লিওনের একঘেয়ে জীবন

লিওনের একঘেয়ে জীবন

০১.

ঘরে ঢুকতেই ত্ৰিণার বুকটি কেন জানি কেঁপে উঠল। কোয়ার্টজের স্বচ্ছ জানালার সামনে মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লিওন। অসাধারণ রূপবান এই মানুষটির এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে কী যেন একটা অস্বাভাবিকতা আছে, হঠাৎ দেখলে বুকের মাঝে কোথায় জানি একটা ছোট ধাক্কা লাগে। লিওনকে দেখে ত্রিণা হঠাৎ কেন জানি ব্যাকুল হয়ে উঠে, দুই পা এগিয়ে গিয়ে নরম গলায় বলল, লিওন–

লিওন ঘুরে তাকাল। তার মাথার চুল এলোমেলো। অনিন্দ্যসুন্দর মুখে এক ধরনের কাঠিন্য, জ্বলজ্বলে নীল চোখ দুটিতে এক ধরনের অসুস্থ অস্থিরতা। ত্রিণাকে দেখে তার মুখের কাঠিন্য সরে সেখানে খুব ধীরে ধীরে এক ধরনের অসহায় বিষণ্ণতা ভর করে। ত্রিণা আরো এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে লিওন?

লিওন কয়েক মুহূর্ত ত্রিণার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরের আদিগন্ত বিস্তৃত শহরটিকে দেখাচ্ছে একটা অপার্থিব জগতের মত। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে লিওন একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, বাইরে দেখ, কী সুন্দর!

লিওনের গলার স্বর শুনে ত্রিণা হঠাৎ কেন জানি শিউরে ওঠে। সে এগিয়ে গিয়ে লিওনের হাত স্পর্শ করে এক ধরনের আর্তকণ্ঠে বলল, তোমার কী হয়েছে লিওন?

আমার কিছু হয় নি।

হয়েছে। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। বল আমাকে।

লিওন ঘুরে ত্ৰিণার দিকে তাকাল, তার সোনালি চুল, কোমল ত্বক, মুখে ছেলেমানুষি এক ধরনের সারল্য, শরতের নির্মেঘ আকাশের মতো নীল চোখ এবং এই মুহূর্তে চোখ দুটিতে এক ধরনের অসহায় ব্যাকুলতা। লিওন একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, সারা পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই মেয়েটির জন্যে তার বুকের ভিতরে সত্যিকারের খানিকটা ভালবাসা রয়েছে। সে ত্রিণাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, আমার কিছু হয় নি ত্রিণা।

ত্রিণা মাথা নেড়ে বলল, না লিওন হয়েছে। আমি তোমাকে খুব ভালো করে জানি। আমি নিজেকে যেটুকু জানি, সময় সময় তোমাকে তার থেকে অনেক ভালো করে জানি। তোমার কিছু একটা হয়েছে।

লিওন একদৃষ্টিতে ত্ৰিণার দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। ত্রিণা আবার ব্যাকুল গলায় বলল, বল আমাকে।

বলব?

হ্যাঁ, বল কী হয়েছে তোমার?

লিওন একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে করছে না ত্রিণা।

ত্রিণা হঠাৎ অমানুষিক আতঙ্কে শিউরে উঠে লিওনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল, না, লিওন এ রকম কথা বোলো না।

আমি বলতে চাই নি, তুমি শুনতে চেয়েছ।

কিন্তু তোমার কথা তো সত্যি হতে পারে না। পৃথিবীতে একজন মানুষ তার জীবনে যা চাইতে পারে তুমি তার সব পেয়েছ, তোমার কেন বেঁচে থাকার ইচ্ছে করবে না?

মনে হয় সেজন্যেই।

কী বলছ তুমি!

হ্যাঁ ত্রিণা। লিওন বিষণ্ণ গলায় বলল, মনে হয় সেজন্যেই আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে করে না। একজন মানুষের জীবনে যা–কিছু পাওয়া যেতে পারে আমি তার সব পেয়েছি। অর্থ বিত্ত মান সম্মান সাফল্য এমনকি ভালবাসা–সত্যিকারের ভালবাসা, তাও আমি পেয়েছি তোমার কাছে। আমার দেহে কোনো রোগ নেই, আমার বুকে কোনো শোক নেই, জীবনে কোনো ব্যর্থতা নেই, কোনো জটিলতা নেই, কোনো কুটিলতা নেই, কোনো হিংস্রতা নেই–কী ভয়ঙ্কর একঘেয়ে জীবন। একজন মানুষ যখন সবকিছু পেয়ে যায়, যখন তার জীবন একদম একঘেয়ে হয়ে যায় তখন জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে যায়, আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে করে না। সবকিছু তখন এত অর্থহীন মনে হয়।

মিথ্যা কথা! ত্রিণা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, সব মিথ্যা কথা। মানুষের জীবন কখনো অর্থহীন হয়ে যায় না।

যায়। লিওন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে।

ত্রিণা হঠাৎ লিওনকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে লিওন

লিওন চমকে উঠে ত্ৰিণার দিকে তাকাল, কী একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি এ কথাটি কেন বললে ত্রিণা?

আমি জানি না কেন বলেছি। কিন্তু তোমার কথা শুনে কেন জানি মনে হল তুমি বুঝি আমাকে ছেড়ে যাবে লিওন। তুমি কি সত্যিই যাবে?

লিওন কোনো কথা বলল না। ত্রিণার মুখ খুব ধীরে ধীরে রক্তশূন্য হয়ে আসে, সে পিছনে সরে এসে ঘরের দেয়াল ধরে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ভয় পাওয়া চোখে লিওনের দিকে তাকিয়ে থাকে। লিওন এক পা এগিয়ে এসে আবার নরম গলায় বলল, তুমি এ রকম একটি কথা কেন বললে ত্রিণা?

 ত্ৰিণা অপ্রকৃতিস্থের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আমি জানি, আমি জানি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি তোমার চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি।

লিওন কেমন যেন বিষণ্ণ চোখে ত্রিণার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ত্রিণা, বাইরে তাকিয়ে দেখ, কুয়াশায় সব ঢেকে যাচ্ছে আর দেখতে কী সুন্দর লাগছে!

লিওনের গলার স্বর শুনে ত্রিণা আবার শিউরে উঠে কাঁপা গলায় বলল, তুমি কোথায় যাবে লিওন?

লিওন বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি শীতলঘরে যাব।

শীতলঘরে?

হ্যাঁ ত্রিণা। প্রথমে ভেবেছিলাম আত্মহত্যা করব। দশ তলা একটি বিল্ডিং থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়া বা মাথার মাঝে একটা ছোট বুলেট কিংবা ধমনীতে এক ফোঁটা বিষয় কিংবা অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে গভীর একটা ঘুম। যখন ঘুমের কথা ভাবছিলাম তখন হঠাৎ শীতলঘরের কথা মনে হল। সেটি মৃত্যুর মতোই কিন্তু তবু পুরোপুরি মৃত্যু নয়। হয়তো ভবিষ্যতে কোনোকালে আবার জীবন ফিরে পাব। সেটি কবে হবে কেউ জানে না। হয়তো এক শ বছর বা এক হাজার বছর। কিংবা কে জানে হয়তো লক্ষ বছর, কেউ সেটা বলতে পারে না। পৃথিবী কেমন হবে তখন কেউ জানে না। হয়তো আমার জীবন তখন এ রকম একঘেয়ে মনে হবে না, এ রকম অর্থহীন হবে না। কে জানে ভবিষ্যতের সেই মানুষের জীবনে হয়তো আবার বেঁচে থাকার একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে।

ত্রিণা দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার সমস্ত শরীর অল্প অল্প করে কাঁপছে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অসম্ভব রূপবান মানুষটিকে ঘিরে তার সমগ্র জীবন। এর বাইরে তার কোনো জগৎ নেই–এই মানুষটিকে ছাড়া সে কেমন করে বাঁচবে? তার দুই চোখ পানিতে ভরে আসে, চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসে, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে সে ভাঙা গলায় বলল, লিওন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। যেও না। আমি আর তুমি চলে যাব দক্ষিণের পাহাড়ি অঞ্চলে। সবকিছু ছেড়ে চলে যাব। নিঃস্ব মানুষ যেরকম কষ্ট করে বেঁচে থাকে, ঠিক সেরকম আমরা কষ্ট করে বেঁচে থাকব। দেখবে তখন তোমার জীবনকে অর্থহীন মনে হবে না। সারাদিন ঘুরে ঘুরে আমরা জ্বালানি আনব, একমুঠো খাবার আনব, রাতে আমরা সেই একমুঠো খাবার ভাগাভাগি করে খেয়ে আগুনের সামনে বসে থাকব। দেখবে তুমি তোমার জীবনকে একঘেয়ে মনে হবে না, অর্থহীন মনে হবে না।

লিওন কয়েক পা এগিয়ে এসে ত্রিণাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে কোমল গলায় বলল, আমি দুঃখিত ত্ৰিণা, আমি খুব দুঃখিত। পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার কোনো আপনজন নেই, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হবে কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। আমাকে যেতেই হবে। আমি আর পারছি না ত্রিণা।

ত্ৰিণা হঠাৎ আকুল হয়ে কেঁদে উঠল। শক্ত হাতে লিওনকে আঁকড়ে ধরে বলল, না লিওন। তুমি যেও না। যেও না।

লিওন ত্রিণার মাথায় হাত বুলিয়ে গভীর ভালবাসায় বলল, আমাকে যেতেই হবে ত্রিণা। আমার আর কিছু করার নেই।

গভীর শূন্যতায় হঠাৎ ত্রিণার বুকের ভিতর হাহাকার করে ওঠে।

০২.

লিওন কানো একটি সিলঝিনিয়ামের ক্যাপসুলে শুয়ে আছে। তার সারা শরীর নিও পলিমারের অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ে ঢাকা। মাথার কাছে একটি গোল জানালা, সেখানে একজন কমবয়সী টেকনিশিয়ানের মুখ দেখা যাচ্ছে। ক্যাপসুলটির বাইরে কন্ট্রোল প্যানেলে সে কিছু একটা করছে। টেকনিশিয়ানটি হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনি কি প্রস্তুত?

আমি প্রস্তুত।

আপনাকে শেষবারের মতো প্রশ্ন করছি, আপনি কি স্বেচ্ছায় শীতলঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন?

লিওন শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ, আমি স্বেচ্ছায় শীতলঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।

আপনি জানেন যে কবে আপনাকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে সেটা কেউ জানে না।

আমি জানি।

সেটা এক শ বছর হতে পারে, এক হাজার বছর হতে পারে আবার এক লক্ষ বছর হতে পারে।

আমি জানি।

আপনাকে কখনো পুনরুজ্জীবিত নাও করা হতে পারে। শীতলঘরেই আপনার মৃত্যু হতে পারে।

আমি জানি।

ভবিষ্যতে কিছু একটা সমস্যা হতে পারে, দুর্যোগ হতে পারে। আপনার দেহ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

আমি জানি।

আপনার দেহ পুনরুজ্জীবিত করার পর কিছু একটা বড় ধরনের ভুল হয়ে যেতে পারে, আপনার দেহে অকল্পনীয় বিকৃতি হতে পারে, আপনার অমানুষিক যন্ত্রণা হতে পারে, অসহনীয় কষ্ট হতে পারে। আপনি সেটা জানেন?

লিওন চেষ্টা করে নিজের গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখে বলল, আমি সেটা জানি।

বেশ, মহামান্য লিওন। আপনাকে তাহলে শীতলঘরে নিয়ে যাব। প্রথমে আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হবে, গভীর ঘুম। সেই ঘুমন্ত দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে আনব ধীরে ধীরে। আপনি প্রস্তুত?

আমি প্রস্তুত।

আপনি কি কাউকে কিছু বলে যেতে চান?

চাই। আমার ভালবাসার মেয়েটির নাম ত্রিণা। আমি ত্রিণাকে বলে যেতে চাই যে আমি তাকে ভালবাসি, লক্ষ বছর পরেও যখন আমাকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে তখনো আমি তাকে ভালবাসব।

টেকনিশিয়ানটি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি মহামান্য ত্রিণাকে আপনার শেষ কথাটি জানিয়ে দেব। আপনার ভবিষ্যৎ যাত্রা শুভ হোক মহামান্য লিওন। শুভ যাত্রা।

টেকনিশিয়ানের কথাটি শেষ হবার আগেই সিলঝিনিয়ামের কালো ক্যাপসুলটির মাঝে খুব ধীরে ধীরে একটা সঙ্গীতের সুর ভেসে আসে, তার সাথে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ। লিওন চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, বিদায় পৃথিবী। বিদায়। কিছুক্ষণের মাঝেই সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে।

০৩.

গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে আছে। শুধু অন্ধকার নয় সাথে এক ধরনের বিস্ময়কর নীরবতা, পরিপূর্ণ শব্দহীনতা। নৈঃশব্দ্যের এক বিচিত্র জগৎ। বিশাল শূন্যতায় মহাকাল যেন স্থির হয়ে আছে। এই শূন্যতার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। এখানে সময় স্থির হয়ে আছে। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে থাকা স্থির সময়ে নৈঃশব্দ্যের একটি অপার্থিব জগৎ।

০৪.

অন্ধকার নৈঃশব্দ্যের জগতে চেতনার প্রথম স্পর্শ হল খুব সাবধানে। অত্যন্ত সূক্ষ্ম সেই অনুভূতি। এত সূক্ষ্ম সেই অনুভূতি যে সেটি আছে কি নেই সেটি বোঝা যায় না। মনে হয়। একটি নিউরন বুঝি পাশের নিউরনকে স্পর্শ করেছে খুব সাবধানে। সেই সূক্ষ্ম অনুভূতি জেগে রইল বহুকাল। তারপর সেটি আরো একটু বিস্তৃত হল। আরো একটু প্রবল হল। এখন সেটি সত্যিকারের অনুভূতি। সত্যিকারের চেতনা। সেটি সুখের চেতনা নয়, দুঃখের চেতনা নয়। আনন্দ বা বেদনার চেতনা নয়। শুধুমাত্র অনুভব করা যায় সেরকম একটি চেতনা। লিওন প্রথমবার তার অস্তিত্বকে অনুভব করল, প্রথমবার নিজেকে বলল, আমি লিওন। আমি বেঁচে আছি। বেঁচে আছি।

কিন্তু বেঁচে থাকার সেই অনুভূতি খুব অস্পষ্ট অনুভূতি। সত্যি কি সে লিওন? সত্যি কি সে বেঁচে আছে? নাকি এটি ধরাছোঁয়ার বাইরের একটি অনুভূতি। শুধু একটি অনুভূতি? লিওন দীর্ঘকাল আবছায়ার মতো সেই অনুভূতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে রইল। তারপর একদিন সেই অনুভূতি আরো একটু স্পষ্ট হল, আরো একটু প্রবল হল। লিওন প্রথমবার অনুভব করল সে সত্যি লিওন। সে সত্যি বেঁচে আছে, তার অনুভূতিও সত্যি। দুঃখ, কষ্ট, ভালবাসা, আনন্দ, যন্ত্রণা নয়, শুধু একটি অনুভূতি–সত্যিকারের অনুভূতি।

সেই অনুভূতির জগৎ গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা, সেখানে কোনো আলো নেই, শব্দ নেই, কারো স্পর্শ নেই, কম্পন নেই। পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ্যের এক অপার্থিব শীতল অন্ধকার জগৎ। কতকাল তাকে অসহায়ভাবে অপেক্ষা করতে হবে?

ধীরে ধীরে তার চেতনা আরো প্রবল হয়,অনুভূতি আরো স্পষ্ট হয়। সে নিজেকে আরো গভীরভাবে অনুভব করে। তার স্মৃতি ফিরে আসে। তার শৈশবের কথা মনে হয়, যৌবনের কথা মনে হয়। ব্যর্থতার কথা মনে হয়, সাফল্যের কথা মনে হয়। তার ভালবাসার কথা মনে হয়, ত্রিণার কথা মনে হয়। কোথায় আছে এখন ব্রিণা? কত বছর পার হয়েছে এখন? কতকাল? কোথায় আছে এখন সে? নিশ্চয়ই সে মারা গেছে বহুকাল আগে। কখন সে কারো একটু কথা শুনবে? একটু দেখবে? একটা কিছু স্পর্শ করবে? কখন সে একটু কথা বলবে?

চারদিকে গাঢ় অন্ধকার, নৈঃশব্দ্যের দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে ঢাকা। তার মাঝে সমস্ত চেতনা উন্মুখ করে লিওন অপেক্ষা করে। একটু আলোর জন্যে অপেক্ষা করে একটু শব্দ, একটু হাতের ছোঁয়া। কিন্তু মহাকাল যেন স্থির হয়ে গেছে, তার বুঝি আর মুক্তি নেই। নিঃসীম অন্ধকারে বুঝি সে চিরকালের জন্যে বাঁধা পড়ে গেছে।

একদিন সে প্রথমবার একটা শব্দ শুনতে পেল। সত্যিই কি শব্দ? নাকি কেউ চেতনায় এসে প্রশ্ন করেছে? কে একজন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

লিওন আকুল হয়ে বলতে চাইল, আমি লিওন। লিওন। কিন্তু সে কোনো কথা বলতে পারল না। কেমন করে বলবে? তার চেতনা ছাড়া এখনো যে কিছুই নেই।

কিন্তু কী আশ্চর্য! যে প্রশ্ন করেছে সে তার কথা বুঝতে পারল, তাকে বলল, তুমি লিওন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি লিওন। তুমি কে?

আমি? অদৃশ্য জগৎ থেকে সেই প্রাণী হঠাৎ নিপ হয়ে গেল। লিওন প্রাণপণে সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইল, আমি কোথায়? আমাকে দেখতে দাও। কথা বলতে দাও। আমাকে জাগিয়ে দাও। কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। কেউ তার কথার উত্তর দিল না।

তারপর আবার বুঝি বহুকাল কেটে গেল। কী ভয়ঙ্কর বৈচিত্র্যহীন জীবন। গভীর অন্ধকারে এক নৈঃশব্দ্যের জগৎ যার কোনো শুরু নেই, যার কোনো শেষ নেই। যে জগৎ থেকে কোনো মুক্তি নেই। দুঃখ নেই কষ্ট নেই আনন্দ–বেদনা নেই, শুধুমাত্র তিল তিল করে বেঁচে থাকা। না জানি কতকাল এভাবে বেঁচে থাকতে হবে।

তারপর আবার একদিন সে কথা শুনতে পেল, কেউ একজন তাকে জিজ্ঞেস করছে, তুমি কেমন আছ লিওন?

লিওন আকুল হয়ে বলল, ভালো নেই, আমি ভালো নেই।

কেন তুমি ভালো নেই? তোমার কি কোনো কষ্ট হচ্ছে?

না আমার কোনো কষ্ট নেই। আমার কোনো দুঃখ নেই। আনন্দ বেদনা যন্ত্রণা কিছু নেই। এ এক ভয়ঙ্কর জীবন। আমি এর থেকে মুক্তি চাই।

অদৃশ্য প্রাণী অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে মুক্তি চাও?

আমাকে জাগিয়ে দাও

দীর্ঘ সময় কেউ কোনো উত্তর দিল না, তারপর অদৃশ্য মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। তোমাকে আমরা কেমন করে জাগাব?

মানুষকে যেভাবে জাগায়।

কিন্তু

কিন্তু কী?

অদৃশ্য জগতের সেই প্রাণী দ্বিধান্বিত গলায় বলল, তুমি তো মানুষ নও।

লিওন হতচকিত হয়ে বলল, তুমি কী বললে?

প্রাণীটি চুপ করে রইল। লিওন আতঙ্কিত গলায় বলল, আমি মানুষ নই?

না।

তাহলে আমি কী?

তুমি একটি মানুষের স্মৃতি। একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম, হলোগ্রাফিক মেমোরিতে ধরে রেখে যন্ত্রের মাঝে বাঁচিয়ে রাখা একটি মানুষের স্মৃতি। যে মানুষের স্মৃতি সেই মানুষটি বহুকাল আগে মারা গেছে। নীল চোখের সুপুরুষ একজন মানুষ।

মারা গেছে?

হ্যাঁ।

আমি সেই মানুষের স্মৃতি?

হ্যাঁ।

আমার–আমার মৃত্যু নেই?

না তোমার মৃত্যু নেই। কম্পিউটার প্রোগ্রামের মৃত্যু হয় না।

লিওন ভয়ঙ্কর আতঙ্কে পাথর হয়ে বলল, আমি এভাবে বেঁচে থাকতে চাই না, আমাকে ধ্বংস কর–ধ্বংস কর–

মানুষটি কোনো উত্তর দিল না। লিওন শুনল সে চাপা গলায় কাউকে ডাকছে, বলছে, দেখ স্মৃতির প্রোগ্রামটা কী বিচিত্র ব্যবহার করছে। এস দেখে যাও।

লিওন দেখতে পেল না কিন্তু সে জানে অনেক মানুষ একটি যন্ত্রকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সে যন্ত্রে সে চিরদিনের জন্যে বাঁধা পড়ে আছে।

চিরদিনের জন্যে।