সাত
বাসববাবু টেলিফোনে খবর পেয়েই বাড়ি চলে এলেন। তখন সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। নীহারবাবু, রঞ্জনবাবু এবং আরও কয়েকজন গোয়েন্দা অফিসার সঙ্গে এসেছেন। এসেছে এক গাদা পুলিশ। কয়লা-ঘরের ভেতর থেকে যে ডেড বডিটা উদ্ধার করা হল তাকে হিরণ না চিনলেও সে ছিল সাদা পোশাকের পুলিশ। নীহারবাবু তাকে এই বাড়ির দিকে নজরে রাখার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। সেইমতো সে গোপনে কাজও করছিল। কিন্তু কার্লস জ্যাকলের লোকেরা যে তাকে চিনতে পেরে হঠাৎ অতর্কিতে আক্রমণ করবে তা সে ভাবতেও পারেনি।
বাসববাবু বাড়িতে এসে দেখলেন হিরণ কেমন মনমরা হয়ে বসে আছে। স্ত্রীর জ্ঞান ফিরেছে একটু আগে। ডাক্তারের ওষুধ আর ইঞ্জেকশানের প্রভাবে তিনি এখন স্বাভাবিক। কী থেকে কী যে হয়ে গেল তার কিছুই টের পাননি তিনি। তাঁর ঘুমিয়ে থাকার সময়েই মংপু শয়তানটা একটু বেশিমাত্রায় ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করেছিল তাঁর ওপর। ফলে সেই ঘুম ভাঙতে দেরি হল অনেক।
স্বপ্নার ব্যাপারেও দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে গেছে। কেন না এই বাড়ির নাটকীয় সব ঘটনাগুলোর পরই সে ফিরে এসেছে। আসলে হিরণ ও রিয়ার অন্তরঙ্গ কথাবার্তা শুনে ওর কেবলই নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হচ্ছিল। ওর মনে হচ্ছিল নেহাতই ওকে দলে না রাখলে খারাপ দেখায় তাই বুঝি ওকে চিত্তরঞ্জনে যাবার কথা বলা হচ্ছে। তাই ওর অভিমান হয়েছিল খুব। এবং যদি মা কিছু বলেন তাই ঘরে না-গিয়ে কাছাকাছি ওর এক বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছিল। তখন কি ও ঘুণাক্ষরেও জানত যে ও দরজা খুলে চলে যাবার পরই ওই বাড়িতে অমন একটা রোমহর্ষক ঘটনা হয়ে যাবে বলে? অবশ্য দরজা ও না খুললেও মংপু এ বাড়িতে ঢুকতই। লালবাজার অঞ্চলে সেই ভয়াবহ ডাকাতি ও রাহাজানির কুশীলবদের মধ্যে মংপুও তো একজন ছিল। কলকাতার কুখ্যাত ক্রিমিন্যালদের মধ্যে নৃশংতায় মংপুর নামও ছিল ব্ল্যাক লিস্টের বিশেষ তালিকায়। তা মংপুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও সেই মুঠো ফসকে যাওয়ায় পুলিশমহল ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তবে উৎকণ্ঠা যেটুকু রইল তা হল রিয়ার ব্যাপারে। ওরা যখন ওকে কিডন্যাপ করেছে তখন নিশ্চয়ই অকথ্য অত্যাচার করবে ওর ওপর। তার ওপর মেয়েটার পায়ে গুলি লেগেছে। সেই গুলিতে ক্ষতস্থান কত গভীর বা গুলি বিধে আছে কি না তাও তো দেখা দরকার। গুলি যদি ভেতরে থাকে সেটাকে বারও করতে হবে। কিন্তু এসব করবে কে?
বাসববাবুর আদেশানুযায়ী পুলিশের লোকেরা থানায় খবর পাঠিয়ে যেখানে
যত বদের আখড়া ছিল সর্বত্র তোলপাড় শুরু করে দিল। কেন না পুলিশের কাজের পদ্ধতিই এই, যেখানে দেখিবে ছাই। এইভাবে কাজও হয়। অভাবিত সাফল্য নেমে আসে। এখন কার্লস জ্যাকলের চেয়েও রিয়াকে খুঁজে বার করাটা একান্তভাবে দরকার। পুলিশের কাছে এ এক মস্ত চ্যালেঞ্জ।
স্বপ্নার বাবা বাসব মজুমদারের দুটি হাত ধরে বললেন, দেখুন মশাই! আপনি আমার প্রতিবেশী। পাশাপাশি বাড়িতে থাকি। তাই বলতে দ্বিধা নেই, আমার স্বপ্নার কিছু যে হয়নি এর চেয়ে সুখের আর কিছুই নেই। কিন্তু রিয়া পরের মেয়ে। ওর বাবা-মায়ের কাছে আমি কী করে মুখ দেখাব? আপনি যেভাবেই হোক উদ্ধার করুন ওকে।
বাসববাবু বললেন, আমার দিক থেকে ওই মেয়েটিকে খুঁজে বার করবার ব্যাপারে কোনও ত্রুটিই হবে না। বিশেষ করে ও যখন আমারই বাড়ি থেকে গুম হয়েছে তখন বিরাট দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ তো একটা থেকেই যায়। তা ছাড়া ও বুদ্ধি করে ফুলদানি এনে মংপুকে ঘায়েল না করলে হিরণ একা কিছুই করতে পারত না। অতএব আপনি একটু ধৈর্য ধরুন এবং নিশ্চিত থাকুন।
যদি ওরা ওকে মেরে ফেলে?
না এইরকম কেসে চোদ্দো-পনেরো বছরের একটা মেয়েকে অপহরণ করলে শত্রুপক্ষ তাদের মারে না। বরং মোটা টাকার বিনিময়ে তাকে বিক্রি করে দেয়। সেইরকমটা যাতে হতে না পারে আমি সেই ব্যবস্থাই করছি। ওরা সেই ভুলটাই করতে যাবে এবং ধরা পড়বে।
তবু আমার হাত-পা যেন কাঁপছে। ওর মা-বাবা খবর পেলে কী যে করবে তা ভেবে পাচ্ছি না।
এখুনি ওর মা-বাবাকে খবর দেবার দরকারটা কী?
সে কী! যাদের মেয়েকে হারালাম তাদের একটা খবর দেব না?
না দেবেন না। একটু দেখুন না দু’-একটা দিন।
কিন্তু ওকে কি আমরা সত্যিই ফিরে পাব? মেয়েটার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন? কী সুন্দর মুখ। গায়ের রং দেখেছেন? যেন দুধে-আলতায় গোলা। মেয়ে বড় হচ্ছে। আর হয়তো দু’-চার বছর বাদেই ওর বিয়ে দিতে হবে, এখন এই অবস্থায়…।
মেয়েটাকে আগে উদ্ধার করি। তারপর ওইসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যাবে।
আপনি তো বললেনই মশাই। আপনার তো মেয়ে নেই, থাকলে বুঝতেন মেয়ের বাপেদের জ্বালা কত।
বাসববাবু হেসে বললেন, সব বুঝি আমি। আরে আমার মেয়ে নাই বা থাকল, আমার স্ত্রী তো একজনের মেয়ে। আমার স্বর্গগতা মা-ও তো একজনের মেয়ে ছিলেন। তা ছাড়া ভুলে যাবেন না, আমার কিন্তু একটা ছেলেও আছে। অতএব মেয়েটাকে যদি ফিরে পাই, তা হলে কিন্তু ওর ব্যাপারে সব দায়িত্বই আমার। হিরণের মুখে যা শুনলাম তাতে বুঝতে পেরেছি, মা আমার যা তা মেয়ে নয়। অবশ্যই হিরণই বা আমার কম কীসে? মংপুর মতন ওইরকম একজন ঘোড়েল গুন্ডাকে ওইভাবে কাবু করা কি যা তা কাজ? আমার তো এখনও ওর মুখে শোনা ঘটনাগুলো ছায়াছবির দৃশ্য বলেই মনে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমি কী ভাবছি জানেন? চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এবার বই লেখা শুরু করব। বই লিখবেন?
হ্যাঁ, এই লালবাজারকে নিয়ে, লালবাজারের রাহাজানি নিয়ে, কার্লস জ্যাকলকে নিয়ে, মংপুকে নিয়ে। এই লেখার মধ্যে কোনও গোঁজামিল থাকবে না। একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কাহিনি। কম দেখলাম এ জীবনে? লালবাজারের চৌহদ্দিতেও কখনও পা না দিয়ে কষ্টকল্পিত কাহিনি লিখে পুলিশের ঘাড়ে ব্যর্থতার বোঝা চাপিয়ে শখের গোয়েন্দার বাহাদুরি দেখিয়ে কত লেখক লালে লাল হয়ে গেল। আর আমি লিখলে সে বই চলবে না?
রঞ্জনবাবু বললেন, নিশ্চয়ই চলবে। পুলিশের কাব্য পুলিশে লিখলে ভালই তো হয়। তবে হিরণবাবুর কৃতিত্ব কিন্তু অবিস্মরণীয়। ও যেভাবে মংপুকে ফাঁদে ফেলেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। আমরা হলে বোধহয় এমনটি পারতাম না।
হিরণ এতক্ষণ স্থিরভাবে ওর মায়ের পাশে বসে সব শুনছিল। এবার থাকতে না পেরে বলল, এখন কি এই সব আলোচনার সময়? তা ছাড়া আপনারা পারতেন না, এমন কথা বলছেন কেন? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে কার্লস জ্যাকলের হাতে হাত কড়া তো একদিন আপনারাই পরিয়েছেন। শুধু একটু অসাবধানতার জন্যে লোকটা পালিয়েছে জেল ভেঙে।
নীহারবাবু রঞ্জনবাবুকে বললেন, শুনেছি জেলারকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। মা বললেন, তাতে আর লাভটা কী?
বাসববাবু বললেন, লাভ-লোকসানের ব্যাপার নয়। সরকারি কাজকর্মের একটা বিধিনিষেধ তো আছে।
রঞ্জনবাবু বললেন, আর আমাদের কপালেও আছে অযথা ছুটোছুটি, দৌড়োদৌড়ি। হিরণবাবু যেভাবে মংপুকে কবজা করেছিল, তাতে ওই লোকটাকে নিংড়েই কার্লস জ্যাকলের ঘাঁটিতে হানা দেওয়া যেত।
হিরণ বলল, দেখুন, মংপুকে ধরার মধ্যে সত্য সত্যই আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। ওটা অ্যাকসিডেন্ট। মাথা মোটা মংপু আমাকে নেহাতই ছেলেমানুষ ভেবে সিন ক্রিয়েট করতে গিয়েই ওর বিপদ ডেকে এনেছিল। আমরাও আত্মরক্ষার খাতিরে একটু কৌশল প্রয়োগ করেছিলাম মাত্র। এর বেশি কিছু নয়। তাও তো শেষরক্ষে হল না।
নীহারবাবু বললেন, তোমরা সবই করলে সেই সঙ্গে একটু ভুল করে ফেলেছিলে তোমরা। মংপুর হাত-পা বেঁধে আগেই যদি বাইরের দরজায় খিলটা দিয়ে দিতে তা হলে আর অন্য কেউ ভেতরে ঢুকে ওদের অপহরণ করতে পারত না।
আসলে এই রকম যে ঘটবে তা ভাবতেও পারিনি। তাই মাথার ঠিক ছিল না। রঞ্জনবাবু বললেন, ঠিক আছে, ধরা ওরা পড়বেই। হয় আজ, নয় কাল। তবে আজ থেকেই এই বাড়ির সামনে একদল পুলিশ সদা সতর্ক থাকবে। ,
মা বললেন, এই ব্যবস্থাটা আগে করলে তো এমনটি হত না। মাঝখান থেকে নিরীহ একটা মেয়ে ওদের কবলে পড়ে কোথায় যেন লোপাট হয়ে গেল। খুনও হল একজন। কী দরকার ছিল একা বেচারিকে দিয়ে নজরদারি করবার? ওই দুর্ধর্ষ শত্রুর মোকাবিলা কখনও একা একজনকে দিয়ে হয়? আমার তো মনে পড়লেও গা শিউরে উঠছে।
বাসববাবু বললেন, ভুল যা হবার তা হয়ে গেছে। আসলে ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে তা ভাবতেও পারিনি।
এর পরে আর কোনও কথাবার্তা নয়। বাসববাবু সকলকে নিয়ে একটু চা-পান করেই আবার বিদায় নিলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, ফিরতেও পারি, নাও পারি! আমার জন্য চিন্তা করো না। তোমরা সাবধানে থেকো।
স্বপ্নার বাবাও বিদায় নিলেন।
হিরণ দরজা বন্ধ করে ওর বিছানায় উপুড় হয়ে শুল। কিছু ভাল লাগছে না ওর। রিয়ার জন্য ওর ভীষণ মন কেমন করছে। সত্যি, কী যে করছে মেয়েটা। ওর বদলে যদি ওরা তখন ওকে তুলে নিয়ে যেত তা হলে আর যাই হোক কার্লস জ্যাকলের মুখোমুখি হতে পারত সে।
হিরণ যখন বিছানায় শুয়ে রিয়ার ব্যাপারে নানারকম ভাবছে ঠিক তখনই—। ক্রিরিরিং…। ক্রিরিরিং।
হিরণ উঠে গিয়ে রিসিভার ধরল, হ্যালো।
কার্লস জ্যাকল।
গলাটা গম্ভীর করে হিরণ বলল, বাসব মজুমদার বলছি।
আওয়াজটা একটু অন্যরকম ঠেকছে। খুব রেগে আছেন নিশ্চয়ই তা যাকগে, আমার লোকেরা আপনার ছেলের বদলে কাদের একটা মেয়েকে তুলে নিতে এসেছে। মেয়েটার ভারী মিষ্টি চেহারা কিন্তু। ওর পায়ের গোড়ালির কাছে একটা গুলি লেগেছিল। সেটা ডাক্তার দেখিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। ওর জন্যে চিন্তা করবেন না। আসলে আমার খুব দেখবার ইচ্ছে ছিল আপনার ছেলেকে।
হিরণ বলল, মেয়েটা এখন কোথায়?
কোথায় বলি বলুন তো? এখুনি নিয়ে যাবেন? অবশ্যই।
খুব ভাল হয় তা হলে। কেন না খুন জখম চুরি ডাকাতি রাহাজানি আমি এই সব কাজে সত্যিই আনন্দ পাই। তবে ওই সব ছেলেমেয়ে চুরির ব্যাপারে আমি নেই। তাই বলছিলাম…
কোথায় দেখা করব বলুন?
কে আপনি?
বাসব মজুমদার।
গলা শুনে প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল আমার। বাসব মজুমদার আমাকে ভুলেও কখনও আপনি বলেননি। তুমি নিশ্চয়ই তাঁর সেই সুযোগ্য পুত্র যে কিনা মংপুর মতন একজন কুখ্যাত গুন্ডাকে আর একটু হলেই দিয়েছিল শেষ করে।
হিরণ বলল, হ্যাঁ আমিই সেই।
তুমি নির্ভয়ে চলে এসো। মেয়েটাকে নিয়ে যাও। তুমি এলে ভালই হবে। কেন না তোমাকে একবার দেখবার ইচ্ছে আমার বহু দিনের।
হিরণ হেসে বলল, বলেন কী! আপনাকে দেখবার সাধও আমার কম নয় কিন্তু। হাজার হলেও আপনি আমার বাবার বন্ধু তো?
ওদিক থেকে হা হা করে একটা হাসির সুর শোনা গেল। তারপরই শোনা গেল, তুমি তা হলে এখুনি একবার চলে এসো বাবুঘাটে। আমার গাড়ি তোমার জন্যে ওইখানেই অপেক্ষা করবে। আর হ্যাঁ, কোনওরকম চালাকি করবার যেন চেষ্টা কোরো না।
না। চালাকি কিছু করব না। তবে আশা করি মেয়েটাকে সুস্থ শরীরেই ফেরত পাব।
দেরি না করে চলে এসো।
ওদিক থেকে ফোন নামিয়ে রাখার শব্দ শোনা গেল।
মা হিরণকে টেলিফোনে কথা বলতে শুনে এগিয়ে এলেন এবার, কে ফোন করেছিল রে?
রঞ্জনকাকু।
কী বলছিল?
বলছিলেন বাপি চলে যাওয়ার পর আর কেউ কোনওরকম ঝামেলা পাকাতে এসেছিল কি না।
তুই কিন্তু ঠিক বলছিস না হিরণ। ফোনে অন্যরকম কথাবার্তা শুনছিলাম। তুমি সব তাতেই এত সন্দেহ কর কেন বলো তো মা?
মা বললেন, কী জানি বাবা। ভয় করে।
হিরণ একবার অকারণেই এ-ঘর ও-ঘর করে ছাদে উঠে এল। তারপর আলশের কাছে গিয়ে ডাকল, স্বপ্না। স্বপ্নারে! স্বপ্না উঠে এল ছাদে।
হিরণ চাপা গলায় বলল, একটু আগে একটা ফোন এসেছিল। আবার ফোন!
হ্যাঁ, রিয়ার ব্যাপার! কার্লস জ্যাকল ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলছে। সত্যি!
হ্যাঁ।
কিন্তু কে যাবে? তুমি?
সেইরকমই কথা হয়েছে।
যদি ওরা তোমাকে আটকে দেয়।
সে কী আর না-দেবে ভেবেছিস? তবে মুশকিল হচ্ছে একটাই, আমাদের বাড়ির সামনে যেরকম পুলিশ পাহারা রয়েছে তাতে এখান থেকে বেরোব কী করে তাই ভাবছি।
স্বপ্না বলল, ফোনে কী কী কথা হল শুনি?
হিরণ সব বলল।
শুনে স্বপ্না বলল, তুমি যেয়ো না হিরণদা। ওদের মতলব ভাল নয়। বরং তোমার বাবা এলে সব কথা খুলে বলো তুমি তাঁকে। এমন ভুল কখনও কোরো না।
তা না হয় না করলাম। এদিকে বাপির কানে উঠলে, বাপি যদি অন্য কোনও স্টেপ নিতে যান, তা হলে যে মেয়েটাকেই খুন করে ফেলে দেবে। তখন কী হবে?
তা হলে তুমি যাবে?
হ্যা, আর যদি আমি আজ রাত্রের মধ্যে না-ফিরি, কাল সকালে বাপিকে তুই সব বলবি।
ওরা তোমাকে কোথায় যেতে বলেছে যেন? বাবুঘাটে ?
হ্যাঁ।
তুমি এক কাজ করো হিরণদা, একেবারে তৈরি হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে আমাদের বাড়ি চলে এসো। আর শোনো, আসবার সময় তোমার একস্ট্রা প্যান্টজামা একটা নিয়ে এসো।
প্যান্টজামা কী হবে?
নিয়েই এসো না, এলে সব বলব। আপাতত একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়। তবে পিস্তলটা যেন রেডি থাকে।
ও বুঝেছি। তার মানে তুইও যেতে চাস আমার সঙ্গে?
আঃ। এসোই না তুমি।
স্বপ্নার কথামতো হিরণ বেশ ভালভাবেই তৈরি হয়ে নিল। প্যান্টের হিপ পকেটে ছুরি, পকেটের ভেতর পিস্তল, আলাদা কিছু বুলেট ইত্যাদি। তারপর স্বপ্নার কথামতো এক্সট্রা একটা জামাপ্যান্ট নিয়ে মাকে বলল, মা, আমি একটু সপুদের বাড়ি যাচ্ছি।
ভেতর দিয়ে যা।
তা নয় তো কি এই রাতদুপুরে বাইরে দিয়ে যাব?
স্বপ্না তৈরিই ছিল। হিরণ যেতেই ওকে নিয়ে ওর পড়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। বলল, শোনো হিরণদা, একা তোমার কখনওই যাওয়া চলবে না ওখানে। তোমার জামা প্যান্ট পরে আমিও যাব। আমার একটা প্যারেড করতে যাওয়া টুপি আছে, সেটা পরে থাকলে আমাকে কখনই মেয়ে বলে মনে হবে না। আমরা দু’জনেই যাব। একসঙ্গে নয়, আলাদা আলাদা ভাবে। আমি তোমার হয়ে দেখা করব ওদের সঙ্গে। তোমাদের ব্যাপারে সব কিছুই তো আমি জানি, তাই উত্তরও দিতে পারব যথাযথভাবে। তুমি হবে আমার বডিগার্ড। দূর থেকে সব কিছু লক্ষ করবে, পিছু নেবে, দরকার হলে ফাইট করবে রীতিমতো। একান্ত না পার ফোনে তোমার বাবাকে জানাবে।
হিরণ লাফিয়ে উঠল আনন্দে, দি আইডিয়া। প্ল্যান একটা যা করছিস তা কিন্তু ভারী চমৎকার। এ যে একেবারে পাণ্ডব গোয়েন্দার অভিযান হয়ে গেল। আমরা শুধু পাঁচের বদলে তিন আর পঞ্চ নামের কোনও কুকুর আমাদের সঙ্গে নেই, তফাত এইটুকুই।
স্বপ্না বলল, এইটুকু সময়ের মধ্যে আমি কীভাবে তৈরি হয়েছি জান? এই দেখো।
হিরণ দেখল স্বপ্না ওর কোমরে কাল রঙের কী যেন একটা জড়িয়েছে। কী ওটা?
নাইলনের ফিতে। বিশ ফুটের মতো।
কোথায় পেলি তুই?
কিনে আনলাম। যদি ওরা কোনওভাবে আমাকে চিনে ফেলে বা আটকে রাখে তা হলে এটা হয়তো কাজে লাগবে। আর নিয়েছি আগুন ধরাবার জন্যে একটা সিগারেট লাইটার।
আর?
আর কী নেব? ছুরি, ব্লেড এসব তো আছেই।
হিরণ ওর প্যান্টসার্ট দিলে স্বপ্না সেটা পরে তৈরি হয়ে নিল।
মা ডাকলেন, সপু, খাবি আয়। যাচ্ছি মা।
ঘরে কে রে?
হিরণদার সঙ্গে একটু কথা বলছি।
হিরণ বলল, আমি তা হলে আসি?
স্বপ্না এক চোখ টিপে বলল, হ্যাঁ, এসো।
ওরা দু’জনেই তখন এক এক করে পথে নামল। বাইরে এসে আড়চোখে তাকিয়ে দেখল হিরণ, সেখানে কী দারুণ পুলিশি ব্যবস্থা। ওরা ছায়ান্ধকারে দেওয়ালের গা ঘেঁষে একটু একটু করে এগিয়ে পথের বাঁকে হারিয়ে গেল। তারপর বড় রাস্তায় এসেই একটা ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে উঠে বসল তাতে। ট্যাক্সির ড্রাইভার একজন সর্দারজি। বললেন, কিধার যানা হোগা বাবুসাব? হিরণ বলল, ধরমতল্লা।
ধরমশালা তো নেহি?
হিরণ বলল, কে তুমি?
কাজ। সর্দারজি হাসতে হাসতে বললেন, হুকুমত সিং। হুকুম তামিল করাই আমার হিরণ তখন পকেটে হাত দিয়েছে।
সর্দারজি সামনের আয়নায় সেটা দেখে বুঝতে পেরেই বললেন, ইয়ে বুরা কাম মাত করো ভাই। পিছে দেখো।
হিরণ দেখল ওদের ঠিক পেছনেই একটা ট্যাক্সি ওদেরকে অনুসরণ করে আসছে। আর সেই ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসে আছে দু’জন শক্ত-সমর্থ লোক। দানবের মতো চেহারা। কী ভীষণ। দেখেই বোঝা গেল এরা দু’জনেই হচ্ছে পেশাদার কোনও গুন্ডা। যারা নাকি কার্লস জ্যাকলের হয়ে কাজ করে।
হিরণ বলল, তুমি তা হলে কার্লস জ্যাকলের লোক?
সর্দারজি হেসে বললেন, সন্দেহ আছে না কি?
আমাদের তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
নিয়ে গেলেই দেখতে পাবে।
এটা তো বাবুঘাটের পথ নয়, আমাদের মেয়ে কই? তার কাছেই তো নিয়ে যাচ্ছি তোমাদের।
তোমাদের কথায় বিশ্বাস করে দেখছি ভুল করেছি।
কথার খেলাপ করেই ভুল করেছ। তোমার একা আসবার কথা ছিল, তুমি সঙ্গে একজনকে এনেছ। তোমার সঙ্গে কথা ছিল কোনওরকম চালাকি করবে না কিন্তু, তুমি রিভলভার অথবা পিস্তল যা হোক কিছু একটা বার করতে যাচ্ছিলে। তা হলেই বুঝলে তো কথার খেলাপটা তুমিই করেছ? আসলে পুলিশের লোককে কখনও বিশ্বাস নেই। ওরা হল কেউটে সাপের জাত। আর সেই পুলিশের ছেলে হল সাপের বাচ্চা। তাই শত্রুর শেষ আমরা রাখব না। মেয়েটা মুক্তি পাবে, কিন্তু তুমি পাবে না। আর বাসব মজুমদার…। ওর যা অবস্থা হবে তা শুনলেও তুমি শিউরে উঠবে।
কী করবে আমার বাপির?
‘শোলে’ দেখেছ?
মেট্রোয় দেখেছি, জ্যোতিতে দেখেছি।
গব্বর সিং-এর অভিনয় মনে আছে?
ও কি ভোলবার?
আমরাও গব্বর সিং হয়ে তোমার বাপির দুটো হাতই কেটে নেব। তারপর সেই হাত দুটো লালবাজারের সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়ে এখানকার পাট চুকিয়ে বরাবরের জন্য চলে যাব আমরা।
কোথায় যাবে?
আমাদের লালমহলে।
সেটা আবার কোথায়?
সে এমনই এক দেশ সেখানে লালবাজারের বাসব মজুমদারের দৃষ্টি গিয়ে পৌঁছবে না।
বাপির হাত কেটে নেবে শুনেই হিরণ তখন ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠেছে! ও মুহূর্তের মধ্যে পিস্তলটা বার করে তাইতে গুলি ভরে নিল।
সর্দারজির হাতেও তখন রিভলভার। হিরণের দিকে তাগ করে বলল, খবরদার। কোনওরকম বেয়াদপি করবে তো এখুনি শেষ করে দেব। হিরণ বলল, গাড়ি থামাও। মেয়েটাকে নেমে যেতে দাও। সর্দারজি একটা অশ্রাব্য গালাগালি করল।
পর মুহূর্তেই যা হয়ে গেল তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
স্বপ্না এইসব কথাবার্তার ফাঁকেই কখন যে ওর ছুরিটা বার করে ফেলেছিল কেউ দেখেনি। সে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই ছুরি দিয়ে পেঁচিয়ে দিল সর্দারজির গলাটা। গাড়ি তখন দ্বিতীয় হুগলি সেতুর কাছে এসে ক্যা-ক্যাচ্ করে ব্রেক কষ টার্গেট একটু রং হয়ে গেছে। হয়তো বা বরাতজোের। তাই গলার নলিটা দু ‘ফাঁক না হয়ে তার পাশ থেকেই ঘাড় অব্দি চিরে গেল ভীষণভাবে। রক্তে ভেসে গেল সারা শরীর।
পরক্ষণে অপর ট্যাক্সি থেকে গুন্ডা দু’জন নেমে এসে জাপটে ধরল ওদের। ওরই মধ্যে একজনকে লক্ষ্য করে একটা গুলি করেছে হিরণ। গুলিটা ওর বাঁদিকের কাঁধে গিয়ে লাগল।
আহত লোকটি ডান হাতে বাঁ কাঁধটা চেপে ধরে হিরণকে এক ঝটকায় ফেলে দিল রাস্তার ওপর।
এতেই যথেষ্ট। হিরণের আর নড়বারও শক্তি রইল না।
স্বপ্না ও হিরণকে পেছনের ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে ওরা সকলে যখন দ্রুত সেই পথ ধরে এগোতে লাগল, তখন দেখল পুলিশের একটা টহলদারি জিপ ওদের পিছু নিয়েছে।
হরিণ শিকার করে শিকারিরা যেভাবে মৃত পশুগুলোকে নিয়ে যায়, ওরা ঠিক সেইভাবে স্বপ্না ও হিরণকে নিয়ে চলল।
স্বপ্না তারই মধ্য থেকে চিৎকার করতে লাগল, বাঁচাও বাঁচাও বাঁচাও।
গাড়ি খিদিরপুর পার হতেই জ্যামে আটকাল। ততক্ষণে একটা ট্রাফিক সিগন্যালে ধাক্কা দিয়ে দু’–একজন পথচারীকে চাপা দিয়ে একটা গলির মুখে এসে থামল ট্যাক্সিটা।
পুলিশের গাড়ি অবশ্য অতদূর এল না। আসবেই বা কি করে? ওরই মধ্যে চারদিক থেকে পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমাবৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। কে বা কারা যে একাজ করছে তা কে জানে? হয়তো বা কার্লস জ্যাকলের সংগঠিত শক্তি অথবা অন্য কোনও দুষ্কৃতীর দল পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে বাধা দিচ্ছে। পুলিশের গুলিও হার মানল সেই বোমাতঙ্কের কাছে। কাজেই পিছু হটতে হল তাদের। অনেক পরে যখন সমস্ত এলাকাটা পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে গেল অপারেশন তখন সাকশেসফুল। বাড়ি বাড়ি তল্লাসি চালিয়ে হিরণ এবং স্বপ্নার হদিসও পাওয়া গেল না কোথাও।