লাল নীল – ৩

তিন

কপার টাউনের ক্লাক হাউস এখনও দেখা হয়নি আপনার। চলুন, আজ সন্ধ্যাবেলা যাই।

ধলাই পাহাড়ের কোলে ঘেঁষে অনেকখানি জমির ওপর এই ক্লাব হাউস। চারপাশে বাগান, টেনিস কোর্ট, সাঁতারের বাঁধানো চৌবাচ্চচা। ভেতরে বিলিয়ার্ড রুম আছে—আছে বার, ডান্স—ফ্লোর। কপার টাউনের মানুষগুলো দেশি, কিন্তু তাদের জীবনযাত্রা বিদেশি। দিনে তারা এই যন্ত্র—নগরীর যন্ত্র, আর রাতে রক্তমাংসের মানুষ। সন্ধ্যা সাতটার পর থেকে এ জায়গাটা ক্রমশ সরগরম হয়ে ওঠে। রাত বারাটো—একটা অবধি।

কপার টাউনের ক্লাব হাউস কিন্তু সবার জন্যে নয়। মোটা মাইনের কৌলীন্য যাদের আছে, শুধু তাদেরই জন্য—তারাই মেম্বার হতে পারে। নিচু মহলের লোক যারা—অর্থাৎ মজদুর, তাদের জন্যও আমাদের ব্যবস্থা আছে। লেবার—ব্যারাকের কাছাকাছি একটা মহুয়ার দোকানে তারা রোজ ছুটির পর আমোদ কিনতে যায়। আসলে কিন্তু ক্লাব আর মহুয়ার দোকানে কোনো তফাত নেই—তফাত কেবল পোশাকের, ভাষার আর বোতলের লেবেলের।

আজকের রাতটা বেশ ঝরঝরে। আকাশও পরিষ্কার। অয়ন বোসকে ক্লাবের ফটকে দেখা গেল। মেম্বারশিপের চাঁদা নিয়মিত দেওয়া সত্ত্বেও অয়ন নিয়মিত ক্লাবে আসত না। আসত মাঝে মাঝে খেয়াল হলে। তার মদ্যপানের শখ আছে—অভ্যাস নেই, তাই নিয়মিত আসার দরকারও হত না। ইদানীং নিত্য আসে। আসার একটা গোপন উদ্দেশ্যও আছে। এই ক্লাবের মধ্যে কপার টাউনের উঁচু মহলকে একসঙ্গে পাওয়া যায়, নেশার ঝোঁকে মনের কথার লেনদেন হয়, নকল সভ্যতার মুখোশগুলো মুখ থেকে মাঝে মাঝে খসে পড়ে। অন্যের অসতর্ক মুহূর্তের অপেক্ষায় অয়ন সতর্ক হয়ে থাকে।

অয়নের সঙ্গে আপনিও ভেতরে চলে যান।

ডান্স হল থেকে মিউজিকের আওয়াজ আসছে। বার থেকে উচ্চচকণ্ঠের হাসি—কলরব, বিলিয়ার্ড রুম থেকে টুকরো টুকরো কথাবার্তা। কোন ঘরে যাবেন আপনি? অয়নের সঙ্গে যখন এসেছেন তখন তার পিছু পিছু ‘বারে’ই ঢুকে পড়ুন।

আজকের আসর জমজমাট। কোণের একটা টেবিলে তাসের জুয়া চলছে—ডন রিভাস সঙ্গীদের সঙ্গে ‘পোকার’ খেলছে। এক পেগ জিন ফরমাস করে অয়ন এসে জুটল সেই টেবিলে।

হ্যালো ডন।

হ্যালো বোস!

আজ তোমার ‘লাক’ কেমন?

ডন মুখ বিকৃত করে বললে, বুড়ি স্ত্রীর মতো—একদম ঠান্ডা।

ডনের রসিকতাগুলো প্রায়ই আদি রসাত্মক। হাত পেতে সে আবার বললে, কিছু ক্যাশ ধার দাও না। দেখি, তোমার মতো নওজোয়ানের পয়ে আমার বুড়ি স্ত্রী গরম হয় কিনা।

হল ফাটিয়ে হেসে উঠল ডন। পকেট থেকে দশ টাকার একখানা নোট বের করে অয়ন বললে, সবে মাসের চোদ্দ তারিখ, মাইনেটা এরই মধ্যে ফুঁকে দিলে?

ডন তাস খেলতে খেলতে বললে, কি করি বলো? আমার হাতে এলেই টাকাগুলোর পাখা গজায়।

বয় জিন দিয়ে গেল। ডন বললে, আওর এক পেগ—বোস সাবকা অর্ডার।

গ্লাসটা ডনের দিকে এগিয়ে দিয়ে অয়ন বললে, ক্লাবের চাঁদা তোমার ছ’ মাস বাকি, ‘বারে’র বিল একগাদা পড়ে আছে, তোমার দর্জি তাগাদ করে করে হায়রান! তোমার মত এমন বেহিসেবী মানুষ আর দেখি না।

এক চুমুকে গ্লাস খালি করে ডন বললে, দুনিয়ায় বোকারাই হিসেব করে। আরে, জীবনটা এক পেগ জিনের মতো। ডেসটিনি—নিয়তি কখন এক চুমুকে সাবাড় করে দেবে কে জানে। দেখলে তো, মিসেস গুপ্তার কী হল। বিয়ের রাতেই খতম। হিসেব মিলল কি?

অয়ন ডনের মুখের পানে লক্ষ করলে। কিন্তু লক্ষ করার মতো কোনো চিহ্ন নেই। অয়ন বললে, জীবন সম্পর্কে তোমার ফিলজফি শুনতে ভালো, কিন্তু এতে বদনাম হয় যে! তুমি একটা ফ্যাক্টরির ম্যানেজার, অথচ চারদিকে তোমার দেনা! লোকে বলবে কি বলো তো?

ডন বললে, নেভার মাইন্ড বোস। দু—চার দিনের মধ্যেই একটা ফালতু মোটা টাকা পেয়ে যাচ্ছি, সব দেনা এবার মিটিয়ে দেব—পাই টু পাই।

বাই জোভ। মোটা টাকা ফালতু পেয়ে যাচ্ছ। কোত্থেকে? উৎসুক গলায় অয়ন বললে।

ডন গম্ভীর হয়ে বললে, টাকা দুনিয়ায় ছড়ানো রয়েছে, কুড়িয়ে নিতে পারলেই হল। আমি যখন হংকং—এ ছিলাম, চার হাতে টাকা কামিয়েছি, বুঝলে বোস?

তাই নাকি! হংকং—এ ছিলে তুমি। কি কাজ করতে?

মুচকে হেসে ডন জবাব দিলে, ধর্মযাজকের কাজ!—হ্যালো কান্তা!

দেখা গেল, বারে কান্তা এসেছে। টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলে, ডক্টর দাসকে দেখেছ?

বিলিয়ার্ড রুমে।

কান্তা আর দাঁড়াল না। ব্যস্তভাবেই চলে গেল।

অয়ন বললে, এক হাত টেবল—টেনিস খেলে আসি।

.

কিন্তু টেবল—টেনিসের ঘরের পথ মাড়াল না অয়ন। কান্তার পিছু পিছু গিয়ে ঢুকল বিলিয়ার্ড—ঘরে।

ধীরাজ দাস আর সাহানী ‘স্কিটল’ খেলছে। কান্তাকে দেখে ডাক্তার বললে, এক্সকিউজ মি মিস্টার সাহানী, কান্তার সঙ্গে একটা জরুরি কথা সেরেই আসছি। এই যে অয়ন, মিস্টার সাহানীর সঙ্গে আমার হয়ে খেলো তো।

বেরিয়ে গেল কান্তার সঙ্গে ধীরাজ ডাক্তার। কিন্তু কী কথা থাকতে পারে কান্তার সঙ্গে ডাক্তারের, যা প্রকাশ্যে বলা যায় না?

একবার ‘কিউ’ চালিয়েই অয়ন ‘উঃ’ বলে উঠল।

কি হল? সাহানী প্রশ্ন করলেন।

ডান হাতের কব্জিটা মচকে গেছে কিনা—

বটে। তবে থাক।

ধন্যবাদ দিয়ে অয়ন পায়ে পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল। কোথায় গেল ওরা? এদিক—ওদিক তাকাল সে। বাগানে গেছে নাকি?

বারান্দা থেকে নেমে এক—পা এক—পা করে এগোতে লাগল অয়ন। ঝিলমিল রাত, শুক্লপক্ষ শুরু হয়েছে। ঘাস—জমির ওপর হাঁটতে হাঁটতে বাগানের এধার—ওধার লক্ষ করলে সে। মরশুমী ফুলের বেডে পাশে, মার্বেল মূর্তির ধারে, লতাকুঞ্জের তলায়। কোথাও নেই।

হাঁটতে হাঁটতে বাগানের শেষ প্রান্তে চলে এল অয়ন। এদিকে শুধু ধলাই পাহাড়। ফেরা যাক তাহলে।

কিন্তু ফিরে আসতে আসতে একটা জায়গায় অয়নের পা আটকে গেল। কান সজাগ করে শুনতে লাগল সে। আওয়াজ আসছে একটা প্রকাণ্ড ঝাউয়ের আড়াল থেকে।

আজকাল আমার কোয়ার্টারে আর যাও না কেন?

ধীরাজ ডাক্তারের স্বভাব—নীরস গলা।

সময় পাই না।

কান্তার গলা চিনতে অয়নের ভুল হল না।

বাজে কথা রাখো। সময় পাও না, না আমাকে এড়িয়ে যেতে চাও?

কান্তার গলার স্বর একটু তীব্র হল : যদি তাই চাই, দোষ কি? ভুলে যাচ্ছ কেন তুমি পঞ্চাশের কাছে, আর আমি এখনও তিরিশ পার হইনি। তুমি কি আশা করো জীবনভর আমি তোমায় নিয়ে থাকব?

হ্যাঁ, তাই থাকবে। তোমায়—আমায় এই শর্তই ছিল।—ধীরাজ ডাক্তারের নীরস গলা আরও বিশ্রী শোনাল। বলতে লাগল, সাত বছর আগে বম্বে শহরে কলবা দেবীর এক বস্তিতে তুমি পচে মরছিলে। লেখাপড়া কিছু শিখেছিলে, কিন্তু কাজ ছিল না। দু’—বেলা পেট ভরে খাওয়া জুটত না। সেই নর্দমা থেকে তুলে এনে তোমাকে আমি খাইয়ে পরিয়ে নতুন করে গড়লাম, সমাজের উঁচু তলায় ঠাঁই দিলাম। আর, তুমি এমনি বেইমান যে আজ আমাকেই পুরোনো জুতোর মত ছুড়ে ফেলে দিতে চাও।

কে বললে এসব কথা?

তুমি কি মনে করো কান্তা, আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? লুকিয়ে লুকিয়ে তুমি কার সঙ্গে ভিড়েছ আমি জানি না ভেবেছ?

তোমাদের লুকোচুরি খেলা আমি সব জানি।

কি জানো তুমি?

তোমার ভালবাসার নতুন খদ্দের জুটেছে—চড়া দাম হেঁকেছে সে। তাই যৌবনের দেমাকে তুমি আমাকে আর পাত্তা দিচ্ছ না।

ধীরাজ ডাক্তারের গলায় যেন করাতের ধার।

তার সঙ্গে তুমিই তো মিশতে বলেছিলে। বলোনি?

স্বার্থের জন্য বলেছিলাম, কিন্তু সেই সুযোগ নিয়ে তলে তলে তুমি নিজের আখের গুছিয়ে নেবে, সেটা কি ভেবেছিলাম? আমি জানতে পেরেছি, পাসপোর্টের দরখাস্ত করেছ তোমরা—শিগগিরই তোমরা দুজনে বিদেশে পালাচ্ছ। তোমায় আমি সাবধান করে দিচ্ছি কান্তা, এতটা বাড়াবাড়ি কোরো না! জেনে রাখো, তোমার তাসের ঘর আমি এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে পারি। লালী গুপ্তা বেশি দিন মরেনি, আর ঝাউবনী থানাও বেশি দূরে নয়, তোমার ভালোবাসার লোককে এক মুহূর্তে ফাঁসিয়ে দেব!

কান্তার গলা শোনা গেল না। বেশ কয়েক সেকেন্ড। তারপর হঠাৎ হেসে বললে, আচ্ছা পাগল তুমি দাস! বাড়াবাড়ি না হয় একটু করেইছি, কিন্তু সে তো তোমার—আমার স্বার্থের জন্যে। সুখে থাকতে হলে টাকার দরকার হয় না? আর, তুমি আমাকে কি না বললে!

অভিমানে কান্তার গলা বুজে এল।

আমাকে ভাঁওতা দেবার চেষ্টা কোরো না কান্তা।

ধীরাজ ডাক্তারের গলা একটু নরম শোনাল।

কান্তার গলা শোনা গেল, তোমাকে আমি ভাঁওতা দেব। একথা তুমি বলতে পারলে। বেশ, কাল থেকে দেখো আমি তার সঙ্গে মেলামেশাই ছেড়ে দেব।

ঠিক?

উত্তরে মৃদু একটা চুম্বনের শব্দ শোনা গেল। কান্তা বললে, রাগ পড়েছে তো? চলো ক্লাবে যাই, কেউ হয়তো এসে পড়বে।

ধীরাজ দাস আর কান্তা ঝাউয়ের আড়াল থেকে বেরোতেই, অয়ন চট করে ঝাউয়ের আড়ালে সরে গেল। আকাশ—পাতাল ভাবতে লাগল সে অনেকক্ষণ। এইমাত্র সে যা শুনল, হীরা সিংকে জানানো বিশেষ দরকার। তার ঘরে হীরা সিংয়ের আসার অপেক্ষায় বসে না থেকে থানায় যাওয়াই ভাল।

দ্রুত পায়ে বাগান পার হয়ে অয়ন গেটের দিকে চলল। কিছু দূর থেকেই সে দেখতে পেল, চেনা স্টুডিবেকার গাড়িখানা সাঁ করে গেটের মধ্যে ঢুকল। লালী মারা যাওয়ার পর নীলাদ্রি গুপ্ত এই প্রথম ক্লাবে এল। লালীর শোকটা নীলাদ্রির মনে গভীরভাবে লেগেছিল নিশ্চয়, লোকজন বন্ধু—বান্ধবের সঙ্গ তাই এড়িয়ে চলত। কিন্তু শিলাই নদীর বন্যাবেগ যেমন আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসে, মানুষের শোকের বেগও তাই।

নিজের ছোট্ট মরিসখানাতে উঠে বসে স্টার্ট দিলে অয়ন।

.

হীরা সিং বললে, রহস্যের অন্ধকারে একটু যেন আলোর ইসারা দেখতে পাচ্ছি অয়ন। তুমি যা বললে, তা থেকে এইটুকু স্পষ্ট হয়েছে যে, মিসেস লালী গুপ্তার খুনির সঙ্গে ধীরাজ ডাক্তার আর কান্তা দুজনেই রীতিমতো জড়িত। আর, এও বোঝা যাচ্ছে যে, কান্তার নতুন প্রণয়ী যে, সেই হচ্ছে খুনি। নইলে ধীরাজ ডাক্তার কান্তাকে ভয় দেখাতো না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কার সঙ্গে কান্তার গোপন প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে? কে সে?

অয়ন বললে, ডন রিভাস হতে পারে। কেননা, সে হচ্ছে আমাদের পয়লা নম্বর সন্দেহভাজন ব্যক্তি। কান্তার মতলব বিদেশে পালাবে প্রেমিকের সঙ্গে—হয়তো ঘর বাঁধবে সেখানে। বিদেশি লোক, জোয়ান বয়স, মোটামুটি সুপুরুষ—ভগবান জানেন, কি করে তার হাতে ফালতু মোটা টাকা আসে—কান্তার মতো নোংরা চরিত্রের মেয়ের কাছে ডন আদর্শ নাগর নয় কি?

কিন্তু তুমি বলেছিলে না, নীলাদ্রি গুপ্তের ওপর কান্তার দুর্বলতা আছে?

সেখানে সুবিধে নেই দেখে কান্তার মত বদলাতে কতক্ষণ? বুড়ো ধীরাজ ডাক্তারের পায়ে জীবন—যৌবন সঁপে দেওয়ার চেয়ে হয়তো ডনকেই সে মন্দের ভালো হিসেবে বেছে নিয়েছে। আচ্ছা, হীরা সিং, ওরা তো পাসপোর্টের চেষ্টা করছে। তুমি পাসপোর্ট অফিস থেকে খবর নিতে পারো না?

হীরা সিং বললে, পারি। কিন্তু যদি নাম ভাঁড়িয়ে থাকে? এই ধরনের লোকেরা তাই করে। একমাত্র ধীরাজ ডাক্তারের কাছ থেকেই খুনির নামটা আদায় করা যেতে পারে। কিন্তু আদায় করতে হলে ডাক্তারকে অ্যারেস্ট করতে হয়।

অয়ন সাগ্রহে বললে, তাই করো হীরা সিং—দেরি না করে দু’নম্বর সাসপেক্ট ধীরাজ দাসকেই গ্রেফতার করো। কান্তা অত্যন্ত চতুর মেয়ে, বুড়োর চোখে ধুলো দিয়ে, কবে বিদেশে পালিয়ে যাবে কে জানে—খুনিকে ধরার কোনও আশাই আর—

অয়নের কথা চাপা দিয়ে টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। হীরা সিং রিসিভার তুলে নিলে, ইয়েস, ঝাউবনী পুলিশ—স্টেশন—ইন্সপেক্টর হীরা সিং বলছি—

তারপরেই ইন্সপেক্টরের মুখ মেঘলা থমথমে হয়ে উঠল। রিসিভার নামিয়ে রাখতেই অয়ন বললে, কি হল?

আসামি ফাঁকি দিয়েছে।—হীরা সিং জবাব দিলে।

তার মানে?

ধীরাজ ডাক্তার এইমাত্র মোটর—অ্যাক্সিডেন্টে চোট পেয়েছে।

বাঁচবে কিনা সন্দেহ!

.

না, ধীরাজ দাস বাঁচল না। পরদিনই মারা গেল।

ভোরের দিকে অল্পক্ষণের জন্য জ্ঞান ফিরে এসেছিল। হীরা সিংহের প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার শুধু বললে, গাড়ির টাই—রডটা খোলা ছিল—জানতে পারিনি। রাস্তার বাঁকের মুখে—

আর কিছু বলতে পারেনি সে। এইটুকুই তার শেষ জবাববন্দি।

হীরা সিং অয়নকে বললে, স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে চাকার সরাসরি যে যোগ থাকে, তা টাই—রডের সাহায্যে। এ—কথা যারা মোটর চালায়, তারা সবাই জানে। টাই—রড খোলা। এর মানে কি বলতে পারো?

অয়ন বললে, চুপিসারে কেউ খুলে রেখেছিল। এছাড়া অন্য মানে হয় না।

রাইট।—ডাক্তার কিছু না জেনে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে চালিয়েছিল। কিন্তু রাস্তায় বাঁকের মুখে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দেখে চাকা ঘুরছে না। তখন আর সামলাবার উপায় নেই। ঢালু পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি ডাইনে না বেঁকে সোজা গিয়ে পড়ল পাশের খাদে। সুতরাং, একে অ্যাক্সিডেন্ট বলবে, না খুন বলবে?

অয়ন বললে, কিন্তু আমি ভাবছি, এই খুনের মধ্যেও কী অদ্ভুত বুদ্ধির পরিচয়! ধীরাজ ডাক্তারের মুখে টাই—রডের কথা না শুনলে সকলেই ভাবত এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা—পরিকল্পিত খুন বলে কেউ সন্দেহই করত না। খুনি অসাধারণ বুদ্ধিমান!

হীরা সিং বললে, তা তো বুঝলাম। কিন্তু সেই যে তোমাদের বাংলায় ছড়া আছে—হারাধনের ছেলেদের মধ্যে এখন তাহলে রইল বাকি দুই! ডন রিভাস আর কান্তা। এই দুজনের ওপর এখন আরও সজাগ চোখ রাখতে হবে।

অয়ন বললে, আচ্ছা, কান্তাকে জেরা করলে হয় না?

হীরা সিং মাথা নেড়ে বললে, তাতে ফল কিছু হবে বলে মনে হয় না অয়ন। খুনিই যদি কান্তার নাগর হয়, তবে প্রণয়ীর সঙ্গে বেইমানি সে করবে না। মাঝখান থেকে খুনি হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। তার চেয়ে নজর রাখা যাক, সমস্ত এয়ারপোর্টে খবর দিয়ে রাখি, ওরা ভাগবার চেষ্টা করলে একসঙ্গে দুজনকেই ধরা যাবে।

কিন্তু দিন দুই বাদে এমন একটা ব্যাপার ঘটল, যা অয়নের ধারণার বাইরে। শুধু অয়ন নয়, আমার—আপনার—সমস্ত কপার টাউনের ধারণার বাইরে।