শয়তান
শয়তান কিন্তু একসময় ফেরেশতা ছিলো। তার নাম ছিলো ভিআইপি ফেরেশতা। সে ছিলো মহাবিশ্বের প্রথম গোঁয়ার, এবং গোঁয়ার্তুমির ফল যে ভালো হয় না, তা বুঝতে তাকে স্বর্গ হারাতে হয়েছিলো।
তবে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তাকে বেশিদিন দুঃখে কাটাতে হয়নি। পৃথিবীর অনেক দেশেই শয়তান এখন স্বর্গের চেয়েও আরামে আছে। তার ভিআইপি মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয়নি। বাংলাদেশে প্রথম যখন করোনা ভাইরাস আঘাত হানে, তখন সে ভিআইপি হাসপাতাল নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলো।
শয়তানকে কেউ দেখেছে, এরকম প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু তার অস্তিত্ব পৃথিবীর নানা অঞ্চলে মানুষ টের পেয়েছে। শয়তান আমাদের রাস্তাঘাটে প্রায়ই রডের বদলে বাঁশ ঢুকিয়ে দিচ্ছে, বায়ুযোগে সেতু নির্মাণ করে বিল তুলে নিচ্ছে, এবং রেললাইনে ঢেলে দিচ্ছে পাথরের বদলে ইটের সুড়কি।
শয়তান বাকপটুও বটে। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতে শয়তানকে আমরা বক্তৃতা দিতে দেখি। শয়তান বানিয়ে বানিয়ে এমনভাবে সত্য কথা বলে, যা শুনে ওই সত্য সম্পর্কে আমাদের আর কোনো সন্দেহই থাকে না।
লেখালেখিতেও শয়তান পিছিয়ে নেই। ইতিহাসের সব মোটা বইগুলি শয়তানের নিজ হাতে লেখা। সুবিধার পক্ষে তার কলম সবসময় উদ্যত থাকে। সম্প্রতি শিশুদের কিছু পাঠ্যবইয়ে শয়তান তার স্বরচিত কবিতা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি পড়ে দেখেছি, এ কবিতা রবীন্দ্রনাথের কবিতার চেয়ে উৎকৃষ্ট।
শয়তান যখন প্রথম পৃথিবীতে আসে, তখন তার লক্ষ্য ছিলো মানুষকে দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন করা। অভাবে স্বভাব নষ্ট হবে— এরকম একটি ধারণা ইনসানের ব্যাপারে তার ছিলো। সে আশা করেছিলো, মানুষকে গরিব ও ক্ষমতাশূন্য করে দিতে পারলে, তারা বেশি বেশি করে পাপ করবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো এর উল্টো! সে দেখলো যে, পাপের জন্য দারিদ্র্যের চেয়ে প্রাচুর্যই বেশি সহায়ক। ক্ষমতাহীন মানুষদের পাপ করার সুযোগ কম। এ জন্য শয়তান এখন কাউকে নিশানা করলে, সবার আগে তার হাতে কিছু টাকা ও ক্ষমতা তুলে দেয়।
শয়তান ভ্রমণপ্রেমী। গরিব মানুষদের টাকায় সে ধনী মানুষদের জন্য ইউরোপে আলুচাষ প্রকল্প, পুকুর খনন প্রকল্প, খিচুড়ি রান্না প্রকল্প, ক্যামেরা- ক্রয় প্রকল্প, লিফট-দেখা প্রকল্প, অভিজ্ঞতা-অর্জন প্রকল্প, শহিদদের- সম্মাননা-জানানো প্রকল্প, পুরস্কার গ্রহণ প্রকল্প, ও আরও অনেক নৌকাডুবি প্রকল্প খুলে থাকে। নানা দেশ থেকে বানরেরা, বিশেষ করে যে-দেশগুলি উন্নতিতে আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে গেছে, সস্ত্রীক এসব প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে, এবং বিস্তর কেনাকাটা করে ঘরে ফিরছে।
শয়তান থেকে মুক্তি লাভের জন্য ‘আউজু বিল্লাহি মিনাশ শাইতোয়ানির রাজিম’ নামে একটি দোয়ার প্রচলন আছে। দোয়াটি মানুষ পড়বে, এরকমই নির্দেশনা ছিলো। কিন্তু দেখা গেলো, শয়তানই এখন এ দোয়া বেশি বেশি পড়ছে। এতে আল্লাহ্, আমার ধারণা, খুবই বিভ্রান্ত হন। কারণ শয়তানকে শয়তান থেকে মুক্ত করা সহজ কাজ নয়।
আমার গ্রামে একটি রাস্তা আছে, খুবই ভাঙাচোরা, যা গত পঞ্চাশ বছর ধরে একই স্বাস্থ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিরিশ বছর ধরে শয়তান এটিকে পাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু পাকা করছে না। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে, শয়তানের প্রতিশ্রুতি বায়বীয় প্রতিশ্রুতি। এ প্রতিশ্রুতি আমলে না নেয়াই ভালো।
শয়তান গাড়ি পছন্দ করে, এবং তার গাড়ি মানুষের গাড়ি থেকে আলাদা। মানুষের গাড়ির বাঁশির আওয়াজ পিপ পিপ পিপ, কিন্তু শয়তানের গাড়ির বাঁশির আওয়াজ ভোঁ বুম ট্যাঁ ট্যাঁ টা। মানুষের গাড়ির ইঞ্জিন হয় ১৫০০ সিসি, ১৮০০ সিসি; কিন্তু শয়তানের গাড়ির ইঞ্জিন হয় ৪০০০ সিসি, ৫০০০ সিসি। কোথাও যেতে মানুষের বিশ টাকা লাগলে, শয়তানের লাগে বিশ হাজার টাকা। শয়তান তার গাড়িতে বিশেষ স্টিকার লাগিয়ে রাখে। স্টিকারে লেখা থাকে— “শয়তান”।
শয়তানের দাবি, মানুষের জন্মের নিয়ন্ত্রণ আল্লাহর হাতে থাকলেও মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। মানুষ মারা যায় সেদিন, যেদিন সে শয়তানের সাথে সম্পর্ক ছেদ করে ফেলে।
পাদটীকা: শয়তান জ্বিন নাকি ফেরেশতা ছিলো, এ নিয়ে হাঙ্গামা করার কোনো প্রয়োজন নেই। শয়তান ধারণাটি শুধু ইসলাম ধর্মের নয়। শয়তানের অস্তিত্ব আরো বহু ধর্মে আছে। আর ‘ফেরেশতা’ শব্দটি এখানে ভালো চরিত্রের অধিকারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ইসলাম ধর্মে শয়তানের আদি অবস্থা নিয়ে দুটি মত প্রচলিত আছে। আল তাবারি, আল-আশারি, আল-তালাবি, ক্বাদি- বেদওয়াইয়ি, আল-আলুসি, তাঁদের মতে ইবলিশ প্রথম থেকেই ফেরেশতা ছিলো। পরে তাকে জ্বিনে পরিণত করা হয়। সুরা আল-কাহাফের ৫০ নাম্বার আয়াতে যে তাকে জ্বিনদের একজন বলা হয়েছে, সেখানে তার ওই জ্বিনে পরিবর্তিত হওয়ার পরের রূপটির দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল-তাবারি তাঁর জামি আল-বায়ান তাফসিরে এ প্রসঙ্গে যুক্তি দিয়েছেন। আবার ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাসিরের মতে, ইবলিশ প্রথম থেকেই জ্বিন ছিলো। ইসলামে এ বিতর্কের কারণ হলো, সুরা বাকারাতে ইবলিশের আদি পরিচয় নিয়ে অন্য রকম ইঙ্গিত আছে। ইবলিশ আর শয়তান একই জিনিস কি না, এ নিয়েও তর্ক আছে। যাইহোক, এগুলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।