শঙ্খচূড় – ৪

চার

জিজ্ঞেস করলাম, অলকাতিলকা কে?

গোকুল বললে, নীলু পণ্ডিতের মেয়ে।

পাহাড়ের কোলে পুবগাঁয়ে চতুষ্পাঠী খুলেছিল নীলকণ্ঠ পণ্ডিত। সারাটা জীবন শাস্ত্রপাঠ আর পুঁথি ঘেঁটেই কাটিয়েছে। সরস্বতীর ভক্ত বলে জীবনে লক্ষ্মীর কৃপা পায়নি। দেড় বিঘে ভুঁই সম্বল, তারই ফসলে অন্ন জুটত পণ্ডিতের। কোনোদিন দু’বেলা, কোনোদিন একবেলা। তবু পণ্ডিত বিদ্যা বেচতো না। ছাত্রদের কাছে গুরুদক্ষিণা চাইতে লজ্জা করত তার। পালে—পার্বণে কেউ কিছু দিত, কেউ বা বিনি কড়িতে পড়তে এসে শাক—ভাতের ভাগও নিয়ে যেত। পণ্ডিতের রাগ হত না, কিন্তু রাগ করত তিলক!

বুড়ো বয়সের মেয়ে তিলক। ওর আগে আরো তিনটি ঘরে এসেছিল, থাকেনি। তিলক সর্বশেষ সন্তান। বড় আদরের। আদর করে নীলু পণ্ডিত মেয়ের নাম রেখেছিল অলকাতিলকা। পাড়ার লোকে ডাকত তিলক বলে।

ফুটফুটে মেয়ে, কাঁচা হলুদবরণ চেহারা, পটে—আঁকা মুখ, নাকে মাকড়ি, পানের গড়ন চিবুকে টোল আর কাজল—বিনা—কালো একজোড়া চোখে ঢলঢলে চাউনি।

তাকিয়ে থাকবার মতো রূপসী মেয়ে তিলক।

পুবগাঁয়ের উত্তরে পোটো—পাড়া। সেখানে সুদামের ঘর। তিলকের নিত্যসাথী সুদাম। শিশুকাল থেকেই। দুজনে ভাবও যত, ঝগড়াও তত। সকাল নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই, যখনই দেখ, দেখবে সুদাম আর তিলক, তিলক আর সুদাম। কখনো চকমকি নদীতে জল ছোড়াছুড়ি করছে, কখনো জঙ্গলের ধারে হর্তুকি গাছতলায় সুদাম বাঁশি বাজাচ্ছে আর তিলক খেলাঘরে ধুলোর ভাত রান্না করছে। কখনো বা সুবলের আটচালায় তিলককে মাটির বেনে—বউ গড়ে দিচ্ছে সুদাম।

মাঝে মাঝে তিলক বায়না ধরে, আমি বাঁশি বাজাব, শিখিয়ে দে—

হেসে সুদাম বলে, ইঃ! বাঁশি বাজাতে হবে না, কাঁসি বাজা।

রেগে যায় তিলক। তলদা বাঁশের পাতলা বাঁশি মড়মড় করে চিবিয়ে ভেঙে দেয়। কখনো বা পছন্দ হয় না বেনে—বউ। বলে, ছাই হয়েছে! নাকে নথ কই, ঝুমকো পাশা কই?

এক আছাড়ে বেনে—বউ পঞ্চত্ব পায়।

রেগে সুদামও যায় শেষ অবধি। তিলকের চুলের ঝুঁটি নেড়ে বলে, বেরো—

টেবো গাল আরো ফুলিয়ে একছুটে চলে যায় তিলক। বলে যায়, জন্মের শোধ আড়ি!

পরদিনই কিন্তু আবার দেখা যায়, চমমকি নদীতে এ ওর গায়ে জল ছুঁড়ছে আর হাসছে খিলখিল করে। নয়তো এ বাজাচ্ছে বাঁশি, আর ও নাচছে চুড়ো—বাঁধা চুলে ফুল গুঁজে।

সুদামের বয়স তখন বারো, আর তিলকের আট।

দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর।

সেবার বর্ষার গোড়ায় নীলকণ্ঠ অসুখে পড়ল। পালা—জ্বর। বর্ষা গেল, শরৎ গেল, শীতও গেল। পড়ুয়া ছাত্ররা ছেড়ে গেল, জ্বর আর ছাড়ে না। দিনও আর চলে না। এই সময় একদিন নীলু পণ্ডিত ঠাহর করে দেখলে, মেয়ে বড় হয়েছে।

ভরা চোদ্দোয় পা দিয়েছে তিলক। ঢেউ কমে এসেছে বটে, কিন্তু থই থই করছে রূপের গাঙ। মাথায় হয়েছে লম্বা, ভারি হয়েছে কাঁকাল, তারই ভারে অলস হয়েছে চলন, ঢলঢলে চোখে কথায় কথায় লজ্জা।

সত্যিই বড় হয়েছে তিলক। ভাবনায় পড়ল নীলু পণ্ডিত। একদিন দু’দিন করে সাতদিন ভাবল। তারপর একদিন কাঁথা মুড়ি দিয়ে মেয়ের হাত ধরে গেল গোপীনাথের মন্দিরে।

মাধবদাস পুরোহিত বললে, পুজো দেবে নাকি পণ্ডিত?

নীলকণ্ঠ বললে, দেব। পুজো দিতেই তো এলাম।

এসো, ফুল—তুলসী নাও।

ফুল—তুলসী কি হবে গোঁসাই?

মাধবদাস বললে, কি নিবেদন করবে তবে ঠাকুরকে?

বড় বিচিত্র হাসি হাসলে নীলকণ্ঠ। বললে, আমার বাগানে একটিই ফুল—এই আমার অলকাতিলকা। গোপীনাথকে তাই নিবেদন করব বলে এসেছি গোসাঁই।

মাধবদাস অবাক হয়ে চেয়ে রইল।

ধুঁকতে ধুঁকতে নীলু পণ্ডিত বললে, আমি আর বাঁচব না গোসাঁই। ডাক এসেছে। তাই তিলককে নিয়েই আমার যত ভাবনা। তিলক বড় হয়েছে, অথচ আমি দরিদ্র, সৎপাত্রের হাতে মেয়েকে দেবার সামর্থ্য নেই। ভেবে—চিন্তে গোপীনাথের দোরেই মেয়েকে আনলাম, এমন সৎপাত্র আর পাব কোথায়? আমার অলকাতিলকাকে তুমি গোপীনাথের দাসী করে দাও গোঁসাই। নইলে মরেও আমার শান্তি হবে না—আমার সোনার প্রতিমা কোথায় ভেসে যাবে কে জানে!

পণ্ডিতের হাড়সার গাল বেয়ে টসটস করে জল গড়িয়ে এল।

মাধবদাস স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিজের মনেই বললে, গোপীনাথের দাসী! তুমি কি মেয়েকে দেবদাসী করতে চাও পণ্ডিত?

নীলকণ্ঠ ঘাড় নাড়লে।

মাধবদাস বললে, দেবদাসী হওয়ার মানে বোঝ? গোপীনাথ আর গুরু ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না। এমনকি, তুমি বাপ, তোমার সঙ্গেও না। মরণকালে মেয়ের হাতের সেবা পাবে না, একফোঁটা জলও নয়।

পাথর হয়ে এতক্ষণ বসে ছিল তিলক। এবার চমকে উঠল।

পলকে মনে পড়ে গেল বাবরি চুলে—ঘেরা সুদামের কালোকোলো মুখখানা।

নীলকণ্ঠ বললে, সেবা না পাই, শান্তি তো পাব!

মাধবদাসের মুখ তবু গম্ভীর। বললে, কিন্তু অলকাতিলকা, তুমি নিজে কি পারবে? বেশ করে ভেবে দেখো মা। নিজের মনকে জিজ্ঞেস করো।

নীলকণ্ঠ তাকাল মেয়ের দিকে।

চোখে জল এসে পড়েছিল, সামলে নিয়ে তিলক কাঁপা গলায় বললে, পারব গোসাঁইঠাকুর। বাবা শান্তি পাক।

গোপীনাথের সামনে বলছ?

বিগ্রহের মুখের দিকে ভরা চোখে তাকাল তিলক। বাঁকা দীঘল চোখে তাকে দেখে ভুবনমোহন হাসি হাসছে গোপীনাথ? মুছে গেল সুদামের মুখ। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলে তিলক, তারপর মুখ তুলে অকম্পিত গলায় বললে, ঠাকুরের সামনেই বলছি।

প্রসন্ন হয়ে উঠল মাধবদাসের মুখ। বললে, কাল শুভদিন। স্নান করে নতুন কাপড় পরে এসো। আমি তোমায় দীক্ষা দেব।

নীলকণ্ঠ জিজ্ঞেস করলে, রাজাবাহাদুরের অনুমতি নিতে হবে না?

এবার হাসলে মাধবদাস। হেসে বললে, গোপীনাথের চেয়ে বড় রাজা আর কে আছে? ঠাকুর অলকাতিলকাকে গ্রহণ করবেন।

.

পরদিন জঙ্গলের ধারে হর্তুকিতলায় সুদাম বাঁশি বাজিয়ে সারা দিনটা কাটিয়ে দিলে! তিলক এল না। সকালেও না, বিকালেও না।

সে তখন মন্দিরের মাধবদাসের কাছে। স্নান সেরে নববস্ত্র পরে শুদ্ধ হয়ে এসেছে তিলক। সারাদিন নির্জলা উপবাস। গোধূলি লগ্নে মাধবদাস প্রথমে গোপীনাথের সঙ্গে তার বিবাহ দিলেন। তারপর দিলেন মন্ত্র। পৈতে আর হর্তুকি দিয়ে তিলক পুরোহিতকে প্রণাম করলে।

সেদিন থেকে গোপীনাথের পরিণীতা হয়ে গেল অলকাতিলকা। মন্দিরের দেবদাসী।

মেয়েকে দেবতার হাতে সম্প্রদান করে নীলু পণ্ডিত একা ঘরে ফিরে গেল। বাপ যে এখন পর! যেতে যেতে যতবার চোখ মোছে, ততবার ভেসে যায়। তবু বড় শান্তি, বড় সোয়াস্তি!

ঘরে ফিরে দেখে অন্ধকার দাওয়ায় ভূতের মতো বসে আছে সুদাম। জিজ্ঞেস করলে, তিলক কই?

নীলকণ্ঠ বললে, স্বামীর ঘর করতে গেছে।

তীরের মতো সিধে হয়ে উঠে দাঁড়াল সুদাম। বললে, বে হয়েছে তিলকের!

সব কথাই খুলে বললে নীলকণ্ঠ।

সুদাম শুধু বললে, তা বেশ করেছ। তারপর চুপচাপ চলে গেল। ঘরে যাবার আগে হাতের বাঁশিটাকে চকমকির জলে ভাসিয়ে দিয়ে গেল।