শঙ্খচূড় – ৬

ছয়

রাধাষ্টমী তিথিতে গোপীনাথের পাশে রাধা দাঁড়াল।

মেলা বসল, রাজবংশের প্রথানুযায়ী প্রজাদের নতুন বস্ত্র আর চাল বিতরণ হল, কত ঘটাপটায় গমগম করতে লাগল মন্দির। দেবগড় রাজ্যের যত লোক ভেঙে এল গোপীনাথের রাধা দেখতে।

দেখল সবাই। কিন্তু চিনল শুধু পুবপাড়ার লোকেরা। এ যে সেই নীলু পণ্ডিতের মেয়ে তিলকের মুখ বসানো গো! তবে কি তিলকই গোপীনাথের রাধা ছিল আর জন্মে?

কথাটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল গোটা রাজ্যে। আর সেই থেকে দেবদাসী অলকাতিলকার নাম হয়ে গেল গোপীনাথের রাধা।

দেখল অলকাতিলকাও। প্রথমটায় অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে, এ রাধা গড়েছে কে?

মাধবদাস বললে, সুবল পোটোর ছেলে সুদাম।

সুদাম! এক নিমেষে অষ্টাদশী অলকাতিলকা যেন সেই হর্তুকি গাছতলার বালিকা তিলক হয়ে গেল। সুদাম তারই মুখ গড়েছে! বেশ গড়েছে তো! খুশিতে উছলে উঠল বালিকা তিলক। কিন্তু পরক্ষণেই লজ্জায় মরে গেল আঠারো বছরের নবযৌবনা অলকা তিলকা। একি কাণ্ড করেছে সুদাম! লোকের কাছে অলকাতিলকা এখন মুখ দেখাবে কেমন করে? একবার পেলে হয় সেই বজ্জাত পোটোকে!

বিকালে পালকি করে ঘরে ফেরার সময় কিংখাবের ঝালরের ফাঁকে চোখ রেখে বসে রইল দেবদাসী। মন্দিরের আশেপাশে যদি সেই বাবরি চুলে ঘেরা কালোকোলো মুখখানা নজরে পড়ে। এত লোক এসেছে, আর সে আসেনি?

কিন্তু না, সুদাম আসেনি মন্দিরে।

রাতে মাথার কাঁটা কাজলে ডুবিয়ে শুকনো কলা পাতায় অলকাতিলকা লিখল:

 দুপুরে চকমকির ঘাটে যেন দেখা হয়। কথা আছে।

 তিলক

তারপর পরিচারিকাকে ডেকে বললে, কাল সুয্যি ওঠার আগে পুবপাড়ার উত্তরে পোটো—পাড়ায় যেতে হবে। সুদাম পোটোর হাতে এটা দিয়ে আসবি।

ভাঁজ—করা চিঠির সঙ্গে একজোড়া কানপাশাও এল দূতীর হাতে।

.

মন্দির থেকে বসন্তবিহারে না গিয়ে পালকি চলল চকমকির ঘাটে। সকালে একদফা স্নান সেরেই বেরিয়েছিল অলকাতিলকা, তবু সঙ্গে নিয়েছিল গামছা আর শাড়ি।

ঝাঁ ঝাঁ করছে ভরদুপুর। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। নদীর ধারে এ সময় কেউ থাকে না, জলের ধার ঘেঁষে শুধু একটা বক এক—পা তুলে থির হয়ে দাঁড়িয়ে। আর জলে পা ডুবিয়ে চুপ করে বসে আছে সুদাম। আহা, কত ভালো মানুষটি! যেন আরেকটি বক—তপস্বী!

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল অলকাতিলকা। পায়ের নূপুর যেন মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, ঝম—ঝম, ঝমর—ঝম!

ফিরে তাকাল সুদাম। মুখ ভরে গেল হাসিতে। বললে, ডেকেছিস কেন তিলক?

নাকের পাটা ফুলিয়ে তিলক বললে, এ তুই কি করেছিস সুদাম!

কি আবার করলাম?

রাধার মুখ আমার মতো করে গড়লি কেন? ছি, ছি, আমার যে লজ্জা রাখার ঠাঁই নেই!

হাসি মুখে সুদাম বললে, আমার যে আনন্দ রাখবার ঠাঁই নেই!

আমায় লজ্জা দিয়ে তোর আনন্দ? মরি, মরি, কি আনন্দের ছিরি!

হাত ঘুরিয়ে বলতে গিয়ে বাজুবন্ধের ঝুমকো দুলে উঠল। সুদাম দেখল তিলক বড়ই রাগ করেছে। আগের তিলক যেমন কথায় কথায় মান করত। বললে, রাগ করিসনি তিলক।

রাগ করব না! লোকে কি ভাবছে বল তো?

আমার দোষ নেই তিলক। রাধার মুখ ভাবতে গেলে তোরই মুখখানা আমার চোখে ভেসে ওঠে। ছোটবেলা থেকে শুধু তোকেই যে দেখেছি! আমি কি করব বল?

সুদামের গলাটা কেমন অসহায়।

তিলকের রাগটা নিভে এল। ধপ করে সুদামের পাশে বসে পড়ে বললে, আমাকে তুই এখনো ভুলতে পারিসনি?

কই আর পারলাম! তোকে আমি জেগেও দেখি, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও দেখি। আমি পোটো, তাই পট আঁকতে গেলে, মূর্তি গড়তে গেলে আমার হাত বাগ মানে না। পটের মুখ, মূর্তির মুখ তোরই মতো অমন পানের গড়ন হয়ে যায়, চোখ দুটো অমন ঢলঢলে, জোড়া ভুরু অমন জোড়া ধনুকের মতো, ঠোঁট দু’খানা অমন আধখোলা ফুলকুঁড়ির মতো হয়ে যায়! রাধাই গড়তে বল, আর ললিতা—বিশাখাই গড়তে বল, আমি ওই একখানা মুখই গড়তে জানি।

তিলক দেখলে তারই পানে চেয়ে সুদামের টানা টানা সরল চোখ দুটো আবেশে বিভোর হয়ে উঠেছে। সুদাম আর ছোটটি নেই, তখন একুশ বছরের যুবা। কালো শিমুল তুলোর আঁশের মতো ফুরফুরে দাড়ি দুই গালে, ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা। তবু তার কথায় তিলক তেমন লজ্জা পেল না, বরং একটা মিষ্টি শিহরণ খেলে গেল তার অঙ্গে অঙ্গে। সে বুঝতে পারলে না সেটা কিসের অনুভূতি, কিন্তু বড় ভালো লাগল।

কৌতুকের সুরে তিলক বললে, তোর বিদ্যের বালাই নিয়ে মরি! কাল মন্দিরে যাসনি কেন শুনি?

সুদাম বললে, গোপীনাথের মুখ আর দেখব না বলে। সেকি রে! ঠাকুরের ওপর এত গোসা কেন তোর?

সুদামের রাধাকে সে কেড়ে নিয়েছে কেন?

কী বললি! আমি তোর রাধা! ওরে আমার সাধের কেষ্টঠাকুর রে!

খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল তিলক।

সে—হাসি গায়ে মাখলে না সুদাম। উদাস গলায় বললে, তামাসা করছিস? কর গে যা!

জলের দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।

হাসি থামিয়ে তিলক ডাকলে, রাগ করতে হবে না। আয়, চান করি।

জলে নামল দু’জনে। সেই ছোটবেলার মতো এ ওর গায়ে জল ছোড়াছুড়ি করলে খানিক। দু’জনের মাঝখানে এই ক’বছরের ব্যবধান যেন নেই।

এক সময় তিলক জিজ্ঞেস করলে, সুদাম, তোর বাঁশি?

নেই।

নেই! গেল কোথা?

চকমকি জানে।

এ কেমনতর কথা! বল না কোথা?

চকমকির জলে বাঁশি ফেলে দিয়েছি।

কেন?

কে আর শুনবে?

সুদামের গলায় এমন একটা উদাস—করা বিষাদ প্রকাশ পেল যে তিলকের বুকটা হঠাৎ কেমন করে উঠল। তাড়াতাড়ি বললে, আমি শুনব সুদাম। তুই বাজাস।

সুদাম একটু হেসে বললে, বাজাব। কিন্তু তুই শুনবি কেমন করে? তুই কোথা আর আমি কোথা!

মুখের কথা হারিয়ে গেল তিলকের। তাই তো! কোথায় পোটো—পাড়ার সুদাম, আর কোথায় বা বসন্তবিহারের দেবদাসী! মাঝখানে যে অনেকগুলো বছরের তফাত!

একটু ভেবে তিলক বললে, যেদিন আবার চান করতে আসব, সেদিন বাজাস।

কবে আসবি?

এই ধর কাল।

তারপর?

পরশু।

তারপর?

রোজ।

সুদাম বললে, বাঁশিটা আবার চিবিয়ে ভেঙে দিবি না তো?

ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠল দু’জনে। হাসতে হাসতেই তিলক পালকিতে গিয়ে বসল।

.

সেদিন সন্ধ্যা—আরতির পর নাটমন্দিরে অলকাতিলকা যখন নাচ শুরু করলে, তার দৃষ্টি গোপীনাথের মুখ থেকে বারবার সরে রাধার মুখের ওপর পড়তে লাগল। আর, মনটা থেকে থেকে পালিয়ে যেতে লাগল চকমকি নদীর ঘাটে, যেখানে মেঘলা আকাশ, ভরা দুপুর, আর জলে পা ডুবিয়ে বাবরি—মাথা দীঘল—চোখ এক যুবা হাসি—মুখে বলছে, রাধাই বল আর ললিতা—বিশাখাই বল, আমি ওই একটা মুখই গড়তে জানি।

কথাটা যতবার মনে পড়ছে, ততবারই সেই অজানা মিষ্টি শিহরণের ঢেউ খেলে যাচ্ছে তার ঢেউ—খেলানো অঙ্গে অঙ্গে। নাচতে আজ বড় ভালো লাগছে দেবদাসীর। কত ছন্দ, কত তাল, কত লাস্যের লীলা তার আজকের নাচে। পায়ের নূপুর যেন একঝাঁক ভোমরার মতো আনন্দে গুঞ্জন করছে।

নাচের শেষে মাধবদাস একটু অবাক হয়ে বললে, এ নাচ তুমি কোথায় পেলে মা? আমি তো শেখাইনি!

অলকাতিলকা ভয়ে ভয়ে বললে, তাল কেটেছে বুঝি? মুদ্রায় ভুল হয়েছে?

মাধবদাস বললে, না, তা বলিনি। তবে মনে হচ্ছিল এ নাচ ঠাকুরের উদ্দেশে নয়, মানুষের জন্যে। হয়তো আমারই বোঝার ভুল।

অপ্রতিভ হয়ে গেল অলকাতিলকা। প্রতিদিনের মতো সে তো গোপীনাথের উদ্দেশেই নেচেছে। তবে? কি হল আজ তার নাচে?

মাধবদাস আবার বললে, একটা কথা মনে রেখো মা। দেবদাসী আর নটীর নৃত্যে তফাত কি জানো? সংযমের।

.

রাতে কন্দর্পকান্তি এল। বললে গোপীনাথের রাধাকে দেখলে?

অলকাতিলকা ঘাড় নাড়লে। বুঝতে পারলে প্রশ্নের জের সহজে মিটবে না।

কন্দর্প জিজ্ঞেস করলে, কেমন লাগল?

আজকাল অনেক বুদ্ধি ধরে অলকাতিলকা। প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার জন্যে বললে, কেমন করে বলব? মন্দিরে অগুরু—ধূপের ধোঁয়ায় ভালো করে দেখতে পাইনি।

কন্দর্পও ছাড়বার পাত্র নয়। বললে, তাহলে দর্পণের সামনে দাঁড়াও, ভালো করেই দেখতে পাবে।

মুখে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে তিলক বললে, রাজাবাহাদুর কি বেছে আর পোটো পেলেন না? ঠাকুর—দেবতার মুখ গড়তে যে মানুষের মুখ গড়ে, অমন পোটোকে রাধা গড়তে দিলেন কেন?

কন্দর্প বললে, দিয়ে ভালোই করেছি দেখছি। লোকটার পছন্দের সঙ্গে আমার পছন্দের মিল আছে।

অলকাতিলকা অপাঙ্গে তাকিয়ে বললে, সামান্য একজন প্রজার সঙ্গে রাজাবাহাদুরের পছন্দের মিল আছে, এ কথাটা শুনতে খারাপ।

রূপের ভক্ত সবাই। সেখানে রাজা—প্রজা নেই।—কন্দর্প বললে, ওকে আমি তার পাওনার তিন—গুণ পুরস্কার দিয়েছি।

পোটোর কপাল ভালো!

কিন্তু লোকটা বোধ হয় পাগল।

কিসে বুঝলেন?

সমস্ত টাকা সে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘আমার রাধা আমি গোপীনাথকে দান করেছি, বেচিনি।’

চুপ হয়ে গেল অলকাতিলকা।

কন্দর্প হঠাৎ প্রশ্ন করলে, সুদাম পোটোকে তুমি চিনতে?

চমকে উঠল অলকাতিলকা। অতর্কিতে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, কই, না!

কিন্তু অলকাতিলকা নিজেও বুঝতে পারলে না কেন এ লুকোচুরি। কন্দর্প বললে, আশ্চর্য, তোমাকে চোখে না দেখেও তোমার মুখ সে গড়ল কেমন করে!

অলকাতিলকা হালকা গলায় বললে, পোটোরা কল্পনায় দেখে অমন কত কি গড়ে।

কন্দর্পকান্তি উচ্চচকণ্ঠে হেসে বললে, তা হবে। কেউ কল্পনায় রূপ দেখেই সুখ পায়। সে যেন স্বপ্নে জল খেয়ে তেষ্টা মেটানো! একটু থেমে আবার বললে, আমার তেষ্টা কিন্তু সত্যিকার জল না পেলে মেটে না অলকাতিলকা!

কন্দর্পকান্তির সতৃষ্ণ দৃষ্টি দেবদাসীকে যেন ছুঁয়ে গেল।

.

সেদিন অনেক রাত অবধি ঘুম এল না অলকাতিলকার।

অন্ধকার ঘরে তার মনে হল শয্যার দু’পাশে দুটি পুরুষ এসে দাঁড়িয়েছে। একজন কন্দর্পকান্তি, আরেকজন সুদাম। একজনের দৃষ্টিতে রূপের মাদকতা, আরেকজনের দৃষ্টিতে রূপের বন্দনা। তারই জন্যে একজনের বুকজোড়া তৃষ্ণা, আরেকজনের বুকভরা তৃপ্তি।

একি অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছে সে!

দু’জনেই হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছে। একজন বলছে, ‘এসো, আমি তোমাকে রানি করব!’ অন্যজন বলছে, ‘তুই আমার রাধা!’ কিন্তু অলকাতিলকা জানে কারো ডাকেই সাড়া দেওয়ার উপায় তার নেই। সে যে দেবদাসী—গোপীনাথের পায়ে নিবেদিতা। দেবতার পূজার ফুল কি মানুষের গলার মালা হতে পারে? মানুষের কাছে তার আকাঙ্ক্ষা করতেও নেই, মানুষের আকাঙক্ষা মেটাতেও নেই।

দেবদাসীর এই জীবন!

তবু কেন মনটা কাল থেকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে পিছন পানে? ঘরপালানো ছেলের মতো ছুটে ছুটে যাচ্ছে কখনো সেই হর্তুকি গাছতলায়, কখনো চকমকি নদীর ধারে, কখনো বা পোটো—পাড়ার একটা আটচালার নিচে! যেখানে জংলা সুরে তলদা বাঁশের বাঁশি বাজত, যেখানে খেলনা—হাঁড়িতে ধুলোর ভাত রান্না হত, যেখানে ছিল কথায় কথায় কোঁদল আর কথায় কথায় ভাব!

সত্যি, কি কুঁদলে ছিল সেদিনের তিলক! একদিনের কথা মনে পড়লে এখনো তার হাসি পায়। ছবিটা যেন আজও স্পষ্ট দেখতে পায়।

হর্তুকিতলায় ঘরকন্না সাজিয়ে বসে আছে তিলক। সুদাম আর আসে না। ধুলোর ভাত আর বটফলের তরকারি কখন রান্না হয়ে গেছে! তবু দেখা নেই সুদামের। একা একা অতিষ্ঠ হয়ে তিলক ঘরে চলে যাবে কিনা ভাবছে, এমন সময় জঙ্গলের ওধার থেকে বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়।

সুদাম এসেই গেরেম্ভারি চালে বলে, ভাত বেড়ে দে বউ—ঝট করে দে।

ইঃ, কি আমার কত্তা এল রে! তিন প’র বেলায় এসে বলে, ‘ঝট করে ভাত দে!’ ভাত দেব, না চুলোর পাঁশ দেব!

সুদাম ঘাবড়ে গিয়ে বলে, রাগ করছিস কেন?

নাকের মাকড়ি দুলিয়ে তিলক বলে, কাল যে বললি ‘জুলজুলিয়া পুক’ ধরে দিবি, এনেছিস?

—তাই তো! গতকাল তিলককে সে সত্যিই বলেছিল জঙ্গল থেকে জোনাকি পোকা ধরে এনে দেবে। খেলাঘরে ঝাড়লন্ঠন করবে সে। কিন্তু—কিন্তু হয়ে বলে, ওই যাঃ! ভুলে গেছি।

খেপে যায় তিলক। বলে, ভুলে গেছিস! মিথ্যুক কোথাকার! দিবি নে তাই বল। আচ্ছা, না দিবি তো আমিও ভাত দেব না, যা।

পা দিয়ে ভাত তরকারি ছড়িয়ে দেয় তিলক। সুদামেরও মেজাজ কাঁহাতক ঠিক থাকে? বলে, অত তেজ দেখাসনি বউ!

বেশ করব, দেখাব।

দেখাবি?

হ্যাঁ, দেখাব। টাট্টু ঘোড়ার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বললে তিলক।

আর সহ্য হল না। চুলের ঝুঁটি ধরে দুম করে এক কিল বসিয়ে দিলে সুদাম। কিল খেয়ে কিল চুরি করার পাত্রী নয় তিলক। ঝাঁপিয়ে পড়ে খামচে দিল সুদামের মুখ। তারপর বেশ খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে ভেংচি কেটে বললে, সুদাম না বাদাম! অমন কত্তার মুখ আর দেখব না—দেখব না—দেখব না!

বলেই ছুট।

প্রতিশোধ নিয়েও তিলক কিন্তু ঘরে ফিরে অনেক কান্না কেঁদেছিল। পিঠের ব্যথায় নয়, সুদামকে আর দেখতে পাবে না বলে। কিন্তু অবাক কাণ্ড! রাত পোহাতেই সেই তলদা বাঁশের বংশীধর তার দোরগোড়ায় এসে হাজির। শুয়েছিল তিলক, চট করে চোখ বুজে ফেললে।

সুদাম বললে, ভোর হয়ে গেল, এখনো শুয়ে! বাবা, কি ঘুম রে!

তিলক বললে, ঘুমোইনি তো!

তবে চোখ বুজে আছিস কেন?

আমি যে কাল তিন সত্যি করেছি তোর মুখ আর দেখব না। এখন কি করি?

বলতে বলতে ঠোঁট কেঁপে বোজা চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে এল তিলকের।

হেসে উঠল সুদাম। বললে, তুই তো তিনবার বলেছিস দেখবি না, চারবার বল, ব্যস, তাহলেই পচে যাবে।

তিলক যেন অকূলে কূল পেল। তৎক্ষণাৎ বলে ফেলল, তোর মুখ আর দেখব না।

তারপর একগাল হেসে চোখ মেলে তাকাল।

কিন্তু সেদিন কে জানত সেই শপথ একদা সত্যি হয়ে উঠবে! দেবদাসী হয়ে ইস্তক সুদামের মুখ সে সত্যিই দেখেনি। এক—আধটা বছর নয়, পাঁচ—পাঁচটা বছর। গোপীনাথের সেবা, মন্দিরে নাচ, আর বসন্তবিহারে নির্বাসনের মাঝে সে তো ভুলেই গিয়েছিল সুদামকে, আর সুদামের সঙ্গে সঙ্গে তার পূর্ব জীবনকে!

কিন্তু সুদাম? সুদাম তাকে ভুলে যায়নি। তিলকের মুখখানা সে নিত্য দেখেছে। জেগে জেগে আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। তার প্রমাণ সে এঁকে রেখেছে রাধার মুখে।

আসলে ভোলেনি তিলকও। কিছুই ভোলেনি। তার মনের মধ্যেই এতদিন লুকিয়েছিল সুদাম। জঙ্গলে লুকোচুরি খেলতে খেলতে যেমন হঠাৎ হারিয়ে যেত। অথবা চকমকির জলে হঠাৎ ডুব দিয়ে যেমন তিলকের পা ধরে টানত। তা নইলে এতদিন বাদে চকমকির ঘাটে সুদামকে দেখে একটুও নতুন লাগল না কেন? বরং নতুন মনে হল নিজেকে। কন্দর্পকান্তির দৃষ্টি তাকে বলে দিয়েছে তার রূপ আছে,সে পুরুষকে ভোলাতে পারে। কিন্তু একুশ বছরের জোয়ান সুদামের আবেশভরা দীঘল চোখে চোখ রেখে বুঝতে পারল সে সুন্দর! সে পুরুষের প্রিয়া!

আর, এই কথাটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তিলকের মনে হয়েছে মেয়ে হয়ে জন্মানো তার সার্থক হল।

কাল আবার চকমকির ঘাটে অপেক্ষা করবে সুদাম। তার জন্যে, শুধু তারই জন্যে। ভাবতে কী ভালো লাগছে!

শয্যা ছেড়ে অলকাতিলকা জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। জঙ্গলের মাথায় সাতটি তারা জ্বলজ্বল করছে। ছোটবেলায় সুদাম বলত, ওরা সাত ভাই চাঁপা।

রাত এখনো বাকি। সকাল হতে আর কত দেরি?