লাল নীল – ৫

পাঁচ

হীরা সিং বললে, আমি তো বলেছিলাম, কপার টাউনের বাতাসে ক্রাইমের গন্ধ আরও উগ্রভাবে পাওয়া যাচ্ছে। দেখলে তো?

অয়ন বললে, হুঁ, ব্ল্যাকমেল করার পরিণাম একই দেখছি। ধীরাজ ডাক্তারও একই কারণে মরেছে। কিন্তু হংকং সাংহাই ফেরত দুর্দান্ত বেপরোয়া ডন রিভাস যে একটা মেয়ের হাতে মরবে ভাবতে পারিনি।

হীরা সিং বললে, না, কান্তা কালেলকরের হাতে ডন খুন হয়নি।

তবে মরল কিসে?

বিষে?

বিষে!—

বিষে!—অয়ন অবাক হয়ে বললে, নদীর ধারে বিষ এল কোথা থেকে?

হীরা সিং বললে, সিগারেটে ছিল। মার্শ টেস্ট করে ডনের হাতের সিগারেটে আর্সেনিয়াম অক্সাইড পাওয়া গেছে।

স্তম্ভিত হয়ে গেল অয়ন।

হীরা সিং বললে, তুমি কেমিস্ট্রির ভাল ছাত্র ছিলে, তুমি নিশ্চয় জানো কী মারাত্মক বিষ ওটা—

জানি।—অয়ন বললে, একটা সুস্থ সবল মানুষকে মারবার জন্যে আর্সেনিয়াম অক্সাইডের ০.১ গ্রামই যথেষ্ট। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, টাকা দেবার ছল করে এসে কেউ ডনকে ওই বিষাক্ত সিগারেট অফার করেছিল, আর সেই সিগারেট খেয়ে ডনের ব্ল্যাকমেল করার সাধ জন্মের মতো মিটে গেছে! তাই না?

ঠিক তাই।

একটু ভেবে অয়ন বললে, কিন্তু ওই সিগারেট কান্তাও তো অফার করতে পারে—

হীরা সিং প্রশ্ন করলে, কান্তা কালেলকর কি স্মোক করে?

না, কখনো দেখিনি।

তাহলে? যে সিগারেটর খায় না, সে হঠাৎ সিগারেট বার করে আমায় অফার করলে আমি কি করব? আমার সন্দেহ হবে—আমি সিগারেট নেব না। সুতরাং পাছে ডনের সন্দেহ হয়, এই ভেবে কান্তা নিশ্চয় তাকে সিগারেট অফার করতে শিলাইয়ের ধারে যায়নি। আমার ধারণা, খুনি নায়ক কান্তার বদলে অন্য লোককে পাঠিয়েছিল।

না হীরা সিং—অয়ন বললে, দলের দু—দুটো লোক বিশ্বাস ভঙ্গ করার পর সে আর কাউকে ব্ল্যাকমেল করার সুযোগ দেবে বলে মনে হয় না। আমার বিশ্বাস, কোনো লোককে না পাঠিয়ে সে নিজেই গিয়েছিল চিরকালের মতো ডনের মুখ বন্ধ করে দিতে। ধীরাজ ডাক্তারের মোটরের টাই—রড সে নিজেই খুলে রেখেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই চতুর নায়ক, যে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আজও কপার টাউনে অবাধে—

জুতোর আওয়াজে অয়ন আর হীরা সিং থানা—ঘরের দরজার দিকে তাকাল।

একজন কনস্টেবলের সঙ্গে স্বয়ং নীলাদ্রি আসছে।

অবাক হয়ে উভয়ে উঠে দাঁড়াল। হীরা সিং বললে, মিস্টার গুপ্ত, আপনি থানায়।

থমথমে মুখ আর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর নিয়ে নীলাদ্রি বললে, না এসে আর উপায় কি ইন্সপেক্টর? কপার টাউনে একটার পর একটা যা ঘটছে, তা দেখে—শুনে আর স্থির থাকা সম্ভব নয়। এই কপার টাউন—আমার শ্বশুরের হাতে—গড়া এই তামা—নগরী বড় শান্তির জায়গা ছিল। আজ এটা ‘প্যানিক টাউন’—আতঙ্ক—নগরী হয়ে দাঁড়িয়েছে! ডন খুব হওয়ার পর লোকে আর এখানে থাকতে চাইছে না। তাই বাধ্য হয়েই আপনার কাছে আসতে হল।

হীরা সিং সংযত গলায় বললে, পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করছে মিস্টার গুপ্ত।

নীলাদ্রির মুখে সেই পেটেন্ট হাসিটি দেখা গেল—লোকে যেটাকে শ্লেষ বলে ভুল করে। ঠোঁটের ডান দিকের প্রান্ত ঈষৎ উঁচু করে বললে, মানলাম পুলিশ চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ অবধি চেষ্টার ফলটা কী দাঁড়াল? না, না ইন্সপেক্টর, কপার টাউন থেকে এসব ক্রাইম বন্ধ করতেই হবে—খুঁজে বার করতেই হবে অপরাধীকে—প্লিজ ইন্সপেক্টর, আপনারা আরও তৎপর হোন! পুলিশের যোগ্যতায় আমাকে বিশ্বাস করতে দিন।

দরজা অবধি ফিরে গিয়ে নীলাদ্রি ঘুরে দাঁড়াল। তার মুখের সেই পেটেন্ট হাসিটুকু অন্তর্হিত হয়েছে। সুগম্ভীর স্বরে বললে, দিন তিনেকের জন্যে আমাকে দিল্লি যেতে হচ্ছে। আমার হয়ে তুমিই পুলিশকে সাহায্য করো অয়ন।

তাই হবে স্যার।

যত শিগগির পারেন খুনীকে ধরে দিন ইন্সপেক্টর—কপার টাউনের শান্তি ফিরিয়ে আনুন। এর জন্যে মোটা রিওয়ার্ড দিতেও আমি প্রস্তুত। কে জানে, দেরি হলে হয়তো আরও কিছু ঘটে যাবে।

নীলাদ্রির দীর্ঘ দেহ দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

নিঃশব্দে বসে রইল অয়ন। নীলাদ্রি গুপ্তকে এতখানি বিচলিত আগে সে কখনো দেখেনি। তার কানে বাজতে লাগল : ‘দেরি হলে হয়তো আরও কিছু ঘটে যেতে পারে।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হীরা সিং জিজ্ঞেস করলে, আচ্ছা, কপার টাউনে ‘ক্রেভেন এ’ সিগারেট কে খায় অয়ন?

একমাত্র আমি। আমার ফেরেঞ্জাইটিস আছে, ওই ব্র্যান্ডের সিগারেট খেলে কাশি হয় না।

তুমি ছাড়া এখানে আর কেউ খায় না?

না। এর কারণ ওটা বিলিতি বলে খুব কমই আমদানি হয়, দামও বেশি। কিন্তু কেন বলো তো?

অয়নের মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে হীরা সিং জবাব দিলে, ডনের আঙুলের ফাঁকে যে সিগারেট পাওয়া গেছে, সেটা ক্রেভেন এ।

অয়নের মুখ দিয়ে কথা সরল না।

চিন্তিত মুখে হীরা সিং বললে, খুনি কেমন ধোঁকা দিয়েছে দেখেছ! আমার বদলে অন্য পুলিশ অফিসার থাকলে আজ তোমার বাঁচার রাস্তা থাকত না। আমি ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছি অয়ন! এমন অসাধারণ বুদ্ধিমান প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল।

মুখ নিচু করে নিজের চিন্তায় ডুবে ছিল অয়ন। হঠাৎ মুখ তুলে বললে, বুদ্ধিমানেরাই কিন্তু মারাত্মক ভুল করে বসে।—আজ চলি হীরা সিং।

.

থানা থেকে বেরিয়ে অয়নের মনে পড়ল তার সিগারেট ফুরিয়েছে।

বিচিত্রা স্টোর্সের সামনে এসে তার মরিসখানা থেমে গেল। টাউনের সবচেয়ে বড় দোকানা, একমাত্র এরাই বিলিতি সিগারেট রাখে। গাড়ি থেকে নেমে গেল অয়ন।

মিনিট কয়েক বাদে সিগারেট কিনে যখন ফিরে এল, অয়নের মুখ—চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে নিজের মনেই সে আরেকবার বললে, বুদ্ধিমানেরাই মারাত্মক ভুল করে!

.

লালী টেলিফোন করেছে : ‘তুমি বলেছিলে দরকার হলেই তোমাকে ডাকতে। আজ সন্ধেবেলা আসতে পারবে? বড় দরকার।’

অফিস থেকে বেরিয়ে অয়ন সোজা চলে গেল আইভি লজে। বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে লালী অপেক্ষা করছিল। অয়ন বললে, কি খবর? ডেকেছ কেন?

লালী বললে, বসো, বলছি। নীল বিজনেস ব্যাপারে দিল্লি চলে গেছে জানো বোধ হয়?

জানি। সবাইকে বলেই গেছেন।

একা একা আমি থাকতে পারছি না!

তাহলে মাথুর পালা গেয়ে শোনাই এসো। ব্রজের রাধার বিরহকথা শুনলে কপার টাউনের রাধার বিরহ—যন্ত্রণা হালকা হতে পারে।

অয়নের পরিহাসে লালীর মুখে কিন্তু হাসি এল না। বিমর্ষ গলায় বললে, ঠাট্টা কোরো না অয়ন। বিরহ—টিরহ নয়। কাল রাতে একটা কাণ্ড হয়েছে—

কি হয়েছে শুনি?

আজকাল ঘুমটা আমার আগের মতো গাঢ় হয় না, অল্পেই ভেঙে যায়। রাত তখন কত জানি না, কি একটা মৃদু শব্দে জেগে উঠলাম। মনে হল, ঘরের বন্ধ দরজাটা কেউ ঠেলছে। তার একটু পরেই হঠাৎ চোখে পড়ল জানলার সার্শিতে একটা কালো ছায়া—মানুষের! ধড়মড় করে উঠে বসে বেড ল্যাম্পটা জ্বালতেই ছায়াটা সরে গেল। বাকি রাতটুকু আর ঘুমোতে পারলাম না।

অয়ন গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেল। তার মসৃণ কপালে ভাঁজ পড়েছে।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে লালী বললে, কাল রাত থেকে ভয়টা আমাকে পেয়ে বসেছে। আজ রাতেও যদি সেই ছায়াটা আসে?

হেসে উঠে অয়ন বললে, ভালই তো, এলে চেনা—পরিচয় হয়ে যাবে। তারপর হাসি থামিয়ে বললে, ভয় পেও না। আজ রাতে আমি এখানে থাকব ভাবছি।

.

রাতে খাওয়া—দাওয়ার পর অয়ন ঘড়ি দেখলে। পৌনে এগারোটা। বললে, এবার শুতে যাও লালী।…হ্যাঁ, ভাল কথা, তুমি কি বরাবর দরজা বন্ধ করে শোও?

লালী বললে, না। নীল বাড়িতে থাকলে ভেজিয়ে রাখি, না থাকলে বন্ধ করে দিই।

আজও দরজা ভেজিয়ে শুয়ো। কোনো ভয় নেই, আমি পাহারায় থাকব। গুড নাইট!

গুড নাইট অয়ন!

লালী শুতে চলে গেল। শিস দিতে দিতে অয়ন গেল লাইব্রেরি ঘরে। টেলিফোন সেখানেই থাকে। ডায়াল করে রিসিভার কানে তুলে বললে, আমি অয়ন বোস বলছি—আমার অঙ্কের উত্তর মিলে গেছে হীরা সিং।

হ্যাঁ, আশা করছি আজই রাতে কপার টাউনের নেপথ্য—নায়কের সঙ্গে আমার চার চোখের মিলন ঘটবে এবং কাল সকালের মধ্যেই তাকে তোমার হেফাজতে তুলে দিতে পারব। তৈরি থেকো।

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে অয়ন গেল একতলায় বাবুর্চিখানায়। খাওয়া—দাওয়ার পাট চুকিয়ে জাফর আলি ডিশ ধুয়ে রাখছিল।

অয়ন জিজ্ঞেস করলে, এ বাড়িতে সদর দরজা ছাড়া আর কোনো ঢোকার রাস্তা আছে নাকি জাফর?

জাফর বললে, আছে কর্তা। গারাজ—ঘর দে’ বাড়িতে ঢোকা যায়। আজ এক তাজ্জ্বব কারবার হয়েছে কর্তা! ভোরে উঠে দেখি গারাজ—ঘরের তালা খোলা!

তাই নাকি!

হাঁ কর্তা। কাল রাতে লালদিঘির জানলায় নাকি চোর উকি দিয়েছিল।

চোর—টোর নয়, ও চোখের ভুল। গারাজের চাবি কার কাছে থাকে?

আমারই কাছে। আজ ভাবতেছি তালা পাল্টে দেব।

অয়ন হাল্কা ভাবে বললে, না, না, তার দরকার নেই। কাল হয়তো ঠিকমতো তালা বন্ধ করা হয়নি। আজ দেখেশুনে বন্ধ করে দিও।

আচ্ছা কর্তা।

অয়ন দোতলার বারান্দায় চলে এল। বাগানের একটা দীর্ঘ ঝাউ বারান্দার একধারে ছায়া ফেলেছে। অন্ধকার এখানটায় আরও ঘন। লালীর ঘরের দরজা এখান থেকে সোজা দেখা যায়। অয়ন সিগারেট ধরিয়ে বেতের চোয়ার টেনে বসল অন্ধকারে।

শরৎকালের মাঝামাঝি। বাইরেটা জ্যোৎস্না আর কুয়াশায় মাখামাখি। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে বসে রইল অয়ন। হরিণের মতো সতর্ক হয়ে।

সে আসছে! অন্ধকার রহস্য—নাটকের সেই নেপথ্য—নায়ক, লালী গুপ্তার জীবনের অদৃশ্য রাহু, কপার টাউনের অজানা আতঙ্ক। কাল সে বিফল হয়ে ফিরে গেছে, অয়নের হিসেব যদি নির্ভুল হয়, আজ সে আবার আসবেই!

ঘুমিয়ে পড়েছে শহরের মানুষ। ঘুমিয়ে পড়েছে রাতচরা পশু—পাখি। নিজের হৃদযন্ত্রের ধুক ধুক আওয়াজ শুনতে শুনতে জেগে আছে শুধু অয়ন। চোখ সজাগ আর কান খাড়া করে। কিন্তু জেগে থাকতে থাকতে কখন যে দু—চোখের পাতা এক হয়ে গেল টের পায়নি সে।

হঠাৎ ঘুমের চটকা ভেঙে গেল। কি যেন একটা অস্পষ্ট শব্দ। ছিলা—ছেঁড়া ধনুকের মতো খাড়া হয়ে বসল অয়ন। ঘুম—জড়ানো দুই চোখের দৃষ্টি ধারালো করে তাকাল লালীর ঘরের দিকে। দেখলে—

কুয়াশা—মাখা এক টুকরো পানসে জ্যোৎস্না পড়েছে দরজায়। দরজার কপাট দু’খানা আস্তে আস্তে ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। নিঃসাড়ে বেরিয়ে এল এক ছায়ামূর্তি—লালীর ঘর থেকে। কপাট দু’খানা আবার ভেজিয়ে দিয়ে ছায়ামূর্তি এগিয়ে গেল করিডরে।

যার অপেক্ষায় বসে বসে অয়ন প্রতিটি মুহূর্ত গুনছিল, সে কখন এল জানতেও পারেনি। এত সতর্কতা সত্ত্বেও!

নিজেকে অভিশাপ দিতে দিতে অয়ন দ্রুত এসে দাঁড়াল লালীর ঘরের দরজায়। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে ঢোকা হল না। ছায়ামূর্তি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে! নিঃশব্দে বেরাল—পায়ে পিছু নিলে অয়ন।

লম্বা করিডর। অন্ধকার। দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে অয়নও এগোতে লাগল ছায়ামূর্তির পিছনে। অন্ধকারটা খানিক সয়ে এসেছে চোখে। কিন্তু নেহাতই কপাল খারাপ অয়নের। একটা পাম—টবের স্ট্যান্ডের সঙ্গে বেমক্কা ধাক্কা লেগে গেল তার।

চকিতে ঘুরে দাঁড়াল ছায়ামূর্তি। প্যান্টের পকেটে একবার হাত ঢোকাল। পরক্ষণেই অয়ন দেখতে পেল অন্ধকারেও কি একটা জিনিস চকচক করছে তার হাতে।

অয়ন চট করে ঢুকে গেল লাইব্রেরি ঘরে, তারপর দরজার পাশে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাত বাড়িয়ে সুইচটা খুঁজতে গিয়ে হাতে ঠেকল পাশের র্যাকে একটা ব্রোঞ্জের ভেনাস।

মৃত্যুর মতো ঠান্ডা স্তব্ধতা। নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। শুধু লাইব্রেরির দেয়াল—ঘড়িটা সময়ের হৃৎপিন্ডে একটানা ঘা দিয়ে চলেছে।

একটু পরেই লাইব্রেরিতে নিঃশব্দে ঢুকে এল ছায়ামূর্তি। হাতের মুঠোয় সেই চকচকে জিনিসটা। সতর্কভাবে এদিক ওদিক চাইতে লাগল।

আর ভাববার সময় নেই। আচমকা হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে দিল অয়ন, আর চোখের নিমেষে ব্রোঞ্জের ভেনাসটা তুলে নিয়ে সজোরে আঘাত করলে ছায়ামূর্তির ডান হাতের কব্জিতে। প্রচণ্ড শব্দে রিভলভারটা ছিটকে পড়ল। চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা কুড়িয়ে নিলে অয়ন। তারপর সেটা নাচাতে নাচাতে চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, গুড মর্নিং স্যার!

অয়ন, তুমি!

আজ্ঞে হ্যা, আপনি আসবেন জানতাম। তাই অভ্যর্থনার জন্যে অয়ন বোস হাজির।

বাঁ হাতের ডান কব্জি চেপে ধরে নীলাদ্রি গুপ্ত তখন সোফায় বসে পড়েছে।

রিভলভারের মুখ তার দিকে রেখে অয়ন পিছু হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বললে, খেলা আপনার শেষ গুপ্তসাহেব। হীরা সিং আসা অবধি এইখানেই বিশ্রাম করুন।

লাইব্রেরি ঘরের দরজার হুড়কোটা বাইরে থেকে টেনে দিলে অয়ন। করিডরে আলো জ্বলছে। জাফর আলি, বাবুর্চি, আয়া ভীত মুখে দাঁড়িয়ে। অয়ন আর দাঁড়াল না, লালীর ঘরের দিকে ছুটল।

ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকতেই অয়নের দম আটকে এল। তাড়াতাড়ি বাজি জ্বালতেই দেখা গেল, বিছানায় লালী চোখ বুজে শুয়ে, আর খাটের ঠিক নিজেই স্টপ কক লাগানো একটা বড় কাচের জার। তারই মুখ দিয়ে হালকা সবুজ ধোঁয়ার কুণ্ডলী বদ্ধ ঘরের বাতাসকে ভারী করে তুলেছে।

কেমিস্ট্রি—পড়া অয়নের বুঝতে বাকি রইল না যে, এ হচ্ছে বিষাক্ত ফ্লোরিন গ্যাস। তৎক্ষণাৎ সে কাচের পাত্রটার স্টপ কক বন্ধ করে দিলে, খুলে দিলে বন্ধ জানলাগুলো। তারপর লালীর গায়ে ধাক্কা দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ডাকলে, লালী। লালী। ওঠো।

লালী আচ্ছন্নের মতো চোখ মেলে হাঁপাতে হাঁপাতে সাড়া দিলে, কি—কি হয়েছে অয়ন?

কিছু না বলে অয়ন শক্ত দুই হাতে লালীকে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

থানায় বসে হীরা সিং বললে, কমিশনার অফ পুলিশ তোমাকে কনগ্র্যাচুলেশন্স জানিয়েছেন।

হাসি মুখে অয়ন বললে, সেটা আমার একার পাওনা নয়, অর্ধেক ভাগ তোমারও আছে হীরা সিং। আমি পেশাদার গোয়েন্দাও নই, শখের গোয়েন্দাও নই। যা করেছি, আমার ইন্সপেক্টর বন্ধুর জন্যেই।

শুধুই কি বন্ধুর জন্যে। বন্ধুর চেয়েও যে আপন, তার জন্যেও কি নয়?

অয়নের চঞ্চল চোখ শান্ত হয়ে এল। বললে, একথা অস্বীকার করব না। লালীকে বাঁচানোই আমার একমাত্র পণ ছিল।

আচ্ছা অয়ন, তুমি কি করে জানলে যে, নীলাদ্রি গুপ্ত গত রাতে আবার আসবে লালী গুপ্তাকে খুন করতে?

তা হলে গোড়া থেকে বলতে হয়!—অয়ন শুরু করলে, কপার টাউনের নীলাদ্রি গুপ্ত খুবই পপুলার ফিগার ছিল। আমি তার কাছে এতদিন কাজ করেছি—মেলামেশা করেছি, আমিও বুঝতে পারিনি অমন সুন্দর দেহের আড়ালে একটা নোংরা ক্রিমিন্যাল মন লুকিয়ে থাকতে পারে! লালীর বাবাও তাকে বুঝতে পারেননি, তাই অসঙ্কোচে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর নীলাদ্রি হয়তো লালীকে ভালোবাসতে পারত, কিন্তু গোল বাধাল কান্তা কালেলকর চাকরিতে এসে। কান্তা কি টাইপের মেয়ে, ধীরাজ ডাক্তারের মুখে আমরা শুনেছি। যৌন আবেদনের কাছে স্ত্রীর অনুরাগ আকর্ষণ ভেসে গেল। খেলাটা অবশ্য চলছিল খুবই গোপনে। কিন্তু সারা জীবনে তো লুকোচুরি চলতে পারে না। তাই নীলাদ্রি প্ল্যান করলে পথের কাঁটা লালীকে সরিয়ে ফেলতে। সেই চেষ্টাই সে করল একুশে জুলাইয়ের রাতে। ডন রিভাস পাকা স্মাগলার, বিষটা যে সে—ই আনিয়ে দিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু নীলাদ্রির ব্যাড লাক—আশ্চর্যভাবে লালী বেঁচে উঠল। ভেস্তে গেল নীলাদ্রি—কান্তার সুখের প্ল্যান। ওদিকে নতুন বিপদ দেখা দিল দুই ব্ল্যাকমেলারকে নিয়ে—ধীরাজ ডাক্তার আর ডন রিভাস। অতএব বাঁচবার জন্যে নীলাদ্রি দুজনকেই খতম করে দিলে। ধীরাজ দাসের মোটর গাড়ির টাই—রড খুলে দিয়ে আর ডনকে আর্সেনিক মেশানো সিগারেট খাইয়ে। কিন্তু দু’দুটো খুনের পরেও নীলাদ্রি নিজে রইল পুলিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমরা যখন ‘খুনি কে’ ভেবে মাথা ঘামিয়ে মরছি, সে তখন সকলের সন্দেহের বাইরে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে! এমনই অসাধারণ চতুর সে।

একটা সিগারেট ধরালে অয়ন। তারপর আবার বলতে লাগল, কিন্তু সব চাতুরির সীমা আছে—সব অপরাধের শেষ আছে। কান্তার একটা কথা আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল—ডনকে সে ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিল, ‘কে জানত, ডাইনিটা মরেও বেঁচে উঠবে। অগাধ টাকা হাতে এসেও এল না?’ হ্যাঁ, টাকার অঙ্কটা সত্যিই অগাধ, লালীর বাবা মেয়ের নামে সতেরো লাখ টাকা রেখে গেছেন। লালী মরলে সে—টাকায় কার অধিকার? একমাত্র নীলাদ্রি গুপ্তের। তবু স্পষ্ট সন্দেহ করতে পারলাম না। কেননা, তখনও নীলাদ্রির বাইরের খোলসটা নিখুঁত। স্ত্রী হয়ে লালী পর্যন্ত সন্দেহ করতে পারেনি। ভেবে—চিন্তে তোমাকে পাঠালাম কলকাতায় লালীর অ্যাটর্নি—কাকা অর্ধেন্দু রায়চৌধুরির কাছে। তুমি ফিরে এসে বললে, একুশে জুলাইয়ের দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ বাদেই নীলাদ্রি অর্ধেন্দুবাবুর কাছে গিয়েছিল সাকসেশন সার্টিফিকেট সম্পর্কে।

অর্ধেন্দুবাবু সন্দেহবশত লালীর বিষয় কিছু না জানিয়েই ব্যাপারটা চেপে রাখেন। এই খবরটা পেয়ে আমার মনে এই প্রথম সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কোন স্বামী স্ত্রী মারা যাবার সাত দিনের মধ্যেই টাকার জন্যে এত ব্যস্ত হয়ে ওঠে? সন্দেহ হলেও নীলাদ্রিকে তখনও খুনি বলে ভাবতে পারিনি। কিন্তু—

অয়নের মুখে যেন ঘনঘটা করে এল। একটু থেমে বললে, কিন্তু ডন রিভাসের খুন আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল খুনিকে। বিচিত্রা স্টোর্সে খোঁজ করে আমি জানতে পারলাম, খুনের দিন সকালে নীলাদ্রি গুপ্তর ড্রাইভার ‘ক্রেভেন এ’ সিগারেট কিনে নিয়ে গেছে। তোমাকে বলেছিলাম হীরা সিং ‘বেশি বুদ্ধিমান লোকেরাই মারাত্মক ভুল করে বসে’। নীলাদ্রি ভেবেছিল, ডনকে আমার ব্যান্ডের সিগারেট খাইয়ে খুনের সন্দেহটা আমারই ওপর ফেলবে, কিন্তু এইখানেই ভুল হত তার। ‘ক্রেভেন এ’র বদলে কোনো সস্তা দামের চালু সিগারেট কিনলে নীলাদ্রির ড্রাইভারের কথা দোকানির মনে থাকেত না। কত লোকেই তো কেনে। নিঃসন্দেহ হলামা নীলাদ্রিই ডন রিভাসকে শেষ করেছে। এ—কথা তোমাকে বলে নীলাদ্রিকে তখনই অ্যারেস্ট করাতে পারতাম, কিন্তু আমি চেয়েছিলাম তাকে হাতে—হাতে ধরতে। একটা কথা স্পষ্টই বোঝা গেল হীরা সিং, লালী গুপ্তা বেঁচে উঠলেও খুনি সহজে হাল ছাড়বে না। সতেরো লাখ টাকার লোভ সামলানো কি সহজ কথা? বুঝলাম, ডন রিভাসের পরে আবার লালীর পালা। হলও তাই। লালীর কাছে যখন শুনলাম, রাতের অন্ধকারে কে একজন এসে তার শোবার ঘরের দরজা ঠেলেছে—জানলার সার্শিতে ছায়া ফেলেছে, আমার ধারণা হল সে নীলাদ্রি ছাড়া কেউ নয়। তার দিল্লি যাওয়ার কথাটা ভুয়ো—একটা জোরালো অ্যালিবাই খাড়া করার মতলব। আমার নিশ্চিত ধারণা হল, কাল সে ফিরে গেছে, আজ আবার সে আসবে। আগামী কাল দিল্লী থেকে তার বাড়ি ফেরার দিন—আজই রাতে তাকে আসতে হবে শেষ চেষ্টা করতে। লালী তার শেষ শিকার! জাফরের সঙ্গে কথা কয়ে বুঝতে পারা গেল, গারাজ ঘরের তালার ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় নীলাদ্রির কাছে আছে। তাই তার আসাকে সহজ করার জন্যে জাফরকে গারাজ ঘরের দরজায় অন্য তালা লাগাতে মানা করলাম আর লালীকে বললাম, ঘরের দরজা ভেজিয়ে রাখতে। তারপর—তারপর লাল—নীলের খেলা কি করে শেষ হল আগেই বলেছি।

একটা নতুন সিগারেট ধরালে অয়ন। জিজ্ঞেস করলে, কান্তা কোথায়?

লক—আপে।

হীরা সিং প্রশ্ন করলে, লালী গুপ্তা কেমন আছেন?

ভাল। ফ্লোরিন গ্যাস বড় বিষাক্ত। আরেকটু দেরি হলে বড্ড বিপদ হয়ে যেত।

.

ঝাউবনী বেড়াতে এসে কপার টাউনের রহস্য—নাটক আপনি তো নিজেই দেখলেন। দেখলেন কপার টাউনের বাইরে যত আলো, ভেতরে তত কালো। দেখলেন মানুষের সভ্যতা কোন পথে চলেছে।

ঝাউবনী থেকে ফিরে যাবার আগে চলুন শেষবারের মতো একবার শিলাই নদীর ধারে যাই। যেখানে পাইন জঙ্গলের ঠান্ডা ছায়ায় শুকতো পাতার নরম পুরু গদির ওপর চুপচাপ বসে আছে অয়ন আর লালী। আকাশ আজ বড় বেশি নীল, শরতের রোদ বড় বেশি সোনালি।

অনেকক্ষণ ওরা পাশিপাশি বসে আছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ। একমুঠো শুকনো পাতা কুড়িয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলে লালী। তারপর বললে, ওই পাতাগুলোর মতো জীবনের গতি তিন বছর উড়িয়ে দেওয়া যায় না অয়ন? মুর্শিদাবাদের সেই দিনগুলোতে আবার ফিরে যাওয়া যায় না?

অয়ন বললে, কি হবে ফিরে গিয়ে?

জীবনটাকে নতুন করে শুরু করা যেত। সেদিন তোমাকে যা দেওয়া হয়নি, আমার মনের সেই ঋণ শোধ করতাম।

অয়ন হাসলে। মুর্শিদাবাদের সেই কিশোরের হাসি। বললে, তোমার কাছে আমার তো কোনো চাহিদা নেই লালী। কোনোদিন ছিলও না। তবে আজ একটা জিনিস চাইবার আছে।

কি অয়ন?

ছুটি।

ছুটি। কেন চাইছ?

অয়ন হাসি মুখে বললে, আমার মধ্যে একটা চিরকালের বেদে আছে। পাছে নিজের কামনায় নিজেই জড়িয়ে পড়ে, সেই ভয়ে সে পালাতে চায়। একদিন মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়েছিল, আজ আবার পালাতে চাইছে।

স্তব্ধ হয়ে লালী চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। আইভরি—গাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল নামল। তারপর বললে, না অয়ন, ছুটি তোমাকে দিতে পারব না। জীবনের কতটা পথ আমার বাকি কে জানে! একা একা চলতে আর সাহস হয় না। আমার প্রাণটা যখন বাঁচিয়েছ, তখন কথা দাও আমার পাশে তুমি থাকবে?

চুপ করে রইল অয়ন।

হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে লালী বললে, কথা দাও।

একখানা বলিষ্ঠ হাতের মুঠিতে আরেকটি দুর্বল হাত আশ্রয় খুঁজে পেল।