লাল নীল – ৪

চার

খোলা চিঠিখানা হতে নিয়ে নীলাদ্রি গুপ্ত হল—এ পায়চারি করছে, আর দেয়াল—ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে বারবার। ঠোঁটের কিনারে ওক কাঠের পাইপটা নিভে গেছে অনেকক্ষণ, দাঁতে কামড়াচ্ছে শুধু। বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে অসীম চাঞ্চল্য।

সকালের ডাকে এসেছে চিঠিখানা। কলকাতা থেকে, তারই নামে। প্রথমবার চিঠিখানা পড়ে চমকে উঠেই পাথর হয়ে গিয়েছিল নীলাদ্রি। দ্বিতীয়বার পড়তেই বুকের রক্ত আবার চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। পায়চারি থামিয়ে নীলাদ্রি চিঠিখানা তৃতীয়বার পড়লে:

শ্রীচরণেষু,

 আমি মরিনি, মরণের দোরগোড়া থেকে ফিরে

এসেছি। নেহাত পরমায়ু ছিল বলেই বোধ হয়।

 আমায় চোখে দেখলেও তুমি প্রথমে বিশ্বাস করতে

পারবে না জানি। বিশ্বাস আমি নিজেই করতে পারিনি

যে, চিতায় শুয়েও বেঁচে উঠব। তবু বলছি, ব্যাপারটা

অলৌকিক নয়। কেমন করে বেঁচে উঠলাম, সে অনেক

কথা। চিঠিতে জানানো সম্ভব নয়, দেখা হলে জানাব।

 এখন আমি অনেকটা সুস্থ। কাল সন্ধের ট্রেনে

ঝাউবনী পৌঁছুব। স্টেশনে গাড়িটা পাঠিও। ইতি—

 লালী

এও কি সম্ভব? লালী বেঁচে উঠেছে—বেঁচে আছে। এ যদি অলৌকিক ঘটনা না হয় তো অলৌকিক কাকে বলে? কিন্তু এমন ঘটনা জগতে এই প্রথম নয়। ভাওয়ালের রাজকুমার মৃত বলে ঘোষিত হবার পর ঠিক এমনি অলৌকিক ভাবেই বেঁচে উঠেছিলেন। বাঁচিয়েছিল এক সন্ন্যাসী। গল্পকথা নয়, বাস্তব সত্য! কে বাঁচাল মরা লালীকে? জড়বাদীরা বলবে, প্রকৃতির খেয়াল। ধর্মবিশ্বাসীরা বলবে, ঈশ্বরের অনুগ্রহ। আর নীলাদ্রি? সে কি বলবে? সে বলবে নিয়তির খেলা!

কিন্তু এ চিঠি যদি সত্যিই লালীর না হয়? যদি আর কারো লেখা হয়?

নীলাদ্রি আবার তাকাল চিঠিখানার দিকে। দ্রুততর হল পায়চারি। না, এ হাতের লেখা নীলাদ্রির চেনা। হুবহু লালীর লেখা মনে হচ্ছে। এ কি জাল হতে পারে? যদিও বা হয়, নীলাদ্রির চোখের দৃষ্টি আর হাতের স্পর্শ ঠিক চিনে নেবে তার লালীকে।

দেয়াল—ঘড়ির দিকে তাকাল নীলাদ্রি। প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে সে মোটর পাঠিয়েছে স্টেশনে। আর, এই একঘণ্টা ধরে অসহ্য ক্লান্তিকর প্রতীক্ষায় ছটফট করছে নীলাদ্রি। প্রতি মিনিট গুনছে—প্রতি সেকেন্ড গুনছে।

নিচের ড্রাইভে মোটরের আওয়াজ শোনা গেল। থামল পোর্টিকোতে এসে।

কার্পেট—পাতা কাঠের সিঁড়িতে মৃদু পায়ের শব্দ।

নীলাদ্রির স্নায়ু—শিরাগুলো টানটান হয়ে উঠল। হলঘরে সব ক’টা ঝাড়বাতি একে একে জ্বেলে দিলে। যেমন জ্বালিয়েছিল সেই পার্টির রাতে। তারপর কটা রঙের দুই চোখের তারায় সমস্ত চেতনা কেন্দ্রীভূত করে চেয়ে রইল দরজার দিকে।

হ্যাঁ, যে এল সে লালীই বটে। একটু রোগা দেখাচ্ছে শুধু, আর আইভরির মতো পীতাভ সাদা রঙটা খানিক ময়লা হয়েছে মাত্র। আর কোনও তফাত নেই।

কিন্তু লালীর পিছন পিছন যে লোকটি এসে সেলাম করে দাঁড়াল, তাকে দেখে নীলাদ্রির আরও চমক লাগল। সে আর কেউ নয়, হঠাৎ—ফেরারী জাফর আলি খানসামা।

বেশ কিছুক্ষণ কথা বললে না কেউ। নীলাদ্রি চেয়ে রইল লালীর দিকে, আর ঘরের আশেপাশে তাকিয়ে হঠাৎ এক সময় লালীর আইভরি—গাল বেয়ে টসটস করে নেমে এল জল। তারপর আস্তে আস্তে বললে, এ জন্মে আবার এই ঘরে—এই সংসারে ফিরে আসব, তা কি ভেবেছিলাম? লোকে জানল আমি মরে গেছি, অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে আমারও মনে হল অন্ধকারের অতলে আমি ডুবে যাচ্ছি! কিন্তু আসলে কি হয়েছিল জানো?

নীলাদ্রি এগিয়ে এল। লালীকে বুকে জড়িয়ে বললে, এখনও তোমাকে দুর্বল মনে হচ্ছে। ও—কথা থাক, পরে শুনব।

.

বলতে শুরু করল জাফর আলি। শুরু করল সেই একুশে জুলাইয়ের দুর্যোগ—রাত থেকে। শিলাই নদীর ধারে সেই শ্মশানঘাট থেকে।

জাফর বললে, লালদিদির লাশ শোয়ানো হল কাঠের বিছনেয়। আগুন দেয়—দেয়, ঠিক তখুনি ডন সাহেব চিল্লিয়ে উঠল, বান আসছে। ব্যাস, দেখতে দেখতে শ্মশানঘাট ভোঁ—ভাঁ। শিলাইয়ের বান তো নয়, যেন সাক্ষাৎ যমদূত। জানের ভয় বড় ভয়, মিছে কথা বলব না হুজুর, আমারও মনটা চেয়েছিল পালাতে। কিন্তু পালাতে গিয়ে পা দু’খান আটকে গেল। চোখ গিয়ে পড়ল কাঠের বিছনেয় লালদিদির ওপর। কলজেটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। ছোট্ট বয়েস থেকে ওই লালদিদি আমারই কোলে—পিঠে মানুষ, আর আজ এই নিশুতি শ্মশানঘাটে ওকে একা ফেলে যাব? অমন সোনার দেহ বানের জলে ভেসে যাবে! না, না, তা হবে না, ওর বাপের নিমক খেয়েছি যে!

তিন কুড়ি উমর হলে কি হয়, শরীলে আমার তাকত আছে হুজুর। এক ঝটকায় লালদিদির লাশ তুলে নিলেম কাঁধে, তুলে নিয়েই ছুট! ডাইনী শিলাইয়ের বান তখন পিছনে তাড়া করেছে! ছুট—ছুট—ছুট! ঝিমঝিমে জ্যোচ্ছনায় জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা দূর এগিয়ে তবে হাঁপ ছাড়লেম। কিন্তু কী তাজ্জব! লালদিদির গা’টা গরম—গরম ঠেকছে কেন? মরা মানষের গা কি গরম হয়? সাপে—কাটা লাশ যেমন ছ্যাঁকছেঁকে হয়, ঠিক তেমনতর!

অথচ দাস ডাক্তার বলেছে, লালদিদি খতম! কেমন সন্দ হল। সাত—পাঁচ ভেবে লালদিদিকে কাঁধে ফেলে আবার ছুট। একদম সেই পাহাড়ি বস্তিতে বুড়ো নেপালি হেকিমের ডেরায়।

চ্যাটাইয়ের ওপর লালদিদির লাশ রেখে, নেপালি বুড়ো মিটমিটে আলোয় অনেকক্ষণ ধরে দেখলে আর বিড় বিড় করে কি সব আওড়ালে। তারপর ঘাড় নেড়ে বললে, হবে। সারারাত ধরে বুড়ো লালদিদিকে কত কি জড়িবুটি খাওয়ালে, শোঁকালে, মাখালে। আমি ঠায় বসে রইলেম হুজুর। বুকের মধ্যে ‘কি হয়, কি হয়’ ভাব। পরদিন বেলা যখন দুপুর, তখন—ইয়া আল্লা—লালদিদি ঘোলা ঘোলা চোখ মেলে তাকাল।

একটু থামল জাফর আলি। তারপর বললে, এবার তুমি বলো লালদিদি।

চলে গেল জাফর। নীলাদ্রি স্থির হয়ে শুনছে। লালীকে প্রশ্ন করলে, কি হয়েছিল তোমার?

সেই নেপালি বুড়ো বললে, আমাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল। বিষটা পাহাড়ি সাপের বিষ জাতীয়। এই বিষে হৃদযন্ত্রের কাজ আস্তে আস্তে থেমে আসে, কিন্তু সেটা মৃত্যু নয়! আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে বিষ কাটাতে পারলে হৃদযন্ত্রের কাজ আবার স্বাভাবিক হতে পারে। ভগবান বুদ্ধকে নমস্কার যে ঠিক সময়ে তিনি শিলাই নদীতে বান এনেছিলেন। সামান্য কিছু দেরি হলেই আমার দেহটার ছাই ঝাউবনীর বাতাসে—

নীলাদ্রি কেমন যেন অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, তারপর—তারপর কি হল বলো।

লালী বললে, আমার পুরো চেতনা ফিরে আসতে—চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হতে আরও দুটো দিন গেল। তারপর নেপালি বুড়ো জাফরকে বললে, এইবার রুগিকে নিয়ে যেতে পারো।

নীলাদ্রি ক্ষোভের সঙ্গে বললে, আশ্চর্য! এত কাণ্ড হয়ে গেল, অথচ আমাকে একটা খবরও দিলে না—বাড়িতেও ফিরে এলে না!

লালী বললে, প্রথমে বাড়িতে ফিরে যেতেই মন চেয়েছিল, পরে ভেবে দেখলাম, মরবার পর এত শিগগির বাড়িতে না ফেরাই ভালো। কপার টাউন চমকে উঠবে—অনেক সন্দেহ, অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতূহলের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তোমায়। সে এক বিশ্রী ব্যাপার হবে। তার চেয়ে বরং আমার মরার কথাটা লোকের মনে থিতিয়ে আসুক, আমিও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠি, তখন ফেরা যাবে।

তারপর?

তারপর ঝাউবনীতে থাকা আর সম্ভব হল না। কখন কে জেনে ফেলবে কে জানে। তাছাড়া আরও চিকিৎসার দরকার—শরীর তখনো ভীষণ দুর্বল। মনে পড়ল অর্ধেন্দুকাকার কথা—বাবার অ্যাটর্নি বন্ধু। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে কলকাতায় চলে গেলাম—জাফরকে সঙ্গে নিয়ে। অর্ধেন্দুকাকা যতট আশ্চর্য হলেন, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত হলেন আমার জন্যে। একটা ভালো নার্সিং হোমে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। মাস দেড়েক সেখানে থাকার ফলে আমি অনেকটা সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম। তখন আবার মন টানতে লাগল ঘরের দিকে। হাজার হলেও স্ত্রীলোকের মন তো! মরে গিয়েও নিজের হাতে—গড়া ঘর—সংসারের ওপর মায়া—মমতা যায় না। তাই যে ঝাউবনী একদিন চিরকালের মতো আমাকে বিদায় করে দিয়েছিল, সেইখানেই আবার ফিরে এলাম।

লালীর চোখে জল এসে গেল। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, কিন্তু কেন এমন হল বলতে পারো? আমি তো কখনও কারো সুখের অন্তরায় হইনি—কারো ক্ষতি করিনি! তবে আমায় বাঁচতে দিতে কার এত অনিচ্ছা?

পাইপের ধোঁয়ায় নীলাদ্রির মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ সে লালীকে বুকের কাছে টেনে নিলে। বললে, যা হবার হয়ে গেছে। তার জের টেনে আর লাভ কি লালী? এই ব্যাপার নিয়ে পুলিশকে ঘাঁটাঘাঁটি করতে দিলেই শত্রু ধরা পড়বে, এমন কথা জোর করে বলা যায় না। মাঝখান থেকে সারা কপার টাউন কানাকানি করবে—আমাদের পারিবারিক সম্ভ্রম নষ্ট হবে। তবে তুমি যদি চাও—

না, থাক।—একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লালী বললে, যা অজানা, তা অজানাই থাক।

স্বামীর বাহুবেষ্টন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে লালী যাবার জন্যে এগোল।

নীলাদ্রি হঠাৎ ডাকলে, একটা কথা লালী—

বলো।—লালী ফিরে তাকাল।

কাকে সন্দেহ হয় তোমার?

জ্যান্ত লালীর মুখে মরা হাসি দেখা দিল। নিষ্প্রাণ নির্জীব অদ্ভুত সে হাসি। একটু চুপ করে থেকে সে বললে, আমার ভাগ্যকে।

তারপর চলে গেল।

.

অয়ন বললে, লালী গুপ্তার বেঁচে ওঠাকে তুমি কি বলতে চাও হীরা সিং? অলৌকিক ব্যাপার, না বিজ্ঞানের মারপ্যাঁচ?

হীরা সিং মৃদু হেসে বললে, কোনোটাই না। আমি বলি মিসেস গুপ্তার মৃত্যুটাই একটা ধাপ্পা!

অর্থাৎ?

মিসেস গুপ্তাকে মারবার চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু বিষমেশানো শ্যাম্পেন তিনি এত কম খেয়েছিলেন যে মরলেন না—চেতনা হারালেন মাত্র। আততায়ী তবু সুযোগ নিতে ছাড়ল না। তার হাতের লোক ধীরাজ ডাক্তারকে দিয়ে হার্টফেলিওর ঘোষণা করে রাতারাতি লাশ জ্বালিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করল। কিন্তু আততায়ীর নিতান্ত দুর্ভাগ্য, শিলাই নদীর বান তার প্ল্যানটাই বানচাল করে দিল। মিসেস গুপ্তা ফিরে আসায় এটাই প্রমাণ হল যে তিনি মারা গেছেন বলে তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়নি—তাঁকে মারবার উদ্দেশ্যেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাই নয় কি?

অয়ন ঘাড় নেড়ে বললে, আমারও ধারণা তাই। যাই হোক, মরতে মরতে লালী বেঁচে ওঠায় আমরাও বেঁচে গেলাম। খুনিকে খুঁজে বেড়ানোর আর দরকার কি? আমাদের ছুটি।

না, অয়ন।—গম্ভীর হয়ে হীরা সিং বললে, আমাদের কাজ আরও বাড়ল।

কি রকম?

আমার পুলিশি অভিজ্ঞতায় কপার টাউনের বাতাসে ক্রাইমের গন্ধ আরও উগ্রভাবে পাচ্ছি।

খুলে বলো।

পাপ থেকেই পাপের জন্ম। একটা অপরাধ আরেকটা অপরাধকে টেনে আনে। খুনি হাল ছেড়ে বসে থাকবে ভেবো না। তোমাকে আরও সজাগ হতে হবে অয়ন, আরও সতর্ক।

অনেক ভাবনার মেঘ এসে জড়ো হল অয়নের মুখে।

হীরা সিং পুনরায় বললে, মিসেস গুপ্তা ফিরে আসার পর ডন রিভাসের ভাবগতিক লক্ষ করেছ?

অয়ন বললে, নজর রেখেছি, তবে ভাবগতিক আগের মতোই—তফাত কিছু দেখিনি।

কান্তা কালেলকর?

হঠাৎ বেশি গম্ভীর হয়ে পড়েছে। কথাও কম বলে।

আচ্ছা, লালী গুপ্তার ফিরে আসাটা নীলাদ্রি গুপ্ত কিভাবে নিয়েছেন?

একজন ভালোমানুষ পত্নীপ্রেমিক স্বামীর পক্ষে যেভাবে নেওয়া উচিত। অয়ন বললে, গুপ্তসাহেব চাপা স্বভাবের মানুষ—বাইরে উচ্ছ্বাস দেখা যায় না। তবে লালী মারা যাবার পর তিনি সামাজিক মেলামেশা ছেড়েই দিয়েছিলেন, এখন সেটা আবার শুরু হয়েছে—ক্লাবেও তাঁকে আগের মতো দেখা যাচ্ছে।

নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকালে অয়ন। ন’টা বাজে। উঠে পড়ে বললে, চলি হীরা সিং, ক্লাবে যাব।

.

‘বারে’ ঢুকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলে অয়ন।

কোণের টেবিলে তাসের জুয়ার আসর জমেছে। কিন্তু সেরা জুয়াড়ি আজ নেই। তাহলে কি ডন রিভাস আজ ক্লাবে আসেনি? খুবই অস্বাভাববিক ব্যাপার। অয়ন ভালো করেই জানে যে, দিনান্তে একবার জুয়ার টেবিলে না বসলে ডনের ডিনার হজম হয় না। আর, এও জানে যে ক্লাব—হাউসের বার—রুম ছাড়া অন্য ঘরের প্রতি তার কোনো টান নেই। তবে আজ গরহাজির কেন? কোথায় গেল সে? কোথায় যেতে পারে? রাতের ছায়ায় গা ঢাকা দিয়ে কপার টাউন থেকে ভাগল নাকি? না, সে উপায় নেই, হীরা সিং কড়া পাহারা রেখেছে।

অয়ন এবার হলের মাঝামাঝি তাকালে। সাহানী নামক হংস—দম্পতির সঙ্গে এক টেবিলে নীলাদ্রি বসেছে। মিঃ সাহানী বলছেন, কপার টাউনের লোকেরা নাকি কানাঘুষো করছে, কিন্তু মিসেস গুপ্তা বেঁচে ওঠায় আমরা যে কী খুশি হয়েছি নীল, বলে বোঝাতে পারব না। দেখা যাচ্ছে, আজকের এই ভেজালের যুগে মৃত্যুও ভেজাল!

নিজের রসিকতায় সাহানী নিজেই হেসে উঠলেন। মিসেস সাহানী বললেন, থামো! লালী ভাগ্যবতী, নীলাদ্রির ভালোবাসার টানেই সে বেঁচে উঠেছে। আমি মরলে কি আর বেঁচে উঠতাম?

হংসের প্রতি হংসী নিদারুণ কটাক্ষ হানলেন।

বিব্রতভাবে মিঃ সাহানী বলে উঠলেন, কী মুশকিল! তুমি যে এখনও বেঁচে আছ, আমার ভালোবাসার টান কেমন করে প্রমাণ করব ডিয়ার?

নীলাদ্রির ঠোঁটে সেই পেটেন্ট হাসিটি দেখা দিল। হুইস্কির পাত্রটা তুলে ধরে বললে, লালীর দীর্ঘ জীবন!

তাদের টেবিলের পাশ কাটিয়ে অয়ন এগিয়ে যাচ্ছিল, নীলাদ্রি দেখতে পেয়ে ডাকলে, এই যে অয়ন!

বলুন স্যার।—থেমে গেল অয়ন।

লালীর বেঁচে ওঠা নিয়ে কপার টাউন নাকি কানাঘুষো করছে?

তাই নাকি?

সাহানীর দিকে একবার তাকিয়ে নীলাদ্রি অয়নকে বললে, যারা কানাকানি করছে, তাদের জানিয়ে দিও, আমার পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে অপরের মাথা ঘামানো আমি পছন্দ করি না।

সুযোগ পেলে জানিয়ে দেব।

হ্যাঁ, আরেকটা খবর জানিয়ে দিও। লালী ফিরে আসায় এবার পুজোর সময় কপার টাউনের ওয়াকার্স আর অফিসারদের তিন মাসের মাইনে বাড়তি বোনাস হিসেবে দেওয়া হবে।

গদগদ গলায় চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট সাহানী বললেন, খুবই আনন্দের কথা!

ওটা অবশ্য দেওয়া হবে আমার পার্সোন্যাল অ্যাকাউন্ট থেকে। নীলাদ্রি বললে।

অবাক হবার ভঙ্গিতে অয়ন বললে, আপনার নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে! কেন?

গভীর স্বরে নীলাদ্রি বললে, লালীকে ফিরে পেয়ে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী লোক। আমি চাই, সকলেই আমার সুখের ভাগ নিক।

ঈষৎ মাথা নুইয়ে সেখান অয়ন থেকে সরে গেল। একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে লাগল। তিন মাসের মাইনে একস্ট্রা বোনাস? টাকার অঙ্কটা কম হবে না, আর সেটা যাবে নীলাদ্রি গুপ্তের নিজের পকেট থেকে! হঠাৎ গুপ্তসাহেব এতটা দিলদরিয়া হয়ে পড়লেন কেন? স্ত্রীকে ফিরে পেয়ে সত্যিই কি তিনি সবাইকে তাঁর সুখের ভাগ দিতে চান? না, লালীর হঠাৎ মরা আর হঠাৎ বাঁচা নিয়ে কপার টাউনের আবহাওয়ায় যে সন্দেহের কানাকানি ছড়িয়ে পড়ছে, বকশিস দিয়ে সেটা বন্ধ করতে চান? যদি তাই হয়, নীলাদ্রি গুপ্তর মতো পদস্থ ব্যক্তির পক্ষে সেটাই তো স্বাভাবিক। কে চায় ঘরের কথা নিয়ে বাইরে আলোচনা হোক?

তবু একটা ‘কিন্তু’ থেকে যায়। সে কিন্তুটা যে কি, অয়ন তা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন না। লালীর সঙ্গে দেখা হলে হয়তো বুঝতে পারা যাবে।

ভাবতে ভাবতে বার—কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াল অয়ন।

হেল্লো বোস! কি দেব?—বার—ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলে।

অয়ন বললে, জিন অ্যান্ড লাইম। তোমার সবচেয়ে রেগুলার খদ্দের ডন রিভাসের খবর কি?

ম্যানেজার বললে, ওর কথা আর বোলো না। অনেক টাকা বাকি ফেলেছে জন, ধারে ড্রিঙ্কস দেওয়া তাই বন্ধ করে দিয়েছি।

তাই বুঝি আজকাল আর আসে না?

ক’দিন আসেনি। আজ হঠাৎ একটু আগে এসেছিল, কান্তা কালেলকরের খোঁজ করে আবার চলে গেল।

জিন—লাইমের দাম মিটিয়ে অয়ন আর দাঁড়াল না। কান্তার খোঁজ করছে ডন! তাহলে আগে কান্তা কোথায় দেখা যাক।

বল—রুমে গিয়ে অয়ন উঁকি দিল। ভালো নাচিয়ে বলে কান্তার নাম আছে, নাচের পার্টনার হিসেবে তার চাহিদাও আছে। তাই নাচের মজলিশে রোজই তাকে দেখা যায়। কিন্তু ডান্স ফ্লোরে আজ সে নেই। ডনের মতো কান্তাও আজ ক্লাবে গরহাজির! সবার আগোচরে কোথাও না কোথাও দুজনের দেখা হয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু কে জানে কোথায়!

হতাশ হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল অয়ন। বৃথাই আজ ক্লাবে আসা। কোনও নতুন সূত্র সংগ্রহ করা গেল না।

শ্লথ পায়ে অন্যমনস্কের মতো হাঁটতে লাগল অয়ন। কিন্তু বারান্দার বাঁকের মুখে এসেই দাঁড়িয়ে পড়ল। হ্যাঁ, তার অনুমানে ভুল হয়নি। সবার আগোচরেই দুজনের দেখা হয়েছে, কিন্তু এত কাছে অয়ন আশা করেনি।

বারান্দাটা বাঁক নিয়ে যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে ক্লাবের পুরোনো ভাঙা কিছু আসবাব জড়ো করা। এদিকটা একেবারে নির্জন। অল্প পাওয়ারের একটা আলো জ্বলছে। অয়ন দেখল, জড়ো—করা আসবাবের পাশে দাঁড়িয়ে কথা কইছে ডন আর কান্তা। পা টিপে টিপে ভাঙা আসবাবের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল সে।

উত্তেজিত গলায় ডন বলছিল, টাকা—টাকা চাই আমার!

কান্তা বললে, চুক্তি অনুসারে তোমার পাওনা তো মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কি হিসেবে চাও?

হিসেব—টিসেব বুঝি না। অনেক দেনা হয়েছে আমার, তাই টাকার দরকার।

তোমার পাওনা ছাড়া আরও দু—দফা টাকা তোমাকে পাইয়ে দি!য়েছি। আর পারব না। এবার তুমি নিজে চাও গে।

নিজেই চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার লোক দিতে রাজি হচ্ছে না।

কান্তা বললে, রাজি হচ্ছে না তো আমি কি করব?

ভালো চাও তো রাজি করাও তাকে।—ডন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে।

কান্তা তেতো গলায় বললে, কে ভেবেছিল ডাইনিটা মরেও বেঁচে উঠবে! আমাদের ব্যাড লাক—অগাধ টাকা হাতে এসেও এল না!

কান্তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ডন বলে উঠল, আমার কাজ আমি করেছি, ও জিনিস এই ডন রিভাস ছাড়া কেউ জোগাড় করতে পারত না। তোমাদের কাজ হাসিল হয়নি বলে আমি দায়ী নই। টাকা আমার চাই।

অল্প আলোতেও বুঝতে পারা গেল, কান্তার ঝকঝকে চোখ দুটো আরও ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। তবু নরম গলায় বললে, তুমি কি আমাদের ব্ল্যাকমেল করতে চাও ডন?

সোজা রাস্তায় টাকা আদায় না হলে তাই করতে হবে। পুলিশের কাছে তোমার লোককে ফাঁসিয়ে দিতে এক মিনিটও লাগবে না।

সাপের মতো হিসহিস করে উঠল কান্তা : তাহলে তুমিও কি বাঁচবে?

হা হা করে হেসে উঠল ডন। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্তা বললে, চুপ।

মুখ থেকে হাতখানা সরিয়ে ডন বললে, আমার ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না সুন্দরী! হংকং সাংহাই ফেরত ডন পুলিশের পরোয়া করে না। তোমার ডার্লিংকে কি করে বাঁচাবে, সেটা তুমি ভাবো। বেশি কিছু বলতে চাই না।

ডন চলে যাচ্ছিল, অদ্ভুত রকম ঠান্ডা গলায় কান্তা বললে, শোনো ডন, কত টাকা চাই তোমার?

আপাতত হাজার পাঁচেক।

কাল সন্ধেবেলা পাবে।

এই তো ভালো মেয়ের মতো কথা! কোথায় দেখা পাব তোমার? এখানে?

না, না, ক্লাবে নয়। নিরিবিলি জায়গায়—ধরো, শিলাইয়ের ধারে।

ও—কে! গুডনাইট কান্তা!

ডন চলে গেল শিস দিতে দিতে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কান্তাও এগিয়ে গেল। বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে অয়ন তার পিছু নিলে।

বল—রুমে গিয়ে ঢুকল কান্তা। অয়নও। সাহানী—দম্পতি আর নীলাদ্রি তখন বার ছেড়ে সেখানে এসে জুটেছে। ওয়ালজের তালে তালে শুরু হয়েছে নাচ—জোড়ায় জোড়ায়।

কান্তাকে দেখে নীলাদ্রি এগিয়ে এল। বললে, এসো কান্তা, আমি নাচের পার্টনার খুঁজছি।

মুখে মৃদু হাসি এনে সৌজন্যের সঙ্গে কান্তা বললে, আমার সৌভাগ্য।

দুজনে ডান্স—ফ্লোরে চলে গেল। সেই দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অয়ন হঠাৎ মিসেস সাহানীকে বললে, যদি কিছু মনে না করেন—আপনাকে পার্টনার পেতে পারি?

হাসিমুখে হংসী বললেন, নিশ্চয়—যদি চল্লিশ পার—হওয়া পার্টনার তোমার পছন্দ হয়।

অয়ন দূর থেকে লক্ষ করলে, নীলাদ্রির বুকের সন্নিকটে থেকে কান্তা কি যেন বলছে। নাচতে নাচতে সে চেষ্টা করতে লাগল নীলাদ্রি আর কান্তার কাছে কাছে থাকতে। কিন্তু যতবারই ওদের কাছাকাছি আসে, ততই ওরা সরে সরে যায়। খানিক পরে অয়ন দেখলে নীলাদ্রি—কান্তা নাচতে নাচতে বল—রুম থেকে বারান্দায় বেরিয়ে যাচ্ছে।

নাচের শেষে নীলাদ্রি একা ফিরে এল। বললে, কান্তার শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছে, তাই চলে গেল।

.

কোয়ার্টার্সে ফিরে অনেক রাত অবধি অয়নের ঘুম এল না। সিগারেটের পর সিগারেট পুড়ল। ভর্তি হয়ে গেল অ্যাশ—পট। তবু রহস্যের জট খুলল না।

তার সমস্ত হিসেব গোলমাল হয়ে গেছে আজ। ভুল হয়ে গেছে অঙ্কে।

ডন আর কান্তার সম্পর্ক নিয়ে এতদিন সে যা ভেবেছিল, আজ ক্লাবে গিয়ে বোঝা গেল যে, তার সবাটাই মিথ্যে। কান্তাকে ডন শাসিয়েছে, ‘টাকা না পেলে তোমার লোককে পুলিশের কাছে ফাঁসিয়ে দিতে আমার এক মিনিটও লাগবে না!’ এই কথা থেকে স্পষ্টই কি প্রমাণ হয়ে যায় না যে ডন রিভাস আর যাই হোক, কান্তার প্রণয়ী নয়? প্রণয়ী হলে সে কান্তাকেই ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করতে না। আর, কান্তার সঙ্গে তার প্রণয়—সম্পর্ক যখন নেই, তখন খুনির দলের একজন হলেও খুনি সে নয়।

ডন বারবার কান্তাকে বলেছে ‘তোমার লোক’। বলেছে, ‘আমার ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না, তোমার ডার্লিংকে কি করে বাঁচাবে তাই ভাবো!’ সুতরাং আরও একবার পরিষ্কার হয়ে গেল যে কান্তার প্রেমিকই লালী গুপ্তার খুনি। সে ধীরাজ ডাক্তার নয়, ডন রিভাস নয়, কোনো তৃতীয় ব্যক্তি।

কিন্তু কে সে—লালী বেঁচে ওঠার যার স্বার্থে ঘা লাগল, অগাধ টাকা যার হাতে এসেও এল না?

কে সেই নেপথ্য নায়ক তৃতীয় ব্যক্তি?

হঠাৎ বিছানায় উঠে বসল অয়ন। মাথার গোড়ায় টেলিফোন। রিসিভার তুলে ডায়াল করলে হীরা সিংকে।

হ্যালো, আমি অয়ন বলছি। যত তাড়াতাড়ি পারো কলকাতায় অর্ধেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে তোমায়—প্রবীণ অ্যাটর্নি অর্ধেন্দু রায়চৌধুরি, লালীর বাবার পুরোনো বন্ধু।…কেন? মনে হচ্ছে, রহস্যের ধোঁয়া কেটে গিয়ে এইবার একটা স্পষ্ট ক্লু দেখতে পাব! কাল সব বলব— এখন বড় ঘুম পাচ্ছে।

রিসিভার রেখে, আলো নিভিয়ে, নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ল অয়ন।

.

ধলাই পাহাড়ের কোলে পাইনের জঙ্গল, ওপাশ দিয়ে পাহাড়ের পা ছুঁয়ে বয়ে চলেছে শিলাই।

আকাশে সূর্যাস্ত হচ্ছে।

পাইনের ঠান্ডা ছায়ায় ঝরা পাতার পুরু গদির ওপর বসেছে অয়ন আর লালী। আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে চুপ করে বসে আছে লালী। নিজের ভেতরে নিজে ডুবে আছে যেন।

অয়ন তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, কপার টাউনে ফিরে আসার পর তুমি কেমন যেন বদলে গেছ লালী।

চোখ ফিরিয়ে বললে, কপার টাউনে ফিরে আসার পর নয়, বলো মরে যাবার পর বদলে গেছি। আমার জীবনটাই যে বদলে গেছে অয়ন!

কিন্তু আমি দেখছি, তুমি ছাড়া তোমার জীবনের কিছুই বদলায়নি। তোমার বাড়ি, তোমার ঐশ্বর্য, তোমার প্রতিদিনের সংসার—যাত্রা, তোমার স্বামীর যত্ন—ভালোবাসা আগেও যা ছিল, এখনও তাই। বদলে গেছ শুধু তুমি।

নিরাসক্ত গলায় লালী বললে, কি করে বুঝলে? কই, আর কেউ তো একথা বলে না!

একটু শান্ত হেসে অয়ন বললে, তোমাকে আমার মতো আর কেউ বোধ হয় জানে না। তাই তফাতটা কেউ টের পায়নি। একটা প্রশ্ন করব লালী? নিজেকে তুমি এমন করে গুটিয়ে নিয়েছ কেন? সেই একুশে জুলাইয়ের রাতটাকে তুমি কি এখনও ভুলতে পারোনি? তোমার মনে কি সেই ভয়ের ছায়া রয়েছে?

কয়েক মুহূর্ত লালী জবাব দিলে না। তারপর আস্তে আস্তে বললে, তুমি ঠিকই ধরেছ অয়ন। একটা অজানা ভয় এখনও আমাকে ভয় দেখায়। আমার কেবলই মনে হয়, কি যেন বিপদ আমার পায়ে পায়ে ঘুরছে।

কেন এমন মনে হয় লালী?

কেন জানো? মরবার আগে আমি জীবনের সুন্দর দিকটাই শুধু দেখেছিলাম। এখান থেকে আমরা যেমন চাঁদের উজ্জ্বল পিঠটাই দেখি! কিন্তু বেঁচে ওঠার পর জীবনের যে চেহারা দেখতে পোলাম, তা বড় কুৎসিত—চাঁদের অপর পিঠের মতো অন্ধকার! এখানে মানুষ মানুষকে বিষ দেয়—মানুষই মানুষের শত্রু।

অয়নের মুখখানা গম্ভীর হয়ে এল। জীবনের খারাপ দিকটাও জেনে রাখা ভালো। খারাপ অভিজ্ঞতা মানুষকে সাবধান হতে শেখায়।

লালী বললে, কিন্তু সাবধান হতে শেখা মানেই তো মানুষকে অবিশ্বাস করতে শেখা! তাহলে সংসারে স্নেহ মায়া ভালোবাসা—সবই কি নকল? তাহলে কি বুঝব কেউ আমার আপন নয়—কেউ আমাকে চায় না!

পুরোনো আইভরির মতো লালীর মুখের রঙ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ঠোঁট দু’খানা কাঁপছে থরথর করে।

মমতায় ভরে উঠল অয়নের বুক। সেই লালী। মুর্শিদাবাদে তার কৈশোর—সঙ্গিনী, তার প্রথম যৌবনের মনোনীতা! লালীর একখানা হাত নিজের মুঠির মধ্যে নিয়ে অত্যন্ত সহজ ভাবে সে বললে, না লালী, সংসারে অন্তত একজন আছে যে তোমাকে চায়। আর কিছুই সে চায় না—শুধু চায় তুমি থাকো। কেননা, তুমি থাকলেই তার থাকার আনন্দ, তুমি না থাকলে তার সবটাই ফাঁকা!

অয়নের মুখের দিকে চেয়ে লালীর দুই চোখ স্নিগ্ধ হয়ে এল। বললে, আমি জানি অয়ন, তোমার চেয়ে বড় বন্ধু আমার আর নেই। তাই তোমার কাছে যা বলি, সবার কাছে তা বলতে পারি না।

তোমার এই ভয়ের কথা গুপ্তসাহেবকে বলেছ?

বলেছি। নীল বলে, সেই একুশে জুলাইয়ের ভয়টা আমার মনের বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওটাকে আমল দিতে নেই।

ঠিকই বলেন।—অয়ন প্রসঙ্গ পাল্টালে : আচ্ছা, নীলাদ্রি গুপ্তকে তুমি তো পছন্দ করে বিয়ে করেছিলে?

না, পছন্দ করেছিলেন আমার বাবা।

জানাশোনা হল কি করে?

পূর্ব বাংলার এক জমিদার ফ্যামিলির ছেলে ও। বাংলা ভাগ হবার পর কলকাতায় আসে। ছাত্র হিসেবে ব্রিলিয়ান্ট, জিওলজিতে অনার্স। বাবার কাছে এসেছিল জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের চেষ্টায়। বাবা তখন কপার টাউনের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, নীলকে নিজের পি. এ. করে নিলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই ও ডিরেক্টর হয়ে গেল। বাবা তখন ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দিলেন।

একটা কথা খোলাখুলি জিজ্ঞেস করতে চাই লালী। বিয়ে করে তুমি সুখী হয়েছ তো?

হয়েছিলাম বইকি! নীলাদ্রি রূপে—গুণে অসাধারণ, এমন স্বামী পেলে কোন মেয়ে না সুখী হয়? শুধু স্বামী—ভাগ্য নয়, বাবা মায়া যাবার আগে সতেরো লাখ টাকা আমার নামে রেখে গেলেন। তবু তোমার কথাটাই মনে পড়ে আয়ন—’বড় বেশি সুখ ভাল নয়!’ মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি গরিব ঘরের মেয়ে হতাম, সাধারণ স্বামী নিয়ে সাধারণ জীবন কাটিয়েই হয়তো সত্যিকার সুখ পেতাম! আমার ভাগ্যকে কেউ হিংসে করত না!

কে তোমায় হিংসে করে বলে মনে হয়?

এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে লালী বললে, কান্তা কালেলকর।

অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেছে। শিলাইয়ের ওপারে আকাশের পৃষ্ঠায় লাল পেন্সিলের রেখাগুলো কে যেন রবার দিয়ে ঘষে মুছে দিচ্ছে। অয়ন উঠে পড়ে বললে, চলো, ফেরা যাক।

পাইন—জঙ্গলের রাস্তায় মোটর রেখে ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল। গাড়ির কাছে এসে অয়ন বললে, তুমি যাও। আমার ফিরতে দেরি হবে।

গাড়িতে উঠে বসল লালী। তার দিকে একটু ঝুঁকে অয়ন পুনরায় বললে, এই কথাটা মনে রেখো যে, তোমার বিপদ—আপদে একটা মানুষ সব সময় জেগে আছে। যখনই দরকার বুঝবে, আমাকে ডেকে পাঠিও।

স্নিগ্ধ হেসে লালী ঘাড় নাড়লে। গাড়ি চলে গেল।

অয়ন উল্টো দিকে পা চালালে। তার চোখ দুটো শিলাইয়ের দিকে।

কান্তা বলেছিল ডন রিভাসকে ‘কাল সন্ধেবেলা টাকা পাবে।’ ক্লাবে নয়, শিলাইয়ের ধারে। সন্ধ্যা নেমেছে, ওদেরও আসার সময় হয়েছে।

আশেপাশে সতর্ক চোখ রেখে অয়ন শিলাইয়ের ধার দিয়ে এগোতে লাগল। তার মাথার মধ্যে একটা নামই ঘুরছে—কান্তা! কান্তা। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ব্ল্যাকমেলার ডনের মুখ বন্ধ করতে আসছে কান্তা। হীরা সিংকে দিয়ে তাকে অনায়াসেই অ্যারেস্ট করানো যেত। কিন্তু না, অন্য রাস্তা ধরাই বুদ্ধিমানের কাজ। ব্ল্যাকমেলারের নীতির বালাই থাকে না। তবে যে—মুখ টাকা দিয়ে বন্ধ হয়, সে—মুখ আবার টাকা দিয়েই খোলা যায়? তাহলে কি রহস্যের চাবিকাঠি অয়নের হাতে চলে আসবে না? পুলিশকে না বলুক, অয়নকে ডন নিশ্চয়ই বলে দেবে খুনি কে। কান্তা চলে গেলে আজই ডনের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতে হবে।

ভাবতে ভাবতে অয়ন শিলাইয়ের তীরে একটা বড় পাথরখণ্ডের কাছে পৌঁছতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। পাথরটার পাশে কে একজন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে আছে। এমন বেয়াড়া সময় কে এখানে? ঝুপসি অন্ধকারে চেনা যায় না।

পকেট থেকে টর্চ বার করে জ্বালতেই অয়ন দারুণ চমকে উঠল।

নির্জন নদীর ধারে শুয়ে রয়েছে ডন রিভাস। হাতের শিথিল আঙুলের ফাঁকে একটা কর্ক—টিপড সিগারেট। দেহের কোথাও কোনও আঘাতে চিহ্ন নেই।

তবু অয়নের বুঝতে দেরি হল না যে ডনও ধীরাজ ডাক্তারের সঙ্গী হয়েছে।