লালবাজারে রাহাজানি – ৮

আট

হাঙ্গার ফোর্ট স্ট্রিট থেকে লালবাজার কতটুকুই বা পথ। ঠিক পার্ক স্ট্রিটের মুখের কাছে আসতেই একটা বেপরোয়া লরি এসে ধাক্কা মারল বাসববাবুর জিপটাকে। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাসব মজুমদার ছিটকে পড়লেন চৌরঙ্গি রোডের ওপর। জিপের ড্রাইভার হরকিষণ গুরুতর আহত অবস্থায় স্টিয়ারিং ধরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল। জিপটাও ভেঙে চুরে পড়ে রইল রাস্তায়। এই রকম অবস্থায় যা হয়, পথচারীরা হই হই করে ছুটে গেল সেই দিকে। বাসববাবু সংজ্ঞাহীন না হলেও প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন তিনি। হরষিণের কী হবে তা কে জানে?

কয়েকজন লোক ধরাধরি করে তুলে বসাল বাসববাবুকে। ডান পায়ের হাঁটুতে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথাতেও আঘাত লেগেছে প্রচণ্ড। দুর্ঘটনার ঘোর তাই কাটিয়ে উঠতে সময় লাগল একটু। প্রথমত তিনি কোনও কথা বলতে পারলেন না। অনেক পরে একটু যখন প্রকৃতিস্থ হলেন তখন দেখলেন খবর পেয়ে সাহায্যকারী পুলিশবাহিনী এসে গেছে। কেউ নিশ্চয়ই কোথাও থেকে ফোনে পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে এই দুর্ঘটনার কথা। যাই হোক, পুলিশের অনেক হোমরাচোমরা অফিসারও ছুটে এলেন ঘটনাস্থলে।

বাসব মজুমদার এবং হরকিষণ দু’জনকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। বাসব মজুমদারকে ছেড়ে দেওয়া হল ফার্স্ট এড দিয়ে। কিন্তু হরষিণের অবস্থা এখনতখন। স্যালাইন, ব্লাড প্রয়োজনীয় সবকিছুই দিতে হল তাকে।

এদিকে ঠিক ওই দুর্ঘটনার সময়টিতেই ভবানীপুরের পিনাকী গুপ্ত নামে এক যুবক হঠাৎ করেই এসে পড়েছিল সেইখানে। ডালহৌসি এলাকার একটা নামী ব্যাঙ্কের কর্মচারী সে। ওর এক বন্ধুকে সি অফ করবার জন্য হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিল। তারপর ধর্মতলায় ব্যক্তিগত প্রয়োজনের দু’-একটা টুকিটাকি জিনিস কেনাকাটা করে ওই পথ দিয়ে ফিরছিল। পিনাকী গুপ্তকে দেখতে সুন্দর। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ বছর। মাথায় হেলমেট পরে থাকায় তাকে সৈনিকের মতো দেখাচ্ছিল। একটা লাল রঙের স্কুটারে চেপে ঝড়ের বেগে আসছিল সে। তার চোখের সামনেই ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটা ঘটতে দেখে বারেকের তরে থমকে দাঁড়াল। তারপর এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত, তা ভেবে স্থির করে নিল। অর্থাৎ আহত পুলিশ অফিসারের দিকে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে সে সামান্য একটু দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নিল ধাবমান লরিটির। যেতে যেতেই লরির নাম্বারটা নোট করে নিল। যদিও সে জানে এইসব গাড়ির নাম্বার প্লেট কখনও থাকে না তবু নিজের সুবিধের জন্যেই এই কাজ করল।

লরিটির পিছনে ধাওয়া করে পিনাকীর একটা কথাই বার বার মনে হতে লাগল নিছক অসাবধানতার ফলে এই দুর্ঘটনা নয়, হত্যার উদ্দেশেই ঘটানো হয়েছে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে।

লরিটি চলছে তো চলছেই, থামবার আর নাম নেই। অবশেষে কালীঘাট স্টেশনের কাছে একটু নির্জনে এক জায়গায় গিয়ে থামল লরিটা। পিনাকী সেটাকে অতিক্রম করে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে স্কুটারটাকে এক জায়গায় দাঁড় করাল। তারপর দেখতে লাগল ওদের গতিবিধি।

একজন স্যুটেডবুটেড লোক ছায়ান্ধকারে নেমে এলেন লরির ভেতর থেকে। ড্রাইভারও নামল।

লোকটি পাশের একটি সুদৃশ্য ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকে গেল। আর কয়েকজন লোক এসে সেই ট্রাক থেকে কিছু মালপত্তর নামিয়ে গাদা করতে লাগল টিনের শেড দেওয়া একটি ঘরের ভেতর। মাল খালাস হতে সময় লাগল অনেক। তারপর লরিটি ধীরে ধীরে যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল।

পিনাকী দেখল লরির নাম্বার প্লেট আবার বদলে দেওয়া হয়েছে। দুটো নাম্বারই সে তার নোটবুকে লিখে রেখে যখন আবার স্কুটারে এসে বসতে যাবে, তখনই পেছন দিক থেকে ঘাড়ে একটা রদ্দা। পিনাকী দেখল বানরাকৃতি একটা লোক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফিক ফিক করে হাসছে তার দিকে চেয়ে। লোকটার মাথায় ব্যান্ডেজ। মারধর খেয়েছে বোধহয় কোথাও।

পিনাকী চোখে অন্ধকার দেখল যেন। পরক্ষণেই বলল, কে তুই? বানরাকৃতি বলল, তুমি কে?

পিনাকী বলল, তোর বাবা। বলেই লোকটার চোয়াল লক্ষ্য করে মারল এক ঘুসি।

আকৃতি বানরের মতো হলেও প্রকৃতিও তাই। লোকটা ওই অবস্থাতেই এমন একটা লাফ দিল যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল পিনাকীর।

ততক্ষণে লোকটা একটা শিস দিয়েছে। আর অমনি মালখালাস করা সেই লোকগুলো এসে ঘিরে ধরল পিনাকীকে।

পিনাকী বুঝল আর বাঁচার কোনও উপায় নেই। তাই কৌশলে সেই অন্ধকারে নোটবুকটা টুক করে ঘাসের ওপর ফেলে দিল। তারপর কাউকে আক্রমণ করবার কোনওরকম চেষ্টা না করে স্থির হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

লোকগুলো এসেই বলল, ইয়ে আদমি কৌন হ্যায় মংপু?

হম না জানে। সি আই ডি মালুম হোতা। ইসকো আভি লে যাও অন্দরমে। সেই সুদৃশ্য বাড়ির ভেতরেই পিনাকীকে নিয়ে গেল ওরা। ছ’-সাত জন লোক। ওর জামার কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। রাত এখন কত তা কে জানে? কিন্তু এই ঘরের বাসিন্দারা যে কেউ ঘুমিয়ে নেই, তা সে ভালই বুঝতে পারল।

ভেতর সন্দেহভাজন লোকজন সব।

একটি ঘরের ভেতর ভয়ংকর চেহারার একজন বসেছিল। কী অমানুষিক মুখ। খারাপ লোকগুলোকে দেখতে সত্যিই কি একইরকম হয়? চোখের দিকে তাকালে বুক যেন শুকিয়ে আসে। যারা পিনাকীকে সেই ঘরে নিয়ে গেল তারা এক ধাক্কায় ঘরের ভেতর ফেলে দিল পিনাকীকে। অন্ধকার রাতে বাঘের চোখ যদি কেউ দেখে থাকে সে-ই তা হলে অনুমান করতে পারবে সেই লোকটির চোখের চাহনি কী ভীষণ!

লোকটি পিনাকীর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল, এত রাত্রে এখানে

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তুমি কী করছিলে?

পিনাকী বলল, তার আগে জানতে পারি কি আপনি কে?

লোকটি হাসল। বলল, আমার আসল নাম আমিই ভুলে গেছি। তোমাকে কী বলব? তবে সবাই জানে আমি।… যাক তোমার নাম কী বলো? আমার নাম পিনাকীরঞ্জন গুপ্ত।

বাড়ি কোথায়?

ভবানীপুরে।

তার মানে কলকাতার ছেলে। বয়স তো খুব একটা বেশি নয়।

এখানে কী করছিলে?

একটা বেপরোয়া লরি পার্ক স্ট্রিটের কাছে এসে পুলিশের জিপে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে এসেছে। আমি সেই লরির পিছু নিয়ে এখানে এসেছি।

বলো কী! তুমি তো বেশ বাহাদুর ছেলে দেখছি। লরিটা এখন কোথায়? এইমাত্র আপনার বাড়ির সামনে কিছু মাল খালাস করেই চলে গেল। আর তারপরই আপনার লোকেরা আমাকে ধরে নিয়ে এল এখানে।

ওই লরির ভেতরে তো আমিও ছিলাম।

পিনাকী বলল, আপনি ইচ্ছে করেই তা হলে জিপটাকে ধাক্কা দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। বাসব মজুমদারকে একটু শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম।

হয়তো মারা যাননি উনি।

জানি। ওনাকে কই মাছের মতো জিইয়ে রেখে তিল তিল করে মারব আমরা। একেবারে তো মারব না।

আমি এসব কিছুই জানতাম না। শুধু দুর্ঘটনা দেখে উত্তেজিত হয়ে লরিটার পিছু নিয়েছিলাম।

লরির ভেতর থেকে আমি সব দেখেছি। তুমি সেটা বুঝতে পারনি।

যাই হোক, তোমার ঠিকানাটা দাও। স্কুটার তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি।

পিনাকী বলল, ধন্যবাদ। ওটা এখন আমি নিজেই নিয়ে যেতে পারব।

পিনাকীর কথা শুনে ঘর ফাটিয়ে হো হো করে হেসে উঠল লোকটি। তারপর বলল, এই বাড়িতে ঢোকবার মুখে কোনও কিছু অদ্ভুত জিনিস তুমি লক্ষ করেছ? না। আসলে আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম।

মস্ত একটা ভিমরুলের চাক তোমার চোখে পড়েনি? পড়লে বুঝতে ওটা আসল নয়। সিমেন্ট বালি জমিয়ে করা হয়েছে। তা সেই ভিমরুলের চাকে তুমি শুধু হাতই দাওনি, একেবারে তার ভেতরে ঢুকে পড়েছ। এখান থেকে তুমি বেরোবে কী করে?

পিনাকী মনে সাহস এনে বলল, যেভাবে আপনার লোকেরা এখান থেকে বেরোয়, আমিও ঠিক সেইভাবেই বেরুব।

তাই নাকি?

হ্য৷৷ অর্থাৎ আমি কিছু দেখিনি, শুনিনি, জানি না। তা হলেই তো ল্যাঠা চুকে

গেল। যেমন ছিলাম তেমন হয়ে যাব।

লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি কী করো?

ডালহৌসি পাড়ায় একটি ব্যাঙ্কে চাকরি করি।

আমার সঙ্গে হাত মেলাবে তুমি? আপত্তি কী?

যদি বিশ্বাসঘাতকতা করো?

আপনার মতো লোকের কি শাস্তি দিতে একটুও আটকাবে তা হলে?

লোকটি পিনাকীর পিঠ চাপড়ে বলল, সাব্বাস। এইরকম একজন স্মার্ট ইয়ংম্যানকেই আমি খুঁজছিলাম।

এমন সময় মংপু এসে ঘরে ঢুকল। তারপর কী যেন একটা লোকটির হাতে তুলে দিতেই লোকটি ভুরু কুঁচকে বলল, এটা কী?

একটা নোটবুক। এই ছোকরা এটা ঘাসের ওপর ফেলে এসেছিল।

কী আছে এতে?

পিনাকী বলল, বিশেষ কিছুই না, হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল ওটা। আমার প্রয়োজনীয় কিছু টুকিটাকি এর মধ্যে নোট করে রাখি। এতে আমার বাড়ির ঠিকানাও আছে। অফিসের ফোন নম্বরও আছে। আর ওই বেপরোয়া লরির দুটো নম্বরই নোট করে রেখেছি, আপনার সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো আজ রাতে অথবা কাল সকালেই আমি পুলিশকে জানিয়ে আসতাম।

কিস্যু লাভ হতো না তাতে। লরির দুটো নম্বরই ফলস। আমার লরির নম্বর অন্য। তা ছাড়া এই বাড়ির মধ্যে সন্দেহজনক কোনও কিছুই পেত না পুলিশ। আমার আসল যা কিছু তা আছে…। কার্লস জ্যাকলের নাম শুনেছ?

পিনাকী বলল, সে কোথায় থাকে? কার্লস জ্যাকল তো শুনেছি খুব নামকরা স্মাগলার। জেলপলাতক দাগি আসামি।

এবং সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ। কিন্তু ওর স্টিয়ারিং আমার হাতে। যাই হোক, এটা জেনে রেখো আমার খাতায় নাম একবার লেখালে মৃত্যুই কিন্তু তার একমাত্র মুক্তির পথ। যদি বিশ্বাসঘাতকতা না কর, তা হলে আমার দিক থেকে ভয়ের কোনও কারণ নেই। আমার হয়ে যারা কাজ করে আমি তাদের হয়ে লড়াই করি। পারলেন কী বাসব মজুমদার জেলের গরাদে কার্লস জ্যাকলকে বেশিদিন আটকে রাখতে? জেলারের একমাত্র ছেলেকে কিডন্যাপ করতেই সে ফাঁদে পা দিল। কার্লসকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিতেই ফেরত পেয়ে গেল ছেলে।

কাগজে দেখেছিলাম জেলার নাকি সাসপেন্ড হয়েছেন?

সে তো হবেনই। তবে আমরাও ওঁকে এত টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি যাতে আমাদের উপকার করতে গিয়ে খেতে না-পেয়ে মরে না যান উনি। কিন্তু বাসব মজুমদারের ওপর আপনার এত রাগ কেন?

অনেক লোভ দেখিয়েও ওনাকে আমরা বাগে আনতে পারিনি তাই। শুধু বাসব মজুমদার নয়, ওনার সাগরেদ দু’জনও ভয়ানক জেদি। এই লোকগুলোর জন্যে কোনও ডাকাতি রাহাজানিতেই আমরা সাকশেসফুল হতে পারছিলাম না। কার্লস জ্যাকলকে ধরবার জন্য ওনারা খড়্গপুর পর্যন্ত ধাওয়া করেছিলেন। তবে সহ্যশক্তি বটে কার্লসের। পুলিশের মার কী জিনিস তা তো জানো না, সেই মার খেয়েও ও মুখ খোলেনি। ভুলেও বলেনি আমার নাম। তোমাকে অবশ্য এখুনি এত কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। তবে তোমার কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি তুমি পুলিশের স্পাই নও। তা ছাড়া সকলকেই তো সন্দেহ করলে চলে না, কোনও কোনও মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। না হলে দল চলবে কী করে? তোমার অল্প বয়স, তুমি দুঃসাহসী, স্পষ্টবক্তা এবং জেদি। তাই তোমাকে দলে নিলাম।

পিনাকী বলল, কী করতে হবে আমাকে?

তুমি রাইফেল শুটিং জানো? পিস্তল, রিভলভার চালিয়েছে কখনও? না।

শিখে নিতে হবে। তারপর অকারণেই একটু পায়চারি করে বলল, বিয়ে করেছ? বাড়িতে কে কে আছে তোমার?

বিয়ে করিনি। দলে নাম লেখালে করবও না। বাড়িতে বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই আছে।

বোনের বয়স কত?

আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট।

দেখাশোনা চলছে?

হ্যাঁ।

ওর বিয়ের দায়িত্ব আমাদের। ব্যবস্থা করেই জানাবে, সব টাকা আমরা দেব। পিনাকী বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল লোকটির মুখের দিকে।

রহস্যময় লোকটি বলল, বিয়ে যখন করনি তখন ও চেষ্টা আর কোরো না। এখন শুধু দলের হয়েই কাজ করো।

যা আপনি বলবেন।

শোনো, পার্ক স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট আর লালবাজার এই তিনটি এলাকাই আমাদের। লালবাজার অঞ্চলে আমাদের কাজ হল নানারকম ঝুট ঝামেলা পাকিয়ে, উড়ো চিঠি দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করা। আর আচমকা খুন জখম ডাকাতি রাহাজানি করে পুলিশকে খেপিয়ে তোলা। বড় ধরনের দাও মারতে গেলে আমাদের আসরে নামতে হবে ডালহৌসিতে। তুমি যখন ওই এলাকাতেই আছ তখন তোমার ব্যাঙ্কের সমস্ত খবরাখবর তুমি আমাকে দেবে। কেন না ওইটাই হেড অফিস তো। এরপর আমি যখন যেমন নির্দেশ দেব তখন ঠিক তেমনটিই করবে তুমি।

আপনার হুকুম তামিল করতে আমি সব সময়ই প্রস্তুত।

লোকটি এবার ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর বলল, রাত অনেক হল। মংপু! ওকে একটু এগিয়ে দাও।

পিনাকী বলল, প্রয়োজন হবে না। আমি নিজেই যেতে পারব।

মংপু তবুও খানিকটা পথ সঙ্গে এল।

পিনাকী ওর স্কুটারে স্টার্ট দিতেই মংপু বলল, বিদায় দোস্ত। তখনকার ব্যাপারটা নিয়ে যেন মন খারাপ কোরো না। ওটা ভুলে যেয়ো। । মংপু আবার সেই রকম গা জ্বালানো খি খি হাসি হাসল।

পিনাকী হেসে বলল, ব্যথাটা না কমলে কিন্তু ভুলছি না

পিনাকী বিদায় নিল ওর কাছ থেকে। তারপর স্কুটারে চেপে দ্রুত এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে।

ওর গন্তব্য কিন্তু ভবানীপুর নয়।

ও সোজা লালবাজারে এসে দোতলায় উঠে গেল। নীহার তালুকদার এবং রঞ্জন রায় দু’জনেই ছিলেন। কার্লস জ্যাকলের অশুভ আবির্ভাবের ফলে ওঁদের রাতের ঘুম চলে গেছে। তার ওপর বাসব মজুমদারকে এইভাবে হত্যার চেষ্টা। রিয়ার অপহরণ এবং স্বপ্না ও হিরণের অন্তর্ধান ওদের দারুণ ভাবিয়ে তুলেছে। খিদিরপুরে টহলদারি পুলিশের গাড়িতে হামলা আরও একটি দুঃসংবাদ। তাই পুলিশের কাজের ব্যস্ততা সত্যিই চরমে। এর ওপর আছে সমস্ত এলাকার ওপর কড়া নজরদারি। সব সময়েই গভীর উৎকণ্ঠা, কী হয়, কী হয়।

ডালহৌসি পাড়ার একটি নামী ব্যাঙ্কের একজন কর্মচারী হিসেবে নীহারবাবু, সব রঞ্জনবাবু, বাসববাবু এবং আরও অনেক পদস্থ পুলিশ অফিসারের সঙ্গেই যোগাযোগ আছে পিনাকীর। কার্লস জ্যাকলকে ঘিরে কাণ্ড-কারখানাগুলো চলছে তা কারও অজানা নয়, তাই ভিমরুল চাকের খবরটা পুলিশকে দেবার জন্যই পিনাকী ছুটে এল এখানে।

বিস্মিত রঞ্জন রায় জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর পিনাকী! এত রাতে তুমি এখানে?

পিনাকী বলল, আই অ্যাম ইন গ্রেট ডেঞ্জার।

নীহারবাবু বললেন, কেন! হলটা কী? তুমি তো ভবানীপুরে থাক, এত রাতে এখানে কী করে এলে?

সে অনেক কাণ্ড করে এসেছি। ট্রাফিক পুলিশকে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে দিতে। মি. মজুমদার কেমন আছেন?

ভালই আছেন। ওনার ডান পায়ের হাঁটুতে চিড় ধরেছে। প্লাস্টার করে হসপিটাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ওনাকে। উনি বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে হরকিষেণটা মারা গেল এইমাত্র।

হরষিণের হত্যাকারীর সন্ধান আমি পেয়েছি।

পিনাকীকে ঘিরে তখন হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সমস্ত পুলিশ অফিসাররা।

পিনাকী এক এক করে সব কথা খুলে বলল। তারপর বলল, আমি জানি। এরপর ওরা আর আমাকে বাঁচিয়ে রাখব না। তবু খবরটা আমি আপনাদের জানিয়ে দিলাম। কার্লস জ্যাকলকে যিনি পরিচালনা করছেন তিনি এমন একজন…

নীহারবাবু সঙ্গে সঙ্গে খবরটা জানালেন বাসব মজুমদারকে।

ফোন পেয়েই বাসব মজুমদার বললেন, এখুনি তোমরা আমার বাড়িতে একটা গাড়ি পাঠিয়ে দাও। আর শোনো, ভবানীপুর পি এসকে বলে পিনাকীর বাড়ির দিকে সাদা পোশাকের কিছু পুলিশকে নজর রাখতে বলো। একাধিক লোক যেন বাড়ির চারপাশে পাহারায় থাকে।

সে ব্যবস্থা এখুনি করছি। কিন্তু স্যার! আপনি এই অবস্থায় কেন আসবেন? আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। জানো তো, পুলিশের চাকরি বিছানায় শুয়ে থাকবার জন্য নয়। কষ্ট হলেও আমি ঠিকই যেতে পারব।

আচ্ছা স্যার, আমি গাড়ির ব্যবস্থা করছি।

ফোন রেখে আবার রিসিভার তুলে নতুন করে নাম্বার ডায়াল করলেন নীহারবাবু, হ্যালো, ভবানীপুর…