শঙ্খচূড় – ৭

সাত

চকমকির দুই পাড় আকুল হয়ে উঠেছে জংলা বাঁশির সুরে।

তিলক বললে, থাম না, একটা কথা বলি।

বাঁশি থামিয়ে সুদাম বললে, বল।

রাজাবাহাদুর তোকে যে টাকা পাঠিয়েছিল, ফেরত দিলি কেন? তিলক জিজ্ঞেস করলে।

একটা নুড়ি চকমকির জলে ছুড়ে দিয়ে সুদাম বললে, টাকার দরকার নেই আমার।

কেন? ঘড়া ঘড়া মোহর আছে বুঝি তোর?

ছোট্ট করে জবাব দিলে সুদাম, আছে বইকি।

গালে হাত দিয়ে তিলক বললে, বলিস কি! কোথায়?

তিলকের দিকে আঙুল দেখিয়ে সুদাম বললে, এই তো।

ঠোঁট বেঁকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে তিলক বলে উঠল, তোর বুকের পাটা তো কম নয় দেখছি! জানিস আমি কার? পরের ধনে পোদ্দারি?

তার দিকে ফিরে সুদাম বললে, ভুল বললি তিলক। পরের ধন নয়। আমার জিনিস যদি ডাকাতে কেড়ে নেয়, তাহলে জিনিসটাই চলে যায়, আমার স্বত্ব কি চলে যায় রে?

অবাক হয়ে গেল তিলক। বললে, ডাকাত! ডাকাত আবার কে?

দীঘল সরল দুই চোখ জ্বলে উঠল। সুদাম বললে, গোপীনাথ।

সুদামের রাগ দেখে তিলক হেসে ফেললে। বললে, ডাকাত কোথায়? ও যে রাখাল! হাতে তো লাঠি নেই, বাঁশি।

সেয়ানা ডাকাতের ওই তো হাতিয়ার।

মিষ্টি মিষ্টি হেসে তিলক বললে, তোর হাতেও যে তাই! তুইও তাহলে সেয়ানা ডাকাত?

সুদামের গলাটা উদাস হয়ে এল। বললে, না তিলক, সে আমি হতে চাই নে। ডাকাতি করে কি মন পাওয়া যায় রে?

তবে কি করে পাওয়া যায়? ভিক্ষে করে?

উঁহু। ডাকাতি করেও না, ভিক্ষে করেও না। যে পায়, সে আপনি পায়।

বাঁশিতে আবার ফুঁ দিল সুদাম। ভরদুপুরের আকাশ যেন ঝিমিয়ে এল সেই সুরে। ঘাটে পড়ে রইল তেল গামছা শাড়ি। তিলক যেন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে।

.

কাল, পরশু, তরশু, রোজ।

কিংখাবের ঝালর—দেওয়া পালকিটা রোজই দুপুরে এসে থামে হিজলগাছতলায়। চকমকির ঘাট সেখান থেকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এক রশি। তোলা জলে স্নান তিলকের আর ভালো লাগে না, নদীর জল নইলে গা জুড়োয় না তার। নদী যেন টানে তাকে।

নদী টানে, না বাঁশি টানে?

কেউ টানে না, টানে শুধু মন।

নাইতে গিয়ে ক্রমেই বেলা বেড়ে যায়। বেলা পড়েও আসে এক একদিন। কথা আর থামে না, সুর আর ফুরোয় না।

ওদিকে হিজলগাছতলায় পালকি রেখে পাইকরা দোক্তা খায়, খোসগল্প করে, ঝিমোয়।

কেতু সর্দার গতজন্মে বোধ করি নন্দী বা ভৃঙ্গী ছিল। দোক্তায় তার শানায় না, ভাং চাই। পানের সঙ্গে গুণ্ডির বদলে একমুঠো শুকনো ভাংয়ের পাতা চিবোলে তবে তার মৌজ হয়। কেতুর একটা মাত্র চক্ষু সর্বদাই রক্তবর্ণ। গুলি—পাকানো পেশীবহুল দেহ, ডান হাতের কব্জি অবধি কাটা, চওড়া গালপাট্টা আর চুমরানো গোঁফের দরুন মুখের চেহারাখানা এমন হয়েছে যে মা দুর্গার পায়ের তলায় বসিয়ে দিলেই হয়।

শোনা যায়, কেতু একবার জঙ্গলে চিতাবাঘের মুখে পড়ে। ডান হাতের মুঠো চিতার হাঁয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে, সে বাঁ হাতেই তার টুঁটি টিপে দফা নিকেশ করেছিল। সেই থেকে তার নাম চিতেমারা কেতু।

এ হেন কেতু সর্দার সেদিন পান খেতে গিয়ে দেখল ভাংয়ের বটুয়া ফাঁক! দেবগড়ের জঙ্গলে কিছু কিছু ভাংয়ের গাছ পাওয়া যায়। কেতু জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

বেশি দূর যেতে হল না। আধ রশি তফাত থেকেই দৃশ্যটা কেতুর একটি মাত্র চোখে পড়ে গেল।

চকমকির ঘাটে বসে সুদাম বিভোর হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। আর, তারই পিঠে হেলান দিয়ে বসে আছে গোপীনাথের মন্দিরের দেবদাসী!

কেতু ভাং খুঁজতে ভুলে গেল।

.

সে—রাতে কন্দর্পকান্তির বৈঠকখানায় একচোখো নুলো কেতুকে দেখা গেল। শিকারের সময় রাজবাহাদুরের খাস খানসামা সে। কবজি—কাটা হাতটা কপালে ঠেকিয়ে বললে, একটা খবর আছে রাজা হুজুর।

এই সময়টা কন্দর্পকান্তি ধ্যানে বসে। সুরাদেবীর ধ্যানে বৈঠকখানা নিরিবিলি থাকে। স্নান সেরে মলমলের ফিনফিনে পিরান গায়ে দিয়ে বসে। গোলাপি আতর লাগায়। গোলাপের খোশবায়ে মেজাজও খুশ থাকে।

কন্দর্পকান্তি বললে, খবরটা কি? জঙ্গল থেকে চিতে বাঘ ছিটকে বেরিয়েছে? না বুনো হাতি?

আজ্ঞে, ওসব নয়। আজকাল চকমকির ভাঙা ঘাটে বাঁশি বাজে।

তা বাজুক না। যত খুশি বাজুক। তাতে আমারই বা কি, তোরই বা কি?

দেহের ঊর্ধ্বাংশ নুইয়ে কেতু সবিনয়ে নিবেদন করলে, কেতু সর্দার তো আপনার জুতোর সুখতলা! আমার কি যাবে—আসবে হুজুর? তবে আপনার কিছু আসে—যায় বটে।

হাতের গেলাসটা নামিয়ে রাখলে কন্দর্পকান্তি। ভুরু কুঁচকে বললে, খুলে বল কেতু।

খুলেই বললে কেতু। চকমকির ঘাটে ভরদুপুরে যে দৃশ্যটা তার একচোখে ধরা পড়েছিল, তা আর ঢেকে রাখলে না। সব বলে শেষকালে জুড়ে দিলে, গুপীনাথের বদনাম, মন্দিরের বদনাম, আপনারও বদনাম।

কন্দর্প শুনলে। তারপর ঘরময় পায়চারি করতে লাগল অন্যমনস্ক হয়ে। হঠাৎ এক সময় থেমে জিজ্ঞেস করলে, ঠিক দেখেছিস তো?

কেতুর হাসিটা দন্তুর পশুর মতো। সেই দাঁতালো হাসি হেসে সে বললে, দু’চোখে বরং দু’রকম দেখায় হুজুর, একচোখে দেখতে ভুল হয় না।

হুঁ। লোকটা কে?

আজ্ঞে, সুদাম পোটো।

চমকাল না কন্দর্পকান্তি। প্রথমে কয়েক মুহূর্ত গুম হয়ে রইল, তারপর ভরাট গলায় হেসে উঠল। বললে, আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম। যাক, রাধা গড়ার রহস্যটা বোঝা গেল এবার। কেতু!

আজ্ঞে করুন।

কাল সকালে জলসাবাড়িতে পালকি নিয়ে যাবার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবি।

যে আজ্ঞে রাজাহুজুর।

.

মন্দির—চত্বর থেকে বেরিয়ে পালকি চড়াইয়ের পথ ধরল।

কিংখাবের ঝালর ঈষৎ সরিয়ে অলকাতিলকা বললে, এদিকে কেন? নদীর ঘাটে যাও।

পালকির আগে আগে আটোসোটা নিয়ে যাচ্ছে কেতু সর্দার। পালকির পাশে এসে দাঁতালো হাসি হেসে বললে, রাজাহুজুরের মানা আছে আজ্ঞো।

একটু অবাক হয়ে দেবদাসী জিজ্ঞেস করলে, মানা কেন?

আজ্ঞে জঙ্গল থেকে চিতেবাঘ আর বুনো হাতি ছিটকে বেরুচ্ছে।

কই, কাল তো বেরোয়নি!

কেতুর চুমরানো গোঁফের নিচে আবার দাঁতাল হাসি দেখা গেল। বললে, রাতে বেরিয়েছিল, তাই দেখতে পাননি।

দেবদাসী বললে, রাতে বেরিয়েছিল তো দিনে ভয় কি?

ভয় আছে বৈকি দিদি হুজুর। বুনো জানোয়ারকে বিশ্বেস নেই। কখন কোথা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে কে জানে! রাজাহুজুর তাই বন্দুক হাতে নিজে পাহারা দিতে যাবে।

কি যেন ভাবলে অলকাতিলকা। মসৃণ কপালে দু—একটা রেখা পড়ল। একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলে, রাজা বাহাদুরের কানে কথাটা কে তুললে কেতু?

কোন কথাটা দিদি হুজুর?

এই আমি রোজ চকমকির ঘাটে নাইতে যাই। তুমি বলেছ?

জিভ কেটে কেতু জবাব দিলে, আমি! তারা! তারা! রাজা হুজুর হাওয়ায় খবর পায়। কোথায় বাঁশি বাজে আর কোথায় কাঁসি বাজে—সব জানে।

মেঘলা হয়ে এল অলকাতিলকার মুখ। বললে, আজ থেকে আমার নাওয়া তাহলে বন্ধ!

একচোখা কেতু আশ্বাস দিয়ে বললে, বন্ধ কেন হবে দিদি হুজুর? ঘরে গিয়ে দেখুন গে, ঘড়া ঘড়া রঙ্গিনীর জল তোলা আছে। ঠান্ডা হিম, গোলাপের খোসবাই ভুরভুর করছে।

কিংখাবের ঝালর টেনে দিলে অলকাতিলকা। আর কিছুই বললে না। শুধু মনে মনে বুঝতে পারলে, জঙ্গল নয়, রাজপোশাকের আড়াল থেকে একটা বুনো জানোয়ার সত্যিই বেরিয়ে এসে তার পথ আটকেছে। জন্তুটার গরম নিশ্বাসের হলকা অনুভব করতে পারছে সে।

বসন্তবিহারের ফটকে দেবদাসীকে নামিয়ে দিয়ে রাজবাড়ির পালকি ফিরে গেল। ঘরে পালংকে গা ঢেলে দিলে অলকাতিলকা।

এতক্ষণে চকমকির ঘাটে পা ডুবিয়ে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে সুদাম। সেই সুরে ভরদুপুরের আকাশ নেশায় ঢুলছে! সুদাম বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে আর দীঘল চোখে ফিরে ফিরে দেখছে ঘাটের পথে কেউ আসছে কিনা। একা একা বসে অনেকক্ষণ বাজাবে সুদাম, তারপর বেলা পড়ে আসবে, গাঙশালিকেরা ঝাক বেঁধে উড়ে যাবে বাসায়। মন—মরা সুদামও আস্তে আস্তে ফিরে যাবে। ভাববে তিলকের আজ কী হল? আসতে ভুলে গেল! একটু দেখা, দুটো কথা, তাও হল না!

সুদামের নিভে—যাওয়া মলিন মুখখানা অনেক দূরে বসেও অলকাতিলকা যেন স্পষ্ট দেখতে পেল। আর, ঝরঝর করে জল গড়িয়ে এল তার চোখের কাজল ধুয়ে। বড় ভালো লাগল কাঁদতে। কান্নায় যে এত সুখ, আগে সে জানত না।

স্নান—ঘরে পড়ে রইল ঘড়া ঘড়া রঙ্গিনী ঝরনার তোলা জল। ঠান্ডা হিম। গোলাপের খোসবায়ে ভুরভুরে।

সেদিন আর নাওয়াও হল না, খাওয়াও হল না। মানুষের কথা ভেবে ভেবেই গোপীনাথের দাসীর দিন গেল।