শঙ্খচূড় – ১

এক

সম্বলপুর থেকে মোটর ছাড়ল রাত এগারোটায়। শিকারের বাতিক আছে, তাই দিন চারেকের ছুটিতে যাব দেবগড়। পথ বেশি দূর নয়, পঞ্চাশ কিলোমিটারের কাছাকাছি।

শহর ছাড়িয়ে মোটর পাহাড়ি রাস্তা ধরল। বাঁধানো পিচের রাস্তা। ক্রমশ চড়াই। বিরাট পাহাড়—রেঞ্জের গা বেয়ে, ঘুরে ঘুরে চলেছি। শরৎকালের শুরু। গেল বর্ষার তোড়ে প্রত্যেকটা কালভার্ট ভেঙে ভেসে গেছে। জল অবশ্য এখন নেই, কিন্তু ভাঙা সাঁকোগুলো এখনো মেরামত হয়নি। উঁচু রাস্তা থেকে সাবধানে পাশের খাদে নেমে আবার উঠতে হচ্ছে। সরাসরি বাঁধানো রাস্তা দিয়ে যাবার উপায় নেই। সময়ও তাই বেশি লাগছে।

মাঝ—রাত নাগাদ অনেকটা উঁচুতে এসে পৌঁছলাম। একপাশে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল, অন্যপাশে নিচু জঙ্গল। শুধু নিচু নয়, গহন গভীর। কৃষ্ণপক্ষের রাত, শিবের জটার চাঁদের মতোই চাঁদের একটা ভগ্নাংশ আকাশে। তা দিয়ে থিয়েটারের সিন সাজানো যায়, পথিকের কাজে লাগে না। একটা বিশ্রী ঘোলাটে অন্ধকার আকাশে পাহাড়ে জঙ্গলে লেপে আছে।

রাতের অরণ্যকে চাক্ষুষ দেখতে দেখতে চলেছি। অনেক ভয়, অনেক রহস্য আর অনেক অজ্ঞাত। ইতিহাস জমা হয়ে আছে ওই অরণ্যে।

একটা ঝাঁকানি দিয়ে গাড়ি থেমে গেল। টুক করে নিভে গেল হেডলাইটের আলো।

ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হল?

ইশারায় সে বললে, সামনে দেখুন।

ঠাহর করে দেখলাম সেই ঘোলাটে অন্ধকারে। বাঁধানো পিচের রাস্তা জুড়ে গুটি তিনেক বাচ্চচা বনবেড়াল হুটোপুটি করে খেলছে। একপাশে একটি বৃহদাকার বনবেড়ালি থাবা পেতে বসে শিশুদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা দেখছে, আর মাঝে মাঝে লোভী সন্তানদের স্তন্য দিচ্ছে।

কিন্তু আমার ভুল হয়েছিল দেখতে। বনবেড়াল নয়, চিতা। মা—চিতা তার ছানাপোনাদের নিয়ে রাস্তার মাঝখানে দিব্য সংসার পেতে বসেছে। সরকারি রাস্তা, সুতরাং কিছু বলা চলে না। বললাম, হেডলাইট জ্বেলে চলে গেলেই তো হয়। ওরা সরে যাবে।

ড্রাইভার বললে, না হুজুর, সরবে না, মা—চিতাটা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়বে। লাফিয়ে গাড়িতে উঠতেও পারে।

অপেক্ষা করতেই হল। প্রায় আধ ঘণ্টা। তারপর মা—চিতা বোধহয় বললে, বাছারা, এবার ঘুমোবার সময়। চলো।

চিতা—পরিবার নিচের জঙ্গলে নেমে গেল। আমাদের মোটরও হেডলাইটের তীক্ষ্ন আলোয় অন্ধকার ফুঁড়ে এগোতে লাগল।

কিন্তু আধঘণ্টা যেতে না যেতেই আবার থামতে হল। নেভাতে হল আলো। আর সঙ্গে সঙ্গে রাতের আকাশ কাঁপিয়ে একটা কর্কশ চিৎকার দস্তুর মতো ঘাবড়ে দিল আমাকে।

ড্রাইভার বললে, ওর সঙ্গীটাকে ডাকছে।

না, বাঘ নয়, হাতি। ঘন মেঘের বরণ প্রকাণ্ড এক দাঁতালো হাতি পথের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রেয়সীকে ডাকছে। ভাবলাম, এই যদি প্রিয়া সম্ভাষণ হয়, তবে দাম্পত্যকলহের চেহারাটা কেমন!

একটু পরেই পাশের বাঁশঝোপ মড়মড় শব্দে ভেঙে একটি তরুণী হস্তিনী এসে উপস্থিত হল। হাতির প্রেম দেখবার সৌভাগ্য ইতিপূর্বে আর হয়নি। দেখলাম, পুরুষ—হাতিটা তার শুঁড় বুলিয়ে প্রিয়ার সর্বাঙ্গে আদর করল খানিক। তারপর তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি টের পেয়েই বোধ করি আরো নিরিবিলি জায়গার সন্ধানে দুজনে জঙ্গলে ঢুকে গেল।

গাড়ি আবার ছাড়ল।

দেবগড় কাছে এসে পড়েছে। পথ আরো দুর্গম, পাহাড় আরো উঁচু, জঙ্গল আরো ভয়—ভীষণ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এ আমার ভ্রমণ কাহিনি নয়, নেহাতই একটা গল্প। আষাঢ়ে গল্প। এটুকু তারই ভূমিকা।

.

দেবগড় পৌঁছতে রাত শেষ প্রহরে এসে পৌঁছল।

পাহাড়ের সর্বোচ্চচ মাথা খানিকটা কেটে সমতল করা হয়েছে। সেই সমতল স্থানে সামান্য তফাতে পাশাপাশি দুটি বাংলো বাড়ি। একসময় সে দুটি বাড়িই ছিল। প্রাচীন স্থাপত্যরীতিতে গড়া। হাল আমলে মেরামতি আর অদল—বদলের ফলে জাতে উঠে বাংলো হয়েছে।

বাংলো দুটি একই প্রাকার দিয়ে ঘেরা। ফটকের গায়ে মার্বেলের ওপর ওড়িয়া ভাষায় খোদাই করা ‘বসন্তবিহার’। নামটা চেষ্টা করে পড়তে হল। কালের প্রলেপে শিলালিপি জীর্ণ স্মৃতির মতো অস্পষ্ট, শ্বেত পাথরও আর শ্বেত নয়, হলদেটে।

আমি ইতিহাসের ছাত্র নই, একদা এই সবুজ বনে—ঘেরা গিরি—চূড়ায় রমণীয় বসন্তকালে কে বিহার করতেন আমার জানা নেই। তবে ভোরবেলায় আশপাশে তাকিয়ে জায়গাটার তারিফ না করে পারলাম না। বসন্তবিহারের তিনপাশে পাহাড়ি অরণ্য, আর এক পাশে ফটকের প্রায় গা ঘেঁষে পাহাড়ের দ্বিতীয় চূড়া, তারই গা বেয়ে প্রগলভা মেয়ের মতো হাসতে হাসতে একটি ঝরনা পাক খেয়ে খেয়ে সোজা লাফিয়ে পড়ছে পাতালে। তার মানে অন্তত হাজার ফুট নিচে। ঝরনাটার নাম বড় শৌখিন—রঙ্গিনী।

প্রথম বাংলোতেই আস্তানা পাতা গেল। থাকার ব্যবস্থা মোটামুটি আরামদায়ক, খাওয়ার ব্যবস্থাও আধুনিক। কিচেন আছে, ডাইনিং টেবিলও আছে। কিন্তু রাঁধুনিটি সেই আদ্যিকালের—প্রভু জগড়নাথের চেলা।

বসন্তবিহারি আজকাল ব্যবহার হয় সরকারি ‘টুরিস্ট লজ’ হিসেবে। আমার সঙ্গে মা লক্ষ্মী বা হুইস্কির কেস নেই দেখে রাঁধুনি গোকুলঠাকুর আমার দিকে কেমন একটা অশ্রদ্ধার চোখে তাকিয়ে রইল। কেননা, পরে শুনলাম, পুজোর ছুটি থেকে নিউ ইয়ার্স ডে অবধি মদ আর মদালসা ছাড়া এখানে যাত্রী আসে না। বুঝলাম, গোকুলঠাকুরের শ্রদ্ধা আকর্ষণের জন্য ধার করেও একটি মা লক্ষ্মী জোগাড় করে আনা আমার উচিত ছিল। কিন্তুা তা যখন হল না, তখন দশ টাকার একখানা নোট তার হাতে দিয়ে বললাম, বাজার—টাজার তুমিই কোরো। হিসেব আমি বুঝি না।

গোকুলঠাকুর পাকা লোক। এক মুহূর্তে আমার ওপর তার অগাধ শ্রদ্ধা এসে গেল। তরমুজের বিচির মতো কালো দাঁতে হাসির অন্ধকার ছড়িয়ে বললে, বসন্তবিহারের মতো এমন স্থান গোটা উড়িষ্যা অঞ্চলে আর পাবেন না। দু’—চারদিন থেকে যান, গোপীনাথের দয়ায় রাধিকাদর্শন হয়ে যাবে।

.

গোকুলঠাকুরের কথার তাৎপর্য তখন ঠিক বুঝিনি। বুঝলাম সেদিন রাতের বেলা।

গোকুলঠাকুর রাঁধে ভালো। সব রকম ব্যঞ্জনই তার হাতে সমান। তাই ডালে ঝোলে বিশেষ পার্থক্য দেখা গেল না। বেলা একটার মধ্যে সে আমাকে খাইয়ে দিল। তারপর পারিপাটি নিদ্রা।

আমার ঘুম যখন ভাঙল, বেলা তখন পাঁচটা বাজে। বাংলোর হাতায় বেরিয়ে এসে দেখি, পাহাড়ের দ্বিতীয় চূড়ার আড়ালে গা—ঢাকা দিয়েছে সূর্য। আর পশ্চিমের আকাশটা কমিউনিস্ট পতাকার মতো লাল। পাহাড়ের দেয়ালে দিনান্তের আলো ঢাকা পড়ায় পুব দিকের হাতায় আর চারপাশের জঙ্গলে এরই মধ্যে একটা বিষণ্ণ ছায়া নেমেছে। দুপুরে হরেকরকম পাখিদের যে বিচিত্র মিষ্টি কূজন শুনেছিলাম, তা মিলিয়ে গিয়ে একটা একক পাখির কর্কশ ডাক একটানা শোনা যাচ্ছে কবর—কট, করর—কট। পাশে ঝরনা থাকার দরুন উড়ে—আসা জলকণায় বাতাসটা ভিজে আর ভারি।

হাতার বুক—সমান উঁচু পাঁচিলের কাছে গিয়ে দেখি, নিচের পাহাড়ি রাস্তায় দু’—একজন গরিব ওড়িয়া মেয়ে জঙ্গল থেকে শুকনো লকড়ির বোঝা মাথায় নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে কয়েকটা বস্তি আছে। কিন্তু কী অস্বাভাবিক নির্জনতা!

শরৎকালের ঝলমলে দিনের বেলা বসন্তবিহারকে ভালো লেগেছিল। প্রকৃতির সঙ্গে একটা নিবিড় বন্ধুতার সম্পর্ক বোধ করেছিলাম। কিন্তু এখন এই ঘনিয়ে—আসা সন্ধ্যার ছায়ায় বসন্তবিহার রূপ বদলেছে। বহু পুরাতন কবরখানার মতো কেমন একটা গা—ছমছমে স্তব্ধতা চারপাশে! বাতাসে স্যাঁৎসেতে মন—মরা ভাব!

কেন? বসন্তবিহারে বসন্ত কি আর আসে না?

একা একা সময় কাটে না। রাতে সকাল সকাল খাবার টেবিলে বসা গেল। দিনের বেলা দেখেছিলাম গোকুল মুর্গির পালক ছাড়াচ্ছে। কিন্তু রাতে খেতে বসে চাপাটির সঙ্গে একবাটি সুক্তোর ঝোল দেখে হতাশ হলাম। একটু বাদেই অবশ্য ভুল ভাঙল। বাটির মধ্যে একটা মুর্গির ঠ্যাং আবিষ্কার করে বুঝলাম গোকুল আমায় ঠকায়নি।

খাওয়া—দাওয়া সেরে বিছানায় আড় হয়ে পেঙ্গুইন সিরিজের গোয়েন্দা উপন্যাসে ডুব দিলাম। অল্প সময়ের মধ্যে বসন্তবিহারও অন্ধকারে ডুব দিল। একে একে বাতিগুলো নিভিয়ে গোকুলঠাকুরও ঢুকল নিজের ঘরে। জ্বলতে লাগল শুধু আমার ঘরের টেবিল ল্যাম্প।

দুপুরে পরিপাটি নিদ্রার ফলে রাতে ঘুম আমার সঙ্গে ভাসুর—ভাদ্রবউ সম্পর্ক পাতিয়েছে। তার ওপর গোয়েন্দা গল্পটাও জমাটি। রাত গড়িয়ে কোথায় পৌঁছেছে, পড়তে পড়তে খেয়াল হয়নি। খেয়াল হল সিগারেটের বাসনায় যখন পড়া থামালামত।

রাতে মানুষ যখন ঘুমোয়, অরণ্য তখন জাগে, কথা কয়। অদ্ভুত ভাষা শুনতে পেলাম আশপাশের জঙ্গল থেকে। শুকনো পাতার খসখস, থেকে থেকে রাতচরা পাখিদের অস্পষ্ট কাৎরানি, ভুখা চিতার চাপা আস্ফালন। আরো নানাবিধ অজানা অস্বস্তিকর শব্দ।

ঠিক এই জাতের রাতের সঙ্গে আমার কিছু পরিচয় ছিল। সিগারেট ধরাতে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত থমকে থেমে রইলাম। তারপর আবার পেঙ্গুই সিরিজে মন দিলাম।

হঠাৎ বই থেকে মনটা সরে গেল।

বাঁশির আওয়াজ!

কে যেন বাঁশের বাঁশি বাজাতে বাজাতে পাহাড়ের নিচে থেকে উঠে আসছে। আশ্চর্য মোহময় সেই সুর! যেন সম্মোহন করে। মেঠো জংলা সুর, তবু তার মূর্ছনা রক্তে মিশে যেন উতলা করে তোলে।

এই নিশুতি বুনো রাতে জঙ্গলের পথে কোন পাগল বাঁশুরিয়ার প্রাণে ভাব এসেছে কে জানে! সে যেই হোক, বাঁশিতে তার দখল আছে বলতেই হবে। কিন্তু বাঁশি বাজার এই কি সময়? আর এই কি স্থান?

বাঁশির সঙ্গে ও আবার কি?

ঝুম—ঝুম, ঝুম—ঝুম, ঝুমুর—ঝুম!

উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগলাম। নূপুর বাজছে। মৃদু—অতি মৃদু শব্দে। নূপুর যেন সন্ত্রস্ত, পাছে কেউ জানতে পারে।

মনে হল ঝুম—ঝুম আওয়াজটা আসছে বসন্তবিহারের দ্বিতীয় বাংলোর দিক থেকে।

বাঁশি উঠে আসছে পাহাড়ের নিচে থেকে, আর নূপুর চলেছে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে।

ওই জংলা বাঁশি এত রাতে ডাকবেই বা কাকে? আর মুখরা নূপুরকে শাসন করতে করতে চলেছেই বা কোন পাহাড়ি গ্রাম্য রাধা?

বড় কৌতূহল হল। অগ্র—পশ্চাৎ কিছু না ভেবেই ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম বাংলোর হাতায়। ভাবলাম না নিচু পাঁচিল টপকে নিশাচর চিতা যে কোনো মুহূর্তে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, পায়ের তলায় কিলবিল করে উঠতে পারে পাহাড়ি চন্দ্রবোড়া।

ধূসর আকাশে কৃষ্টপক্ষের ভাঙা চাঁদ। ঝিমঝিমে জ্যোৎস্নায় চারধারে তাকিয়ে দেখি আমি ছাড়া কেউ নেই।

তবে কি ভুল শুনলাম? রাত—জাগা মস্তিষ্কের বিভ্রান্ত কল্পনা?

কিন্তু না, ওই তো আবার বাজছে বাঁশি! কাছে আসছে ক্রমশ। তার সঙ্গে ঝুম—ঝুম, ঝুমুর—ঝুম। অতি সাবধানী নূপুর ফটক পার হয়ে নেমে যাচ্ছে ঢালু রাস্তায়।

হতচেতনের মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ ছটফটিয়ে উঠল রাতের হাওয়া। অরণ্যের শাখায় শাখায় হাহাকার তুলে শনশন করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল। ককিয়ে উঠল রাতচরা একটা পাখি। আর সমস্ত শব্দকে ছাপিয়ে এক নারীকণ্ঠের ব্যাকুল ভয়ার্ত ডাক শোনা গেল: সুদা—আ—আ—ম!

ডাকটা এলো যেন ওই রঙ্গিনী ঝরনার দিক থেকে।

একটি গলার ডাক কোটি কণ্ঠের ডাক হয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে অরণ্যে অরণ্যে মাথা কুটতে লাগল। শিউরে উঠল রাত্রি, শিউরে উঠলাম আমি।

কে ডাকে অমন করে? কাকে ডাকে?

অস্বচ্ছ জ্যোৎস্নায় ভালো করে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। কেউ নেই!

রাত এখনো বাকি।

সাহস ফুরিয়ে গেল হঠাৎ। এক—পা এক—পা করে ঘরে ফিরে গেলাম।