নয়
মংপু পিনাকীকে বিদায় দিয়ে এসেই ঘরের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, এটা কী হল মি. ডলফিন?
ভয়ংকর লোকটি তখন নিশ্চিত্তে বসে তাঁর রিভলভারের নলগুলি পরীক্ষা করছিল। যেন কিছুই বুঝল না এমনভাবে বলল, কীসের কী হল?
ওই লোকটাকে আপনি অতটা বিশ্বাস করলেন কেন?
তোমাকেও তো একদিন বিশ্বাস করেছিলাম।
এই কথা শুনে মংপু চুপ করে গেল। তারপর বলল, হ্যাঁ করেছিলেন, তার আগে আপনি জেনেছিলেন আমি কী। আর এই লোকটা…। এ যদি পুলিশের লোক হয়, তা হলে…? ,
তা হলে কী?
ও তো এখুনি থানায় খবর দিয়ে আমাদের দলবল সমেত ধরিয়ে দেবে। দিক না। ক্ষতি কী? একদল গবেট নিয়ে কাজ কারবার করার চেয়ে দল উঠিয়ে দেওয়াই ভাল।
আপনার কথার অর্থ আমি ঠিক বুঝলাম না।
আজ দুপুরে বেশি চালাকি করতে গিয়ে তুমিই যে কাণ্ডটা করেছিলে তাতে সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে যদি উদ্ধার করতে না পারতাম, তা হলে তোমাকে নিংড়ে এতক্ষণে পুলিশ তো আমাদের সব ঘাঁটিই দখল করে নিত। তোমার মতো একটা দুর্ধর্ষ শয়তান যদি একটা বাচ্চা ছেলের কাছে হেরে যায়, তা হলে কার ওপরে ভরসা করব? তাই বাধ্য হয়েই আমাকে নতুন লোক দেখতে হচ্ছে।
মংপু মাথা হেঁট করল। বলল, এর জন্য আমি লজ্জিত বস। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। কিন্তু পুলিশ এখন যেভাবে খেপে আছে তাতে এই লোকটা যদি পুলিশের স্পাই হয়, তা হলে তো ভয়ের ব্যাপার।
জয় তো ভয়ের ভেতর দিয়েই হয়। যেখানে ভয় নেই সেখানে জয়ও নেই। আমি কিন্তু ব্যাপারটা ভাল বুঝছি না।
ডলফিন হেসে বলল, তোমার কি ওকে পুলিশের লোক বলে সন্দেহ হচ্ছে? অবশ্যই। ছোকরার তেজ দেখলেন না? আমি ওর ঘাড়ে একটা রদ্দা দিতেই এমন একটা ঘুসি ছুড়েছিল যে লাগলে আমি মরে যেতাম। তা ছাড়া ওর উদ্ধত কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। ভিমরুলের চাকে এসেও ওর ভয় নেই। আপনার সামনে দাঁড়িয়েও বুক কাঁপেনি ওর। এতেও কি মনে হচ্ছে না ও পুলিশের লোক ছাড়া কেউ নয়?
ধরো তাই যদি হয় তা হলে? পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাবার উপায় একটা করতে হবে তো?
অবশ্যই। আমাদের এখুনি গা ঢাকা দেওয়া দরকার।
না। আজ এখানে মরণবাঁচনের লড়াই হবে। ওই ছোকরা যে পুলিশের স্পাই তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে এক মত। আমার দু’জন লোক ওর পিছু নিয়েছে তারা জানালেই আমি সতর্ক হব। ডালহৌসি পাড়ার অতবড় একটি ব্যাঙ্কের কর্মচারী, অথচ তার সঙ্গে লালবাজারের পুলিশদের চেনা-পরিচয় থাকবে না, এ হতে পারে না।
ব্যাঙ্কে চাকরি করে না ছাই। এ পরিচয়টাও মিথ্যে হতে পারে।
না ওর নোটবুক দেখে বুঝেছি ও মিথ্যে বলেনি।
এমন সময় ফোন বেজে উঠল।
ডলফিন রিসিভার উঠিয়ে সব কথা শুনেই বললেন, আমার অনুমান তা হলে মিথ্যে নয়। ঠিক আছে তোমরা ওকে আক্রমণ করনি তো?
ওদিক থেকে কী যেন উত্তর হল।
চলে এসো তোমরা। বলে ফোন নামিয়ে রাখল ডলফিন।
মংপু বলল, কার ফোন?
ওই ছোকরার ব্যাপারে। ও লালবাজারের সদর দপ্তরে এই রাতেই গিয়ে ঢুকে পড়েছে।
মংপু চিৎকার করে উঠল। বলল, একবার শুধু আদেশ করুন বস, ওর বাবা, মা, ভাই বোন যে যেখানে আছে সব ব্যাটাকে কেটে বাড়িটাকে জ্বালিয়ে দিয়ে আসি। এই মুহূর্তে ওই ছোকরার মাথাটা আমার চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে।
শান্ত হও বৎস। অত বেশি উত্তেজিত হোয়ো না। মাথা গরম করে এখন কখনও ওইসব করতে যায়? পুলিশ এত বোকা নয়, এখন ওর বাড়ির চারপাশেই কড়া নজর পুলিশের। গেলেই ধরা পড়বে।
কিন্তু ওই লোকটাকে লালবাজার অব্দি পৌঁছতে দেওয়া হল কেন? তার আগেই তো ওকে সরিয়ে দেওয়া যেত। আমাকে বললে, আমিই ওর পিছু নিয়ে একটি গুলিতে দিতাম ওর ভবলীলা সাঙ্গ করে।
ডলফিন হেসে বলল, পুলিশের গতিবিধির ওপর তোমার কোনও ধারণা নেই বলেই তুমি এই কথা বলছ। বাসব মজুমদারকে আঘাত করার পর ওই একই এলাকায় আজ কখনও খুন-জখমের ঝুঁকি নেয় কেউ?
তা হলে কী হবে বস?
ওদেরকে আসতে দাও। আমার অনেক দিনের পাতা ফাঁদ। সেই ফাঁদে পা দিতে দাও ওদের।
ওরা এলে তো একা আসবে না। আসবে বিরাট পুলিশবাহিনী নিয়ে। ওদের সঙ্গে লড়ে আমরা পেরে উঠব কেন?
শোনো, ছোকরা চলে যাওয়ার পরমুহূর্তেই আমি ঠিক করে ফেলেছি এই তাসের ঘর আর রাখব না।
মংপু হাঁ করে তাকিয়ে রইল ডলফিনের মুখের দিকে।
ডলফিন বলল, মাথায় ঢুকল না তো কিছু?
মংপু বলল, না।
পুলিশ এলে গোডাউনের ভেতর আর এই বাড়ির মধ্যে পরম সমাদরে ঢুকিয়ে নিতে হবে তাদের। তারপর শুরু হবে খেল। একটু দূরে কোথাও দাঁড়িয়ে…
তার আগে বাড়িটা ফাঁকা করতে হবে তো?
বাড়িতে আছেটা কী? আছেই বা কে? সবাই বাইরে গা ঢাকা দিয়ে আছে। এবার আমরাও চলে যাব এখানকার পাট চুকিয়ে। কখন যাব?
সংকেত এলেই। নীচের দরজাটা বন্ধ থাকবে। আমরা বারান্দা টপকে পালাব। ঘরের ভেতর আলো জ্বলবে, যদি লোডশেড়িং হয়, এমার্জেন্সি কাজ করবে। গোডাউনের দরজাও খোলা থাকবে আমাদের। পুলিশ এসে ওর ভেতরে ঢুকে পড়লেই…
বলুন, থামলেন কেন?
দুটো প্রচণ্ড শক্তিশালী বোমা রাখা আছে দু’জায়গায়। আর এই হচ্ছে ডিটোনেটর। এর মধ্যে দুটো বোতাম আছে। ওপরের বোতামটা টিপলে এক নম্বরটা ফাটবে। আর নীচেরটা টিপলে ফাটবে দু’নম্বরটা।
মংপু দারুণ উত্তেজিত হয়ে বলল, পায়ের ধুলো দিন বস।
এমন সময় দরজার সামনে রেড এলার্ম বেজে উঠল। উত্তেজিত ডলফিন বলল, কুইক। পুলিশ এল বলে।
মংপু বলল, আপনি এত তাড়াতাড়ি কী করে এই ব্যবস্থাটা করলেন?
তাড়াতাড়ি নয় তো? এ আমার অনেক দিনের পরিকল্পনা। সব রেডিই ছিল। শুধু ওই ছোকরাকে আমার লরির পেছনে ধাওয়া করতে দেখেই মনস্থির করলাম নাটকটা আজই শেষ করে দেব বলে।
কিন্তু ধরুন যদি ও আপনার প্রস্তাবে রাজি হত?
তা হলেও নজরে রাখতাম ওকে। তারপর ডালহৌসির ওই ব্যাঙ্কে অপারেশন শেষ হলে ওকেও সরিয়ে দিতাম। তবে কিছু টাকা অবশ্য পেত ওর বাড়ির লোকেরা।
ডলফিন আর সময় নষ্ট না করে কৌশলে চলে এল বাড়ির বাইরে। মংপুও সঙ্গে এল।
এক বিরাট পুলিশবাহিনী তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ভিমরুলের চাকের দিকে। ওরা জানেই না কি নিদারুণ মরণফাঁদ ওদের জন্য পেতে রেখেছে দুষ্কৃতীরা। এই নিষ্ঠুর চক্রান্তে ভগবানও শিউরে উঠলেন বুঝি।
মাঝেরহাট ব্রিজের কাছে একটি বাড়িতে কাল দুপুর থেকে রিয়াকে বন্দি করে রেখেছিল ওরা। কী থেকে কী হয়ে গেল রিয়া ভেবেও পেল না। হিরণ ছাদে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দু’জন লোক কাল কাপড়ে ওর মুখ বেঁধে নাকে রুমাল চেপে ধরল। তারপর নিয়ে এল এই বাড়িতে। পা থেকে গুলি বার করে ইঞ্জেকশান দিয়ে পায়ে ব্যান্ডেজ করে এই বাড়ির দোতলার একটি চিলেকোঠায় ওকে আটকে রাখল। হাত-পা বাঁধেনি, কিন্তু বাইরে থেকে দরজায় শিকল দিয়ে রেখেছে। ঘরের ভেতরে আছে গেলাস ঢাকা খাবার-জলের একটা কলসি। আর কোনও কিছু নেই। ঘরের পেছনদিকের দেওয়ালে আছে ছোট্ট একটি জানলা। সেখান দিয়ে সে অনবরত ট্রেনের যাতায়াত দেখেছে সারাদিনে। আর দেখেছে একজনকে। সে হল কার্লস জ্যাকল। লোকটা নামেও যেমনি ভয়ংকর, চেহারাতেও তেমনি। হিরণের মুখে ওর অত্যাচারের কাহিনি আর চেহারার বর্ণনা তো শুনেই ছিল, এখন চাক্ষুস দেখে বুঝল হিংস্র পশুর প্রকৃতি নিয়ে মানুষ কীভাবে ঘুরে বেড়ায়।
ওকে নিয়ে এসে ওরা যখন এই ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, ঠিক তখনই অশুভ আবির্ভাব হল কার্লস জ্যাকলের।