শঙ্খচূড় – ৯

নয়

শড়কিটা দৈবাৎ শিরীষ গাছের গায়ে বিঁধেছিল, তাই রক্ষে! নইলে কী যে হত ভাবলেও অলকাতিলকার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এখনো।

সেদিন রাতে সে সুদামকে বলেছিল, চারদিকে শত্তুর! আমার গা ছুঁয়ে বল আর কখনো এমুখো হবি না?

সুদাম অবশ্য তার গা ছোঁয়নি। তখনই চলে গিয়েছিল।

শড়কি যদি তাকে তাগ করে, করুক। তিলকের গায়ে যেন ছোঁয়া না লাগে।

সেই থেকে আজ দু’রাত সুদাম আর আসে না। তবু চোখে ঘুম নেই অলকাতিলকার। আধ—পাগল মানুষটার কখন যে কি খেয়াল হয় কে জানে!

পুবের চাঁদ মাথার ওপর এল। আজও জানলায় দাঁড়িয়ে আছে অলকাতিলকা। কি জানি কখন বাঁশি ডাকে!

কিন্তু বাঁশি তো নয়, ঘোড়ার খুরের শব্দ! থামল ফটকে। এত রাতে রাজাবাহাদুর আগে কখনো আসেনি। দেবদাসীর মনটা শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিলে।

কন্দর্পকান্তি ঘরে এল। রক্তাভ চোখ, মুখের নিশ্বাসে ঝাঁঝালো সুরভি।

অলকাতিলকা আড়ষ্ট হয়ে গেল। বললে, এত রাতে আপনি!

পায়ের ওপর পা তুলে বসলে কন্দর্পকান্তি। বললে, এত রাত কোথায়? দেখতে এলাম কেমন আছ, কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা।

সে—খবর নেওয়ার জন্যে তো রাজবাড়ির মাইনে—করা লোক আছে। রাজাবাহাদুর কষ্ট করেন কেন?

হাসতে হাসতে কন্দর্প বললে, কথায় বলে, কষ্ট না করলে কেষ্ট পাওয়া যায় না। আমি কি বলি জানো? কষ্ট না করলে রাধা পাওয়া যায় না।

ইঙ্গিতটা বুঝতে দেরি হল না। মুখে একটু হাসি টেনে অলকা—তিলকা বললে, রাজাবাহাদুরের কথাটা কি ঠিক হল? কেষ্টকে পাওয়া সহজ, কেষ্ট সকলের। কিন্তু রাধা যে শুধু একজনের।

একটা চোখ ঈষৎ ছোট করে কন্দর্প ক্লান্তি বললে, তাই নাকি? সেই একজনটি কে?

রাধা গোপীনাথের—সে তো সবাই জানে।

কিন্তু তুমি কার রাধা? গোপীনাথ, না সুদাম পোটোর?

বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল অলকাতিলকার। ভয়টাকে সামলে নিতে কয়েক মুহূর্ত লাগল। তারপর বলে উঠল, ওকথা বলবেন না। আমি রাধা নই, গোপীনাথের কোটি দাসীর মধ্যে একটি দাসী।

দাসী—জিভ আর তালুর সংযোগে আক্ষেপের শব্দ করলে কন্দর্প। বললে, এত রূপ কি দাসী হবার জন্যে বিধাতা দিয়েছেন? না, না, এত রূপ রানি হবার জন্যে।

অলকাতিলকা আড়ষ্ট হয়েই রইল।

কন্দর্প বললে, শোনো দেবদাসী, আমি অনেকদিন অপেক্ষা করেছি, আজ তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই আমার আসা। তুমি আমার হবে কিনা বলো?

এই আশঙ্কাই করেছিল অলকাতিলকা। রূপের চেয়ে বড় শত্রু নারীর আর আছে? নতমুখে নীরব রইল সে।

কন্দর্প বলতে লাগল, আমি শিকারি মানুষ, মারতেই শিখেছিলাম, আদর করতে জানতাম না। ফুল, চাঁদ, স্ত্রীলোকের রূপ কখনো ভালো করে দেখিনি। তোমার দিকে তাকিয়ে জীবনের সেই দিকটা একদিন দেখতে পেলাম। আমার বাসনার আগুন তুমি জ্বালিয়েছ অলকাতিলকা, সে আগুন তোমাকেই নেভাতে হবে।

লজ্জায় বিতৃষ্ণায় পিছন ফিরে দাঁড়াল অলকাতিলকা। বললে, এসব কথা শোনাও আমার পাপ। আমি দেবদাসী—গোপীনাথ আমার স্বামী।

গোপীনাথ তো পাথরের। পাথরের স্বামী নিয়ে রক্তমাংসের মানুষ কখনো সুখী হয়? না সাধ মেটে? আমি তোমার কোনো সাধ অপূর্ণ রাখব না অলকাতিলকা। ভোগের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে দেব। তুমি আমার হও।

পিছন ফিরেই অলকাতিলকা বললে, আমায় মাপ করুন রাজাবাহাদুর। আমি গরিবের মেয়ে, ভোগ কি, আমি জানি নে। তাই ভোগে আমার রুচিও নেই।

শ্লেষের বাঁকা হাসিতে ঠোঁট বেঁকে গেল কন্দর্পকান্তির। বললে, তাই বটে! গরিবের মেয়ে তুমি, রাজার অনুরাগে তোমার রুচি হবে কেন? তোমার রুচি হবে সুদাম পোটোর গুপ্ত প্রেমে!

চকিতে ফিরে তাকাল অলকাতিলকা। মুখ তার সিঁদুরবরণ হয়ে উঠেই আবার সাদা হয়ে গেল।

আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কন্দর্পকান্তি। রক্তাভ চোখে আহত পৌরুষের জ্বালা। ঈষৎ স্খলিত পায়ে এক—পা এক—পা করে এগিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগল, এত গরব কিসের দেবদাসী? রূপের? কিন্তু আমি রাজা, আমার খাজনা আমি ইচ্ছে করলেই আদায় করতে পারি জানো?

একটা সর্বগ্রাসী ভয় যেন হাঁ করে গিলতে এল অলকা তিলকাকে। সর্বাঙ্গ তার হিম হয়ে আসতে লাগল। ঘরের কোণে সরে গিয়ে কাতর গলায় সে বললে, জানি। শুনেছি এই জলসাবাড়িতে এক সময় রাতের পর রাত আমার মতো অনেক মেয়ের সর্বনাশ হয়েছে। চোখের জলের নদী বইয়েও তাহা রেহাই পায়নি। তবু বলছি, আমাকে দয়া করুন রাজাবাহাদুর, দয়া করুন।

কাম—গদগদ জড়ানো গলায় কন্দর্প বললে, অত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি শুধু আদর করব—ভালোবাসব।

একই ইতিহাস সত্যিই আবার ফিরে আসে। তা নইলে বহুকাল বাদে সেই বিগত উচ্ছৃঙ্খল রাত্রিগুলোর প্রভাব এই বসন্তবিহারে আবার ফিরে আসবে কেন? শাক্ত পূর্বপুরুষদের ব্যভিচারী রক্ত এতদিনের নারী—উদাসীন কন্দর্পকান্তির রক্তে আজ আগুন ধরাল কেন?

এক—পা এক—পা করে এগোচ্ছে কন্দর্প। রক্তাভ একজোড়া চোখ যেন লেহন করছে অলকাতিলকার ভয়ার্ত সুন্দর মুখ, থরথর কাঁপা পূর্ণ বিকশিত বুক, ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্ব—

হাত বাড়িয়ে তার আঁচলের প্রান্তটা ধরে ফেললে কন্দর্প।

অলকাতিলকা চিৎকার করে উঠতে গেল, কিন্তু তার আগেই খোলা জানলা পথে একখণ্ড পাথর কন্দর্পের মাথা ঘেঁষে সজোরে এসে লাগল দেয়ালজোড়া আরশির গায়ে।

ঝনঝন শব্দে চুরমার হয়ে গেল আরশিখানা।

পলকে নেশা কেটে গেল কন্দর্পের। জানলার ধারে ছুটে গিয়ে হাঁক দিলে, কে? কে ওখানে?

একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দ। সাঁ করে একটা ছায়ামূর্তি জঙ্গলের অন্ধকারে মিশে গেল।

চাঁদ তখন পাহাড়ের আড়ালে। চিন্তিত মুখে জঙ্গলের পানে তাকিয়ে রইল কন্দর্প। তারপর অলকাতিলকার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কে ছিল ওখানে? সুদাম?

পালঙ্কের বাজুটা ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়েছিল অলকাতিলকা। বললে, আর যেই হোক, সুদাম নয়।

কথাটা বিশ্বাস হল কিনা কন্দর্পের মুখ দেখে বোঝা গেল না। একটু চুপ করে থেকে আপন মনে বললে, বন্দুকটা না এনে ভুল করেছি দেখছি। একটা শিকার হাতছাড়া হয়ে গেল!

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কন্দর্প। একটু বাদেই ঘোড়ার খুরের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল।

.

শঙ্কর মাছের চাবুকে বড় ধার! মুখের ওপর আড়াআড়িভাবে যে ঘা পড়েছিল, সেটা এখনো শুকোয়নি। তা না শুকোক, বুকের মধ্যে যে পুরনো ঘা—টা নতুন করে দগদগিয়ে উঠেছে, সেটাই কেতুকে কষ্ট দিচ্ছে বেশি।

মা—মরা মেয়ে কুন্তী। দুনিয়ায় বাঁধন বলতে ছিল শুধু ওই। বড় যত্নে মানুষ করেছিল। মেয়ের পায়ে কাঁটা ফুটলে কেতুর বুকে ফুটত। কুন্তী একবার বায়না ধরেছিল চিতাবাঘের বাচ্চচা পুষবে। কেতু ঘুমন্ত বাঘিনীর বুক থেকে বাচ্চচা চুরি করে এনেছিল মেয়ের জন্যে। আরেকবার কুন্তী কাঁদতে কাঁদতে এসে বাপকে বলেছিল, গাঁয়ের মকর পরিদা তার ক্ষেত থেকে আখ তুলতে দেয়নি। পরদিনই রাতের অন্ধকারে সে শড়কি দিয়ে মকরের পেট এফোঁড়—ওফোঁড় করে দিয়েছিল। কেতুর চওড়া মিশকালো বুকখানার ভেতরটাও ছিল পাথরের মতো শক্ত। দুনিয়ায় কারো জন্যে একফোঁটাও দয়া—মায়া ছিল না। কিন্তু বুকের এক জায়গা ছিল তুলোর মতো নরম, রাজ্যের স্নেহ মায়া জড়ো করা ছিল সেখানে। সে কেবল একটা মানুষের জন্যেই। তার মেয়ে কুন্তীর জন্যে।

আর, মেয়েটা হয়েও ছিল বড় ফুটফুটে। কে বলবে চাষার ঘরের মেয়ে! রুপোর অনেক গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল কেতু। চুড়ো—বাঁধা চুলে ঘুন্টি, নাকে বেসর, কানে মাকড়ি, হাতে খাড়ু আর পায়ে ঝাঁঝর মল পরে কুন্তী যখন ঘুরে বেড়াত, কেতু ভারি আরাম পেত দেখে দেখে।

কুন্তী যখন চোদ্দ বছরে পা দিল, কেতুর বড় সাধ হয়েছিল মেয়ের বিয়ে দেবে। খুঁজে—পেতে বরও ঠিক করেছিল পছন্দসই। কিন্তু সব ভেস্তে দিলে হতভাগী! কোত্থেকে যে ওলাউঠো নিয়ে এল! বুক চিরে রক্ত দিয়েছিল কেতু, মা রক্তখাগী তবু দয়া করলে না! বোধ হয় বাঘিনীর বুক থেকে একদিন বাচ্চচা চুরি করেছিল বলেই! একরাতে কাবার হয়ে গেল মেয়েটা! আর, কেতুর বুকের ভেতর যে নরম জায়গাটুকু ছিল, সেখানে প্রথমে একটা দগদগে ঘা হল, তারপর ক্রমে ক্রমে তাও শুকিয়ে নিরেট পাথর হয়ে গেল।

কিন্তু যথার্থই কি ঘা শুকোল? না, চাপা রইল। এতদিন বুঝতে পারেনি কেতু।

বারো বছর বাদে সেদিন রাতে জঙ্গলের ধারে শিরীষ গাছতলায় মরা কুন্তীর ঢলঢলে মুখখানা আবার দেখল কেতু। আগেও দেখেছে কয়েক ঝলক। কখনো পালকির কিংখাব—ঝালরের আড়ে, কখনো চকমকির ঘাটের পথে, কখনো বা জঙ্গলের আলো—আঁধারিতে। কিন্তু সে—দেখা তো বাপের চোখ দিয়ে দেখা নয়! সে—রাতের ভরা চাঁদের আলোয় কেতু পষ্ট দেখেছিল ঠিক যেন কুন্তীই হাসছে! হাতের টিপ তার কি করে ঠিক থাকবে? বাঘ কি নিজের বাচ্চচাকে থাবা দেয়?

সেদিন থেকে কুন্তীর মুখখানা বারবার দেখতে পাচ্ছে কেতু। আর, অবাক কাণ্ড! মেয়ের মুখ ভাবতে গিয়ে ওই দেবদাসীর মুখখানাই তার মনে আসছে!

আচ্ছা জ্বালায় পড়েছে কেতু!

কিন্তু কেতু সর্দারের শড়কি থেকে বেঁচে গেছে বলে ওরা কি রাজাহুজুরের বিষ—নজর থেকেও বাঁচবে? বাঁচবে না, কিছুতেই না। তার চেয়ে ওরা দুটিতে পালিয়ে যাক এ রাজ্যি ছেড়ে। দুনিয়ার যেখানে হয় চলে গিয়ে সুখে থাক তোরা। কেবল এ রাজ্যে আর নয়। ভয় কি তোদের? কেতু সর্দার তো রয়েছে, আমি নিজে সঙ্গে করে দেবগড়ের এলাকা পার করে দেব। চলে যা তোরা, পালিয়ে যা!

এই কথাই আজ মেয়েটাকে বলতে গিয়েছিল কেতু। গিয়েছিল অনেক রাতে জঙ্গলের অন্ধকারে লুকিয়ে—চুরিয়ে। যাতে রাজাহুজুর জানতে না পারে। কিন্তু চুপি চুপি জলসাবাড়ির জানলার কাছে যেতেই দেখল—

শয়তানের বংশে শয়তানই জন্মায়। মনে হল রাজাহুজুর মাতাল হয়ে দেবদাসী নয়, যেন তার কুন্তীর ওপর অত্যেচার করতে যাচ্ছে! কেতুর মাথার মধ্যে ওলোট—পালোট হয়ে গেল। পাথরের একটা চাঁই কুড়িয়ে নিয়ে ধাঁ করে ছুড়ে দিলে।

দামি আরশিখানা বাঁচল না বটে, কিন্তু ছুঁড়িটার ইজ্জৎ বাঁচল। সেটা তো আর কাচের মতো ঠুনকো নয়।

মেয়েটাকে আজ কিছুই বলা হল না।

না হোক, কেতু আবার যাবে। দেবগড়ের সীমানা ওদের পার করে না দেওয়া অবধি কেতুর সোয়াস্তি নেই।

.

মৃদঙ্গটা কোল থেকে নামিয়ে রাখল মাধবদাস। অন্যান্য যন্ত্রীদের যেতে বলে মন্দির একেবারে ফাঁকা করে দিলে, তারপর দেবদাসীকে কাছে ডাকলে।

তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে মা।

বলুন।—অলকাতিলকা পাশে বসল।

মাধবদাস বললে, তোমার বাবা নীলকণ্ঠ পণ্ডিত যেদিন তোমাকে এই মন্দিরে প্রথম এনেছিল, সেদিনের কথা তোমার মনে পড়ে?

পড়ে।

সেদিন তোমাকে আমি বলেছিলাম, দেবদাসী হতে গেলে গোপীনাথকে একাগ্রভাবে দেহ—মন সমর্পণ করতে হয়। অন্য পুরুষের সঙ্গ করা, এমনকি স্বপ্ন দেখাও পাপ। মনে আছে?

অলকাতিলকার মন শঙ্কাতুর হয়ে উঠল। মৃদু স্বরে বললে, মনে আছে। কিন্তু একথা কেন বলছেন গুরুদেব?

স্বভাবগম্ভীর গলায় মাধবদাস বললে, দেবদাসীর সাধনা বড় কঠিন সাধনা মা। সেই সাধনায় তুমি কি উত্তীর্ণ হতে পেরেছ?

অলকাতিলকার মুখ নত হয়ে এল। ভূমিতলে চোখ রেখে নিরুত্তর হয়ে রইল।

মাধবদাস বললে, কিছুকাল থেকে লক্ষ করেছি তোমার মধ্যে কি একটা পরিবর্তন এসেছে। আজকাল মন্দিরে আসতে তোমার বিলম্ব হয়ে যায়, গোপীনাথের সামনে নাচতে নাচতে তুমি অন্যমনা হয়ে পড়, তোমার নাচের মুদ্রা ছন্দ পালটে যায়! এর কারণ কি?

লজ্জিত পাণ্ডুর মুখে চুপ করে রইল অলকাতিলকা।

কিছু গোপন কোরো না দেবদাসী। আমার প্রশ্নের জবাব দাও, বলো এর কারণ কি? মাধবদাসের গলায় আদেশের সুর।

আস্তে আস্তে মুখ তুললে দেবদাসী। কাঁপা কাঁপা গলায় বললে, আপনি গুরু, আপনার কাছে আমার গোপন কিছু নেই। এর কারণ সুদাম।

সুদাম! যে ওই রাধামূর্তি গড়েছে?

ঘাড় নেড়ে অলকাতিলকা বললে, আমার ছোটবেলার সঙ্গী। এই মন্দিরে আসার পর থেকে দিনে দিনে আমি তাকে ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু যেদিন এই রাধামূর্তি দেখলাম, সেদিন থেকে তার চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছে! তার বাঁশি যেন নিশির ডাক, কানে গেলেই মনকে আমি সামলাতে পারিনে। মন্দিরে যখন নাচি, হঠাৎ সব বাজনা ছাপিয়ে সেই বাঁশির সুর বেজে ওঠে, আমি নাচের খেই হারিয়ে ফেলি—ছন্দ পালটে যায়—গোপীনাথের বদলে দেখি সুদাম দাঁড়িয়ে হাসছে! এ আমার কী হল গুরুদেব, এ আমার কী হল!

চোখের জলে ভেসে গেল অলকাতিলকার মুখ।

মাধবদাসের মুখ কঠোর গাম্ভীর্যে থমথম করতে লাগল। শান্ত অথচ কঠিন গলায় বললে, তুমি গোপীনাথের পরিণীতা হয়ে অন্য পুরুষে আসক্ত! ছি, ছি দেবদাসী!

অলকাতিলকার বুকের ভেতর তোলপাড় করে উঠল। মাধবদাসের পায়ে হাত রেখে বললে, না, না, না, সুদামের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই গুরুদেব! আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, এই দেহ গোপীনাথ ছাড়া আর কাউকে দিইনি।

তবু তুমি ভ্রষ্টা! গোপীনাথকে দেহ দিয়েছ, কিন্তু মন? মনে মনে তুমি দ্বিচারিণী!

মাধবদাসের নিষ্ঠুর কথাগুলো গমগম করে উঠল নাটমন্দিরে। আজন্মব্রহ্মচারী সেই বৈষ্ণব পুরোহিত বলতে লাগল, পবিত্রতা কি শুধু দেহের? আসল পবিত্রতা মনের। সেই মনকে তুমি কলঙ্কিত করলে দেবদাসী! দেবতাকে নিবেদন—করা ফুল দিয়ে মানুষের জন্যে মালা গাঁথলে!

নাটমন্দিরে লুটিয়ে কাঁদতে লাগল অলকাতিলকা।

অপরাধ করেছি গুরুদেব, মহা অপরাধ করেছি! সুদামের ভালোবাসা আমি ঠেলতে পারিনি—সামলাতে পারিনি নিজের মনকে! বলে দিন আমি কি করব?

মাধবদাস বললে, গোপীনাথকে জিজ্ঞাসা করো। তিনিই বলে দেবেন।

গুরুর পা ছেড়ে অলকাতিলকা গিয়ে আছড়ে পড়ল গোপীনাথের পায়ে। বললে, ঠাকুর, তুমি তো প্রেমের ঠাকুর! তুমিই বলো ভালোবাসা কি অপরাধ? তুমি বলো, আমি কি কলঙ্কিনী?

পাথরের গোপীনাথ জবাব দেয় না। বড় মধুর হাসি হাসতে থাকে শুধু।

অলকাতিলকাও ওঠে না। শুধু কাঁদে আর প্রশ্ন করে, ভালোবাসলে কি দোষ হয়?

প্রহরের পর প্রহর কাটে। একে একে তারা নেভে, প্রদীপ নেভে। পুব আকাশ স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।

জবাব দেয় না গোপীনাথ। রাধাকে পাশে নিয়ে শুধু হাসে। আর, গোপীনাথের সেই হাসি—মাথা মুখের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাধবদাসের মন থেকে সকল সংশয় আর সংস্কারের কুয়াশা কেটে গিয়ে, একটি নির্মল সত্য স্বচ্ছ হয়ে ফুটে উঠল।

অলকাতিলকার হাত ধরে তুলে মাধবদাস স্নিগ্ধস্বরে বললে, ঠাকুরের নির্দেশ আমি পেয়েছি দেবদাসী। ভালোবাসা যদি খাঁটি হয়, তবে তা মানুষকে দিলেও ঠাকুরের কাছেই পৌঁছবে। তুমি যাও, দেবদাসীর জীবন ছেড়ে সুদামকে নিয়ে ঘর বাঁধো গে।

অলকাতিলকা বিহ্বল হয়ে বললে, আমার অপরাধ হবে না?

শান্ত সুন্দর হাসি হাসলে মাধবদাস। হেসে বললে, না, কোনো অপরাধ হবে না মা। আমি তোমাদের আশীর্বাদ করছি।

 * * *

চিতা আর চিন্তা এক। দুটোই দগ্ধে দগ্ধে মারে।

গোপীনাথের চিন্তা, সুদামের চিন্তা, রাজাবাহাদুরের চিন্তা। অত চিন্তার বোঝা অলকাতিলকা আর বইতে পারছিল না। ভেবে ভেবে এক—এক সময় হাঁপ ধরত, রাত—জাগা চোখের কোলে কালি পড়ত। তবু ভাবনার কুল—কিনারা দেখতে পেত না সে। দুটি মানুষ আর একটি দেবতা তার উনিশ বছরের জীবনে এসে দাঁড়িয়েছে, তিনজনেই বলছে, ‘অলকাতিলকা, তুমি আমার হও!’ কি করবে সে? একটা মন কি তিনজনকে ভাগ করে দেওয়া যায়?

ভেবে ভেবে সারা হয়ে গিয়েছিল অলকাতিলকা।

কত সহজে মীমাংসা করে দিলেন তার গুরু! বলে দিলেন, ‘ভালোবাসা যদি খাঁটি হয়, তা মানুষকে দিলেও ঠাকুরের কাছেই পৌঁছবে।’

তবে আর কিসের লজ্জা, কিসের ভয়? সুদামের সঙ্গে ঘর বাঁধতেই বা অপরাধ কোথায়?

মন্দির থেকে ফিরে যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে অলকাতিলকা। পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে তার মন।

কিন্তু এত সুখের ভাগ যে নেবে, সে কই? সে তো আর আসে না! অলকাতিলকা নিজেই যে মানা করেছে। চারদিকে শত্রু! কোথায় শড়কির ফলা সাপের জিভের মতো লকলক করছে কে জানে! তবু সুদামকেই আজ চাই। শত বিপদ মাথায় নিয়ে শত বাধা ডিঙিয়ে তাকে আসতেই হবে। তারই হাত ধরে অলকা তিলকা এই পাপের জলসাবাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। যেখানে রাজা নেই, শড়কি নেই। যেখানে নির্ভয় সুখ আর নিশ্চিন্ত শান্তি!

শুকনো কলাপাতায় কাজল দিয়ে পত্র লিখলে অলকাতিলকা। ‘আজ রাতে একবার আসিস। যেমন করেই হোক।’

ডাকলে দাসীকে। যেতে হবে পোটো—পাড়ায়।

এবার পত্রের সঙ্গে দাসীর হাতে গেল গলার হার। আঁচলে গেরো দিয়ে চলে গেল সে। আর, সারাটা দিন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে লাগল অলকাতিলকা। কখন রাত আসবে, চাঁদ উঠবে, বাঁশি ডাকবে!

.

অবশেষে রাতও এল, চাঁদও উঠল পুবের আকাশে, বাঁশিও ডাকল পাহাড়ীয়া পথে।

নিশি—পাওয়ার মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এল অলকাতিলকা। নিশুতি রাতের কানে কানে আজ আর চুপি চুপি বেজে উঠল না ঝুম—ঝুম, ঝুমুর—ঝুম!

শিরীষগাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে সুদাম। কোমরে বাঁশিটা গোঁজা। বললে, তোর নূপুর আজ বাজে না কেন তিলক?

তিলক বললে, খুলে রেখে এসেছি।

খুলে রেখেছিস! কেন?

সব বলব। কিন্তু এখেনে নয় সুদাম, জঙ্গল থেকে আবার যদি কেউ—চল রঙ্গিনীর ধারে গিয়ে বসি।

সুদামের হাত ধরে ঝরনার দিকে উঠে গেল তিলক।

পাহাড়ের এদিকটায় আর জঙ্গল নেই। বড় বড় পাথরের খণ্ড আর লম্বা লম্বা বুনো আগাছা। দু’জনে গিয়ে একটা পাথরের ওপর পাশাপাশি বসল। ঠিক পিছনেই রঙ্গিনী ঝরনা খলখলিয়ে হাসতে হাসতে লাফিয়ে পড়ছে প্রায় হাজার ফুট নিচে একটা বিশাল গহ্বরে। তারপর ফেনায় ফেনায় উপচে পড়ে খাঁড়ি বেয়ে চকমকির বুকে ঝাঁপ দিয়েছে।

চতুর্দশীর চাঁদ উঠে এসেছে মাথার ওপর। ফিনিকফোটা জ্যোৎস্নায় চারদিক হাসছে।

তিলক বললে, তুই আমাকে কতখানি ভালোবাসিস সুদাম?

হেসে সুদাম বললে, কি করে বলি বল? আকাশ কত বড়, তা কি বলতে পারা যায়?

বুনো ঘাসের শিস ছিঁড়তে ছিঁড়তে তিলক বললে, তুই আমাকে অনেক দিয়েছিস সুদাম, আমি তোকে কিছুই দিতে পারিনি। এ দুঃখু রাখার ঠাঁই ছিল না আমার। ওই জলসাবাড়ির সোনার পিঁজরায় দিনরাত আমি পাখা ঝটপটিয়ে মরেছি। আজ আমি বেরিয়ে এসেছি তোর হাত ধরে চলে যাব বলে। আর ফিরব না।

তিলক! এ তুই কী বলছিস!

.

সুদাম যদি অবাক হয়ে তিলকের মুখের পানে তাকিয়ে না থাকত, তবে হয়তো দেখতে পেত বড় বড় পাথরের টুকরোর আড়াল দিয়ে একটা প্রাণী গুঁড়ি মেরে উঠছে।

বুনো জানোয়ার নয়, মানুষ! জানোয়ারের চেয়ে সতর্ক একটা ছায়ামূর্তি!

সুদাম বললে, তুই যে দেবদাসী!

তিলক বললে, আমার দিকে চেয়ে দেখ, আমি আর দেবদাসী নই। তাই তো আজ সব ছেড়ে চলে আসতে পেরেছি।

কালো ওড়নাখানা গা থেকে সরিয়ে ফেলল তিলক। লালপেড়ে মোটা শাড়ি পরনে, কোনো অলঙ্কার নেই, নূপুরও খুলে রেখে এসেছে। অনেক দিন পরে সুদাম দেখলে সেই হর্তুকিতলার তিলককে।

তিলক আবার বললে, গুরুঠাকুর কাল কি বলেছেন জানিস? বলেছেন, সুদামকে নিয়ে তুমি ঘর বাঁধো গে, গোপীনাথ কোনো অপরাধ নেবে না।

কোনো কথা বললে না সুদাম। টানা টানা দীঘল চোখ মেলে অনেক দূরে চেয়ে রইল।

এত ভাবছিস কি। চল চলে যাই। তিলক বললে।

যেন স্বপ্নের ঘোর কেটে গেল সুদামের। বললে, ঘর বাঁধার ভাবনা আমি যে কোনোদিন ভাবিনি তিলক! ভাবতে ভরসাও হয়নি। ফুল গাছে থাকলেই ভালো, তাকে ছিঁড়লে কি ভালোবাসা হয়?

তিলক বললে, তুই না হয় সন্নেস, কিন্তু আমি যে মেয়ে। ঘর—সংসারের সাধ যে আমার চিরকালের।

কিন্তু তুমি বামুনের মেয়ে, আর আমি জাতে কুমোর!

লাজ—লজ্জা দ্বিধা—সঙ্কোচের বাঁধ ভেঙে গেল তিলকের। সুদামের গলাটা জড়িয়ে ধরে বললে, রাজার মেয়ে যদি গয়লার ছেলের জন্যে জাত খোয়াতে পারে, তবে আমিই বা পারব না কেন বল। ভালোবাসায় তোর জাত ধুয়ে গেছে রে!

টসটস করে গলানো মুক্ত গড়িয়ে এল তিলকের গাল বেয়ে।

.

কালকাসুন্দা—ঝোপটা নড়ে উঠল। পাশ থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে এল আরেকটা ছায়ামূর্তি। মাথায় ঝাঁকড়া বাবরি, আবছা আঁধারে একটা মাত্র চোখ জ্বলছে।

কেতু সর্দার!

শিরীষ গাছতলাটা ফাঁকা! কোথায় গেল ওরা? আসেনি নাকি আজ? হতেই পারে না। একটু আগেও জংলা সুরে বাঁশি বাজছিল পাহাড়ি রাস্তায়!

এদিক—ওদিক তাকাতে তাকাতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল কেতু। বাজপাখির মতো সজাগ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগল। ওই যে—পাহাড়ের একেবারে কিনারায় রঙ্গিনীর দিকে পিঠ করে বসে—ওরাই না?

এই নিশি—রাতে ঘর ছেড়ে জঙ্গলে পা দেবে ওরা ছাড়া আর কারা? ভালোই হয়েছে, দু’জনকে একসঙ্গে পাওয়া গেছে। মেয়েটাকে বলবে কেতু, ‘তোর চাঁদ—মুখে রাহুর নজর পড়েছে মা, পালিয়ে চ’, আজই রাতে পালিয়ে চ’ সুদামের ঘরে। সকাল হলে পালকি করে তোদের পার করে দেব এ রাজ্যের এলাকা। কেতু সর্দার থাকতে ভয় কি?’

রঙ্গিনীর দিকে এগোল কেতু। মেয়েটার কাছে গিয়ে বলবে, ‘শড়কি ধরা এ জন্মের মতো ছেড়ে দিলাম মা! আজ থেকে তুই আমার কুন্তী!’

.

সুদাম বললে, চ’ তাহলে চলেই যাই। অনেক দূরে গিয়ে ঘর বাঁধব। আমি পুতুল গড়ব, তুই বেচবি। কষ্ট করতে পারবি তো?

তোকে পেলাম, আর আমার কষ্ট কি সুদাম?

হঠাৎ শুকনো পাতা উড়িয়ে হু হু করে ছুটে এল খ্যাপা দমকা হাওয়া ঈশান কোণ থেকে। দেখতে দেখতে লাল হয়ে গেল রুপোলি আকাশ।

ভুরু কুঁচকে তিলক বললে, চাঁদনি রাতে ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে, এ কেমনতর কাণ্ড! এই বেলা চলে চল। খুব চুপিসারে যেতে হবে কিন্তু।

কেন? মাধবঠাকুর তো যেতে বলেছে। তবে আমাদের আটকাবে কে?

রাজাবাহাদুর। তার চর শড়কি নিয়ে কোথায় ওত পেতে আছে কে জানে? জঙ্গলের ভেতর গা—ঢাকা দিয়ে যাই চল।

কিন্তু জঙ্গলে চিতা আছে, হাতি আছে, শাঁখচুড়ো সাপ আছে!

ভয় কি? মরি তো দু’জনে একসঙ্গেই মরব!

পারবি?

খুব পারব।

মাথার ওপর পাখসাট মেরে একটা রাতচরা পাখি বিশ্রী কক—কক শব্দে হেসে উঠল।

হাত তিরিশেক তফাতে পাথরের আড়ালে ছায়ামূর্তি পাশে হাত বাড়াল। হাত পড়ল কালো চকচকে একটা বস্তুর ওপর।

.

লম্বা লম্বা বুনো আগাছা সরিয়ে পাথরের পাশ দিয়ে কেতু তখন হনহনিয়ে উঠে আসছে। পা চালিয়ে আর রে ছোঁড়া—ছুঁড়ি, পা চালিয়ে আয়! তুফান উঠবে!

.

তবে আয়, চলে আয়।

তিলকের হাতখানা মুঠোর মধ্যে ধরে দাঁড়িয়ে উঠল সুদাম।

আর ঠিক তখনই হাত পঞ্চাশেক তফাতে পাথরের আড়াল থেকে মুখ বাড়াল সেই কালো চকচকে বস্তুটা।

এক ঝলক আগুনের সঙ্গে সঙ্গে দুম করে একটা বিকট শব্দ!

দু’হাতে বুক চেপে টলে পড়ল সুদাম। যে পাথরটায় বসেছিল, তারই কিনারায়। দেহের অর্ধেকটা ঝুলে পড়ল খাদের দিকে।

এক পলকের জন্যে বাকরোধ হয়ে গেল তিলকের। তারপরেই তার সমস্ত চেতনা, সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা ভয়ার্ত চিৎকার দিয়ে উঠল, সুদাম!

সেই মর্মান্তিক বিলাপ ঝোড়ো হাওয়ার কাতরানি ছাপিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে মাথা কুটে ককিয়ে কেঁদে উঠল, সুদা—আ—আম!

ঝুঁকে পড়ে সুদামের রক্তমাখা দেহটা জড়িয়ে ধরল তিলক। পাগলের মতো তুলতে গেল টেনে। পারল না। চোখের নিমেষে সুদামের দেহের ভার তাকে সুদ্ধ টেনে নিয়ে গেল অতল পাতালে।

ঝপাৎ করে একটা আওয়াজ ভেসে এল শুধু!

খলখল করে রঙ্গিনী তেমনি হাসতে লাগল।

.

ছুটতে ছুটতে থমকে থেমে গেল কেতু। যেন প্রাণ নেই! যেন গুলিটা ওরই বুকে লেগেছে!

কিন্তু সে একটা নিমেষ। তারপরেই পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে তরতর করে নামতে লাগল। পাথর ডিঙিয়ে, কাঁটাঝোপ মাড়িয়ে। কতবার হোঁচট খেল, কতবার পিছলে পড়ল।

রঙ্গিনী ঝর্ণা রঙ্গ করে যে বিশাল গহ্বরে ঝাঁপ খেয়ে পড়ছে, তারই পাশে নেমে এল কেতু।

কেউ নেই! জলের তলায় বাসর জাগতে গেছে দু’জনে!

সুদাম আর তিলককে খেয়ে মা রক্তখাগীর মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে রঙ্গিনী।

বড় দেরি হয়ে গেল! সেই যদি এল, আরেকটু আগে এল না কেন কেতু? আর কেউ না জানুক, কেতু সর্দার জানতে পেরেছে এ কাজ কার। বাঘ—মারা বন্দুক দিয়ে তুমি জোড়—বাঁধা পাখি মারলে রাজাহুজুর! বিচার কি নেই?

নুলো হাতখানা দিয়ে চোখ মুছে ফেললে কেতু। ভিজে চোখটা আগুনের ফুলকি হয়ে জ্বলতে লাগল।

.

সেই রাতেই ঝড় এল। ঈশান কোণ থেকে কালো ঘোড়ার মতো কেশর ফুলিয়ে ছুটে এল মেঘের কুণ্ডলী। দেখতে দেখতে কালো হয়ে গেল পরিষ্কার আকাশ। মাতালের মতো টলতে লাগল অরণ্য। আর কালো আকাশ চিরে দিগ—দিগন্ত কাঁপিয়ে কোথায় যেন পড়ল একটা বাজ।

পরদিন সকালে মন্দিরের দরজা খুলেই হাহাকার করে বসে পড়ল মাধবদাস।

মন্দিরের ভাঙা ছাদের নিচে গোপীনাথের রাধা আটফাটা হয়ে আছে! গোপীনাথ কিন্তু অক্ষত দেহে তেমনি মধুর হাসি হাসছে।