শঙ্খচূড় – ৮

আট

দিন গেল, রাত এল। আসে আর যায়।

অরণ্যের রাত যেন যাদুকরী। সে ডাকে, সে টানে।

আরতি—নৃত্যের পর জলসা বাড়িতে ফিরে সাজ বদলাতে যাচ্ছিল অলকাতিলকা। চমকে উঠল। যাদুকরী রাত শুধু ডাকে আর টানে না, সে বুঝি বাঁশি বাজিয়ে সাপও খেলায়! জঙ্গলে অনেক কেউটে, অনেক শঙ্খচূড়!

কিন্তু এ তো সাপ—খেলানোর সুর নয়! রাতের বাঁশিতে জংলা সুর বাজে, এ কেমন কথা! এ সুর যে অলকাতিলকার বড় চেনা, তার রক্তে মিশে আছে এ সুর।

এই অসময়ে কে বাজায়?

সাজ পালটানো আর হল না দেবদাসীর। জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এ যে সেই সুর, যে সুর শোনার অপেক্ষায় হর্তুকি গাছতলায় আট বছরের বালিকা—মন উৎসুক হয়ে থাকত। যে সুরে চকমকির ঘাটে ভরদুপুরের আকাশ ঝিমিয়ে আসে। এ সেই জংলা সুর! দূর থেকে ক্রমশ কাছে আসছে।

কে বাজায়? যাদুকরী রাত, না আর কেউ?

হাত বাড়িয়ে কালো ওড়নাখানা টেনে নিল অলকাতিলকা। তারপর গায়ে মাথায় জড়িয়ে, পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। পায়ের নূপুর ভয়ে ভয়ে বাজতে লাগল ঝুম—ঝুম ঝুমুর—ঝুম ঝুম—ঝুম।

ছুটে এল পরিচারিকা। বললে, কোথা যাও? সঙ্গে যাব?

ঠোঁটে আঙুল দিয়ে, হাতের আংটি খুলে দিলে অলকাতিলকা।

বাঁশি কাছে আসছে।

ফটকের পাহারাদার আটকালো: রাজাবাহাদুরের হুকুম নেই একা ছেড়ে দিতে।

বাঁশি আরো কাছে আসছে।

অলকাতিলকার বুকের ভেতরটা কাঁপছে। পাহারাদারকে বললে, মন্দিরে মুক্তোর হার ফেলে এসেছি। এখুনি যাও, নিয়ে এসো।

পাহারাদার আর দাঁড়াল না। লাঠি লণ্ঠন নিয়ে ঢালু পথে নেমে গেল। আর, ফটকে দাঁড়িয়ে সেদিকে অনিমেষে তাকিয়ে রইল অলকাতিলকা।

ধীরে ধীরে সেই পাহাড়ি রাস্তার চড়াইয়ের দিক থেকে দেখা গেল বাবরি চুলে ঘেরা একটা মাথা, আর মুখের কাছে দু’হাতে ধরা একটা আড় বাঁশি। আবছায়া জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট করে দেখা যায় না, তবু অলকাতিলকার চেতনা সজাগ হয়ে উঠল।

মাথা থেকে বুক, বুক থেকে গোটা দেহটাই দেখা গেল এবার। চওড়া বুকের ছাতি, সরু কোমরে খাটো ধুতির কোঁচার দিকটা জড়িয়ে বাঁধা।

চিনেছে। সুদাম!

যেন হাওয়ার ওপর পা। ফেলে ছুটে গেল অলকাতিলকা। শঙ্কিত নূপুর চাপা আনন্দে বেজে উঠল ঝুম—ঝুম ঝুমুর—ঝুম!

পথে, মাঝামাঝি দু’জনে দেখা।

উৎকণ্ঠায় আলুথালু হয়ে অলকাতিলকা বললে, এখানে কেন এলি সুদাম?

বাঁশিটা কোমরে গুঁজে সুদাম বললে, না এসে যে পারি নে তিলক। আজ সাতদিন তোকে দেখতে পাইনি।

তাই বলে চার কোশ পথ ভেঙে এলি! শুধু আমায় দেখতে!

মিষ্টি করে হাসল সুদাম: আর কাকে দেখতে?

সুদামের হাতখানা ধরে ফেললে তিলক। বললে, একে রাত, তায় জঙ্গলের পথ—বুনো জানোয়ার আছে—না, না সুদাম, আমার মাথা খাস, বল আর আসবি নে?

বলব। আগে বল, কাল থেকে তুই চকমকির ঘাটে যাবি?

তিলকের গলাটা ধরে এল। বললে, চকমকির ঘাটে যাওয়া আমার বন্ধ, সুদাম। রাজাবাহাদুরের মানা।

খানিক চুপ করে রইল সুদাম। তারপর আস্তে আস্তে বললে, আমি জানতাম, আমার কাছে তোর আসা একদিন বন্ধ হয়ে যাবে! গোপীনাথ তোকে কেড়ে নিয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিল। রাজাহুজুর আর ফিরিয়ে দেবে না।

চোখে জল এসে পড়েছিল, সামলে নিয়ে তিলক বললে, মনে কষ্ট করিসনে সুদাম। আমার জন্যে আর ঘুরে বেড়িয়ে কি হবে বল! তার চেয়ে তুই বিয়ে—থা কর, করে সুখী হ।

হেসে উঠল সুদাম। বললে, সুখ কাকে বলে জানিস?

কাকে?

যখন দিনান্তে একটিবার তিলকের সঙ্গে সুদামের দেখা হয়। তুই ছাড়া আমার সুখ কোথায় রে?

তিলক আর পারলে না। বড় সুখে, বড় আনন্দে সুদামের চওড়া বুকে মুখ গুঁজে ধরে—রাখা চোখের জল ছেড়ে দিলে।

আর, ঠিক সেই সময় পাথরের রাস্তায় ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল খটাখট খটাখট।

চকিতে মুখ তুলে তাকাল তিলক। তারপরেই সুদামের হাত টেনে জঙ্গলের অন্ধকারে মিশিয়ে গেল।

মুহূর্ত কয়েক বাদেই ঘোড়সওয়ারের মূর্তিটা ছুটে বেরিয়ে গেল তীরবেগে। আবছায়া অন্ধকারে লোহার রেকাব চকচক করছে।

সুদামের মুঠিটা তখন শক্ত করে চেপে আছে তিলক।

.

আরো খানিক বাদে অলকাতিলকা যখন বসন্তবিহারে এল, পাহারাদার তখনও মন্দির থেকে ফেরেনি।

পরিচারিকা বললে, রাজাবাহাদুর এসে ফিরে গেছে।

.

সেই রাতেই কন্দর্পকান্তির বৈঠকখানায় কেতু সর্দারের ডাক পড়ল। সেই চওড়া গালপাট্টা, চুমরানো গোঁফ আর রক্তবর্ণ একটি মাত্র চোখ।

কন্দর্প বললে, তোকে একটা কাজ করতে হবে কেতু।

নুলো হাতখানা কপালে ঠেকিয়ে কেতু বললে, আজ্ঞা করুন রাজাহুজুর।

কাল থেকে রাতে জঙ্গলে গা—ঢাকা দিয়ে থাকবি, আর জলসা বাড়ির ওপর নজর রাখবি। কে আসে, কে যায়, খবর চাই আমার। বুঝলি?

তা আর বুঝব না হুজুর? কিন্তু জঙ্গলে চিতে আছে যে!

থাকলই বা। তুই তো চিতে—মারা কেতু। না হয় বাঁ—হাতের কবজিটাও যাবে। যাকগে, কবজির দাম পাবি।

নুলো হাতখানা আরকবার কপালে ঠেকিয়ে, চিতার মতো দাঁত বের করলে কেতু।

.

পরদিন রাতে কন্দর্পকান্তির ঘোড়া বসন্তবিহারের ফটকে আবার থামল। দেবদাসী ঘরেই ছিল।

কাল কোথায় বেরিয়েছিলে?

সহজভাবেই জিজ্ঞেস করল কন্দর্প। কিন্তু অলকাতিলকা যেন এক মুহূর্তের জন্য কাঠ হয়ে গেল। শ্বেতপাথরের মেঝের দিকে চোখ রেখে থেমে থেমে বললে, মুক্তোর হারছড়াটা কাল কোথায় যে হারিয়ে ফেলেছি! পথে পড়ল কিনা—খুজতে গিয়েছিলাম।

খুঁজে পেলে?

না।

হেসে উঠল কন্দর্পকান্তি। বললে, পাবে না আমি জানি। মুক্তোর মালা হচ্ছে যুবতীর মন, একবার হারালে আর পাওয়া যায় না! দুটোই দামি জিনিস কিনা। সামলে রাখতে হয়।

অলকাতিলকা বোবা হয়ে গেল।

কন্দর্প বললে, যাকগে, একছড়া গেছে, দশছড়া আসবে। মালার অভাব কি? পরবার লোকেরই অভাব।

অলকাতিলকা চোখ তুললে। কন্দর্পকান্তিকে একবার দেখে নিয়ে বললে, রাজাবাহাদুরের এত বড় রাজ্যে সে—অভাব তো হবার কথা নয়!

কন্দর্প বললে, কথা অবশ্য নয়, কিন্তু রাজা হলেই কি সব অভাব মেটে? আমার অভাব কোথায়, তুমি খোঁজ রাখো?

কন্দর্প একটু কাছে এগিয়ে এলো। দু’পা সরে গিয়ে অলকাতিলকা বললে, আমি সামান্য মেয়ে, রাজা—রাজড়ার অভাব আমি কেমন করে জানব বলুন?

রাজা—রাজড়াও তো মানুষ। মানুষ কি চায়, তুমি জানো না?

জানি। সুখী হতে চায়।

কন্দর্পের চোখে তৃষ্ণা আর গলায় আবেগ। বললে, আমিও চাই অলকাতিলকা। কিন্তু সুখী একা হওয়া যায় না, পাশে আরেকজনকে দরকার হয়।

অলকাতিলকার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। মৃদু গলায় বললে, দেবগড়ের রাণি হবার যুগ্যি মেয়ে কি দেশে নেই? গোটা উড়িষ্যায় অনেক রূপসী মেয়ে আছে।

তা আছে বটে। রূপসী অনেক, কিন্তু মনের মতো শুধু একটি। তুমি জানো সে কে। জানো না?

অলকাতিলকা যেন পাথর।

কন্দর্প আবার বললে, ধরো, আমি যদি তাকেই চাই, সে কি আমায় ফিরিয়ে দিতে পারে?

অলকাতিলকা পাথর হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ থেকে কে যেন সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে।

জবাবটা ভেবে রেখো।

হাতের ছড়িটা ঘোরাতে ঘোরাতে বেরিয়ে গেল কন্দর্পকান্তি।

.

বাঁশি ডাকে আরো বেশি রাতে। যখন মানুষ ঘুমোয়, অরণ্য জাগে। আর, অরণ্যের সঙ্গে সঙ্গে জাগে অলকাতিলকার শঙ্কিত অথচ উৎসুক মন।

ভাবে আর যাব না, কিন্তু না গিয়েও পারে না। বাঁশি শুধু ডাকে না, বশ করে। শুধু বশ করে না, অবশ করে। জংলা সুর যেন নেশার মতো। কানে গেলেই আবেশে রিমঝিম করে ওঠে সকল ইন্দ্রিয়, সমস্ত চেতনা। অবশ মন আস্তে আস্তে ফণা—তোলা নাগিনীর মতো দুলতে থাকে। নিজেকে আর সামলাতে পারে না অলকাতিলকা। কালো ওড়নাখানা গায়ে মাথায় জড়িয়ে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরোয়!

পদ্ম—কাটা মেঝের ওপর অগাধে ঘুমিয়ে থাকে পরিচারিকা। জলসাঘরের বারান্দায় নাক ডাকায় পাহারাদার। ফুলের বাগান পার হয়ে অলকাতিলকা চলে আসে ফটকে। ফটক পার হয়ে রাস্তায়। আলতো পায়ের ভয়তরাসী নূপুর বাজে ঝুম—ঝুম ঝুম—ঝুম।

যেন ফিসফিস করে বলে, চুপ চুপ! এই বুঝি কে জাগল! এই বুঝি কে দেখল!

কিন্তু কেউ জাগেও না, কেউ দেখেও না। দেখে শুধু জঙ্গলের মাথায় সপ্তর্ষি তারা। দেবদাসীর ভয় দেখে মিটিমিটি হাসে।

অলকাতিলকা বলে, এই নিশুত রাত—তোর প্রাণে কি ভয়—ডর নেই সুদাম?

হাসিমুখে সুদাম বলে, তোর আছে? থাকলে কি আমার কাছে আসতে পারতিস?

রাগ দেখিয়ে তিলক বলে, যত নষ্টের গোড়া ওই মুখপোড়া বাঁশিটা! সাধ হয় ছোটবেলার মতো ওটাকে চিবিয়ে ভাঙি।

তলদা বাঁশের বাঁশিটা এগিয়ে ধরে সুদাম বলে, নে না, সাধটা মিটিয়ে নে। বাঁশি ভাঙতে পারবি, আমার গান তো কাড়তে পারবিনে।

খুব পারব।

পারবি নে তিলক। যতদিন তুই থাকবি, ততদিন আমার গানও থাকবে।

যদি একশো বছর থাকি?

আমার গানও একশো বছর থাকবে।

যদি দু’দিন থাকি?

আমার গানের মেয়াদও দু’দিন। তুই—ই তো আমার গান রে?

সুদামের বুকের কাছে আরো সরে এসে তিলক বললে, আমার কেন এত ভয় করে সুদাম?

কিসের ভয়?

আমাদের ওপর কার যেন কু—দৃষ্টি পড়েছে!

সুদাম হেসে বললে, দূর! মিছে তোর ভয়।

একটা নিশ্বাস ফেলে তিলক বললে, তা হবে। রাত ভারি হল সুদাম, এবার ঘরে যা।

আগে তুই যা।

না, আগে তুই যা।

ঢালু পথে পা বাড়াল সুদাম। যেতে যেতে বাঁশিতে ফুঁ দিল। সেদিকে খানিক তাকিয়ে থেকে তিলক আস্তে আস্তে ফটকের দিকে এগোল।

দু’জনের কেউই এতক্ষণ লক্ষ করেনি পাশের কালকাসুন্দা ঝোপের দিকে। নইলে দেখতে পেত কু—দৃষ্টি সত্যিই পড়েছে ওদের ওপর। ঝোপের আড়াল থেকে জ্বলজ্বলে একটা চোখ সব দেখছিল! সে চোখ চিতার নয়, চিতে—মারা কেতুর।

.

রোজ রাতে লুকিয়ে দেখা করে?

আজ্ঞে।

লোকটা কে? নতুন কেউ?

কাট—গ্লাসের গেলাসটা তুলে নিল কন্দর্পকান্তি। কমলালেবু রঙের পানীয় টলটল করছে।

কেতু সবিনয়ে নিবেদন করলে: আজ্ঞে না, ফুলে ভোমরায় ভাব থাকলে কি বদল হয়? ভোমরা সেই পুরানো!

মানে সুদাম পোটো?

ঠিক ধরেছেন হুজুর।

হাতের ভরা পাত্রটাকে কন্দর্পকান্তি এক আছাড় মারলে মার্বেলের মেঝের ওপর। টুকরো টুকরো হয়ে গেল শৌখিন কাট—গ্লাসের গেলাস।

কেতু বলে উঠল, আহা—হা! মুখে তুলতে গিয়ে ফসকে গেল হুজুর!

চোপরাও!

ধমকে উঠল কন্দর্পকান্তি। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বললে, সুদাম পোটোর এমন আস্পর্ধা! প্রজা হয়ে রাজার ওপর টেক্কা দেয়!

ভাঙা কাচের টুকরোগুলো কুড়োতে কুড়োতে কেতু দন্তুর প্রাণীর মতো হাসলে। বললে, মানুষের বুকের ভেতর একটা রাজ্যি আছে হুজুর, সেখেনে সে নিজেই রাজা!

কথাটা কন্দর্প বোধ করি কান দিয়েই শুনল, মন দিয়ে বুঝল না। অন্যমনস্ক হয়ে ডাকল, কেতু!

কাচের টুকরোগুলো একপাশে জড়ো করে রেখে কেতু উঠে দাঁড়াল।—আজ্ঞে করুন রাজাহুজুর!

বয়স হলেও অন্ধকারে তোর একচোখ হায়েনার মতো জ্বলে, না রে?

তা জ্বলে বইকি আজ্ঞে।

শড়কিতে তোর বাঁ—হাতের টিপ এখনো পাকা, তাই না?

ঘাড় নেড়ে কেতু বললে, সবই মা রক্তখাগীর দয়া!

কাছে এগিয়ে এল কন্দর্পকান্তি। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় বললে, তাহলে শোন। আজ রাতে এক শড়কিতে দুটোকেই—

কন্দর্পের কথা শেষ হল না। নুলো হাতখানা কপাল ঠেকিয়ে কেতু বলে উঠল, মাপ করতে হল হুজুর। আমি চিতে—মারা কেতু, আমায় জোড়—বাঁধা পাখি মারতে আজ্ঞে করবেন না। ও বড় ছোট কাজ!

ছোট কাজ!

কয়েক মুহূর্ত কেতুর মুখের পানে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল কন্দর্প। তারপর বললে, ও! সাধু হয়েছিস!

এবার শব্দ করে হেসে উঠল কেতু। বললে, কি যে বলেন হুজুর! জীবনভর শয়তানের গোলামি করে আমি সাধু হব! আর না হুজুর, এবার ছুটি দিন।

তা হবে না কেতু। জীবনভর যখন শয়তানের গোলামি করেছিস, তখন আজও করতে হবে। নইলে—

দেয়ালে কোণে রাখা রাইফেলটা টেনে নিয়ে কথাটা শেষ করলে কন্দর্প, নইলে একেবারে ছুটি দিয়ে দেব।

গুম খেয়ে গেল কেতু সর্দার। তারপর একটু হেসে বললে, না হুজুর, না! আমার জানের চেয়ে আপনার বন্দুকের একটা টোটার দাম বেশি। বাজে খরচ করবেন না!

কাল রাতে আমার খবর চাই।

যে আজ্ঞা রাজাহুজুর।

.

যেন ওত পেতে এগিয়ে এল একটা বুনো জানোয়ার। গুঁড়ি মেরে এসে দাঁড়াল কালকাসুন্দা ঝোপের আড়ালে।

জানোয়ার নয়, মানুষ। কেতু সর্দার। হায়েনার মতো একটা মাত্র চোখ সত্যিই জ্বলছে। হাতের শক্ত মুঠোয় একটা শড়কি!

ফাগুনে হাওয়ায় বাঁশির আওয়াজটা শুনেই এগিয়ে এসেছে কেতু। আকাশে একাদশীর চাঁদ। ছিটে—ছিটে জ্যোৎস্নায় জঙ্গলময় সলমাচুমকির কাজ করা।

ওই যে দেবদাসী আসছে পা টিপে টিপে। পায়ের নূপুর যেন ভয়ে মরে যাচ্ছে, ঝুম—ঝুম, ঝুমুর—ঝুম, ঝুম—ঝুম!

উলটো পথে সুদাম এল। বাঁশিটা গুঁজে রাখলে কোমরে। দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়াল শিরীষগাছতলায়।

সব দেখতে পাচ্ছে কেতু। সুদামের মুখ আর দেবদাসীর পিঠ। শুধু শুনতে পাচ্ছে না ওদের কথা। না পাক, চোখের নিশানা ঠিক হলেই হল!

কত কথাই বলছে দু’জনে। সত্যি যেন জোড়—বাঁধা পাখি! হাওয়ায় ফুরফুর করে শিরীষ ফুলের থোকা ঝরে ঝরে পড়ছে ওদের গায়ে মাথায়। রাজাহুজুরের হুকুম এক শড়কিতে দুটোকে গেঁথে ফেলতে হবে। কিন্তু খুনের নেশা লাগছে না কেন কেতুর রক্তে? বয়েস হয়েছে বলে? না, লোহার পাতের মতো শক্ত বুকের ছাতির মধ্যে মানুষের মনটা এখনো একেবারে মরেনি বলে?

গলা টিপে মারো সেই মনটাকে। রাজাহুজুরের হুকুম বরাবর সে তামিল করে এসেছে, আজও তামিল করতে হবে। অনেক নুন খেয়েছে, কেতু সর্দার বেইমান নয়।

কিন্তু দুনিয়ার কার পাকা ধানে মই দিয়েছে ওই ছোঁড়া—ছুঁড়ি দুটো। কারো না। তবে? একজোড়া বাচ্চচা হরিণ—হরিণীকে মেরে লাভ কি?

লাভ নেই বটে, কিন্তু লোকসান আছে। জান নিতে না পারলে জান দিতে হবে। রাজাহুজুরের হুকুম!

কেতুর ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে বলে, পালিয়ে যা রে তোরা, পালিয়ে যা! এমন রাজ্যে পালিয়ে যা, যেখেনে রাজা নেই, কেতু সর্দার নেই!

বোকা ছেলেমেয়ে দুটো তবু নড়ে না। কথা কইছে, রঙ্গ করছে, হাসছে! ভয় নেই, ডর নেই, ওরা দু’জন ছাড়া গোটা দুনিয়ায় যেন আর কেউ নেই!

মরুক তবে।

সুদামের মুখোমুখি বলে কেতুর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছে দেবদাসী। ভালোই হয়েছে। এক সঙ্গেই দুজনকে গেঁথে ফেলা সহজ। শড়কিটা মেয়েটার পিঠ ফুঁড়ে ছেলেটার বুকে সোজা ঢুকে যাবে।

বাঁ—হাতের মুঠো আরো শক্ত হল। আস্তে আস্তে শড়কি—ধরা হাতখানা উঁচিয়ে ধরলে কেতু। আর, ঠিক সেই সময় মিষ্টি হেসে মুখ ফেরাল দেবদাসী। ভরা একাদশীর চাঁদের আলো পড়ল তার মুখে।

হাত কেঁপে গেল কেতু সর্দারের। কিন্তু শড়কি তখন সে ছেড়ে দিয়েছে। সাঁত করে একটা শব্দ হল শুধু, চকচকে ফলাটা সাপের জিভের মতো লকলক করে উঠেই শিরীষগাছের গুঁড়িতে গেঁথে গেল।

ভয়ার্ত আওয়াজ করে নিমেষে অলকাতিলকাকে টেনে সরিয়ে নিলে সুদাম।

ক্লান্ত পশুর মতো কেতু তখন হাঁপাচ্ছে।

.

অস্থির পায়ে ঘরময় করে বেড়াচ্ছে কন্দর্প কান্তি। মাথা হেঁট করে এসে দাঁড়াল কেতু।

পারলাম না হুজুর।

স্থির হয়ে গেল কন্দর্প। হাত দু’খানা পিছনে মুষ্টিবদ্ধ।

পারলি না!

আজ্ঞে না।

কেন পারলি না?

হাতের টিপ ফসকে গেল হুজুর।

অত্যাচারী রাজবংশের রক্ত কন্দর্পের শিরায় শিরায় টগবগ করে উঠল। বললে, মিছে কথা! সাপের ছোবল ফসকায়, কেতু সর্দারের শড়কি ফসকায় না।

মা রক্তখাগীর দিব্যি! জীবনে এই পেরথম ফসকাল।

কর্কশ স্বরে কন্দর্প বললে, বাজে কথা রাখ! তৈরি হ।

দেয়ালে ঠেসিয়ে রাখা রাইফেলটা নিতে যাচ্ছিল কন্দর্প, হঠাৎ থেমে বললে, নাঃ, একটা টোটা বাজে খরচ করে লাভ নেই।

দেয়ালে ঝোলানো শংকর মাছের চাবুকটা টেনে নিলে সে।

একটুও চমকাল না কেতু। অনুনয় করে বললে, ওটাও রেখে দিন হুজুর। তার চে’ আমার এই বাঁ—হাতের কব্জিটাও কেটে বাদ দিয়ে দিন, যাতে আর কখনো শড়কি ধরতে না হয়!

উত্তরে সপাং করে একটা শব্দ হল শুধু। কেতুর কালো মুখের এপাশ থেকে ওপাশ অবধি আড়াআড়িভাবে রক্ত ঝুঁজিয়ে পড়তে লাগল।

তিক্ত হাসিতে ঠোঁট দু’খানা বেঁকিয়ে কন্দর্প বললে, হাতের টিপ ফসকে গেছে! না, অলকাতিলকার চাঁদ—মুখ দেখ ভুলে গেছিস?

রক্তাক্ত মুখে বীভৎস হেসে কেতু বললে, তা গেছি হুজুর। তার চাঁদ—মুখ দেখেই ভুলে গেছি। ভালো করে আগে দেখিনি, মুখখানা অনেকটা আমার ওলাউঠোয় মরা মেয়ে কুন্তীর মতন!

তাজা রক্তের সঙ্গে দু’ফোঁটা চোখের জল এসে মিশল।

ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল কন্দর্প। তারপর হাতের চাবুকটা আছড়ে ফেলে দিলে।