লালবাজারে রাহাজানি – ৬

ছয়

স্বপ্না আর রিয়া এল দুপুরবেলা। হিরণ তখন ক্যাসেটে গান শুনছে। আজ খুব জোর খাওয়াদাওয়া হয়েছে। মা ছেলের জন্যে কত কী যে করেছিলেন তার ঠিক নেই। আসলে হিরণ যে আবার ফিরে আসবে তা কেউ ভাবতেও পারেনি। বিশেষ করে বাবা-মা অশুভ আশঙ্কাটাই করেছিলেন বেশি। তাই ছেলেকে ফিরে পেয়ে মায়ের আনন্দের কি শেষ ছিল? ছেলে যা যা খেতে ভালবাসে মা তার সব কিছুই করেছিলেন।

স্বপ্না আর রিয়া ঘরে আসতেই হিরণ উল্লসিত হয়ে বলল, এই ক্যাসেটটা ক’দিন হল কিনেছি। কেমন? ভাল না?

রিয়া বলল, খুব ভাল। তা বলছিলাম কী হিরণদা, তুমি তো গল্পের বইয়ের পোকা। কিন্তু তুমি যে এমন সংগীতরসিক তা তো আগে জানতাম না। হিরণ হেসে বলল, সংগীতরসিক মানে ফিল্মি সংগীতের রসিক, অন্য গানের নয়।

সে যাই হোক, গান গানই। কিন্তু তোমাকে যে বলেছিলাম আমার জন্য বই রাখতে, রেখেছ?

উঁহু। বই তুমি বেছে নেবে। বলেই বুক সেলফের কাছে গিয়ে চাবিটা খুলে বলল, এই দ্যাখো কত বই।

বই দেখে তো অবাক হয়ে গেল রিয়া।

স্বপ্না অবশ্য চোখ কপালে তুলল না। কেন না ও তো সবই জানে। হিরণের কেনা প্রায় সমস্ত বই-ই ওর পড়া।

রিয়া বলল, এত বই তোমার।

এর ভেতর থেকে তোমার যে বই ইচ্ছে

স্বপ্না বলল, পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়।

নাও।

পাণ্ডব গোয়েন্দা আমার সব পড়া। শুকতারায় পড়েছি, আনন্দমেলায় পড়েছি, বই কিনেছি, প্রাইজ পেয়েছি, এক একটা বই দশবার করে পড়েছি। বলেই বইয়ের তাক থেকে দুটো বই টেনে বার করে নিল। একটা হল ‘সেরা রহস্য পঁচিশ’ আর একটা ‘সোনার গণপতি হিরের চোখ’।

স্বপ্না বলল, এই বইদুটো তুমি কবে কিনলে?

এই তো পয়লা বৈশাখে।

স্বপ্না রিয়ার হাত থেকে সোনার গণপতি টেনে নিয়ে পড়তে বসে গেল। রিয়া বলল, তা হলে হিরণদা, যাবার ব্যাপারে আর কোনও দ্বিমত নেই তো? আছে। স্বপ্না না গেলে আমি যাব না।

স্বপ্না বলল, আমি কোন দুঃখে যাব? আমার পেছনে কি কার্লস জ্যাকল ছুরি নিয়ে ঘুরছে?

হিরণ বলল, দ্যাখ স্বপ্না, ঘুসি মেরে তোর পিঠ আমি ভেঙে দেব। একসঙ্গে দু’জনে পাশাপাশি বাড়িতে থাকি। দু’দিন বাদে বদলি হলে কোথায় চলে যাবি তার ঠিক কি? হইহুল্লোড় করবার এখনই তো সময়। এমন মওকা কিন্তু আর আসবে না। তাই বলি এই চান্স ছাড়িস না কিন্তু। তা ছাড়া তুই গেলে ভালই হয়। মনে একটু জোর পাই।

দেখি বাড়িতে বলে। ছাড়ে কি না, দু’-একদিনের জন্য তো নয়।

বেশ তো অসুবিধে থাকে দু’-একদিনই থাকবি। তুমি তো বললে, তারপর দিতে আসবে কে? আমি না হয় পৌঁছে দিয়ে যাব?

স্বপ্না হাসল।

রিয়া বলল, ও না যাক। তুমিই চলো হিরণদা। যাবার আগে একটু গোছগাছ করে নাও। তোমার জামাপ্যান্ট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় যা কিছু সব নিয়ো। তার সঙ্গে এই সব গানের ক্যাসেট আর বাছাই করা খানকতক বই। আমাদের পরিবেশে কিছুদিন থাকলে আর তোমার এখানে আসতে ইচ্ছে করবে না।

হিরণ বলল, তোমাদের ওখানে পাহাড় আছে?

ছোটখাটো টিলা আছে দু’-একটা। তবে পাহাড় আছে কাছাকাছিই। গিরিডি, দেওঘর, শিমুলতলা, চারদিকে পাহাড়। ওখান থেকে বহুদূরে পাহাড়ের রেখা দেখা যায়।

হিরণ বলল, আমি যাব। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। আর এও জেনে রেখো, আমি বেশ তৈরি হয়েই যাব। কার্লস জ্যাকলের ছায়াও যদি ওখানে গিয়ে হাজির হয় তা হলে তাকেও আর ফিরে আসতে হবে না।

রিয়া বলল, মধুপুরে আমার মাসিমার বাড়ি। সেখানে গেলে বাগান দেখবে কাকে বলে। কত যে ফুলগাছ রয়েছে সেখানে, তার যেন শেষ নেই। তুমি আপনমনে ঘুরবে অর আমি লক্ষ করব কেউ তোমাকে টার্গেট করছে কি না। যদি করে তুমি অমনি তাকে ডিস্যুম করে দেবে। আচ্ছা হিরণদা তুমি আমাকে ওটা শিখিয়ে দিতে পারো না? ওই পিস্তল চালানোর ব্যাপারটা।

নিশ্চয়ই পারি। ও এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। পিস্তল চালাতে যে কেউ পারে। তবে বাপি কি ওটা সঙ্গে রাখতে দেবেন?

কেন, দেবেন না কেন? তোমার আত্মরক্ষার জন্য ওটা তো অবশ্যই দেওয়া উচিত।

হিরণ বলল, ও জিনিস কাছে থাকলে আমি যমকেও ডরাই না।

রিয়া বলল, তুমি গেলে আমার বাবা-মা দারুণ খুশি হবেন। কবে যাবে তুমি? যেদিন তুমি নিয়ে যাবে।

তোমার বাবা যদি ছাড়পত্র দেন তা হলে কালই আমি নিয়ে যাব তোমাকে। কাল কখন যাব আমরা?

যখন মনে করবে। সকালে ব্ল্যাকডায়মন্ড ধরে আসানসোলে নেমে আমাদের ওখানে যেতে পারো। যে কোনও লোক্যাল ট্রেনে বর্ধমান হয়েও চিত্তরঞ্জন যাওয়া যায়। একটু বেলায় দশটা নাগাদ তুফান আছে। আর আছে অজস্র গাড়ি।

স্বপ্না তখন একমনে ‘সোনার গণপতি হিরের চোখ’ পড়ছিল। এবার বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে বলল, আর কাকাবাবু যদি মত না দেন?

তা হলে যাব না। অবশ্য সেইসঙ্গে রিয়াবাবুকেও যেতে দেব না। রিয়া তো হেসে গড়িয়ে পড়ল। বলল, কী কাণ্ড! আমি আবার বাবু হলাম কবে থেকে?

আজ থেকেই। চিত্তরঞ্জনে যাওয়া যদি না হয় তা হলে এখন থেকেই তুমি আমার সহকারী হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য তোমার হাতেও একটা পিস্তল যাতে তুলে দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থাও আমি করব। কার্লস জ্যাকল লালবাজারে কী রাহাজানি করেছে, তার ডবল রাহাজানি আমি ওর ওপরেও করব।

রিয়া বলল, সত্যিই তুমি আমাকে পিস্তল ধরাবে?

নিশ্চয়ই। তোমাকে আমি কিশোরী ফুলনদেবী করে ছাড়ব। বাপি রাজি না হলেও নীহারকাকুকে ধরে তোমার আমার জন্যে দুটো পিস্তল আমি জোগাড় করবই।

আনন্দে যেন খুশির বন্যা বয়ে গেল রিয়ার হৃদয়ে। আর স্বপ্না?

হঠাৎ সে বই মুড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আসি রে। তোরা গল্প কর। বলেই দ্রুত চলে গেল ঘর থেকে।

রিয়ার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বলল, কী হল হিরণদা? সপুটা ওইভাবে চলে গেল কেন? মনে হল যেন ওর খুব রাগ হয়েছে?

হিরণ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আসলে ব্যাপারটা কী জানো? ও বোধহয় মনে মনে চায় না, আমি তোমার সঙ্গে তোমাদের ওখানে যাই।

রিয়ার চোখদুটো জলে ভরে এল। বলল, এই যদি হয় তা হলে আর আমার এখানে না থাকাই ভাল। আমি আজই চলে যাব এখান থেকে।

সে কী! আমাকে নিয়ে যাবে না?

তোমার জন্যই তো এত কাণ্ড। তোমাকে নিয়ে গেলেই ওর চোখ টাটাবে। যখন থেকে তোমাকে নিয়ে যাব বলেছি, তখন থেকেই ও উলটোপালটা বকছে। ও এত সেন্টিমেন্টাল তা জানতাম না।

রিয়া এবার ছুটে গিয়ে হিরণের বিছানায় উপুড় হয়ে ওর বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল।

হিরণ বলল, আর কাঁদতে হবে না। আমি কালই যাব তোমাদের বাড়ি। তুমি এক কাজ করো, তোমার মনের মতন কতকগুলো বই আর প্রিয় গানের ক্যাসেট কিছু আমার এই সুটকেসে গুছিয়ে নাও দেখি? বলে একটা চামড়ার সুটকেস এগিয়ে দিল ওর দিকে।

এতক্ষণে কাজ হল। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়াল রিয়া। ওঃ। কী মেয়েরে বাবা। এরই মধ্যে ফর্সা মুখ কেঁদে লাল করে ফেলেছে।

রিয়া সুটকেসটা টেনে নিয়ে বই আর ক্যাসেট গোছাতে গোছাতে বলল, নেহাত তুমি যাচ্ছ তাই। না হলে এখুনি আমি চলে যেতাম। একা তুমি যেতে পারতে?

না পারবার কী আছে? কাল যখন তোমাকে নিয়ে যাব, তখন দেখবে পারি কি না।

হিরণ একদৃষ্টে রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ওর কর্মতৎপরতা। স্বপ্না একটু আগে অভিমান করে চলে গেছে। দরজাটা খোলা আছে তাই। ও সেটা বন্ধ করতে গিয়ে দেখল, মা পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু এ কী! ছাদে ওঠার সিঁড়ির ধাপে পরম নিশ্চিন্তে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা গোঁফ-দাড়ি ভুরুহীন ন্যাড়া মাথা বানরাকৃতি ওই লোকটা কে? চার ফুটের একটুও বেশি হবে না লোকটা। পরণে হাফ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। হিরণের চোখে চোখ পড়তেই কুতকুতে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল লোকটা। কী সাহস! একেবারে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু কী হিংস্র ওর চাহনি। মুখে হাসি, চোখে বিষ।

হিরণ বলল, কে তুমি

লোকটি তেমনই হেসে বলল, বন্ধু। তারপর আবার খিক খিক হাসি। ভয় নেই, ডর নেই। যেন এটা ওর নিজেরই বাড়ি।

ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল হিরণের। বলল, কার হুকুমে তুমি বাড়ির ভেতর ঢুকেছ?

রিয়া তখন দরজার কাছে। ওর দু’চোখে বিস্ময়। বলল, ও কে হিরণদা? জানি না। মাকে একবার ডাকো তো?

লোকটি ধূর্তর হাসি হেসে বলল, মাকে এখন হাজার ডাকলেও উঠবে না। এ ঘুম সহজে ভাঙবে না ভাই।

তার মানে ঘরে ঢুকেই ক্লোরোফর্ম ইউজ করেছ তুমি, তাই না?

লোকটি আবার সেই গা জ্বালানো হাসি হাসতে লাগল।

হিরণ বলল, শয়তান!

লোকটি বলল, কোথায় পালাবার মতলব হচ্ছিল?

সে জেনে তোমার লাভ।

লাভ আছে বইকী ভায়া। তোমার ওপর নজর রাখার ডিউটিই যে আমার। তুমি স্বর্গে গেলেও আমাকে তোমার পিছু পিছু যেতে হবে, আবার নরকে গেলেও তাই।

সেই জন্যেই বুঝি তুমি এখানে এসেছ?

লোকটি ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিক তাই। অনেকক্ষণ ধরেই বাড়ির ভেতর ঢোকবার চেষ্টা করছিলুম। হঠাৎ সুযোগ মিলল। একটি মেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতেই আমিও সুট করে ঢুকে পড়লাম। ভাগ্যে তোমরা দরজায় খিল দাওনি। না হলে কী অসুবিধেই যে হত।

কিন্তু তুমি কি জানো, বাঘের ঘরে ঢুকেছ তুমি?

কই না তো। বাঘের ঘর তো চিড়িয়াখানায়। তা ছাড়া বাঘের ঘরে বাঘের গায়ের বোঁটকা গন্ধ ছাড়ে। এখানে তো মিষ্টি গন্ধ। ফুলদানিতে ফুল। এমন একটি মিষ্টি মেয়ে। কী নাম গো তোমার? মিষ্টি মেয়েটি? ভারী মিষ্টি মিষ্টি গোলাপি গন্ধ ছাড়ছে তোমার গা থেকে।

হিরণ বলল, ওর নাম যাই হোক, তুমি এই মুহূর্তে এখান থেকে বিদেয় হও মি. মাংকি। না হলে ফল কিন্তু ভাল হবে না।

লোকটি হেসে বলল, আরে আমাকে বাঁদরের মতন দেখতে হলে কী হবে, আমার নাম মি. মাংকি নয়। মংপু।

আই সে ইউ গেট আউট।

এত সহজে আমি এখান থেকে যাচ্ছি না ব্রাদার।

যাবে না?

না। আমি যে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি।

ভুল করেছ। তুমি কি করে ভাবলে যে, আমি তোমার মতন একটা কিম্ভুতকিমাকারের সঙ্গে আলাপ করব?

লোকটির চোখদুটো এবার জ্বলে উঠল দপ করে। কঠিন গলায় সে বলল, আমার হাতে সময় খুব কম। আর আলাপ করবার মতো পরিবেশও এটা নয়। আমার গাড়ি আছে। চলো, দু’ বন্ধুতে কাছাকাছি কোনও পার্কে বসে একটু দোস্তি করে আসি।

হিরণ বলল, বেশ, তা হলে একটু দাঁড়াও জামাটা ছেড়ে আসি আমি।

মংপু শয়তানের হাসি হেসে বলল, বেশি দেরি করো না কিন্তু।

রিয়া ভয়ার্ত স্বরে বলল, না তুমি যেয়ো না। যেতে পাবে না। ওর চোখদুটো দেখছ না। ও নিশ্চয়ই কার্লস জ্যাকলের লোক। তোমাকে ও দোস্তি করবার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে না। তোমাকে খুন করবার মতলব নিয়েই ও এসেছে।

হিরণ বলল, আমি জানি। তুমি আর এখানে থেকো না রিয়া। আমার জন্যে তুমিও কেন বিপদে পড়বে। তাই আমি বলি কী, তুমি এখুনি ঘরে যাও। বলেই রিয়াকে ইশারা করল হিরণ।

রিয়া আর কোনও কথা না বলে মাথা হেঁট করে দরজার কাছে যেতেই মংপু বাধা দিল ওকে। বলল, যাচ্ছো কথায় মিষ্টিমুখী। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। আমি ওকে নিয়ে বাইরের দরজায় শিকল দিয়ে চলে গেলে লোকজন ডেকে দরজা খুলিয়ে যা ইচ্ছে করবে। এখন এক-পাও এগোবে না।

হিরণ ততক্ষণে জামা ছাড়বার অছিলায় ঘরে ঢুকেই পিস্তলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। শুধু পিস্তল নয়, গুলিও নিয়েছে একাধিক। যে ভাবেই হোক মনুষ্যরূপী এই মর্কটটাকে খুন না করে ও ছাড়বে না। কিন্তু ট্রিগারে হাত দিয়েই চমকে উঠল ও। দেখল সেই বেঁটেখাটো পিশাচটার হাতেও একটা রিভলভার রয়েছে। সাপের চোখের মতো তাকিয়ে লোকটা এমন হিস হিস করে হাসছে যা দেখে গা জ্বলে গেল। তার ওপরে লোকটা রিয়াকে এমনভাবে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার গায়ে রিভলভারের নলটা ঠেকিয়ে রেখেছে যে কোনও ভাবেই ওকে গুলি করা যাবে না।

হিরণকে আশাহত দেখে মংপু বলল, রং টার্গেট হয়ে গেল বন্ধু। ভেবেছিলে তুমি খুব চালাক, জামা ছাড়বার অছিলায় ঘরে ঢুকে পিস্তলটা বার করে এনে আমাকে সাবাড় করে দেবে। হাতের কাছে ভাগ্যিস মেয়েটা ছিল, না হলে হয়েছিল আর কী। হিরণ বলল, তোমার অনুমান ঠিক। তবে তুমিও দেখছি ধড়িবাজ কম নয়।

মংপু বলল, যদি এই মেয়েটার কোনওরকম ক্ষতি না চাও তা হলে এখুনি ফেলে দাও ওটা।

রিয়া চিৎকার করে বলল, না। কখনও ও কাজ করো না হিরণদা। ও আগে আমাকে ছাড়ুক। তারপর দেবে।

মংপু বলল, ঠিক আছে। আজ হাতে বেশি সময় নেই। আর রিস্কটাও একটু বেশি রকম নেওয়া হয়েছে। আজ এই মিষ্টিটাকেই নিয়ে যাই। কাল তোমাকে নিয়ে যাব। কখন কোথায় তুমি থাকবে সেটা ফোনেই জানাব। বলে রিয়াকে শক্ত করে ধরে এক-পা এক-পা করে পিছু হটতে লাগল মংপু।

হিরণ বললে, ওকে ছেড়ে দাও। ও আমাদের বাড়ির মেয়ে নয়। আমাদের পরিবারেরও কেউ নয়। আমি আজই যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।

পিস্তলটা তা হলে আমার দিকে ছুড়ে দাও।

এর ভেতরে গুলি পোরা আছে মূর্খ। যদি ফসকায় তো আমাদের তিনজন এখুনি দু’জন হয়ে যাব। বলে পিস্তলটা ও মেঝেয় শুইয়ে রাখল।

আর সেই মুহূর্তেই মংপু এক ধাক্কায় রিয়াকে ফেলে দিয়ে বাঁহাতে হিরণের জামার কলারটা ধরে ডান হাতে ওর গালে টেনে একটা চড় মারল। তারপর ওকে শক্ত করে টিপে ধরে ওর নাকে একটা রুমাল চাপাতেই একটুক্ষণ ছটফটানি। পরক্ষণেই সব স্থির।

মংপুর ধাক্কার বেগ সামলাতে না-পেরে দেওয়ালে চোট লেগে মাথাটা ফুলে উঠেছে রিয়ার। যা জোর লেগেছে তাতে ঝিম ঝিম করছে মাথাটা। কী ভাগ্যিস ফেটে যায়নি এই ঢের। কিন্তু এই মুহূর্তে ও যে কী করবে, তা ভেবে পেল না। তবুও বিপদকালে উপস্থিত বুদ্ধিটা হারাল না ও। মেঝের ওপর নামিয়ে রাখা হিরণের পিস্তলটা কুড়িয়ে নিতে গিয়েই বিপত্তি ঘটে গেল। বেঁটে শয়তানটা পা দিয়ে সরিয়ে দিল পিস্তলটা। এত জোরে সরাল যে সেটা সিঁড়ির ধাপে লাগতেই সশব্দে একটা গুলি ছিটকে এসে পায়ে লাগল রিয়ার। রিয়া আর্তনাদ করে উঠল। হিরণ এতক্ষণ অজ্ঞান হওয়ার ভান করে নেতিয়ে পড়েছিল মংপুর কাঁধের ওপর। এইবার দু’হাতে ওর গলা টিপে এমনভাবে ঝুলে পড়ল পেছন দিকে যে, ওর পক্ষে তা শ্বাসরোধকারী হয়ে উঠল।

ততক্ষণে রিয়াও বুঝে গেছে এবার ওকে কী করতে হবে। সে ছুটে ঘরের ভেতর ঢুকে টেবিলের ওপর থেকে ফুলদানিটা পেড়ে এনে সজোরে এক ঘা মাথার ওপর বসিয়ে দিতেই রক্তাক্ত মংপু লুটিয়ে পড়ল মেঝেয়।

রিয়া বলল, হিরণদা তুমি তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে! তুমি কী করে গলায় চাপ দিলে ওর?

হিরণ বলল, ওর হাতের চড় খেয়ে বদনচন্দ্র বিগড়ে গিয়েছিল অবশ্য, তবে যে মুহূর্তে ও আমার নাকে রুমাল চেপে ধরেছিল সেই মুহূর্তে আমি নিশ্বাস বন্ধ করে অজ্ঞান হওয়ার ভান করেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে, আর আমিও ওর সঙ্গে গিয়ে ঘাঁটিটা ওদের দেখে আসব। কিন্তু তোমার পায়ে গুলি লাগায় আর আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। এখন এসো এটাকে দু’জনে মিলে সজোরে বেঁধে ফেলি। তারপর?

তারপর জ্ঞান ফিরলে মারের চোটে ভুবন অন্ধকার করে দেব ওর। কার্লস জ্যাকলের ঘাঁটির সন্ধান ওর কাছ থেকেই পাব। সব জেনে নিয়ে ওরই কাটা মুণ্ডু উপহার পাঠাব কার্লস জ্যাকলকে। ওকে বুঝিয়ে দেব চোরের ওপর বাটপাড়ি কী করে করতে হয়। হিরণ আর একটুও দেরি না করে রিয়ার সাহায্য নিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল মংপুকে।

রিয়া বলল, দেখো হিরণ, এর ওপর বলপ্রয়োগ করতে আর আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। তবে কিনা এর কাটা মুণ্ডু কাউকে উপহার পাঠাবার তো দরকার নেই। যে অপরাধের জন্যে কার্লস জ্যাকল কুখ্যাত হয়েছে সেই একই অপরাধ আমরা কেন করব? তার চেয়ে বরং তোমার বাপির হাতেই তুলে দেব একে। উনি একে জেলের ঘানি টানাবেন।

হিরণ বলল, এদের আটকে রাখবে এমন কোনও জেলখানা এখনও তৈরি হয়নি রিয়া। এদের একমাত্র ওষুধ হচ্ছে একেবারে নাশ করা। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। আপাতত চলো একে কয়লা-ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখি।

সিঁড়ির নীচেই একটা ঘরে ঘুঁটে কয়লা ইত্যাদি রাখা হয়। জ্বালানি গ্যাস কমে গেলে ওগুলোর তো প্রয়োজন, তাই ওরা সেই রক্তাক্ত মংপুর ছোট্ট শরীরটাকে টানতে টানতে সেখানে নিয়ে গিয়ে দরজা খুলেই অবাক। দেখল একটা ডেড বডি কে বা কারা যেন শুইয়ে রেখেছে তার ভেতরে।

শিউরে উঠল হিরণ।

রিয়া চিৎকার করে সভয়ে পিছিয়ে এল। ওর গুলিবিদ্ধ পায়ের যন্ত্রণাও নিমেষের মধ্যে ভুলে গেল যেন। কেমন যেন এক গভীর আতঙ্কে থমথম করে উঠল ওর মুখ। কেন না এই লোকটাকেই তো স্বপ্না আর ও এই বাড়ির দিকে নজর রাখতে দেখেছিল। কিন্তু ওর এমন মর্মান্তিক পরিণতিটা করল কে? এ নিশ্চয়ই মংপুর কাজ?

হিরণ বলল, তুমি এঁকে চেনো?

রিয়া কোনওরকমে ঘাড় নেড়ে হ্যা বলেই বসে পড়ল সেখানে। ও কেমন যেন হয়ে গেল। এমন চটপটে মেয়ে ও কি শেষকালে ভয় পেয়ে গেল?

হিরণ একাই কয়লা-ঘরের ভেতর মংপুকে টেনেহিঁচড়ে ঢুকিয়ে শিকল তুলে দিল দরজায়। তারপর বাথরুমে ঢুকে এক আঁজলা জল এনে ওর চোখেমুখে দিয়ে ছাদে উঠে গেল। দ্রুত আলশের কাছে গিয়ে পাশের বাড়ির দিকে ঝুঁকে পড়ে ডাকল, স্বপ্না! স্বপ্না!

ওর মা উঠে এলেন ছাদে, ও তো তোমাদের বাড়িতে।

আমাদের বাড়ি থেকে অনেকক্ষণ চলে গেছে ও।

সে কী! গেল কোথায় মেয়েটা! বাড়ি আসেনি তো?

দেখুন ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে বোধহয়।

আমি নিজে খিল দিয়েছি। ও এলে দরজা তো আমিই খুলতাম।

তা ছাড়া রিয়াও আছে তোমাদের বাড়ি।

হিরণ বলল, হ্যাঁ, ও আছে। বলে একটু থেমেই হিরণ বলল, আপনি একবার শিগগির আমাদের বাড়ি আসুন। খুব বিপদ হয়ে গেছে আমাদের।

স্বপ্নার মা আতঙ্কিত হয়ে বললেন, কী হয়েছে?

আমার মা অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছেন। রিয়াও কেমন যেন হয়ে গেছে। আর স্বপ্না যখন ঘরে ফেরেনি, তখন সেটাও তো খুব ভয়ের ব্যাপার।

ওমা! সে কী! কী করব আমি? বলেই দ্রুত ছাদ থেকে নেমে চলে এলেন ওদের বাড়ি।

কিন্তু রিয়া কোথায়? ক্লান্ত রিয়া যে কয়লা-ঘরের সামনেই উদাস হয়ে বসে পড়েছিল। কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। এরই মধ্যে কোথায় গেল সে?

হিরণ মায়ের ঘরে ঢুকল। মা তেমনিই শুয়ে আছেন। পাশের ঘরে, মানে যে ঘরে হিরণের সব কিছু থাকে রিয়া সেখানেও নেই। তা হলে? তা হলে কোথায় গেল রিয়া?

স্বপ্নার মা বললেন, রিয়া কই? স্বপ্না কোথায়? কী হয়েছে বলো না বাবা? এখানে এত রক্ত কেন? তোমার মায়ের কী হয়েছে?

এতগুলো কথার উত্তর একসঙ্গে কী করে দেবে হিরণ? ওর মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করতে লাগল। রিয়ার পায়ে গুলি লেগেছে। এই অবস্থায় সে কোথায় যেতে পারে? স্বপ্না! স্বপ্নার কী হল? ও ঘরে ফিরল না কেন?

স্বপ্নার মায়ের হাঁকডাকে ততক্ষণে অন্যান্য প্রতিবেশীরাও ছুটে এসেছেন সবাই মিলে। হিরণের মায়ের চোখেমুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

হিরণের এবার কেমন যেন সন্দেহ হল। সে কোনওরকমে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে কয়লা-ঘরের কাছে এসেই দেখল দরজার শিকল খোলা। এমন তো হবার কথা নয়। সে নিজে শিকল দিয়ে গিয়েছিল দরজায়। তাই সন্দেহটা প্রকট হল। আতঙ্কিত হয়ে চমকে উঠল সে। রিয়া তো নেই। সেইসঙ্গে মংপুও উধাও হল কী করে? শুধু সেই ডেড বডিটা তেমনিই পড়ে আছে ঘরের ভেতর। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে মংপুর পেছনেও লোক ছিল। হয়তো বা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল দূরে কোথাও। পরে দেরি দেখে বাড়িতে আসে, আর ওর ছাদে ওঠার সুযোগ নিয়েই কিডন্যাপ করে রিয়াকে। তারপর রক্তের দাগ দেখেই হোক বা রিয়াকে ভয় দেখিয়েই হোক মংপুকে কয়লা-ঘরের ভেতর থেকে খুঁজে বার করে এবং ওকে নিয়ে যাবার সময় রিয়াকেও সঙ্গে নিতে ভুল করে না।

হিরণ আর একটুও দেরি না করে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নম্বর ডায়াল করল, হ্যালো লালবাজার…হ্যালো…হ্যালো…।