শঙ্খচূড় – ২

দুই

সকালে চা নিয়ে এলো গোকুলঠাকুর।

জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতে বাঁশি বাজাচ্ছিল কে?

গোকুল বললে, রাতে ঘুম হয়নি বুঝি?

বললাম না। মেয়েছেলে কেউ এখানে থাকে নাকি? ঝুম—ঝুম করে নূপুর বাজছিল, অথচ কাউকে দেখা গেল না।

গোকুলের মুখে উদ্বেগ দেখা গেল। বললে, রাতে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন নাকি?

ঘাড় নাড়লাম।

গোকুলও মাথা নেড়ে বললে, আর বেরোবেন না। চিতেয় ধরবে।

বুঝলাম, গোকুল আমার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম, তুমি বলেছিলে এখানে রাধাদর্শন হবে। শুধু নূপুরই শুনলাম—কই, দর্শন হল না তো?

কালো দাঁতে অমাবস্যার হাসি ছড়িয়ে গোকুল বললে, হবে বৈকি! সবে তো দুদিন এসেছেন। গোপীনাথের দয়া হলেই দর্শন হবে। তবে রাত—বিরেতে ঘর থেকে একা বেরোবেন না যেন।

গোকুল কিচেনে ফিরে গেল। বলে গেল এবেলা মোচার কোপ্তা খাওয়াবে।

খুবই আশার কথা। কিন্তু খেতে বসে এই মুহূর্তে গয়ায় চলে যাব কিনা ভাবতে লাগলাম। গোকুলের তৈরি মোচার কোপ্তা নিয়ে অনায়াসেই পিতৃপুরুষকে পিণ্ডদান করা যায়!

দুপুরে আজ আর ঘুমের চেষ্টা করলাম না। খানিক বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জায়গাটা ঘুরে—ফিরে দেখতে। বেলা তখনো আছে।

ঢালু রাস্তা ধরে নামতে নামতে অনেকটা নিচে নেমে এলাম। পাহাড়ের মাঝামাঝি। রাস্তাটা এখানে দু’—ভাগ হয়েছে। বাঁয়ের রাস্তাটা খাঁজ—কাটা, একসার সিঁড়ির মতো জঙ্গলের মধ্যে নেমে গেছে। যেখানে এসে থেমেছে, সেখানে মস্তবড় একটা ফাঁকা চত্বর। সেই চত্বরে প্রাচীন এক পাথরের মন্দিরের ভগ্নাবশেষ, তারই সামনে নাট—মন্দিরের দু’—তিনটে নকশা—কাটা থাম ইতিহাসের রাজ—দরবারে নির্বাক শাস্ত্রির মতো এখনো দাঁড়িয়ে। ভাঙাচোরা মন্দিরের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি, উঁচু বেদির ওপর মানুষপ্রমাণ শ্রীকৃষ্ণমূর্তি। কষ্টিপাথরে গড়া। পিলসুজে একটি প্রদীপ জ্বলছে, বিগ্রহের গলায় ফুলের মালা। পায়ের কাছে তুলসীপাতা। বোঝা গেল আজো নিয়মিত পূজা হয়।

এই তাহলে গোপীনাথ!

মন্দিরের দরজার সামনে বসলাম। দরজায় ক্ষয়—ধরা একটা বিরাট পাল্লা কাত হয়ে ঝুলছে, আরেকটা নেই। আমি আর্টের ছাত্র নই, তবু চোখে আমার পলক পড়ল না গোপীনাথের রূপ দেখে। কোন শতকে কোন শিল্পী এই মূর্তি গড়েছিল, ইতিহাস তার নাম মনে রেখেছে কিনা জানি না, আমি কিন্তু সেই অজ্ঞাত প্রতিভাকে নমস্কার জানালাম।

একদিন এই মন্দির নিশ্চয় শত দীপে আলো হয়ে উঠত, অগুরু—ধূপের সুগন্ধে ভরে থাকত, ঝুলন পূর্ণিমা দোল পূর্ণিমায় কত উৎসব হত এর নাট—অঙ্গনে। আর, আজ এই মন্দির দিনে অতীতের শ্মশান, রাতে হয়তো পাহাড়ি ময়াল আর চিতাদের আশ্রয়।

কালের চেয়ে দুরন্ত কালাপাহাড় আর কে আছে?

ঝুম—ঝুম, ঝুম—ঝুম, ঝুমুর—ঝুম!

চমকে উঠলাম। এবারে আওয়াজ অত মৃদু সন্ত্রস্ত নয়, অত দূরেও নয়। ধীরে ধীরে নূপুরধ্বনি আরো স্পষ্ট, আরো ছন্দময় হয়ে উঠল। কে যেন খুব কাছাকাছি চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।

না, চলে ফিরে নয়, কে যেন নাচছে! ধ্রুপদী অঙ্গের বিচিত্র ছন্দে, লয়ে, যতিতে। সঙ্গে বাজছে মৃদঙ্গের বোল, তারের ঝঙ্কার, মন্দিরার তাল।

সে কি গোপীনাথের রাধা? না মন্দিরের পেছনে কোনো নর্তকী লুকিয়ে নাচছে?

কিন্তু না, মন্দিরের পিছনে কেউ নেই। চত্বরের আশপাশে জঙ্গলের আড়ালেও কেউ নেই। এদিক ওদিক সেদিক খুঁজে আবার সেই শূন্য নাটমন্দিরে এসে দাঁড়ালাম।

বেলা তখন পড়ন্ত। দিবা আর সন্ধ্যার সেই সন্ধিক্ষণে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের বুকে দাঁড়িয়ে সেই অপার্থিব নূপরধ্বনি শুনতে শুনতে সমস্ত চেতনা আবার যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল।

হঠাৎ পাহাড়ি রাস্তায় খটাখট খটাখট শব্দ হতে লাগল। কঠিন পাথরে ঘোড়ার খুরের শব্দ! এই জনহীন পাহাড়ে কোন ঘোড়সওয়ার যায়? ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে সেই দ্বিধাবিভক্ত রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। পড়ন্ত বেলার মরা আলোয় দেখলাম, হাওয়ায় শুকনো পাতা উড়ছে।

কেউ নেই!

তবে কি সবটাই আমার দিবাস্বপ্ন!

হবেও বা।

.

বসন্তবিহারে যখন ফিরে এলাম, দেবগড় পাহাড়ের আড়ালে তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে বটের ঝুরির মতো নামছে অন্ধকার।

গেট থেকে নজরে পড়ল দ্বিতীয় বাংলো থেকে একটি স্থূলকায় শিম্পাঞ্জি জাতীয় জীব বেরিয়ে আসছে। অস্পষ্ট অন্ধকারেও চিনলাম, রূপবান গোকুলঠাকুর ছাড়া কেউ নয়। কিন্তু সন্ধ্যার ঝোঁকে ওই যাত্রীহীন বাংলোয় গোকুল কেন?

জিজ্ঞেস করলাম, ও—বাংলোটায় লোক এল নাকি?

না হুজুর। ওটায় কেউ আসে না।

তবে ওখানে কি করছিলে?

গোকুল বললে, বাতি জ্বালতে গেছিলাম। কখন তিনি আসবেন, বলা তো যায় না।

তিনি! তিনি কে?

অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে গোকুল জবাব দিল, রাধা ঠাকরুণ।

রাধা ঠাকরুণ! সে আবার কে?

জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে গোকুল বললে, গোপীনাথ জীউর রাধা।

তাজ্জব হয়ে গেলাম। বলে কি! শ্রীকৃষ্ণের রাধাও আমার মতো টুরিস্ট হয়ে বৃন্দাবন থেকে দেবগড়ের বসন্তবিহারে আসেন! নাকে কেমন একটু রহস্যের গন্ধ এসে ঠেকল। মনে পড়ল, প্রথম যেদিন এখানে আসি, আমার সঙ্গে ‘রাধা’ নেই দেখে গোকুল বীতশ্রদ্ধ হয়েছিল। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমার জানতে বাকি নেই যে, এই ধরনের টুরিস্ট লজে বা ডাক—বাংলোয় খানসামারা বকশিশের বিনিময়ে ‘রাধা’ সাপ্লাই করে থাকে। গোকুলঠাকুরও ‘রাধা’র স্টকিস্ট নাকি? আর, ওই দ্বিতীয় বাংলোতেই ওর স্টক থাকে বোধ হয়? তাই রাত দুপুরে বাঁশি বাজিয়ে আর নূপুরের আওয়াজ শুনিয়ে খদ্দেরকে চারে ফেলার চেষ্টা করে।

বললাম, চলো না গোকুল, ও—বাংলোটা দেখে আসি।

গোকুল একটু থতিয়ে গিয়ে বললে, কালই সকালে যিব!

গলায় একটু জোর দিয়ে বললাম, না, এখনই যিব। রাধা ঠাকরুণ যখন আসে, তখন ওটা তো তীর্থস্থান।

গম্ভীর হয়ে গেল গোকুল। চাবিটা আমার হাতে দিয়ে বললে, মু যিব না।

তারপর কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল।

দরজায় গোকুল তালা দিয়ে এসেছে ভাবিনি। কিন্তু তালাটা লোকের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার একটা ধাপ্পাবাজিও হতে পারে। কৌতূহল হল, দেখাই যাক না ভেতরে কি আছে।

ঘর থেকে টর্চ নিয়ে দ্বিতীয় বাংলোতে গিয়ে উঠলাম। তালা খুলে কপাট দুটো ঠেলতেই ক্যাঁচ করে আওয়াজ হল। মনে হল, এ বাংলোটা বহুদিন ব্যবহৃত হয়নি। বাড়িটা প্রথম বাংলোর চেয়ে আকারে ছোট। মেরামতের ফলে এর সমুখটাই আধুনিক হয়েছে, ভেতরে প্রাচীনত্ব বিশেষ বদলায়নি।

দু’খানা ঘর। একখানা অপেক্ষাকৃত বড়। সাদা—কালো পাথরের পদ্ম—কাটা মেঝে, লাল পাথরের দেয়ালে লতাপাতার নকশা। খিলানওয়ালা ছোট ছোট জানলাও আছে, কিন্তু জানালা না বলে তাকে গবাক্ষ বলাই ভালো। সবগুলোই বন্ধ ছিল, খুলে দিলাম। ঘরে পা দিতেই অবরুদ্ধ বাতাসে একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে ঠেকল। আশ্চর্য, একটু বাদেই কিন্তু যে—গন্ধটা পাওয়া গেল, সেটা ভ্যাপসা নয়, অতিক্ষীণ মৃগমদসৌরভ! যেন কোনো বিলাসিনীর কেশের গন্ধ। অনেকদিন আগে শিকারের জন্যে নসিবপুরের রাজবাড়িতে অতিথি হয়েছিলাম। সেখানকার অন্দরমহলে দু’বেলা খেতে যাবার সময় ঠিক এই অপূর্ব কবিরাজি কেশ—তৈলের গন্ধ পেতাম।

পরিচ্ছন্ন ঘর। শামাদানে একটা আধপোড়া মোমবাতি জ্বলছে। তারই আলোয় দেখলাম, ঘরের আরেক পাশে চৌকির ওপর একখানা থালায় একগাছি টাটকা—গাঁথা শিউলির মালা, দু’—খিলি সাজা পান আর এক গেলাস জল রয়েছে।

অথচ গোকুল বললে, এ বাংলোয় কেউ আসে না! আসে নিশ্চয়, তবে প্রকাশ্যে নয়। নইলে কার জন্যে বাতি জ্বালা? কার জন্যেই বা পুষ্পমালা, তাম্বুল আর জল?

দেখতে হবে কে সেই নেপথ্যচারিণী, যে অলক্ষ্যে এই বসন্তবিহারে বিহার করতে আসে? গোকুলেরই বা এত লুকোচুরির হেতু কি? আমি লম্পট না হতে পারি, কিন্তু ভীষ্মদেব তো নই!

অপর ঘরে গেলাম। অপরিচ্ছন্ন, অন্ধকার। গোটা কয়েক চামচিকে ঝটপট করে উঠল। সেখান থেকে দালান, বারান্দা, স্নানের ঘর, রসুই—ঘর, উঠোন।

কেউ কোথাও নেই! এখনো আসেনি। হয়তো রাত বাড়লে চুপিচুপি আসবে।

সদরে তালা দিয়ে চলে এলাম। মতলব করলাম, চাবিটা গোকুল না চাইলে আজ আর দেব না।

.

আজ রাতের স্পেশাল ডিশ পুডিং।

গোকুল জানালে, তার হাতের কাস্টার্ড পুডিং খেয়ে একবার সাহেব তাকে বিলেত নিয়ে যেতে চেয়েছিল। শুনে উৎফুল্ল হলাম। কিন্তু হায়, আমার কপালে পুডিং হয়ে দাঁড়াল প্রায় বেগুনের ভর্তা!

গোকুলের ভাগ্য ভালো যে, সাহেবের সঙ্গে বিলেত যায়নি। গেলে সাহেব তাকে নির্ঘাত ইংলিশ চ্যানেলের জলে ফেলে দিত।

যাই হোক, শুধু মুরগির শুক্তো দিয়েই ডিনার সমাপ্ত করা গেল। তারপর ঘরে নয়, বারান্দায় বেতের চেয়ারে সিগারেট ধরিয়ে বসলাম। বারান্দায় আবছায়া অন্ধকার। আজ আর ঘুম—পরিকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছি না।

গোকুল এসে শুধোলে, ঘরে শুতে যাবেন না?

বললাম, ঘুম পেলে যাব। তুমি শুয়ে পড়োগে।

গোকুল গেল না। আমতা আমতা করে বললে, সেপাকু জঙ্গল অছি পরা—চিতে অছি।

হাতের টর্চ আর পাশে রাখা দোনলা বন্দুকটা দেখালাম। আমি শিকারি, অরণ্যবাসী কোন শ্বাপদ আমার কুশল জানতে এলে তার অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেই রাখি।

আমার বাইরে থাকাটা তবু গোকুলের মনঃপূত হল না। বললে, কেতে কালিনাগ শঙ্কচূড় অছি!

বললাম, আমিও সাপের ওঝা অছি।

গোকুল এবার আস্তে আস্তে চলে গেল। মনে হল, ও আমাকে ভয় দেখিয়ে ঘরে পাঠাবার মতলবেই এসেছিল। আমি বাইরে থাকলে ওরই যেন বিশেষ অসুবিধা। এমন ধোয়া—মোছা উঁচু বারান্দায় সাপের আসার সম্ভাবনা যদিচ কম, তবুও পা দুটো চেয়ারে তুলেই বসলাম।

বারান্দার যেখানটায় বসলাম, সেখান থেকে দ্বিতীয় বাংলোটা সোজা নজরে পড়ে। সেদিকে চোখের পাহারা রেখে চুপচাপ সিগারেট ফুঁকতে লাগলাম। দেখি, নেপথ্যচারিণী রাধা কখন দ্বিতীয় বাংলোয় রসকেলি করতে আসে! আর, দেখি শ্যামচাঁদটিই বা কে—গোকুলঠাকুর স্বয়ং, না আর কোনো রসিকজন? চাবিটা যদিচ আবার পকেটে, তবু ডুপ্লিকেট কি থাকতে পারে না?

পেঙ্গুইন সিরিজের গোয়েন্দা যেন আমার কাঁধে ভর করল। সজাগ গোয়েন্দার মতো জেগে থাকতে থাকতে সিগারেটের প্যাকেট ফুরিয়ে এল। হাতঘড়ির রেডিয়াম—ডায়ালে ছোট কাঁটাটা দশটার ঘর থেকে একটার ঘরে এসে পৌঁছাল।

কিন্তু কোথায় কে!

ঝিমঝিমে চাঁদনি রাত। চারদিক নিশুতি। মাঝে মাঝে শুধু অরণ্য বিকারগ্রস্ত রোগীর মতো এলোমেলো কথা কয়ে উঠছে। কখনো শুকনো পাতার ফিসফিস মর্মরে, কখনো চিতা—হায়েনার ক্রুদ্ধ আস্ফালনে, কখনো বা রাতচরা পাখির কর্কশ কাতরানিতে প্রলাপ বকছে অরণ্য।

বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখের পাতা জুড়ে এসেছিল, টের পাইনি। তন্দ্রা ছুটে গেল বাঁশির আওয়াজে। সেই অলৌকিক বাঁশি, আর সেই আশ্চর্য সুর! সোজা হয়ে চেয়ারে বসলাম। একটু বাদেই নূপুরধ্বনি শোনা গেল, ঝুম—ঝুম, ঝুম—ঝুম, ঝুমুর—ঝুম!

চেয়ে দেখি, কৃষ্ণা চতুর্থীর ভাঙা চাঁদ পশ্চিমে হেলে পড়েছে। কিন্তু শেষ—রাতের আকাশে এ কী অদ্ভুত আলো! মার্কারি ল্যাম্পের আলো নয়, অথচ তেমনিধারা স্নিগ্ধ নীলচে দ্যুতি। সেই অপার্থিব ছটায় দেবগড় পাহাড়ে এক আশ্চর্য মায়া—জগৎ তৈরি হয়েছে।

দ্বিতীয় বাংলোর দিকে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টি আমার স্থির হয়ে গেল। পলক ফেলতে ভুলে গেলাম। অতি সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে একটি মেয়ে নেমে আসছে। আর ভীরু পায়ের নূপুর বাজছে ঝুমঝুম ঝুমর—ঝুম! মেয়েটি যুবতী। সুঠাম দেহ। পরনে গাঢ়—নীল শাড়ি, দেহের ঊর্ধ্বাংশ পাতলা কালো ওড়নায় ঢাকা। শুধু বেরিয়ে আছে মুখখানি আর মণিবন্ধ পর্যন্ত দুটি করতল। সেই অনৈসর্গিক নীলাভ আলোয় গৌরবর্ণ মুখখানি নীরক্ত পাণ্ডুর দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখ মুখ নাক যেন তুলি দিয়ে আঁকা। বড় বড় দীর্ঘপল্লব চোখ দুটিতে সন্ত্রস্ত চাহনি। টিকালো নাকে সোনার বেসর। আঙুলের রত্নাঙ্গুরী আর মণিবন্ধের মণিময় কঙ্কণ ঝিলিক দিয়ে উঠছে।

কে এই রূপসী যুবতী? কোথা থেকে এল, কোথায় যাচ্ছে? ওই যাদু—ভরা বাঁশি কি একেই ডাকছে? এই কি গোকুলঠাকুরের রাধা? রাধাই বটে! গোকুলের রুচি আছে বলতে হবে। এমন রাধার জন্যে সমরখন্দ বোখারা না হোক, সমগ্র উড়িষ্যা বিলিয়ে দেওয়া যায়।

মেয়েটি আলগোছে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসছে। বারান্দা থেকে বাংলোর হাতায়। আমি সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখছি।

কাছে আসছে মেয়েটি। আরো কাছে। আমার বারান্দার পাশ দিয়ে যাচ্ছে নিলাজ নূপুরকে শাসন করতে করতে।

চকিতে হাতের টর্চ টিপে বললাম, কে?

সাত ব্যাটারির হান্টিং টর্চের উজ্জ্বল আলোয় দিন হয়ে গেল বাংলোর হাতার একটা অংশ।

কিন্তু কই সে রূপসী রাধা? তীব্র উজ্জ্বল আলোর ঝলকে যেন মোমের পুতুলের মতো নিমেষে গলে মিশিয়ে গেল সে! বাঁ হাতে চোখ দুটো মুছে দেখলাম। টর্চের রশ্মি সারা হাতায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম।

কোথাও নেই! মেয়েটি কোথাও নেই!

বোকা বনে গেলাম। এক লহমার মধ্যে কোথায় চলে গেল সে? নাকি হাওয়ায় উবে গেল।

কিন্তু টর্চ নিভিয়ে দিতেই আবার সেই ঝুম—ঝুম, ঝুম—ঝুম, ঝুমুর—ঝুম! চমকে তাকিয়ে দেখি, না, যায়নি, ফটকের দিকে ওই তো চলেছে চতুরা রাধা! আমি টর্চের বোতাম টিপবার সঙ্গে সঙ্গেই ও বোধহয় আলোর সীমানার বাইরে চকিতে গা—ঢাকা দিয়েছিল। অথবা পাঁচিলের অন্ধকার কোণে।

আবার সেই অপার্থিব মৃদু নীলাভ আলোর ছটা! সেই আলোয় স্পষ্ট দেখলাম মেয়েটি চলে যাচ্ছে। সেই ঘন নীল শাড়ি, সেই কালো ওড়না, মেখলা—পরা সেই গুরু নিতম্বের মন্থর ছন্দ!

পাহাড়ি পথ বেয়ে বাঁশি ক্রমশ এগিয়ে আসছে ফটকের কাছে, আর নিতম্বিনীও চলেছে ফটকের দিকে এগিয়ে ঝুম—ঝুম, ঝুমুর—ঝুম।

পা টিপে টিপে অন্ধকারেই ওর অনুসরণ করলাম। বারান্দায় বন্দুকটা ফেলে যেতে ইচ্ছা হল না, তুলে নিলাম হাতে।

ফটকের ফাঁক দিয়ে সোজা রাস্তাটা দেখা যায়। ঢালু হয়ে নেমে গেছে। দেখা গেল, আবছায়া অন্ধকারে একটি ছায়ামূর্তি উঠে আসছে। মাথার বাবরি চুলের গুচ্ছ আর সরু কোমর দেখে আন্দাজ করা যায় সে তরুণ।

মেয়েটি একবার থমকে দাঁড়াল, তারপর ফটক পার হয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল। নিলাজ নূপুর লজ্জা—ভয় ভুলে এবার প্রগলভার মতো হেসে উঠল ঝুম—ঝুম, ঝুম—ঝুম!

দেবগড়ে এসেছি শিকারের উদ্দেশ্যে, কিন্তু কে জানত এই জংলা পাহাড়ে এমন একটা গুপ্ত প্রণয়—নাট্যের দর্শকের ভূমিকা কপালে জুটবে! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।

মেয়েটি প্রায় ছুটে চলেছে।

বাঁশুরিয়া এগিয়ে চলেছে।

মাত্র হাত কয়েক ব্যবধান, এমন সময় ঘোড়ার খুরের খটাখট খটাখট শব্দে পাহাড়ি রাস্তা গমগম করে উঠল।

ছায়াবাজির মতো পলকে মিলিয়ে গেল দুটো ছায়ামূর্তি! জনহীন পাহাড়ি—পথের পাথরে পাথরে শুধু বাজতে লাগল ধাবমান অশ্বখুরের কঠিন শব্দ—খটাখট খটাখট খটাখট!

আর, সেই সঙ্গে রঙ্গিনীর দিক থেকে শোনা গেল নারী—কণ্ঠের সেই ভয়ার্ত সকরুণ চিৎকার, সুদা—আ—আ—ম!

নিথর রাত্রি শিউরে উঠল। কোথায় যেন ককিয়ে উঠল একটা কালপ্যাঁচা। শাখায় শাখায় হাহাকার তুলে অস্থির হয়ে উঠল ভয়াল অরণ্য। নির্জন পাহাড়ে সেই অলৌকিক পরিবেশের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিল। সব যেন ওলোট—পালোট হয়ে গেল মাথার মধ্যে। ঝরর্ণার দিকে হাতের বন্দুকটা তুলে পাগলের মতো পরপর দুটো ফায়ার করলাম।

ঢালু রাস্তায় নেমে যেতে লাগল ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। ক্রমশ দূরে। আর তারই সঙ্গে পুরুষ—গলার বিশ্রী কর্কশ হাসি হা—হা—হা—হা!

সেদিকে বন্দুকের মুখ ফিরিয়ে আবার ফায়ার করতে যাচ্ছিলাম, একখানা রোমশ শক্ত হাত আমার হাতখানা চেপে ধরল।

হুজুর! হুজুর!

সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি গোকুলঠাকুর। বন্দুকের আওয়াজে ছুটে এসেছে।

ঘরে চলুন হুজুর। গোকুল বললে।

রাত তখন শেষ। পুবদিক ফরসা হয়ে আসছে।

বললাম, ওরা কারা এসেছিল? ওই বাঁশিওয়ালা, ঘোড়সওয়ার আর ওই নূপুর—পায়ে মেয়েটি—ওরা কারা?

গোকুল সে—কথার জবাব দিলে না। শুধু বললে, রাতে আপনাকে বাইরে বেরোতে মানা করেছিলাম, কেন বেরোলেন? ঘরে চলুন।

বললাম, আগে বলো ওরা কারা?

গোকুল নির্বাক হয়ে গেল।

আবার বললাম, এ বাড়ি এখন সরকারি বাংলো। সরকারি চাকরি করো তুমি। সত্যি কথা না বললে আমি রিপোর্ট করে দেব গোকুল, জানিয়ে দেব যে রাত হলে ওই বাংলোটায় মেয়েছেলে আমদানি হয়।

গোকুল এবার কাঁদো—কাঁদো হয়ে বললে, মহাপ্রভুর দিব্যি, উনি মানুষ নন হুজুর, গোপীনাথের রাধা।

কড়া গলায় বললাম, চালাকি পেয়েছ? গোপীনাথের রাধা এখানে আসবে কেন? তোমার হাতের রান্না খেতে?

গোকুল বললে, চাবিটা সঙ্গে আছে? আসে কিনা দেখবেন আসুন।

গোকুল আমাকে নিয়ে গেলে দ্বিতীয় বাংলোয়। সেখানে আরেকটা রোমাঞ্চকর বিস্ময় আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। দরজা খুলে বড় ঘরে ঢুকলাম। খোলা দরজা দিয়ে উষার আলো এসে পড়েছে। দেখলাম, গেলাসের জল অর্ধেক, পানের একটা খিলি নেই, শিউলিফুলের মালা জানলার ধারে পড়ে। আর—

পদ্ম—কাটা মার্বেলের মেঝের ওপর আলতা—পরা পায়ের কয়েকটি ছাপ! যেন লক্ষ্মীর পায়ের আলপনা!

গোকুল বললে, দেখুন, চাবি তো সারারাত আপনার কাছেই ছিল। দোর বন্ধ থাকলে মানুষ কি ঢুকতে পারে?

বললাম, পারে বইকি। চাবির নকল থাকলেই ঢুকতে পারে?

গলায় জোর দিয়ে গোকুল বললে, বিশ্বাস করুন হুজুর, চাবির নকল নেই। নিচের বস্তিতে আমার বেটা থাকে, আমি তার মাথায় হাত দিয়ে বলতে পারি।

গোকুলের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল। ছেলের নামে শপথ করে কোনো বাপই মিথ্যে বলতে পারে না। ওর মুখ দেখে বুঝলাম, গোকুলও মিথ্যে কথা বলছে না। কিন্তু ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে রোমাঞ্চে আমি হতবাক হয়ে গেলাম কিছুক্ষণ।

তারপর জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে ওই বাঁশিওয়ালা কে? ওই কি গোপীনাথ?

না, ও সুদাম। সুবল পোটোর ছেলে।

তবে রাধা কি গোপীনাথকে ছেড়ে সুদামের সঙ্গেই দেখা করতে আসে?

তাই আসে হুজুর। রোজ আসে। যারা রাতে ঘুমিয়ে থাকে, তারা কিছু শুনতেও পায় না, দেখতেও পায় না। যাদের ঘুম হয় না, তারা ভয় পেয়ে পরদিনই বাংলো ছেড়ে পালিয়ে যায়।

খুবই স্বাভাবিক। এই ভূতুড়ে জংলা পাহাড়ের মাথায় নিশুত রাতে রাধাদর্শনের শখ ক’জনের থাকে? জিজ্ঞেস করলাম, মাঝে মাঝে ‘সুদাম’ বলে কে কেঁদে ওঠে? রাধা?

গোকুল বললে, সারাটা রাত জেগেছেন, আগে নেয়ে—খেয়ে জিরিয়ে নিন হুজুর। তারপর বলব ‘খন—গোড়া থেকে সব বলব।