‘লুপ্ত সহর’ লিখিলাম বটে—কিন্তু আসলে সে সহর এখনও একেবারে লোপ পায় নাই। সহরের পথঘাট, দোকানপাট এমনকি ঘরের আসবাব পর্যন্ত অনেক জায়গায় ঠিক রহিয়াছে অথচ সে সহর আর এখন সহর নাই—সেখানে লোক থাকে না, কোন কাজ চলে না—মাঝে মাঝে নানা দেশ হইতে লোক আসে কিন্তু সেও কেবল ‘তামাসা’ দেখিবার জন্য।
পম্পেয়াই—আড়াই হাজার বৎসরের পুরাতন সহর, ইটালির পাগলা পাহাড় ভিসুভিয়াস তাহাতে ছাই চাপা দিয়া আগুন ঢালিয়া একেবারে সহরকে সহর বুজাইয়া দিয়াছিল। প্রায় আঠার শত বৎসর এমনিভাবে সহর চাপা পড়িয়াছিল—সেখানে যে সহর ছিল সেই কথাই লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল—কারণ বাহির হইতে সহরের চিহ্নমাত্র দেখা যাইত না। চাষারা নিশ্চিন্তে চাষ করিত, লোকে স্বচ্ছন্দে চলা-ফিরা করিত, কাহারও মনে হয় নাই যে এই মাটি খুঁড়িলেই প্রকাণ্ড সহর বাহির হইয়া পড়িবে। তারপর, সে প্রায় একশত বৎসরের কথা, সেই মাটির নিচ হইতে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব জিনিস বাহির হাইতে লাগিল। বাড়ির টুকরা, পাথরের বেদী, বাঁধান রাস্তা এইসকল দেখিয়া তখন লোকের মনে পড়িল দু হাজার বৎসর আগে এইখানে প্রকাণ্ড সহর ছিল।
পম্পেয়াই বড় যেমন-তেমন সহর ছিলা না—সেকালের ইতিহাসে লেখে, তিন লক্ষ লোক সে সহরে বাস করিত। জায়গাটা সমুদ্রের ধারে আর খুব স্বাস্থ্যকর, তাই বড় বড় রোমান ধনীরা অনেকে সেখানে থাকিতেন। খুব জমকালো সহর বলিয়া সে সময় পম্পেয়াই-এর খুব নাম ছিল। ভিসুভিয়াসের যে কোনরকম দুষ্ট মতলব আছে তাহা কেহ জানিত না তাই একেবারে পাহাড়ের গা ঘেঁষিয়া সহর বসান হইয়াছিল।
সহর ধ্বংস হয় ৭৯ খৃষ্টাব্দে। তখন রোমান ধনীরা তাঁহাদের সুন্দর সহরকে সুন্দর করিয়া সাজাইয়া আরামে আলস্যে দিন কাটাইতেছেন—পম্পেয়াই সহর বাবুয়ানায় মত্ত। কোন বিপদের চিহ্ন নাই, তখন বলিতে গেলে পৃথিবীময় রোমান রাজ্য—রোমের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, রোমানদের সঙ্গে শত্রুতা করে কার সাধ্য! লোকে নিশ্চিন্ত আছে কোথাও ভয় নাই! মাঝে মাঝে একটু আধটু ভূমিকম্প হইত, পাহাড়ের ভিতরে গুর গুর শব্দ শোনা যাইত, কিন্তু তাহাতেও লোকের বিশেষ কোন ভয় নাই। কিছুদিন দেখিয়া শুনিয়া সকলেরই সেসব অভ্যাস হইয়া গেল। তারপর একদিন হঠাৎ পাহাড়ের চূড়া ভাঙিয়া কালো ধোঁয়া দম্কা হাওয়ার মতো চারিদিকে ছুটিয়া বাহির হইল। সেই ধোঁয়ায় পঞ্চাশ মাইল পথ এমন অন্ধকার হইয়া গেল যে মাটি আর আকাশ তফাৎ করা যায় না। তারপরে খানিকক্ষণ গরম ধূলার তুফান চলিল। ইহার মধ্যে যাহারা সহর ছাড়িয়া পলাইয়াছিল তাহাদের অনেকে বাঁচিতে পারিয়াছিল। কিন্তু সহরের মধ্যে একজন লোকও বাঁচে নাই। ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ চমকাইতে লাগিল, ক্রমাগত ভয়ানক বাজ পড়িতে লাগিল। ভূমিকম্প আরম্ভ হইল, বাড়িঘর ঠক্ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল, ভিসুভিয়াস সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলিয়া ফুলিয়া শেষটায় ভয়ানক শব্দে ফাটিয়া গেল। পাহাড়ের ভিতর হইতে লক্ষ লক্ষ মণ জ্বলন্ত পাথর ছিটকাইয়া চারিদিকে আগুন বৃষ্টি করিতে লাগিল। ইহার পরেও হয়ত অনেক লোক বাঁচিতে পারিত কিন্তু এখানেই বিপদের শেষ হইল না। ভিসুভিয়াসের ভিতরকার পাথর গরমে গলিয়া ভাঙা পাহাড়ের ফাটল দিয়া সহরের উপর গড়াইয়া পড়িল, সমস্ত সহরটা যেন টগ্বগ্ করিয়া ফুটিয়া উঠিল। অনেকে আগুনের ভয়ে সমুদ্রের দিকে পলাইয়াছিল কিন্তু সেখানেও রক্ষা নাই। এই প্রলয় কাণ্ডের মধ্যে সমুদ্র কি স্থির থাকিতে পারে? সে প্রথমটা তীর হইতে পিছাইয়া গেল। দেখিয়া বোধ হইল যেন সমুদ্র আগুনের ভয়ে হটিয়া যাইতেছে। সমুদ্রের জন্তুগুলি শুকনা ডাঙায় পড়িয়া কত যে মারা গেল তাহার ঠিক নাই। কিন্তু সমুদ্র যাইবে কোথায়? একটু পরেই ভূমিকম্পের একটা ধাক্কার সঙ্গে সে আবার আসিয়া পড়িল, এবং নৌকা ঘরবাড়ি পথঘাট যাহা ছিল সমস্ত ভাঙিয়া ভাসাইয়া প্রমাণ করিয়া দিল যে, ‘আমিও বড় কম নই।’ জল, মাটি, আকাশ—এই তিনের রেষারেষির মধ্যে পড়িয়া দেখিতে দেখিতে দেশটার চেহারা বদলাইয়া গেল। ভিসুভিয়াসের উপরটা আগে ছাদের মতো সমান ছিল—সেই জায়গাটা বাটর মতো গর্ত হইয়া গেল—সেই বাটির মধ্যে আবার একটা নূতন ছুঁচাল চূড়া বাহির হইল। আর পম্পেয়াই?—পম্পেয়াই যেখানে ছিল সেখানে প্রায় ত্রিশ হাত উঁচু পাথর মাটি আর ছাই!
সেই পম্পেয়াই আবার এতদিন পরে মানুষে কত যত্নে খুঁড়িয়া খুঁড়িয়া বাহির করিতেছে। দু হাজার বৎসর আগে মানুষেরা কি খাইত, তাহাদের ঘর বাড়ির বন্দোবস্ত কিরকম ছিল, তাহাদের হাট বাজার সরাইখানা সভাঘর মন্দির কিরূপ ছিল এখন আমরা চোখের সামনে দেখিতে পাই। ভিসুভিয়াস একদিকে যেমন সহরটাকে নষ্ট করিয়াছে আর একদিকে আবার সেই ভাঙা সহরকে ছাই চাপা দিয়া এতকাল আশ্চর্যরকম রক্ষা করিয়াছে। খুঁড়িতে খুঁড়িতে কত মানুষের মৃতদেহ পাওয়া যায়—সেগুলি সমস্তই জমিয়া পাথর হইয়া রহিয়াছে। কোন জায়গায় দু-একটি, কোথাও অনেকগুলি লোক একত্র মরিয়া আছে। কোথাও মা অন্ধকারে তাঁহার শিশুকে খুঁজিতে গিয়া মারা পড়িয়াছেন। কাহারও হাতে টাকার থলি, কাহারও হাতে গহনার বাক্স।
চারিদিকে ভয়ের ছবি; লোকে ব্যস্ত হইয়া চারিদিকে পলাইয়াছে—অন্ধকারে পথ হারাইয়া দিক্বিদিক ভুলিয়া পাগলের মতো ছুটিয়াছে। এই গোলমাল ব্যস্ততার ঠিক মধ্যেই এক রোমান প্রহরী ফটকে পাহারা দিতেছিল। আশ্চর্য তাহার সাহস, সে তাহার জায়গা ছাড়িয়া এক পা-ও নড়ে নাই, পালাইবার চেষ্টাও করে নাই। ফটকে থাকিতে হইবে এই তাহার কর্তব্য—সুতরাং ‘যো হুকুম!’ সে ফটকের সামনে খাড়া থাকিয়াই মারা গেল এবং এইরূপ অবস্থাতেই অস্ত্রশস্ত্র বর্মশুদ্ধ তাহার দেহ পাওয়া গিয়াছে। কর্তব্য-নিষ্ঠার এরূপ আশ্চর্য পরিচয় জগতে খুব কমই পাওয়া যায়।
এখন সেই সহরের মধ্য দিয়া হাঁটিয়া যাইতে কেমন অদ্ভুত লাগে। অনেক জায়গায় দু হাজার বৎসর আগে যে জিনিসটি যেখানে ছিল একনও ঠিক তেমনি আছে—এক জায়গায় একটা টেবিলে খাওয়া-দাওয়া চলিতেছিল হঠাৎ লোকে খাওয়া ফেলিয়া পালাইয়াছে—সেই টেবিল সে খাওয়া তেমনি রহিয়াছে—রুটিটা জমিয়া পাথরের মতো হইয়া গিয়াছে—ছিপি-আঁটা মাটির বোতলে মদ ছিল, সেই মদ পর্যন্ত ঠিক রহিয়াছে! এক জায়গায় হাঁড়িতে কি যেন জ্বাল হইতেছিল—সেই হাঁড়ি এখনও চুল্লির উপর সেইভাবে বসান রহিয়াছে। কোন জায়গায় বাড়ির ইঁট পুড়িয়া ঝামা হইয়া গিয়াছে; আবার কোথাও সাদা টালি, লালা কালো নানারকম পাথরের কাজ, সমস্তই পরিষ্কার রহিয়াছে। একটা দেয়ালের গায়ে বিজ্ঞাপন লেখা আছে-
“আসেলিনাস্ ও স্মাইরিনে বলিতেছেন—ফস্কাস্কে তোমাদের অলডারম্যান পদে নিযুক্ত কর।” ফস্কাস্ বেচারা এই সম্মান পাইয়াছিল কিনা তাহা জানিবার আর কোন উপায় নাই।