অনুক্রম
ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু যখন হাসপাতালে পৌঁছুলেন তখন রাত্রি দশটা। হাসপাতালের দরদালানে লোক কমে গেছে। এক পাশে এক বেঞ্চিতে একটি যুবতী শরীর শক্ত করে বসে আছে, তার পায়ের কাছে জবুথবু হয়ে বসে আছে একটি বুড়ো চাকর। যুবতীর চোখে বিভীষিকাময় সম্ভাবনার আতঙ্ক।
একটি নার্স ব্যোমকেশকে দেখে এগিয়ে এল। রাখালবাবু বললেন—‘থানা থেকে আসছি।’
‘আসুন।’ নার্স তাঁদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে বসাল। বলল—‘একটু বসুন, ডাক্তার গুপ্ত আপনাদেরই জন্য অপেক্ষা করছেন।’
নার্স চলে গেল। অল্পক্ষণ পরে ডাক্তার গুপ্ত এলেন। মধ্যবয়স্ক মধ্যমাকৃতি মানুষ, বিশ বছর ধরে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেও ক্লান্ত হননি, বরং প্রাণশক্তি আরো বেড়েছে। রাখালবাবু নিজের এবং ব্যোমকেশের পরিচয় দিলে ডাক্তার হেসে বললেন—‘আরে মশাই, আজ দেখছি অসাধারণ ঘটনা ঘটার দিন। ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গেও পরিচয় হল। বসুন, বসুন।’
তিনজন বসলেন। রাখালবাবু বললেন—‘ব্যাপার কি বলুন দেখি।’
ডাক্তার গুপ্ত বললেন—‘আরে মশাই, আশ্চর্য ব্যাপার, অভাবনীয় ব্যাপার। আমি বিশ বছর ডাক্তারি করছি, এমন প্রকৃতিবিরুদ্ধ ব্যাপার দেখিনি। অবশ্য ডাক্তারি কেতাবে দু’-চারটে উদাহরণ পাওয়া যায়। কিন্তু স্বচক্ষে দেখা—কোটিকে গুটিক মিলে।’
ব্যোমকেশ হেসে বলল—‘রহস্য নিয়েই আমার কারবার, আপনি আমাকে অবাক করে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে, একটা মনের মত রহস্য এতদিনে পাওয়া গেছে। আপনি গোড়া থেকে সব কথা বলুন।’
ডাক্তার বললেন—‘বেশ, তাই বলছি। আজ রাত্রি সাড়ে আটটার সময় তিনটি ছোকরা একজন অজ্ঞান লোককে ট্যাক্সিতে নিয়ে এখানে এল। তারা রবীন্দ্র সরোবরে বেড়াতে গিয়েছিল, দেখল একটা গাছের তলায় বেঞ্চির পাশে মানুষ পড়ে আছে। দেশলাই জ্বেলে মানুষটাকে দেখল, তার পিঠের বাঁ দিকে শজারুর কাঁটা বিঁধে আছে। লোকটা কিন্তু মরেনি, অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। ওদের মধ্যে একজন লোকটিকে চিনতে পারল, তাদের ফ্যাক্টরির মালিক দেবাশিস ভট্ট। তখন তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে এল।
‘ছোকরাকে টেবিলে শুইয়ে পরীক্ষা করলাম। শজারুর কাঁটা দিয়ে হত্যা করার কথা সবাই জানে; আমি ভাবলাম এ ক্ষেত্রে কাঁটা বোধ হয় হার্ট পর্যন্ত পৌঁছয়নি। কিন্তু হার্ট পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি—অবাক কাণ্ড। হার্ট নেই! তারপর বুকের ডান দিকে হার্ট খুঁজে পেলাম। প্রকৃতির খেয়ালে ছোকরা ডান দিকে হার্ট নিয়ে জন্মেছে।
‘শজারুর কাঁটা হার্টকে বিঁধতে পারেনি বটে, কিন্তু বাঁ দিকের ফুসফুসে বিঁধেছে। সেটাও কম সিরিয়াস নয়। যতক্ষণ কাঁটা বিঁধে আছে, ততক্ষণ রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে না, কিন্তু কাঁটা বার করলেই ফুসফুসের মধ্যে রক্তপাত হয়ে মৃত্যু হতে পারে।
‘যাহোক, খুব সাবধানে পিঠ থেকে কাঁটা বার করলাম। ছ’ ইঞ্চি লম্বা কাঁটা, তার দু’ইঞ্চি বাইরে বেরিয়ে ছিল, বাকিটা সোজা ফুসফুসের মধ্যে ঢুকেছিল। এই দেখুন সেই কাঁটা।’
ডাক্তার পকেট থেকে একটি শজারুর কাঁটা বার করে ব্যোমকেশের হাতে দিলেন। শজারুর কাঁটা অনেকেই দেখেছেন, সবিস্তারে বর্ণনার প্রয়োজন নেই। এই কাঁটাটি নরুনের মত সরু, কাচের কাঠির মত অনমনীয় এবং ডাক্তারি শল্যের মত তীক্ষ্ণাগ্র। মারাত্মক অস্ত্রটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ব্যোমকেশ রাখালবাবুর হাতে দিল, বলল—‘তারপর বলুন।’
ডাক্তার বললেন—‘কাঁটা বার করলাম। ছোকরার বরাত ভাল ফুসফুসের মধ্যে রক্তপাত হল না। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান হল, নিজের ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিয়ে স্ত্রীর কাছে খবর পাঠাতে বলল। তারপর তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ালাম। ওর স্ত্রী যখন এল তখন ও ঘুমুচ্ছে।’
ব্যোমকেশ বলল—‘বাইরে একটি মেয়ে বসে আছে, সেই কি—?’
ডাক্তার বললেন—‘হ্যাঁ, দেবাশিসের স্ত্রী। ও স্বামীর কাছে থাকতে চায়, কিন্তু এখন তো তা সম্ভব নয়। ওকে বললাম, বাড়ি ফিরে যাও; কিন্তু ও যাবে না।’
‘ওকে স্বামীর কাছে যেতে দেওয়া হয়েছিল?’
‘একবার ঘরে গিয়ে স্বামীকে দেখে এসেছে। আমরা আশ্বাস দিয়েছি, আশঙ্কার বিশেষ কারণ নেই, তুমি বাড়ি যাও, কাল সকালে আবার এস। কিন্তু ও কিছুতেই যাবে না।’
ব্যোমকেশ উঠবার উপক্রম করে বলল—‘আচ্ছা, আমি একবার চেষ্টা করে দেখি।’
ডাক্তার বললেন—‘বেশ তো, দেখুন না। কিন্তু একটা কথা। ওর স্বামীকে কেউ খুন করবার চেষ্টা করেছিল একথা ওকে বলা হয়নি, বলা হয়েছে অ্যাক্সিডেন্টে বুকে চোট লেগেছে। আপনারাও তাই বলবেন। মেয়েটি এমনিতেই শক্ পেয়েছে, ওকথা শুনলে আরো বেশি শক্ পাবে।’
‘না, বলব না।’
রাখালবাবু বললেন—‘শজারুর কাঁটা আমি রাখলাম। এই নিয়ে চারটে হল।’
দীপা বেঞ্চির ওপর ঠিক আগের মতই সোজা হয়ে বসে ছিল, ব্যোমকেশ আর রাখালবাবু তার কাছে যেতেই সে উঠে দাঁড়াল। রাখালবাবু বললেন—‘আমি পুলিসের লোক। ইনি শ্রীব্যোমকেশ বক্সী।’
ব্যোমকেশের নাম দীপার মনে কোনো দাগ কাটল না। তার শঙ্কাভরা চোখ একবার এর মুখে একবার ওর মুখে যাতায়াত করতে লাগল।
ব্যোমকেশ নরম সুরে বলল—‘আপনি ভয় পাবেন না। আপনার স্বামীর গুরুতর আঘাত লেগেছিল বটে, কিন্তু জীবনের আশঙ্কা আর নেই।’
দীপা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে বোধ করি নিজেকে সংযত করল। তারপর ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল—‘আমাকে ওঘরে থাকতে দিচ্ছে না কেন?’
ব্যোমকেশ বলল—‘দেখুন, আপনার স্বামীকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, এ সময় আপনি তাঁর কাছে থেকে কী করবেন? তার চেয়ে—’
দীপা বলল—‘না, আমাকে যদি ওঁর কাছে থাকতে না দেওয়া হয়, আমি সারা রাত্রি এখানে বসে থাকব।’
ব্যোমকেশ বলল—‘কিন্তু রুগীর ঘরে ডাক্তার আর নার্স ছাড়া এসময় অন্য কারুর থাকা নিষেধ।’
দীপা বলল—‘আমি কিচ্ছু করব না, খাটের একপাশে চুপটি করে বসে থাকব।’
ব্যোমকেশ আরো কিছুক্ষণ দীপাকে বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তাকে টলাতে পারল না। তখন সে মাথা চুলকে বলল—‘আচ্ছা, ডাক্তারবাবুকে বলে দেখি। দেবাশিসবাবুর কি অন্য কোনো আত্মীয় এখানে নেই?’
‘না, ওঁর অন্য কোনো আত্মীয় নেই।’
‘আপনার নিশ্চয় আত্মীয়স্বজন আছেন। তাঁরা কোথায় থাকেন, তাঁদের খবর দেওয়া হয়েছে?’
দীপা বলল—‘তাঁরা কাছেই থাকেন, কিন্তু তাঁদের খবর দিতে ভুল হয়ে গেছে।’
ব্যোমকেশ বলল—‘ঠিকানা দিন, আমরা তাঁদের খবর দিচ্ছি।’
দীপা ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর দিল। ব্যোমকেশ তখন ডাক্তার গুপ্তর কাছে ফিরে গিয়ে বলল—‘ডাক্তারবাবু, বউটিকে স্বামীর কাছে থাকতে দিন। ও বুদ্ধিমতী বলেই মনে হল, কিন্তু বড় ভয় পেয়েছে।’
ডাক্তারবাবু দু’ একবার আপত্তি করলেন, স্ত্রীজাতি বড় ভাবপ্রবণ, আবেগের বশে যদি স্বামীকে আঁকড়ে ধরে, ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজী হলেন। ব্যোমকেশ দীপাকে ডেকে এনে যে ঘরে দেবাশিস ছিল সেই ঘরে নিয়ে গেল। দীপা পা টিপে টিপে গিয়ে খাটের পাশে দাঁড়াল, সামনের দিকে ঝুঁকে ব্যগ্র চোখে দেবাশিসের মুখ দেখল। দেবাশিস পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে, তার মুখের ভাব শান্ত প্রসন্ন। দীপা তার মুখের ওপর চোখ রেখে অতি সন্তর্পণে খাটের পাশে বসল। একজন নার্সও সঙ্গে এসেছিল, সে ঠোঁটে আঙুল রেখে দীপাকে সতর্ক করে দিল।
রাত্রি এগারোটার সময় হাসপাতাল থেকে বেরুবার পথে রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে চাইলেন—‘বউটির বাপের বাড়িতে টেলিফোন করতে হবে।’
ব্যোমকেশ বলল—‘না, সশরীরে সেখানে উপস্থিত হওয়া দরকার। আজ রাত্রে তোমার বিশ্রাম নেই।’
রাখালবাবু বললেন—‘আমি বিশ্রামের জন্যে ব্যস্ত নই।’
পুলিসের গাড়িতে দীপার বাপের বাড়িতে পৌঁছুতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। রাস্তা নিরালা, বাড়ির সদর দোর বন্ধ। রাখালবাবু সজোরে কড়া নাড়লেন।
কিছুক্ষণ পরে বিজয় ঘুম-চোখে দরজা একটু ফাঁক করে বলল—‘কে? কি চাই?’
রাখালবাবু বলল—‘ভয় নেই, দোর খুলুন। আমরা পুলিসের লোক।’
ইতিমধ্যে নীলমাধব উপস্থিত হয়েছেন। বিজয় দোর খুলে দিল, রাখালবাবু ব্যোমকেশকে নিয়ে ভিতরে এসে প্রশ্ন করলেন—‘দেবাশিস ভট্ট আপনাদের কে?’
নীলমাধব বললেন—‘আমার জামাই। কি হয়েছে?’
রাখালবাবু বললেন—‘একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, আপনার জামাই বুকে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে আছেন। আপনার মেয়েও খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছেন।’
নীলমাধব বললেন—‘অ্যাঁ! কোন্ হাসপাতালে?’
‘রাসবিহারী হাসপাতালে। ভয় পাবেন না আঘাত গুরুতর হলেও জীবনের আশঙ্কা নেই।’
‘আমরা এখনি যাচ্ছি। বিজয়, তুমি এদের বসাও, আমি তোমার মাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি ছুটে বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। ব্যোমকেশ, বিজয়কে প্রশ্ন করল—‘দেবাশিসবাবু আপনার ভগিনীপতি?’
‘হ্যাঁ। আমিও হাসপাতালে যাব।’
‘না আপনার সঙ্গে আমাদের একটু আলোচনা আছে।’
খানিক পরে নীলমাধব আধ-ঘোমটা টানা স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। রাখালবাবু বললেন—‘আপনারা পুলিসের গাড়িতেই যান। গাড়ি আপনাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবে। ততক্ষণ আমরা এখানেই আছি।’
তাঁদের রওনা করে দিয়ে তিনজনে বৈঠকখানায় এসে বসলেন। ব্যোমকেশ বিজয়কে প্রশ্ন করল—‘আপনার বোনের কত দিন বিয়ে হয়েছে?’
বিজয় বলল—‘দু’মাসের কিছু বেশি।’
‘আপনার ভগিনীপতি কি কাজ করেন?’
বিজয় ‘প্রজাপতি প্রসাধন ফ্যাক্টরির কথা বলল।
‘তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?’
‘যতদূর জানি, কেউ নেই!’
‘বন্ধুবান্ধব?’
‘অন্য বন্ধুবান্ধবের কথা জানি না, কিন্তু নৃপতিদার আড্ডায় যারা যায় তাদের সঙ্গে দেবাশিসের ঘনিষ্ঠতা আছে।’ নৃপতি লাহার আড্ডার পরিচয় দিয়ে বিজয় বলল—‘কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন?’
ব্যোমকেশ একবার রাখালবাবুর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে বলল—‘আপনাকে বলছি, আপনি উপস্থিত অন্য কাউকে বলবেন না, দেবাশিসবাবুকে কেউ খুন করবার চেষ্টা করেছিল।’
বিজয়ের চোখ জ্বল্জ্বল্ করে উঠল, সে উত্তেজিত হয়ে বলল—‘আমি জানতাম।’
ব্যোমকেশের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল—‘কী জানতেন?’
‘জানতাম যে, এই ঘটবে।’
‘জানতেন এই ঘটবে! কী জানতেন সব কথা বলুন।’
উত্তেজনার ঝোঁকে কথাটা বলে ফেলেই বিজয় থমকে গেল। আর কিছু বলতে চায় না, এ-কথা সে-কথা বলে আসল কথাটা চাপা দিতে চায়। ব্যোমকেশ তখন গম্ভীরভাবে বলল—‘দেখুন, দেবাশিসবাবুর শত্রু তাঁকে খুন করবার চেষ্টা করেছিল, দৈবক্রমে তাঁর প্রাণ বেঁচে গেছে। আপনি যদি আসামীকে আড়াল করবার চেষ্টা করেন তাহলে সে আবার চেষ্টা করবে। আপনি কি চান, আপনার বোন বিধবা হন?’
তখন বিজয় বলল—‘আমি যা জানি বলছি। কিন্তু কে আসামী, আমি জানি না।’
বিজয় দীপার প্রেম কাহিনী শোনাল। শুনে ব্যোমকেশ একটু চুপ করে রইল, তারপর বলল—‘মনে হয়, আপনার বোনের ছেলেমানুষী ভালবাসার নেশা কেটে গেছে। আচ্ছা, আজ আমরা উঠলাম। কাল বিকেলবেলা আমরা নৃপতিবাবুর বাড়িতে যাব। আপনিও উপস্থিত থাকবেন।’
ইতিমধ্যে পুলিসের গাড়ি ফিরে এসেছিল। ব্যোমকেশ গাড়িতে উঠে রাখালবাবুকে বলল—‘আজ এই পর্যন্ত। কাল সকালে আবার হাসপাতালে যাব।’
হাসপাতালে রাত্রি আড়াইটের সময় দেবাশিসের ঘুম ভাঙল। চোখ চেয়ে দেখল, একটি মুখ তার মুখের পানে ঝুঁকে অপলক চেয়ে আছে। ভারি মিষ্টি মুখখানি। দেবাশিস আস্তে আস্তে বলল—‘দীপা, কখন এলে?’
দীপা উত্তর দিতে পারল না, দেবাশিসের কপালে কপাল রেখে চুপ করে রইল।
‘দীপা!’
‘উঁ।’
‘ক্ষিদে পেয়েছে।’
দীপা ত্বরিত মাথা তুলল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, নার্স ঘরে প্রবেশ করেছে। নার্স ইতিপূর্বে আরো কয়েকবার ঘরে এসে রুগীকে দেখে গেছে। বলল—‘কি খবর? ঘুম ভেঙেছে?’
দীপা বলল—‘হ্যাঁ। বলছেন, ক্ষিদে পেয়েছে।’
নার্স হেসে বলল—‘বেশ। আমি ওভালটিন তৈরি করে রেখেছি, এখনি আনছি। আগে একবার নাড়িটা দেখি।’ নাড়ি দেখে নার্স বলল—‘চমৎকার। আমি এই এলুম বলে।’
নার্সের সঙ্গে সঙ্গে দীপা দোর পর্যন্ত গেল। নকুল তখনো দোরের পাশে বসেছিল, উঠে দাঁড়াল। বলল—‘বউদি, দাদাবাবু খেতে চাইছে?’
দীপা বলল—‘হ্যাঁ।’
‘জয় জগদীশ্বর! তাহলে আর ভয় নেই। বউদি, তুমিও তো কিছু খাওনি। তোমার ক্ষিদে পায়নি?’
দীপা একটু চুপ করে থেকে বলল—‘পেয়েছে। নকুল, তুমি বাড়ি যাও। নিজে খেয়ো, আর আমার জন্যে কিছু নিয়ে এস।’
‘আচ্ছা বউদি।’
নকুল চলে গেল। নার্স ফীডিং কাপে ওভালটিন এনে দেবাশিসকে খাওয়াল। তারপর দেবাশিস তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে দীপার একটি হাত মুঠির মধ্যে নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
ভোর হলে দীপার মা বাবা বিজয় সকলে আবার এলেন। দেবাশিস তখন ঘুমোচ্ছে। দীপার মা দীপাকে বললেন—‘দীপা, আমরা এখানে আছি, তুই বাড়ি যা, সেখানে স্নান করে একটু কিছু মুখে দিয়ে আবার আসিস।’
দীপা দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বলল—‘না। নকুল আমার জন্যে খাবার এনেছিল, আমি খেয়েছি।’
বেলা আন্দাজ দশটার সময় ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু হাসপাতালে এলেন। ডাক্তার গুপ্ত একগাল হেসে বললেন—‘ভাল খবর। ছোকরা এ যাত্রা বেঁচে গেল। সকালে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তবু এখনো অন্তত দু’তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হবে।’
রাখালবাবু বললেন—‘ভাল। আমরা তাহলে তার সঙ্গে দেখা করতে পারি?’
ডাক্তার বললেন—‘পারেন। কিন্তু দশ মিনিটের বেশি নয়।’
ব্যোমকেশ বলল—‘আপাতত দশ মিনিটই যথেষ্ট।’
দেবাশিস তখন পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে ছিল, আর দীপা তার মুখের কাছে ঝুঁকে চুপি চুপি কথা বলছিল। ব্যোমকেশ আর রাখালবাবুকে আসতে দেখে লজ্জিতভাবে উঠে দাঁড়াল।
ব্যোমকেশ স্মিতমুখে দীপাকে বলল—‘আপনি কাল থেকে এখানে আছেন, এবার অন্তত ঘণ্টাখানেকের জন্যে যেতে হবে। আমরা ততক্ষণ দেবাশিসবাবুর কাছে আছি।’
দেবাশিস ক্ষীণকণ্ঠে বলল—‘আমিও তো সেই কথাই বলছি।’
দীপা একটু ইতস্তত করল, তারপর অনিচ্ছাভরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বলে গেল—‘আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই আসব।’
ব্যোমকেশ আর রাখালবাবু তখন দেবাশিসের সামনে চেয়ার টেনে বসলেন, রাখালবাবু নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন—‘আমরা আপনাকে দু’চারটি প্রশ্ন করব।’
দেবাশিস বলল—‘বেশ তো, করুন।’
অতঃপর প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হল।
‘আপনি কাল সন্ধ্যের পর লেকে বেড়াতে গিয়েছিলেন?’
‘ঠিক বেড়াতে যাইনি, তবে গিয়েছিলাম।’
‘কেন গিয়েছিলেন?’
‘একজন বন্ধু টেলিফোন করে ডেকেছিল।’
‘কে বন্ধু? নাম কি?’
‘খড়্গ বাহাদুর।’
‘খড়্গ বাহাদুর! নেপালী নাকি?’
‘হ্যাঁ। নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়।’
‘ও সেই! তা লেকের ধারে ডেকেছিল কেন?’
‘ব্যক্তিগত কারণ। যদি না বললে চলে—’
‘চলবে না। বলুন।’
‘ওর কিছু টাকার দরকার হয়েছিল, তাই আমার কাছে ধার চাইবার জন্য ডেকেছিল।’
‘আপনার বাড়িতে আসেনি কেন?’
‘তা জানি না। বোধ হয় বাড়িতে আসতে সঙ্কোচ হয়েছিল, যদি কেউ জানতে পারে।’
‘হুঁ। কত টাকা চেয়েছিল?’
‘এক হাজার।’
‘আপনি টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন?’
‘না না, খড়্গ টেলিফোনে টাকার কথা বলেনি। শুধু বলেছিল জরুরী দরকার আছে।’
‘তারপর?’
‘গিয়ে দেখলাম, সে বড় ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে; দু’জনে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসলাম। খড়্গ টাকার কথা বলল; আমি রাজী হলাম। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর খড়্গ চলে গেল, তার অন্য একজনের সঙ্গে দেখা করবার ছিল। আমি একলা বসে রইলাম। হঠাৎ পিঠে দারুণ যন্ত্রণা হল। তারপর আর মনে নেই।’
‘পিছন দিকে কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন?’
‘না।’
রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল—‘আপনার হৃৎপিণ্ড যে শরীরের ডান দিকে একথা আপনার স্ত্রী নিশ্চয় জানেন?’
দেবাশিস চোখ বুজে একটু চুপ করে রইল, শেষে বলল—‘না, ও বোধহয় জানে না।’
‘আপনার বন্ধুরা জানেন?’
‘না, আমার বন্ধু বড় কেউ নেই, সহকর্মী আছে। সম্প্রতি মাস দুয়েক থেকে আমি নৃপতিদার বাড়িতে যাই, সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে।’
‘নৃপতিবাবুর বাড়ির বন্ধুরা কেউ জানে?’
‘না।’
‘কেউ জানে না?’
‘বাবা জানতেন আর ডাক্তারবাবুরা জানেন।’
‘এমন কেউ আছে আপনার মৃত্যুতে যার লাভ হবে?’
‘কেউ না।’
‘আচ্ছা, আজ আর আপনাকে বেশি প্রশ্ন করব না। আপনি সেরে উঠুন, তারপর যদি দরকার হয় তখন দেখা যাবে।’
সন্ধ্যের পর নৃপতির ঘরে আড্ডাধারীরা সকলেই উপস্থিত হয়েছিল। বিজয়ও ছিল। সকলের মুখেই উদ্বেগের গাম্ভীর্য। আজ প্রবাল পিয়ানো বাজাচ্ছে না, তক্তপোশের ওপর গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বিজয়ের মুখে দেবাশিসের কথা শোনার পর সকলেই মুহ্যমান। খবরের কাগজের দুঃসংবাদ হঠাৎ নিজের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রবাল মুখ তুলে প্রশ্ন করল—‘ব্যোমকেশ বক্সী কে?’
কপিল মুখের একটা ব্যঙ্গ-বঙ্কিম ভঙ্গী করল। বিজয় উত্তর দেবার জন্যে মুখ খুলল কিন্তু উওর দেবার দরকার হল না, সদর দরজার বাইরে জুতোর শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু প্রবেশ করলেন।
সকলে উঠে দাঁড়াল। নৃপতি এগিয়ে গিয়ে বলল—‘আসুন, আমরা আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি। আমার নাম নৃপতি লাহা। এঁরা—’ নৃপতি একে একে কপিল, প্রবাল, সুজন ও খড়্গ বাহাদুরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, তারপর চেয়ারে বসিয়ে সিগারেট দিল—‘বিজয়ের মুখে আমরা সবই শুনেছি।’
ব্যোমকেশ একটু র্ভৎসনার চোখে বিজয়ের পানে চাইল, বিজয় কুণ্ঠিতভাবে বলল—‘হ্যাঁ ব্যোমকেশবাবু, এরা ছাড়ল না, শজারুর কাঁটার কথা এদের বলেছি।’
খড়্গ বাহাদুর বলল—‘আচ্ছা ব্যোমকেশবাবু, এই যে শজারুর কাঁটা নিয়ে ব্যাপার, এটা কী? আপনার কি মনে হয় এসব একটা পাগলের কাজ?’
ব্যোমকেশ বলল—‘পাগলের কাজ হতে পারে, আবার পাগল সাজার চেষ্টাও হতে পারে।’
সুজন বলল—‘সেটা কি রকম?’
ব্যোমকেশ বলল—‘পাগল সাজলে অনেক সময় খুনের দায়ে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। বড় জোর পাগলা গারদে বন্ধ করে রাখে, ফাঁসি হয় না, এই আর কি। আপনারা দেবাশিসবাবুর বন্ধু, তাঁর জীবন সম্বন্ধে নিশ্চয় অনেক কিছু জানেন।’
নৃপতি বলল—‘দেবাশিসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বেশি দিনের নয়। আমাদের মধ্যে কেবল প্রবাল তাকে আগে থেকে চিনত।’ বলে প্রবালের দিকে আঙুল দেখাল।
ব্যোমকেশ প্রবালের দিকে চাইল। প্রবাল গলা পরিষ্কার করে বলল—‘স্কুলে দেবাশিসের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছিলাম। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল কিন্তু বন্ধুত্ব ছিল না।’
‘বন্ধুত্ব ছিল না!’
‘বন্ধুত্ব ছিল না, অসদ্ভাবও ছিল না। তারপর ও পাস করে দিল্লী চলে গেল, অনেক দিন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। মাস দু’-এক আগে এই ঘরে তাকে আবার দেখলাম।’
‘ও’—ব্যোমকেশ সিগারেটে দু’তিনটে টান দিয়ে খড়্গ বাহাদুরের দিকে চোখ ফেরাল। বলল—‘কাল রাত্রে আন্দাজ আটটার সময় আপনি দেবাশিসবাবুকে টেলিফোন করেছিলেন?’
খড়্গ বাহাদুর বোধহয় প্রশ্নটা প্রতীক্ষা করছিল, সংযত স্বরে বলল—‘হ্যাঁ।’
‘কোথা থেকে টেলিফোন করেছিলেন?’
‘এখান থেকে। নৃপতিদার টেলিফোন আছে। আমার সকলেই দরকার হলে ব্যবহার করি। কাল আমরা সকলেই এখানে ছিলাম, দেবাশিস ছাড়া। তার আশায় অনেকক্ষণ এখানে অপেক্ষা করলাম। কিন্তু সে যখন এল না তখন তাকে টেলিফোন করেছিলাম।’
‘তারপর লেকে দেখা হয়েছিল। এখন একটা কথা বলুন দেখি, আপনি যখন দেবাশিসবাবুকে ছেড়ে চলে আসেন তখন আশেপাশে কাউকে দেখেছিলেন?’
‘দেখে থাকলেও লক্ষ্য করিনি। আমরা একটা গাছের তলায় বেঞ্চিতে বসেছিলাম। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, ললাকজন বেশি ছিল না।’
ব্যোমকেশ তখন নৃপতিকে বলল—‘আপনাকে একটি কাজ করতে হবে। আমরা আপনাদের পৃথকভাবে প্রশ্ন করতে চাই। আমরা একটা ঘরে গিয়ে বসব, আর আপনারা একে একে আসবেন। ছোট একটা ঘর পাওয়া যাবে কি?’
নৃপতি বলল—‘পাশেই ছোট ঘর আছে, আসুন দেখাচ্ছি।’
পরদা-ঢাকা দরজা দিয়ে নৃপতি তাদের পাশের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটি ছোট, কয়েকটি চেয়ারের মাঝখানে একটি গোল টেবিল, টেবিলের ওপর টেলিফোন যন্ত্র।
ব্যোমকেশ বলল—‘এই তো ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম। রাখাল, তুমি সভাপতির আসন অলঙ্কৃত কর। নৃপতিবাবু, আপনি বাকি সকলকে বসতে বলে আসুন। আগে আপনার জেরা শেষ করে একে একে ওঁদের ডাকব।’
ছোট্ট ঘরটিতে এজলাস বসল। প্রশ্নোত্তর চলল। চাকর কফি দিয়ে গেল। একে একে সকলে সাক্ষী দিল। সকলের শেষে এল বিজয়। ব্যোমকেশ তাকে বলল, ‘বিজয়বাবু, আপনার বোনের আইবুড়ো বেলার বই-খাতা জিনিসপত্র নিশ্চয় এখনো আপনাদের বাড়িতে আছে? বেশ। কাল আমরা যাব, একটু নেড়েচেড়ে দেখব যদি দরকারী কিছু পাওয়া যায়।’
বিজয় বলল, ‘আচ্ছা।’
অতঃপর সভা ভঙ্গ হল। দশটা বাজতে তখন বেশি দেরি নেই।
পরদিন সকাল আটটার সময় বিজয় নিজেদের বাড়িতে অপেক্ষা করছিল, ব্যোমকেশ আর রাখালবাবু আসতেই তাঁদের দোতলায় দীপার ঘরে নিয়ে গেল। বলল—‘এইটে দীপার ঘর। এই ঘরেই তার যা কিছু আছে, বিশেষ কিছু নিয়ে যায়নি।’
বেশ বড় ঘর। জানলার পাশে খাট বিছানা, অন্য পাশে টেবিল চেয়ার বই-এর আলমারি। পিছনের দেয়ালে একটি এস্রাজ ঝুলছে। টেবিলের মাঝখানে ছোট্ট একটি জাপানী ট্রান্জিস্টার রাখা আছে। ব্যোমকেশ ঘরের চারদিকে একবার সন্ধানী চোখ ফিরিয়ে বলল—‘দীপা দেবীর দেখছি গানবাজনার শখ আছে।’
বিজয় বলল—‘হ্যাঁ, একটু-আধটু এস্রাজ বাজাতেও জানে। নিজের চেষ্টাতে শিখেছে।’
‘লেখাপড়া কত দূর শিখেছেন?’
‘স্কুলের পড়া শেষ পর্যন্ত পড়েছে। কলেজে দেওয়া হয়নি।’
‘আপনার বাবা বাড়িতে আছেন?’
‘না। বাবা মা হাসপাতালে গেছেন।’
‘দেবাশিসবাবু ভাল আছেন। আমি টেলিফোনে খবর নিয়েছিলাম। বোধহয় দু’-তিন দিনের মধ্যেই ছেড়ে দেবে।’
‘হ্যাঁ। আপনারা চা খাবেন?’
ব্যোমকেশ রাখালবাবুর দিকে একবার তাকিয়ে বলল—‘আপত্তি কি? একবার হয়েছে, কিন্তু অধিকন্তু ন দোষায়।’
‘আচ্ছা, আমি চা নিয়ে আসছি, আপনারা দেখুন। বই-এর আলমারির চাবি খুলে দিয়েছি। খাটের তলায় দুটো ট্রাঙ্ক আছে, তার চাবিও খোলা।’
বিজয় বেরিয়ে যাবার পর ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে বলল—‘ঘরে তল্লাশ করার মত বিশেষ কিছু নেই দেখছি। আমি বই-এর আলমারিটা দেখি, তুমি ততক্ষণ ট্রাঙ্ক দুটো হাঁটকাও।’
রাখালবাবু খাটের তলা থেকে ট্রাঙ্ক দুটো টেনে বার করলেন, ব্যোমকেশ আলমারি খুলে বই দেখতে লাগল। বইগুলি বেশ পরিচ্ছন্নভাবে সাজানো; প্রথম সারিতে কবিতা আর গানের বই: সঞ্চয়িতা গীতবিতান দ্বিজেন্দ্রগীতি নজরুলগীতিকা প্রভৃতি। দ্বিতীয় থাকে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের কয়েক ভল্যুম গ্রন্থাবলী। নীচের থাকে স্কুল-পাঠ্য বই। দীপা স্কুলে পড়ার সময় যে বইগুলি পড়েছিল সেগুলি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে।
ব্যোমকেশ বইগুলি একে একে খুলে দেখল, কিন্তু কোথাও এমন কিছু পেল না যা থেকে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আধুনিক কোনো লেখকের বই আলমারিতে নেই, এমন কি শরৎচন্দ্রের বইও না; এ থেকে পারিবারিক গোঁড়ামির পরিচয় পাওয়া যায়, দীপার মানসিক প্রবণতার কোনো ইশারা তাতে নেই।
‘ব্যোমকেশদা, একবার এদিকে আসুন।’
ব্যোমকেশ রাখালবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তিনি একটা খোলা ট্রাঙ্কের সামনে হাঁটু গেডে। বসে আছেন, সামনে মেয়েলী জামাকাপড়ের স্তূপ, হাতে পোস্টকার্ড আয়তনের একটি সুদৃশ্য বাঁধানো খাতা। খাতাটি ব্যোমকেশের দিকে এগিয়ে দিয়ে রাখালবাবু বললেন—‘কাপড়-চোপড়ের তলায় ছিল। পড়ে দেখুন।’
অটোগ্রাফের খাতা। বেশির ভাগ পাতাই খালি, সামনের কয়েকটি পাতায় উদয়মাধব প্রভৃতি বাড়ির কয়েকজনের হস্তাক্ষর, দু’-একটি মেয়েলী কাঁচা হাতের নাম দস্তখত। তারপর একটি পাতায় একজনের স্বাক্ষরের ওপর একটি কবিতার ভগ্নাংশ—তোমার চোখের বিজলী-উজল আলোকে, পরাণে আমার ঝঞ্ঝার মেঘ ঝলকে। —তারপর আর সব পৃষ্ঠা শূন্য।
অটোগ্রাফের খাতাটি যে দীপার তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, মলাটের ওপরেই তার নাম লেখা রয়েছে।
যিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা একটু মোচড় দিয়ে উদ্ধৃত করেছেন তাঁর নামটি অপরিচিত নয়, তিনি বিশেষ একটি আড্ডার নিয়মিত সভ্য।
ব্যোমকেশ খাটো গলায় বলল—‘হুঁ! আমাদের সন্দেহ তাহলে মিথ্যে নয়।’
বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ব্যোমকেশ চট্ করে অটোগ্রাফের খাতাটি পকেটে পুরে রাখালবাবুকে চোখের ইশারা করল।
বিজয় দু’হাতে দু’ পেয়ালা চা নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখল, বলল—‘আসুন। কিছু পেলেন?’
রাখালবাবু কেবল গলার মধ্যে শব্দ করলেন, ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল—‘সত্যান্বেষণের পথ বড় দুর্গম। কোথায় কোন কানা গলির মধ্যে সত্য লুকিয়ে আছে, কে বলতে পারে! যাহোক, নিরাশ হবেন না, দু’-চার দিনের মধ্যেই আসামী ধরা পড়বে।’
তারপর দু’জনে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় যেতে যেতে রাখালবাবু বললেন—‘তাহলে এখন বাকি রইল শুধু আসামীকে গ্রেপ্তার করা। অবশ্য পাকা রকম সাক্ষীসাবুদ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে পাকড়ানো যাবে না।’
ব্যোমকেশ বলল—‘না, তাকে পাকড়াবার একটা ফন্দি বার করতে হবে। কিন্তু তার আগে নিঃসংশয়ভাবে জানা দরকার, দেবাশিসের স্ত্রী এ ব্যাপারে কতখানি লিপ্ত আছে।’
হাসপাতালে ডাক্তার গুপ্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। একটি নিভৃত ঘরে দীপার সঙ্গে ব্যোমকেশ ও রাখালবাবুর কথা হল। ব্যোমকেশ বলল—‘আমরা আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। কেন প্রশ্ন করতে চাই এখন জানতে চাইবেন না, পরে আপনিই জানতে পারবেন।’
দীপা সহজভাবে বলল—‘কি জানতে চান, বলুন।’ তার মুখে আতঙ্কের ভাব আর নেই, সে তার স্বাভাবিক সাহস অনেকটা ফিরে পেয়েছে।
সওয়াল জবাব আরম্ভ হল। রাখালবাবু অচঞ্চল চোখে দীপার মুখের পানে চেয়ে রইলেন।
ব্যোমকেশ বলল—‘নৃপতি লাহা নামে একটি ভদ্রলোকের বাড়িতে যাঁদের নিয়মিত আড্ডা বসে তাঁদের আপনি চেনেন?’
দীপার চোখের দৃষ্টি সতর্ক হল, সে বলল—‘হ্যাঁ, চিনি। ওঁরা সবাই আমার দাদার বন্ধু।’
‘ওঁরা আপনার বাপের বাড়িতে যাতায়াত করেন?’
‘বাড়িতে কাজকর্ম থাকলে আসেন।’
‘এঁদের নাম নৃপতি লাহা, সুজন মিত্র, কপিল বসু প্রবাল গুপ্ত, খড়্গ বাহাদুর। এঁদের ছাড়া আর কাউকে চেনেন?’
‘না, কেবল এঁদেরই চিনি।’
‘আচ্ছা, নৃপতি লাহা বিপত্নীক আপনি জানেন?’
‘…যেন শুনেছিলাম।’
‘এঁদের মধ্যে আর কারুর বিয়ে হয়েছে কিনা জানেন?’
‘বোধহয়…আর কারুর বিয়ে হয়নি।’
‘প্রবাল গুপ্ত কি বিবাহিত?’
‘ঠিক জানি না…বোধ হয় বিবাহিত নয়।’
‘প্রবাল গুপ্ত বিবাহিত…সম্প্রতি স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে।’
‘…আমি জানতাম না।’
‘যাক। কপিল বসু লোকটিকে আপনার কেমন লাগে?’
‘ভালই তো।’
‘ওর সম্বন্ধে কোনো কুৎসা শুনেছেন?’
‘না।’
‘আর সুজন মিত্র? সে সিনেমার আর্টিস্ট, তার সম্বন্ধে কিছু শোনেননি?’
‘না, ও-সব আমি কিছু শুনিনি।’
‘আপনি সিনেমা দেখতে ভালবাসেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘সুজন মিত্রের অভিনয় কেমন লাগে?’
‘খুব ভাল।’
‘উনি কেমন লোক?’
‘দাদার বন্ধু, ভালই হবেন। দাদা মন্দ লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন না।’
‘তা বটে। আপনি ফুটবল খেলা দেখেছেন?’
‘ছেলেবেলায় দেখেছি, যখন স্কুলে পড়তুম।’
‘খড়্গ বাহাদুরের খেলা দেখেছেন?’
‘না…রেডিওতে খেলার কমেন্টারি শুনেছি।’
‘এবার শেষ প্রশ্ন। —আপনার স্বামীর হৃদ্যন্ত্র বুকের ডান দিকে আপনি জানেন?’
‘জানি।’
ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলে চাইল—‘জানেন?’
‘হ্যাঁ, কিছুদিন আগে দুপুর রাত্রে আমার স্বামীর কম্প দিয়ে জ্বর এসেছিল। আমাকে ডাক্তার ডাকতে বললেন। আমি জানতুম না ওঁদের পারিবারিক ডাক্তার কে, তাই আমার বাপের বাড়ির ডাক্তারকে ফোন করলাম। সেনকাকা এসে ওঁকে পরীক্ষা করলেন, তারপর যাবার সময় আমাকে আড়ালে বলে গেলেন যে, ওঁর হৃদ্যন্ত্র উল্টো দিকে। এরকম নাকি খুব বেশি দেখা যায় না।’
প্রকাণ্ড হাঁফ-ছাড়া নিশ্বাস ফেলে ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়াল, বলল—‘আমার বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। আর কিছু জানবার নেই, আপনি স্বামীর কাছে যান। —চলো রাখাল।’
হাসপাতালের বাইরে এসে ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে প্রশ্ন করল—‘কি দেখলে? কি বুঝলে?’
রাখালবাবু বললেন—‘কোনো ভুল নেই, মেয়েটি নির্দোষ। প্রতিক্রিয়া যখন যেমনটি আশা করা গিয়েছিল, ঠিক তেমনটি পাওয়া গেছে। এখন কিং কর্তব্য?’
ব্যোমকেশ বলল—‘এখন তুমি থানায় যাও, আমি বাড়ি যাই। ভাল কথা, একটা বুলেট-প্রুফ গেঞ্জি যোগাড় করতে পার?’
‘পারি। কী হবে?’
‘একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। আজ রাত্রে গেঞ্জি নিয়ে আমার বাড়িতে এস, তখন বলব।’
সন্ধ্যের পর ব্যোমকেশ একা নৃপতির আড্ডায় গেল। সকলেই উপস্থিত ছিল, ব্যোমকেশকে ছেঁকে ধরল। নৃপতি তার সামনে সিগারেটের কৌটো খুলে ধরে বলল—‘খবর নিয়েছি দু’-এক দিনের মধ্যেই দেবাশিসকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে। ওর বিপন্মুক্তি উপলক্ষে আমি পার্টি দেব, আপনাকে আসতে হবে।’
ব্যোমকেশ বলল—‘নিশ্চয় আসব।’
কপিল ব্যোমকেশের গা ঘেঁষে বসে আবদারের সুরে বলল—‘আপনার সত্যান্বেষণ কত দূর অগ্রসর হল, বলুন না ব্যোমকেশবাবু।’
ব্যোমকেশ হেসে বলল—‘দিল্লী দূরস্ত। শজারুর কাঁটার ওস্তাদটি কে তা এখনো জানা যায়নি। তবে একটা থিওরি খাড়া করেছি।’
সুজন গলা বাড়িয়ে বলল—‘কি রকম থিওরি?’
ব্যোমকেশ সিগারেটে কয়েকটা ধীর মন্থর টান দিয়ে বলতে আরম্ভ করল—‘ব্যাপারটা হচ্ছে এই। কোনো একজন অজ্ঞাত লোক শজারুর কাঁটা দিয়ে প্রথমে একটা ভিখিরিকে খুন করল, তারপর এক মজুরকে খুন করল, তারপর আবার খুন করল এক দোকানদারকে। এবং সর্বশেষে দেবাশিসবাবুকে খুন করবার চেষ্টা করল। চার বারই অস্ত্র হচ্ছে শজারুর কাঁটা। অথাৎ হত্যাকারী জানাতে চায় যে চারটি হত্যাকার্য একই লোকের কাজ।
‘এখন হত্যাকারী যদি পাগল হয় তাহলে কিছুই করবার নেই। পাগল অনেক রকম হয়; এক ধরনের পাগল আছে যাদের পাগল বলে চেনা যায় না; তারা অত্যন্ত ধূর্ত, তাদের খুন করার কোনো যুক্তিসঙ্গত মোটিভ থাকে না। এই ধরনের পাগলকে ধরা বড় কঠিন।
‘কিন্তু যদি পাগল না হয়? যদি পুলিসের চোখে ধূলো দেবার জন্যে কেউ পাগল সেজে শজারুর কাঁটার ফন্দি বার করে থাকে? মনে করুন, দেবাশিসবাবুর এমন কোনো গুপ্ত শত্রু আছে যে তাঁকে খুন করতে চায়। সরাসরি খুন করলে ধরা পড়ার ভয় বেশি, তাই সে ভিখিরি খুন করে কাজ আরম্ভ করল; তারপর মজুর, তারপর দোকানদার, তারপর দেবাশিসবাবু। স্বভাবতই মনে হবে দেবাশিসবাবু হত্যাকারীর প্রধান লক্ষ্য নয়, একটা বিকৃতমস্তিষ্ক লোক যখন যাকে সুবিধে পাচ্ছে খুন করে যাচ্ছে। হত্যাকারী যে দেবাশিসবাবুকেই খুন করবার জন্যে এত ভণিতা করেছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। —এই আমার থিওরি।’
কিছুক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ হয়ে রইল, তারপর নৃপতি বলল—‘কিন্তু মনে করুন এর পর আবার একটা খুন হল শজারুর কাঁটা দিয়ে! তখন তো বলা চলবে না যে দেবাশিসই হত্যাকারীর আসল লক্ষ্য।’
ব্যোমকেশ বলল—‘না। তখন আবার নতুন রাস্তা ধরতে হবে।’
কপিল বলল—‘খুনীকে কি ধরা যাবে?’
ব্যোমকেশ বলল—‘চেষ্টার ত্রুটি হবে না।’
এমন সময় কফি এল। প্রবাল উঠে গিয়ে পিয়ানোতে মৃদু টুং-টাং আরম্ভ করল। ব্যোমকেশ কফি শেষ করে আরো কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে বাড়ি ফিরে চলল।
ব্যোমকেশ বাড়ি ফিরে আসার কয়েক মিনিট পরে রাত্রি পৌনে ন’টার সময় রাখালবাবু এলেন। তাঁর হাতে একটি মোড়ক। ব্যোমকেশ বলল—‘এনেছ?’
রাখালবাবু মোড়ক খুলে দেখালেন; ব্রোকেডের মত কাপড় দিয়ে তৈরি একটি ফতুয়া, কিন্তু সোনালী বা রূপালী জরির ব্রোকেড নয়, স্টীলের জরি দিয়ে তৈরি ঘন-পিনদ্ধ লৌহ-জালিক। জামার ভিতরে পরলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু এই কঠিন বর্ম ভেদ করা ছোরাছুরি তো দূরের কথা, পিস্তল রিভলবারেরও অসাধ্য।
ব্যোমকেশ জামাটি নিয়ে নেড়েচেড়ে পাশে রাখল, বলল—‘আমার গায়ে ঠিক হবে। এখন আর একটা কথা বলি; আমাদের শজারুর পিছনে লেজুড় লাগাবার ব্যবস্থা করেছ?’
রাখালবাবু বললেন—‘সব ব্যবস্থা হয়েছে। আজ রাত্রি সাতটা থেকে লেজুড় লেগেছে, এক লহমার জন্যে তাকে চোখের আড়াল করা হবে না। দিনের বেলাও তার পিছনে লেজুড় থাকবে।’
ব্যোমকেশ বলল—‘বেশ। এখন এস পরামর্শ করি। আমি পুকুরে চার ফেলে এসেছি—’
খাটো গলায় দু’জনের মধ্যে অনেকক্ষণ পরামর্শ হল। তারপর সাড়ে ন’টা বাজলে রাখালবাবু ওঠবার উপক্রম করছেন, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।
ব্যোমকেশ ফোন তুলে নিয়ে বলল—‘হ্যালো।’
অপর প্রান্ত থেকে চেনা গলা শোনা গেল—‘ব্যোমকেশবাবু? আপনি একলা আছেন?’
ব্যোমকেশ রাখালবাবুর দিকে সঙ্কেত-ভরা দৃষ্টিপাত করে বলল—‘হ্যাঁ, একলা আছি। আপনি—’
‘গলা শুনে চিনতে পারছেন না?’
‘না। আপনার নাম?’
‘যখন গলা চিনতে পারেননি তখন নাম না জানলেও চলবে। আজ সন্ধ্যের পর আপনি যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে আমি ছিলাম। একটা গোপন খবর আপনাকে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সকলের সামনে বলতে পারলাম না।’
‘গোপন খবর! শজারুর কাঁটা সম্বন্ধে?’
‘হ্যাঁ। আপনি যদি আজ রবীন্দ্র সরোবরের বড় ফটকের কাছে আসেন আপনাকে বলতে পারি।’
‘বেশ তো, বেশ তো। কখন আসব বলুন।’
‘যত শীগ্গির সম্ভব। আমি অপেক্ষা করব। একলা আসবেন কিন্তু। অন্য কারুর সামনে আমি কিছু বলব না।’
‘বেশ। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরুচ্ছি।’
টেলিফোন রেখে ব্যোমকেশ যখন রাখালবাবুর দিকে তাকাল তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে সে বলল, ‘টোপ ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মাছ টোপ গিলেছে। এত শীগ্গির ওষুধ ধরবে ভাবিনি। রাখাল, তুমি—’
ব্যোমকেশ পাঞ্জাবি খুলে ফেলল, রাখালবাবু তাকে বুলেট-প্রুফ ফতুয়া পরাতে পরাতে বললেন—‘আমার জন্যে ভাববেন না, আমি ঠিক যথাস্থানে থাকব। শজারুর পিছনে লেজুড় আছে, তিনজনে মিলে শজারুকে কাবু করা শক্ত হবে না।’
‘বেশ।’ ব্যোমকেশ ফতুয়ার ওপর আবার পাঞ্জাবি পরল, তারপর রাখালবাবুর দিকে একবার অর্থপূর্ণ ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেল। রাখালবাবু কব্জিতে ঘড়ি দেখলেন, দশটা বাজতে কুড়ি মিনিট। তিনিও বেরিয়ে পড়লেন। প্রচ্ছন্নভাবে যথাস্থানে যথাসময়ে উপস্থিত থাকতে হবে।
রবীন্দ্র সরোবরের সদর ফটকের সামনে লোক চলাচল নেই; কদাচিৎ একটা বাস কিংবা মোটর হুস করে সাদার্ন অ্যাভেন্যু দিয়ে চলে যাচ্ছে।
ব্যোমকেশ দ্রুতপদে সাদার্ন অ্যাভেন্যু রাস্তা পেরিয়ে ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল; এদিক-ওদিক তাকাল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। রবীন্দ্র সরোবরের ভিতরে আলো-আঁধারিতে জনমানব চোখে পড়ে না।
ব্যোমকেশ ফটকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খানিক ইতস্তত করল, তারপর ভিতর দিকে অগ্রসর হল। দু’-চার পা এগিয়েছে, একটি লোক অদূরের গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল, হাত তুলে ব্যোমকেশকে ইশারা করে ডাকল। ব্যোমকেশ তার কাছে গেল, লোকটি বলল, ‘চলুন, ওই বেঞ্চিতে বসা যাক।’
জলের ধারে গাছের তলায় বেঞ্চি পাতা। ব্যোমকেশ গিয়ে বেঞ্চিতে ডানদিকের কিনারায় বসল। চারিদিকের ঝিকিমিকি আলোতে অস্পষ্টভাবে মুখ দেখা যায়, তার বেশি নয়। ব্যোমকেশ বলল—‘এবার বলুন, আপনি কি জানেন।’
লোকটি বলল—‘বলছি। দেখুন, যার কথা বলতে চাই সে আমার ঘনিষ্ঠ লোক, তাই বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। সিগারেট আছে?’
ব্যোমকেশ সিগারেটের প্যাকেট বার করে দিল; লোকটি সিগারেট নিয়ে প্যাকেট ব্যোমকেশকে ফেরত দিল, নিজের পকেট থেকে বোধকরি দেশলাই বার করতে করতে হঠাৎ বলে উঠল—‘দেখুন, দেখুন কে আসছে!’ তার দৃষ্টি ব্যোমকেশকে পেরিয়ে পাশের দিকে প্রসারিত, যেন ব্যোমকেশের দিক থেকে কেউ আসছে।
ব্যোমকেশ সেই দিকে ঘুরে বসল। সে প্রস্তুত ছিল, অনুভব করল তার পিঠের বাঁ দিকে বুলেট-প্রুফ আবরণের ওপর চাপ পড়ছে। ব্যোমকেশ বিদ্যুদ্বেগে পিছু ফিরল। লোকটি তার পিঠে শজারুর কাঁটা বিঁধিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল, পলকের জন্যে হতবুদ্ধির মত চাইল, তারপর দ্রুত উঠে পালাবার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যোমকেশের বজ্রমুষ্টি লোহার মুগুরের মত তার চোয়ালে লেগে তাকে ধরাশায়ী করল।
ইতিমধ্যে আরো দু’টি মানুষ আলাদিনের জিনের মত আবির্ভূত হয়েছিল, তারা ধরাশায়ী লোকটির দু’হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল। রাখালবাবু তার হাত থেকে শজারুর কাঁটা ছিনিয়ে নিয়ে বললেন—‘প্রবাল গুপ্ত, তুমি তিনজনকে খুন করেছ এবং দু’জনকে খুন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছ। চল, এবার থানায় যেতে হবে।’
হপ্তা দুই পরে একদিন মেঘাচ্ছন্ন সকালবেলা ব্যোমকেশের বসবার ঘরে পারিবারিক চায়ের আসর বসেছিল। অজিত ছিল, সত্যবতীও ছিল। গত রাত্রি থেকে বর্ষণ আরম্ভ হয়েছে, মাঝে মাঝে থামছে, আবার আরম্ভ হচ্ছে। গ্রীষ্মের রক্তিম ক্রোধ স্নেহে বিগলিত হয়ে গেছে।
অজিত বলল—‘এমন একটা গাইয়ে লোককে তুমি পুলিসে ধরিয়ে দিলে! লোকটা বড় ভাল গায়। —সত্যিই এতগুলো খুন করেছে?’
সত্যবতী বলল—‘লোকটা নিশ্চয় পাগল।’
ব্যোমকেশ বলল—‘প্রবাল গুপ্ত পাগল নয়; কিন্তু একেবারে প্রকৃতিস্থ মানুষও নয়। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে ছিল, হঠাৎ দৈব-দুর্বিপাকে গরীব হয়ে গেল; দারিদ্রের তিক্ত রসে ওর মনটা বিষিয়ে উঠল। ওর চরিত্রে ষড়রিপুর মধ্যে দুটো বলবান—লোভ আর ঈর্ষা। দারিদ্র্যের আবহাওয়ায় এই দুটো রিপু তাকে প্রকৃতিস্থ থাকতে দেয়নি।’
সত্যবতী বলল—‘সব কথা পরিষ্কার করে বল। তুমি বুঝলে কি করে যে প্রবাল গুপ্তই আসামী?’
ব্যোমকেশ পেয়ালায় দ্বিতীয়বার চা ঢেলে সিগারেট ধরাল। আস্তে-আস্তে ধোঁয়া ছেড়ে অলস কণ্ঠে বলতে শুরু করল—
‘এই রহস্যর চাবি হচ্ছে শজারুর কাঁটা।
আততায়ী যদি পাগল হয় তাহলে আমরা অসহায়, বুদ্ধির দ্বারা তাকে ধরা যাবে না। কিন্তু যদি পাগল না হয় তখন ভেবে দেখতে হবে, সে ছোরা-ছুরি ছেড়ে শজারুর কাঁটা দিয়ে খুন করে কেন? নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য আছে। কী সেই উদ্দেশ্য?
দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকবার আততায়ী শজারুর কাঁটা মৃতদেহে বিঁধে রেখে দিয়ে যায়, অর্থাৎ সে জানাতে চায় যে, এই খুনগুলো একই লোকের কাজ। যে ভিখিরিকে খুন করেছে, সে-ই মজুরকে খুন করেছে এবং দোকানদারকেও খুন করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে—কেন?
আমার কাছে এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর—ভিখিরি থেকে দোকানদার পর্যন্ত কেউ হত্যাকারীর আসল লক্ষ্য নয়, আসল লক্ষ্য অন্য লোক। কেবল পুলিসের চোখে ধুলো দেবার জন্যে হত্যাকারী এলোপাথাড়ি তিনটে খুন করেছে, যাতে পুলিস কোনো মোটিভ খুঁজে না পায়।
তারপর চেষ্টা হল শজারুর কাঁটা দিয়ে দেবাশিসকে খুন করবার। দেবাশিস দৈব কৃপায় বেঁচে গেল, কিন্তু আততায়ী কে তা জানা গেল না।
আমার সত্যান্বেষণ আরম্ভ হল এইখান থেকে। দেবাশিসই যে হত্যাকারীর চরম লক্ষ্য তা এখনো নিঃসংশয়ে বলা যায় না, কিন্তু মনে হয় তার ওপরে আর কেউ নেই। ভিখিরি থেকে শিল্পপতি, তার চেয়ে উঁচুতে আর কেউ না থাকাই সম্ভব। যাহোক, তদারক করে দেখা যেতে পারে।
অনুসন্ধানের ফলে দেখা গেল, নৃপতির আড্ডায় যারা যাতায়াত করে তারা ছাড়া আর কারুর সঙ্গে দেবাশিসের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা নেই; ফ্যাক্টরির লোকেরা তাকে ভালবাসে, ফ্যাক্টরিতে আজ পর্যন্ত একবারও স্ট্রাইক হয়নি। আর একটা তথ্য জানা গেল, বিয়ের আগে দীপা একজনের প্রেমে পড়েছিল, তার সঙ্গে পালাতে গিয়ে সে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তারপরে দেবাশিসের সঙ্গে দীপার বিয়ে হয়।
দীপার গুপ্ত প্রণয়ী কে ছিল দীপা ছাড়া কেউ তা জানে না। কে হতে পারে? দীপার বাপের বাড়িতে গোঁড়া সাবেকী চাল, অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে স্বাধীনভাবে মেলামেশার অধিকার দীপার নেই, কেবল দাদার বন্ধুরা যখন বাড়িতে আসে তখন তাদের সঙ্গে সামান্য মেলামেশার সুযোগ পায়। সুতরাং তার প্রেমিক সম্ভবত তার দাদারই এক বন্ধু, অর্থাৎ নৃপতি কিংবা তার আড্ডার একজন।
এই সঙ্গে একটা মোটিভও পাওয়া যাচ্ছে। দীপার ব্যর্থ প্রেমিক তার স্বামীকে খুন করবার চেষ্টা করতে পারে যদি সে নৃশংস এবং বিবেকহীন হয়। যে-লোক শজারুর কাঁটা দিয়ে তিনটে খুন করেছে সে যে নৃশংস এবং বিবেকহীন তা বলাই বাহুল্য। নৃপতির আড্ডায় যারা আসত তাদের সঙ্গে দেবাশিসের আলাপ মাত্র দু’মাসের। কেবল একজনের সঙ্গে তার স্কুল থেকে চেনাশোনা ছিল, সে প্রবাল গুপ্ত। চেনাশোনা ছিল কিন্তু সম্প্রীতি ছিল না। প্রবাল গুপ্ত যদি দীপার প্রেমাস্পদ হয়—
বাকি ক’জনকেও আমি নেড়েচেড়ে দেখেছি। নৃপতির একটি স্ত্রীলোক আছে, তার কাছে সে মাঝে মাঝে গভীর রাত্রে অভিসারে যায়। সুজন মিত্র ব্যর্থ প্রেমিক, সে যাকে ভালবাসে বছরখানেক আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে। খড়্গ বাহাদুর এবং কপিলের জীবনে নারী-ঘটিত কোনো জটিলতা নেই। খড়্গ বাহাদুর শুধু ফুটবলই খেলে না, জুয়াও খেলে। কপিল আদর্শবাদী ছেলে, পৃথিবীর চেয়ে আকাশেই তার মন বেশি বিচরণ করে।
কিন্তু আর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দরকার নেই, সাঁটে বলছি। দীপার বাপের বাড়িতে তার ঘর তল্লাশ করে পাওয়া গেল একটি অটোগ্রাফের খাতা; তাতে নৃপতির আড্ডার কেবল একটি লোকের হস্তাক্ষর আছে, সে প্রবাল গুপ্ত। প্রবাল লিখেছে—তোমার চোখের বিজলি-উজল আলোকে, পরাণে আমার ঝঞ্ঝার মেঘ ঝলকে। তার কথায় কোনো অস্পষ্টতা নেই। আরো জানা গেল দীপা গান ভালবাসে, কিন্তু প্রবাল যে বিবাহিত তা সে জানে না। সুতরাং কে গানের ফাঁদ পেতে দীপাকে ধরেছে তা জানতে বাকি রইল না।
তারপর আর একটি কথা লক্ষ্য করতে হবে। যেদিন ভোরবেলা ভিখিরিকে শজারুর কাঁটা দিয়ে মারা হয় সেইদিন রাত্রে দীপার ফুলশয্যা। সমাপতনটা আকস্মিক নয়।
এবার প্রবালের দিক থেকে গল্পটা শোন।
যারা জন্মাবধি গরীব, দারিদ্রে তাদের লজ্জা নেই; কিন্তু যারা একদিন বড়মানুষ ছিল, পরে গরীব হয়ে গেছে, তাদের মনঃক্লেশ বড় দুঃসহ। প্রবালের হয়েছিল সেই অবস্থা। বাপ মারা যাবার পর সে অভাবের দারুণ দুঃখ ভোগ করেছিল, তার লোভী ঈর্ষালু প্রকৃতি দারিদ্র্যের চাপে বিকৃত হয়ে চতুর্গুণ লোভী এবং ঈর্ষালু হয়ে উঠেছিল। গান গেয়ে সে মোটামুটি গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহ করতে পেরেছিল বটে, কিন্তু তার প্রাণে সুখ ছিল না। একটা রুগ্ন মরণাপন্ন মেয়েকে বিয়ে করার ফলে তার জীবন আরো দুর্বহ হয়ে উঠেছিল।
কিছুদিন আগে ওর বউ মারা গেল। বউ মরার আগে থাকতেই বোধহয় ও দীপার জন্যে ফাঁদ পেতেছিল; ও ভেবেছিল বড় ঘরের একমাত্র মেয়েকে যদি বিয়ে করতে পারে, ওর অবস্থা আপনা থেকেই শুধরে যাবে। দীপার চরিত্র যতই দৃঢ় হোক, সে গানের মোহে প্রবালের দিকে আকৃষ্ট হল। মুখোমুখি দেখাসাক্ষাতের সুযোগ বেশি ছিল না। টেলিফোনে তাদের যোগাযোগ চলতে লাগল।
পালিয়ে গিয়ে দীপাকে বিয়ে করার মতলব প্রবালের গোড়া থেকেই ছিল; দীপা যে ঠাকুরদার অনুমতি চাইতে গিয়েছিল সেটা নিতান্তই লোক-দেখানো ব্যাপার। প্রবাল জানত বুড়ো রাজী হবে না। কিন্তু পালিয়ে গিয়ে একবার বিয়েটা হয়ে গেলে আর ভয় নেই, দীপাকে তার বাপ-ঠাকুরদা ফেলতে পারবে না।
দীপা বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। তারপর তাড়াতাড়ি দেবাশিসের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হল।
প্রবালের মনের অবস্থাটা ভেবে দেখ। অন্য কারুর সঙ্গে দীপার বিয়ে হলে সে বোধহয় এমন ক্ষেপে উঠত না। কিন্তু দেবাশিস! হিংসেয় রাগে তার বুকের মধ্যে আগুন জ্বলতে লাগল।
বিয়ের সম্বন্ধ যখন স্থির হয়ে গেল তখন সে ঠিক করল দেবাশিসকে খুন করে তার বিধবাকে বিয়ে করবে। দীপা তখন স্বাধীন হবে, বাপের বাড়ির শাসন আর থাকবে না। দীপাকে বিয়ে করলে দেবাশিসের সম্পত্তি তার হাতে থাকবে। একসঙ্গে রাজকন্যে এবং রাজত্ব। দেবাশিসের আর কেউ নেই প্রবাল তা জানত।
কিন্তু প্রথমেই দেবাশিসকে খুন করা চলবে না। তাহলে সে যখন দীপাকে বিয়ে করবে তখন সকলের সন্দেহ তার ওপর পড়বে। ক্রূর এবং নৃশংস প্রকৃতির প্রবাল এমন এক ফন্দি বার করল যে, কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারবে না। শজারুর কাঁটার নাটকীয় খেলা আরম্ভ হল। তিনটে মানুষ বেঘোরে প্রাণ দিল।
যাহোক, প্রবাল দেবাশিসকে মারবার সুযোগ খুঁজছে। আমার বিশ্বাস সে সর্বদাই একটা শজারুর কাঁটা পকেটে নিয়ে বেড়াত; কখন সুযোগ এসে যায় বলা যায় না। একদিন হঠাৎ সুযোগ এসে গেল।
নৃপতির আড্ডাঘরের পাশের ঘরে টেলিফোন আছে। দোরের পাশে পিয়ানো, প্রবাল সেখানে বসে ছিল; শুনতে পেল খড়্গ বাহাদুর দেবাশিসকে টেলিফোন করছে, জানতে পারল ওরা রবীন্দ্র সরোবরের এক জায়গায় দেখা করবে। প্রবাল দেখল এই সুযোগ। শজারুর কাঁটা তার পকেটেই ছিল, সে যথাস্থানে গিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। তারপর—
প্রবাল জানত না যে প্রকৃতির দুর্জ্ঞেয় খামখেয়ালির ফলে দেবাশিসের হৃৎপিণ্ডটা বুকের ডান পাশে আছে। দীপা অবশ্য জানত। কিন্তু প্রবাল যে দেবাশিসকে খুন করে তাকে হস্তগত করার মতলব করেছে তা সে বুঝতে পারেনি। হাজার হোক মেয়েমানুষের বুদ্ধি; বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘কখনো অর্ধেক বৈ পুরা দেখিলাম না।’
এই হল গল্প। আর কিছু জানবার আছে?’
অজিত প্রশ্ন করল—‘তোমাকে মারতে গিয়েছিল কেন?’
ব্যোমকেশ বলল—‘আমি সেদিন ওদের আড্ডায় গিয়ে বলে এসেছিলাম যে শজারুর কাঁটা দিয়ে যদি আর খুন না হয়, তাহলে বুঝতে হবে দেবাশিসই আততায়ীর প্রধান লক্ষ্য। তাই প্রবাল ঠিক করল আমাকে খুন করেই প্রমাণ করবে যে, দেবাশিস আততায়ীর প্রধান লক্ষ্য নয়; সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। আমি যে তাকে ধরবার জন্যেই ফাঁদ পেতেছিলাম তা সে বুঝতে পারেনি।’
সত্যবতী গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল—‘বাব্বা! কী রাক্কুসে মানুষ! দীপার কিন্তু কোনো দোষ নেই। একটা সহজ স্বাভাবিক মেয়েকে খাঁচার পাখির মত বন্ধ করে রাখলে সে উড়ে পালাবার চেষ্টা করবে না?’
খুট খুট করে সদর দরজায় টোকা পড়ল। ব্যোমকেশ উঠে গিয়ে দোর খুলল—‘আরে দেবাশিসবাবু যে! আসুন আসুন।’
দেবাশিস সঙ্কুচিতভাবে ঘরে প্রবেশ করল। সত্যবতী উঠে দাঁড়িয়েছিল, দেবাশিসের নাম শুনে পরম আগ্রহে তার পানে চাইল। দেবাশিসের চেহারা আবার আগের মত হয়েছে, দেখলে মনে হয় না সে সম্প্রতি যমের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। সে হাত জোড় করে বলল—‘আজ রাত্রে আমার বাড়িতে সামান্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছি, আপনাদের সকলকে যেতে হবে।’
ব্যোমকেশ বলল—‘বেশ, বেশ। বসুন। তা উপলক্ষটা কী?’
দেবাশিস রুদ্ধ কণ্ঠে বলল—‘ব্যোমকেশদা, আজ আমাদের সত্যিকার ফুলশয্যা। দীপাকে আমার সঙ্গে আনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে লজ্জায় আধমরা হয়ে আছে, এল না। বউদি, আপনি নিশ্চয় আসবেন, নইলে দীপার লজ্জা ভাঙবে না।’