লেসে ফ্যের

লেসে ফ্যের

নৃতত্ত্ববিদের কৈলাস, কৈলাস পর্বতে নয়, তাঁদের স্বর্গ আসামের পর্বতে। এ কথা ভূ-ভারতের তাবৎ নৃতত্ত্ববিদ্ উত্তমরূপে জানেন বলেই আসামে আসবার জন্য তাদের ছেকছেকের অন্ত ছিল না। কিন্তু ইংরেজ তখন আসামের ম্যানেজার, কাজেই ব্যাপারটা দাঁড়াল ইংরেজি প্রবাদে যাকে বলে ‘ডগ ইন দি মেঞ্জার’ নয় ‘ডগ অ্যান্ড দি ম্যানেজার’। ইংরেজ নিজে অনুন্নত পার্বত্য জাতির ভেতর বসবাস করে তাদের সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধতর করত না, অন্য উৎসাহী পণ্ডিতকেও তাদের সঙ্গে মিশতে দিত না।

ইংরেজ কস্মিনকালেও কোনও প্রকারে জ্ঞানচর্চা করেনি একথা বলা আমার উদ্দেশ্য না। কিন্তু ওই কর্ম সে করেছে রাজ্যবিস্তার এবং আনুষঙ্গিক ধনার্জনের বহু পূর্বে। নৃতত্ত্ব এবং সমাজতত্ত্বের যখন প্রচার এবং প্রসার হল, টাকার গরমিতে ইংরেজ তখন কোনও প্রভু হস্তীদেহ খুঁড়িখানা ভারি গোছ হয়ে গিয়েছেন, মা-সরস্বতীর পেছনে আসামের বনে-বাদাড়ে ঘোড়ার মতো গুত্তি আর তার গায়ে নেই। যে দু চারখানা বই ইংরেজ আসামের অনুন্নত সম্প্রদায়গুলো সম্বন্ধে লিখেছে সেগুলো প্রাচীন পদ্ধতিতে লেখা– নৃতত্ত্বের নব নব তত্ত্বাবিষ্কারের দৃষ্টি-বিন্দুর সন্ধান এ কেতাবগুলোতে পাবেন না।

কিন্তু জানা-অজানায় ইংরেজ এদের অনেকের সর্বনাশ করে দিয়ে গিয়েছে, এদের ভেতর মিশনারিদের ঘোরাঘুরি এবং বসবাস করতে দিয়ে।

খ্রিস্টধর্ম অতি উত্তম ধর্ম। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান কোনও ধর্ম থেকেই সে নিকৃষ্ট নয়। কোটি কোটি লোক শত শত বৎসর ধরে খ্রিস্টের বাণী থেকে নব নব আদর্শের অনুপ্রেরণা পেয়েছে, খ্রিস্টের অনুকরণ করে বহু সাধুসন্ত ভগবানের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন, তাঁদের দেখে সংশয়বাদীরা বলেছেন, ভগবান আছেন কি না জানিনে কিন্তু যদি থাকেন তবে তার স্বরূপ এঁদেরই মতো।

কিন্তু সেই মহান ধর্মপ্রচারের ভার যদি অজ্ঞের হাতে পড়ে তবে তার ফল বিষময় হয়। কারণ সে তখন খ্রিস্টের নামে যে বাণী প্রচার করে সে উচাটন শয়তানের।

আসামের সব মিশনারি যে শয়তান ছিলেন, একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু অজ্ঞের স্কন্ধে শয়তান ভর করে যে কী কুকর্ম করতে পারে সে তত্ত্ব হজরত মোহাম্মদ (দ.) জানতেন বলেই বলেছেন,

মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা জ্ঞানীর নিদ্রা শ্রেয়ঃ।

যে মিশনারি এসে আসামের বনের ভেতর বাসা বাঁধল তার বাংলো দেখে আমরা দূরের থেকে মুগ্ধ হই। অনেকটা যেন–

“ওই যেখানে দিঘির উঁচু পাড়ি,
সিসু গাছের তলাটিতে,
পাঁচিলঘেরা ছোট্ট বাড়ি
ওই যে রেলের কাছে,
ইস্টেশনের বাবু থাকে,
আহা এরা কেমন সুখে আছে ৷’

 টিলার উপর ফুটফুটে বাংলো, চতুর্দিকে ফুলের কেয়ারি, ঝকঝকে তকতকে বারান্দায় বেতের চেয়ার-টেবিল সাজানো– মনে হয়, আহা, পাদরি কেমন সুখে আছে।

যাদের ভেতর পাদরি সাহেব খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে এসেছেন, তাদের তুলনায় তিনি আছেন অনেক সুখে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই কিন্তু বিলেতের যে কোনও মজুরের বাড়ি পাদরির বাসার চেয়ে অনেক বেশি আরামদায়ক, মজুর পাদরি সাহেবের চেয়ে খায় ভালো এবং পাদরির সবচেয়ে দুঃখ যে তাকে আত্মীয়স্বজন স্বদেশবাসী বর্জন করে আমরণ থাকতে হয় স্বদেশ থেকে বহুদূরে অনাত্মীয়ের মাঝখানে। তাই রবীন্দ্রনাথ এদেরই একজনকে দিয়ে বলিয়েছেন,

আপনার জন আপনার দেশ
হয়েছি সর্বত্যাগী
 হৃদয়ের প্রেম সব ছেড়ে যায়
তোমার প্রেমের লাগি।
 সুখসভ্যতা রমণীর প্রেম
বন্ধুর কোলাকুলি
ফেলি দিয়া পথে তব মহাব্রত
মাথায় লয়েছি তুলি।
এখনো তাদের ভুলিতে পারিনে
মাঝে মাঝে জাগে প্রাণে,
 চিরজীবনের সুখবন্ধন
সেই গৃহমাঝে টানে।

কিন্তু এটা হল পাদরির হৃদয়ের দিক। এবং বাইরের দিক দিয়ে দেখতে গেলে পাদরি আপন দেশের তুলনায় যত দৈন্যেই থাকুক না কেন, এদেশের মধ্যবিত্ত সন্তানের চেয়েও তাদের আর্থিক অবস্থা ঢের ঢের ভালো এবং চাষাভুষোদের সঙ্গে এদের কোনও তুলনাই হয় না।

কিন্তু পার্থক্যটা সবচেয়ে মারাত্মক হয় যখন পাদরি পার্বত্য অনুন্নত জাতির ভেতর গিয়ে বাংলো বাঁধে।

অনুন্নত জাতি বুঝতে পারে না যে, ক্রিস্টান হয়ে গেলেই সে পাদরি সায়েবের বাংলো ভেট পেয়ে যাবে না। পাদরির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সে পাদরির বাড়ি, ঘর-দোর, জামা-কাপড়, বাসন-কোসন, টেবিল-চেয়ার দেখে মুগ্ধ হয় এবং এইসব জিনিস যোগাড় করার জন্য তার সরল মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু নাগা কিংবা লুসাইয়ের যা আমদানি তা দিয়ে এসব বস্তুর কল্পনাও সে করতে পারে না। ফলে তার জীবন বিষময় হয়ে ওঠে।

পাদরি সায়েবেরা এই সর্বনাশটি করেছেন অনন্ত জাতিদের। চোখের সামনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যে ছিমছাম স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিংটি তুলে ধরেছেন, সে স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছনোর ক্ষমতা নাগা কিংবা লুসাইয়ের কস্মিনকালেও হবে না– দ্বন্দ্ব তার লেগেই থাকবে।

অন্য বাবদে এইসব অনুন্নত সম্প্রদায়গুলোর প্রতি ইংরেজের নীতি ছিল ‘লেসে ফ্যের’ অর্থাৎ তাদের জীবনধারণ পদ্ধতিতে কোনও প্রকার পরিবর্তন না আনা, এবং আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, একমাত্র নাগাদের বাদ দিয়ে আর সব অনুন্নত সম্প্রদায়কে যত কম খাটানো যায় ততই মঙ্গল। তার কারণ এদের অনেকেই এমন শান্ত সরল ও নির্ধন্দু জীবন-যাপন করে যে, আমাদের ‘সভ্যতা’, তাদের জীবনে নতুন কিছু তো আনবেই না, বরঞ্চ নানা প্রকারে দৈন্য দুর্দশা সৃষ্টি করবে। অন্তত একজন অতিশয় জ্ঞানবৃদ্ধ ঋষিতুল্য ভারতীয়কেও আমি এই মত পোষণ করতে দেখেছি। প্রাতঃস্মরণীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় হয় সাঁওতালদের সঙ্গে গত শতকের শেষের দিকে। তখনও বোলপুর অঞ্চলে ধান-কল হয়নি, সেখানকার কৃত্রিম জীবন তখনও সাঁওতালদের চরিত্র নষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়নি। দ্বিজেন্দ্রনাথ সেই সরল অনাড়ম্বর সাঁওতালদের জীবনধারণ-পদ্ধতি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলেন এবং আমাকে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, এদের জীবনে আমরা যেন হস্তক্ষেপ না করি। এবং তার বিশ্বাস ছিল যে, সাঁওতালরা যে অহেতুক ভূতপ্রেতকে ডরায়, সেটা সারাবার জন্য সর্বশক্তিমান ভগবানের ধারণা এদের ভেতর প্রচার করলে ভালো হয়। সে ধারণা প্রচার করার কতটুকু প্রয়োজন, গুণীরা তার বিচার করবেন কিন্তু দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রথম উপদেশ আমি সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করে নিয়েছি।

আমি জানি, এর বিরুদ্ধে আপত্তি উঠতে পারে। যারা শিক্ষাদীক্ষায় বিশ্বাস করেন, মড়ক এবং অন্যান্য ব্যাধি যাঁরা নির্মূল করতে চান, তাঁরা হয়তো সহজে আমাদের ‘লেসে ফ্যের’ পন্থা মেনে নেবেন না। উত্তরে আমার নিবেদন, এইসব অনুন্নত জাতির সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান এখনও এত কম যে, বিচক্ষণ ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন, এদের সম্বন্ধে আরও অনেক অনুসন্ধান করার পর বিস্তর ভেবে-চিন্তে কাজ আরম্ভ করতে হবে অবশ্য ততদিন বেঁচে থাকলে আমি এখনও আপত্তি জানাব। কারণ ধর্মের মিশনারি আর ‘সভ্যতা’র মিশনারিদের ভেতর আমি পার্থক্য দেখতে পাই অতি কম।