শঙ্খচূড় – ১০

দশ

গামছার খুঁটে চোখ মুছে গোকুল ঠাকুর নীরবে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললে, বিশ্বেস করুন আর নাই করুন হুজুর, দেবদাসীই গোপীনাথের রাধা ছিল। তা নইলে সে মরবার পর সেই ফুটফুটে চাঁদের রাতে খামোকা ঝড় উঠল কেন? আর বাজ পড়ে রাধাই বা আটফাটা হল কেন বলুন?

বলবার কী বা আছে! গোকুলের বিশ্বাসকে সংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে পারি, কিন্তু ইতিহাসকে মিথ্যে প্রমাণ করব, এমন অকাট্য যুক্তি কই?

গোকুল বললে, সাধ মেটেনি, তাই রাত যখন ভারি হয়, ওরা এখনো আসে—গোপীনাথের রাধা আর সুদাম পোটো। দু’জনা দু’জনকে ছেড়ে থাকতে পারে না কিনা। একটা কথা বলব হুজুর? রাত—বিরেতে রাজাহুজুরের মতোন আর বন্দুক চালাবেন না, ওরা ভয় পায়।

বললাম, বন্দুক চালাবার সুযোগও আর পাব না গোকুল। তোমারও গল্প শেষ হল, আমারও এখানে থাকার মেয়াদ ফুরোল।

গোকুল বললে, গল্পতো আমার শেষ হয়নি হুজুর, একটু বাকি আছে। রাতে খাওয়া—দাওয়া চুকলে বলব’খন। ও—বেলা হরিয়াল পাখির রোস্ট খাওয়াব আজ্ঞে।

বললাম, তা খাইও। কিন্তু গল্পের বাকিটুকু এখনই শুনিয়ে দাও।

শুনুন তবে।

.

সে—রাতের পর থেকে কেতু যেন কেমন হয়ে গেল। পালকি বয় না, রাজবাড়ি যায় না। ঘরেও না বড় একটা। গালে খোঁচা—খোঁচা দাড়ি, বাবরি চুলে আর পাট নেই।

তাকে দেখা যায় কোনোদিন রঙ্গিনী ঝর্ণার পাশে সেই পাথরটায় বসে আছে, যেখানে বসেছিল সুদাম আর তিলক। কোনোদিন বা দেখা যায় নিঝুম দুপুরে চকমকির ঘাটে। রাজাবাহাদুর ডেকে পাঠিয়েছিল, যায়নি।

কেবলই ভাবে। কি যে ভাবে, সেই জানে। হয়তো ভাবে বড় দেরি হয়ে গেল! সে—রাতে কেতু যদি গেল, একটু আগে গেল না কেন? সে আর কিছু পারুক আর নাই পারুক, বন্দুকের গুলিটা নিজে বুক পেতে নিতে পারত! চোরের মতো মারলে কেন ওদের রাজাহুজুর? তুমি রাজা বলে? তোমার দামি বন্দুকে টোটা ভরা থাকে বলে? কিন্তু ওদের মেরে তুমিই কি জিতলে? ওরা জোড় বেঁধে দুনিয়ায় এসেছিল, জোড় বেঁধেই চলে গেল! ওদের জোড়া তো ভাঙতে পারলে না!

নুলো হাতখানা দিয়ে বারবার চোখ মোছে কেতু। আর, একটা মাত্র চোখ ধক ধক করে জ্বলে ওঠে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, আছে, আছে, মা রক্তখাগীর দুনিয়ায় এখনো বিচার আছে! দু’দিন সবুর করো!

একদিন বসে আছে চকমকির ঘাটে, জঙ্গলের ভেতর থেকে বাঁশির আওয়াজ এল। চমকে উঠল কেতু।

না, তলদা বাঁশের বাঁশি নয়, তুবড়ি বাঁশি। কাঁধের বাঁকে বেতের ঝাঁপি ঝুলিয়ে একজন সাপুড়ে চলেছে জঙ্গলের পথ দিয়ে। বিদেশি লোক, গেরুয়া আলখাল্লা পরনে, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, হাতে লোহার বালা।

কি যে খেয়াল হল কেতুর, লোকটার পিছু নিলে। জিজ্ঞস করলে, এ—দেশে কেন গো গুণিন?

লোকটা বললে, শুনেছি দেওগড়ের জঙ্গলে শঙ্খচূড় সাপ মেলে। তাই ধরতে এসেছি।

বলো কি! শাঁখচুড়ো ধরতে পারো তুমি! ওস্তাদ গুণিন বটে! আমায় ধরে দেবে একটা? ট্যাকা দেব।

কেতু ট্যাঁক থেকে গোটা কয়েক টাকা বের করলে।

লোকটা বললে, কি করবে সাপ নিয়ে?

দুধ—কলা দিয়ে পুষব গো!

সেই দাঁতালো হাসিটি হাসলে কেতু।

ওষুধ আছে?

ওষুধ লাগবে না। আমি তো আর সাপ খেলাব না তোমার মতন।

লোকটা বললে, ও সাপ হল রাজা সাপ। একবার যদি তোমার গন্ধ পায়, তবে তুমি নজরের বাইরে থাকলেও খুঁজে খুঁজে এসে ঠিক চোট করবে। খুব হুঁশিয়ার!

চাপা উল্লাসে কেতু যেন ফেটে পড়ল। বললে, বলিহারি আজব তামাসা! তবে তো আমার একটা চাই—ই ওস্তাদ!

সবগুলো টাকা লোকটার হাতে গুঁজে দিলে কেতু।

.

দাবায় বসেছে কন্দর্পকান্তি। একাই খেলছে। দিবানিদ্রার পর তবু খানিকটা সময় কাটে।

চৈত্রের দুপুর ঝাঁ ঝাঁ করহে। বৈঠকখানায় অনেক দিন বাদে কেতু এসে হাজির।

নিজের চালে নিজেই মাত হয়ে যাচ্ছেন নাকি হুজুর?

কন্দর্প মুখ না তুলেই বললে, তেমন খেলোয়াড় আমি নই।

তা বইকি আজ্ঞে। তবে কি জানেন, কে কখন মাত হয়, কে বলতে পারে বলুন?

কোথায় ছিলি এতদিন? কন্দর্প জিজ্ঞেস করলে।

কোথায় আর থাকব আজ্ঞে, আপনার চরণের তলায়।

ডেকে পাঠিয়েছিলাম, আসিসনি কেন?

দেহটা বেজুত হয়েছে রাজাহুজুর, তাই আসতে পারিনি।

আজ কি মনে করে?

ছুটি চাইতে আজ্ঞে।

ছুটি! দাবার ছক থেকে মুখ তুলে তাকাল কন্দর্প। বললে, কত দিনের?

একেবারে হুজুর। বয়েস তো কম হল না।

কেতুর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিলে কন্দর্প। এই ক’দিনে মানুষটা সত্যিই বুড়ো হয়ে পড়েছে। গুলি পাকানো মিশকালো চেহারায় সেই তেল—চকচকে ভাব আর নেই। মুফে দাড়ি, বাবরি চুলে জট।

কন্দর্প বললে, তোকে নিয়ে ময়ূরভঞ্জের জঙ্গলে শিকারে বেরোব ভাবছিলাম, তুই ছুটি চাইতে এলি?

কত রকম শিকারই তো করলেন রাজাহুজুর! আর কেন?

শিকারের মজা কি ছাড়া যায় রে?

কেমন একটা খাপছাড়া হাসি হেসে কেতু বললে, তা বটে। বন্দুকের নেশা বড় নেশা।

ছ্যাঁৎ করে উঠল কন্দর্পের মনটা। কপালে সন্দেহের রেখা পড়ল। বললে, তার মানে?

মুখ্যু চাষার কথার কি মানে হয় হুজুর? আমায় ছুটি দিতে আজ্ঞা হোক। বিদেশ যাব মন করেছি।

মন করেছিস তো যা। কন্দর্প আবার দাবায় চোখ দিলে।

কেতু গেল না। উসখুস করতে লাগল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বললে, একটা নিবেদন আছে রাজাহুজুর।

কি? কিছু টাকা চাই?

আমি একা মানুষ, টাকা কি হবে আজ্ঞে? হুজুরের একটি জামা যদি পায়ে করে দেন তো পরে বাঁচি। নতুন চাইনে, আপনার পরা জামা হলেই চলবে।

বাড়ির খানসামাকে ডেকে মলমলের একটা পিরান অনতে হুকুম দিলে কন্দর্প।

মাথা চুলকে হেতু সবিনয়ে বললে, হুজুরের গোলাপি আতর এক ফোঁটা মাখিয়ে দিতে বলবেন আজ্ঞে!

হেসে উঠল কন্দর্পকান্তি। বললে, বুড়ো বয়সে শখ তো খুব দেখছি! আচ্ছা, তাই হবে।

.

আতর—মাখা মলমলের পিরান নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল কেতু। রাজাহুজুরের মেজাজটা আজ খুশ। এত সহজে কাজ হয়ে যাবে ভাবা যায়নি।

ঘরের এককোণে রশি—বাঁধা সরা—ঢাকা একটা তিজেল হাঁড়ি। তারই পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসল কেতু। হাঁড়ির গায়ে একটা টোকা দিতেই ভেতরে ক্রুদ্ধ নিশ্বাসের ঝড় বইতে লাগল।

কেতু আনন্দে বলে উঠল, বা বেটা বা! খুব তেজ হয়েছে দেখছি! খিদে পেয়েছে? ব্যাং খাবি? ইঁদুর? দুধ? দেব, দেব! সবুর কর!

রশির বাঁধন খুলে ফেললে কেতু। সরাখানা সামান্য একটু সরিয়ে মলমলের পিরানটা হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে। তারপর আবার দাড়ি দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে বললে, এখন নয়, আরো সাতদিন উপোসী থাক, আরো তেজ বাড়ুক, তখন খেতে দেব!

.

কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী। অন্ধকারে কোলের মানুষ চেনা যায় না।

চৈত্রের গুমোটে রাত যেন নিশ্বাস রোধ করে আছে।

মিশকালো একটা মূর্তি বুনো জন্তুর মতো নিঃশব্দে রাজবাড়ির পাঁচিল টপকাল। হাতে তার খড়—পাকানো একগাছা রশি, আলগোছে টানতেই উঠে এল কাপড়ের একটা পুঁটলি।

বৈঠকখানায় আলো জ্বলছে।

পুঁটলিটা হাতে নিয়ে মূর্তিটা বনবেড়ালের মতো পা টিপে টিপে এগোল সেদিকে। খোলা জানলার ধারে এসে দাঁড়াল। একটা মাত্র চোখ লাল আঙারের মতো জ্বলছে। রশির গেরো খুলে কাপড়টা সরাতে দেখা গেল পুঁটলি নয়, সেই সরা—ঢাকা তিজেল হাঁড়ি, ভেতরে একটা জ্যান্ত আক্রোশ চাপা নিষ্ঠুরতায় ফুঁসছে!

খোলা জানলার ঠিক নিচেই হাঁড়িটা রেখে একবার হাত বুলোলে কেতু। হিসহিস স্বরে বললে, বড্ড খিদে, না রে? যা, খা গে যা!

সরাখানা নিমেষে টেনে নিয়ে বাগানের অন্ধকারে মিশিয়ে গেল কেতু।

আর, ফোঁস করে সোজা হয়ে উঠল এক বন্য শঙ্খচূড়। জানলা বরাবর ফণা তুলে। তারপর লতার মতো লতিয়ে লতিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

.

কমলা রঙের পানীয়টায় আজ নেশা তেমন জমছে না।

নেশার জন্যে নেশা করত না কন্দর্পকান্তি। করত শরীরটাকে চাঙ্গা করতে। ইদানীং মাত্রাটা বেড়ে গেছে। না বাড়িয়ে উপায় কি? সন্ধে হলেই সেই এক চিন্তা। অলকাতিলকা!

কী না করেছিল কন্দর্প তার জন্যে! আরো কী না করতে পারত! দেবগড়ের রানি করতে চেয়েছিল। শুনল না মেয়েটা, লুকিয়ে একটা পোটোর ছেলের সঙ্গে পালাবার ফন্দির করলে!

বেইমান! দু’জনকেই শেষ করে দেবার মতলব করেছিল কন্দর্প। ভালোই হল, একটার বেশি খুন করতে হল না। বেঁচে গেল বন্দুকের একটা টোটা! গোলাপি আতরে আজ কাঁচা রক্তের গন্ধ!

কিন্তু রূপ ছিল বটে অলকাতিলকার। আগুন—জ্বালানো রূপ! সে—আগুন কমলা রঙের পানীয় ঢেলেও নিভছে না।

চ্যাপ্টা বোতল থেকে কন্দর্প আবার গেলাসে ঢালতে যাবে, এমন সময় ঠিক পিছনেই কার ক্রুদ্ধ নিশ্বাস ফুঁসে উঠল!

চকিতে মুখ ফেরাল কন্দর্প।

মাত্র হাত দশেক তফাতে কালান্তক যমের মতো এক শঙ্খচূড় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে! লাল চুনির মতো রক্তচক্ষু থেকে নিষ্ঠুরতা ঠিকরে পড়ছে। লকলক করছে চেরা জিভ। যেন বলছে, ‘চিনেছি! গোলাপি আতরের নিশানায় ঠিক চিনেছি তোমায়!’

কন্দর্পের হাত কেঁপে ছলকে পড়ে গেল কমলা রঙের পানীয়। দেহের পেশী শক্ত হয়ে উঠল আতঙ্কে। মুখ থেকে সমস্ত রক্ত কে যেন নিংড়ে শুষে নিলে!

কন্দর্প জানে, বুনো হাতি, খ্যাপা চিতা—এদের তবু ঠেকানো যায়, কিন্তু নাগরাজ শঙ্খচূড়ের হাত থেকে পার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু পাকা শিকারি সে, এলিয়ে—আসা স্নায়ুগুলোকে ঠিক রাখার চেষ্টা করলে। একবার তাকিয়ে দেখলে, দক্ষিণের দেয়ালের কোণে ঠেসিয়ে—রাখা ওই তার দোনলা বন্দুক! কিন্তু আনতে যাবে কেমন করে? মাঝখানে পথ আগলে রয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যু—শঙ্খচূড়!

পালাবার রাস্তা নেই! দুটো দরজা বন্ধ, খোলা জানলাটা নাগরাজের পাশে।

শঙ্খচূড়ের চোখে চোখ রেখে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কন্দর্প। বিনবিন করে ঘাম দেখা দিয়েছে তার সারা মুখে। সেকেলে দেয়ালঘড়ির দোলকটা ঘরের স্তব্ধতার বুকে একটানা হাতুড়ি পিটতে লাগল টক—টক টক—টক টক—টক।

হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল টোটা—ভরা ছ’ঘরা পিস্তলটা রয়েছে দেরাজের ওপর। আর দেরাজটা আছে উত্তরের দেয়াল ঘেঁষে, কয়েক হাত পেছনে।

সাপের চোখে চোখ রেখে পিছু হটতে লাগল কন্দর্প। পরাস্ত যোদ্ধার মতো এক—পা এক—পা করে।

শঙ্খচূড়ও চতুর কম নয়। সেও এগিয়ে আসতে লাগল এঁকেবেঁকে। হাতের শিকারকে সে নাগালের বাইরে যেতে দিতে নারাজ। আরো তীব্র আক্রোশে সে ফুঁসছে। আরো চওড়া হয়ে উঠেছে তার ফণা! আরো ঘনঘন লকলক করছে তার চেরা জিভ!

এক পা, দু’ পা, তিন পা—পিছু হটছে কন্দর্প।

হিলহিল করে সামনে এগোচ্ছে নাগরাজ।

দেরাজের কাছাকাছি এসে কন্দর্প ছোঁ মেরে তুলে নিলে পিস্তলটা। আর সেই মুহূর্তে লেজের ডগার ওপর ভর দিয়ে কন্দর্পের কপালে বিষ—চুম্বন দিলে বিষধর শঙ্খচূড়!

অসহ্য জ্বালায় জ্বলে গেল কন্দর্পের সর্বাঙ্গ। তবু টলে পড়বার আগে শেষ শক্তি দিয়ে পিস্তলের ঘোড়া টিপল সে।

অব্যর্থ টিপ! বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে থেঁতলে গেল প্রকাণ্ড ফণাটা।

পিস্তলের আওয়াজে রাজবাড়ির লোকেরা যখন ছুটে এল, তখন দেখল, মার্বেলের মেঝের ওপর সাপ আর মানুষ পাশাপাশি শুয়ে আছে।

.

দেবগড়ের রহস্যকথার এইখানেই ইতি।

শুনতে শুনতে দুপুর গড়িয়ে গেল। গোকুল উঠে চলে গেল কিচেনে। আজ পাখির রোস্ট খাওয়াবে। সিগারেট ধরিয়ে আমি বসেই রইলাম।

জগৎ—সংসারে বোধ করি আশার পূরণ হয় না। হয়তো অতৃপ্তি আছে বলেই জীবন এত মোহময়! তাই অতৃপ্ত আত্মারা জীবনের ভাঙা খেলাঘরে বারবার ফিরে আসে। তা নইলে একশো বছর পরে আজো গভীর রাতে সুদামের বাঁশি বাজে কেন? কেনই বা সাড়া দেয় দেবদাসী অলকাতিলকার ভীরু নূপুর? আর, সে কোথায় গেল? সেই মরা কুস্তীর বাপ একচোখো নুলো কেতু সর্দার? কন্দর্পকান্তির ওপর অমানুষিক প্রতিশোধ নিয়ে কোথায় পালাল সে? ইতিহাস তার খোঁজ রাখে না। জঙ্গলের অন্ধকারে পালাতে গিয়ে চিতে—মারা কেতু হয়তো চিতার পেটেই গেছে!

আজ সকাল সকাল ডিনারের ডাক পড়ল। রাত আটটায় আমার গাড়ি আসবে।

গোকুল ঠাকুরের শেষ অবদান এই হরিয়াল পাখির রোস্ট। পাখিগুলো বোধ হয় ডানলোপিলো দিয়ে তৈরি! চিবোতে চিবোতে মনে হল, ছেড়ে দিলেই আবার জ্যান্ত হয়ে উড়ে যাবে!

বাইরে মোটরের হর্ন শোনা গেল। সম্বলপুরেই অহারপর্বটা সেরে নেব স্থির করে উঠে পড়লাম। মালপত্র কী বা আছে, আর বাঁধতেই বা কতক্ষণ? বিদায়—সম্ভাষণ জানিয়ে যাব বলে গোকুলের খোঁজ করতে দেখি ছোট বাংলো থেকে সে বেরিয়ে আসছে। বললে, ফুলের মালা আর পান—জল রেখে এলাম। উনি কখন আসবেন বলা তো যায় না।

উনি মানে দেবদাসী অলকাতিলকা। গোকুলেরা যাকে গোপীনাথের রাধা জ্ঞান করে।

গাড়ি ছেড়ে দিল। জঙ্গলের ধার দিয়ে মোটর চলেছে। মুখ বাড়িয়ে আবছায়া জ্যোৎস্নায় বসন্তবিহারকে একবার দেখে নিলাম।

রহস্যময় সন্তবিহার! অভিশপ্ত বসন্তবিহার!

.

যদি আমার মতো আপনাদের শিকারের বাতিক থাকে, তবে দেবগড়ের এই প্রাচীন পান্থশালায় একদিন হয়তো আপনারা কেউ এসে আশ্রয় নেবেন। যদি আমার মতো নিশাচর হন, তাহলে নিশুতি রাতে শুনতে পাবেন পাহাড়ি পথে তলদা বাঁশের বাঁশি বঁজছে, আর মুখচোরা ভীরু নূপুর চুপি চুপি সাড়া দিচ্ছে ঝুম—ঝুম ঝুমুর—ঝুম ঝুম—ঝুম! হয়তো বা আমারই মতো আপনাদেরও রাধাদর্শন হয়ে যাবে!

সেদিন আমার এই গল্পকে আর গল্প মনে হবে না। মনে হবে সমস্ত যুক্তি—তর্ক আর বৈজ্ঞানিক বিচারের বাইরেও কিছু সত্যবস্তু আছে।