শঙ্খচূড় – ৩

তিন

এক শতক আগের দেবগড়। তারই জীর্ণ ইতিহাসের কয়েকটি পৃষ্ঠা স্মৃতির ধুলো ঝেড়ে খুলে বসল গোকুলঠাকুর।

গোকুলের ঠাকুরদা মথুর ছিল দেবগড়—রাজার খাস খানসামা। এ কাহিনি ঠাকুরদার মুখে শুনেছিল তার বাবা। বাবার মুখে শুনেছে গোকুল।

খানসামার নাতি গোকুল লেখাপড়া শেখেনি, গল্প বলার আর্ট তার জানবার কথা নয়। তবু সে যা বললে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে গেলাম। তারই বলা গল্পকে কিছু কিছু সাজিয়ে—গুছিয়ে আপনাদের কাছে পেশ করছি।

.

নাটকের যেমন প্রস্তাবনা, তেমনি দেবগড়ের এই রহস্য কাহিনির গোড়ার কথাটুকু বলে নেওয়া দরকার। নইলে বুঝতে অসুবিধা হতে পারে।

দেবগড়ের রাজা তখন রাজাবাহাদুর দিব্যকান্তি মহতাব। এখানকার রাজবংশ ছিল কালীসাধক। কিন্তু দিব্যকান্তি নিজে ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব। গোপীনাথকে একদিন স্বপ্নে দেখে তাঁর ইচ্ছে হল মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। মূর্তি গড়ার জন্য খোঁজ পড়ল সেরা শিল্পীর। সে—সময় সেরা শিল্পী ছিল সুবল পটুয়া। মাটি আর পাথর দুয়েরই মূর্তি গড়ায় ওস্তাদ। দিব্যকান্তি তাকেই ভার দিলেন।

পুরো দেড় বছর ধরে কষ্টিপাথর কুঁদে কুঁদে গোপীনাথের মূর্তি গড়ল সুবল পোটো। সময়ে স্নান নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রামের ছুটি নেই, ঠুকঠুক করে ছেনি—হাতুড়ি চলছে তো চলছেই। সমস্ত চেতনা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে সজাগ দুই চোখের তারায়। চোদ্দ মাসের মাথায় মূর্তি গড়া প্রায় শেষ হয়ে এল। কুচকুচে কালো মানুষপ্রমাণ বিগ্রহ, কি তার লীলায়িত বঙ্কিম ভঙ্গিমা, কি সুঠাম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ! দেখলে মনে হয় পাথরের তৈরি নয়, কালো ননী দিয়ে গড়া!

সবই হয়ে গেল। হাত পা নাক মুখ, অধরে ভুবনমোহন হাসিটি অবধি। বাকি রইল শুধু চোখ দুটি। সুবল ঠাকুরের চক্ষুদানের কাজে হাত দিল। চোদ্দটা মাস ধরে বিগ্রহের দিকে অবিশ্রাম তাকিয়ে থেকে থেকে সুবলের নিজের চোখের দৃষ্টি তখন ক্ষীণ হয়ে আসছে। তবু নিভে—আসা দৃষ্টিপ্রদীপকে বারবার উসকে দিয়ে, সুবল আরো দু’মাস খেটে গোপীনাথের চক্ষুদান করল। মুগ্ধ হয়ে গেলেন রাজা দিব্যকান্তি, বিহ্বল হয়ে গেল সবাই। টানা টানা দীঘল চোখ দুটি যেন জ্যান্ত মানুষের। কি মনোহরণ বাঁকা চাউনি! চোখের তারা দুটি যেন এখুনি নড়ে উঠবে!

চক্ষুদান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুবল নিজে অন্ধ হয়ে গেল। সবাই বললে, গোপীনাথকে নিজের চোখ নিবেদন করেছে সুবল।

গোপীনাথের পাশে রাধামূর্তি গড়া আর হল না। জয়পুর থেকে আনানো শ্বেতপাথরের খণ্ড পড়ে রইল। আরও শিল্পী কি দেবগড়ে ছিল না? ছিল। কিন্তু কেউ ভরসা করলে না সুবল পোটোর গড়া গোপীনাথের পাশে জোড় মিলিয়ে রাধা গড়তে।

সুবলের একমাত্র সন্তান সুদাম তখন বারো বছরের ছেলে।

তবু দেবগড় পাহাড়ের একাংশে বিশাল মন্দির তৈরি হল, আর বহু ঘটা করে সেই মন্দিরে রাধাহীন গোপীনাথের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলেন রাজা দিব্যকান্তি। সে—উৎসব সবাই দেখল, দেখল না শুধু অন্ধ সুবল।

রাজা দিব্যকান্তির বড় ছেলে কন্দর্পকান্তি তখন ষোলো বছরের কিশোর।

গোড়ার কথা এইটুকু।

.

আট বছর বাদে রাজা দিব্যকান্তি মারা গেলেন। মরবার আগে ছেলেকে বলে গেলেন, পারো তো আমার অপূর্ণ বাসনা পূর্ণ কোরো—গোপীনাথের পাশে রাধা প্রতিষ্ঠা করো।

দিব্যকান্তির পর দেবগড়ের রাজা হল কন্দর্পকান্তি। তখন চব্বিশ বছরের যুবক। চেহারাটা ঠিক কন্দর্পের মতো না হলেও সুপুরুষ বলা যায়। লম্বা বলিষ্ঠ দেহ, রঙটা তামাটে। চোখে প্রখর উজ্জ্বলতা। শক্ত চোয়ালে আর ঈষৎ—চাপা নাকে একটা জেদি চরিত্রের ছাপ। রাজকুমার না হয়ে সৈনিক হলেও কন্দর্পকে যেন মানাতো ভালো। এস্টেটের কাজ দেখার চেয়ে দিনরাত ঘোড়ার পিঠে টগবগিয়ে বেড়ানোতেই তার ঝোঁক। রাজবাড়ির জলসাঘরে মিতা শিকারের বদলে জঙ্গলের চিতা শিকারের শখই বেশি। এ হেন কন্দর্পের প্রকৃতিতে বৈষ্ণব ধর্মের ছিটেফোঁটা না থাকলেও বাপের শেষ ইচ্ছা সে ঠেলতে পারল না।

গোপীনাথের পাশে রাধা চাই।

রাজবাড়িতে আবার ডাক পড়ল বুড়ো সুবল পোটোর। ছেলের কাঁধে হাত রেখে লাঠি ঠকঠকিয়ে এল অন্ধ সুবল।

কন্দর্প জিজ্ঞেস করলে, দেবগড়ে তোমার মতো ওস্তাদ কারিগর এখন কেউ আছে সুবল?

সুবল জবাব দিলে, আছে হুজুর। আমার চেয়েও সরেশ হাত।

কে সে?

আমার ছেলে এই সুদাম।

কন্দর্প এবার ভালো করে তাকাল সুদামের পানে। কালোকোলো চেহারা, ঝাঁকড়া বাবরি চুল, চওড়া বুক থেকে নেমে এসেছে সরু কোমর, পাতলা চিকন মুখে গোপীনাথের মতোই টানা টানা দীঘল একজোড়া চোখ যেন আবেশে ঢুলু ঢুলু।

কন্দর্প বললে, এ তো ছেলেমানুষ।

না হুজুর। সুবল বললে, কুড়ি পেরিয়েছে সুদাম।

তোমার গোপীনাথের পাশে মানানসই রাধা গড়তে পারবে তোমার ছেলে?

হাতজোড় করে সুবল নিবেদন করলে, পারবে বইকি হুজুর। নিজের বেটা বলে বাড়িয়ে বলছি না। তবে হুজুর, ছেলেটা আমার আধ—পাগল, খেয়ালি। ওকে সময় দিতে হবে।

বেশ, দিলাম সময়। কন্দর্প বললে, কাজ শুরু করে দাও। সামনের বছর রাধাষ্টমী তিথিতে আমি রাধা প্রতিষ্ঠা করব।

তাই হবে হুজুর। সুবল বললে। তারপর ছেলের কাঁধে হাত রেখে ঘরে যেতে যেতে বললে, বাপের নাম রাখিস বাপ সুদাম। তোর রাধা যেন রূপে আমার গোপীনাথকে টেক্কা দেয়।

বড় কম কথা বলে সুদাম। শুধু বললে, দেখি।

পরদিন থেকেই বাপের ছেন—হাতুড়ি হাতে নিলে সুদাম। জয়পুরি শ্বেতপাথর কুঁদে কুঁদে শুরু হয়ে গেল রাধা গড়া। দিনভর কাজ করে সুদাম, রাতে ঘরের আঙনে বসে বাঁশি বাজায়। কখনো বা মাঝরাতেও তার ঘরে প্রদীপ জ্বলে, শব্দ শোনা যায় ঠুকঠক, ঠুকঠুক।

এক দুই করে আট মাসের মাথায় সুদাম পোটোর রাধা সম্পূর্ণ হল। ছেনি—হাতুড়ি ধরেছিল সেই মাঘ মাসে, ছাড়লে ভাদ্রের গোড়ায়।

না, বাপের নাম রেখেছে সুদাম। রাধা যেন পাথরে গড়া নয়, রক্তমাংসের। বুকে হাত রাখলে বুঝি ধুকপুক শব্দটুকু টের পাওয়া যাবে। আর রূপ? হ্যাঁ, সুবলের গোপীনাথকে টেক্কা দিয়েছে বটে!

 গোরোচনা গোরী নবীনা কিশোরী

 থির বিজরী প্রায়।

 অঙ্গের হিল্লোলে লাবণি উথলে

 অনঙ্গ মূরছা যায়।।

সবার আগে দেখল কন্দর্পকান্তি আর মাধবদাস পুরোহিত। বার বার দেখল। দেখে মুগ্ধ হওয়ার বদলে চমকে উঠল দুজনে।

রাধার মুখে এ কার মুখ বসিয়েছে সুদাম পোটো?

এ মুখ যে অলকাতিলকার!