লাল নীল – ২

দুই

নীলাদ্রি জানল যে, শিলাই নদীর বানে লালী ভেসে গেছে।

ব্যাপারটা অভাবিত। হয়তো নিয়তির নির্দেশেই এমনটা হয়েছে। কিন্তু লালী যখন তাকে ছেড়েই যেতে পারল, তখন তার দেহটা আগুনে ছাই হোক, অথবা স্রোতে ভেসে যাক—নীলাদ্রির কাছে একই। হিন্দু শাস্ত্রমতে সদগতি না হলেও মৃতের একটা গতি তো হয়েছে।

কিন্তু একদিন বাদেই যে ব্যাপারটা ঘটল, নীলাদ্রির কাছে সেটা আরও অভাবিত। সকাল থেকে পরিচিত বন্ধু—বান্ধবীদের মুখে সান্ত্বনার বাঁধা বুলি শুনে শুনে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। দুপুরে লাঞ্চের পর এল তার স্টেনো কান্তা কালেলকর। অফিসে কিছু জরুরি চিঠি এসে পড়ে আছে, সেগুলোর জবাব দেওয়া দরকার। ডিকটেশন দিতে দিতে নীলাদ্রির তন্দ্রা আসছিল, সেই সময় বেয়ারা এসে জানালে, এক আদমি সাহেবের দেখা চায়।

বিরক্ত হল নীলাদ্রি। বললে, পরে দেখা হবে।

বেয়ারা চলে গিয়েই আবার ফিরে এল। লোকটি নাকি বলছে, জরুরি কথা আছে।

উঠতেই হল নীলাদ্রিকে। নিভে—যাওয়া পাইপটা আবার ধরিয়ে ড্রয়িংরুমে গেল। ঘরে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল নীলাদ্রি।

আগন্তুক দাঁড়িয়ে উঠে বললে, আমি ইন্সপেক্টর হীরা সিং।

ঝাউবনী পুলিশ—স্টেশন থেকে আসছি।

নীলাদ্রির কটা রঙের চোখ দুটো এক মুহূর্তের জন্য যেন পাথরের হয়ে গেল। তারপরেই সহজভাবে হাত বাড়িয়ে দিলে করমর্দনের জন্য।

বসুন। ইন্সপেক্টর মালহোত্রা কি বদলি হয়েছেন?

হ্যাঁ, হঠাৎ বদলি হয়েছেন। তাঁর জায়গায় আমি মাত্র দিন তিনেক হল এসেছি।

জেনে সুখী হলাম। কিন্তু আমার কাছে কেন এসেছেন ইন্সপেক্টর?

হীরা সিং নম্র ভদ্রতার সঙ্গে বললে, একটা বিষয় জানতে। আপনার এই মনের অবস্থায় কোনো প্রশ্ন করা যদিও আমার উচিত নয়, তবু—

একটু পোশাকী হাসি মুখে এনে নীলাদ্রি বললে, ঠিক আছে। বলুন, কি জানতে চান?

গত পরশু দিন সন্ধেবেলা মিসেস গুপ্তা হঠাৎ মারা গেছেন শুনলাম—

ঠিকই শুনেছেন।

ভারি দুঃখের বিষয়! কি করে মারা গেলেন?

হার্টফেল করে।—নীলাদ্রির মুখে বিষণ্ণ গাম্ভীর্য নেমে এল।

হীরা সিং কোলের ওপর টুপিটা নাড়াচাড়া করতে করতে বললে, মিস্টার গুপ্ত, আপনি কি নিশ্চয় করে বলতে পারেন যে অন্য কোন কারণ ছিল না?

হতবাক হয়ে গেল নীলাদ্রি। সে কিছু বলার আগেই দরজার কাছ থেকে একটা নীরস গলার জবাব শোনা গেল : নিশ্চয় বলতে পারেন।

ধীরাজ ডাক্তার কখন ঘরে ঢুকেছেন, কেউ লক্ষ করেনি।

ডাক্তার বললেন, মিসেস গুপ্তার হার্ট উইক ছিল। দুর্ঘটনার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম, নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি হার্ট ফেলিওর ছাড়া অন্য কোনো কারণ ছিল না।

নীলাদ্রি পরিচয় করিয়ে দিলে, ডক্টর ধীরাজ দাস—কপার টাউন হসপিটালের চিফ মেডিকেল অফিসার। আর, ইন্সপেক্টর হীরা সিং—ঝাউবনী থানার নতুন অফিসার।

টুপি থেকে চোখ তুলে হীরা সিং বললে, আমি কিন্তু অন্য রিপোর্ট পেয়েছি।

কি রিপোর্ট?

মিসেস গুপ্তাকে বিষ দেওয়া হয়েছিল।

ঘরের মধ্যে নিরেট স্তব্ধতা। হঠাৎ সেই স্তব্ধতা খানখান করে দিল ধীরাজ ডাক্তারের কর্কশ হাসি। হাসতে হাসতেই ডাক্তার বললেন, এমন আজগুবি গল্প কোথায় পেলেন ইন্সপেক্টর? আমি ডাক্তার, বিষ দেওয়া হলে আমি জানতে পারতাম না!

নীলাদ্রির ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। তবু নিজেকে যথাসাধ্য সংযত রেখে বললে, একটা সম্ভ্রান্ত পরিবার সম্পর্কে এমন একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা আপনার কাছ থেকে আশা করিনি ইন্সপেক্টর। এ রিপোর্ট আপনি কোথায় পেলেন? কে দিয়েছে?

শান্ত স্পষ্ট গলায় হীরা সিং বললে, আপনারই বাড়ির পুরোন খানসামা জাফর আলি।

দারুণ অবাক হয়ে নীলাদ্রি বললে, জাফর আলি! অসম্ভব।

বেশ তো, তাকে ডেকে আপনি নিজেই জিজ্ঞেস করুন। ঘণ্টা দুই আগে সে থানায় গিয়েছিল কিনা।

চুপ হয়ে রইল নীলাদ্রি।

হীরা সিং আবার বললে, ডাকুন তাকে।

নীলাদ্রি চিন্তিত মুখে বললে, কাকে ডাকব? গত পরশু রাত থেকে জাফর বাড়িতেই নেই।

সেকি! কোথায় গেল সে?

বলে যায়নি। কিন্তু জাফর যে সত্যি কথাই বলেছে, তার কোন প্রমাণ পেয়েছেন?

মৃদু হেসে হীরা সিং বললে, প্রমাণ পেলে এখানে তদন্ত করতে আসতাম না, সোজা আসামিকে গ্রেফতার করতাম।

নীলাদ্রির ঠোঁটে সেই পেটেন্ট হাসিটি দেখা গেল—হঠাৎ দেখলে যেটাকে চাপা ঠাট্টা বলে মনে হয়। বললে, তাই বলুন, শুধু সন্দেহ—শুধু ধোঁয়া!

নীলাদ্রির কটা রঙের চোখের ওপর চোখ রেখে হীরা সিং বললে, সন্দেহটা ধোঁয়া নয় গুপ্তসাহেব। অপরাধের অন্ধকারে সন্দেহ হচ্ছে প্রথম দেশলাই—কাঠি। সন্দেহ ছাড়া তদন্ত হয় না।

স্বভাব—নীরস গলায় ধীরাজ ডাক্তার রসিকতা করলেন, ভাল, ভাল! কিন্তু ডাক্তারি শাস্ত্রে বলে, সন্দেহ একটা বদ ব্যায়রাম। আর, নতুন পুলিশ ইন্সপেক্টরদের মধ্যেই এ ব্যায়রামটা উৎকটভাবে দেখা দেয়।

বয়সে নবীন হলেও হীরা সিং ধীরস্থির প্রকৃতির। ধীরাজ ডাক্তারের কথার কোনো জবাব দিলে না। শুধু দাঁড়িয়ে উঠে বললে, আপনাকে আরেকটু কষ্ট দেব গুপ্তসাহেব। মিসেস গুপ্তার ঘরখানা একবার দেখতে চাই।

বেশ, চলুন—হীরা সিংকে সঙ্গে নিয়ে নীলাদ্রি এগোল

.

লালীর ঘরটা চাবি দেওয়া ছিল। চাবি খুলে দুজনে ঢুকল। হীরা সিং ঘরের এধার থেকে ওধার অবধি চোখ বুলিয়ে নিলে। বোঝা গেল, লালী গুপ্তা মারা যাবার সময় যা ছিল, ঘরখানা তেমনি অবস্থায় রয়েছে। বিছানায় কিছু শুকনো ফুল—পাতা, আলমারির একটা পাল্লা খোলা, দোলা—চেয়ারের ওপর খানকয়েক দামি শাড়ি—ব্লাউজ তখনো ডাঁই করা।

এটা ওটা দেখতে দেখতে ড্রেসিং টেবিলের ওপর হীরা সিংহের নজর পড়ল। অনেক দামের আরশিখানা আড়াআড়ি ভাবে ফাটা। পাউডার কেসটা খোলা, টেবিলের পায়ের কাছে জার্মান সিলভারের একটা হেয়ার—ব্রাশ পড়ে। হেঁট হয়ে সেটা কুড়িয়ে নিতে গিয়ে, হীরা সিং আরেকটা কি যেন জিনিস মুঠোর মধ্যে লুকিয়ে ফেললে। তারপর প্রশ্ন করলে, আচ্ছা, আপনাদের পার্টি কখন শুরু হয়েছিল?

নীলাদ্রি বলল, সন্ধে সাতটায়।

মিসেস গুপ্তা শুরু থেকেই পার্টিতে হাজির ছিলেন?

না, আমরা সবাই ওর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

উনি কখন এসেছিলেন?

পৌনে আটটা নাগাদ।

এই সময়টা উনি কোথায় ছিলেন?

ওর ঘরে—মানে এই ঘরে।

একা?

হ্যাঁ।…ও, না, না, সাড়ে সাতটার সময় আমি অয়নকে বলি লালীকে ডেকে আনতে।

হীরা সিংয়ের চোখের দৃষ্টি ছোট হয়ে এল। প্রশ্ন করলে, তিনি কে?

নীলাদ্রি বললে, অয়ন বোস—আমার পি—এ।

তিনি তো আপনার কর্মচারী। ঘরের বয়—বেয়ারা থাকতে তাঁকে পাঠালেন কেন মিস্টার গুপ্ত?

কর্মচারী হলেও অয়ন আমার ঘরের লোক হয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় সে লালীর খেলার সাথী ছিল। তাছাড়া—

নীলাদ্রি থেমে গেল হঠাৎ।

তাছাড়া? প্রশ্ন করলে হীরা সিং।

নীলাদ্রি বললে, শুনেছি, এক সময় লালীর প্রতি অয়নের দুর্বলতা ছিল। অবশ্য এখানে যতদিন আছে, তার কোনো প্রকাশ দেখিনি। খুবই ভদ্র, সংযত ছেলে, বন্ধুর মতোই ব্যবহার।

টুপিটা মাথায় দিয়ে হীরা সিং বললে, ধন্যবাদ মিস্টার গুপ্ত। আমি এবার চলি।

বারান্দা দিয়ে চলতে চলতে নীলাদ্রি বিষণ্ণ গলায় বললে, একটা প্রশ্ন ইন্সপেক্টর। আমার যা ক্ষতি হবার সে তো হয়ে গেল, এই ব্যাপার নিয়ে আর এগোনো কি দরকার মনে করেন?

হীরা সিং থেমে গিয়ে বললে, আপনি কি চান না, আপনার স্ত্রীর মৃত্যু সম্পর্কে যদি কোনো অস্পষ্টতা থাকে, সেটা পরিষ্কার হয়ে যাক?

চাই।—নীলাদ্রি বললে, কিন্তু অনর্থক এই পরিবারের সম্মানে কাদার ছিটে লাগবে—সেটা চাই না।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন গুপ্তসাহেব, কাদা না থাকলে ছিটে লাগবে না।

হীর সিং চলে গেল।

.

আইভি লজ থেকে চলুন এবার কপার টাউনের অফিসারদের কোয়ার্টার্সে।

সন্ধ্যার পর অফিস থেকে অয়ন বিছানায় চিৎপাত হয়ে ভাবছে। ভাবছে, এবার চাকরি ছেড়ে চলে গেলেই তো হয়। ঝাউবনীর ওপর আর কিসের মোহ? কী আকর্ষণ আছে এই তামা—নগরীর? না, কিছু নেই। তবু আরও কিছুদিন তাকে থাকতে হবে এখানে।

আশ্চর্য, লালী আগেই টের পেয়েছিল তার শেষ ঘনিয়ে আসছে। তার পরম সুখের চরম শেষ! সত্যিই হয়তো টের পেয়েছিল। তা নইলে সে ভয় পাবে কেন? কেন ভেঙে ফেলল আরশি, কেন পায়ে লাগল হোঁচট, কেনই বা টকটকে লাল রুবির লকেটটাকে মনে হল বিপদের সঙ্কেত?

বোকা মেয়ে! বিপদের গন্ধ পেলেও বন্ধুর পোশাক পরা শত্রুকে সে চিনতে পারেনি। বুঝতেই পারেনি সে সংসার—অরণ্যের ঝোপে—ঝাড়ে লোভ, ঈর্ষা, কপটতা সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে আছে! সভ্যতার সোনার খাঁচা ভেঙে মানুষের ভেতরকার আদিম জন্তুটা মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে। এই তো স্বাভাবিক। মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ কি? অয়ন তো বলেইছিল, বড় বেশি সুখ ভাল নয়, তবু কেন হুঁসিয়ার হয়নি লালী? অয়ন কী করতে পারে?

কিন্তু কিছুই কি করবার নেই—এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া? না, কপার টাউন ছেড়ে তার যাওয়া চলবে না। আরও কিছুদিন—

ভাবনার সুতোটা ছিঁড়ে গেল টকটক আওয়াজে। ভেজানো ছিল দরজা। অয়ন শুয়ে শুয়েই বললে, কে? ভেতরে আসা হোক—

দরজা ঠেলে সাধারণ সুটপরা যে লোকটি ঘরে ঢুকল, তাকে দেখে ধড়মড় করে দু’ সেকেন্ডে বিছানায় উঠে বসল অয়ন। অপলকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, হীরা সিং না?

মৃদু হেসে হীরা সিং শুধু ঘাড় নাড়লে।

খুশিতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল অয়ন, আরে বোস, বোস; ওঃ, কতকাল বাদে দেখা! আমরা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ছেড়েছি প্রায় দশ বছর হল—তাই না?

হীরা সিং আবার ঘাড় নাড়লে।

একসঙ্গে তিনটে প্রশ্ন ছুড়ে দিলে অয়ন, এখানে কবে এসেছিস?

কোথায় এসেছিল? কেন এসেছিস?

এক কথায় জবাব দিলে হীরা সিং, ঝাউবনী থানার ইন্সপেক্টর হয়ে এসেছি।

তাই নাকি! আমার পাত্তা পেলি কি করে?

ধীরে ধীরে হীরা সিং বললে, মিসেস লালী গুপ্তার মৃত্যুর খেই ধরে তোমার কাছে পৌঁছলাম অয়ন।

অয়নের কথা হারিয়ে গেল। পুরোনো কলেজ—বন্ধুকে দেখে যে খুশির উচ্ছ্বাস জেগেছিল, পলকে তা নিভে গেল। একটু চুপ থেকে বললে, অরেকটু পরিষ্কার করে বলো হীরা সিং।

মিসেস গুপ্তার মৃত্যু সম্পর্কে তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে এসেছি।

ও! কিন্তু তার মৃত্যুতে হঠাৎ পুলিশের টনক নড়ল কেন হীরা সিং?

পুলিশের সন্দেহ যে মিসেস গুপ্তাকে বিষ দিয়ে খুন করা হয়েছে।

অয়ন বললে, আশ্চর্য! লালী মারা যাবার পর পুলিশ আসেনি, পোস্টমর্টেম হয়নি—হবার উপায়ও নেই; কেননা, তার মরা দেহ বানের জলে ভেসে ভেসে এতক্ষণ সমুদ্রে পৌঁছে গেছে! তবু পুলিশের সন্দেহ হল কেমন করে?

হীরা সিং বললে, গুপ্ত—পরিবারেরই ঘনিষ্ঠ একজন রিপোর্ট করেছে।

তার নাম বলতে আপত্তি আছে?

তার নাম জাফর আলি।

খানসামা জাফর আলি! (হীরা সিং সায় দিলে) তাহলে তাকেই প্রশ্ন করো, আমাকে কেন?

হীরা সিং বললে, প্রথম কারণ, জাফর আলিকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ঘটনার আগে একমাত্র তুমিই লালী গুপ্তার সঙ্গে কিছুক্ষণ ছিলে। ঠিক কিনা?

ঠিক।

আশা করি, এবার আমার প্রশ্নের জবাবে সত্যি কথাই বলবে।

বলব। কিন্তু,—অয়নের মুখে একটু তেতো হাসি দেখা দিল : অবিশ্বাস হচ্ছে পুলিশের ধর্ম। ইন্সপেক্টর হীরা সিং আমার কথা বিশ্বাস করবে কি?

মৃদু হাসলে হীরা সিং। বললে, আজকের পুলিশ ইন্সপেক্টর এক সময় অয়ন বোসের দোস্ত ছিল, আর সেদিন দোস্ত দোস্তকে বিশ্বাস করত। আজ যদি অয়ন বোস পাল্টে গিয়ে না থাকে, তবে হীরা সিংও পাল্টায়নি জেনো।

অয়ন বললে, বেশ, তাহলে প্রশ্ন করো।

পকেট থেকে ছোট্ট একটা কাগজের মোড়ক বার করলে হীরা সিং। বললে, লালী গুপ্তার ঘর থেকে এই পুরিয়ার কাগজটা পাওয়া গেছে। বোঝা যাচ্ছে, পার্টিতে যাবার আগে এই পুরিয়ার জিনিস তিনি খেয়েছিলেন। আচ্ছা, বলতে পারো এটা তিনি পেলেন কোথা থেকে? কে দিয়েছিল?

মেঝের দিকে চেয়ে অয়ন চুপ করে রইল একটুক্ষণ। তারপর মুখ তুলে স্পষ্ট গলায় বললে, আমি দিয়েছিলাম। কিন্তু ওর মধ্যে বিষ ছিল না, ছিল মাথা ধরার ওষুধ।

মাথার বালিশের তলা থেকে গোটা কতক একই ধরনের পুরিয়া বার করলে অয়ন। বললে, মাথা আমার প্রায়ই ধরে বলে এগুলো সঙ্গে রাখি।

হীরা সিং অয়নের মুখ লক্ষ্য করছিল। বললে, তোমার কৈফিয়ত দোস্ত বিশ্বাস করবে, কিন্তু পুলিশ যদি বিশ্বাস না করে?

শুকনো মুখে অয়ন বললে, তাহলে আর কী করতে পারি। কিন্তু লালীকে আমি খুন করতে যাব কেন?

হীরা সিং বললে, তুমি লালী গুপ্তার ব্যর্থ প্রেমিক, তাই। তাঁকে তুমি ভালোবাসতে, অথচ জীবনে পাওনি।

কথাটা সত্যি।—অয়ন বলতে লাগল, কিন্তু তাকে আমি চাইনি কোনোদিন। গরিব—ঘরের ছেলে আমি, বড়লোকের মেয়েকে সুখে রাখতে পারব না জানতাম। তাছাড়া লালীও আমার ভালোবাসেনি কখনো। হীরা সিং, আমি পুলিশও নই, ক্রিমিনোলজিস্টও নই, তবু প্রত্যেক খুনের একটা না একটা মোটিভ থাকে, এটা জানি। বলতো পারো, এ ক্ষেত্রে আমার মোটিভ কী হতে পারে? কী লাভ আমার তাকে মেরে? আমি তো তার ঐশ্বর্যের কানাকড়িও পাব না! আর, ব্যর্থ প্রেমের জ্বালা যদি বলো, তবে লালীর বদলে নীলাদ্রি গুপ্তকেই আমি খুন করতে পারতাম।

চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল হীরা সিং।

অয়ন আবার বললে, একটা কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, পার্টিতে যাবার আগে লালী বিষ খায়নি।

হীরা সিং প্রশ্ন করলে, তাহলে তুমি বলছ, হঠাৎ হার্টফেল করেই মিসেস গুপ্তা মারা গেছেন?

না। জাফরের সঙ্গে আমি একমত। লালীকে বিষ দিয়েই খুন করা হয়েছে, আর সেটা পার্টিতে যাবার পরে।

তোমার এ ধারণা হল কেন?

প্রমাণ পেয়েছি বলে।

সোজা হয়ে বসল হীরা সিং। তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে বললে, প্রমাণ! কি প্রমাণ?

বিছানা থেকে উঠে গিয়ে অয়ন তার কাবার্ড খুললে। সাবধানে বার করে আনল সরু ডাঁটিওয়ালা কাচের একটা পানপাত্র। তার মধ্যে এখনো টলটল করছে সামান্য একটু সাদা পানীয়। সেটা ইন্সপেক্টরের সামনে রেখে বললে, এই প্রমাণ।

এ তুমি কোথায় পেলে অয়ন?

পার্টিতে লালীর টেবিল থেকে। নীলাদ্রি আর লালী গুপ্তাকে শুভেচ্ছা জানাবার সময় সবাইকে শ্যাম্পেন পরিবেশন করা হয়েছিল। এই কাপে প্রথম চুমুক দেবার পরেই লালী মুখ গুঁজে পড়ে যায়।

পানপাত্রটা লক্ষ করে হীরা সিং বললে, হুঁ। মিসেস গুপ্তার ড্রেসিং টেবিলে যে বিশেষ রঙের লিপস্টিক দেখেছি, এই কাপের কিনারে সেই রঙেরই ছোপ লেগে আছে দেখছি। কিন্তু এটা তোমার ঘরে এল কেমন করে?

তাও বলছি। অসুস্থ লালী টেবিলের মুখ গুঁজে পড়েছিল, তার মুখ দেখতে পাইনি। তাকে ঘরে নিয়ে যাবার জন্যে নীলাদ্রি গুপ্ত যেই তাকে বুকের কাছে তুলে নিল, এক পলকের জন্যে দেখতে পেলাম তার মুখ। সে—মুখ নীলচে, দুই কসে অল্প অল্প ফেনা! একটা ভয়ানক সন্দেহে আমার মনটা কেমন করে উঠল—সবার চোখ এড়িয়ে লালীর কাপটা আমি সরিয়ে ফেললাম।

এই শ্যাম্পেনে বিষ মেশানো কি করে বুঝলে?—হীরা সিং জিজ্ঞেস করলে।

অয়ন বললে, একটা বেড়ালকে কয়েক ফোঁটা খাইয়েছিলাম, পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেটা মরে গেল। কাপে যেটুকু তলানি রয়েছে, তুমি ফরেনসিক ল্যাবরেটারিতে পরীক্ষা করাতে পারো।

কোনো কথা না বলে হীরা সিং মিনিট দুই পায়চারি করলে ঘরে। তারপর থেমে বললে, তোমার যদি সন্দেহ হয়ে থাকে, তবে এই কাপটা নিয়ে সোজা পুলিশ—স্টেশনে যাওনি কেন? তোমার তো তাই করা উচিত ছিল।

মানছি উচিত ছিল।—অয়ন বললে, কিন্তু পুলিশ মানেই লাখো। ঝামেলা! তাই ভেবেছিলাম, নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে অন্ধকারে যদি আলো দেখতে পাই, তখন পুলিশকে জানাব। কিন্তু ঝাউবনীতে তুমি যখন এসেছ, তখন তদন্তের ভার তোমার হাতে দিয়ে আমি সরে যেতে চাই।

না।—অয়নের একখানা হাত ধরে হীরা সিং বললে, এ কেসটায় তোমার সাহায্য আমার বিশেষ দরকার অয়ন। আমি এখানে একেবারে নতুন, আর তোমার মেলামেশা সকলের সঙ্গে। সুতরাং তোমার পক্ষে যা সহজ, আমার পক্ষে তা নয়। তদন্তের ভার আমাদের দুজনকেই নিতে হবে—আমি বাইরে, তুমি ঘরে। রাজি?

বেশ, আমি রাজি।—অয়ন বললে।

দরজার দিকে এগোতে এগোতে আবার বললে, পারতপক্ষে তুমি কখনো থানার দিকে যেও না, লোকের নজর পড়তে পারে। আমিই আসব তোমার এখানে—একটু বেশি রাতে। কপার টাউনকে আমি জানিয়ে দিতে চাই যে, লালী গুপ্তার মৃত্যু নিয়ে পুলিশ আর মাথা ঘামাচ্ছে না।

.

দিন চারেক বাদে হীরা সিং আবার এল। বললে, ফরেনসিক থেকে রিপোর্ট এসেছে।

উৎসুক হয়ে উঠল অয়ন।

রিপোর্টটা পড়ে শোনাল ইন্সপেক্টর। শ্যাম্পেনের মধ্যে তীব্র বিষ পাওয়া গেছে। এ জিনিস ভাইপার সাপে বিষ থেকে তৈরি। উৎকট যন্ত্রণাদায়ক রোগে যন্ত্রণা উপশমের জন্য এই বিষ থেকে ইঞ্জেকশন তৈরি হয়। দেখতে সাদা পাউডারের মতো। তবে এদেশে মেলে না, পাওয়া যায় ইউরোপের কোনো কোনো দেশে। এ বিষের কাজ হচ্ছে অতি দ্রুত ঘুম পাড়িয়ে দেয়া, কিন্তু ডোজ সামান্য একটু বেশি হয়ে গেলে মুখ দিয়ে ফেনা ওঠে, হাত—পায়ের আঙুলের ডগা, ঠোঁট নীলচে হয়, তারপর ধীরে—অতি ধীরে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া থেমে আসতে থাকে।

রিপোর্ট পড়া শেষ করে হীরা সিং বললে, যাক, একটা বিষয় নিঃসন্দেহ হওয়া গেল যে, বিষ খাইয়েই লালী গুপ্তাকে খুন করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিষ এল কোথা থেকে? এই জিনিসের ইমপোর্ট লাইসেন্স ভারতবর্ষের কোনো ফার্মাকোলজিস্টকে দেওয়া হয়নি, সে খবরও আমি নিয়েছি। তাহলে এই বিদেশি বিষ জোগাড় করল কে?

অয়ন বললে, যা সোজা পথে আসতে পারে না, তা চোরা—পথে আসে।

পুলিশের তা অজানা নয়। কিন্তু কার চোরা—হাতে আমদানি হয়েছে, সেটা জানতে পারলেই শ্যাম্পেন বিষ কে মিশিয়েছিল জানা সহজ হবে।

সমস্ত ব্যাপারটাই কিন্তু রীতিমতো মাথা খাটিয়ে প্ল্যান করা।

অর্থাৎ?

অর্থাৎ লোকের চোখে ধুলো দেওয়ার আশ্চর্য ফন্দি। নীলাদ্রি গুপ্ত নিজের হাতে শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে লালীর কাপে ঢেলে দিয়েছিলেন। সেই একই বোতলের শ্যাম্পেন খেয়ে পার্টির কারো কিছু হল না, মরল কেবল লালী। ব্যাপারটা ম্যাজিক মনে হয় না?

হীরা সিংয়ের কপালে কে যেন লাঙল চালিয়ে দিল। বললে, তুমি বলতে চাও বোতলের শ্যাম্পেনে বিষ মেশানো ছিল না—কেবলে, মিসেস গুপ্তার কাপে শ্যাম্পেন ঢালার পর তাইতে বিষ মেশানে হয়। কিন্তু পার্টির সকলের চোখের সামনেই শ্যাম্পেন পরিবেশন করা হয়েছিল এবং তারপরেই লালী গুপ্তা চুমুক দিয়েছিলেন। তাহলে বিষ মেশানো হল কখন?

অয়ন বললে, কাল রাতে ভেবে ভেবে আমি এর একটা উত্তর খুঁজে পেয়েছি।

কি রকম? হীরা সিং জিজ্ঞেস করলে।

অয়ন বললে, এমনও হতে পারে যে, শ্যাম্পেন ঢালার আগেই লালীর কাপে বিষ ছিল। সাদা কাচের পাত্রের গায়ে যদি অল্প সাদা গুঁড়ো লাগানো থাকে, হাজার চোখের সামনেও সেটা ধরা পড়তে পারে কি?

হীরা সিং প্রায় লাফিয়ে উঠে অয়নের হাত ধরে ঝাঁকানি দিল : শাবাশ। রহস্যের পয়লা দরোয়াজা খুলে গেছে অয়ন। আচ্ছা বলো তো, শ্যাম্পেনের কাপগুলো টেবিলে টেবিলে কে রেখেছিল?

জাফর আলি। শুধু নীলাদ্রি গুপ্ত আর লালীর জন্যে দুটো কাপ এনে দিয়েছিল ডন রিভাস।

কে সে?

কপার টাউনের ফ্যাক্টরি—ম্যানেজার। পার্টিতে সে—ই ছিল বারম্যান।

কোন দেশের লোক?

শুনেছি ওয়েস্ট জার্মানি।

কেমন টাইপের মানুষ?

ফ্যাক্টরি ম্যানেজারেরা সাধারণত যেমন টাইপের হয়। সারাদিন ফ্যাক্টরিতে খাটে, আর সন্ধের পর ক্লাবে গিয়ে মদ আর তাসের জুয়ায় মেতে থাকে অনেক রাত অবধি। বিশেষত্বের মধ্যে খুব আমুদে স্বভাব।

লোকটার আগের জীবন সম্বন্ধে কিছু জানো?

না। কিন্তু ডনকে সন্দেহ করার কোন কিছু যুক্তি আছে কি? ও কপার টাউনের নেহাতই একজন ওয়ার্কার, বস—এর বউকে খুন করার পেছনে কী স্বার্থ?

কোথায় কার স্বার্থ কে জানে। এ ধরনের খুনের প্ল্যানিং একজনে হয় না অয়ন—একাধিক লোকের সাহায্য দরকার। সুতরাং অপরাধের যে নেটওয়ার্ক—যে জাল বিছানো হয়, তার একগাছা সুতো ধরে টান দিলে বাকি সুতোগুলোতেও টান পড়ে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ পায়চারি করে হীরা সিং আবার বললে, আচ্ছা, গুপ্ত ফ্যামিলির সঙ্গে যারা খুব ঘনিষ্ঠ, তাদের মধ্যে কার ওপর তোমার সন্দেহ হয়?

অয়ন বললে, এক, ডাক্তার ধীরাজ দাস। আইভি লজে প্রায়ই আসা যাওয়া। গুপ্ত পরিবারের বন্ধু ও ডাক্তার। ডন রিভাসকে এক নম্বর যদি বলো, ধীরাজ ডাক্তার হল দু—নম্বর সন্দেহভাজন ব্যক্তি। কেননা, লালীর মৃত্যুর কারণটাকে তিনি হার্টফেলিওর বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন। বিনা স্বার্থে এত বড় অন্যায় কেউ করে না।

আচ্ছা, আর কে?

কান্তা কালেলকর। নীলাদ্রি গুপ্তর রূপবতী স্টেনো। ভয়ানক দেমাকী আর চালিয়াত মেয়ে।

মিসেস গুপ্তার সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল তার?

সখীর মতো। কিন্তু আমার মনে হয় লালীকে সে হিংসে করত।

কিসের জন্য? বেশি রূপসী বলে, না মনিবানী বলে?

নীলাদ্রির মতো পুরুষকে লালী স্বামী হিসেবে পেয়েছে বলে। ওর হাবভাবে আমি বুঝতে পারি যে নীলাদ্রির ওপর ওর লোভ আছে—যদিও মনিবের কাছে ওকে বিশেষ প্রশ্রয় পেতে দেখিনি।

তাহলে কান্তা কালেলকরকে তিন নম্বর সন্দেহভাজন বলা যেতে পারে। আর কে?

অয়ন বললে, চার নম্বর জাফর আলি। লালী মারা যাবার পরে তার ডুব মারাটাই সন্দেহজনক। জাফর যখন খবর দিতে গিয়েছিল, তুমি কেন তাকে থানায় আটকে রাখোনি হীরা?

হীরা সিং বললে, আটকাতে গিয়েছিলাম, কিন্তু জাফর আলি বললে, ‘হুজুর, আমি মুসলমান, আমি কোরান ছুঁয়ে বলতে পারি দিদিকে বিষ দেওয়া হয়েছে। এইটুকুই কেবল জানি—আর কিছুই জানি নে! আমায় কেটে ফেললেও গলা দিয়ে খুন ছাড়া আর কোনো কথা বেরোবে না।’ এরপর তাকে আটকে রেখে কি হবে?

একটু স্তব্ধ হয়ে থেকে অয়ন বললে, এই ক’জনকে বাদ দিলে থাকে শুধু নীলাদ্রি গুপ্ত। কিন্তু তার সম্পর্কে সন্দেহের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নীলাদ্রি লালীকে অত্যন্ত ভালোবাসত—একথা লালী নিজেই আমাকে বহুবার বলেছে।

হীরা সিং বললে, তাহলে কি দাঁড়াল?

চিন্তিত মুখে অয়ন বললে, আমরা যে তিমিরে, সেই তিমিরে।

অয়নের কাঁধ চাপড়ে হীরা সিং বললে, তবু সহজে হাল ছাড়লে চলবে না। চোখ—কান সজাগ করে রাখো অয়ন, আজ যা দেখা যাচ্ছে না, কাল তা দেখা যেতে পারে। আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত।