভা) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জাদুকরের সম্মানিত পদ থেকে খারিজ করে দেয়। এই ঘটনা ঘটেছিল কয়েক বছর আগে। অভিযোগ যে এনেছিল সে হচ্ছে জুলুদের এক ছোটোখাটো নেতা, গো তারই পুত্র। কিছুদিন আগে অভিযোগকারী–অর্থাৎ, গোর পিতা সিংহের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। শত্রু হিংহের কবলে মারা গেছে বটে কিন্তু টোয়াবেনির বিদ্বেষ আজও জাগ্রত যার অভিযোগের ফলে টোয়াবেনি পদমর্যাদা হারিয়েছে, তার পুত্রের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়ার কথা সে ভাবতেই পারে না।
টোয়াবেনির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বক্তব্য কী ছিল, অথবা কোন ধরনের ছিল–এই সব প্রশ্নের উত্তর না-দিয়ে বার বার আত্তিলিওকে এক কথা বলতে লাগল, বাবা বলেছে গোর। সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সম্মতি দেবার আগে সে মেয়ের আর গোর মরা মুখ দেখবে।
আত্তিলিও জুলুদের নিয়মকানুন যেটুকু জানেন, তা থেকে বুঝলেন এই বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়।
জা বাব, মদাবুলি বলল, আমি তোমার সাহায্য চাই।
তা তো বুঝলুম, আত্তিলিও মনে মনে বললেন, কিন্তু আমি বিদেশি মানুষ, জুলুদের সামাজিক ব্যাপারে হাত দেব কী করে?
তাঁর মৌনব্রত দেখে মন্দাবুলি নিরস্ত হল না। সে আত্তিলিওকে এই ব্যাপারে টোয়াবেনির সঙ্গে কথা কইতে অনুরোধ করল। সে এ-কথাও বলল আত্তিলিও যদি জিপোশোকে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বলেন, তাহলে হয়তো মনস্কামনা পূর্ণ হতে পারে সর্বাধিনায়ক জিপোসো যদি চায় তাহলে টোয়াবেনির ইচ্ছার বিরুদ্ধেও এই বিবাহ হওয়া সম্ভব, জুলুল্যান্ডে জিপোসোর কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা তারও নেই।
অশ্রুসজল চক্ষে বালিকা বার বার তার সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগল, তার বিশ্বাস আত্তিলিও যদি হস্তক্ষেপ না-করেন তাহলে তার মৃত্যু নিশ্চিত।
এই মেয়েটিকে তিনি কী উপায়ে সাহায্য করতে পারেন সেই কথাই ভাবছিলেন আত্তিলিও, হঠাৎ তার চোখের সামনে মদাবুলির সমস্ত শরীর হল আড়ষ্ট, মুখ হল রক্তহীন, বিবর্ণ ও বিকৃত!
আত্তিলিও চমকে উঠলেন, বিদ্যুৎ ঝলকের মতো এক ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা তার মনে এল, নিশ্চয়ই ওকে অজান্তে বিষ খাওয়ানো হয়েছে?
আর ঠিক সেই মুহূর্তে মদাবুলির পিছনে ছায়া-আচ্ছন্ন কুটিরের যে জায়গায় মধ্যাহ্নের সূর্যালোক প্রবেশ করেছিল, সেই আলোক-উজ্জ্বল স্থানে আবির্ভূত হল দ্রুত ধাবমান এক ছায়া!
আত্তিলিও বুঝলেন বিষ-টিষ কিছু নয়; অতিজাগ্রত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রখর অনুভূতি দিয়ে আসন্ন বিপদের আভাস পেয়েছে বনবালা দারুলি তাই এই ভাবান্তর।
বালিকার পিছনে, এই ছ-ফিট দূরে কুটিরের প্রবেশপথে নড়ে উঠেছে সর্পিল ছায়া।
.
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বিপদ
সাপের মতো লম্বা দোদুল্যমান ছায়াটা যে একটি আন্দোলিত লাঙ্গুলের ছায়া ছাড়া আর কিছুই নয়, এ-কথা সহজেই বুঝলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে ছায়ার পিছনে অবস্থিত নিরেট কায়ার স্বরূপ নির্ণয় করতেও তাঁর ভুল হল না–সমগ্র আফ্রিকাতে ওইভাবে চাবুকের মতো লেজ আছড়াতে পারে একটিমাত্র জীব–সিংহ!
ভয়াবহ পরিস্থিতি। দরজার ওপাশে অপেক্ষা করছে ক্ষুধিত শ্বাপদ! যেকোনো মুহূর্তেই সে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে!
সতৃষ্ণ নয়নে রাইফেলটার দিকে তাকালেন আত্তিলিও। ছায়া দেখে বোঝা যায় সিংহ ওত পেতে বসে আছে দরজার বাইরে বাঁ-দিকে। ডান দিক দিয়ে ঘুরে রাইফেল তুলতে গেলে অস্ত্র তুলে নেবার আগেই সিংহ তাকে দেখতে পাবে এবং তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাঁ-দিক দিয়ে ঘুরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাইফেলের নল ধরে সেটাকে আনা যায় বটে, কিন্তু ওইভাবে অস্ত্রটাকে বাগাতে হলে সিংহের খুব কাছাকাছি যেতে হয়।
আত্তিলিও শেষোক্ত উপায় অবলম্বন করতে চাইলেন। তিনি বসে ছিলেন, এইবার উঠে দাঁড়ালেন; আস্তে আস্তে, নিঃশব্দে।
দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন আত্তিলিও। কাটাগাছ ঘেরা অতি উঁচু বেড়াটাকে যে জানোয়ার লাফ মেরে ডিঙিয়ে আসতে পেরেছে, সে নিশ্চয়ই অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও বৃহৎ দেহের অধিকারী। দারুণ ক্ষুধার্ত না হলে সিংহ এমন দুঃসাহসের পরিচয় দেয় না–আত্তিলিও বুঝলেন সিংহকে হত্যা না করতে পারলে আজ মৃত্যু তার নিশ্চিত।
কিন্তু ঘরের মেঝেতে বিছানো মাদুরটাই গোলমাল বাধাল। প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে কট কট শব্দে প্রতিবাদ জানাতে লাগল মাদুর! আত্তিলিও মনে মনে মাদুরটাকে অভিশাপ দিলেন। কুটিরের ভিতর বদ্ধ স্থানে ওই কট কট শব্দটা তার কানে পিস্তলের আওয়াজের মতো আঘাত করছিল, অপেক্ষমাণ শ্বাপদ যে ওই আওয়াজ থেকেই শত্রুর গতিবিধি বুঝতে পারছে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্য উপায় না-থাকায় আত্তিলিও ওইভাবেই এগিয়ে চললেন। তিনি জানতেন, উজ্জ্বল দিবালোকের ভিতর দাঁড়িয়ে কুটিরের ম্লান অন্ধকারে জন্তুটা ভালো দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু একটু পরে অন্ধকারটা সহ্য হয়ে গেলেই সে ভিতরে ঢুকে পড়বে। ইতিমধ্যে যদি তিনি কিছু না করতে পারেন, তবে সিংহের কবলে তার এবং মদাবুলির অবস্থা যে কতদূর শোচনীয় হতে পারে সে-কথা চিন্তা করে শিউরে উঠলেন আত্তিলিও।
মদাবুলির সমস্ত শরীর তখন আড়ষ্ট। চোখে না-দেখেও সে বুঝতে পেরেছে একটা ভয়ংকর ঘটনার প্রস্তুতি চলেছে তার পিছনে। বালিকার ভীতিবিহ্বল দুই চক্ষু লক্ষ করছে আত্তিলিওর গতিবিধি এবং তার জিহ্বা হয়ে গেছে মৌন, নির্বাক। খুব ধীরে ধীরে তাকে পেরিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালেন আত্তিলিও সাহেব।
প্রবেশপথের মুখেই দাঁড়িয়ে আছে সিংহ। তার দেহটা আত্তিলিওর চোখের আড়ালে, অদৃশ্য, দৃষ্টিগোচর হচ্ছে শুধু ছায়া আর কর্ণগোচর হচ্ছে দেয়ালের ওপার থেকে ভেসে আসা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গভীর জান্তব শব্দ।
চট করে থাবা চালিয়ে দিলেই এখন সিংহ আত্তিলিওকে ধরে ফেলতে পারে। কিন্তু রাইফেলটা এসে গেছে তার হাতের নাগালের মধ্যে যা করতে হয় এখনই করতে হবে, সময় নেই–আত্তিলিও হাত বাড়ালেন।
তাঁর ঘর্মাক্ত হাতের মুঠি রাইফেলের ঠান্ডা নলটাকে স্পর্শ করল। সঙ্গেসঙ্গে কানে এল শ্বাপদ কণ্ঠের গর্জনধ্বনি। রাইফেল উঠে এল হাতে। একটা সোনালি বাদামি দেহ চমকে উঠল বিদ্যুৎ ঝলকের মতো–
প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়লেন আত্তিলিও! পশুরাজ ভারসাম্য রাখতে পারল না, সংঘাতের . ফলে সেও মাটির উপর গড়িয়ে পড়ল।
সিংহ আবার উঠে আক্রমণ করার আগেই আত্তিলিও গড়াতে গড়াতে খোলা দরজা দিয়ে কুটিরের বাইরে চলে গেলেন। আকস্মিক বিপদে আত্তিলিওর বুদ্ধিভ্রংশ হয়নি, গড়াগড়ি দেবার সময়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছিলেন তিনি অন্ধকার কুটির থেকে বাইরে তীব্র সূর্যালোকের মধ্যে এসে তাঁর চক্ষু যে সাময়িক দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে সেই ভয়াবহ তথ্য চরম মুহূর্তেও তিনি ভুলে যাননি, হাতের রাইফেলটাও তিনি হস্তচ্যুত হতে দেননি–অস্ত্রটাকে তিনি ধরে রেখেছিলেন শক্ত মুঠিতে।
আত্তিলিও যে-মুহূর্তে রোদের দিকে পিছন ফিরে রাইফেল তুলে কুটিরের ভিতর দৃষ্টিপাত করলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সিংহও ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ল এবং চূড়ান্ত ফয়সালা করার জন্য তাকে লক্ষ করে লাফ দিতে উদ্যত হল–হাঁটু পেতে বসে রাইফেল উঁচিয়ে বললেন আত্তিলিও, শুয়ে পড়ো মদাবুলি।
বিনা বাক্যব্যয়ে শুয়ে পড়ল মদাবুলি। সঙ্গেসঙ্গে প্রচণ্ড সিংহনাদ। রাইফেলের কর্কশ ধমক। বারুদের উগ্র গন্ধের সঙ্গে মিশল শ্বাপদ-দেহের দুর্গন্ধ এবং রক্তাক্ত গন্ধ!
আবার জাগল শ্বাপদ কণ্ঠের ভৈরব হুংকার! রক্তাক্ত শরীরে গর্জে উঠল আহত সিংহ, মাথার উপর দুলে দুলে উঠল ঝাকড়া কেশর; তার জ্বলন্ত দৃষ্টি একবার পড়ছে ধরাশায়ী াবুলির দিকে, আবার ঘুরে যাচ্ছে কুটিরের বাইরে উপবিষ্ট অস্ত্রধারী মানুষটার দিকে সে এখনও ঠিক করতে পারছে না কার উপর প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। সিংহ মনস্থির করার আগেই আত্তিলিওর রাইফেল আবার অগ্নিবর্ষণ করল। লক্ষ্য ব্যর্থ হল না, চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল সিংহের মাথার খুলি সব শেষ! পশুরাজ আর কোনোদিন নরমাংস খেতে চাইবে না।
…কিন্তু মদাবুলি? সে কথা কইছে না কেন? বালিকার দেহের উপর ঝুঁকে পড়লেন আত্তিলিও। সিংহ তার দেহস্পর্শ করতে পারেনি। সে অজ্ঞানও হয়নি, দারুণ আতঙ্ক সাময়িকভাবে তার বাশক্তি ও চলৎশক্তিকে লুপ্ত করে দিয়েছে, কিন্তু তার চেতনা সম্পূর্ণ জাগ্রত দুই চোখের নীরব ভাষায় বালিকা আত্তিলিওকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল।
আর তারপর যেন শুরু হল নরকগুলজার। চতুর্দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল বহু মানুষের পায়ের আওয়াজ। ভয়ার্ত গোরু বাছুরের হাম্বা ধ্বনি। টোয়াবেনি এসে উপস্থিত হল চেঁচাতে চেঁচাতে। সেইসঙ্গে সেখানে ভিড় করল বহু নারী ও বালক-বালিকা, সিংহের মৃতদেহ নজরে আসামাত্র আবার পিছিয়ে গেল সভয়ে।
আত্তিলিও কুটিরের বাইরে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। ইতিমধ্যে তিনি রাইফেলে আবার গুলি ভরে নিয়েছেন এবং তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মদাবুলির বাপ টোয়াবেনি। টোয়াবেনির জলন্ত দুই চোখের দিকে তাকিয়ে আত্তিলিওর মনে হল চোখ নয়, একজোড়া ধারালো ছুরির ফলা ঝকঝক করছে হত্যার আগ্রহে। তিক্ত কণ্ঠে আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন, সিংহ ভিতরে এল । কী করে?
অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গিতে উত্তর এল, জানি না। আমি কুটিরের ভিতরে ছিলাম। সিংহ কী করে এসেছে বলতে পারব না।
টোয়াবেনি একটু থামল, তার পাতলা নাকের উপর ফুটে উঠল কুঞ্চনরেখার চিহ্ন, বলল, গন্ধ পাচ্ছি, আমি ভয়ের গন্ধ পাচ্ছি।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ – রহস্যময় ঢাক ও নিগ্রোদের অজ্ঞতা
ভয়, টোয়াবেনি আবার বলল, আমি ভয়ের গন্ধ পাচ্ছি।
খুব অদ্ভুত কথা সন্দেহ নেই। ভয়ের আবার গন্ধ কী? কিন্তু শুধু যে কথাটাই অদ্ভুত তা নয়, টোয়াবেনির বলার ভঙ্গিও ছিল অদ্ভুত রহস্যময়।
আত্তিলিও বেড়ার গায়ে লাগানো দরজার দিকে চাইলেন। দরজাটা ঠিক মদাবুলির কুঁড়েঘরের দিকে–সব ঠিক আগের মতোই আছে? … না! সব ঠিক নেই। আত্তিলিও সাহেবের তীক্ষ্ণদৃষ্টি ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছে তাঁর জুতোপরা পায়ের ছাপগুলো ধুলোর উপর থেকে অদৃশ্য। খুব তাড়াতাড়ি কেউ ওই ছাপগুলো মুছে ফেলেছে!
কে? কেন? কোন উদ্দেশ্যে?
নীচু হয়ে ভালো করে জমি দেখতে লাগলেন আত্তিলিও–তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একটা পায়ের ছাপ উক্ত ব্যক্তির দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেই সবুট পদচিহ্নকে প্রায় লুপ্ত করে তার উপর আত্মপ্রকাশ করেছে আর একটা গুরুভার জীবের সুগভীর পদচিহ্ন–সিংহের পায়ের দাগ।
ব্যাপারটা এইবার আত্তিলিওর বোধগম্য হয়েছে। কোনো এক ব্যক্তি টোয়াবেনির আস্তানায় তার উপস্থিতির সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছিল বলেই জুতোর ছাপগুলো হয়েছে অদৃশ্য, উক্ত ব্যক্তির পরিচয় আর উদ্দেশ্যও এখন তার কাছে গোপন নেই।
সিংহের মুখে যদি তার দেহটা টোয়াবেনির ক্রাল ছেড়ে অদৃশ্য হত, তবে কারো পক্ষে সঠিক ঘটনার অনুমান করা সম্ভব ছিল না; কারণ, আত্তিলিও যে অকুস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন সে-কথা শুধু জানত টোয়াবেনি। হ্যাঁ, মৃন্দাবুলিও জানত আত্তিলিওর উপস্থিতি কিন্তু নরখাদক সিংহ তার নিকটস্থ দুটো মানুষকে জীবিত রাখত কি? অতএব দেখা যাচ্ছে জুতো পরা পায়ের ছাপগুলো যদি মুছে ফেলা যায়, তাহলে সিংহের কবলগ্রস্ত শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের উপস্থিতির আর প্রমাণ থাকে না তৃতীয় ব্যক্তির সম্মুখে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, বনের জানোয়ার মানুষের ইচ্ছা পূরণ করবে কেন? তা করবে না, কিন্তু বন্ধ দরজা যদি হঠাৎ খুলে গিয়ে খাদ্যসংগ্রহের পথ উন্মুক্ত করে দেয়, তবে সবচেয়ে কাছাকাছি জ্যান্ত খাবারের দিকেই এগিয়ে আসবে মাংসলোলুপ শ্বাপদ এবং মন্দাবুলির যে কুঁড়েঘরটাতে আত্তিলিও ঢুকেছিলেন সেটা যে দরজার সবচেয়ে নিকটবর্তী কুটির সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। সমস্ত পরিকল্পনাটি নিখুঁত। গোলমাল শুনে অন্যান্য কুটির থেকে বেরিয়ে এসে জুলুরা কেউ আত্তিলিওর জুতোর ছাপ দেখতে পেত না। আত্তিলিও যদি সিংহের মুখে উধাও হতেন, তবে তো কথাই নেই–কিন্তু যদি তাকে ফেলে মৃন্দাবুলিকে তুলে নিত তাহলেও নিকটেই অবস্থিত আত্তিলিওকে নিশ্চয়ই সে জ্যান্ত রাখত না, এবং নখে দন্তে ছিন্নভিন্ন অভিযাত্রীর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে টোয়াবেনি যখন শপথ করে বলত তার অজ্ঞাতসারে সাদা মানুষটি মদাবুলির কুটিরে প্রবেশ করেছে, তখন তার কথাই অভ্রান্ত সত্য বলে গৃহীত হত–এমনকী সর্বাধিনায়ক
জিপোসোর মতো বুদ্ধিমান মানুষও আত্তিলিওর মৃত্যুর জন্য নরখাদক সিংহকেই দায়ী করত–কাটার বেড়াতে ঘেরা আস্তানার মধ্যে সিংহের অনুপ্রবেশ কী করে ঘটল তাই নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না।
আর একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল, আত্তিলিওর ব্যঙ্গোক্তি শোনা গেল, তবে ওই দরজাটা চমৎকার। খুবই কার্যকরী দরজা। এবার ওটা দয়া করে খুলে দাও, আমি বাইরে যাব।
আত্তিলিও ভেবেছিলেন টোয়াবেনি ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে, চিৎকার করে অভিশাপ দেবে, হাতের বর্শা তুলে মারতে আসবে কিন্তু না। সে-রকম কিছুই সে করল না। এক গাল হেসে দড়ি ধরে টান মারল টোয়াবেনি, দরজা খুলে গেল আর দরজা খোলার সময়ে তার একটা পা এসে পড়ল অবশিষ্ট একমাত্র জুতোর ছাপটার উপর। •
ওই ছাপটাকে অবহেলা করা ঠিক হয়নি, আত্তিলিও বললেন, কিন্তু বড়ো দেরি হয়ে গেছে, ওটা আমি দেখে ফেলেছি।
এখন সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন আত্তিলিও–তিনি আর মন্দাবুলি যখন কথা বলছিলেন তখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি মেয়ের কথা শুনেছে টোয়াবেনি, তারপর ফিরে গিয়ে নিজস্ব কুটিরের নিরাপদ স্থান থেকে দড়ি টেনে দরজা খুলে দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করেছে ক্ষুধার্ত সিংহের জন্য–সে জানত চারদিকে ওত পেতে বসে আছে দলে দলে নরখাদক শ্বাপদ, দরজা খোলা থাকলে এক বা একাধিক সিংহের আবির্ভাব ঘটবেই ঘটবে। টোয়াবেনি যা ভেবেছিল তাই হল। খোলা দরজা দিয়ে একসময়ে প্রবেশ করেছে পূর্বোক্ত সিংহ; শয়তান জাদুকরও সঙ্গেসঙ্গে দরজা বন্ধ করতে একটুও দেরি করেনি! তারপর সে অবাধ্য কন্যা ও পরচর্চায় নিযুক্ত সাদা মানুষটার অপঘাত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেছে সাগ্রহে! সিংহ তার শিকার নিয়ে মন্দাবুলির কুটির থেকে বেরিয়ে এলেই সে আবার দড়ি টেনে শ্বাপদের পলায়নের পথ মুক্ত করে দিত কিন্তু এমন চমৎকার পরিকল্পনাটা নষ্ট হয়ে গেল রাইফেলের অগ্নিবর্ষী মহিমায়। গুলির আওয়াজ শুনেই বেরিয়ে এসেছে টোয়াবেনি–সঙ্গেসঙ্গে সে বুঝেছে সর্বনাশ হয়েছে, সব কিছু ভেস্তে দিয়েছে সাদা মানুষের রাইফেল…।
উদবিগ্ন চিত্তে তাবুর দিকে পা চালালেন আত্তিলিও। পথের মধ্যে আর কোনো সিংহের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। অন্যদিনের মতো সিংহ শিকারের চেষ্টা করলেন না তিনি। সিংহের আকস্মিক আক্রমণ তাকে ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট দুর্বল করে দিয়েছিল–অন্তত সেদিনটা তিনি ওই ভয়ংকর জীবের মারাত্মক সান্নিধ্য এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলেন। নরখাদকের চাইতে নরঘাতকের দুরভিসন্ধির কথা ভেবেই তিনি বেশি উদবিগ্ন বোধ করেছিলেন তিনি বুঝেছিলেন মদাবুলি আর নগো এখন মোটেই নিরাপদ নয়। যেকোনো মুহূর্তে শয়তানের চক্রান্তে তাদের প্রাণহানি ঘটতে পারে। আত্তিলিও যে তার শয়তানি ধরে ফেলেছিলেন, সিংহের আবির্ভাবের রহস্য যে তার কাছে গোপনীয় নেই, সে-কথা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে টোয়াবেনি–অতএব আত্তিলিওর উপরেও সে হামলা চালাতে পারে যখন-তখন এবং সেই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা যে কমান্ডার সাহেবের মনে উঁকি দেয়নি তা নয়।
কাল সকালে উঠে আমার প্রথম কাজ হচ্ছে জিপোসোর সঙ্গে দেখা করা–আত্তিলিও মনে মনে বললেন। তিনি জানতেন সর্বাধিনায়ক তার কথা বিশ্বাস করবে।
তাবুতে ঢুকতেই জামানি তাকে জানাল পরিস্থিতি খুব খারাপ। সারাদিন ধরে টমটম (ঢাক) বেজেছে। ওই শব্দের সূত্র ধরে জানা গেছে যে, দলবদ্ধ সিংহের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে জুলুদের দুটি আস্তানা। বিল আর প্রফেসর বিশ্রাম নিতে তাবুতেও এসেছিলেন, সিংহ-ঘটিত দুঃসংবাদ কর্ণগোচর হওয়ামাত্র তারা ওষুধপত্র আর রাইফেল নিয়ে অকুস্থলের দিকে ছুটে গেছেন। তবে আরও খারাপ খবর আছে–জুলুল্যান্ডের পশ্চিম অংশে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে।
বিদ্রোহ! কার বিরুদ্ধে? চমকে প্রশ্ন করলেন আত্তিলিও।
জাতির মাতব্বর আর জাদুকরদের বিরুদ্ধে, জামানি বলল, ওরা সিম্বাদের (সিংহদের) থামাতে পারছে না বা থামাচ্ছে না। একজন জুলু-সর্দারকে তির ছুঁড়ে মেরে ফেলা হয়েছে। জিপোসোর হয়ে খাজনা আদায় করতে গিয়েছিল ওই সর্দার। তার অনুচরকে তির মেরে খুন করা হয়েছে শুনে জিপোসো ভয়ানক খেপে উঠেছে, সে চলে গেছে হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে সঙ্গে গেছে জুলুল্যান্ডের সেরা দু-শো যোদ্ধা।
বাঃ। চমৎকার, আত্তিলিও ভাবলেন, জিপোসোর কাছ থেকে এখন আর কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না।
আর সুকামবানা–জামানি আবার বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু হঠাৎ থেমে গিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে ছুটে চলে গেল।
সুকামবানা নামক লোকটিকে চিনতেন আত্তিলিও। সে ছিল জুলু-শিকারিদের জাদুকর, অত্যন্ত বেয়াড়া ধরনের লোক টোয়াবেনির স্বল্প সংখ্যক বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। ধাঁ করে আত্তিলিওর মাথার ভিতর একটা ভয়াবহ সম্ভাবনা বিদ্যুতের মতো চমকে উঠল–সুকামবনা আর টোয়াবেনির অশুভ যোগাযোগ কোনো ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের সূচনা করছে না তো?..
নৈশভোজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আত্তিলিও তাঁর তাঁবুতে জামানিকে ডেকে পাঠালেন। জামানি সহজভাবেই তার সঙ্গে দেখা করতে এল, কারণ, প্রত্যেক রাতেই পরের দিনের কর্মসূচি সে আত্তিলিওর কাছে জানতে পারত। কিন্তু সেসব কথা না-তুলে মাসাংগা যখন তাকে সুকামবানার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন সে ঘাবড়ে গেল। মুখ ফসকে দু-একটা কথা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য জামানি তখন মনে মনে নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছে, কিন্তু এখন আর আত্তিলিও তাকে ছাড়তে রাজি নন–জেরার মুখে সে আরও কয়েকটা গোপনীয় কথা ফাঁস করে ফেলল। শেষকালে আত্তিলিও যখন শপথ করে বললেন সর্বাধিনায়ক জিপোসোকে তিনি কিছু বলবেন না, তখনই সব কিছু খুলে বলতে রাজি হল জামানি।
জামানির বক্তব্য সংক্ষেপে পরিবেশিত হলে যা হয় তা হচ্ছে এই
বর্ষার দেবতা আনজিয়ানা জুলুদের পূজা প্রার্থনাআর কাকুতিমিনতি শুনেও অবিচলিত; বৃষ্টির নাম নেই, খরদাহে জ্বলছে জুলুদের দেশ, সিংহরা সংখ্যায় বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে তাদের সাহস আর ঔদ্ধত্য জন্তুগুলো এখন আর মানুষকে ভয় করে না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য জুলুল্যান্ডের মানুষ অতীন্দ্রিয় জগৎকে অর্থাৎ প্রেতাত্মাদের দায়ী করছে। আত্তিলিওর কাছে টোয়াবেনি বলেছিল তার ছেলেরা নাকি টোয়াবেনির এক ভাই-এর কালে গেছে একটা বেড়া বাঁধার কাজে সাহায্য করতে–কথাটা আদপেই সত্যি নয়। একদল ক্ষিপ্ত জুলুকে সংঘবদ্ধ করার জন্য টোয়াবেনির ছেলেরা যেখানে গিয়েছিল সেটি হচ্ছে আর এক শয়তানের আস্তানা–সুকামবানার ক্রাল!
জামানির বক্তব্য থেকে আরও একটি তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেন আত্তিলিও সুকামবানার সঙ্গে নাকি জরুরি পরামর্শ করেছেন আনজিয়ানা স্বয়ং! এই অতি মূল্যবান সংবাদটি অবশ্য সুকামবানা নিজেই জুলুদের জানিয়েছে, জামানিও বাদ যায়নি।
এই পর্যন্ত বলেই জামানি হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল, তার কথাগুলো মুখের ভিতর আটকে যেতে লাগল বার বার; ভাঙা ভাঙা গলায় ফিস ফিস করে ভয়ার্ত জামানি যা বলল তা থেকে আত্তিলিও বুঝলেন সুকামবানা নাকি সবাইকে বলেছে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী হচ্ছে এক জুলুযোদ্ধা! সুকামবানার মতে উক্ত জুলুযোদ্ধার চোখ দুটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে অমঙ্গলের অভিশাপ এবং এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উদ্ধার লাভ করতে হলে অবিলম্বে অভিশপ্ত চক্ষুবিশিষ্ট ওই মানুষটিকে শাস্তি দেওয়া দরকার কিন্তু অনেক মানুষের ভিড়ের ভিতর থেকে প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে হলে গন্ধ বিচারের সভায় যে-মানুষটি ওইভাবে বিচার করতে সক্ষম, সেই অদ্বিতীয় জাদুকরকে তার অধিকৃত পদ থেকে খারিজ করে তার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে ঈর্ষাকাতর জ্ঞানী ব্যক্তিদের সভা এবং সর্দার জিপোসো। বর্ষার দেবতা আনজিয়ানা এই অবিচারে ক্রুদ্ধ হয়েছেন, অনাবৃষ্টির জন্য জিপোসোর অবিচারও কিছুটা দায়ী বলে মতপ্রকাশ করেছে সুকামবানা।
জিপোসো এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের বিচারে টোয়াবেনিকে যে দোষী সাব্যস্ত করে জাদুকরের সম্মানিত পদ থেকে বিচ্যুত করা হয় তা শুনেছিলেন আত্তিলিও–অতএব তিনি সহজেই বুঝতে পারলেন সুকামবানার উল্লিখিত জাদুকরটি টোয়াবেনি ছাড়া আর কেউ নয়।
জামানির কাছ থেকে আরও একটি সংবাদ জানতে পারলেন আত্তিলিও। সংবাদটি হচ্ছে এই–
জিপোসো বিদ্রোহ দমনে যাত্রা করার আগে সুকামবানা গন্ধের সাহায্যে বিচার করার অনুমতি চেয়েছিল। জিপোশো অনুমতি দেয়নি। সে জানত গন্ধ বিচার অনিবার্যভাবেই নরহত্যা ঘটাবে, এমনকী গণহত্যার মতো বীভৎস কাণ্ড ঘটাও অসম্ভব নয়।
কিন্তু জিপোসো এখন অনুপস্থিত, সুকামবানা আর টোয়াবেনিকে বাধা দেবে কে? আত্তিলিও বললেন, তাহলে নিশ্চয়ই কাল ওরা গন্ধ বিচারের সভা ডাকছে।
না, না, কাল নয়, জামানি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, কাল নয় মাসাংগা, কাল কিছু হবে না।
তবে? কবে হবে ওই বিদঘুঁটে কাণ্ড?
জবাব নেই। জামানি আবার বোবা। মাসাংগার অনেক অনুরোধ-উপরোধেও তার মৌনভঙ্গ হল না।
পরের দিন কোথাও গেলেন না আত্তিলিও, তাবুতেই বসে থাকলেন। ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। আত্তিলিও ঢাকের ভাষা জানেন না, কিন্তু ঘন ঘন দ্রুততালে সেই ধ্বনিতরঙ্গের প্রবল উত্তেজনা তিনি অনুভব করতে পারলেন। ঢাক কী বলছে জানার জন্য তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। কিন্তু জানবেন কী করে? তাঁবুর নিগ্রোরা হঠাৎ ঢাকের ভাষা ভুলে গেছে! আত্তিলিওর বিশ্বস্ত অনুচর জামানিও ব্যতিক্রম নয়। বার বার প্রশ্ন করে একই উত্তর পেলেন আত্তিলিও–ঢাকের ভাষা তারা নাকি কিছুই বুঝতে পারছে না! এক রাতের মধ্যে আয়ত্ত-বিদ্যার এমন হঠাৎ বিলুপ্তি এবং স্মরণশক্তির এমন আকস্মিক বিপর্যয় দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আত্তিলিও!…
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ – গন্ধের বিচার
রাত এল। যথানিয়মে আবার এল প্রভাত। আজ আর ঢাক বাজছে না। আগের দিনের অবিরাম ধ্বনিতরঙ্গের পরে এই অস্বাভাবিক স্তব্ধতা যেন ভয়ংকর এক ঘটনার পূর্বাভাস।
আত্তিলিও উঠে দাঁড়ালেন, জামাকাপড় পরে প্রস্তুত হলেন, তারপর পদার্পণ করলেন তাঁবুর বাইরে। জামানিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আমি টোয়াবেনির কাছে যাচ্ছি। তুমিও সঙ্গে চলো। আত্তিলিও যা ভেবেছিলেন তাই হল–জামানি তার আদেশ অমান্য করে দাঁড়িয়ে রইল এবং বার বার তাকে তাঁবু ছেড়ে বাইরে যেতে নিষেধ করল। সে এ-কথাও বলল, তার নিষেধ অগ্রাহ্য করা মাসাংগার উচিত নয়।
আত্তিলিও শুনলেন না। তিনি জানতেন জামানি তাকে ভালোবাসে, তার বিপদ হতে পারে বলেই সে তাকে কোথাও যেতে বারণ করছে। কিন্তু আত্তিলিওর কানে তখনও বাজছে জুলু বালিকার কাতর প্রার্থনা–জা বাব, আমি সাহায্য চাই।
আত্তিলিও অনুমান করেছিলেন মদাবুলি আর গোর সর্বনাশ করার জন্য এক চক্রান্তের জাল বুনছে দুই শয়তান টোয়াবেনি ও সুকামবানা। চক্রান্তকারীদের কী করে বাধা দেবেন সে-কথা আত্তিলিও নিজেও ভাবতে পারেননি, বিশেষত ষড়যন্ত্রের চেহারাটা তখন পর্যন্ত তার কাছে অস্পষ্ট–কিন্তু যে ভয়াবহ বিপদের ফলে দুটি নিরাপরাধ মানুষের জীবন বিপন্ন হতে চলেছে, তাতে যথাসাধ্য বাধা দেওয়া উচিত মনে করেই তিনি টোয়াবেনির আস্তানা লক্ষ করে যাত্রা করেছিলেন। সঙ্গে ছিল নিত্যসঙ্গী রাইফেল আর ক্যামেরা। পথে যেতে একটা সিংহের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। ক্যামেরার সাহায্যে পশুরাজের আলোকচিত্র গ্রহণ করতেও তার ভুল হয়নি। সিংহটা তাকে আক্রমণের চেষ্টা না-করে বিলক্ষণ সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল। সেদিন সকালে গুলির আওয়াজে জুলুদের কাছে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে রাজি ছিলেন না আত্তিলিও।
প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে তিনি টোয়াবেনির ক্রালের নিকটে অবস্থিত পাহাড়ের উপর এসে পৌঁছালেন। সেখান থেকে চারদিকে দৃষ্টিসঞ্চালন করে তিনি দেখলেন তার উলটোদিকে যে পাহাড়টার উপর এই সময়ে টোয়াবেনির গোরুগুলো ঘাস খেয়ে বেড়ায়, সেখানে তারা নেই–গোরুগুলোকে কালের ভিতর তাদের নির্দিষ্ট আবেষ্টনীর মধ্যে আজ বন্দি করে রাখা হয়েছে। আস্তানার দরজাটা খোলা এবং সেই উন্মুক্ত প্রবেশপথের মুখে ভিড় করেছে জুলু-রমণীর দল। দ্বারের বাইরে ছোটো ছোটো কয়েকটা দলে বিভক্ত হয়ে উত্তেজিত স্বরে কথা কইছে প্রায় শ-খানেক পুরুষ। বিস্তীর্ণ মাঠের এখানে ওখানে কালো কালো ছাপ দেখে আত্তিলিও বুঝলেন, যেসব ঝোঁপঝাড় বা শুষ্ক নালার মধ্যে সিংহের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা ছিল, সেই জায়গাগুলো জুলুরা আগুনে পুড়িয়ে সাফ করে ফেলেছে।
দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন আত্তিলিও। এই মুহূর্তে পিছন ফিরে তিনি যদি যাত্রা করেন তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। যেখানে আছেন, সেখান দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদের ভয় নেই। কিন্তু অত দূর থেকে কিছু দেখা বা শোনার আশা তাহলে একেবারেই ত্যাগ করতে হয়। সামনে এগিয়ে গেলে অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তবে এটুকু বিপদের ঝুঁকি নিলে হয়তো তিনি এমন দৃশ্য দেখতে পাবেন যা ইতিপূর্বে ইউরোপ বা আমেরিকাবাসী কোনো শ্বেতাঙ্গের দৃষ্টিগোচর হয়নি। হয়তো এসব দুর্লভ দৃশ্যের আলোকচিত্র গ্রহণ করার সুযোগও পেতে পারেন তিনি, এবং–
এবং বরাত ভালো থাকলে রক্তারক্তির ভয়াবহ সম্ভাবনাকেও হয়তো রোধ করতে পারবেন।
মুহূর্তের আবেগে পরিচালিত হলেন আত্তিলিও, হাতের রাইফেল মাটিতে নামিয়ে তিনি পাহাড় ভেঙে নীচের দিকে নামতে লাগলেন। আত্তিলিও ভেবেছিলেন, নিরস্ত্র অবস্থায় গেলে জুলুরা নিশ্চয়ই তার মনোভাব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করবে না। তা ছাড়া রাইফেল এখন কোন কাজে লাগবে? অবস্থা যদি ঘোরালো হয়, তবে শ-খানেক বর্শার বিরুদ্ধে একটা রাইফেল নিয়ে তিনি কী করতে পারেন?
পাহাড়ের উপর থেকে নীচের দিকে নামতে তিনি যখন অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছেন সেই সময়ে হঠাৎ জনতার ভিতর থেকে একটা উত্তেজিত তীব্র স্বর সকলকে সাবধান করে দিল।
এক-শো লোকের জনতা এক মুহূর্তে চুপ, সকলের দৃষ্টি পড়েছে আত্তিলিওর দিকে! পাহাড়ের মাঝামাঝি নেমে এলেন আত্তিলিও। জনতা কথা কইল না, নিঃশব্দে তাঁকে লক্ষ করতে লাগল। নীচু জায়গাটা পার হয়ে পরবর্তী উচ্চভূমির উপর পা রাখলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে মুখর হয়ে উঠল মৌন জনতা! সকলেই একসঙ্গে কথা বলতে চায়।
উঁচু জমি পার হয়ে এসে দাঁড়ালেন জুলুদের মাঝখানে–তৎক্ষণাৎ চিৎকার, গোলমাল, হইহই, ধুন্ধুমার কাণ্ড!
আত্তিলিও জুলুদের কাছে বিনীত ভদ্র ব্যবহার পেতে অভ্যস্ত, কিন্তু জনতার মধ্যে কেউ তাকে ভদ্রতাসূচক অভিবাদন জানিয়ে অভ্যর্থনা করল না। ভদ্রতা, শিষ্টতা প্রভৃতি সৌজন্যবোধ সেদিন জুলুদের ভিতর থেকে অন্তর্ধান করেছে সাদা মানুষের অনধিকার চর্চায় তারা বিরক্ত, কয়েকজন আবার বিরূপ মনোভাব গোপন করতেও চাইল না। আত্তিলিও দেখেও দেখলেন না, বুঝেও বুঝলেন না। সোল্লাসে হাত নেড়ে তিনি জুলুদের অভিবাদন জানালেন, সালাগাতলে!
একজন উত্তর দিল। সেই একজন অবশ্য খুব সাধারণ মানুষ নয়; যে-লোকটি আত্তিলিওর অভিবাদনে সাড়া দিয়েছিল সে হচ্ছে জুলুদের মধ্যে এক প্রাচীন ইনডানা (জ্ঞানী ব্যক্তি)। সাহস ও বীরত্বের জন্য সে যৌবনে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল এবং জুলুদের সামাজিক ব্যাপারে তার মতামতের মূল্য ছিল খুব বেশি।
ওই বিশিষ্ট লোকটির সঙ্গে আত্তিলিও সাহেবের যে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে কোনো তরফ থেকেই কৃত্রিমতার স্থান ছিল না।
স্খলিত চরণে এগিয়ে এসে পূর্বোক্ত ইনডানা আত্তিলিওর হাতে হাত দিয়ে করমর্দন করল।
আত্তিলিও বললেন, ওদের জানিয়ে দাও আমি এখানে দর্শক হিসাবে এসেছি। যা দেখব, যা শুনব, সে-কথা আমি শ্বেতাঙ্গ কর্তৃপক্ষের কাছে বলব না।
ভীষণ চেঁচামেচি গোলমাল হচ্ছিল। হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলল ইনডানা। কয়েক মিনিট ধরে নির্বাক জুলুজনতাকে উদ্দেশ করে সে কথা বলল। প্রথমেই সে জনতাকে জানিয়ে দিল সাদা মানুষের সঙ্গে ম্যাজিকের বাক্স (ক্যামেরা) ছাড়া কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই, অতএব তার উদ্দেশ্য খারাপ নয়। তারপর অভিযাত্রীদের সততা ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের প্রমাণ হিসেবে সাদা মানুষদের বিভিন্ন কীর্তিকলাপের কথা বলতে আরম্ভ করল–সিংহের আক্রমণে আহত জুলুদের চিকিৎসা করে অভিযাত্রীরা যে অনেককে বাঁচিয়ে তুলেছেন সেইসব কথা সে উল্লেখ করল, সিংহ শিকারের কথা, দাঁতের ব্যথা উপশম করে জুলুদের আরাম দেওয়ার ইতিহাস প্রভৃতি সব ঘটনার কথাই সে বলেছিল এবং পরিশেষে সাদা মানুষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মূল্যবান উপহারগুলোর কথাও সে জনতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলল না।
ইনডানার কথা শেষ হল। সঙ্গেসঙ্গে মুখ খুলল সুকামবানা। ঝড়ের বেগে সে অনেক কথাই বলে গেল। উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত সেই দ্রুত বাক্যঝটিকার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হচ্ছে–
চুলোয় যাক সাদা মানুষরা!
জনতা এইবার একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। জনতার এক অংশ জানাল আত্তিলিওর উপস্থিতি তাদের কাছে আপত্তিকর নয়, অপর অংশ বিদেশিকে ঘটনাস্থলে থাকতে দিতে অসম্মত। আত্তিলিও কোনোদিকে নজর দিলেন না, নির্লিপ্তভাবে তিনি ম্যাজিকের বাক্স হাতে ফটো তুলতে শুরু করলেন।
সুখের বিষয় অকুস্থলে টোয়াবেনি উপস্থিত ছিল না। সে থাকলে হাওয়া বদলে যেত। আত্তিলিও পূর্বোক্ত ইনডানাকে ভোটের সাহায্যে সমস্যার সমাধান করতে বললেন। ভোট নেওয়া হল। শূন্যে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে জ্বলে জ্বলে উঠল অনেকগুলো বর্শাফলক অধিকাংশ মানুষই হাতের অস্ত্র তুলে ধরে আত্তিলিওর স্বপক্ষে রায় দিল। যারা বিদেশির উপস্থিতি চায়নি, তারা বিনা বাক্যব্যয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবি মেনে নিল। এই ব্যাপারে সুকামবানার আর কিছু বলার উপায় থাকল না। জনতাকে উদ্দেশ করে সে একটি হুকুম দিল, সঙ্গেসঙ্গে আত্তিলিওর উপস্থিতি ভুলে গেল জনতা–সুকামবানা আর জ্ঞানী ব্যক্তিদের মাঝখানে রেখে তারা গোল হয়ে বসে পড়ল।
তারপর বৃত্তাকারে উপবিষ্ট জনতার ভিতর থেকে জাগল মিলিত কণ্ঠে সংগীতধ্বনি। খুব ধীরে ধীরে মৃদুস্বরে গান গাইছে জনতা। ঐকতান সংগীত শুরু হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই কুটির থেকে বেরিয়ে এল টোয়াবেনি! চতুর্দিকে দণ্ডায়মান জুলু-মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে সরে দাঁড়াল, বৃত্তাকারে উপবিষ্ট পুরুষরা বৃত্ত ভেঙে তাকে মধ্যস্থলে প্রবেশ করার পথ ছেড়ে দিল। টোয়াবেনি কারো দিকে চাইল না, তার গতিবিধি এখন সম্মোহিত ব্যক্তির মতোই আড়ষ্ট এবং তার ভাবলেশহীন চক্ষু দুটির দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে একটা শানিত বর্শাফলকের উপর। ওই বর্শাটাকে মাটিতে পুঁতে তার চারপাশে গোল হয়ে বসেছিল পুরুষের দল।
টোয়াবেনির উপস্থিতির সঙ্গেসঙ্গে সম্মিলিত কণ্ঠের মৃদু সংগীতধ্বনি বেজে উঠল। টোয়াবেনির পাতলা ছিপছিপে শরীরটা দুলতে লাগল একবার সামনে, একবার পিছনে… তীব্রতম পর্যায়ে উঠে গেল গায়কদের কণ্ঠস্বর… উদারা, মুদারা, তারা… তারপর আবার নীচের দিকে নেমে আসতে লাগল সুরের ঢেউ, মৃদু থেকে হল মৃদুতর, অস্পষ্ট এবং পরিশেষে বিরাম লাভ করল স্তব্ধতার গর্ভে। গান থামল। এখন মৌন জনতার নির্নিমেষ দৃষ্টির একমাত্র লক্ষ্য হল টোয়াবেনি। আত্তিলিও অনুভব করলেন এক ভয়ংকর প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে নির্বাক মানুষগুলো।
টোয়াবেনির নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত; তার দেহে বুঝি ভর করছে প্রেতাত্মা। আচম্বিতে এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে সে ভূপৃষ্ঠে প্রোথিত বর্শার কাছ থেকে ছিটকে অনেক দূরে এসে পড়ল, তারপর ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক জুলু-যোদ্ধার দেহের ঘ্রাণ গ্রহণ করল। আবার ঘুরে এসে সে লাফিয়ে লাফিয়ে যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে শুঁকতে লাগল। এক একটি লোককে দু-বার, তিনবার করে সে কল, তবু শেষ হল না গন্ধের বিচার এবং ক্লান্ত হল না টোয়াবেনি, যন্ত্রের মতো লাফাতে লাফাতে সে যোদ্ধাদের দেহের ঘ্রাণ গ্রহণ করতে লাগল বারংবার…
আত্তিলিও অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন এইভাবে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হবে কী করে? অনেকেই, বিশেষ করে অভিজ্ঞ শিকারিরা জানেন, মানুষ অথবা জানোয়ার ভয় পেলে তাদের শরীর থেকে এক ধরনের গন্ধ নির্গত হয় কিন্তু সেই গন্ধকে আবিষ্কার করতে পারে বিশেষ কয়েক শ্রেণির পশুর ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয়। হয়তো দীর্ঘকাল অনুশীলন করার ফলে বন্য পরিবেশের মানুষ টোয়াবেনি ওই বিদ্যাকে আয়ত্ত করেছে, হয়তো সত্যিকার অপরাধীর দেহনিঃসৃত ঘামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে ভয়ের গন্ধ এবং অনুশীলন করে যদি কেউ ওই গন্ধের স্বরূপ নির্ণয় করতে পারে তার পক্ষে অপরাধীকে শনাক্ত করা খুবই সহজ। কিন্তু অনাবৃষ্টির জন্য কোনো মানুষ অপরাধ বোধ করে ভয়ার্ত হয়ে উঠবে না, কাজেই গন্ধের বিচার এখানে একবারেই অকেজো। জুলুদের পক্ষে সব কিছুই বিশ্বাস করা সম্ভব হলেও আত্তিলিওর পক্ষে এমন কড়া গাঁজা হজম করা দুঃসাধ্য।
ওই যে! ওই যে সেই লোক, যার দুই চোখে জড়িয়ে আছে অমঙ্গলের অভিশাপ তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠল টোয়াবেনি। জনতা চিৎকার করে উঠল।
শূন্যে লাফিয়ে উঠল এক-শো যোদ্ধা, তাদের ঘর্মাক্ত দেহে চকচক করে উঠল সূর্যরশ্মি। একটি লোকের হাত চেপে ধরল টোয়াবেনি, শুরু হল ধস্তাধস্তি। জনতা ছুটে এসে দুজনকে ঘিরে ফেলল। অত লোকের হুটোপুটির ভিতর ধৃত ব্যক্তির চেহারা দেখতে পেলেন না আত্তিলিও, তবে বুঝলেন গন্ধের বিচার শেষ হয়েছে–
ধরা পড়েছে অপরাধী!
.
নবম পরিচ্ছেদ – ক্রুদ্ধ জনতা
আত্তিলিও অবাক হয়ে ভাবছেন টোয়াবেনির ষড়যন্ত্রের শিকার কে হতে পারে, হঠাৎ তার পাশ কাটিয়ে কেউ যেন ছুটে বেরিয়ে গেল। তিনি ঘুরে দেখলেন একটি মেয়ে। সে ছুটছিল তিরবেগে, পিছন থেকে তার মুখ দেখতে পেলেন না আত্তিলিও, তবু মেয়েটিকে তিনি চিনতে পারলেন মন্দাবুলি! তাকে চেঁচিয়ে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলেন আত্তেলিও; তাকে কেউ দেখতে পায়নি সকলেরই ব্যগ্র দৃষ্টি সেইখানে, যেখানে জুলুদের মাঝখানে টোয়াবেনির সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। একটি হতভাগ্য মানুষ! জনারণ্যের ভিতর থেকে তার চেহারা দেখতে না-পেলেও মদাবুলির আচরণেই আত্তিলিও বুঝে গেছেন টোয়াবেনির কবলে পড়ে যে-মানুষটি ছটফট করছে সে গো ছাড়া আর কেউ নয়। আর সঙ্গেসঙ্গে ধাবমান জুলু বালিকার উদ্দেশ্যও তিনি ধরে ফেলেছেন–সে ছুটে চলেছে সর্বাধিনায়ক জিপোসোর সঙ্গে দেখা করার জন্য।
আত্তিলিওর ভ্রূ কুঞ্চিত হল।
চারদিকে অগণিত নরখাদক সিংহের ক্ষুধার্ত দৃষ্টি এড়িয়ে অরণ্য-প্রান্তর ও পর্বতের দুস্তর বাধা ভেদ করে বালিকা কি জিপোসোর সঙ্গে দেখা করতে পারবে? পারবে কি সেই লোকটাকে বাঁচাতে যে এখন ছটফট করছে ক্ষিপ্ত কুসংস্কার-অন্ধ জনতার মধ্যে?…
হ্যাঁ, ছটফট করছে গো, তাকে চেপে ধরেছে ক্রুদ্ধ জনতা। একদল জুলুযোদ্ধা তাকে শূন্যে তুলে ফেলল, তারপর হাতে হাতে তুলে নিয়ে এল একটা মস্ত গাছের নীচে। আত্তিলিও গাছটার দিকে তাকালেন, পত্রবিহীন ওই বিশাল শুষ্ক বৃক্ষটির নাম তিনি শুনেছেন–যাতনাদায়ক বৃক্ষ। তার জুলু অনুচর জামানি একদিন তাকে পূর্বোক্ত গাছটির নাম এবং কার্যকারিতা সবিস্তার জানিয়ে দিয়েছিল। জামানির মুখ থেকেই আত্তিলিও শুনেছেন যে, গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে প্রাচীনকালে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হত–রজ্জবদ্ধ অপরাধীর চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচগান চালাত বর্শাধারী যোদ্ধার দল এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে খুঁচিয়ে মারত ওই হতভাগ্য মানুষটিকে…।
আত্তিলিও সচমকে ভাবলেন তাকেও কি আজ ওইরকম বীভৎস হত্যাকাণ্ডের দর্শক হতে হবে? তা ছাড়া আর একটা ভীষণ সম্ভাবনার কথা তার মনে হল।
নরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করলেই সিংহ যেমন মানুষখেকো হয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবেই মানুষের ভিতরকার পশুও রক্তপাতের জন্য হন্যে হয়ে উঠে নগোর রক্তপাতে উল্লসিত। জনতার মধ্যে যদি রক্তের তৃষ্ণা জাগে, তাগলে তারা কি আত্তিলিওকে রেহাই দেবে?…
ইতিমধ্যেই তাদের পরিবর্তন এসেছে। শান্তশিষ্ট মানুষগুলো বন্য পশুর মতোই ভয়ংকর হয়ে উঠছে, তাদের চোখে-মুখে এখন রক্তলোলুপ শ্বাপদের হিংস্র অভিব্যক্তি!
আত্তিলিওর পা দুটো তাকে ঘটনাস্থল থেকে টেনে নিয়ে যেতে চাইল সেইখানে, যেখানে পড়ে আছে তার রাইফেল–প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তিনি পলায়নের ইচ্ছা দমন করলেন।
ষোলো বছরের একটি বালিকা যদি এই ক্ষিপ্ত যোদ্ধাদের বিরুদ্ধাচরণে প্রবৃত্ত হয়, নিরপরাধ মানুষের প্রাণ রক্ষা করার জন্য ওইটুকু মেয়ে যদি চতুর্দিকে ভ্রাম্যমাণ শত শত নরখাদক সিংহের ভয়াবহ উপস্থিতি অগ্রাহ্য করতে পারে, তবে আত্তিলিওর মতো একজন সৈনিক পুরুষের পক্ষে পালিয়ে আত্মরক্ষার চিন্তা করাও অন্যায়।
তিনি পলায়নের ইচ্ছা দমন করে যেকোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলেন।
চারপাশে দণ্ডায়মান জনতা ও গোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন আত্তিলিও ক্রুদ্ধ জনতার আস্ফালন এখন থেমে গেছে, তারা ধীরভাবে অপেক্ষা করছে ইনডানাদের কথা শোনার জন্য। যতই রাগ হোক, জুলুরা ইনডানা উপাধিপ্রাপ্ত জ্ঞানী ব্যাক্তিদের মতামত কখনো অগ্রাহ্য করে না। সব সমেত তিনজন ইনডান সেখানে উপস্থিত ছিল।
প্রথমেই এগিয়ে এল সেই ইনডানা, যে প্রথমেই আত্তিলিওর সঙ্গে করমর্দন করেছিল। ওই লোকটি নগোর কাছে জানতে চাইল সে অপরাধ স্বীকার করতে রাজি আছে কি না। গো জানাল সে নিরপরাধ। ইনডানাটি তখন জনতাকে জিপোসোর জন্য অপেক্ষা করতে অনুরোধ করল। তার কথার ভঙ্গিতে বোঝা গেল গোর অপরাধ সম্বন্ধে সে নিজেও নিঃসন্দেহ নয়।
এইবার দুনম্বর ইনডানা তার অভিমত প্রকাশ করল। তার কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে গাছের সঙ্গে বেঁধে গোকে মেরে ফেলা উচিত। জুলুদের প্রাচীন পদ্ধতি অনুসারে ধীরে ধীরে খুঁচিয়ে মারার পক্ষপাতী সে নয়, চটপট মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করতেই সে ব্যগ্র কারণ, জিপোস অকুস্থলে এসে পড়ে সব ওলটপালট করে দিতে পারে এমন সম্ভাবনার কথাও জনতাকে সে জানিয়ে দিল এবং শুভ কার্যে বিলম্ব না-করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে পরবর্তী বক্তাকে স্থান ছেড়ে দিল।
জনতার একাংশ প্রবল হর্ষধ্বনিতে সমর্থন জানাল, আর এক দলের তরফ থেকে শোনা গেল শ্লেষতিক্ত ব্যঙ্গধ্বনি!
এইবার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হল তিন নম্বর ইনডানা। তার বক্তব্য হচ্ছে, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী বিচার না-করলে অন্যায় হবে; অতএব গরম জলের সাহায্যে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ নির্ণয়ের যে প্রাচীন প্রথা আছে, সেই প্রথা অনুসারেই গোর বিচার হওয়া দরকার। গোর ডান হাত ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে দিয়ে যদি দেখা যায় সে অক্ষত আছে, তবেই বোঝা যায় সে নির্দোষ।
জনতা সোল্লাসে চিৎকার করে এই প্রস্তাব সমর্থন করল। সঙ্গেসঙ্গে কুটিরের ভিতর থেকে একটা মস্ত বড় হাঁড়ি নিয়ে এল টোয়াবেনি। আত্তিলিও বুঝলেন, শয়তানটা আগে সব ঠিক করে রেখেছিল। গোর সামনে ফুটন্ত গরম জলের হাঁড়ি রাখা হল। সে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু শয়তান টোয়াবেনি বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরে গোর ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিল হাঁড়ির ভিতর।
কয়েক মুহূর্ত… গোর হাত ছেড়ে দিল টোয়াবেনি… সঙ্গেসঙ্গে বাঁ-হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল নগো–গরম জল তার হাতটাকে ঝলসে দিয়েছে।
ওই হচ্ছে অপরাধী, চেঁচিয়ে উঠল সুকামবানা, বেঁধে ফেলো ওকে গাছের সঙ্গেতারপর ধীরে ধীরে বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে ওকে শেষ করে দাও। শয়তান গোই বৃষ্টি বন্ধ করেছে আর সিম্বাদের (সিংহদের) লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের উপর।
তৎক্ষণাৎ জন বারো বলিষ্ঠ যোদ্দা নগোকে ধরে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে ঘিরে শুরু হল উদ্দাম নৃত্য। নাচতে নাচতে বর্শাধারী যোদ্ধারা গোল হয়ে ঘুরতে লাগল গোকে মাঝখানে রেখে। গোর সামনে দিয়ে ঘুরে যাওয়ার সময়ে প্রত্যেক যোদ্ধা তার দেহ লক্ষ করে সজোরে বর্শা চালনা করতে লাগল এবং এমন অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে চালিত বর্শা ফলকের গতিবেগ তারা রোধ করছিল যে, লক্ষ্যস্থলের মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে এসেই থেমে যাচ্ছিল অস্ত্রের শানিত ফলক!
এখন সময় হয়নি–
ধীরে ধীরে কমে আসবে লক্ষ্যস্থলে ও দংশন-উদ্যত বর্শাফলকের মধ্যবর্তী দূরত্ব, মৃদু আঘাতে রক্ত পান করবে একটির পর একটি শানিত বর্শা, অজস্র অগভীর ক্ষত থেকে ঝরতে থাকবে রক্তের ধারা, তারপর এক সময়ে প্রচণ্ড আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে যাবে হতভাগ্য গোর হৃৎপিণ্ড। কিন্তু
কিন্তু নির্বাক ও নিশ্চেষ্ট হয়ে এই বীভৎস্য দৃশ্য দেখার জন্যই কি অপেক্ষা করছেন আত্তিলিও?
.
দশম পরিচ্ছেদ – জাদুকরের ভূমিকায় আত্তিলিও
অনাবৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, চিরস্থায়ী হতে পারে না। আত্তিলিও আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন না, কোনো আশা নেই, এখানে সেখানে কিছু কিছু মেঘ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু বৃষ্টি সুদূর পরাহত।
পকেট ব্যারোমিটার নামক যে ছোটো যন্ত্রটি সর্বদা আত্তিলিওর সঙ্গী, সেই যন্ত্রটির দিকে দৃষ্টিপাত করলেন তিনি। ব্যারোমিটারের কাঁটা দেখে বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টি আসন্ন, খুব সম্ভব দু-চারদিনের মধ্যেই বর্ষণ শুরু হবে। কিন্তু আত্তিলিওর তো দু-দিন পরে হলে চলবে না, এই মুহূর্তে বৃষ্টির দরকার–তবে?…
আত্তিলিও ঘড়ি দেখলেন। ঠিক এগারোটা বেজেছে। প্রায় এক ঘণ্টা হল মদাবুলি চলে গেছে। এখান থেকে। সমবেত কণ্ঠে ঐকতান সংগীত বেজে উঠেছে তীব্র শব্দে, দ্রুততর হয়ে উঠছে নৃত্যের ছন্দ–বর্শা গুলো কিন্তু এখনও গোর দেহ স্পর্শ করেনি। গোর দিকে তাকালেন আত্তিলিও। একটুও বিচলিত হয়নি সে। তার সুশ্রী মুখণ্ডলে গভীর অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের চিহ্ন!…
আত্তিলিও চিন্তা করতে লাগলেন। একজন ইনডানা যেন একটু আগেই কী বলছিল.. কী বলছিল?… হা, হা মনে পড়েছে দু-ঘণ্টা পরেই দূরবর্তী অঞ্চল থেকে এই এলাকায় পদার্পণ করছে সর্দার জিপোসো এবং এলাকার মধ্যে এসে পড়লে সর্বাধিনায়ক তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে কতক্ষণ অজ্ঞ থাকবে বলা শক্ত–অতএব দু-ঘণ্টার মধ্যে কাজ শেষ করা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছিল উক্ত ইনডানা।
দু-ঘণ্টা? এই দু-ঘণ্টা যদি জনতাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেন আত্তিলিও তাহলে বোধ হয় নগোর প্রাণরক্ষা হয়। কিন্তু এই ক্ষিপ্ত জনতাকে কি অতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব? …আত্তিলিও দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন।
একটা তীব্র চিৎকার আত্তিলিওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল।
না, ন্গো নয়–চেঁচিয়ে উঠেছে জনতা! রক্তপাত শুরু হয়েছে! আঘাত মারাত্মক নয়, কিন্তু বর্শার আঘাতে গোর জানু থেকে গড়িয়ে নামছে রক্ত!
আর রক্ষা নেই–আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে উঠবে তারপর হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ করে একসময়ে নেমে আসবে মৃত্যু!
দাঁড়াও! থামো, চেঁচিয়ে উঠলেন আত্তিলিও। নাচ থেমে গেল। দারুণ বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল যোদ্ধার দল।
আত্তিলিও বললেন, দাঁড়াও, জুলুরা, দাঁড়াও! বর্ষার দেবতা আনজিয়ানা এখনই বৃষ্টি পাঠিয়ে দিচ্ছে।
এক-শো মানুষ মুখ তুলল আকাশের দিকে। পরক্ষণেই জাগল ক্রুদ্ধ গুঞ্জনধ্বনি। কোথায় বৃষ্টি? আসন্ন বৃষ্টিপাতের কোনো চিহ্নই নেই নীল আকাশের বুকে। কারো দিকে চাইলেন না আত্তিলিও, কারো কথায় কর্ণপাত করলেন না তিনি, সোজা এসে দাঁড়ালেন জনতার মাঝখানে।
একটু অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরে আমার কথা শোনো, যে ইনডানার সঙ্গে আত্তিলিওর বন্ধুত্ব ছিল, সেই লোকটি এবার এগিয়ে এল। জনতাকে উদ্দেশ করে সে যে আদেশ-বাণী উচ্চারণ করল, তার মর্মার্থ হচ্ছে ধৈর্যধারণ করে সাদা মানুষের ম্যাজিকের বাক্স কী করে সেইটা দেখাই এখন জুলুদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।
আত্তিলিও ততক্ষণে তার ম্যাজিকের বাক্স অর্থাৎ ক্যামেরা বাগিয়ে ধরেছেন এবং অতি মন্থর পদে অগ্রসর হয়েছেন গোর দিকে। ক্যামেরার লেন্স গোর বুকের কাছে ধরে ফিসফিস করে আত্তিলিও বললেন, চেঁচাও।
জোরেই চেঁচিয়েছিল গো। এমন কর্ণভেদী মনুষ্যকণ্ঠের আর্তস্বর ইতিপূর্বে কখনো আত্তিলিওর শ্রুতিগোচর হয়নি।
দেখছ? বিজয়গর্বে ঘুরে দাঁড়ালেন আত্তিলিও জনতার দিকে, এক-শো বর্শার সামনে দাঁড়িয়ে যে ভয় পায়নি, সে এখন চেঁচিয়ে উঠেছে, এখন বুঝেছ আমার ক্ষমতা?
জুলুরা চমৎকৃত! সত্যি কি ভয়ংকর ওই ম্যাজিকের বাক্স? আরও ভয়ংকর ওই বাক্সের চোখটা (লেন্স)?
এইবার একটা লম্বা বক্তৃতা শুরু করলেন আত্তিলিও। অভিভূত জুলু-অভিনেতা স্তম্ভিত বিস্ময়ে সেই আজগুবি, অদ্ভুত আর অসম্ভব কথাগুলো শুনতে লাগল। যত রকমের বিদঘুঁটে অবিশ্বাস্য বিষয়বস্তু আত্তিলিও ভাবতে পেরেছিলেন, সবগুলিই তিনি পরিবেশন করেছিলেন সেই বক্তৃতার মধ্যে।
টোয়াবেনি আর সুকামনা রাগে কাঁপছিল। তাদের দিকে নাটকীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন আত্তিলিও, কী হে! এইবার? তোমরা কী বলতে চাও?
অনেক কিছুই হয়তো বলার ছিল। কিন্তু শয়তান চুপ করে রইল। তারা জানত জুলুরা এখন তাদের কোনো কথায় কর্ণপাত করবে না–সাদা মানুষের ম্যাজিকের বাক্স, আর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা এখন তাদের অভিভূত করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে আত্তিলিও আর এক কাজ করেছেন–পকেট থেকে সিগারেট বার করে বিলিয়ে দিয়েছেন জুলুদের মধ্যে। জুলুল্যান্ডে সিগারেট অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য আর লোভনীয় বস্তু। অধিকাংশ লোকই সিগারেট নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল হত্যার আগ্রহে যারা একটু আগেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল তারাই এখন ধোঁয়া ওড়াচ্ছে নির্বিকারভাবে!
আত্তিলিও জানতেন এই পরিবর্তন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। আবার খেপে উঠবে জনতা। তবে কিছুটা সময় তো পাওয়া গেল। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই আত্তিলিওর উর্বর মস্তিষ্কে জন্ম নিয়েছে এক নতুন পরিকল্পনা–দেখছি? আত্তিলিও কম্পাস বার করে সকলের সামনে ধরলেন, এই দেখ, ছোট্ট বর্শাটা (কম্পাসের কাটা) কেমন কাঁপছে? এর মানে কী জান?
জুলুরা মাথা নাড়ল–না, সাদা মানুষের ভেলকি তারা বুঝতে পারে না। এর মানে হচ্ছে, আত্তিলিও বললেন, এখনই বৃষ্টি শুরু হবে। সামনের গাছটার ছায়া এই জায়গায় পড়লেই বৃষ্টি নামবে।
আত্তিলিও তার ডান পায়ের গোড়ালি মাটিতে ঠুকে জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। জনতা এখন আর হিংস্র নয়। তাদের অস্বাভাবিক উন্মাদনা কেটে গেছে। আত্তিলিও জুলুদের স্বভাব জানতেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন উপস্থিত জনতার মধ্যে অনেক মানুষই এখন সর্বাধিনায়ক জিপোসোর আইন ভঙ্গ করার শোচনীয় পরিণাম সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে। আত্তিলিও হয়েতো জনতার শুভ বুদ্ধিকে জাগিয়ে তুলে নগোকে রক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু টোয়াবেনি আর সুকামবানা তাকে সেই সুযোগ দিল না। শান্ত জনতাকে আবার তারা উত্তেজিত করে তুলল।
…মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে… গাছের ছায়াটা সরে সরে এসে আত্তিলিওর চিহ্নিত স্থানের খুব কাছেই এসে পড়েছে।
চাপা গলায় গর্জে উঠল টোয়াবেনি, ছায়াটা ঠিক জায়গায় এসে পড়লেই বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার কথা। যদি তা না হয় তবে গোকে হত্যা করা হবে। একটু থামল টোয়াবেনি, তার অবরুদ্ধ কণ্ঠ সাপের মতো হিস হিস করে উঠল, তারপর সাদা মানুষের পালা।
আত্তিলিও জানতেন সেটা সহজ নয়। জুলুরা তার গায়ে হাত দিতে সাহস করবে না। তবে টোয়াবেনি যে তাকে খুন করার চেষ্টা করবে সে-বিষয়ে আত্তিলিওর কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না।
সময় কাটতে লাগল ধীরে ধীরে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে এগিয়ে আসতে লাগল গাছের ছায়া নির্দিষ্ট স্থানের দিকে। অবশেষে এল সেই চরম মুহূর্ত, আত্তিলিওর চিহ্নিত স্থানে উজ্জ্বল রোদের আলোকে লুপ্ত করে নামল অন্ধকারের প্রলেপ–
গাছের ছায়া এসে পড়েছে চিহ্নিত স্থানের উপর।
জুলুরা আকাশের দিকে মুখ তুলল–নির্মেঘ আকাশে জ্বলছে মধ্যাহ্ন সূর্য, বৃষ্টিপাতের কোনো সম্ভাবনাই সেখানে দেখা যাচ্ছে না।
জনতার মধ্যে আবার জাগল হিংস্র উত্তেজনা। আবার শুরু হল উদ্দাম নৃত্য। এবার তারা দেরি করতে চায় না, কয়েকটা আসাগাই (বর্শা) গোর দেহে বিভিন্ন স্থানে আঘাত করল। ক্ষতচিহ্নগুলো খুবই তুচ্ছ ছিল বটে, কিন্তু আত্তিলিও জানতেন কিছুক্ষণের মধ্যেই আঘাতের বেগ জোরালো হয়ে উঠবে–রক্ত দেখে খেপে উঠবে.জুলুরা, সঙ্গেসঙ্গে মারাত্মক গম্ভীর হয়ে চেপে বসতে থাকবে বর্শাফলকের দংশন এবং এক সময়ে চমর আঘাতে নেমে আসবে মৃত্যু।
আত্তিলিওর সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত। তিনি বুঝেছেন আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোর মৃত্যু অবধারিত। তারপর তার পালা। টোয়াবেনির ইঙ্গিত পেলেই তারা যে আত্তিলিওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সে-বিষয়ে আত্তিলিও ছিলেন নিসন্দেহ। তার একমাত্র ভরসা সর্বাধিনায়ক জিপোসো। কিন্তু জিপোসোকে যে এখানে নিয়ে আসতে পারে, সেই মদাবুলি এখন কোথায়? চতুর্দিকে ভ্রাম্যমাণ নরভুক সিংহদের নজর এড়িয়ে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে জিপোসোর সঙ্গে দেখা করতে সমর্থ হয়েছে কি জুলুবালিকা?..
একটা বর্শার ফলা নগোর বুকে বিদ্ধ হল। হৃৎপিণ্ডের একটু উপরে। এগিয়ে এল আর একটা বর্শা। আত্তিলিও বুঝলেন চরম আঘাত পড়ার সময় এগিয়ে আসছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করবে গো। আর তারপরেই যে রক্তাক্ত বর্শাফলকগুলো নেচে উঠবে তার চারপাশে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আত্তিলিও সেই দুরবস্থার কথা কল্পনা করে চমকে উঠলেন–গোর মতো নির্বিকার মুখে অবিচলিতভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার সাধ্য তার নেই…
আত্তিলিও নিজের শ্রবণশক্তিকে বিশ্বাস করতে পারলেন না–গোর নাম ধরে কে যেন ডাকছে!
কিন্তু না, ভুল হয়নি–উপত্যকার তলা থেকে নারীকন্ঠের চিৎকার ভেসে এল আবার, নগো! গো!
আত্তিলিও দেখলেন পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে ছুটে আসছে মদাবুলি। পাহাড়ের অপর প্রান্তে যেখানে আত্তিলিও সাহেব রাইফেল রেখে এসেছিলেন সেখানেও আবির্ভূত হয়েছে অনেকগুলো বর্শাধারী মনুষ্যমূর্তি! সর্দার জিপোসো এসে পড়েছে সসৈন্যে।
জনতা সচমকে ফিরে দাঁড়াল, তারপর প্রাণপণে ছুটে পালাতে চেষ্টা করল। কেউ পালাতে পারল না, জিপোসোর সৈন্যরা প্রত্যেকটি মানুষকেই বন্দি করে ফেলল।
মদাবুলি ছুটতে ছুটতে এসে আত্তিলিওর সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।
আত্তিলিও বলে উঠলেন, ভয় নেই, গো বেঁচে আছে।
হাঁফাতে হাঁফাতে উত্তর দিল মদাবুলি, তুমি–তুমিও বেঁচে আছ?
ঠিক দুদিন পরেই বৃষ্টি নামল জুলুল্যান্ডে।
.
একাদশ পরিচ্ছেদ – সর্বাধিনায়ক জিপোসো
আহত গো আরোগ্য লাভ করার সঙ্গেসঙ্গেই জিপোসোর আস্তানাতে বিচারসভা বসল। বলাই বাহুল্য বিচারক ছিল জুলুদের সর্বাধিনায়ক জিপোসা।
বিচারের ফলাফল দেখে আত্তিলিও বুঝলেন জুলুদের নেতা অসাধারণ তার দূরদর্শিতা, রাজনীতিজ্ঞান ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি অতুলনীয়।
ইনডানা বা জ্ঞানী ব্যাক্তিদের সম্বন্ধে কোনো আলোচনা উঠল না। সর্বাধিনায়ক শুধু বলল, উক্ত জ্ঞানী ব্যাক্তিদের জিহ্বা সম্বন্ধে সংযত হওয়া উচিত এবং যেহেতু তারা মূখের মতো কথা বলে এক অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, সেইজন্যে কয়েক দিন সম্পূর্ণ মৌন থেকে তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
গন্ধের বিচারে যে যোদ্ধার দল অংশগ্রহণ করেছিল, তারা রেহাই পেল না। আদালতের রায় অনুসারে প্রত্যেক যোদ্ধাদের উপর জরিমানা ধার্য হল–উত্তমরূপে প্রস্তুত একটি আসাগাই (বর্শা), তিনটি বাছুর ও তিনটি ছাগল। জন্তুগুলো যেমন তেমন হলে চলবে না, দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সেরা জন্তুগুলোকেই দাবি করেছে আদালত।
সাধারণ যোদ্ধাদের চার গুণ বেশি জরিমানা ধার্য হল সুকামবানার উপর। জরিমানার ফলে যে পশু আদায় করা হল, সেই জন্তুগুলোর মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ গোকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেওয়া হল। অবশিষ্ট অংশ গ্রহণ করল সর্দার জিপোসো, আদালতের ব্যয়নির্বাহ করার জন্যে ।
টোয়াবেনিকে নিজের হাতে শাস্তি দিল না জিপোসো। ওই শয়তান জাদুকরের কুকীর্তির বিশদ বিবরণসহ তাকে প্রেরণ করা হল ইশোয়ি নামক স্থানের ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। শ্বেতাঙ্গদের বিচারে টোয়াবেনির যে কী দুরবস্থা হবে সে-বিষয়ে জিপোসো ছিল দস্তুরমতো সচেতন।
নিজের হাতে দণ্ডবিধান করে জুলুদের সমালোচনার বিষয়বস্তু হতে চায়নি বলেই সাদা মানুষদের হাতে টোয়াবেনির দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল সর্দার জিপোসো। অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত এক রক্ষীবাহিনী টোয়াবেনিকে নিয়ে রওনা হল উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশে।
জুলুদের চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে পরিবারের কর্তা মারা গেলে বা অক্ষম হলে ওই পরিবারের সব দায়িত্বই সর্দারকে বহন করতে হয়। টোয়াবেনির পরিবারভুক্ত মানুষগুলোর জন্য খুব ভালো ব্যবস্থাই করেছিল জিপোসো।
তবে টোয়াবেনির অন্যতম কন্যা মদাবুলি সম্বন্ধে আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠকের কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক কারণ, উল্লিখিত জুলুবালিকা হচ্ছে এই অরণ্য-নাটকের নায়িকা।
জিপোসো মন্দাবুলির সঙ্গে গোর বিবাহের ব্যবস্থা করল। তবে টোয়াবেনির পরিবর্তে যেহেতু এখন কন্যার অভিভাবকের স্থান নিয়েছে জিপোসো, তাই বরকে পূর্ব-প্রতিশ্রুত তিরিশটি গোরু কন্যাপণ দিতে হবে জিপোসোরই শ্রীহস্তে! বিচারের এই অংশটুকু শুনলে স্পষ্ট বোঝা যায় রাজ্যের সর্বত্র কী ঘটেছিল সে নিয়ে সর্বাধিনায়ক সর্বদাই অবহিত না হলে গোর কন্যাপণের প্রতিশ্রুতি জিপেসোর কর্ণগোচর হয় কী করে?…
আত্তিলিওর জুলু অনুচর জামানিকে নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে? জিপোসোর বিচারসভাতে জামানিকেও ডাকা হয়েছিল। সে আত্তিলিওকে সব ঘটনা খুলে বলেছিল বলেই একটা দুর্ঘটনা গতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু জুলু জাতির অধিনায়কের পক্ষে সমস্ত ব্যাপারটা অন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে খুব অন্যায় হয় না বরং জাতীয় স্বার্থে সেটাই স্বাভাবিক।
অবশ্য জিপোসো একবারও বলেনি যে, জামানি মূখের মতো জুলুজাতির গোপন তথ্য সাদা মানুষের কাছে ফাস করে দিয়েছে, এবং যে-মানুষ বিদেশিদের কাছে এতখানি বিশ্বস্ত হতে পারে, দেশের বাইরে তার উপস্থিতি জাতির পক্ষে বিপজ্জনক। না, না, এসব কথা মোটেই বলেনি জিপোসো, বরং জামানির প্রশংসায় সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। জিপোসো জানাল তার দেশের যে-মানুষটি এমন অদ্ভুত জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী তাকে সে হারাতে পারে না। জাতীয় স্বার্থে ওই লোকটির সর্বদাই অবস্থান করা উচিত দেশের মধ্যে। অতএব সর্বধিনায়কের নিজস্ব পরামর্শদাতার সম্মানজনক পদে জামানিকে বহাল করা হল এবং টোয়াবেনির ক্রাল-এর যাবতীয় সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের ও ভোগ করার অধিকার দেওয়া হল জামানিকেই।
জামানিকে শুধু ঘরই দেয়নি জিপোসো, ঘরনির ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। দুটি জুলু যুবতীর সঙ্গে জামানির বিবাহের ব্যবস্থা করে দিল সর্বাধিনায়ক জিপোসো। দু-দুটো বউ পেয়ে জামানি এত খুশি হল যে, কন্যাপণ হিসাবে জিপোসোকে এক কুড়ি গোরু দিতেও আর আপত্তি হল না। আত্তিলিও বুঝলেন, জিপোসো সকলের প্রতি সুবিচার করল বটে সেইসঙ্গে নিজের সম্পত্তির পরিমাণও বাড়িয়ে ফেলল সুকৌশলে!
সকলেরই যখন বিচার হল, তখন আত্তিলিওর দলবলই-বা বাদ যায় কেন? জিপোসোর পরিবর্তে অন্য কোনো নেতা হলে সে স্পষ্টই বলত, শোনো ভাই! তোমরা এখানে এসে সিংহ মেরেছ, দাঁতের ব্যথা সারিয়েছ। ভালো ভালো উপহারও দিয়েছ–সব সত্যি; কিন্তু আগে বলো তো ভাই, এখানে তোমাদের কে আসতে বলেছে? শুধু জুলুদের উপকার করে উদার-হৃদয়ের পরিচয় দিতেই তোমাদের শুভাগমন হয়েছে, এমন কথা বিশ্বাস করার মতো মূর্খ আমরা নই। যা হয়ে গেল তার জন্য দেশের লোকের কাছে তোমরা খুবই অপ্রিয় হয়ে উঠবে। জুলুরা তোমাদের ভয় করবে, এড়িয়ে চলবে–কারণ, যেকোনো সময়ে তাদের গোপনীয় কথা তোমরা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস করে দিতে পার। আর এখন তো জুলুল্যান্ডে বৃষ্টি নেমেছে, কাজেই তৃণভোজী পশুরা আবার এখানে ফিরে আসবে এবং সিংহের দলও হামলা না-করে বুনো জানোয়ারের দিকে আকৃষ্ট হবে। অতএব, তোমরা আমাদের দেশ ছেড়ে চটপট বিদায় হও, জুলুরা তাদের ব্যাপারে বিদেশিদের নাক গলানো পছন্দ করে না।
হ্যাঁ, অন্য কোনো নেতার পক্ষে ওই কথা বলাই স্বাভাবিক, কিন্তু জিপোসো হচ্ছে অসাধারণ মানুষ–অপ্রীতিকর বক্তব্যকে সে উপস্থিত করতে পারে সুন্দরভাবে। অনর্থক তিক্ততাকে পরিহার করতে ভালোভাবেই জানে সর্বাধিনায়ক জিপোসো।
অভিযাত্রীরা যে এখন পর্যন্ত স্থান ত্যাগ করার কথা মুখেও আনেননি সেদিকে নজর না-দিয়ে সমবেত জনতাকে জিপোসো জানিয়ে দিল, বিদেশি আগন্তুকরা জুলুদের জন্য যথেষ্ট স্বার্থত্যাগ করেছেন–অতএব তারা দেশত্যাগ করার আগে দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা অবশ্য কর্তব্য। গোকে হত্যা করার অনুষ্ঠানে লিপ্ত হওয়ার জন্য অভিযুক্ত জুলু-যোদ্ধাদের আদেশ দেওয়া হল, তারা যেন প্রত্যেকেই গৃহনির্মিত কারুশিল্পের একটি করে নিদর্শন অভিযাত্রীদের উপহার দেয়–কারণ, পূর্বোক্ত এক-শো অভিযুক্ত যোদ্ধা আত্তিলিওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, অতএব উল্লিখিত উপহার জরিমানাস্বরূপ দিয়ে তারা বিদেশি অতিথির মার্জনা লাভ করতে পারবে। এইটুকু শাস্তি যথেষ্ট বলে মনে করল না জিপোসো; সে জানাল অভিযাত্রীদের জিনিসপত্র সসম্মানে গাড়িতে তুলে দিয়ে তাদের জুলুল্যান্ড পরিত্যাগ করার কাজে সাহায্য করতে হবে এবং ওই সাহায্যের ভার গ্রহণ করার জন্য পারিশ্রমিক দাবি করা চলবে না এ-কথাও জানিয়ে দিতে ভুলল না জিপোসো।
এমন চমৎকার বিচারের ফলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উৎসাহ বা আনন্দের লক্ষণ দেখা গেল না। ম্রিয়মাণ জনতাকে লক্ষ করে জিপোসো গর্জন করে উঠল, তোমাদের জন্য যেন মাসাংগাদের যাত্রা করতে দেরি না হয়ে যায়। কাল সকালেই ওঁরা দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, তোমাদের ত্রুটির ফলে যদি যাত্রা করতে দেরি হয়, তবে জরিমানার পরিমাণ হবে দ্বিগুণ! কথাটা যেন মনে থাকে!
এইবার ভাষণ দিতে উঠলেন আত্তিলিও। খুব সহজ সরলভাবে নির্বিকারমুখে তিনি জানালেন যে নেতা এমন সুন্দরভাবে বিচার করতে পারে এবং নির্বাক অতিথির মনোভাব বুঝতে পেরে তার ইচ্ছা পূরণের জন্য চেষ্টিত হয়, তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা তার নেই। তবে এমন একজন অধিনায়কের নেতৃত্ব লাভ করে সমগ্র জুলুজাতি যে ধন্য হয়েছে এ-বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ।
পরের দিন সকালে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের ভিতর দিয়ে যাত্রা শুরু করলেন অভিযাত্রীরা। সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে, যে লোকগুলো একদিন আগে বৃষ্টির জন্য নরহত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, তারাই আজ হাঁটু পর্যন্ত কাদাজলের ভিতর মালপত্র ঘাড়ে নিয়ে বিব্রত! বৃষ্টিপাতের অবস্থা দেখে অভিযাত্রীরা বুঝলেন বৃষ্টি এখন সহজে থামছে না, অন্তত বেশ কিছুদিন ধরে চলবে অনর্গল ধারাবর্ষণ। হঠাৎ জুলুল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় পূর্ব-পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আত্তিলিও সাহেব জিপোসোর কাছে প্রকৃত মনোভাব ব্যক্ত করেননি। যাওয়ার আগে অশ্রুসজল অভিযাত্রীদের বিদায় জানাল জামানি।
জুলু-যোদ্ধারা খুব মনমরা হয়েই অভিযাত্রীদের মোট বহন করার কার্যে নিযুক্ত হয়েছিল, ভালো ভালো হাতে-গড়া কারুশিল্পও তারা অভিযাত্রীদের উপহার দিতে বাধ্য হয়েছিল জিপোসোর আদেশে অতএব তাদের মুখে-চোখে যে খুব আনন্দের চিহ্ন ফুটে ওঠেনি সে-কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছে তাদের মুখে হাসি ফুটল–আত্তিলিও সাহেব উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে কুণ্ঠিত হননি, এমনকী উপহারের বিনিময়েও অর্থ দিয়েছিলেন মুক্তহস্তে।
জুলুদের বিদায় করে অভিযাত্রীরা এইবার নিজেদের মধ্যে আলোচনাসভা ডাকলেন। হঠাৎ জুলুল্যান্ড থেকে বিদায় নেওয়ায় তাঁদের কর্মসূচির পরিবর্তন প্রয়োজন হয়েছিল। আলোচনার ফলে স্থির হল, মোজাম্বিক এবং দক্ষিণ রোডেশিয়ার ভিতর দিয়ে যাবেন বিল ও প্রফেসর। কোনো অজ্ঞাত কারণে হাতি শিকারের জন্য অস্বাভাবিক আগ্রহ প্রকাশ করছিল বিল; কয়েকটা হাতির ভবলীলা সাঙ্গ করতে না-পারলে তার স্বস্তি নেই। অতএব ঠিক হল, বায়রা থেকে ইউরোপ হয়ে যাত্রা করার আগে প্রফেসরের সঙ্গে আত্তিলিও দেখা করবেন।
তারা স্থির করলেন কেপটাউন থেকে ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকাতে গিয়ে নতুন করে একটা অভিযানবাহিনী সংগঠিত করবেন এবং আফ্রিকার যেসব স্থান আজও অনাবিষ্কৃত সেখানে পূর্বোক্ত অভিযানবাহিনীর সাহায্যে গবেষণার কাজ চালাবেন।
পরবর্তী অভিযানের জন্য যে-জায়গাটা আত্তিলিও মনোনীত করেছিলেন, সেটি হল আফ্রিকার কিভু অরণ্য–অতিকায় দানব-গরিলার বাসস্থান।
অভিযাত্রীদের জল্পনাকল্পনা শুনে অদৃশ্য নিয়তির ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটেছিল মনে হয়; কারণ–
বায়রা থেকে জাহাজ ধরতে পারেনি বিল, তার আগে সে নিজেই ধরা পড়ে গেল এক স্বর্ণকেশী সুন্দরীর হাতে। কিন্তু তারপরই নববধূর সান্নিধ্য ত্যাগ করে বিল ছুটে গেল এক সাংঘাতিক ভবিতব্যের দিকে–
এইবার প্রফেসরের কথা। কেপটাউনে বন্ধুবর আত্তিলিওর সঙ্গে দেখা করার পরিবর্তে তিনি ফ্রান্সের সেনাবাহিনীতে যোগদান করলেন এবং আমাদের কাহিনি থেকেও বিদায় গ্রহণ করলেন এখান থেকেই আত্তিলিও গত্তির অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির মধ্যে আমরা আর প্রফেসরকে দেখতে পাব না…।
এদিকে কাহিনির নায়ক আত্তিলিও কিভুর জঙ্গলে দানব-গরিলার সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু গরিলার পরিবর্তে তার সম্মুখে আবির্ভূত হল দলবদ্ধ এক জান্তব বিভীষিকা! সেই চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ নিয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে আত্তিলিওর পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি।
অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৭৯