চার
রাত্রিবেলা ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বাসববাবু স্ত্রীকে বললেন, তোমাদের ভালই জন্যেই এই ব্যবস্থা আমি করছি। বিশেষ করে ছেলেটাকে এখান থেকে সরাতে না পারলে আমার কোনও কাজে মন লাগবে না।
বুঝলাম। কিন্তু এই রাহুর গ্রাসের মুখে তোমাকে একা ফেলে রেখে আমরাই বা যাই কী করে? আমাদেরও কি মন টিকবে? সবই বুঝি! তবে এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। ওই দুর্ধর্ষ শত্রুর মুখোমুখি আমাকে হতেই হবে। ওর বিষদাঁত যদি ওপড়াতে না পারি তা হলে জেনে রেখো জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে কোথাও আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারব না।
তুমি যেখানে পাঠাচ্ছ আমাদের, সেখানেই যে আমরা নিরাপদে থাকব তারই বা প্রমাণ কী?
ওটা স্টেটের বাইরে। তা ছাড়া কাকপক্ষীতেও টের পাবে না কোথায় যাচ্ছ তোমরা। তোমাদের নিরাপত্তার জন্য ওখানেও সাদা পোশাকের নজরদারি পুলিশ থাকবে!
ভুলে যেয়ো না ওর নাম কার্লস জ্যাকল। এই মুহূর্তে আমরা যে কী আলোচনা করছি সেটাও হয়তো সে জানতে পারছে।
সে ভয় করলে আমাকে এখনই হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হয়। জানি বিপদ আমাদের পদে পদে। তবে যতটা পারি সতর্ক থাকি। সাবধানের মার নেই! আজ বাড়ির সামনে ওরা বোমা ছুড়েছে। কাল যে আরও কোনও বড় ধরনের বিস্ফোরণ কিছু ঘটাবে না, তাই বা কে বলতে পারে?
কিন্তু ওই লোকটা কে? ওর পরিচয় কিছু পেলে?
ওর নাম রহমত। মানিকতলার মোড়ে ফল বিক্রি করে। বাড়ি রাজাবাজারের বস্তিতে। লোকটা গুলি খেয়ে পুলিশ হাসপাতালে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কার্লস জ্যাকলের হয়ে কাজ করতে এসেছিল লোকটা।
তা হলে ওকে গুলি করল কে?
বাসববাবু হেসে বললেন, যারা ওকে দিয়ে বোমা ছুড়িয়েছে হয়তো প্রমাণ লোপের জন্য তারাই করেছে এই কাজ। তাড়াতাড়িতে অথবা ধোঁয়ার জন্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলিটা বুকে না-লেগে কোমরে লেগেছে। তুমি গিয়েছিলে পুলিশ-হসপিটালে?
গিয়েছিলাম বইকী। লোকটি কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়বে কতক্ষণ তা কে জানে? তবু পুলিশি জেরার কাছে যেটুকু মুখ খুলেছে তাতেই ওর নাম আর ঠিকানাটা জানা গেছে।
আর ওই লোকটার ব্যাপারে কোনও খোঁজ পেলে? কার কথা বলছ তুমি?
যার কাটা মুণ্ডুটা এনে কার্লস জ্যাকল উপহার দিয়েছিল তোমাদের।
হ্যাঁ। কালীঘাট স্টেশনের কাছে আজ ভোরের দিকে একজন লোক ট্রেনে কাটা পড়ে। তার মুণ্ডুটা পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ধড়টা পড়েছিল লাইনের ধারে। এমন সময় পাশের ঘর থেকে হিরণ এসে দরজার কাছে দাঁড়াল। বলল, বাপি, লোকটা কাটা পড়েছে ঠিকই। এমনও তো হতে পারে লোকটাকে কেউ মেরে লাইনের ওপর ফেলে রেখেছে। না হলে কার্লস জ্যাকল সঙ্গে সঙ্গে নরমুণ্ডু পায় কী করে? ধড়ের সঙ্গে মুণ্ডুটা কি মিলিয়ে দেখেছ তোমরা?
দেখেছি। আর সেই জন্যই তো পোস্টমর্টমের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রিপোর্ট এলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা আসলে কী? তবে ইতিমধ্যে মৃত-র বাড়ির লোকেরাও সনাক্ত করছে দেহটিকে। এই লোকটি যে খুন হতে পারে, এমন সন্দেহ ওর বাড়ির লোকেদেরও কারও হয়নি। এমনকী মৃতের পকেটে আত্মহত্যার কারণ সম্বন্ধে কোনও চিঠিপত্তরও ছিল না। অতএব ধরা যেতে পারে কার্লস জ্যাকলের লোকেরা খেলাচ্ছলেই ঠান্ডামাথায় খুন করেছে লোকটিকে।
কিন্তু এত লোক থাকতে ওই লোকটাকেই বা বেছে নিল কেন কার্লস জ্যাকল?
যাকে হোক একজনকে নিতে তো হতই। হয়তো এই লোকটির ওপর পুরনো কোনও কিছুর হিস্যা নিয়েছে। লোকটা কোর্টের মুহুরি ছিল।
না। লোকটি খুন হয়েছে রবিবার ভোরে। সেই সময় নিশ্চয়ই কোর্ট খোলা ছিল বাসববাবু বললেন, তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করি। উনি একটা কাজে শিয়ালদহ হয়ে বনগাঁ যাবার জন্যে স্টেশনে আসছিলেন। শর্টকাট করবার জন্য রেলপথ ধরেই হাঁটছিলেন ! আর কোনও প্রশ্ন কোরো না। এবার শুয়ে পড়ো। কালই আমি এখান থেকে সরিয়ে দেব তোমাদের!
হিরণ বলল, আমরা তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।
তোমার ভালর জন্যেই বলছি বাবা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো রাত বারোটা। যাও শুয়ে পড়ো।
হিরণ আর কোনও কথা না বলে নিজের বিছানায় এসে শুল। শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে এপাশ ওপাশ করেও যখন ঘুম ধরে না, তখন এক সময় উঠে বসল। তারপর ছাদের সিঁড়ি বেয়ে এক-পা এক-পা করে উঠে গেল ওপরে। খোলা আকাশের বুকে নক্ষত্রমালার দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে গেল সে।
অসংখ্য চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। পরিস্থিতি ক্রমশ এমনই জটিল হয়ে উঠছে যে, কোনও কিছুই আর স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না! কার্লস জ্যাকল থাবা বাড়িয়েছে যখন, শিকার না-নিয়ে সে পিছু হটবে না। বাপি অত্যন্ত ভালমানুষ। মানুষকে কত সহজে বিশ্বাস করেন। উনি কি পারবেন এই শয়তানের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে? নাকি কার্লসের প্রথম শিকার ও নিজে? রহমত নামের লোকটা প্রকাশ্য দিবালোকে ওদের বাড়ির সামনে বোমা ছুড়তে এল কেন? লোকটা চাইছিল কী? প্যানিক সৃষ্টি করতে? না অপহরণ করতে? ও যদি কার্লস জ্যাকলেরই হয়ে কাজ করতে এসে থাকে তা হলে ওকে গুলিটা করল কে? বাপি ওদের দূরে সরিয়ে দিতে চাইছেন, হয়তো ভালই জন্যই। কিন্তু দূরে গিয়ে বাপির চিন্তায় গুমরে গুমরে মরার মতো কষ্টকর আর কিছু কি আছে। বাপিকে একা পেয়ে সত্যিই যদি কিছু করে ওরা।
হিরণ কতক্ষণ যে নিজের মনে এইসব চিন্তা করল, তার ঠিক নেই। তারপর এক সময় ভাবল, মৃত্যু যখন শিয়রে, জীবনের যখন কিছুমাত্র নিশ্চয়তা নেই, তখন ওই কার্লস জ্যাকলের মুখোমুখি সে নিজেও কি হতে পারে না? আর সেইজন্য ওকে এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে। কারও কোনও বাধা আর ও মানবে না। কাল থেকে ও নিয়মিতই স্কুলে যাবে। কখনও একা, কখনও বা বন্ধুদের সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে। আর সেই সময় কার্লস জ্যাকল যদি ওর দিকে থাবা বাড়ায় তা হলে—।
মতলবটা মাথায় আসা মাত্রই ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল ও। বাপির ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। বাপি তখন ঘুমোচ্ছেন। ঘরের ভেতর ডিম লাইটটা জ্বলছে। ও পা টিপে ঘরে ঢুকল।
তারপর—?
সকালবেলা স্ত্রীর কান্নাকাটিতে ঘুম ভেঙে গেল বাসববাবুর। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললেন, কী ব্যাপার! হয়েছেটা কী?
সর্বনাশ হয়ে গেছে। হিরণকে কোথাও দেখছি না।
সে কী! গেল কোথায় সে?
জানি না, শুধু দেখছি সে নেই।
পাশের বাড়ির স্বপ্নাকে জিজ্ঞেস করেছ? যদি ওদের বাড়িতে গিয়ে থাকে? তুমি যে বললে ওর মামাতো বোন না কে যেন এসেছে?
করেছি। ওদের বাড়িতেও নেই। মেয়েদুটো তো ছাদেই ঘুরছে দেখলাম।
তা হলে তো ভয়ের ব্যাপার। দুশ্চিন্তার কালো মেঘ একটা ঘনিয়ে এল বাসববাবুর মুখে। উনি নিজেও তন্ন তন্ন করে চারদিক খুঁজলেন। হঠাৎ এক সময় বললেন, ছেলেটাকে কেউ এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়নি, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত।
কী করে বুঝলে?
ও বাসি জামাপ্যান্ট ছেড়ে অন্যটা পরেছে। জুতোও পরেছে দেখতে পাচ্ছি। কাজেই কেউ ওকে নিয়ে গেলে নিশ্চয়ই জামাজোড়া পরিয়ে নিয়ে যেত না। তার মানে ও নিজে থেকেই কোথাও গেছে। হয়তো ফিরতে দেরি হবে। অথবা বাইরে বেরিয়েই বিপদে পড়েছে।
কী হবে তা হলে?
কখন গেছে, কীভাবে গেছে, কেন গেছে, এইসব না জেনে তো কিছু বলা যাবে না। আপাতত আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
এমন সময় হঠাৎ কী দেখে যেন বাসববাবু এগিয়ে গেলেন টেবিলের দিকে। দেখলেন ড্রয়ারটা ঠিকমতো বন্ধ হয়নি। কেউ যেন খুলেছিল ওটা। তারপর ঠিকভাবে না—এঁটেই চলে গেছে। এমনকী চাবিটাও সরিয়ে রাখতে ভুলে গেছে সে। চাবিটা লাগানোই ছিল। বাসববাবু ড্রয়ারটা খুলেই অবাক। ভেতরের জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন। কী যেন না-পেয়ে অস্ফুট উচ্চারণ করলেন, স্ট্রেঞ্জ!
মা বললেন, কী হল! কী দেখলে তুমি?
বাসববাবু সে কথার উত্তর না দিয়ে টেলিফোনের নম্বর ডায়াল করে কথা বললেন নীহারবাবুর সঙ্গে
ওদিক থেকে সাড়া আসতেই বললেন, ভাই! খুব একটা যা তা কাণ্ড হয়ে গেছে। ছেলেটাকে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পাচ্ছি না। আর সেই সঙ্গে খুঁজে পাচ্ছি না একটা মূল্যবান জিনিস।
কী জিনিস?
একটা পিস্তল।
সর্বনাশ। পিস্তল শুটিং জানে ও?
শুধু জানে বললে ভুল বলা হবে। অব্যর্থ টিপ ওর। কিন্তু এটা ও কেন নিল তা ভেবে পাচ্ছি না।
মনে হয় কাউকে ও ফলো করেছে।
তা যদি হয় তা হলে তো ভয়ের ব্যাপার। একেবারে শিকারির মুখেই গিয়ে শিকার হয়ে ধরা দেবে।
ওদিক থেকে উত্তর এল, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। আমি ওর খোঁজে লোক লাগাচ্ছি।
বাসববাবু ফোন রেখে হিরণের ঘরে ঢুকে বইপত্তর ঘেঁটে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলেন যদি কোথাও একটুকু চিরকুটও রেখে দিয়ে থাকে ও। কিন্তু না। সেইসব কিছুই পেলেন না তিনি।
এমন সময় স্বপ্না আর রিয়া এসে ঘরে ঢুকল, হিরণদা ফিরেছে কাকিমা? না না। কোথায় যে গেল ছেলেটা কে জানে?
স্বপ্না বলল, ও পাড়ার বংশীদার সঙ্গে বাবার দেখা হয়েছে। বাবা বংশীদার মুখে শুনেছেন হিরণদা নাকি ভোরবেলা খুব জোরে হেঁটে কোনদিকে যাচ্ছিল। এটাকে মর্নিং ওয়াক ভেবে হিরণদাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
বাসববাবু বললেন, দেখলে তো, আমার ধারণাটা ভুল নয়। কিন্তু এইভাবে কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেল ও? কোথায় যেতে পারে? কেনই বা গেল? মা বললেন, কাল সারাদিন ও ঘর থেকে বেরোয়নি। চুপচাপ শুয়ে-বসে ছিল। ছাদে বসে বই পড়ছিল।
বাসববাবু বললেন, অনবরত গল্পের বই পড়ে পড়ে এই রকমটা হয়েছে ওর। যত্ত সব গাঁজাখুরি গল্প পড়েই মাথাটা গেছে। এখন নিজেকেই ও একজন হিরো ভেবে নিয়েছে। আর সেই ভেবেই পিস্তলটা নিয়ে কোনও কিছুর মোকাবিলা করতে গেছে নির্ঘাত।
রিয়া বলল, তা কেন, হিরণদা ওটা আত্মরক্ষার জন্যও তো কাছে রাখতে পারে।
স্বপ্না বলল, তা অবশ্য পারে। কিন্তু এইভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরোবার দরকারটা কী ছিল। জানে তো বাড়িতে ভাববে।
মা বললেন, উঃ। কী সাংঘাতিক ছেলে। কী যে করি আমি। বাসববাবু বললেন, কী আর করবে? বসে বসে কপাল চাপড়াও।
স্বপ্না আর রিয়া দু’জনেই তখন হিরণের শোবার ঘরে ঢুকে ওর বইপত্তর ঘেঁটে কাগজপত্তর খুলে দেখতে লাগল কোথাও কোনও চিরকূট বা ওই জাতীয় কোনও চিঠিপত্তর কিছু রেখে গেছে কি না। ওরাও হতাশ হল। ব্যাপারটা বেশ রহস্যময় বলেই মনে হল ওদের কাছেও। ওরা এ-ঘর ও-ঘর করে ছাদে উঠল। ছাদে উঠে এদিক সেদিক করে তাকিয়েই ওরা দেখল মোড়ের মাথায় একজন লোক দাঁড়িয়ে লক্ষ করছে বাড়িটার দিকে।
রিয়া স্বপ্নাকে বলল, দেখেছিস সপু, লোকটা কেমন বাড়িটার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে?
স্বপ্না বলল, আরে তাই তো! মনে হচ্ছে কোনও মতলব আছে ওর। শুধু তাই নয়, আমরা যে ওকে দেখছি সেটা টের পেয়েই ও চোখ নামিয়ে অন্য কোনও কিছুর দিকে মন দিচ্ছে।
তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে কেমন পটলচেরা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখছে দেখ। চল তো নীচে গিয়ে লোকটাকে একটু চেজ করি।
ওরা যখন নীচে নেমে এল তখন দেখল বাসববাবু ইউনিফর্ম পরে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। ওরা একবার ভাবল বাসববাবুকে লোকটির কথা বলে। কিন্তু তা না বলেই বাইরে এল ওরা। তারপর দ্রুত পায়ে মোড়ের মাথায় এগিয়ে গেল। গিয়ে দেখল কোথায় কে? সেই বিশেষ লোকটির চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।
স্বপ্না বলল, অবাক কাণ্ড তো?
রিয়া বলল, মোটেই অবাক কাণ্ড নয়। লোকটা আসলে বুঝতে পেরেছে আমরা ওর মতলব বুঝে ফেলেছি। তাই আমরা ছাদ থেকে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই গা ঢাকা দিয়েছে।
আমার মনে হয় ব্যাপারটা কাকাবাবুকে একটু জানিয়ে রাখা ভাল।
কী হবে জানিয়ে? একেই ছেলের জন্যে ওঁর মন খারাপ তার ওপরে এইসব শুনিয়ে ওনাকে বিব্রত করে লাভ কি?
ওরা আবার যখন ফিরে এল বাসববাবু তখন একদৃষ্টে সেদিনকার খবরের কাগজের হেডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। এক জায়গায় বড় বড় হরফে লেখা আছে, আবার কার্লস জ্যাকল! অপরাধজগতের কুখ্যাত নায়ক এখন কলকাতায়। জেলপলাতক কার্লস জ্যাকলের নতুন শিকার একজন নিরীহ নাগরিক। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে গোয়েন্দা হানা।
স্বপ্না আর রিয়া দু’জনেই এসে কাকাবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল।
বাসববাবু স্বপ্না বলল, একজন লোক অনেকক্ষণ থেকে এই বাড়িটার দিকে নজর রাখছিল। আমরা ছাদ থেকে নেমে লোকটাকে ধরব বলে যেই গেলাম, অমনি দেখি লোকটা ভ্যানিস হয়ে গেছে।
কাগজের পাতা থেকে চোখ তুলে বললেন, কিছু বলবি মা?
কতক্ষণ আগে?
এই তো। এইমাত্র।
লোকটাকে কী রকম দেখতে বলো তো?
ওরা দু’জনেই চেহারার বর্ণনা দিল।
বাসববাবু বললেন, লোকটাকে আবার কখনও দেখলে আমাকে জানাবি। কথা বলতে বলতেই অফিসের গাড়ি এসে গেল। বাসববাবু রিয়া আর স্বপ্নাকে বললেন, তোমাদের কাকিমাকে একটু দেখো। আর ছেলেটা যদি ফিরে আসে আমাকে একটা ফোন কোরো কেমন? কাকিমার কাছ থেকে নাম্বারটা জেনে নিয়ো।
স্বপ্না বলল, আজ কি আপনার না গেলেই নয়?
বাসববাবু বললেন, আজই তো আমি বেরোব মা। লেটা যদি কোনও বদ লোকের খপ্পরে পড়ে থাকে তা হলে সেখান থেকে ওকে উদ্ধার করে আনতে হবে তো।
অবশ্যই। আপনি যান, আমরা দেখছি কাকিমাকে।
বাসববাবু যাবার জন্যে যে মুহূর্তে এক পা এগিয়েছেন অমনি নীহারবাবু এসে হাজির। বললেন, এবার বোধহয় চাকরিটা ছেড়ে দিতে হল স্যার।
বাসববাবু মুখ কালো করে বললেন, কেন কী হল আবার? কার্লস জ্যাকলের কাছে আমরা হেরে গেলাম।
আবার নতুন কিছু?
হ্যাঁ, অত প্রহরা সত্ত্বেও আমার বাড়ির বাথরুমের ভেতর থেকে – একটা কাটা মুণ্ড উপহার পেয়েছ। এই তো?
ঠিক তাই।
এবং তার কপালে পিনআঁটা কাগজে তোমার নামও লেখা আছে। ভয়ে আমার বুক কাঁপছে স্যার।
ভয়ে পেয়ো না। সাহসে বুক বেঁধে এগিয়ে এসো, দেখবে ভয় কেটে গেছে। তা ছাড়া এখন ভয়কে জয় না করলে সমূহ বিপদ। আমাদের জীবনই এই। লোকে তো বোঝে না, তারা ভাবে গোয়েন্দাদের হাতে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ আছে। তাই দিয়েই তারা গল্পের গোয়েন্দাদের মতো অপরাধীদের পটাপট ধরে ফেলবে। আমরা যে কত অসহায়, কী কঠিন মূল্য যে দিতে হয় আমাদের, তা কে বোঝে? কাজেই সমস্ত সংশয় মন থেকে দূরে সরিয়ে নির্ভয়ে এগিয়ে এসো।
নীহারবাবু বললেন, আরও খারাপ খবর আছে। আমার হিরণকেও ওরা…।
না না, তা নয়। একটু আগে পুলিশ-হাসপাতালে ঢুকে রহমতকে ওরা শেষ করে দিয়ে গেছে।
বাসববাবু রেগে বললেন, ওখানে ওরা ঢোকে কী করে? সিকিউরিটি কী করছিল?
পুলিশের দু’জন লোক পাহারায় ছিল। একজন বাথরুমে গেলে অপরজনকে ওরা কবজা করে ভেতরে ঢোকে। দলে ওরা তিনজন ছিল। সেই তিনজনের একজন অবশ্য এক অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছে। পিছনদিক থেকে কেউ যেন গুলি করেছে তাকে।
লোকটাকে চিনতে পেরেছে?
না। তবে চেহারা দেখে মনে হয় পেশাদার খুনে একজন। ডেড বডি মর্গে পাঠানো হয়েছে?
যথারীতি।
এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠতেই বাসববাবু রিসিভার তুলে বললেন, হ্যালো, মি. মজুমদার বলছি।
ওদিক থেকে উত্তর এল, গুড মর্নিং।
গলাটা খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
সে তো চিনবেনই। আমি যে আপনার পুরাতন বন্ধু। কার্লস জ্যাকল!
ঠিক ধরেছেন। নীহারবাবু আপনার ওখানেই আছেন নিশ্চয়। আর খুব ভয় পেয়ে গেছেন। আমার লোক যে একেবারে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়বে এটা উনি ভাবতেও পারেননি। আসলে এও এক ধরনের খেলা। বুঝলেন কিনা, চোর-পুলিশ খেলা যাকে বলে। আজকের কাগজ দেখেছেন? কী সব কেচ্ছা-কেলেঙ্কারিগুলো ছাপা হয়েছে আপনাদের?
রাগে বাসববাবুর মুখ দিয়ে একটা খারাপ কথা বেরিয়ে এল। ওদিক থেকে উত্তর এল, আপনি কিন্তু বড় বেশি রেগে যাচ্ছেন। আসলে আমি এখন চাইছি আপনার সঙ্গে আমার একটা দোস্তির সম্পর্ক গড়ে তুলতে। আসুন না আমার এখানে, একটু পায়ের ধুলো দিয়ে যান। তবে যাই বলুন না কেন, ছেলেটাকে কিন্তু খাসা তৈরি করেছেন। ওই রকম একটা ছেলে আমার খুব দরকার।
ছেলেটা কোথায়?
যাঃ বাব্বা। তা আমি কী করে জানব?
তুমি সব জানো শয়তান।
আপনি অকারণে এইসব যা তা বলছেন আমাকে। তাই তো বলছি একবার একটু পায়ের ধুলো দিন। আজ দুপুরে একটা দেড়টা নাগাদ বাবুঘাটে আসুন। অবশ্যই নিরস্ত্র এবং পুলিশবাহিনী না নিয়ে। আমার লোক সসম্মানে সেখান থেকে নিয়ে আসবে আপনাকে।
বাসববাবু ফোন রেখে নীহারবাবুকে সব বললেন। তারপর বললেন, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবে নাকি?
প্রশ্নই ওঠে না।
বাসববাবু বললেন, আমার এখন মনে হচ্ছে কী জান? ওর দলের লোকই বোধহয় এখন ওর পেছনে লেগেছে। না হলে কাল আমার বাড়ির সামনে রহমত বোমা ফাটাতে এলে ওকে গুলিই বা করল কে, আর আজ ওকে যারা হত্যা করতে এল তাদেরও একজনকে সরিয়ে দিল কে? কে করেছে এই কাজ? আমার মনে হয় একই লোকের কাজ এটা।
নীহারবাবু বললেন, না। রহমতকে গুলি করেছে আমারই পাঠানো একজন লোক। সে সব সময় আপনার বাড়ির দিকে গোপনে নজর রাখত। আপনার অনুমতি না নিয়েই আমি তাকে নিযুক্ত করেছিলাম এই কাজে। ওর উচিত ছিল রহমতকে গুলি না করে হাতেনাতে ধরা। হয়তো বা বোমার শব্দে উত্তেজিত হয়েই গুলি করেছে। আর সেই রাগেই সম্ভবত কার্লস জ্যাকল আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে একটা কাটা মুণ্ডু উপহার পাঠিয়েছে কাউকে দিয়ে। তবে যাই হোক, লোকটার কিন্তু হিম্মত আছে। কিন্তু আজকের ঘটনার নেপথ্যে যে কে আছে তা কে জানে?
নীহারবাবুর কথা বলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হিরণ এসে ঘরে ঢুকল। বলল, আমি জানি।
বাসববাবু ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। মা ছুটে এসে ধরলেন হিরণকে। স্বপ্না আর রিয়া ভর্ৎসনার সুরে বলল, তুমি কী বলো তো হিরণদা? এইভাবে না বলে কেউ যায়? একটা চিঠি অন্তত লিখে রেখে যাবে তো?
হিরণ বলল, আরে বাবা, আমি তো একেবারেই চলে যাব বলে যাইনি। কাজেই চিঠি লেখার প্রশ্ন ওঠে না।
বাসববাবু বললেন, তোমার জন্যে আমরা কত ভাবছিলাম জানো? এখন তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই কে গুলি করেছে লোকটাকে। হিরণ বলল, আমি।
তুমি গুলি করেছ?
হ্যাঁ। আমি ওকে গুলি করেছি। আমি তো তোমারই ছেলে, কাজেই তোমার কোনও কাজে সহযোগিতা করবার অধিকার আমার নিশ্চয়ই আছে?
আছে। কিন্তু এ যে আগুন নিয়ে খেলা। এই চক্র বড়ই সাংঘাতিক। আমাদের এই পুলিশবাহিনী এক প্রচণ্ড সংগঠিত শক্তি। শয়তানের মারপ্যাচে আমরাই যেখানে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। সেইখানে কিনা তুমি গিয়ে ওদের ক্রোধানলে ঘি দিয়ে এলে?
মা বললেন, যাবার আগে তোর কি উচিত ছিল না বাড়িতে বলে যাওয়া? বললে কি তোমরা যেতে দিতে?
বাসববাবু বললেন, ঠিক ওই সময়েই পুলিশ-হসপিটালে তুমিই বা গিয়ে হাজির হলে কী করে?
এটা একটা মিরাক্যাল বলা যেতে পারে। কাল রাত থেকেই আমার মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড ঝড় তোলপাড় করছিল। আর এও বুঝতে পারছিলাম তোমার সঙ্গে শত্রুতা মানেই ওদের টার্গেট আমিও। এবং সেইজন্যেই তুমি আমায় ঘর থেকে বেরোতে দিচ্ছ না। আজ হোক, কাল হোক, ওদের খপ্পরে পড়তে আমাকে হতই। আমাকে মেরে অথবা কিডন্যাপ করেই ওরা প্রতিশোধ নিত। তাই মরবার আগে ওদেরও একটা মরণকামড় আমি দিতে চেয়েছিলাম। কাল রাতে চুপি চুপি তোমার ঘরে ঢুকে সরিয়েছিলাম পিস্তলটা। তারপর ভোরবেলা ওটা সঙ্গে নিয়েই পথে বেরিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল ওদের সতর্ক চোখ এই বাড়ির দিকে সব সময় তাকিয়ে থাকবে। তাই আমি বাইরে বেরোলেই আমাকে কিডন্যাপ করতে এগিয়ে আসবে ওরা। কিন্তু অনেকক্ষণ পথ চলার পরও যখন তেমন সন্দেহজনক কাউকে আমার পিছু নিতে দেখলাম না, তখন কেন জানি না, আমার মনে হল একবার রহমতের সঙ্গে দেখা করে আসি। যদি ওর মুখ থেকে কার্লস জ্যাকলের কোনও ঠিকানা আদায় করতে পারি, তা হলে যেভাবেই হোক লুকিয়ে ওকে খতম করে আসব।
হিরণের কথায় শিউরে উঠল সকলে।
মা বললেন, তার মানে নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনবে।
হিরণ বলল, আমি যখন জানতে পেরেছি আমরা এখন কার্লস জ্যাকলের শিকার, তখন এই কাজ কেন করব না বলো? প্যাঁচার মতো ওর ভয়ে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা বা পালিয়ে বেড়ানোর চেয়ে ওর সঙ্গে সংঘর্ষের পথেই চলে যাওয়াটা ঠিক নয় কি?
বাসববাবু হিরণের পিঠ চাপড়ে বললেন, আমার ছেলের উপযুক্ত কথাই তুমি বলেছ। কিন্তু ব্যাপারটা কী জানো? কার্লস জ্যাকল সাধারণ ক্রিমিন্যাল নয়। ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবার আগেই ও তোমাকে শেষ করে দেবে।
হিরণ বলল, বেশ, তুমি তা হলে আমার স্কুলের নাম কেটে দিয়ে এসো, আমি আজ থেকেই আর ঘরের বাইরে যাব না। নন্দলাল হয়ে চুপ করে বসে থাকব।
মা বললেন, হ্যাঁ তাই করবে। আমি সব সময়ে তোমাকে চাবি দিয়ে রাখব ঘরের ভেতর। ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাবার বয়স তোমার হোক, তখন যা-ইচ্ছে করবে, এখন নয়।
আমার প্রথম অভিযানেই আমি কিন্তু একটাকে চিরতরে সরিয়ে দিয়ে এসেছি।
মা বললেন, ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট।
বাসববাবু বুকে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। বললেন, তুমি যে ভেতরে ভেতরে কতটা বড় হয়েছ তা আমি বুঝিনি বাবা। তোমার গলায় আমি জয়ের মালা পরিয়ে দেব। পুলিশের চাকরি করছি বলে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করবার দায়িত্ব শুধু আমার একার তা তো নয়। এ অধিকার সবার। শুধু আমার ছেলে হিসেবে যে তোমার তা নয়, তোমার মায়েরও আছে। আছে একজন সাধারণ নাগরিকেরও। বেশি সংখ্যক মানুষ যখন অসৎ হয়, বিভ্রান্ত হয়, তখন দেশের সামনে এমন এক সংকট পাহাড়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায় যে তাকে ঠেলে সরানোর কাজে এগিয়ে আসতে হয় সকলকেই। পুলিশ প্রশাসন বা একজন সরকারি কর্মচারীর ওপর যেমন অনেক দায়দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে, তেমনি সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও ঠিক একই দায়িত্ব সমানভাবে বর্তায়। আলাদাভাবে নয়, সকলকে এক হয়ে একজোটে কাজ করতে হয়। একতাবদ্ধ না হলে এ দেশকে রক্ষা করা অসম্ভব।
মা ফোঁস করে উঠলেন এবার, তোমার লেকচার থামাও তো। কুখ্যাত দাগি আসামিগুলোকে ধরে আনছ, একদিন দু’দিন আটকে রাখছ, আর ছেড়ে দিচ্ছ। এই এলাকার মধ্যেই তোমার বাড়ির আশপাশে ওইরকম কত ঘুরে বেড়াচ্ছে তা তুমি জান না?
কেন জানব না? সবই জানি। আমরা কাজ করি বলেই তো ওদের টুটিটিপে লকআপে পুরি। জানি বলেই তো নিজের জীবন বিপন্ন করেও ধরে আনি ওদের। তারপর তাদের ছেড়েও দিই। দিতে বাধ্য হই। সব চেষ্টা বিফল হয়ে যায়। অত পরিশ্রম, অত হানাহানি, মারামারি, দাপাদাপি সবই নাটক হয়ে যায় একসময়। এই নাটক তোমরাই তো সৃষ্টি করো।
করতে বাধ্য হই। না করে উপায় আছে? আজ তুমি যাকে কুখ্যাত সমাজবিরোধী বলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছ, কাল সকালে তাকে যদি অ্যারেস্ট করি তখন দেখবে তোমার পাশের বাড়িরই অমুকবাবু, তমুকবাবুরা তার সুনজরে থাকবার জন্যে দল বেঁধে তাকে ছাড়াতে যাবে। এ ছাড়াও সমাজের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি তো যাবেনই, অথবা আবেদন নিবেদন করে তাঁদের যেতে বাধ্য করা হবে। তা হলে? তোমাকে, আমাকে, অমুকবাবুকে, তমুকবাবুকে নিয়েই তো আমরা। এবার বুঝেছ তো আমাদের ক্ষমতা কতটা সীমিত? যাক, ওসব কথা বুঝিয়ে বলতে গেলে সাতকাহন হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষ যতদিন না একজোট হয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হবে, পরস্পর পরস্পরের পাশে এসে না দাঁড়াবে, ততদিন কিচ্ছু হবে না, চলতেই থাকবে এইসব। তা ছাড়া মানুষের অভাব অনটন দারিদ্র যত প্রবল হবে, শিক্ষার প্রসার যত কম হবে, ততই বাড়বে অপরাধের মাত্রা। একে রোধ করবে কে?
নীহারবাবু বললেন, হিরণ, তুমি আজ যেভাবে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে এক ভয়ংকর শত্রুর মোকাবিলা করতে গিয়েছিলে, তা তোমার মতো সব ছেলেরই আদর্শ হোক।
হিরণ বলল, হওয়া উচিত। তবে, ভাগ্যিস আমি পিস্তল শুটিংটা শিখেছিলাম আর আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার, তাই হয়তো আমি এতটা দুঃসাহসী হতে পেরেছি।
তাও ঠিক নয়। তুমি সাহসী ছেলে বলেই পেরেছ। না হলে পারতে না। অনেক পুলিশ অফিসারের অনেক ছেলেই আছে, তারা কি সবাই পারে তোমার মতন সাহসে ভর করে এগিয়ে যেতে? তোমার ভেতরে যে ওই বীজ ছিল বাবা।
বাসববাবু বললেন, এবার আমাকে বেরোতে হবে। যে পর্যন্ত তুমি বলেছিলে তার পর থেকে বলো কীভাবে কী হল।
হিরণ বলল, হ্যাঁ, আমি তো রহমতের সঙ্গে দেখা করব বলে গেলাম, যেই না গেছি অমনি দেখি সন্দেহভাজন দু’-তিনজন ঘোরাফেরা করছে সেখানে। দেখেই বুঝলাম গতিক সুবিধের নয়, একটু আড়ালে লুকিয়ে ওদের কথাবার্তা শোনবার চেষ্টা করলাম। টুকরো টুকরো কথা যা দু’-একটা কানে এল তাতেই বুঝলাম ওরা রহমতকে খুন করবার মতলব নিয়ে এসেছে। এই অবস্থায় আমি কী করব যখন ভাবছি, তখন হঠাৎ দেখি ওদের একজন চোখের পলকে হাসপাতালে ঢুকে গেল। তারপরই শোনা গেল গুলির শব্দ, আর হই-হট্টগোল। বুঝলাম অপারেশন সাকশেসফুল। রাগে তখন আমার হাত-পা কাঁপছে। লোকটা বেরিয়ে আসতেই আমি আড়াল থেকে গুলি করলাম লোকটাকে। ইচ্ছে ছিল পায়ে গুলি করবার। তা হলে লোকটা ধরাও পড়ত, ওকে মোচড় দিয়ে অনেক কথাও বার করা যেত। কিন্তু এই প্রথম টার্গেট তো আমার। আর গুলি ছিল মাত্র একটাই। পায়ে গুলি করতে গিয়ে যদি গুলিটা ফসকে যায়, তাই বডি লক্ষ্য করেই গুলি করেছি।
বেশ করেছ। কিন্তু তুমি ভয়ানক রিস্ক নিয়েছ। যদি ওরা পালটা গুলি করত তোমাকে, তা হলে তুমি কী করতে?
হয় পালাতাম, নয় মরতাম।
স্বপ্না আর রিয়া চোখদুটো বড় বড় করে বলল, ওরে বাবা! তুমি যে দেখছি ক্ষুদে রবিনহুড।
মা বললেন, তাই তো দেখছি। নাও, এবার হাতমুখ ধুয়ে একটু কিছু মুখে দাও।
বাসববাবু বললেন, হ্যাঁ, সেই কোন সকালে বেরিয়েছ। এবার জলটল খেয়ে বিশ্রাম নাও। আমি না বলা পর্যন্ত এখন স্কুলে যাবার দরকার নেই। এই বলে নীহারবাবুকে নিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হলেন।
মা বললেন, দুটো খেয়ে গেলে হত না?
দেরি হয়ে যাবে।
বাসববাবু চলে গেলেন। যেতে তো হবেই। অপরাধীদের ধরার ব্যাপারে এখুনি তৎপর না হলে মুখ দেখানো যাবে না। এমনিতেই রাজ্যের বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিগুলো নিয়ে পুলিশ দফতর হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। শুধু বাজে কাজ করতে গিয়েই সময় নষ্ট হচ্ছে কত। এরপর আছে ফুটপাত হকারমুক্ত করা। সকালে তাড়াও, বিকেলে আবার ঠিক বসে যাবে। পাবলিক যদি সাপোর্ট করে তো, রাজনৈতিক নেতারা বিরোধিতা করে। ঠিক কোনও-না-কোনও দাদা দাঁড়িয়ে যাবে ওদের হয়ে। তারপর আছে বেআইনি বাড়ি ভাঙা, যেখানে সেখানে গজিয়ে ওঠা মন্দির ভাঙা। মন্দির একটা গজাল তো পুজো দেবার সে কী ধুম। প্রতিরোধ করতে কেউ এগিয়ে আসবে না। কিন্তু গালাগালি দেবার সময় চায়ের দোকানে বসে ধুয়ে দেবে প্রশাসনকে। সব ক্ষেত্রে সকলের যেমন করবার কিছু থাকে না, তেমনি অনেক ক্ষেত্রেই তো এগিয়ে আসা যায়। দুঃখের বিষয় আসবে না কেউ। আর এই সব ডামাডোলের ভেতর দিয়েই চলতে থাকবে আরও অন্য অসামাজিক কার্যকলাপ। মাথাচাড়া দেবে মগ্ন মৈনাকের মতো কার্লস জ্যাকলের দল। জীবন বিপন্ন হবে বাসববাবুদের। ওদের কথা কেউ ভেবেও দেখবে না। ওরা হবে যূপকাষ্ঠের বলি। অপরাধ? ওরা যে পুলিশ।
বাসববাবু চলে গেলেন। মা যে কখন কোন ফাঁকে ঠাকুরের মানসিক করে ফেলেছিলেন তা কে জানে? হিরণের কপালে একটা টাকা ঠেকিয়ে ঠাকুরের জায়গায় রেখে এসে মেতে উঠলেন ছেলেকে নিয়ে। তারপর স্বপ্না আর রিয়ার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ছেলের জন্য এটা ওটা সেটা কত কী করতে লাগলেন। হিরণ বাথরুমে ঢুকে ভাল করে মুখহাত ধুয়ে, ধপাস করে ওর বিছানায় এসে দেহটা এলিয়ে দিল। কুখ্যাত লোকগুলোর একটাকেও যে খতম করতে পেরেছে, এতেই ওর আনন্দ।
রিয়ার মা কাল সন্ধ্যাবেলা চলে গেছেন।
স্বপ্নার মা এলেন একটু পরে। সব শুনেটুনে কত বোঝালেন হিরণকে। বললেন, তুমি এখন ছেলেমানুষ বাবা। বড়দের কাজ কি তোমাকে সাজে?
হিরণ বলল, ছেলেমানুষ হলেও বালক তো নই। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। তা ছাড়া আমার বাবা যেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন, সেখানে তাঁর ছেলে হয়ে আমি কী করে নীরব থাকি?
বুঝলাম। কিন্তু তোমার বাবা এইসব কাজে অভ্যস্ত। তুমি তো নও। তা ছাড়া যে কাজ তোমার বাবা করে থাকেন সে কাজ করার আইনগত অধিকারও তোমার নেই।
আজ আমার হাতেখড়ি হল।
মা বললেন, শুনেছ ছেলের কথা, এতটুকু ভয়ডর নেই।
হিরণ বলল, ভয় কী। আঘাতের পালটা আঘাত না করলে ওরা আমাদের দুর্বল ভাববে।