পাঁচ
রিয়া বলল, এর বদলাও তো নিতে পারে ওরা।
তা অবশ্য পারে। কিন্তু ওদের কিছু না করেও আমরা ওদের টার্গেট হয়ে গেছি বলেই অতটা রিস্ক নিয়েছিলাম। বাপি সব সময় আইন মোতাবেক কাজ করেন। কিন্তু তাতে করে আইনের অনেক ফাঁকও থেকে যায়। ফলে ওই সব কালপ্রিটদের সহজে ঢিট করা যায় না। ওদের জন্যে যেমন কুকুর, তেমনি মুগুর হওয়া দরকার। কার্লস জ্যাকলটাকে একটু শিক্ষা দেওয়ার দরকার ছিল। না হলে ও ভেবেছিল যা খুশি তাই করে যাবে।
মা বললেন, এবার তোমাকেও একটু শিক্ষা দেওয়ার দরকার। দিন কতকের জন্যে তোমাকে মামার বাড়িতে না পাঠালে দেখছি চলছে না। রিয়া বলল, ওর মামার বাড়ি কোথায়?
চন্দননগরে।
তাতে আর লাভ কী হবে, একটু দূরে বরং কোথাও সরিয়ে দিন।
দূরে কোথায় পাঠাব? ওর বাবা অবশ্য বলছিল কিছুদিনের জন্যে কাশী চলে যেতে। কিন্তু এখানকার যা অবস্থা তাতে ওর বাবাকে ছেড়ে এক-পাও যেতে আমার মন চাইছে না।
রিয়া উল্লসিত হয়ে বলল, হিরণদাকে তা হলে আমাদের চিত্তরঞ্জনেই নিয়ে যাই না কেন?
স্বপ্না বলল, সেটা হলে কিন্তু মন্দ হয় না। হিরণদাও ওদের জিম্মায় রইল, আর আপনিও কাকাবাবুর দেখাশোনা করতে পারবেন। হিরণদা চিত্তরঞ্জনে থাকলে ইচ্ছামতো ফোনেও যোগাযোগ করতে পারবেন।
মা রিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের ফোন আছে?
আমাদের নেই। তবে পাশের বাড়িতে আছে। ওরা খুব ভাল লোক।
স্বপ্নার মা বললেন, সেই ভাল। হিরণকে ওদের ওখানেই পাঠিয়ে দিন। ওর বাবা এলে আলোচনা করে দেখুন, উনি কী বলেন।
উনি এক কথায় রাজি হয়ে যাবেন। কেন না, উনি মোটেই চান না ছেলেটা এখানে থাকুক। তবে কথাটা যেন পাঁচকান না হয়। না না কেউ জানবে না।
রিয়ার আনন্দ ধরে না। হিরণদাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যাবার আনন্দে অধীর হয়ে উঠল সে। আনন্দের আতিশয্যে বলল, তুমি কিন্তু এই ব্যাপারে গোঁয়ার্তুমি কোরো না যেন।
রণ বলল, চিত্তরঞ্জনে হলে যেতে রাজি আছি। অন্য কোথাও নয়। শুনেছি তোমাদের চিত্তরঞ্জনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নাকি খুব ভাল। মনে মনে ওই জায়গায় বেড়াতে যাবার স্বপ্নও দেখেছি কত।
তুমি যদি যাও, তোমাকে নিয়ে চারদিক ঘুরে বেড়াব আমি। তোমাদের কলকাতার চেয়ে ঢের ভাল জায়গা। এমন দম বন্ধ হয়ে আসে না!
সবই তো বুঝলুম। কিন্তু তুমি এখানে কতদিন পরে এলে, আসতে-না-আসতেই চলে যাবে, তা কি ঠিক? স্বপ্নারা কী ভাববে?
স্বপ্না বলল, তাতে কী হয়েছে। তোমার এমন বিপদ। এই বিপদে যদি কিছু দিনের জন্যে তোমাকে একটু সেল্টার দেওয়া যায় তো মন্দ কি? তা ছাড়া তুমি তো আজই যাচ্ছ না।
রিয়া বলল, সত্যি বলতে কী, এখানে আমার একটুও ভাল লাগে না। স্বপ্নাকে দেখবার খুব ইচ্ছে ছিল, অনেকদিন দেখিনি বলেই এসেছিলাম। এখন দেখাশোনা হয়ে গেছে তাই আজ গেলেও ক্ষতি নেই, কাল গেলেও না।
স্বপ্না বলল, বেশ মেয়ে তুই।
আমাকে ভুল বুঝিস নারে। আসলে কী জানিস, আমাদের বাড়িতে কেউ যাবে বললে আমার খুব আনন্দ হয়। তুইও তো যেতে পারিস আমাদের সঙ্গে। আমি আবার কেন তোদের মাঝখানে বাধা হই!
এটা তোর অভিমানের কথা।
হিরণ বলল, ঠিক আছে বাবা আমি কোথাও যাচ্ছি না। ঘরেই থাকছি আমি। কারও মান-অভিমানের দরকার নেই।
স্বপ্না বলল, মান-অভিমানের কী আছে?
নেই যদি তো বাধা হই কথাটা বললে কেন?
ও এমনি কথার কথা।
রিয়া বলল, মোটেই না। তুই এমনভাবে বললি যেন মনে হচ্ছে তোর হিরণদাকে আমি কেড়ে নিচ্ছি।
সে ভাবে আমি বলিইনি।
তোর কথার তো তাই মানে হয়। হিরণদা আমাদের ওখানে কতদিন থাকবে বল? খুব জোর পনেরো দিন কি একমাস। আরও বেশি হলে আর একটা মাস। তার বেশি তো নয়। তুই হিরণদাকে সব সময় পাবি। পাশাপাশি বাড়ি তোদের। রোজ দেখবি, কথা বলবি, যেখানে খুশি যাবি। আমি দূরে থাকব। কিছুদিন পরে তোরা আমার কথা ভুলেই যাবি।
ওদের রকম দেখে মায়েরা হেসেই অস্থির।
চিত্তরঞ্জনে যাবার প্রসঙ্গ আসতেই হঠাৎ করে যেন আবহাওয়ার মোড়টাই ঘুরে গেল। খুন, জখম, ডাকাতি, রাহাজানি, ফোনাতঙ্ক, কাটা মুণ্ডু, কার্লস জ্যাকল সব উড়ে গেল কোথায়। এক লহমায় নিম্নচাপের ঘূর্ণিঝড়ে যেমন গুমোট গরম কেটে যায়, তেমনিই ঠান্ডা হয়ে গেল আবহাওয়াটা।
মা বললেন, এদিকে মুখে সব বড় বড় কথা। আমরা কি আর ছোটটি আছি? অথচ ঝগড়া করছে দেখো, ঠিক ছেলেমানুষের মতন।
স্বপ্নার মা বললেন, আসলে রিয়াকে ও দারুণ ভালবাসে। ওকে পেয়ে মেয়েটা যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছিল।
রিয়া বলল, সেই জন্যেই তো বলছি ওকেও আমাদের সঙ্গে যেতে। সবাই মিলে বেশ হইচই করে ঘুরে বেড়াব।
মন্দ কী? তবে আমাকে ছেড়ে এক রাতও কখনও থাকেনি ও। যদি থাকতে পারে যাক।
মা বললেন, ওমা, সে কী! বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তা হলে কী করবে? এখন থেকে অভ্যেস করুক।
হিরণ বলল, আপনিও তা হলে সঙ্গে চলুন?
আমি! আমি কী করে যাব বাবা? আমি কখনও হুট করতেই ঘর-সংসার ফেলে রেখে যেতে পারি? আমার যাওয়া হবে না!
রিয়া স্বপ্নাকে বলল, কীরে ! যাবি তুই?
স্বপ্না ছোট্ট করে বলল, দেখি।
হিরণ বলল, দেখি কেন? মায়ের জন্যে মন কেমন করবে? ওই একই প্রবলেম আমারও। তুই তো জানিস, আমিও কখনও মাকে ছেড়ে থাকিনি।
স্বপ্নার মা বললেন, এদিক থেকে রিয়া কিন্তু অন্যরকম। ও সবাইকে ছেড়ে থাকতে পারে। স্কুলের বান্ধবীদের সঙ্গে তো প্রায়ই এখানে ওখানে চলে যায়। একবার তিনদিনের জন্যে গিরিডি যাচ্ছি বলে সেই যে গেল, এক সপ্তা কাটিয়ে এল। ওর মা-বাবা তো ভয়েই মরে। ওর ওসবে হেলদোল নেই।
স্বপ্নার মা এরপর আরও অনেকক্ষণ রইলেন এ বাড়িতে। তারপর চলে গেলেন।
স্বপ্না ও রিয়াও গেল। যাবার সময় হিরণ ওদের দু’জনকেই বলল, দুপুরে এলে যাবে।
কিন্তু খুশি হব। যাওয়ার ব্যাপারে একটা পরিকল্পনা করা
স্বপ্না একটা ভেংচি কাটল।
রিয়া বলল, ভাল দেখে একটা গল্পের বই রাখবেন।
মা বললেন, বেশ মেয়েটি।
হিরণ বলল, কার কথা বলছ মা?
রিয়ার কথা বলছি। মেয়েটা যেমন দেখতে তেমনি মিশুকে। ওর মা-টাও খুব ভাল। এখন দেখি তোর বাবার সঙ্গে কথা বলে, উনি রাজি হন কি না।
রাজি না হবার কী আছে? তুমিই তো বললে বাপি চান আমি কিছুদিন দূরে কোথাও থাকি। সেই হিসেবে চিত্তরঞ্জন কিন্তু আইডিয়াল প্লেস। যাই না, দিনকতক ঘুরেই আসি। তোমরা একটু সাবধানে থেকো।
মা বললেন, থাক, আর পাকামো করতে হবে না। আসলে যা শত্রু পেছনে লেগেছে তাতে ওরা যে চিত্তরঞ্জনেও গিয়ে হাজির হবে না তাই বা কে বলতে পারে? ভয়টা তো সেইজন্যেই। তার ওপরে আজ যা করে এলি তুই—
তবে মা, হাত আমার খুলে গেছে। ফের যদি ওইরকম কিছু দেখি তো সব ক’টাকে শেষ করে দেব।
খুব বাহাদুর। বেঁচে যদি থাকি, তোমাকে তোমার বাবার মতন পুলিশের চাকরি আমি করতে দেব না।
হিরণ হেসে বলল, তুমিও জেনে রেখো, বড় হয়ে চাকরিই যদি আমি করি, তা হলে পুলিশের চাকরিই করব।
পুলিশের চাকরির ওপর তোমার এত দুর্বলতার কারণটা একবার জানতে পারি কি? সরকারি ক্ষমতা হাতে নিয়ে দুর্বল মানুষের মাথায় ডান্ডা মারবার অধিকারটা অর্জন করবে বলে নিশ্চয়ই?
হিরণ বলল, তুমি ভুল বুঝেছ মা। পুলিশের লোক কি সবাই খারাপ? আমার বাপিও তো একজন পদস্থ পুলিশ অফিসার। তাঁর সম্বন্ধেও কি তোমার ওই একই ধারণা? স্বীকার করছি পুলিশের ভেতর অনেক খারাপ লোক আছেন, কিন্তু আমরা জনসাধারণও কি সবাই খুব ভাল? সাধুর দলে কি চোর নেই? কোনও কিছুর মধ্যেই শুধু খারাপ দিকটা দেখো না, ভাল দিকটাও দেখো। একজন ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু’পয়সা ঘুষ খেলে সেই অন্যায়টা তোমরা দেখো, কিন্তু জ্যৈষ্ঠের দুপুরে ‘লু’ মাথায় নিয়ে তার ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার কষ্টটা তোমরা দেখো না।
মা বললন, তুই থামবি? ভাল কাজ করলেও পুলিশের কাজে জীবনের ঝুঁকি কত তা কি তুই জানিস না?
জানি বলেই তো বলছি মা, জনগণের সেবা করবার এত বড় মাধ্যম আর কোন কাজে আছে বলো? তাই, আমি শুধু পুলিশ অফিসার না, পুলিশ কমিশনার হবার স্বপ্ন দেখি। তোমাদের আশীর্বাদে তা যদি হতে পারি, তা হলে দুর্নীতি কী করে দমন করতে হয়, আমি দেখিয়ে দেব।
মা বললেন, কী যে আছে আমার কপালে, তা কে জানে? বলে গৃহকর্মে মন দিলেন।
হিরণও আর কোনও কথা না বলে ওর বহুবার পড়া পাণ্ডব গোয়েন্দার একটা খণ্ড নিয়ে পড়তে শুরু করল। পড়তে পড়তেই মনটা আবার অন্যরকম হয়ে গেল তার। কত কী যে মনে এল, তার আর শেষ নেই। মনে মনে নানারকম ফন্দিফিকিরও আঁটল। তারপর একসময় ঘুম নেমে এল দু’ চোখ জুড়ে।