লাল নীল – ১

এক

শাল—পাইন—হরীতকী জঙ্গলই বেশি, ঝাউয়ের সংখ্যা নগণ্য। তবু স্টেশনটার নাম ঝাউবনী। ছোট পাহাড়ি স্টেশন। দিনে—রাতে মাত্র তিনখানা ট্রেন ঝাউবনীতে দেড়’—দু মিনিটের জন্যে ছোঁয়, বাকি ট্রেনগুলো প্রচণ্ড দেমাকে কাঁকর—ঢালা প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে অবজ্ঞাভরে চলে যায়। তবু ঝাউবনীর মর্যাদা কিছু কম নয়। অনেক জংশন স্টেশনের চেয়েও এই ছোট পাহাড়ি স্টেশনের গুরুত্ব—যাকে বালে ইম্পর্টান্স, বেশি। বিশেষ করে শিল্প—বাণিজ্য মহলে। এখানে তামার খনি আছে, অভ্রের খনি আছে। লোকে বলে পাপের খনিও এখানে আছে, সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ঝাউবনীর সঙ্গে বেশ কিছুদিন মিতালি করলে তবে জানা যায়।

এই ঝাউবনী অঞ্চলটাই হল আমার গল্পের পটভূমি। কিন্তু গল্পের মধ্যে ঢুকতে হলে আপনাকে একদিন ঝাউবনী স্টেশনে এসে কাঁকর—ঢালা প্ল্যাটফর্মে নামতে হবে। ধরুন,আপনি এসে একদিন এখানে নামলেন। এই ট্রেনে নতুন প্যাসেঞ্জার আজ আর কেউ আসেনি, আপনাকে নেহাত একাই নামতে হল। আপনাকে নামিয়ে দিয়েই ট্রেন চলে গেল উত্তরপ্রদেশের দিকে। কালো গোলটুপি মাথায় ভদ্রলোকটি—তিনিই স্টেশন মাস্টার, তিনিই টিকিট কালেক্টর—আপনার টিকিটখানা নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে গেলেন। যে লোকটি ট্রেন ছাড়বার ঘণ্টা বাজাল, সেই এগিয়ে এল আপনার কাছে।

কুলি চাই?

কুলি কি হবে? মাল তো নেই।

আপনি জানতে চাইবেন, এখানে গাড়ি পাওয়া যায় কিনা।

লোকটি ঘাড় নেড়ে বললে, যায়। স্টেশনের বাইরে ‘পুশপুশ’ আছে।

তাকে অনুসরণ করে আপনি এগোবেন। প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্ত ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সেই ঢালুর মুখে আপনি এসে দেখলেন, নিচের সড়কের মুখে দুই—তিন পুশপুশ হাজির রয়েছে। এই অদ্ভুত যানের সঙ্গে আপনি হয়তো পরিচিত নন। দুই চাকাওয়ালা পাল্কির মতো গাড়ি, সামনে দুটো লম্বা ডান্ডা, মানুষে টেনে নিয়ে যায়। এক কথায় পাল্কি কাম রিকশা।

পুশপুশওয়ালা জিজ্ঞেস করলে, কোথায় যেতে হবে?

আপনি বললেন, ‘আইভি লজ’।

আপনার দিকে তাকিয়ে পুশপুশওয়ালার চোখে এবার সম্ভ্রম দেখা দিল। বোঝা গেল আইভি লজ বোধ করি কোন রাজা—বাদশার প্রাসাদ বা কোন মন্ত্রীমহোদয়ের আস্তানা।

বকশিস নিয়ে কুলি বিদায় নিল এবং মালসমেত পুশপুশওয়ালা আপনাকে নিয়ে রওনা দিল। খোলা দরজার বাইরে চোখ রেখে, আপনি নিসর্গের শোভা দেখতে দেখতে চললেন। কিন্তু মন আপনার বারবার প্রশ্ন করতে লাগল, এই কি শোভা!

অপরাহ্নের ট্রেনে আপনি এসেছেন, এখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। লাল পাথুরে মাটির এবড়ো—খেবড়ো সড়ক সাপের মতো এঁকেবেঁকে দূরবর্তী জঙ্গলের মধ্যে সেঁধিয়েছে। দু—পাশে ফাঁকা রুক্ষ প্রান্তর। আরও বহুদূরে আকাশের গা ঘেঁষে ছোট—বড় কয়েকটা ছাই রঙের পাহাড়। আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণ ছায়া নেমেছে। কেমন একটা বিশ্রী নির্জনতা। এমন বিশাল ফাঁকার মধ্যে মনটা যেন হু—হু করে ওঠে।

ভাল আপনার লাগছে না জানি, তবুও এগিয়ে চলুন। এই বৈরাগিনী চেহারাটাই ঝাউবনীর একমাত্র রূপ নয়, আরও একটা রূপ আছে। সে—রূপটা দেখতে হলে পাইন—দেওদারের জঙ্গল পেরিয়ে আরও মাইলটাক এগিয়ে যেতে হবে। জঙ্গলের মধ্যে ঢাকের ডুমডুম আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যেন একটা পাহাড়ি বাঁশি কাঁদছে।

কাঁদুক। ঝাউবনীতে শুধু কান্নাই নয়, উল্লাসও আছে প্রচুর। শুধু আসন্ন অন্ধকারের ছায়া নয়, আলোর অহঙ্কারও আছে চোখ ধাঁধানো।

আরও এগিয়ে চলুন, দেখতে পাবেন।

.

জঙ্গল যেখানে ফুরিয়ে গেছে, সেখানে এসে পৌঁছতে দৃশ্যপট বদলে গেল আপনার চোখে। দেহাত ছাড়িয়ে একটা শহরে এসে পড়লেন। মেটাল রোডের দু—ধারে ইলেকট্রিকের আলোর সারি এরই মধ্যে জ্বলে উঠেছে। হালফ্যাশানের বাংলা প্যাটার্নের বাড়ি কিছু দেখতে পাওয়া গেল। রাস্তা ধরে আরও এগোলে দেখতে পাবেন কিছু দোকান পাট, হাসপাতাল, লম্বা লম্বা কয়েকটা ব্যারাক আর ক্লাব হাউস।

জায়গাটার নাম ‘কপার টাউন’ স্থানীয় লোকেরা বলে ‘তামানগরী’।

মেটাল রোড যেখানে দু—ভাগ হয়ে দু—দিকে গেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আপনি বাঁয়ে দৃষ্টিপাত করলে জায়গাটার নামকরণের হেতু বুঝতে পারবেন। মাইলখানেক দূরে ওই ধলাই পাহাড়ের কোলে উঁচু উঁচু প্রকাণ্ড প্ল্যান্টগুলো সন্ধ্যার ঝুপসি অন্ধকারেও আপনার চোখে পড়বে। ওখানে তামার খনি আছে।

না, বাঁ—দিকের রাস্তায় আপনাকে যেতে হবে না। আপনি চলুন ডাউনে—যেখানে আছে আইভি লজ। তিন ফার্লং এগোতেই আপনি সত্যিই ইন্দ্রপুরীর মুখোমুখি দাঁড়ালেন। আধুনিক ইন্দ্রপুরী। সামনে লন আর তিনপাশে প্রশস্ত বাগানের মধ্যে আমেরিকান ধাঁচের চমৎকার দোতলা বাড়ি। গাছে গাছে রঙিন আলোর ফানুস, বাড়িটার গায়েও রঙিন ফ্লাড লাইটের ঢেউ খেলছে। গেটের বাইরে এবং ভেতরে দামি মোটরের ভিড়। এই হল আইভি লজ। কপার টাউন বা তামানগরীর প্রাণকেন্দ্র!

ফটক পেরিয়ে চলুন ভেতরে। কেউ আপনাকে বাধা দেবে না। কেউ প্রশ্ন করবে না আপনি আমন্ত্রিত, না রবাহূত। আপনি রোমাঞ্চগল্পের পাঠক, স্বয়ং লেখকের ছাড়পত্র আপনার হাতে, সর্বত্র আপনার অবাধ গতি।

অতএব আইভি লজের অন্দরে চলুন।

মেহগনি রঙের বর্মা—সেগুনের চওড়া কাঠের সিঁড়িতে কার্পেট পাতা। তারই ওপর পা ফেলে ফেলে চলে আসুন দোতলার হলঘরে।

নীলাদ্রি গুপ্ত আজ পার্টি থ্রো করেছে নিজের বাড়িতে। আসুন, নীলাদ্রি গুপ্তকে চিনিয়ে দিই। বছর পঁয়ত্রিশ—ছত্রিশের ওই যে যুবাপুরুষটি এ—টেবিল থেকে ও—টেবিলে ব্যস্তভাবে আনাগোনা করছে, কখনো বা দরজা থেকে বিশিষ্ট অতিথিদের অভ্যর্থনা করে ডেকে আনছে, ওই হল নীলাদ্রি গুপ্ত। চোস্ত ইভনিং সুট পরনে, গলায় বো টাই, উগ্র রকমের ফর্সা, কটা চোখ আর ছোট করে ছাঁটা বাদমি চুল। কপার টাউন প্রতিষ্ঠানের এক নম্বর সাহেব। যাকে, বলে ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আজ নীলাদ্রির বিয়ের স্মৃতিবার্ষিকী উৎসব। তার বিবাহিত জীবন তিন বছর পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষে কপার টাউনের বাছা বাছা অভিজাতদের সমাবেশ হয়েছে নীলাদ্রির ড্রইংরুমে। অধিকাংশই তার প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মী। কিছু অবশ্য এসেছেন ঝাউবনীর বাইরে থেকেও—বড় বড় কারবারী।

ছোট ছোট টেবিল পড়েছে হলে, চারখানা করে ফ্যান্সি চেয়ার। কেউ বসেছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে জটলা করছে। পুরুষ যত, মহিলা তার চেয়ে কম নয়। মৃদু হাসি, উচ্চচ হাসি, ফিসফিস কথা, কলকণ্ঠের আলাপ—সব মিলিয়ে হলঘরখানা যেন মানুষের মৌচাক।

আজ নীলাদ্রি গুপ্তর বিবাহ—বার্ষিকী। এমন রমণীর সন্ধ্যা কপার টাউনে বছরে একবারই আসে, এমন লোভনীয় পার্টি একবারই হয়। কয়েকটা চেয়ার এখনো খালি পড়ে আছে, একটাতে আপনিও বসে পড়ুন। সঙ্কোচের কারণ নেই। কেউ আপনাকে দেখতে পাবে না, টের পাবে না আপনার শারীরিক উপস্থিতি। অথচ আপনি দেখতে পাবেন সবই এবং সবাইকে। আসলে নীলাদ্রির পার্টিতে আপনি নিজে তো আসেননি, এসেছে আপনার পাঠক—মনের কৌতূহল।

দোরগোড়ায় হাঁসের মতো হাঁসফাঁস করতে করতে এসে দাঁড়ালেন মোটাসোটা খর্বকায় এক বয়স্ক ভদ্রলোক। তাঁর শেরওয়ানী থেকে মাথার চুল অবধি ধবধবে সাদা। সঙ্গে চড়া হলুদ রঙের রেশমি শাড়ি পরা ততোধিক মোটা এক ভদ্রমহিলা। হাতে গোলাপের তোড়া। দেখে ছুটে গেল নীলাদ্রি। দু—হাত বাড়িয়ে উচ্ছ্বসিত সৌজন্যের সঙ্গে হংস—দম্পতিকে স্বাগত জানালে, আসুন, আসুন! মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সাহানীর অভাবে আমাদের পার্টির জৌলুসই ছিল না এতক্ষণ! কান্তা!

ইয়েস বস!

সাতাশ—আঠাশ বছরের একটি যুবতী এসে দাঁড়াল। জরিদার জমির ওপর কালো ডোরাকাটা শাড়ি লম্বাটে দেহটাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উদ্ধত যৌবনের বাঁকাচোরা রেখাগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। খাটো রুখু চুলের গোড়ায় রুপোলি জরির ফিতে বাঁধা। অত্যন্ত কালো আর অত্যন্ত ঝকঝকে দুই চোখ। কান্তা কালেলকর সুশিক্ষিতা মারাঠি মেয়ে। নীলাদ্রির স্টেনো।

নীলাদ্রি বললে, এদের বসতে দাও কান্তা।

বিনম্র গলায় কান্তা শুধু বললে, ইয়েস বস।

মিসেস সাহানী এদিক—ওদিক তাকিয়ে বললেন, নীল তোমার বউকে দেখছি না কেন? মিসেস গুপ্তা কই?

হাসলে নীলাদ্রির পাতলা ঠোঁটের ডান দিকটা ঈষৎ উঠে যায়। একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের ভঙ্গি বলে ভুল হতে পারে। এ হাসিটা নীলাদ্রির পেটেন্ট। তেমনি পেটেন্ট হাসি হেসে সে বললে, বাংলায় একটা মজার ছড়া আছে মিসেস সাহানী:

 যার বিয়ে তার হুঁস নেই।

 পাড়া—পড়শির ঘুম নেই।।

দেখো তো কান্তা, লালীর আসতে কত দেরি।… না থাক, অয়ন কোথায় গেল?

এদিক—ওদিক তাকালে নীলাদ্রি।

এই যে স্যার!

অয়ন বোস কাছে এল। বছর ত্রিশের মধ্যে বয়স। টগবগে যৌবন। তামানগরীতে কাজ করে করেই বোধ হয় গায়ের রংটাও তামাটে। চোখা, নাক, পুরু ঠোঁট, চওড়া কপালের ওপর ঝাঁপিয়ে—পড়া চুল চিরুনির তোয়াক্কা রাখে না। দেহটা পরিণত বয়সের স্বাক্ষর বহন করলেও চোখ দুটো বালকের মতো চঞ্চল। এই অয়ন বোস, কেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস, নীলাদ্রির পি—এ।

নীলাদ্রি একবার অয়নের আপাদমস্তক তাকিয়ে ঈষৎ অপ্রসন্ন মুখে বললে, তোমায় কতবার মানা করেছি, পার্টিতে কখনো এই বেশে আসবে না!

চট করে একবার নিজের দিকে তাকিয়ে নিল অয়ন। নস্যি রঙের একটা সাধারণ টেরিকটনের পাতলুন—তাও ওয়ার্কিং প্যান্ট, আর হাল্কা ক্রিম রঙের পপলিনের বুশ—শার্ট। কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে অয়ন বললে, মাছ ধরতে গিয়েছিলাম স্যার, সেখান থেকে স্ট্রেট এখানে। চেঞ্জ করার সময় পেলাম কই বলুন?

চওড়া কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে নীলাদ্রি বললে, নাঃ, তোমায় নিয়ে আর পারা যায় না! যাও, জেনে এসো লালীর দেরি হচ্ছে কেন?

প্রায় ছুটেই চলে গেল অয়ন। শুধু পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যোন্ট নয়, নীলাদ্রি গুপ্তর ঘরের লোকও হয়ে গেছে সে।

সেদিকে চেয়ে কান্তা ভুরু কুঁচকে বললে, অয়নকে এতখানি আশকারা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না।

মিসেস সাহানী হেসে বললেন, তোমার পি—এ রীতিমতো পাগলাটে দেখছি!

নীলাদ্রি বললে, একটু অদ্ভুতপ্রকৃতি বটে, তবে ছোকরা ভারি কাজের।

.

অয়ন সম্পর্কে যখন হলঘরে নানা মন্তব্য শোনা যাচ্ছে, যে তখন ভেতর—বাড়িতে। আয়া বললে, মেমসাহেব সাজ—পোশাক করছে।

লালীর ঘরের পর্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াল অয়ন। ব্যস্ত গলায় বললে, গুপ্তসাহেব দারুণ তাড়া দিচ্ছেন। গেস্টরা সব হাজির। সাজ—পোশাক টয়লেট যেটুকু বাকি আছে,সেটুকু আসছে বছর একুশে জুলাইয়ের জন্যে থাক।

আজ একুশে জুলাই, নীলাদ্রি—লালির বিয়ের তারিখ।

পর্দার ওপাশ থেকে মেয়ে—গলার আওয়াজ এল, ভেতরে এসো।

পর্দা সরিয়ে ভেতরে পা দিল অয়ন। চারপাশে একগাদা শাড়ি, ব্লাউজ, অলঙ্কার ছড়িয়ে চুপ করে বসে আছে লালী গুপ্তা।

একি, এখনো কিছুই হয়নি যে!—অয়ন অবাক।

নিস্পৃহ গলায় লালী বললে, আচ্ছা অয়ন, পার্টিতে আমি যদি না যাই? তোমাদের গুপ্তসাহেবকে বলে—কয়ে ছুটি দাও না আমায়!

তার মানে?

ভাল লাগছে না। বসো, গল্প করি।

আরে বা, আজ এত বড় উৎসব!

উৎসব—একটুকরো মেঘলা হাসি দেখা দিল লালির মুখে। বললে, আরেকটা উৎসবের কথা মনে পড়ছে। পনেরো বছর আগে মুর্শিদাবাদে। এগারো বছরের একটি ছোট্ট মেয়ের জন্মতিথি উৎসব। তাও সত্যিকারের জন্মতিথি নয়, মিছিমিছি মন—গড়া তিথি। তাদের প্রকাণ্ড বাগানের এককোণে একটা দোফলা আমগাছের নিচে সেই মনগড়া জন্মতিথির উৎসব হয়েছিল। নেমন্তন্ন খেতে এসেছিল পাড়ারএ একপাল ছেলেমেয়ে। কেউ উপহার দিয়েছিল ছেঁড়া বেনারসীর টুকরো, কেউ আধখানা রং—পেনসিল, কেউ বা পেড়ে—আনা ফলসা একমুঠো। সবার চেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল একটি ছেলে—জিয়াগঞ্জের মেলা থেকে কেনা একছড়া লাল পুঁতির মালা উপহার গিয়ে।

অয়নের মুখে একবার ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। বললে, পুরোনো দিনের জের টেনে লাভ নেই। অন্য কথা বলো।

এবার আমার স্বামী আময়ি কি উপহার দিয়েছেন জানো?

একটা মখমলের কেস খুলে লালী আয়নের সামনে ধরলে। সরু সোনার চেনে গাঁথা মস্তবড় একখণ্ড চুনি—তাজা রক্তের মতো টকটকে লাল।

সারা এশিয়ায় এতবড় রুবি আর আছে কিনা সন্দেহ।—লালী বললে।

অয়নের বালকসুলভ চঞ্চল চোখ শান্ত হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে বললে, এই দামি উপহারটা দেখাবে বলেই কি সেই পুঁতির মালার কথাটা পাড়লে? আজকের মিসেস গুপ্তাকে সেদিন সাড়ে ছ’ আনার উপহার দিয়েছিল বলে সেই ছেলেটার লজ্জার শেষ নেই আজো।

হাসি মুখে লালী বললে, তুমি ভারি ছেলেমানুষ অয়ন! উপহারের দাম না জেনেই দিয়ে ফেল আর অনর্থক লজ্জা পাও। সেদিন ছেলেটি জানতেই পারেনি মেয়েটির কাছে কত দামি ছিল সেই পুঁতির মালা। অনেক আনন্দের হীরে দিয়ে গাঁথা ছিল সেটা! কিন্তু এই রুবির লকেটটা কেন দেখ লাম জানো?

কেন?

লালীর মুখের হাসি নিভে এল। বললে, স্বামীর দেওয়া উপহার। কত আনন্দই হওয়া উচিত। কিন্তু এই লকেটটা আমার কাছে কোনো আনন্দ বয়ে আনেনি, বরং কেমন যেন একটা ভয় জাগিয়েছে।

ভয়?

হ্যাঁ। দেখছ না, লাল রুবি পাথরটা লাল আলোর মতো অজানা বিপদের সঙ্কেত দেখাচ্ছে! জানো অয়ন, আজই সকালে আমার হাতে একখানা আরশি ভেঙে গেছে—বিকেলে বারান্দায় যেতে গিয়ে পায়ে হোঁচট লেগেছে—কেবলই মনে হচ্ছে, কোথায় কোনো বিপদ যেন আমারি জন্যে ওত পেতে রয়েছে!

লালীর সাদা মুখখানা আরও সাদা হয়ে উঠল। অয়ন হালকা গলায় বলে উঠল, কী সব আজেবাজে বলছ!

কেমন যেন ক্লান্ত গলায় লালী বললে, আজেবাজে! হয়তো তাই। কিন্তু মন থেকে ভয়টাকে তবু তাড়াতে পারছি না। তাই পার্টিতে গিয়ে বসতেও মন চাইছে না।

তেমনি হালকা গলায় অয়ন বললে, আজকাল খুব রহস্য উপন্যাস পড়ছ বুঝি? তাই তোমার নার্ভগুলো উইক হয়ে পড়েছে। গুপ্ত সাহেবকে বলে একটা নার্ভ—টনিক আনিয়ে দিতে হবে দেখছি!

ঠাট্টা কোরো না অয়ন।

লালীর গলার আওয়াজ অত্যন্ত বিষণ্ণ শোনাল। এবার গম্ভীর হয়ে গেল অয়ন। গলায় আশ্বাস মিশিয়ে বললে, এ বাড়ি তোমার নিজের, এখানে তোমার ভয় কিসের’ শুধু এ—বাড়ি নয়, সারা কপার টাউনের কোথাও তোমার ভয় নেই।

লালীর মুখ ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অয়নের একখানা হাত ধরে বললে, সত্যি বলছ?

আরও হালকা সুরে অয়ন বললে, বড় বেশি সুখে থাকলেই মেয়েরা ভয় পায়। কেবলই ভাবে এত সুখ কি সইবে?

লালী বললে, আমার বড় বেশি সুখ কোথায় দেখলে তুমি?

অয়ন বললে, ধনী—ঘরের মেয়ে তুমি, অগাধ ঐশ্বর্যের মধ্যে বসে আছ। রূপবান গুণবান স্বামী পেয়েছ—তোমার মত এত সুখ কে পায়?

আমাকে তুমি হিংসে করছ অয়ন?

আমি গরীব ঘরের ছেলে, হিংসে করাই তো স্বাভাবিক।

হাসি মুখে লালী বললে, মিছে কথা! হিংসে তুমি আমাকে করতে পার না। একদিন তুমি আমায় ভালোবাসতে।

এক মুহূর্তের জন্যে অয়নের চোয়াল দুটো যেন শক্ত হয়ে উঠল। কেমন যেন তেতো গলায় বললে, তোমাকে তো বলছি, পুরোন দিনের জের টেনে লাভ নেই। পুরোন জিনিস ফেলে দিতে হয়!

তারপর আবার সেই হালকা গলায় বললে, গুপ্তসাহেব এবার আমাদের দুজনকে ডাকতে লোক না পাঠান। নাও, চটপট রেডি হয়ে নাও।

যেতেই হবে?

হবে বৈকি। আজকের পার্টিতে তুমি না গেলে কি চলে? গুপ্তসাহেবের প্রেস্টিজ ঢিলে হয়ে যাবে না?

দু—আঙুলে কপালের রগদুটো টিপে লালী বললে, বেশ, যাব। কিন্তু বিকেল থেকে মাথাটা ধরে আছে, কি করি বল তো?

এতক্ষণ বল নি কেন? দাঁড়াও—

প্যান্টের পকেট হাতড়ে কাগজের একটা ছোট্ট পুরিয়া বার করলে অয়ন। বললে, এটা খেয়ে নাও, পাঁচ মিনিটে আরাম। দোহাই তোমার, এখুনি তৈরি হয়ে চলে এস, নইলে আমার চাকরি নির্ঘাৎ নট হয়ে যাবে।

বলতে বলতে পর্দার বাইরে চলে গেল অয়ন।

.

মৌচাকের গুনগুন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। অনেক জোড়া চোখ আটকে রইল হলঘরের দরজায়।

আজকের মধুচক্রের মক্ষিরাণী এসে দাঁড়িয়েছে।

দেহ জড়িয়ে টকটকে লাল রঙের সিল্কের শাড়ি, জরি বর্ডার—দেওয়া তেমনি লাল শ্লিভলেস ব্লাউজ—সুডৌল কাঁধ থেকে আইভরির মতো হরিদ্রাভ সাদা হাত দুখানি নেমে এসেছে, আইভরি—রং বুকের মাঝখানে রক্তবর্ণ রুবির লকেট, ঘন কালো রেশমি এলো খোঁপা ঘিরে পলাশ কুঁড়ির সারি। লালের আগুনে ছাব্বিশ বছরের যৌবন জ্বলছে।

এই লালী গুপ্তা। কপার টাউনের প্রধান নীলাদ্রি গুপ্তর স্ত্রী।

লাল ঠোঁটে স্মিত হাসির রেখা ফুটিয়ে, হাত দুটি বুকের কাছে জোড় করে লালী এগিয়ে এল হলের ভেতরে। দাঁড়াল একেবারে স্বামীর পাশে। খুশিতে ঝলমল করে উঠল নীলাদ্রির ফর্সা মুখ আর কটা রঙের চোখ।

কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ।

তারপরেই মানুষের মৌচাক আবার গুঞ্জন করে উঠল। শুরু হয়ে গেল উপহার দেওয়ার পালা। কানাকানি হতে লাগল নানা মন্তব্য :

লালী গুপ্তা একখানা বিউটি বটে!

লাকি ডগ ওই নীলাদ্রি, কি বলো?

অত রূপ কিন্তু ভালো নয়।

যা বলেছ, হেলেনের জন্যেই ট্রয়—নগর পুড়েছিল।

ইস, কী খুশি দেখাচ্ছে নীলাদ্রি গুপ্তকে!

বউকে দারুণ ভালবাসে যে!

অমন বউ পেলে সবাই ভালোবাসে।

হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলেন হংস—দম্পতি। রক্তগোলাপের তোড়া লালীর হাতে দিয়ে মিসেস সাহানী বললেন, নামটা তোমার আজ সার্থক হয়েছে লালী।

মিঃ সাহানী গদগদ গলায় বললেন, তোমাদের মতো এত সুন্দর জুটি আমি আর দেখিনি নীল!

অনেকে অনেক কিছুই বললে, শুধু চুপ করে রইল দুটি মানুষ। অয়ন আর কান্তা। অয়নের তামাটে মুখের ওপর দিয়ে একখানা ছায়া ভেসে গেল। আর কান্তার ঝকঝকে কালো চোখ আরো উগ্র রকমের ঝকঝকে হয়ে উঠল।

নীলাদ্রির মুখে সেই পেটেন্ট হাসিটি। ঠোঁটের ডান দিকের কোণ ঈষৎ তুলে সে বো—টাইটা একবার ঠিক করে নিল, তারপর এদিক—ওদিক চেয়ে বললে, আমাদের এই উৎসবকে সুন্দর করে তোলার জন্য আমার আর আমার স্ত্রীর তরফ থেকে প্রত্যেক বন্ধু—অতিথিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি বলতে গর্ব অনুভব করছি যে, লালী আমার জীবন—বাগানের সুন্দরতম ফুল—আমার প্রতিদিনের সুখ, শান্তি, আনন্দ।

লালী স্বপ্নময় চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভুলে গেছে কিছুক্ষণ আগের অনির্দেশ্য ভয় আর মাথা ধরার কথা।

হল—এ মৃদু হাততালির শব্দ। সেই শব্দ ছাপিয়ে নীলাদ্রির গম্ভীর আওয়াজ শোনা গেল, ডন!

হলঘরের একপাশে বারের কাছ থেকে সাড়া দিল ডন রিভাস, ইয়েস বস!

ছ’ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা মজবুত শরীর, ঘাড়ের চামড়া ঘেঁষে ছাঁটা চুল মাথার সামনের দিকে এসে আধ ইঞ্জিটাকে দাঁড়িয়েছে। খাঁড়ার মতো নাক, ধূসর রঙের চোখ সদা—সতর্ক। ডন রিভাস জাতে জার্মান, কপার টাউনের ফ্যাক্টরি—ম্যানেজার।

নীলাদ্রি, বললে, ড্রিঙ্কস প্লিজ!

ও—কে বস।— ডন ডাকলে, জাফর! গিলাস লাগাও।

ঔরঙ্গজেব—মার্কা দাড়িওয়ালা এক বয় ট্রে—ভর্তি সরু ডাঁটি লাগানো কাচের পানপাত্র টেবিলে টেবিলে বিলি করতে শুরু করলে। ডন রিভাস আলাদা দুটো পানপাত্র নিয়ে, মনিব ও মনিবানীর সামনে নিজে খাতির করে সাজিয়ে রাখলে। তারপর এল চাকালাগানো টেবিলে চড়ে স্টেনলেশ স্টিলের বালতির মধ্যে বরফের গুঁড়োয় ডোবানো লম্বা একটা বোতল। ফরাসি দেশের দ্রাক্ষাসব, যার নাম শ্যাম্পেন।

অদ্ভুত কায়দায় ছিপি খুলে ফেললে ডন, তারপর মনিবের দিকে তাকালে।

নীলাদ্রি বললে, ঢালো।

ডন ঢাললে না। ঈষৎ মাথা নুইয়ে সসম্ভ্রমে বোতলটা এগিয়ে ধরলে মনিবের দিকে। বললে, আগে উৎসবের রানিকে। নীলাদ্রি লালীর কাপ ভরে দিতেই বোতলটা ফিরিয়ে নিল ডন রিভাস। তারপর পরিবেশন শুরু করলে প্রভু এবং অতিথিদের পাত্রে।

একবার কেশে নিয়ে মিঃ সাহানী আবেগভরে বললেন, নীলাদ্রি ও লালী গুপ্তার বিবাহিত জীবন চিরদিন সুন্দর ও সার্থক হয়ে থাক। চিয়ার্স!

সকলে পানপাত্র তুলে ধরে প্রতিধ্বনি করলে, চিয়ার্স!

নীলাদ্রি আর লালী প্রথমে শ্যাম্পেনে চুমুক দিলে। দেখাদেখি অন্য সবাই। ভরা পড়ে রইল শুধু কান্তার পাত্র। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে সে বসেছিল—সবার থেকে একটু তফাতে। আস্তে আস্তে অয়ন তার পাশে এসে দাঁড়াল।

তুমি কি শ্যাম্পেন পছন্দ করো না কান্তা।

হুঁ।

অয়ন বললে, তবে ছোঁওনি? তুমি কি চাও না ওদের বিবাহিত জীবন সুখের আর সুন্দর হোক?

চমকে উঠে কান্তা বললে, কে বললে চাই না?

কেউ বলেনি। আমি জানি।

কি জানো?—ঝকঝকে কালো চোখের দৃষ্টি যেন তলোয়ারের ফলা।

হা হা করে হেসে উঠে অয়ন বললে, আঙুর ফল টক! তবে আঙুর থেকে যে শ্যাম্পেন তৈরি হয়, সেটা কিন্তু মিষ্টি! খেয়েই দেখো না।

দাঁতে দাঁত পিষে কান্তা বললে, ইচ্ছে হয়, তুমি খাও।

কান্তার পাত্রটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে অয়ন খালি করে ফেললে। তারপর বললে, ধন্যবাদ কান্তা। গরিবের ছেলে, দামি জিনিস ফেলে দেওয়া অভ্যেস নেই—ওকি !

সমস্ত হলঘর তখন হঠাৎ অস্ফুট চিৎকার করে উঠেছে। আর, নীলাদ্রি ব্যাকুল হয়ে টেবিলে মুখ গুঁজে—থাকা লালীর পিঠে নাড়া দিয়ে ডাকছে, লালী! কি হল? লালী।

কোনো সাড়া নেই। চেতনার কোনো চিহ্নও নেই লালী গুপ্তার দেহে।

নীলাদ্রি উদভ্রান্তের মতো ডাকলে, ডক্টর দাস!

আধাবয়সী ডাক্তার ধীরাজ দাস ছুটে এলেন। কাঁচাপাকা চুল, ঘন ভুরু, পাকানো গোঁফ আর ফরাসি ধাঁচের অল্প দাড়ি। কপার টাউন হসপিটালের চিফ মেডিক্যাল অফিসার।

ছুটে এল অয়ন। ছুটে এল কান্তা।

লালীর মুখ দেখা যাচ্ছে না, ঝুলে—পড়া একখানা হাত তুলে নিয়ে ধীরাজ দাস পালস দেখলেন। একবার—দু’বার। ডাক্তার ঘন ভুরুর ওপর কপালে রেখা পড়ল। নীলাদ্রিকে বললেন, ঘরে নিয়ে চলুন।

লালীর নরম হালকা দেহটাকে নীলাদ্রি বলিষ্ঠ দু—হাতে বুকে তুলে নিল। শুধু এক সেকেন্ডের জন্যে লালীর মুখখানা দেখতে পেল অয়ন, পরক্ষণেই নীলাদ্রির চওড়া বুকের ওপর দেখা যেতে লাগল তার মাথার পিছনটা। কালো রেশমী এলোখোঁপায় পলাশ—কুঁড়ির সারি। ভেতর—বাড়িতে যেতে যেতে ডাক্তার একবার ফিরে তাকিয়ে বললেন, আশা করি রুগির ঘরে কেউ ভিড় করবেন না।

সবাই যখন স্তব্ধ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে, তখন সবার অলক্ষে একখানা হাত লালীর আধ—খাওয়া শ্যাম্পেনের পাত্রটা সরিয়ে নিল।

এত আনন্দের মধ্যে যার শুরু, এমন বিষাদে তার শেষ হবে কে ভেবেছিল!

আপনি—রোমাঞ্চ—গল্পের পাঠক, আপনিও হয়তো ঠিক এ হেন পরিস্থিতির জন্যে মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু এমনিই হয়। জীবনটা মানুষের ভাবনার বাইরেই ঘুরছে অনবরত। তাই আপনার জন্যে আরও একটা চমক অপেক্ষা করছিল।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই সারা কপার টাউনে শোকের খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। হার্টফেল করে লালী গুপ্তা মারা গেছে! অনেক চেষ্টা করেও ডা. ধীরাজ দাস বাঁচাতে পারলেন না।

.

আইভি লজে অনেকেই এলেন লালী গুপ্তাকে শেষ দেখা দেখতে, আর নীলাদ্রির শোকে সমবেদনা জানাতে। কিন্তু হলঘরে দাঁড়িয়ে কান্তা বিষণ্ণ গলায় বললে, মিস্টার গুপ্ত অসম্ভব রকম ভেঙে পড়েছেন, মিসেস গুপ্তাকে জড়িয়ে ধরে ছেলেমানুষের মতো কাঁদছেন! এসময় তাঁর সঙ্গে দেখা করাটা উচিত হবে কি? ওঁকে এখন একা থাকতে দেওয়াই ভাল। আপনারা বরং দু’—একদিন বাদে—

কথাটা যুক্তিসঙ্গত। তাই আপাতত কান্তাকেই সমবেদনা জানিয়ে একে একে সমব্যথীর দল ফিরে গেলেন। অনেকেই এল, গেল, এল না শুধু অয়ন—যে অয়ন একসময় লালীর ছেলেবেলার সাথী, আর কিশোরদিনের বন্ধু ছিল।

অয়নের অনুপস্থিতি আশ্চর্যের ব্যাপার বটে।

একমাত্র পুরোনো খানসামা জাফর আলি ছাড়া লালীর বাপের বাড়ির কেউ বর্তমান নেই। নীলাদ্রির বিধবা মা পাকিস্তানে। সুতরাং কাউকে খবর দেওয়ারও ঝামেলা নেই। কারো আসারও অপেক্ষা নেই।

তবু, সৎকারের জন্যে অপেক্ষা করতেই হল।

ঘরে যখন লালীর মৃতদেহ জড়িয়ে নীলাদ্রি অজস্র চোখের জল ফেলছে, বাইরে তখন একুশে জুলাইয়ের রাতও কাঁদছে। পার্টি যখন অকালে ভাঙল, জাফর আলি এক এক করে হলঘরের বাতিগুলো যখন নিভিয়ে দিতে লাগল, ঝাউবনীর আকাশেও তখন কোনও এক অদৃশ্য খানসামা এক এক করে তারা আর চাঁদের ফানুসগুলো নিভিয়ে দিল। কেউ খেয়াল করেনি কখন ধলাই পাহাড়ের মাথায় মেঘের কুণ্ডলী জমছে আর হাওয়া উঠেছে চনমন করে। দেখতে দেখতে ঝড় এসে পড়ল। নেমে এল মুষলধারে বৃষ্টি।

সেই ঝড়—বৃষ্টি ফোঁসফোঁসানি শান্ত হতে রাত তিন প্রহরে পৌঁছল। ফুলে ফুলে সাজানো হল লালীর শেষ বাসর—শয্যা। যে ফুলগুলি সে কিছুক্ষণ আগে উপহার পেয়েছিল, সেই ফুল দিয়েই।

জাফর আলি দু—একবার মাথা নেড়ে বললে, রাত কাবার না হতেই এত তাড়া কেন? আসমানে এখনো দ্যাওয়া ডাকছে!

ধীরাজ দাস নীরস গলায় বললেন, অনর্থক দেরি করে লাভ নেই। বৃষ্টি তো ধরে গেছে। মিস্টার গুপ্ত, এবার উঠুন—শেষ কাজটুকু আমাদের করতে দিন।

লালীর পাশ থেকে আস্তে আস্তে সরে দাঁড়াল নীলাদ্রি। তাকে দেখাচ্ছে ঝড়ে হাল—ভাঙা পাল—ছেঁড়া একটা জাহাজের মত। গভীর একটা নিশ্বাস ফেলে বললে, যা করবার আপনারাই গিয়ে করুন—কেবল আমাকে যেতে বলবেন না, প্লিজ—

নীলাদ্রির গলার আওয়াজ বুজে এল।

শিলাই নদীর ধারেই ঝাউবনীর শ্মশানঘাট। একটা জঙ্গলের গায়ে। সেখানে লালীর দেহ বয়ে নিয়ে এল অল্প কয়েকজন লোক। ধীরাজ দাস, ডন রিভাস আর দু—চারজন ফ্যাক্টরির কর্মী। এই দুর্যোগে শেষ রাতে আর কেই বা আসবে? পিছন পিছন এল শুধু পুরোনো খানসামা জাফর আলি, আর ওয়ার্কার্স ব্যারাক থেকে নীলাদ্রির দূর সম্পর্কের এক ভাইপো—মুখাগ্নির জন্যে।

ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে দু’চারটে তারা, ঝিমঝিমে চাঁদের আলো দেখা দিয়েছে। টর্চ হাতে কুড়ুল নিয়ে দুজন কাঠ কাঠতে জঙ্গলে ঢুকল। কান পেতে কি যেন শুনল ডন রিভাস, তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল নদীর কোল ঘেঁষে। শিলাই নদীর কাচের মতো স্বচ্ছ জলে কে যেন গেরুয়া রং গুলে দিয়েছে। পাহাড়ি নদী শিলাই গরমকালে ভারি শান্ত, রোগা মেয়েটির মতো। বর্ষা নামলে তার চেহারা যায় পালটে, গেরুয়া ঘাগরা ফুলিয়ে দুলিয়ে পাক খেতে খেতে নাচতে থাকে।

কপালে হাত রেখে ঝিমঝিমে জ্যোৎস্নায় দূরে কি যেন দেখার চেষ্টা করলে ডন। তারপর মুখ ফিরিয়ে বললে, জলদি করো! হারি আপ!

কিন্তু জলদি করো বললেই জলদি করা যায় না। একটা পুরো চিতার জন্যে জ্বালানি কাঠ নেহাত কম লাগে না। অর্ধেক কাঠ কেটে আনতে না আনতেই ডন আবার হাঁকলে, হারি আপ মেন! আওর জলদি করো!

এবার ডনের গলায় স্পষ্ট উৎকণ্ঠা।

ধীরাজ ডাক্তার স্বভাবনীরস গলায় বললেন, ব্যাপার কি?

নদীর উজানে চোখ রেখে ডন বললে, শিলাইয়ের মেজাজ ভাল মনে হচ্ছে না। ওদের হাত চালাতে বলুন। আধ ঘণ্টার মধ্যে কাজ সারতে হবে।

কিন্তু ডনের হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেল। যথাসাধ্য দ্রুত হাত চালিয়ে চিতা সাজাতে অবশ্য মিনিট পনেরোর বেশি লাগল না, তারপর লালীকে যেই শোয়ানো হল, আগুন দেওয়াটা মাত্র বাকি, ঠিক তখনই—

নদীর ধার থেকে তাড়া—খাওয়া জানোয়ারের মতো ছুটে আসতে আসতে ডন শুধু বললে, আসছে।

আতঙ্কিত চোখ মেলে সবাই তাকাল। আসছে নয়, এসে পড়েছে।

শেষ রাতের ঘোলাটে জ্যোৎস্নায় দেখতে পাওয়া গেল, গেরিমাটি—গোলা ফেনিল জলস্রোত বুনো গোখরোর মতো হাজার ফণা তুলে ছুটে আসছে বাতাসের আগে। মাতাল মেয়ের মতো বেসামাল কৌতুকে খলখল করে হাসছে শিলাই।

ঝাউবনীতে যাদের বাস, তাদের জানতে বাকি নেই পাহাড়ি নদীর বান কী মারাত্মক! তার মুখে হাতি পড়লে কুটোর মতো ভেসে যায়।

কর্তব্যের চেয়ে বড় প্রাণের ভয়। দেখতে দেখতে ঝাউবনীর শ্মশানঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। শিলাইয়ের তীরে কাঠের বাসরশয্যায় একা শুয়ে রইল লালী।