লোলির পাহারা
শহর থেকে অনেক দরে ‘লোলি’দের বাড়ি। সে বাড়িতে খালি লোলি থাকে, আর তার বাবা থাকেন, আর থাকে একটা বড়ো শুওর। বাড়ির চারদিকে ছোট ছোট খেত, তার চারদিকে বেড়া দিয়ে ঘেরা। খেতে যে সামান্য ফসল হয়, তাই বেচবার জন্য লোলির বাবা শহরে যান, আর লোলিকে বলে যান, “তুই বাড়িতে থেকে ভালো করে পাহারা দিস্।” লোলি বাড়িতেই থাকে, কিন্তু পাহারা দেয় বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে, নাক ডাকিয়ে!
একদিন লোলির বাবা শহরে যাবার সময়ে লোলিকে বললেন, “ওরে! আমার তো আজকেও ফিরতে সন্ধে হবে, একটু ভালো করে মন দিয়ে পাহারা দিস্। কশাইবুড়ো বলেছিল শুওরটাকে কিনবে—তা হলেই শীতকালটা আমাদের কোনরকমে চলে যাবে। দেখ বাপু, ফটকটি খোলা রেখো না যেন! শুওরটা যদি পালায়, তা হলে কিন্তু উপোস করে মরতে হবে।” লোলি খুব খানিক ঘাড় নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি খুব করে পাহারা দেব—আর কখনো ফটক খুলে রাখব না।”
লোলির বাবা চললেন শহরের দিকে, আর লোলি একটা খড়ের গাদার উপর বসে পাহারা দিতে লাগল। বড়ো শুওরটা শুয়ে শুয়ে ঘঁৎ ঘঁৎ করে নাক ডাকছে, তাই শুনতে শুনতে লোলিও কখন যে চোখ বুজে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, তা সে নিজেও টের পায় নি। হঠাৎ সে কেমন যেন চম্কে উঠল, বাবার কথাগুলো তার মনে পড়ল। সর্বনাশ! শুওর যদি পালায়, তবে এবার দুজনকেই উপোস থাকতে হবে। সে কান পেতে শনল, শুওরের ঘঁৎ ঘঁৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে না! সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল—ফটকের দরজা খোলা! ভয়ে অমন শীতের মধ্যেও লোলির গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটতে লাগল।
লোলি ভাবল, হয়তো শুওরটা ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে, কিন্তু সমস্ত ঘরদোর খুঁজে কোথাও সেটাকে পাওয়া গেল না, তখন লোলি পাগলের মতো রাস্তার দিকে ছুটে চলল। কিন্তু রাস্তায় গিয়ে দেখল, শুওর-টুওর কোথাও কিছু নেই—খালি একটা বুড়ো ভিখারি লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তখন লোলি আবার বাড়ির মধ্যে দৌড়ে গেল। সে বিছানার তলায় ঢুকে দেখল, মাচার ওপরে চড়ে দেখল, প্রকাণ্ড জালাটার ভেতরে হাত দিয়ে দেখল, সমস্ত টেবিল চেয়ার ঝেড়েঝড়ে দেখল, মই দিয়ে বাড়ির চালায় উঠে দেখল—শুওর কোথাও নেই! লোলি কাঁদ কাঁদ হয়ে আবার রাস্তার দিকে ছুটল।
রাস্তায় গিয়ে সে এদিকে-ওদিকে, মাঠের দিকে, গাছের দিকে, নর্দমার দিকে, সব দিকে তাকিয়ে দেখল, শুওর কোথাও নেই। তখন লোলি সত্যিসত্যিই ভ্যা ঁকরে কেঁদে ফেলল। সে কেঁদে উঠতেই তার মনে হল, কোথায় যেন শুওরটা “ঘঁ—চ” করে চেঁচিয়ে উঠল। লোলি তখন কি করবে বুঝতে না পেরে, সেই বুড়োর পিছন পিছন ছটতে লাগল আর কাঁদতে লাগল, “মশাই গো! মশাই গো! আমাদের শুওরটা কোথায় গেল বলে দিন না মশাই!”
লোলির কান্না দেখে বুড়োর হাসি পেয়ে গেল। সে বলল, “কি, বলছ কি? কার শুওর? কি হয়েছে?” লোলি বলল, “আমাদের সেই শুওরটা—আমি শুওর পাহারা দিতে দিতে একটুখানি ঘুমিয়ে পড়েছি, আর—” বুড়ো অমনি ভেংচে উঠল, “একটুখানি ঘুমিয়ে পড়েছ—আর শুওর অমনি পালিয়েছে। খুব পাহারাদার যা হোক!” লোলি ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল, “দোহাই মশায়, আমার শুওর কোথায় গেল বলে দিন।” বুড়ো তখন রেগে বলল, “ভারি তো একটা শুওর, তাই নিয়ে আবার এত ঘ্যানঘ্যান্—এ কিন্তু বাপু নেহাৎ বাড়াবাড়ি!” লোলি বলল, “শুওর গেলে আমাদের উপায় হবে কি? আমরা শীতকালে খাবার পয়সা পাব কোথায়?” বুড়ো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, “যখন পড়ে পড়ে ঘুমচ্ছিলে, তখন সে কথার খেয়াল ছিল না?” এই বলে বুড়ো আবার কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে লাগল।
লোলি এবার তার পা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করল, “মশাই গো, দোহাই আপনার!—ও মশাই গো! আমাদের কি হবে গো!” বুড়ো বলল, “কি আপদ! এমন বিচ্ছিরি প্যান্পেনে ছিঁচকাঁদুনে ছেলেও তো দেখি নি কোথায়! চুপ কর শিগ্গির। এখনি পাড়ার লোক সব ছুটে আসবে, ডাকাত পড়েছে মনে করে!” কিন্তু লোলি কি সে কথা শোনে? সে প্রাণপণে কেবলই চেঁচাচ্ছে, “ওরে আমার
শুওর কোথায় গেল রে? ওরে আমার শুওর কে নিল রে?”
বুড়ো তখন বিরক্ত হয়ে পা দুটো ছাড়িয়ে আবার ঠক্ঠক্ করে হেঁটে চলল—আর ঠিক সেই সময়ে বুড়োর গায়ের ছেঁড়া কম্বলের ভেতর থেকে ঘঁৎ ঘঁৎ করে কিসের একটা শব্দ শোনা গেল। লোলি শব্দ শুনেই চিৎকার করে উঠল, “তবে রে হতভাগা চোর! আমাদের শুওর নিয়ে পালাচ্ছিস! এই বলেই সে বুড়োর লাঠিখানা টেনে ধরল। যেমন লাঠিতে হাত দেওয়া, অমনি লোলির মনে হল যেন তার সমস্ত শরীর ঝিম্ ঝিম করছে; তার হাত-পাগুলো সুড়্ সুড়্ করে বেঁকেচুরে কিরকম ছোট্ট হ’য়ে যাচ্ছে; ঘাড় গলা পেট সব অসম্ভব মোটা হয়ে ফুলে উঠছে; মুখটা অদ্ভুতরকম বদলে গিয়ে নাকটাকে ঠেলে এগিয়ে দিচ্ছে! তারপর দেখতে দেখতে সে চারপায়ে হাঁটতে লাগল।
বুড়ো তখন একগাল হেসে বলল, “হ্যাঁ, এইবার ঠিক হয়েছে। কেমন? আগে ছিলি একটা অপদার্থ নিষ্কর্মা ঘুমকাতুরে কুঁড়ে, আর এখন হয়েছিস কেমন থপ্থপে নাদুস্নুদুস্ হ্যাংলামুখো শুওর। বেশ বেশ! আর কোনদিন দুষ্টুমি করবি? আর কখনো বুড়ো মানুষকে ‘চোর’ বলে ধরতে যাবি? যা, এইবার তোর খড়ের গাদায় গিয়ে শুয়ে থাক। তোর বাবা যখন ফিরে আসবে কশাইবুড়োকে নিয়ে, তখন দেখবে শুওরটা আছে, কিন্তু হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া লোলিটা কোথায় পালিয়েছে! হোঃ—হোঃ—হোঃ—হোঃ।” বুড়ো খুব একচোট হেসে নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল, আর লোলই রাশটায় ধুলোয় পড়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলে ধুলো ভিজিয়ে কাদা করে ফেলল।
লোলি রাস্তায় পড়ে কাঁদছে, এমন সময় হঠাৎ কোত্থেকে একটা খেঁকি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসল। লোলি বেচারা কি করে? সে এখন শুওর হয়ে গেছে, তাই সে তার ভুঁড়ো পেট নিয়ে ছোট-ছোট চারটি পায়ে প্রাণপণে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে সে নিজেদের বাড়ির ফটকের সামনে এসেই এক দৌড়ে সেই খড়ের গাদার মধ্যে ঢুকে বলল, “ঘঁৎ”—অর্থাৎ “বড্ড বেঁচে গিয়েছি!”
লোলি খড়ের মধ্যে শুয়ে হাঁপাচ্ছে আর ভাবছে, এখন কি করা যায়। এমন সময়ে হঠাৎ ভয়ে তার হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে গেল—তার মনে পড়ল, তার বাবা তো সন্ধে হলেই কশাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন, আর তাকেই তো শুয়োর ভেবে কশাইয়ের কাছে বিক্রি করবেন! আর কশাই তাকে একবার পেলেই তো গলায় ছুরি বসিয়ে—! লোলি আর ভাবতে পারে না। সে শুওরের ভাষায় একেবারে “বাপরে মারে! গেছি গেছি!” ব’লে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল। সে ভাবল, এইবেলা সময় থাকতে ছুটে পালাই। কিন্তু পালাবে কোথায়? ঠিক সেই সময়ে তার বাবা সেই কশাইকে নিয়ে ফটক দিয়ে ঢকেছেন। লোলির বাবা ঢুকেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, “দেখছ! হতভাগা ছেলেটা ফটক খোলা রেখেই কোথায় সরে পড়েছে! শুওরটা যে পালায় নি এই ভাগ্যি!” এই বলে তিনি লোলির কান দুটো ধরে কশাইয়ের কাছে টেনে আনলেন। কশাই লোলিকে হাঁ করিয়ে তার মুখ দেখল, তাঁর পাঁজরে খোঁচা মেরে, পিঠের ওপর আচ্ছা করে চাপড়ে তাকে পরীক্ষা করল, তারপর খুশি হয়ে বলল, “হুঁ বেশ।” লোলি তার মাথা নেড়ে হাত-পা ছুঁড়ে লাফাতে লাগল, ক্যাঁচ কোঁচ ঘঁৎ ঘঁৎ কতরকম শব্দ করল, কিন্তু কিছুতেই তার বাবাকে বোঝাতে পারল না যে, সে সত্যি করে শুওর নয়, সে লোলি।
কশাই তার দাম চুকিয়ে দিয়ে, তার পর মুগুরের মতো একটা ডাণ্ডা দিয়ে লোলিকে গুঁতো মেরে বলল, “চল, দেখি। বড় তেজ দেখাচ্ছিস—না? আচ্ছা, কালকে আর বাছাধনকে তেজ দেখাতে হবে না। কাল রাজার জন্মতিথির ভোজ—কেল্লা থেকে হুকুম এসেছে চোদ্দটা শুওর পাঠাতে হবে। এইটাকেই সবার আগে চালান দিচ্ছি। তা হলে ভোজটিও হবে ভালো।”
লোলি ঘঁৎ ঘৎ করে অনেক আপত্তি জানাতে লাগল, আর মনে মনে ভাবল, ‘যেই ফটক খুলবে অমনি দৌড়ে পালাব।’ যেমন ভাবা তেমনি কাজ; লোলির বাবা কশাইয়ের সঙ্গে এগিয়ে এসে যেমন ফটকটা খুলে ফাঁক করে ধরেছেন, অমনি লোলিও হন্হন্ করে দৌড় দিয়েছে। কিন্তু দৌড়ে যাবে কোথায়? বেরিয়েই দেখে কশাইয়ের দুটো ষণ্ডা কুকুর দাঁত বের করে বসে আছে। কাজেই তার আর পালান হল না। যাবার সময় লোলি শনল, তার বাবা বকাবকি করছেন, “মনে করেছিলাম, ছোঁড়াটাকে আজ একটু তামাশা দেখাতে নিয়ে যাব, কিন্তু হতভাগা কোথায় যে গেল!”
কশাই লোলিকে ঠেলে ঠেলে তার বাসায় নিয়ে ছোট্ট নোংরা একটা খোঁয়াড়ের মধ্যে পুরে নিজের কাজে চলে গেল, আর লোলি কাদার মধ্যে পড়ে কাঁদতে লাগল। খানিক বাদে যমের মতো চেহারা দটো লোক এল তাদের একজনের হাতে দড়ি, আর একজনের হাতে মস্ত একটা ছুরি। তারা এসেই লোলিকে দেখে বলল, “হাঁ হাঁ, এইটা তো বেশ মোটা আছে—বাঃ ধর দেখি!” এই বলে তারা লোলিকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরল। লোলি তখন “মেরো না, মেরো না—আমি সত্যিকারের শুওর নই”—বলে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল।
ঠিক সেই সময়ে লোলির কানের কাছে কে যেন “হো-হো” করে হেসে উঠল, আর লোলি ধড়ফড়্ করে লাফিয়ে উঠে দেখল, সে তখনও সেই খড়ের গাদার ওপরেই রয়েছে—আর তার বাবা তার সামনে দাঁড়িয়ে হো হো করে হাসছেন, আর বলছেন, “স্বপ্নে বুঝি শুওর হবার সখ হয়েছিল? আচ্ছা হতভাগা ছেলে যা হোক!” লোলি কতক্ষণ বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, তারপর চোখ রগড়ে আবার চারদিকে চেয়ে দেখল, তারপর বলল, “আমাদের শুওরটা?” তার বাবা বললেন, “ঐ তো! শুনছিস নে? ঐ শোন্।” লোলি শুনল শুওরটা দিব্যি আরামে ঘঁৎ ঘঁৎ করে ডাকছে।
তখন লোলি বলল, “ভাগ্যিস্ পালায় নি!” তার বাবা বললেন, “তোমার মতো গুণধর ছেলেকে পাহারার ভার দিয়েছি, শুওর যে পালায় নি এ তো আমার আশ্চর্য ভাগ্য বলতে হবে।” লোলি বলল, “এখন থেকে খুব ভালো করে পাহারা দেব, আর কক্ষনো ফাঁকি দিয়ে ঘুমোব না।”
সন্দেশ—১৩২৭