গল্পগ্রন্থ

লেডি ফ্রান্সেস কারফাক্সের অন্তর্ধান রহস্য

লেডি ফ্রান্সেস কারফাক্সের অন্তর্ধান রহস্য
[ দ্য ডিস্যাপিয়ারেন্স অফ লেডি ফ্রান্সেস কারফাক্স ]

আমার বুটজোড়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে শার্লক হোমস বললে, কিন্তু ভায়া, হঠাৎ টার্কিশ শখ হল কেন?

বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে দু-পা সামনে বাড়িয়ে বসে ছিলাম আমি। বন্ধুবরের চনমনে নজর ঠিক সেইদিকেই পড়েছে।

অবাক হলাম। বললাম, ইংলিশ জুতো। অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ল্যাটিমারের দোকান থেকে কিনেছি।

অসহিষ্ণুভাবে হাসল হোমস।

বললে, ধুত্তোর! আমি বলছি টার্কিশ বাথের কথা! সস্তায় বাড়ির স্নান ছেড়ে হঠাৎ এত দামি টার্কিশ স্নানের দরকার পড়ল কেন?

কারণ দিনকয়েক ধরে নিজেকে বড়ো বুড়োটে আর বেতো মনে হচ্ছে। টার্কিশ বাথ শরীরটাকে ভেতর থেকে তাজা ঝরঝরে করে দেয় কিন্তু ভায়া আমার জুতো আর টার্কিশ বাথের মধ্যে যোগসূত্রটা তোমার মতো যুক্তিসিদ্ধ ব্রেনের কাছে নিশ্চয় সুস্পষ্ট, আমার কাছে নয়। একটু খোলসা করে বলবে?

চোখ নাচিয়ে হোমস বললে, যুক্তির ধারাবাহিকতা অনুধাবন করতে পারলেই ঠিক খোলসা হয়ে যাবে। যেমন ধর, আজ সকালে তোমার সঙ্গে একজন একই গাড়িতে উঠেছিলেন।

একটু গরম হয়ে বললাম, এর মানে কি খোলসা করা হল? এ তো আর একটি ধাঁধা?

শাব-বাশ! বিক্ষোভ প্রকাশটা চমৎকার যুক্তিসংগত হয়েছে। শেষ বিষয়টা থেকেই তাহলে খোলসা পর্ব শুরু করা যাক। গাড়ির ব্যাপারটা ধরা যাক আগে। তোমার কোটের একদিকের হাতায় আর কাঁধে কাদার ছিটে লেগেছে লক্ষ করেছ? গাড়ির মাঝখানে বসলে কাদা ছিটকে গায়ে লাগলে দু-পাশে সমানভাবে লাগত–একপাশে লাগত না। তাই ধরে নিলাম, তুমি গাড়ির একপাশে বসে ছিলে–আর একপাশে বসেছিল অন্য এক ব্যক্তি।

এ তো সোজা ব্যাপার।

খুবই সোজা এক্কেবারে ছেলেখেলা, তাই তো?

বুটের সঙ্গে চান করার সম্পর্কটা এবার বলো?

সেটাও একটা ছেলেখেলা। তোমার বুটের ফিতেতে ডবল ফাঁস দেখছি–যা তুমি কখনোই নিজে লাগাও না। তার মানে, জুতোজোড়া তুমি খুলেছিলে। অন্য একজন পরিয়ে দিয়েছে। কে পরিয়ে দিয়েছে? মুচি নিশ্চয় নয়–কেননা জুতোজোড়া এই সেদিন কিনেছ। তাহলে নিশ্চয় টার্কিশ বাথ নিতে গেছিলে। নিয়ে অবশ্য ভালোই করেছ–কাজে লাগবে।

সেটা আবার কী?

এইমাত্র বললে না টার্কিশ বাথ নিয়েছ শরীরটাকে ঝরঝরে তাজা করার জন্যে তার মানে একটু হাওয়া বদলও দরকার। লসানে যাবে। ফার্স্টক্লাস টিকিট পাবে–রাজার হালে থাকার খরচ পাবে?

সে তো অতি চমৎকার হয়! কিন্তু কেন?

আর্মচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পকেট থেকে নোটবই বার করে হোমস বললে, নির্বান্ধব মেয়েরা যখন ভেসে ভেসে বেড়ায়, সমাজে কেবল অশান্তির সৃষ্টি করে। এক দল শেয়ালের মাঝে তারা তখন অসহায় মুরগি ছাড়া আর কিছুই নয়। নিজেরা নিরীহ হলেও এই ধরনের মেয়েদের জন্যেই অন্যেরা অনেক ধরনের অপরাধ ঘটিয়ে বসে। টাকা আছে বলেই দেশে দেশে এরা ভেসে বেড়ায়, ভালো ভালো হোটেলে থাকে–তারপর একসময়ে হারিয়ে যায়, শেয়ালের খপ্পরে পড়ে। লেডি ফ্রান্সেস কারফাক্সেরও এই ধরনের সাংঘাতিক কোনো বিপদ ঘটেছে বলে আমার মনে হয়।

দুনিয়ার নির্বান্ধব মেয়েদের নিয়ে কথা বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত বিশেষ একজনের নাম বলায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

নোটবই দেখে হোমস বললে, লেডি ফ্রান্সেস হলেন পরলোকগত আর্ল অফ রাফটনের শেষ বংশধর। তোমার মনে থাকতে পারে, এ-বংশে সম্পত্তি পেয়েছে কেবল পুরুষেরাই–এই প্রথম একজন মহিলার বরাতে জুটেছে আর্লের সম্পত্তি। ওঁর সঙ্গে সবসময় এক ট্রাঙ্ক বোঝাই দামি দামি স্পেনীয় জড়োয়া গয়না থাকে। রুপোর জড়োয়া আর অদ্ভুতভাবে কাটা হিরেগুলো উনি কোনো ব্যাঙ্কে রাখেন না–যেখানে যান, সঙ্গে নিয়ে যান। লেডি ফ্রান্সেস সুন্দরী, মাঝবয়সি, কিন্তু একাকিনী। টাকাকড়ি মোটামুটি আছে, কিন্তু ট্রাঙ্কটিই ওঁর আসল সম্পত্তি।

কী হয়েছে ওঁর?

বেঁচে আছেন কি না সেইটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। ভদ্রমহিলা গত চার বছর ধরে প্রতি হপ্তায় একখানা চিঠি লিখেছেন ওঁর এককালের গভর্নেস মিস ডবনি-কে। ইনি থাকেন ক্যামবারওয়েলে, অবসর নিয়েছেন। গত পাঁচ হপ্তা ধরে কোনো চিঠি পাচ্ছেন না লেডির কাছ থেকে। শেষ চিঠিটা লেখা হয়েছিল লসানের হোটেল ন্যাশনাল থেকে। খবর নিয়ে জানা গেছে হোটেল ছেড়ে নাকি চলে গেছেন–ঠিকানা রেখে যাননি। টাকার অভাব হবে না ভায়া–কিন্তু ওঁর অন্তর্ধান রহস্য ভেদ করতেই হবে–মিস ডবনির অনুরোধে এ-কেসে তাই নাক গলিয়েছি।

কিন্তু মিস ডবনি ছাড়া নিশ্চয় অন্য অনেককেও উনি চিঠি লেখেন?

চিঠি আর এক জায়গাতেই লেখেন–সেখানেও ঢু মেরে কিছু পায়নি। নির্বান্ধব একাকিনী লেডি মেয়েদের বাঁচতে হলে টাকা দরকার এবং সে-টাকা আসে ব্যাঙ্ক থেকে। ব্যাঙ্কের পাশবই ঘাঁটলেই অনেক জানা যায়। ওঁর ব্যাঙ্কের হিসেব আমিও দেখেছি। লসানের বিল মিটোতে সবশেষে একটা চেক কেটেছেন–কিন্তু টাকাটা মোটা অঙ্কের। তার মানে নিশ্চয় হাতে নগদ টাকা নিয়েই লসান ত্যাগ করেছেন। তারপর একটাই চেক কেটেছেন।

কাকে? কোথায়?

মিস মেরি ডেভিনের নামে। কোথায় কেটেছেন ধরা যাচ্ছে না। তবে চেকটা ভাঙানো হয়েছে ক্রেডিট লায়েনেসে–মঁপেলিয়রে–হপ্তা তিনেক আগে। পঞ্চাশ পাউন্ডের চেক।

মিস মেরি ডেভিন কে?

লেডি কারফাক্সের পরিচারিকা। কিন্তু তাকে এত টাকা দেওয়া হল কেন সেটাই আবিষ্কার করতে পারিনি। তোমার গবেষণায় রহস্য পরিষ্কার হবে, এ-বিশ্বাস আছে।

আমার গবেষণা মানে?

লসান অভিযানে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে তোমার। তুমি তো জান, বুড়ো আব্রাহাম প্রাণের ভয়ে কাপছে, তাকে ছেড়ে এখন কোথাও যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া লন্ডন ছেড়ে কোথাও বেরোতেও চাই না–প্রথমত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বড়ো একা বোধ করে, দ্বিতীয়ত আমি কোথাও গেলেই লন্ডনের দুবৃত্তদল উল্লসিত হয়। তাই আমি থাকি, তুমি যাও। শব্দ পিছু দু-পেনি খরচ করে টেলিগ্রাম মারফত খবরাখবর পাঠিয়ো।

দু-দিন পরে লসানের হোটেল ন্যাশনাল পৌঁছোলাম। খুব খাতির করলেন ম্যানেজার মসিয়ে মোজার। বেশ কয়েক হপ্তা হোটেলে ছিলেন লেডি কারফাক্স। খুবই পছন্দ করত ভদ্রমহিলাকে। বয়স চল্লিশের বেশি নয়। এখনও সুন্দরী–যৌবনে অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন সন্দেহ নেই। সঙ্গে দামি জড়োয়া ছিল কি না ম্যানেজারের জানা নেই। তবে চাকরবাকরেরা বলত, শোবার ঘরে একটা ভারী ট্রাঙ্কে সবসময়ে তালা লাগিয়ে রাখতেন। পরিচারিকা মেরি ডেভিনকেও সবার খুব পছন্দ ছিল। হোটেলেরই ওয়েটারের সঙ্গে তার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গিয়েছে। ঠিকানা পেতে অসুবিধে নেই। মেয়েটা থাকে মঁপেলিয়রের এগারো নম্বর রু দ্য এ্যজানে। যা শুনলাম, সব লিখে নিলাম। হোমস নিজেও এর চাইতে বেশি ঘটনা জোগাড় করতে পারত না।

শুধু একটা রহস্যই রয়ে গেল। লেডি কারফাক্সের হঠাৎ অন্তর্ধান ঘটল কেন, তা জানা গেল। লসানে বহাল তবিয়তে ছিলেন ভদ্রমহিলা। লেকের ধারের বিলাসবহুল কক্ষে পুরো ঋতুটা কাটিয়ে যাবার ইচ্ছে নাকি ছিল। তা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি হোটেল ছেড়ে চলে গেছেন অযথা এক হপ্তার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে। পরিচারিকা মেরির হবু বর জুলভাইবার্ট বললে, আগের দিন লম্বা কালচে দাড়িওলা এক ভদ্রলোক এসেছিলেন বলেই লেডি কারফাক্স পালিয়ে গেছেন। লোকটা নাকি একটা আস্ত বর্বর! শহরেই কোথাও থাকে। লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে ম্যাডামের সঙ্গে তন্ময় হয়ে কী সব কথা বলছিল যেন। তারপর আবার আসতেই ম্যাডাম আর দেখা করেননি–পরের দিন হোটেল ছেড়ে দিয়ে চলে যান। সেই থেকেই মনে হয় লোকটার ভয়েই ম্যাডাম গা-ঢাকা দিয়েছেন। তবে মেরি ম্যাডামের চাকরি ছেড়ে দিল কেন, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কারণটা মেরি জানতে পারে–মঁপেলিয়রে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

শেষ হল অনুসন্ধান পর্বের প্রথম অধ্যায়। এবার যেতে হবে লেডি কারফাক্স লসান ছেড়ে যেখানে গেছে, সেখানে। কিন্তু এ-জায়গাটা পাঁচজনে জেনে ফেলুক, লেডি কারফাক্সের তা ইচ্ছে ছিল না বলেই বাক্সপ্যাটরায় খোলাখুলি বাদেন-এর লেবেল লাগাননি। কেউ পিছু নিয়েছিল বোধ হয়–তাই অনেক ঘুরপথে মালপত্র এবং নিজে পৌঁছেছেন খনিজ জলের উৎস রেনিজে। কুক-এর স্থানীয় অফিস থেকে জোগাড় করলাম এই খবর। টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিলাম হোমসকে। জবাবে পেলাম একটা কৌতুকতরসিত প্রশংসা।

বাদেন পৌঁছে খবরাখবর পেতে খুব একটা অসুবিধে হল না। ইংলিশচার হফে দিন পনেরো ছিলেন লেডি কারফাক্স, এইখানেই সাউথ আমেরিকার ধর্মপ্রচারক ডক্টর স্লেসিংগার এবং তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। ধার্মিক লোকের সঙ্গ পেলে বর্তে যায় নিঃসঙ্গ মহিলারা লেডি কারফাক্সও যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন ডক্টর স্লেসিংগারের সঙ্গ পেয়ে। ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে ভদ্রলোক স্বাস্থ্যহানি ঘটিয়ে বসেছিলেন বলে প্রাণ কেঁদে ওঠে লেডি কারফাক্সের। তা ছাড়া, ব্যক্তিত্বও নাকি অসাধারণ রকমের। স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে এসে দিনরাত বারান্দায় বসে একটা প্রবন্ধ লিখছিলেন মিডিয়ানটিস রাজ্য সম্পর্কে দু-পাশে বসে সেবা করতেন তাঁর স্ত্রী আর লেডি কারফাক্স। এসব খবর পেলাম ম্যানেজারের মুখে। একটু সেরে উঠলেই লন্ডন রওনা হন সস্ত্রীক ডক্টর স্লেসিংগার। সঙ্গে যান লেডি কারফাক্স। কিন্তু পরিচারিকা মেরি কাঁদতে কাঁদতে জন্মের-মতো-ওর-চাকরি-ছেড়ে-দিচ্ছি বলে চলে গেল কেন, তা ম্যানেজার জানে না। টাকাপত্র সব মিটিয়ে দেন ডক্টর স্লেসিংগার।

সবশেষে ম্যানেজার বললেন, আপনি কিন্তু একাই খোঁজ করতে আসেননি লেডির। হপ্তাখানেক লাগে আর একজন এসেছিলেন।

নাম বলেছে?

না। ইংরেজ ভদ্রলোক–একটু অস্বাভাবিক ধরনের।

শার্লক হোমসের পদ্ধতিতে ঘটনার মালা গাঁথার কায়দায় জিজ্ঞেস করলাম, বর্বর ধরনের লোক বোধ হয়?

ঠিক বলেছেন। হুবহু তাই। চাষাড়ে, চোয়াড়ে, জাঁহাবাজ। শৌখিন হোটেলে না-উঠে চাষাভুষোর হোটেলে উঠলেই বরং মানাত।

অন্ধকারে আলো দেখতে পেলাম এবার। ছিনেজোঁকের মতো লোকটা পেছন ধরে রয়েছে কেন! এর ভয়েই গোপনে পালিয়েছেন লেডি কারফাক্স–এখানেও সে এসে গেছে। লন্ডন পর্যন্ত গিয়ে লেডির নাগাল ধরে ফেলেনি তো? কী মতলবে ঘুরছে পেছনে কুটিল লোকটা? নিশ্চয় কোনো গভীর ষড়যন্ত্র আছে এর পেছনে।

হোমসকে জানালাম রহস্যের মূল ধরে ফেলেছি। ও জবাবে লিখল, ডক্টর স্লেসিংগারের বাঁ-কানটা কীরকম দেখতে বলো তো? মাঝে মাঝে ওর ইয়ার্কি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। রসিকতার সময় এটা নয় বলেই পাত্তা দিলাম না টেলিগ্রামটার। তা ছাড়া টেলিগ্রাম যখন পেলাম, তখন আমি মেরির সন্ধানে মঁপেলিয়র পৌঁছে গেছি।

মেরি বললে, তার নিজের বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে বলে আর সৎসঙ্গে লেডি কারফাক্সের দিন কাটছে দেখে চাকরি ছেড়ে দেয় সে। চাকরি ছাড়তে সুবিধে হয়ে গেল যখন লেডি কারফাক্স নিজেই একদিন তার সততা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ বসলেন। ইদানীং তার মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। কারণ নিশ্চয় সেই চোয়াড়ে জাহাবাজ লোকটা। নিজের চোখে সে দেখেছে, লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে লেডি কারফাক্সের হাত ধরে মোচড়াচ্ছে বদমাশটা। মুখে না-বললেও, লেডি কারফাক্স যে তার হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই ডক্টর স্লেসিংগারের আশ্রয়ে লন্ডন গিয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই মেরির। সবসময় যেন ভয়ে-ভয়ে থাকতেন। এই পর্যন্ত বলেই চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল মেরি।–ওই দেখুন! বদমাশটা এখানে পর্যন্ত এসেছে?

জানলা দিয়ে দেখলাম বিরাটকায় খোঁচা-খোঁচা কালো দাড়িওলা এক পুরুষ ফুটপাত দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির নম্বর দেখছে। নিশ্চয় আমার মতোই মেরিকে খুঁজছে। দেখেই আর দেরি করলাম না। ঝড়ের মতো রাস্তায় বেরিয়ে এলাম।

শুধোলাম, আপনি ইংরেজ?

পাক্কা শয়তানের মতো ভুরু কুঁচকে সে বললে, তা হয়েছেটা কী?

আপনার নামটা জানতে পারি?

না পারেন না।

ফাঁপরে পড়লাম। কিন্তু সোজা পথই অনেক সময়ে সেরা পথ।

তাই দুম করে জিজ্ঞেস করলাম, লেডি ফ্রান্সেস কারফাক্স কোথায়?

অবাক হয়ে চেয়ে রইল লোকটা।

আমি বললাম, ওঁর পেছনে ঘুরছেন কেন? কী করেছেন তাঁর? জবাব দিন! লোকটা বাঘের মতো গর্জে উঠে সটান লাফিয়ে পড়ল আমার ওপর এবং সাঁড়াশির মতো আঙুল দিয়ে টিপে ধরল আমার গলা। চোখে যখন সর্ষেফুল দেখছি, ঠিক তখনই পাশের ক্যাবারে থেকে নীল কুর্তা পরা খোঁচা-খোঁচা দাড়িওলা একজন ফরাসি মজুর তিরের মতো ছুটে এসে হাতের মোটা গেঁটো দিয়ে ধাঁই করে মারল শয়তানটার বাহুতে এক মারেই আঙুল ঢিলে হয়ে গেল রাসকেলের। আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রাগে ফুলতে ফুলতে ভাবল বোধ হয় আমার টুপি টিপে ধরবে কিনা–পরক্ষণেই উল্কাবেগে ঢুকে গেল আমি যে-কটেজ থেকে বেরিয়েছি, সেই কটেজে।

ফরাসি মজুরটা তখনও আমার পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ঘুরে দাঁড়ালাম ধন্যবাদ দিতে। সঙ্গে সঙ্গে সে বললে, ভায়া ওয়াটসন, খুব হয়েছে। আজ রাতের এক্সপ্রেস ট্রেনে চলো আমার সঙ্গে লন্ডনে।

এক ঘণ্টা পর হোটেলে আমার প্রাইভেট রুমে বসে চিরাচরিত ধড়াচূড়া পরে স্বভাবসিদ্ধ নীরস কণ্ঠে বললে হঠাৎ ধূমকেতুর মতো কেন সে ঠিক বিপদের মুহূর্তটিতে আমার পাশে আসতে পেরেছিল। লন্ডনের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় বেরিয়ে পড়েছিল লন্ডন ছেড়ে। মজুর সেজে আগেভাগে এসে বসে ছিল মপেলিয়রে আমার পথ চেয়ে।

ওয়াটসন, অপূর্ব তদন্ত করেছ। সবকটা বিরাট ভুলই নিখুঁতভাবে করে গেছ। যেখানে গেছ, সেখানেই সন্ত্রাস ছড়িয়ে এসেছ, কিন্তু লাভ হয়েছে অষ্টরম্ভা।

তিক্ত কণ্ঠে বললাম, তুমি নিজে তদন্ত করলেও পক্করম্ভা পেতে।

আরে ভায়া, আমি তো আসল কাজটা করে বসে আছি। অনারেবল ফিলিপ গ্রিনকে আবিষ্কার করে ফেলেছি। এই হোটেলেই তিনি রয়েছেন। সার্থক তদন্ত শুরু হবে তো তাকে দিয়েই।

বলতে-না-বলতেই ট্রে-র ওপর একটা কার্ড নিয়ে এল চাকর–পরক্ষণেই ঘরে ঢুকল দাড়িওলা সেই মারকুটে বদমাশটা–যার গলা টিপুনির ঠেলায় এখনও টনটন করছে কণ্ঠদেশ। আমাকে দেখেই কটমট করে চাইল লোকটা।

বলল, এ আবার কী, মি. হোমস? আপনার চিঠি পেয়ে এসে এ-লোকটাকে এখানে দেখছি কেন?

ইনি আমার পুরোনো দোস্ত এবং সহযোগী ডক্টর ওয়াটসন–এ-কাজে ইনি আমাকে সাহায্য করছেন।

ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বিশাল রোদে পোড়া দু-হাত বাড়িয়ে দিলেন আগন্তুক।

বললেন, আশা করি খুব লাগেনি। লেডি কারফাক্সকে আমি লোপাট করেছি বলায় মাথার ঠিক রাখতে পারিনি, আজকাল আমার স্নায়ুর অবস্থা মোটেই ভালো নয়–ধাঁ করে রেগে যাই। এ-পরিস্থিতি আর সইতে পারছি না, মি. হোমস, আগে বলুন আমার খবর পেলেন কোত্থেকে?

লেডি ফ্রান্সেসের গভর্নর মি. ডবনির কাছ থেকে।

তাই নাকি! সুশান বুড়িকে কি এত সহজে ভোলা যায়!

উনিও আপনাকে ভোলেননি। আপনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার আগে থেকেই তো চেনেন আপনাকে।

তাহলে তো সব খবরই জেনে ফেলেছেন। যৌবনে বড়ো দুর্দান্ত জীবনযাপন করছি। লেডি কারফাক্স তা জেনে ফেলে। মনটা খিঁচড়ে যায় আমার ওপর। সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়–অথচ ভুলতে পারেনি। আমার কুকীর্তি ওকে কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে কিন্তু মন থেকে আমার স্মৃতি মুছতে পারেনি। আমার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসায় এতটুকু চিড় খায়নি। সেই কারণেই বিয়ে পর্যন্ত করেনি। বারবারটনে গিয়ে দু-পয়সা করলাম। ভাবলাম এবার ওর মনটা নরম করা যাক। লসানে গিয়ে কাকুতিমিনতি করলাম। মনটা সত্যিই নরম হয়েছে দেখলাম। তারপরেই খবর পেলাম লসান ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে। আসলে ওর মনের জোর সাংঘাতিক। ভাঙবে তবু মচকাবে না। খোঁজখবর নিয়ে এলাম বাদানে। শুনলাম, এখানেই থাকে ওর পুরানো পরিচারিকা। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ডক্টর ওয়াটসন আমাকেই ওর অন্তর্ধানের জন্যে দায়ী করায় মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল। যাক গে সে-কথা, লেডি ফ্রান্সেস কোথায় আপনার জানা থাকলে দয়া করে বলুন।

অদ্ভুতভাবে গম্ভীর হয়ে গেল হোমস। বললে, সেইটাই তো জানতে চাই। আপনার লন্ডনের ঠিকানাটা কী, মিস্টার গ্রিন?

ল্যাংহ্যাম হোটেলে পাবেন আমাকে।

তাহলে আপনি সেখানেই যান। হোটেল ছেড়ে নড়বেন না–দরকার হলে যেন ডাকলেই পাই। মিথ্যে আশা দিতে চাই না–তবে যা করবার সবই করব কথা দিচ্ছি। আমার এই কার্ডটা রাখুন–আপনিও যোগাযোগ রাখবেন। ওয়াটসন, বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে নাও। মিসেস হাডসনকে আমি টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি, কাল সাড়ে সাতটায় বুভুক্ষু দুই ট্রেনযাত্রীর জন্যে ভালোমন্দ খাবার যেন তৈরি থাকে।

বেকার স্ট্রিটে পৌঁছেই হোমস দেখল একটা টেলিগ্রাম এসে পড়ে রয়েছে ওর নামে। খুলে পড়ল। আগ্রহ চিকমিকিয়ে উঠল দুই চোখে, ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। আমি দেখলাম শুধু দুটো শব্দ লেখা রয়েছে টেলিগ্রামে–খাঁজকাটা ছেড়া। টেলিগ্রাম এসেছে বাদেন থেকে।

মানে? শুধোই আমি।

সব মানে তো ওরই মধ্যে। তোমাকে বলেছিলাম পাদরি সাহেবের বাঁ-কানটা দেখতে কীরকম জানাতে–জানাওনি। মনে পড়ে?

আমি তো তখন বাদেন ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি–জানাব কী করে?

সেইজন্যেই ইংলিশচার হফের ম্যানেজারকে আর একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম। এই তার জবাব।

কিন্তু মানেটা কী?

মানেটা হল, আমরা অসাধারণ ছুঁদে আর বিপজ্জনক এক ক্রিমিনালের সঙ্গে লড়তে নেমেছি! সাউথ আমেরিকায় প্রাতঃস্মরণীয় পাদরি সাহেব ডক্টর স্লেসিংগারের আসল নাম হোলি পিটার্স অস্ট্রেলিয়ার বদমাশ শিরোমণি হোলি পিটার্স–যার কীর্তিকাহিনি গায়ে কাঁটা জাগিয়ে ছাড়ে। শয়তানটার কুকাজের বড়ো বৈশিষ্ট্য হল ধর্মপ্রাণা মেয়েদের ধর্মের কথায় ভুলিয়ে ফাঁদে ফেলা। ওর এই বৈশিষ্ট্য জানা আছে বলেই ডক্টর স্লেসিংগারের কাহিনি শুনে সন্দেহ হয় আমার–যাচাই করার জন্যে পাদরির বাঁ-কানের বর্ণনা চেয়েছিলাম। কেননা, ১৮৮৯ সালে অ্যাডিলেডে১১ মারপিট করতে গিয়ে কুকুর-কামড়ানোর মতো কামড়ানো হয় ওর বাঁ-কান। ওর সঙ্গে স্ত্রীর ভূমিকায় যে স্ত্রীলোকটি থাকে, তার আসল নাম ফ্রেজার জাতে ইংরেজ। এই দুজনের পাল্লায় যখন পড়েছেন লেডি ফ্রান্সেস, তখন ধরে নিতে পারি তিনি বেঁচে নেই, অথবা এমন অবস্থায় আছেন যে পাঁচ হপ্তায় একখানা চিঠিও লিখতে পারেননি। হতে পারে ওরা লন্ডনেই পৌঁছোয়নি। তবে সে-সম্ভাবনা কম। কেননা, কন্টিনেন্টাল পুলিশের কাছে এসব বদমাশদের বাঁদরামি গোপন থাকে না–চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যায়। তাই আমার ধারণা লন্ডনেই কোথাও এরা ঘাপটি মেরে আছে–কিন্তু ঠিক কোথায় বলা সম্ভব নয়। আপাতত খেয়েদেয়ে নিয়ে অপেক্ষা করা যাক। সন্ধে নাগাদ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে নিয়ে লেসট্রেডের সঙ্গে দেখা করব।

কিন্তু লেসট্রেড আর হোমস দুজনেই ঘোল খেয়ে গেল। সাত-সাতটা দিন কতরকম চেষ্টাই করা হল। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল, বদমাশদের বিবরে হানা দেওয়া হল, ডক্টর স্লেসিংগারের যেখানে-যেখানে যাওয়া সম্ভব সব জায়গাতেই ছুঁ মারা হল–কিন্তু মহানগরীর কোন গর্তে যে তিনটি মানুষ ঢুকে বসে রয়েছে, সে-হদিশ পাওয়া গেল না। সাত দিন পরে আচমকা খবর এল ওয়েস্টমিনস্টার রোডে বেভিংটনের দোকানে একটা স্পেনীয় ডিজাইনের রুপোর জড়োয়া গহনা বাধা দেওয়া হয়েছে। বাঁধা যে দিয়েছে, তার চেহারাটা পাদরির মতন। লম্বা-চওড়া, দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার কামানো। কানের চেহারা লক্ষ করা যায়নি তবে বাদবাকি চেহারার সঙ্গে স্লেসিংগারের চেহারার মিল আছে।

এই সাতদিনের মধ্যে ল্যাংহ্যাম হোটেল থেকে মিস্টার গ্রিন তিনবার এসেছেন নিখোঁজ প্রেয়সীর খবর নিতে। উৎকণ্ঠায় যে তাঁর অবস্থা শোচনীয়, তা পোশাক-আশাকের ঢিলেঢালা অবস্থা দেখেই মালুম হয়েছে। তৃতীয়বার যখন এলেন, ঠিক তখনই জড়োয়া গয়না বাঁধা দেওয়ার খবরটা এসেছে।

হোমস খবরটা দিল মিস্টার গ্রিনকে। বললে, গয়না বাঁধা দেওয়া শুরু করেছে রাসকেল।

আকুল কণ্ঠে গ্রিন বললেন, আমাকে কিছু একটা করতে দিন মি. হোমস। কিন্তু গয়না বাঁধা দেওয়ার মানে কি এই নয় যে সর্বনাশ হয়ে গেছে লেডি ফ্রান্সেসের?

গম্ভীর হয়ে হোমস বললে, কয়েদ করেও যদি রেখে দেয় মুক্তি দিতে গিয়ে এখন নিজেরাই বিপদে পড়বে। কাজেই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্যেই তৈরি থাকা ভালো।

কী করতে বলেন আমাকে?

ওরা কি আপনাকে চেনে?

না।

তাহলে বেভিংটনের দোকানে গিয়ে ওত পেতে থাকুন–আবার আসতে পারে গয়না বাঁধা দিতে। অন্য দোকানেও যেতে পারে, তবে বেভিংটন টাকা দিয়েছে ভালো, প্রশ্নও করেনিকাজেই ওর কাছেই আবার আসাটা সম্ভব। আপনি কিন্তু হামলা করবেন না। শুধু পেছনে গিয়ে বাড়িটা দেখে আসবেন। কথা দিন আমাকে না-জানিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যাবেন না।

দু-দিন নতুন খবর আনতে পারলেন না অনারেবল ফিলিপ গ্রিন (এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, ইনি বিখ্যাত অ্যাডমিরাল ফিলিপ গ্রিনের ছেলে ক্রিমিয়ান যুদ্ধে অ্যাজোভ সাগরের নৌবাহিনী পরিচালনা করে যিনি বিখ্যাত)। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় উদ্ৰান্ত চেহারা নিয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে হাঁপাতে হাঁপাতে বিবর্ণ মুখে ঘরে ঢুকলেন ভদ্রলোক।

পেয়েছি! ওকে পেয়েছি!

উত্তেজনায় কথা আটকে গেল ভদ্রলোকের। হোমস সান্ত্বনা দিয়ে ঘরে বসিয়ে দিল চেয়ারে।

বলল, আস্তে আস্তে বলুন।

স্লেসিংগারের সঙ্গে যে মেয়েছেলেটা থাকে, সে এসেছিল। যে গয়নাটা বাঁধা দিয়ে গেল, সেটা কিন্তু লেডি ফ্রান্সেসের। মাগির চোখ দুটো বেজির মতো খরখরে। মাথায় বেশ লম্বা, ফ্যাকাশে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্লেসিংগারের সঙ্গিনীই বটে।

দোকান থেকে বেরিয়ে গেল কেনসিংটন রোডে–পেছনে আমি। ঢুকল একটা আন্ডারটেকারের–দোকানে যাদের কাজ মড়া কবর দেওয়া।

চমকে উঠল হোমস। কেঁপে উঠল গলা। বুঝলাম, কীরকম তোলপাড় চলছে ভেতরে। ধূসর শীতল মুখের প্রতিটা মাংসপেশি শক্ত হয়ে গেল কথাটা শুনেই।

তারপর?

কঁচুমাচু মুখে দোকানি মেয়েটা বললে, একটু দেরি হয়ে গেল। কী করব বলুন, বেমক্কা সাইজ, বড় বড়ো। এতক্ষণে পৌঁছে গেছে নিশ্চয়। আমাকে দেখেই চুপ মেরে গেল দুজনেই। আমি ধানাইপানাই করে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে।

খুব ভালো করেছেন। তারপর কী হল?

মাগিটা বেরিয়ে এল–সন্দিগ্ধচোখে এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে একটা ছ্যাকড়াগাড়িতে উঠে বসল। আমাকে দেখতে পায়নি–লুকিয়ে ছিলাম। কপাল ভালো একটা গাড়ি পেয়ে গেলাম। পেছন পেছন গেলাম। সামনের গাড়ি থামল ব্রিক্সটনের ছত্রিশ নম্বর পোল্টনি স্কোয়ারে। আমি সামনে দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে নামলাম পার্কের কোণে। ওখান থেকেই নজর রাখলাম বাড়ির ওপর।

দেখলেন কাউকে?

ওপরের সব জানলা বন্ধ–অন্ধকার। নীচের তলায় একটা জানলাই কেবল খোলা–তাও খড়খড়ি দিয়ে ঢাকা। ভেতরে কাউকে তাই দেখতে পাইনি। হঠাৎ একটা ভ্যান এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। দুজন লোক ধরাধরি করে একটা জিনিস নামিয়ে নিয়ে গিয়ে ঢুকল হল ঘরের দরজা দিয়ে। মিস্টার হোমস, জিনিসটা একটা কফিন।

আ-চ্ছা!

আর একটু হলেই তেড়েমেড়ে ঢুকে পড়তাম ভেতরে। দরজাটা ফাঁক করে ধরেছিল মাগিটা লোক দুজনকে ঢুকিয়ে নেওয়ার জন্যে এই সময় দেখল আমাকে। দেখেই চিনেছে নিশ্চয় চমকে উঠেই দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা। আপনাকে কথা দিয়েছি নিজে কিছু করব না—তাই ছুটতে ছুটতে আসছি খবরটা দিতে।

খসখস করে একটা কাগজে কী লিখতে লিখতে হোমস বলল, অপূর্ব কাজ করেছেন। ওয়ারেন্ট ছাড়া এখন আর কিছু করা মানেই বেআইনি কাজ করা। আপনি এটা নিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে চলে যান। লেসট্রেড ওয়ারেন্ট বার করে দেবে। জড়োয়া গয়না পাওয়া গেছে এর সাহায্যেই লেসট্রেড পারবে শমন ধরাতে।

কিন্তু এর মধ্যে ওকে তো খুন করেও ফেলতে পারে? কফিনটা এল কেন? কার জন্যে?

অযথা সময় নষ্ট করবেন না–ও-ব্যাপারটা ছেড়ে দিন আমাদের ওপর, মিস্টার গ্রিনকে ঠেলেঠুলে ঘর থেকে বিদেয় করে আমার দিকে ফিরল হোমস। ওয়াটসন, উনি গেলেন আইনের পথে–দরকার পড়লেই চিরকাল যা করেছি। পরিস্থিতি খুব খারাপ–চরম ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া পথ দেখছি না। এক্ষুনি চল পোল্টনি স্কোয়ার যাই।

পার্লামেন্ট হাউসের পাশ দিয়ে আর ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজের ওপর দিয়ে নক্ষত্ৰবেগে ছুটল আমাদের গাড়ি। ভেতরে বসে হোমস বললে, ওয়াটসন, লেডি ফ্রান্সেসকে ছুতোনাতা করে পরিচারিকার কাছ থেকে সরিয়ে রাসকেলরা এনে ফেলে লন্ডনের ওই ভাড়া বাড়িটায়। চিঠিপত্র যদিও-বা লিখে থাকেন লেডি–সে-চিঠি এরা গায়েব করেছে। এদের আসল উদ্দেশ্য ছিল গয়না দখল করা–এতদিনে সে-কাজও করেছে। তাই একটা একটা করে গয়না বাঁধা দিতে আসছে। এখন আর লেডি কারফাক্সকে জ্যান্ত ছেড়ে দেওয়া যায় না তাই তাকে খুন করাই ওদের পক্ষে মঙ্গল।

সেটা তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

এবার আর এক লাইন ধরে চিন্তা করা যাক। দু-লাইনের যুক্তি যেখানে কাটাকুটি করবে–সেইটাই আসল সত্যি বলে জানবে। আমরা এখন লেডিকে ছেড়ে কফিনকে নিয়ে চিন্তা করব। বাগান খুঁড়ে লাশ পুঁতে দিলেই যখন ল্যাটা চুকে যায়, তখন এত হেপাজত করে কফিন আনা হল কেন? পুরো ব্যাপারটাই আইনসংগত হচ্ছে। তাই না? মেডিক্যাল সার্টিফিকেট আর সরকারি অনুমতি না-থাকলে কাউকে কফিনে করে কবর দেওয়া যায় না। তাহলে কি বিষ খাইয়ে অথবা এমনভাবে লেডিকে খুন করা হয়েছে যে ডাক্তারের চোখে ধূলো দেওয়া হয়েছে? ডাক্তার কিন্তু হাতের লোক না হলে এ-অবস্থায় লাশের ধারেকাছেও কেউ আসতে দেয় না। তবে কি ডাক্তার ওদেরই লোক? এটা কিন্তু সম্ভব বলে মনে হয় না।

মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জাল করেনি তো?

সেটা আরও বিপজ্জনক, ওয়াটসন। এসে গেছি–ওই তো বন্ধকি দোকান ছাড়িয়ে এলাম। দাঁড়াও হে গাড়োয়ান! নামমা ওয়াটসন। তোমার চেহারা এমনি যে দেখলেই বিশ্বাস হয়—কারো সন্দেহ হয় না। সোজা ঢুকে পড়ো। জিজ্ঞেস করো, আগামীকাল পোল্টনি স্কোয়ারের কফিন কবরে যাবে ক-টার সময়ে।

বিনা দ্বিধায় দোকানের মেয়েটি বললে, সকাল আটটার সময়ে।

হোমস শুনে বললে, দেখলে তো, যেভাবেই হোক রাস্তা পরিষ্কার রেখেছে রাসকেলরা–সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে আইনসংগতভাবে কবর দিতে চলেছে লেডিকে। আর দেরি করা চলে না। আইনের পথে যেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে–পুলিশের আশায় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা আর সম্ভব নয়। কপাল ঠুকে দেখাই যাক না কেন। হাতিয়ার আছে কাছে?

ছড়িটা আছে!

ওতেই হবে। আইনের রক্তচক্ষুকে ওরা যখন আর পরোয়া করে না, তখন বেআইনিভাবে সোজা হামলা জুড়ে দেখা যাক কাজ হয় কি না। ওহে গাড়োয়ান, তুমি যেতে পারো। চলো ওয়াটসন।

পোল্টনি স্কোয়ারের মাঝামাঝি জায়গায় একটা বড়োসড়ো কালচে রঙের বাড়ির সামনে গিয়ে খুব জোরে ঘন্টা বাজিয়ে দিল হোমস। সঙ্গেসঙ্গে কপাট খুলে দাঁড়াল ঢ্যাঙা মতন একটা মেয়েছেলে।

হল ঘরের ম্যাড়মেড়ে আলোর পটভূমিকায় কালো ছায়ামূর্তিটাই কেবল চোখে পড়ল আমাদের। শুধোল তীক্ষ্ণ্ণ কণ্ঠে, কী চাই?

ডক্টর স্লেসিংগারের সঙ্গে কথা বলতে চাই, ঝটিতি জবাব দিল হোমস।

ও-নামে এখানে কেউ থাকে না, বলেই যেই দরজা বন্ধ করতে যাবে, একটা দরজার ফাঁকে পা ঢুকিয়ে দিল হোমস।

বলল কড়া গলায়, যে-নামেই থাকুক না কেন, দেখা করতে চাই।

দ্বিধায় পড়ল স্ত্রীলোকটি। পরক্ষণেই দু-হাট করে দরজা খুলে ধরে বললে, আসুন ভেতরে। আমার স্বামী কাউকে ডরায় না। হল ঘরের ডান পাশে বসবার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে, বসুন। আসছেন মিস্টার পিটার্স।

বেরিয়ে গেল মেয়েটি। পোকায় খাওয়া ধুলোয় ভরা ঘরটার চেহারা ভালো করে দেখবার আগেই বেড়ালের মতো নিঃশব্দ চরণে ঘরে ঢুকল সৌম্যদর্শন টাক মাথা দাড়ি গোঁফ কামানো বিরাট একটা লোক–মুখটা আশ্চর্য লাল, পুরন্ত গাল–কিন্তু ঠোঁটের গড়ন নিষ্ঠুর, পাশবিক।

বলল সহজ সুরে, ভুল করেছেন মনে হচ্ছে। যাকে খুঁজছেন, তাকে আর একটু এগোলেই–

শক্ত গলায় হোমস, ব্যস, ওতেই হবে। নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। তুমি হেনরি পিটার্স ওরফে রেভারেন্ড ডক্টর স্লেসিংগার। আমার নাম শার্লক হোমস।

চমকে উঠল লোকটা। খরখরে চোখে চাইল ভয়ানক মানুষটার দিকে। বললে চিবিয়ে চিবিয়ে, মিস্টার হোমস, আপনার নাম শুনে আঁতকে ওঠার কারণ দেখি না। বিবেক আমার পরিষ্কার। কী জন্যে এসেছেন এখানে?

বাদেন থেকে সঙ্গে যাকে পাকড়ে এনেছ, সেই লেডি কারফাক্সকে নিয়ে কী করেছ জানতে চাই।

ভদ্রমহিলা কোথায় আমাকে যদি বলেন তো আমারও খুব উপকার হয়। প্রায় এক-শো পাউন্ড পাই তার কাছ থেকে। বাদেনে অন্য নাম নিয়েছিলাম ঠিকই, সেই সময়ে ভদ্রমহিলা ভাব জমালেন আমার স্ত্রীর সঙ্গে। আঠার মতো পেছনে লেগে থেকে আসেন লন্ডনেও। হোটেলের বিল, টিকিট–সব, সব আমি মিটিয়েছি। লন্ডনে এসেই হাওয়া হয়েছেন–ফেলে গেছেন কয়েকটা যাচ্ছেতাই সেকেলে গয়না–দেনা মিটোনোর জন্যে নিশ্চয়ই। মিস্টার হোমস, খুঁজে বার করুন তাকে আর আমার দেনাটা মিটিয়ে দিন।

খুঁজে বার করব বলেই তো এসেছি। এ-বাড়ি তন্নতন্ন করে দেখব এখুনি।

শমন এনেছেন?

পকেট থেকে রিভলভারটা একটু টেনে বার করে দেখাল শার্লক হোমস, আপাতত এই শমনেই কাজ হবে–এর চাইতে ভালো শমন পরে আসছে।

আচ্ছা ছিঁচকে চোর তো আপনি!

প্রফুল্ল কণ্ঠে হোমস বললে, আমার এই স্যাঙাতটিও কিন্তু বিপজ্জনক লোক। এ-বাড়ি তল্লাশ করব দুজনেই।

দরজা খুলে ধরে পিটার্স বললে, অ্যানি পুলিশ ডাক! মেয়েলি স্কার্টের খসখস আওয়াজ শুনলাম সিঁড়িতে দুম করে খুলেই বন্ধ হয়ে গেল হল ঘরের দরজা।

ওয়াটসন! দ্রুত কণ্ঠে বললে হোমস, সময় খুব কম। পিটার্স, বাধা দিতে এস না–জখম হবে। কফিনটা কোথায়?

কফিন নিয়ে আপনার কী দরকার? একটা ডেডবডি রয়েছে ওর মধ্যে।

আমি দেখব বডিটা।

আমি দেখতে দেব না।

তাহলে নিজেই দেখব,হন হন করে হল ঘরে ঢুকে গেল হোমস। পাশের দরজাটা আধখোেলা দেখে ঢুকে পড়ল সেই দরজা দিয়ে। খাবার ঘর সেটা। ম্যাড়মেড়ে গ্যাসের আলোটা বাড়িয়ে দিতেই চোখে পড়ল টেবিলের ওপর শোয়ানো কফিনটা। ডালা খুলে ফেলল হোমস। ভেতরে শুয়ে সিটিয়ে যাওয়া জরাজীর্ণ এক বৃদ্ধা। হাজার অনাহার, উৎপীড়ন অসুখেও এ-চেহারায় আসতে পারেন না সুন্দরী লেডি ফ্রান্সেস কারফাক্স। যুগপৎ বিস্ময় আর স্বস্তিবোধ ফুটে উঠল হোমসের চোখে-মুখে।

হে ভগবান! এ যে দেখছি অন্য একজন।

মিস্টার শার্লক হোমসও ভুল করেন তাহলে! পেছন পেছন এসে মিষ্টি মিষ্টি করে বলল পিটার্স।

কে এ?

আমার স্ত্রীর বুড়ি নার্স–রোজ স্পেন্ডার। ব্রিক্সটন ওয়ার্কহাউস ইনফার্মারি থেকে নিয়ে আসি তিনদিন আগে, তেরো নম্বর ফেয়ার ব্যাঙ্ক ভিলা থেকে ডক্টর হস্লোমকে এনে চিকিৎসা করাই এই তিনদিন–ঠিকানাটা মুখস্থ করে ফেলুন মিস্টার হোমস। তিনদিন সবরকম চেষ্টা করেও লাভ কিছু হল না–মারা গেলেন তৃতীয় দিনে। ডাক্তার বলছেন বুড়ি হয়েছে বলে টিকে থাকতে আর পারল না–আপনি কী বলবেন সেটা আপনিই ভেবে নিন। ধার্মিক খ্রিস্টানের মতোই তাকে বাঁচাতে গিয়েছি, না-পেরে কবর দেওয়ার ব্যবস্থাও করছি। কেনিংটন রোডের স্টিমসন কোম্পানিকে বলে দিয়েছি কাল সকাল আটটায় যেন কবর দেওয়া হয় কফিনটা। হ্যাঁদা পেলেন মিস্টার ছিদ্রান্বেষী? আস্ত গাধার মতো এমন ভুলও মানুষে করে? কফিনের ডালা খোলার সময়ে আপনার হাঁ-করা চোখ-ঠেলে বেরিয়ে আসা মুখের চেহারাটার ফটো তুলে রাখলে পারতাম। ভেবেছিলেন দেখবেন অন্তিম শয়ানে শুয়ে আছেন লেডি ফ্রান্সেস কারফাক্স। তার বদলে দেখতে পেলেন নব্বই বছরের এ-বুড়িকে।

ঠাট্টা বিদ্রুপের তুফানের মধ্যেও অবিচলিত রইল শার্লক হোমস। ভেতর ভেতর যে ফুঁসছে, তা বোঝা গেল দু-হাত মুঠো করা দেখে।

বলল, বাড়িটা তল্লাশ করব।

করা বার করছি আপনার! তীক্ষ্ণ্ণ কণ্ঠে বললে পিটার্স। বাইরের প্যাসেজে শোনা গেল নারীকণ্ঠ এবং একাধিক পদশব্দ। এইদিকে আসুন, এই দেখুন–এই দুটো লোক বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে হামলা জুড়েছে–কিছুতেই বেরোতে চাইছে না। ঘাড় ধরে বের করে দিন তো।

দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল একজন সার্জেন্ট আর একজন কনস্টেবল। পকেট থেকে নিজের কার্ড বার করে এগিয়ে দিল হোমস, এই আমার নাম-ঠিকানা। ইনি আমার বন্ধু ডক্টর ওয়াটসন।

আপনাকে কে না চেনে, মিস্টার হোমস। কিন্তু স্যার শমন ছাড়া এখানে আর থাকতে তো পারবেন না, বললে সার্জেন্ট।

তা পারব না।

গ্রেপ্তার করুন! চিৎকার করে বলল পিটার্স।

সেটা আমার কাজ, আমি বুঝব, গ্রামভারী চালে বললে সার্জেন্ট। মিস্টার হোমস, আপনার কিন্তু এখানে আর থাকা হবে না।

চলো, ওয়াটসন।

রাস্তায় এসে রাগে অপমানে গরম হয়ে গেলাম আমি–হোমস কিন্তু নির্বিকার। পেছন পেছন সার্জেন্ট বেরিয়ে এসে বললে, মিস্টার হোমস, আমি দুঃখিত। কিন্তু আইন যা, তা মানতেই হবে।

ঠিক কথা, সার্জেন্ট। আপনার আর কিছু করার ছিল না।

কারণ ছিল বলেই বাড়ি ঢুকেছিলেন বুঝতে পারছি। আমাকে দিয়ে যদি কোনো সাহায্য হয় তো বলতে পারেন।

একজন নিখোঁজ লেডির খোঁজে গিয়েছিলাম। বাড়ির মধ্যেই আছেন ভদ্রমহিলা। শমনও এল বলে।

বেশ তো, আমি চোখ রাখছি। খবর পেলেই জানাব আপনাকে।

সবে তখন ন-টা বাজে। তদন্ত চালিয়ে গেলাম পুরোদমে। সোজা গেলাম ব্রিক্সটন ওয়ার্কহাউস আতরশালায়। সত্যিই দিন তিনেক আগে এক সহৃদয় দম্পতি এসে তাদেরই এক পুরোনো চাকরানিকে নিয়ে গেছে। মারা গেছে বুড়ি? আশ্চর্য কিছু নয়। অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।

এর পর গেলাম ডাক্তারের কাছে। তিনি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্রেফ জরায় ধুকতে ধুকতে পরলোকে গিয়েছে বুড়ি। আমি তো গিয়ে দেখলাম শেষ হয়ে গিয়েছে। লিখে দিলাম ডেথ সার্টিফিকেট। না, বাড়ির মধ্যে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। তবে হ্যাঁ, একটা খটকা লেগেছে। ওইরকম দানধ্যানের মন আর পকেটের জোর যাদের, তাদের বাড়িতে একটা চাকর পর্যন্ত নেই, এ কেমন কথা?

শেষকালে গেলাম স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। গিয়ে শুনলাম শমন বার করা নিয়ে নাকের জলে চোখের জলে হচ্ছে বেচারি লেসট্রেড। দেরি একটু হবেই। আগামীকাল সকালের আগে সই পাওয়া যাবে না ম্যাজিস্ট্রেটের। শার্লক হোমস যদি লেসট্রেডের সঙ্গে সকাল নটা নাগাদ একটু তদবির করেন তো ভালো হয়। মাঝরাত নাগাদ এল সার্জেন্ট। বললে, বিশেষ কিছু খবর নেই। বিশাল বাড়িটার নানান জানলায় মাঝে মাঝে কেবল আলোর ঝলক দেখা গেছে।

মেজাজ খিঁচড়ে যাওয়ায় কথা বলার মুডে পর্যন্ত রইল না হোমস। শুতে যাওয়ার সময়ে দেখলাম পাইপের পর পাইপ কড়া তামাক টেনে চলেছে আর সরু সরু কাঁপা আঙুল দিয়ে সমানে টরে টক্কা বাজনা বাজিয়ে চলেছে চেয়ারের হাতলে। এ-লক্ষণ আমার চেনা। সমস্যার অনেকগুলো সম্ভাব্য সমাধান মাথার মধ্যে নিয়ে তোলপাড় করার সময়ে এমনি অস্থির হয়ে পড়ে ও। সারারাত বেশ কয়েকবার তন্দ্রার ঘোরে শুনলাম পায়চারি করছে বাড়িময়। সকাল বেলা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল ঘরে। পরনে ড্রেসিং গাউন, কিন্তু ফ্যাকাশে মুখ আর গর্তে-বসা চোখ দেখেই বুঝলাম নিদ্রাদেবীকে বিমুখ করেছে সারারাত।

কবর দেওয়া হবে ক-টার সময়ে ওয়াটসন? আটটা তো? এখন বাজে সাতটা কুড়ি। এখনও সময় আছে, ওয়াটসন, এখনও সময় আছে। মাথায় আমার কী আছে বলতে পার? ব্রেনটা কি ঘুমিয়েছিল? তাড়াতাড়ি নাও, ঝটপট গা তোলো! জীবন ঝুলছে সুতোর ওপর কে জানে এতক্ষণে মরণ এসে গেল কি না। এ ভুলের জন্যে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না নিজেকে। তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি!

পাঁচ মিনিটও গেল না, বেকার স্ট্রিট দিয়ে আমাদের নিয়ে উল্কাবেগে যেন উড়ে চলল একটা ঘোড়ার গাড়ি। আটটা বাজতে পঁচিশ মিনিটের সময়ে পেরিয়ে এলাম বিগবেন১৭, ঠিক আটটার সময়ে ঢুকলাম ব্রিক্সটনে, আটটা দশে বাড়িটার দোরগোড়ায়। আমাদের মতো অপরপক্ষরও দেরি হয়েছিল। ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘোড়া যখন দাঁড়াল, ঠিক তখনই চৌকাঠের ওপর দিয়ে একটা বিরাট কফিন ধরাধরি করে বার করে আনা হল বাইরে। ছিলেহেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে গেল হোমস।

পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে একদম সামনের লোকটার বুকে ঠেলা দিয়ে বললে তারস্বরে, ফিরে চলো! ফিরে চলো! এক্ষুনি ফিরে চলো!

কফিনের পেছন থেকে বিরাট লাল মুখখানা আরও লাল করে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল পিটার্স, আবার কী শয়তানি করতে এসেছেন? শমন কোথায়?

শমন আসছে না–আসা পর্যন্ত কফিন বাড়িতে থাকবে।

হোমসের কণ্ঠস্বরের কর্তৃত্ব অমান্য করা বড়ো কঠিন–সেইমুহূর্তে প্রত্যেকেই স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেল চৌকাঠে। নিমেষমধ্যে বাড়ির মধ্যে উধাও হল পিটার্স। ফলে, হোমসের হুকুম

-মেনে পারল না কুলিরা। টেবিলে কফিন রাখতে-না-রাখতেই একটা ভ্রু-ড্রাইভার আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললে ক্ষিপ্তের মতো, তাড়াতাড়ি হাত চালাও, ওয়াটসন! যত তাড়াতাড়ি পার ডালাটা খোলো। আর একটা ক্রু-ড্রাইভার একজন কুলির হাতে গুঁজে দিয়ে বললে, এই নাও, তুমিও খোলো–এক মিনিটের মধ্যে খুলতে পারলে এক মোহর বকশিশ! একটার পর একটা ⇒ খুলে ছিটকে যেতে লাগল মেঝের ওপর–আর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল হোমসের উত্তেজনা–তুবড়ির মতো ছুটল কথার ফুলকি, খুলেছে! খুলেছে! আর একটা স্কু খুলেছে। প্রশ্ন নয়–একদম প্রশ্ন নয়! আরও খুলছে! নাও, এবার সবাই মিলে চাড় মারো–টান মারো–হেঁইয়ো! খুলে গেছে! খুলে গেছে!

সবাই মিলে গায়ের জোরে টেনে খুলে ফেললাম কফিনের ডালা। সঙ্গেসঙ্গে ভক করে নাকে ঢুকল ক্লোরোফর্মের কড়া গন্ধ। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল সেই গন্ধে। ভেতরে শায়িত একটা নারীদেহের সারামুখটা ঢাকা রয়েছে জ্ঞানলোপকারী এই আরকে ভিজানো তুলোর আস্তরণে টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিল হোমস বেরিয়ে পড়ল মাঝবয়েসি এক মহিলার আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যে সুন্দরী সুশ্রী মুখশ্রী। চকিতের মধ্যে মূর্তির তলায় হাত দিয়ে উঠিয়ে বসিয়ে দিল হোমস।

ওয়াটসন বেঁচে আছে না, মারা গেছে? খুব দেরি করে ফেললাম কি?

আধঘণ্টা ধরে মনে হল সত্যিই বড়ো দেরি করে ফেলেছি। ক্লোরোফর্মের জন্যেই হোক কি দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্যেই তোক মনে হল জীবনের শেষ দ্বার পেরিয়ে গেছেন লেডি ফ্রান্সেস–বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি আর ওঁকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। তা সত্ত্বেও চালিয়ে গেলাম কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস বওয়ানোর চেষ্টা, ইথার ইঞ্জেকশন, বিজ্ঞান যা কিছু জেনেছে, তার কোনো পদ্ধতিটাই বাদ দিলাম না। তারপর যেন মনে হল, নাকের সামনে আয়না ধরলে সামান্য ঝাঁপসা দেখাচ্ছে, চোখের পাতা অল্প অল্প কাঁপছে এবং পলায়মান প্রাণ আবার ফিরে আসছে। এই সময়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। খড়খড়ি ফাঁক করে দেখল হোমস। বলল, লেসট্রেড এসে গেছে শমন নিয়ে কিন্তু যার জন্যে আনা সে তো ভাগলবা! ওই তো আর একজন আসছেন–ভারী পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল প্যাসেজে লেডিকে সেবা করার অধিকার আমাদের চাইতে এঁরই বেশি। আসুন, মিস্টার গ্রিন। লেডি ফ্রান্সেসকে এখুনি এখান থেকে সরানোর ব্যবস্থা করুন। আর হ্যাঁ, কফিন নিয়ে যাও ওর মধ্যে যে-বুড়িটা শুয়ে আছে, তাকে শান্তির শয্যায় শুইয়ে দাও।

সেইদিন রাতেই হোমস বললে, ওয়াটসন, এ-কাহিনি যদি কখনো লেখ, তবে তা আমার এই অত্যন্ত সাজানো গোছানো ব্রেনের মারাত্মক পদস্থলনের নজির হয়ে থাকবে চিরকাল। মস্তিষ্কের এ-রকম বাহারে রোগ সবারই মাঝে মাঝে হয়–এ ধরনের সাংঘাতিক ভুল সব মানুষই করে কিন্তু ভুলটা ধরতে পেরে যে-মানুষ শুধরে নিতে পারে, তাকেই বলব মানুষের মতন মানুষ। এ-মর্যাদার যোগ্য কেবল আমিই। কেননা সমস্ত রাতটা আমি অস্থির হয়ে কেবল একটা সূত্র, একটা কথা মনে আনবার চেষ্টা করেছি। বার বার মনে হয়েছে, সামান্য এই কথাটা আমার গোচরে আনা হয়েছিল। কিন্তু আমি খেয়াল করিনি। কথাটা অদ্ভুত, বিচিত্র একটা পর্যবেক্ষণ, কিন্তু সূত্র হিসেবে অসাধারণ। অথচ আমি শুনেও শুনিনি–মনে রাখিনি। ভোরবেলা বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়ে গেল কথাটা। কবর দেওয়ার ব্যবস্থা যে করে, তার বউ বলেছিল–শুনে ফেলেছিলেন মিস্টার গ্রিন–একটু দেরি হয়ে গেল। কী করব বলুন, বেমক্কা সাইজ–বড় বড়ো। এতক্ষণে পৌঁছে গেছে নিশ্চয়। বেমক্কা সাইজ বড় বড়ো বলতে কী বোঝাচ্ছিল বুঝেছ? কফিন–কফিন! কফিনের কথা হচ্ছিল। আকারে বড়া সাধারণ কফিনের মতো নয়। কেন? এ-রকম বেয়াড়া মাপে কফিন তৈরি হল কেন? সঙ্গেসঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠল সুগভীর কফিনের মাঝখানে শোয়ানো ছোট্ট একটা দেহ গুটিয়ে এইটুকু হয়ে যাওয়া বুড়ির মৃতদেহ। কেন? এইটুকু দেহের জন্যে এতবড়ো কফিন কেন? আর একটা দেহ রাখবার জন্যে। কিন্তু কবর দেওয়া হবে একই ডেথ সার্টিফিকেটের জোরে। এত সোজা ব্যাপারটা আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল বুদ্ধির গোড়ায় গলদ জমেছিল বলে। ঠিক আটটায় কবরস্থ হবেন লেডি ফ্রান্সেস। গাড়ি থেকে কফিন বেরিয়ে যাওয়ার আগেই আটকাতে হবে আমাদের যেভাবেই হোক।

জীবিত পাব কি না জানি না–তবুও মরিয়া হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। তার দামও পেয়েছি–প্রাণটা গিয়েও বলতে পার ফিরে এসেছে সময়মতো পৌঁছোতে পেরেছিলাম বলে। যদূর জানি, এরা খুন-টুনের ধার দিয়েও যায় না। মারপিটের সম্ভাবনা দেখলেই সরে পড়ে। লেডি ফ্রান্সেসকে কবর দেওয়া হবে মৃত অবস্থায়–অথচ যদি কোনোদিন কবর খুঁড়ে দেখা হয় তো মৃত্যুর কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমার বিশ্বাস ঠিক এই লাইনেই চিন্তা করেছিল পিটার্স। এরপর কী কী ঘটেছিল, মনে মনে ভেবে নিতে পার। সিঁড়ির ওপরে কি কাছে আমরা দেখিনি। ওপরতলাতেই একটা খুপরিতে বন্দিনী ছিলেন লেডি ফ্রান্সেস অ্যাদ্দিন। দুজনে দৌড়ে গেছে সেখানে, গায়ের জোরে নাকে ক্লোরোফর্ম চেপে ধরেছে, ধরাধরি করে এনে কফিনে শুইয়েছে। কফিনের মধ্যে আরও ক্লোরোফর্ম ঢেলেছে যাতে জ্ঞান ফিরে না-পায়, তারপর স্ক্র এঁটে ডালা বন্ধ করে দিয়েছে। ওয়াটসন, এ-রকম অপূর্ব কায়দা এত বছরেও আমার চোখে পড়েনি। অপরাধের ইতিহাসে এ-ঘটনা একেবারে নতুন। লেসট্রেডের হাত ফসকে প্রাক্তন-পাদরি যদি সত্যিই লম্বা দেয়, শিগগিরই আরও চমকপ্রদ অপরাধের পর অপরাধের সংবাদ কানে আসবে তোমার।

———-

টীকা

লেডি ফ্রান্সেস কারফাক্সের অন্তর্ধান রহস্য : স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন এবং আমেরিকান ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর ১৯১১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় দ্য ডিস্যাপিয়ারেন্স অব লেডি ফ্রান্সেস কারফাক্স। জানা যায়, প্রথম পাণ্ডুলিপিতে লেডি ফ্রান্সেস উল্লিখিত হয়েছিলেন লেডি মারিয়া নামে। আমেরিকান ম্যাগাজিনে গল্পটির শিরোনাম ছিল দ্য ডিস্যাপিয়ারেন্স অব লেডি কারফাক্স।

টার্কিশ বাথ : স্টিম বাথ বা বাষ্পের দ্বারা স্নানের তুর্কি সংস্করণ। ভিক্টোরীয় যুগে ইংলন্ডে এই ধরনের স্নান জনপ্রিয়তা লাভ করে।

লসান : সুইজারল্যান্ডে, লেক জেনেভার তীরবর্তী শহর। জেনেভা শহর থেকে বাষট্টি কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে এর অবস্থান। শহরের উত্তর পশ্চিমে জুরা পর্বতমালা অবস্থিত।

মঁপেলিয়র : প্রথম খণ্ডের টীকা দ্রষ্টব্য। এই শহরের এক ল্যাবরেটরিতে ১৮৯১ থেকে ১৮৯৪-এর অজ্ঞাতবাসের সময়ে কয়েকমাস পরীক্ষানিরীক্ষা করেন হোমস।

বাদেন : জার্মানির ব্যাদেন-ব্যাদেন কিংবা সুইজারল্যান্ডের ব্যাদেন-এর মধ্যে যেকোনো একটি জায়গা হওয়া সম্ভব।

রেনিজ : রাইন নদীর তীরবর্তী অঞ্চল। মধ্য ইউরোপের এই অঞ্চল বিখ্যাত রাইনল্যান্ড নামে।

কুকস-এর স্থানীয় অফিস : ১৮৪১-এর ৯ জুন প্রতিষ্ঠিত থমাস কুক ট্রাভল এজেন্সি। ব্যাপটিস্ট ধর্মপ্রচারক থমাস কুক (১৮০৮-১৮৯২) লাফবরোতে একটি সভায় যোগ দেওয়ার জন্য সহকর্মীদের প্রস্তাব দেন একসঙ্গে ভ্রমণ করতে এবং মিডল্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানির সঙ্গে ব্যবস্থা করেন আলাদা কয়েকটি কামরায় মাথাপিছু এক শিলিং ভাড়ায় পাঁচশো যাত্রীকে নিয়ে যেতে। এতে যে অর্থের সাশ্রয় হয়, তাই দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি নিজেই ব্যাবসা শুরু করেন দলবদ্ধভাবে ভ্রমণ করাতে। কুকের ব্যাবসা ইংলন্ডের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে ১৮৫৫ সাল থেকে। লসেন শহরে কুক কোম্পানির অফিস খোলা হয় ১৮৯১-এ।

মিডিয়ানটিস রাজ্য : ওল্ড টেস্টামেটে বর্ণিত, ইস্রায়েলাইটদের সঙ্গে সম্পর্কিত, আরব মরুভূমির যাযাবর জাতি মিডিয়ানটিস। এঁরা হলেন আব্রাহামের ছেলে মিডিয়ানের বংশধর। মোজেসের স্ত্রী জিফোরা ছিলেন মিডিয়ানটিস পুরোহিত জেথ্রোর কন্যা। তবে মিডিয়ানটিস রাজ্য নামে আলাদা কোনো রাজ্য ছিল না।

বারবারটন : দক্ষিণ আফ্রিকার ডি কাপ উপত্যকায় মাকনজোয়া পর্বতমালায় অবস্থিত শহর। এই শহরের সন্নিহিত বারবার্স রীফ অঞ্চলে ১৮৫৪ সালে সোনার খনি আবিষ্কৃত হয়।

ল্যাংহ্যাম হোটেল : লন্ডনের পোর্টল্যান্ড প্লেসে অবস্থিত এই হোটেলে আর্থার কন্যান ডয়ালের সঙ্গে লিপিনকট ম্যাগাজিনের সম্পাদক যোসেফ মার্শাল স্টডার্টের দ্য সাইন অব ফোর উপন্যাসের প্রকাশন সম্পর্কিত আলোচনা হয়েছিল।

অ্যাডিলেড : দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর।

ওয়েস্টমিনস্টার রোড : লন্ডনে এই নামে কোনো রাস্তা নেই। হোমস সম্ভবত ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ রোডের কথা বোঝাতে চেয়েছেন।

বেভিংটনের : সম্ভবত ভিক্টোরীয় যুগের বিখ্যাত অলংকার বিক্রেতা ব্র্যাভিংটন্স।

ক্রিমিয়ান যুদ্ধ : দ্য গ্লোরিয়া স্কট গল্পের টীকা দ্রষ্টব্য।

অ্যাজোভ সাগর : স্থলে ঘেরা বিশাল হ্রদ অ্যাজোভ বা আজফ সাগর আসলে ব্ল্যাক সি-র উত্তর দিকের অংশ। কার্চ (Kerch) প্রণালী এটিকে ব্ল্যাক সি-র সঙ্গে যুক্ত করেছে।

ব্রিক্সটন ওয়ার্কহাউস ইনফার্মারি : ইংলন্ডে ওয়ার্কহাউস দরিদ্র মানুষদের কাজের সুযোগ দেওয়ার জন্য ১৬০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তা ছাড়া দরিদ্র এবং অসুস্থদেরও রাখা হত এখানে। এখানকার বাসিন্দাদের বেওয়ারিশ মৃতদেহ অ্যানাটমির ক্লাসে ব্যবহার করা হত ১৮৩৩ সালের আইনে। ব্রিক্সটন ওয়ার্কহাউস ইনফার্মারি সংস্থাটি অবশ্য কাল্পনিক।

বিগবেন : লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার প্যালেসের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত টাওয়ারের চারমুখো ঘড়ির ঘণ্টার আদরের ডাকনাম বিগবেন হলেও সম্পূর্ণ টাওয়ারটিকেই বিশ্ববাসী চেনেন বিগবেন নামে। ১৮৫৮-র দশই এপ্রিল এর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল।

ইথার ইঞ্জেকশন : ইথারের গন্ধ রোগীকে অ্যানিস্থিসিয়া দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হলেও হৃৎপিণ্ডকে স্টিমুলেট করতে ইথার ইঞ্জেকশন দিতেন চিকিৎসকরা। কিন্তু, এখানে প্রশ্ন ওঠে ওই তাড়াহুড়োয় ইথার ইঞ্জেকশন জোগাড় হল কোথা থেকে? ওয়াটসন কি তার ডাক্তারি সরঞ্জাম সবসময়ে সঙ্গে রেখে দিত?