দুই
কর্মব্যস্ত, কলকাতা মহানগরীর বুকে ডালহৌসি অঞ্চলে লালবাজার শুধু কলকাতার নয়, সমগ্র পশ্চিমবাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানকার পুলিশ ও প্রশাসনের সুমহান ঐতিহ্য আজও অটুট আছে। কিন্তু কালে কালে নদী যেমন তার গতিপথের পরিবর্তন করে, তেমনি অপরাধীরাও তাদের অপরাধের ধারাকে ভিন্নমুখী করে তোলে। ফলে দুই আর দুইয়ে চার না হয়ে, বারো মাইনাস আট হয়ে যায়।
বাসব মজুমদার একজন পদস্থ গোয়েন্দা অফিসার। তাঁর নির্দিষ্ট সময়সূচির মধ্যে বা বাইরেও জীবনের নানান ঝুঁকি নিয়ে জলের তলায় ডুব দিয়েও অপরাধীদের খুঁজে বার করেছেন। কলকাতার পুলিশ প্রশাসন তাই বাসববাবুর অবদানে মুগ্ধ। বাসবাবু তাঁর চাকরি জীবনের দিনগুলিতে কখনও কোনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি। এমনকী নিজেও কোনও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েননি। শুধু বাসববাবু কেন, তাঁর সহকর্মী নীহার তালুকদার, রঞ্জন বসু এঁরাও অতি সজ্জন লোক। নীহার এবং রঞ্জনের তুলনা হয় না। একই দিনে পরপর কয়েকটি খুন ও রাহাজানিকে কেন্দ্র করে যখন তিন বছর আগে কার্লস জ্যাকলের পিছু ধাওয়া করেছিলেন, তখন এই দুই অসমসাহসী যুবকের অবদানের কথা তিনি কখনও ভুলবেন না। এরা পাশে না থাকলে হয়তো বেঘোরে মরতে হত সেদিন।
খিদিরপুর এবং ওয়াটগঞ্জ অঞ্চলের সন্ত্রাস ছিল এই কার্লস জ্যাকল। লোকটা আগে ছিল রিপন অঞ্চলের গুন্ডা। ছিপছিপে দোহারা চেহারা। মা বাঙালি। বাবা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। ওকে চার বছরের রেখে ওর বাবা এক ভয়ংকর পথদুর্ঘটনায় মারা যান। তারপর মা কোনওরকমে ভিক্ষেদুঃখু করে মানুষ করেন ওকে। মানুষ অবশ্য হয় না ছেলে। আলিজান আর দুলিয়াজান নামে দুই কুখ্যাত সঙ্গীর সংস্পর্শে এসে চুরি, ছিনতাই, স্মাগলিং প্রভৃতিতে হাত পাকায়। বাপও নেহাত ভাল মানুষ ছিলেন না। তাই শরীরের বদরক্ত অ্যালকোহলের মতো মিশে থাকে। সেই রক্তে শুধু একটি দেশলাই কাঠি ধরিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। আলিজান আর দুলিয়াজান সেই কাজটাই করে দিল ওর। রক্তের আগুন জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে।
মধ্য কলকাতার একটি সিমেনা হলে টিকিট ব্ল্যাকের সময় সাধারণ একটি খুন নিয়ে ওর অপরাধজীবনের শুরু। এবং ছেলের জন্যে ভাবনায় চিন্তায় অর্ধাহারে অনাহারে ওর দুঃখিনী মায়ের মৃত্যু ওকে অপরাধজগতের সিঁড়ি বেয়ে অনেক নীচে নামাতে থাকে। কলকাতা পুলিশের ব্রহ্মতালুতে বিষফোঁড়ার মতো টন টন করতে থাকে কার্লস জ্যাকল। ওর ডাক নাম ছিল ডেভিড। কিন্তু কার্লস জ্যাকল নামটা যে কে চাপাল ওর ঘাড়ে তা কে জানে? পুলিশের খাতায় এই নামেই ও এখন প্রসিদ্ধ। বাংলার আতঙ্ক, কলকাতার আতঙ্ক, লালবাজারে রাহাজানির অন্যতম নায়ক কার্লস জ্যাকল আবার ফিরে এসেছে অপরাধজগতে। সে দেখিয়ে দিয়েছে একমাত্র মৃত্যুদণ্ড ছাড়া, আর কোনও দণ্ডেই তাকে দমিয়ে রাখা যাবে না। লোহার খাঁচায় বনের বাঘকে আটকে রাখা যায় কিন্তু কার্লস জ্যাকলকে নয়। কার্লস জ্যাকল জাদু জানে। সে পালাব মনে করলে লোহার খাঁচাও তার কাছে তারের খাঁচা হয়ে যায়।
লালবাজারের বিশাল চত্বরে গাড়ি থেকে নেমে গম্ভীর মুখে দোতলায় নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন বাসববাবু। কর্মব্যস্ত এই মহানগরী এত খুন, এত দাঙ্গা, এত কিছু সত্ত্বেও কেমন স্বাভাবিক। মানুষের চলাফেরায় এতটুকু অসাচ্ছন্দ্য নেই। অথচ বাসববাবুর মনের মধ্যে এখন দুশ্চিন্তার ঊর্মিমালা ভয়ানক তোলপাড় করছে।
কার্লস জ্যাকলের নোটিশ পেয়েছেন বাসববাবু। ওই কাটা মুণ্ডটাই সেই নোটিশ বহন করে এনেছে। তিনি দ্রুত ঘরে যেতেই বেয়ারারা সেলাম ঠুকল তাঁকে। তারপর যে যার চেয়ারে গিয়ে বসল। প্রতিটি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এখন চেয়ারের মর্যাদা পেয়েছেন। এটি খুবই সম্মানজনক ব্যবস্থা। তবে বাপের বয়সি কর্মচারীদের তরুণ পদস্থ অফিসাররা অনেকেই নাম ধরে ডাকেন, এটা অবশ্য বাসববাবুর পছন্দ নয়। বয়স্ক পিওন বেয়ারাকেও উনি আপনি আজ্ঞে করেন। বাসববাবু ঘরে গিয়ে সিটে বসতেই বৃদ্ধ আর্দালি গোকুল দাস কাছে এসে দাঁড়াল। বাসববাবু বললেন, আমাকে এক গেলাস জল দিয়ে একবার নীহারবাবুকে ডাকুন তো।
গোকুল দাসকে অবশ্য ডাকতে হল না। নীহারবাবু নিজেই এসে হাজির হলেন। বয়সে তরুণ নীহারবাবু বললেন, কী ভয়ানক ব্যাপার! তাজা একটি মানুষের মুণ্ডু কখন যে রেখে গেছে তা কে জানে?
বাসববাবু বললেন, বাইরের লোক এখানে আসে কী করে? সেটাই তো রহস্য।
বিশেষ করে এত সব ঘটনার পরেই বহিরাগতদের ওপর নজর রাখা হয় না, কেন, আমি তো কিছুই বুঝছি না। আজকের কাগজটা দেখেছ? যে খবরটা ছেপে বেরিয়েছে তা কতখানি লজ্জার তা জানো? এইরকম হতে থাকলে লোকের কাছে মুখ দেখানো যাবে না যে। গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ওপর মানুষের ধারণা খারাপ হয়ে যাবে।
নীহারবাবু বললেন, কাটা মুণ্ডুটা আপনি একবার দেখবেন স্যার? অবশ্যই। তার আগে কয়েকটা প্রশ্ন।
কীরকম!
ওই প্যাকেটটা প্রথমে কার নজরে পড়ে। পিয়ন বেয়ারারা সেই সময় কী করছিল? ওটা হাতে করে খুলেছিল কে? খোলবার আগে অন্য কোনওরকম সন্দেহ কী হয়নি? মানে ওর ভেতরে বিস্ফোরক কিছুও তো থাকতে পারত। এই ঘটনার কথা কে কে জানে? সি পি-র কানে উঠেছে কি কথাটা? খবরের কাগজের সাংবাদিকদের কাছে খবর পৌঁছে যায়নি তো?
নীহারবাবু বললেন, ব্যাপারটা কিন্তু আর চাপা নেই স্যার। আমার আর্দালি রজনীই প্রথম দেখতে পায়। তখন অন্যান্য পিয়ন-বেয়ারারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওতে হাত দেওয়ার আগে আমরা মেটাল ডিটেক্টর লাগিয়ে পরীক্ষা করে নিই। যখন বিপদ সংকেত কিছু পাই না তখনই হাত দিই ওতে। ভুল অবশ্য একটু হয়েছিল। অনেকের সামনেই খুলে দেখা হয়েছিল ওটা। তবে সবাই চুপচাপ আছে। কেন না, সি পি-র কানে গেলে উনি নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন। সকলকেই তলব করবেন। কর্তব্যে অবহেলার জন্য বকুনিও খাবেন কেউ কেউ। তবে খবরের কাগজের লোকেদের জানানো হয়নি কথাটা।
এমন সময় বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকার দু’জন সাংবাদিক এসে হাজির হলেন সেখানে, কই স্যার! কোথায় সেই কাটা মুণ্ডু। দেখি, দু’-একটা ছবিটবি তুলি। বাসববাবু এবং নীহারবাবু দু’জনেই অবাক হবার ভান করলেন। কাটা মুণ্ডু! কই কোথায়?
একজন সাংবাদিক বললেন, ব্যাপারটা চেপে যাবেন না স্যার! সব কাজ ফেলে ছুটে এলাম। রগরগে খবর হবে কালকের কাগজে। চায়ের টেবিলে বসে লোকে চেটে চেটে খাবে। জিভ দিয়ে নয় অবশ্য, চোখ দিয়ে।
বাসববাবু বললেন, সেই সঙ্গে আবার নতুন করে প্রমাণ হবে প্রশাসনের ব্যর্থতা, আর আমাদের অকর্মণ্যতা, এই তো? আচ্ছা মশাই, কারও বাড়ির ছেলেমেয়ে যদি সুইসাইড করে তা হলে তার বাপ-মা কী করতে পারে বলুন?
এত মানুষ, এত ভিড় এর ভেতরে হঠাৎ দু’-একটা খুন হলে আমরাই বা কী করতে পারি? আমাদের কাজ হল অপরাধীকে ধরা এবং তাদের শাস্তি দেওয়া। কিন্তু অপরাধ কেউ করবে না এমন গ্যারান্টি তো দিতে পারি না। আজ শুধু কলকাতায় নয়, পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখুন। তাকিয়ে দেখুন ভারতের বাইরের দেশগুলোর দিকে, দেখবেন সর্বত্র অপরাধ করবার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। আসলে ওই একটা কথা আছে না, মা যা হতে চাইছেন। তেমনি প্রকৃতিও যা হতে চাইছেন তাকে না হওয়ার হাত থেকে আমরা আটকাব কী করে? সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আজ অনেক সমস্যা। সারা বিশ্বের মানুষ আজ উচ্ছৃঙ্খল। এর জন্যে কে বা কারা দায়ী তা জানি না। তবে আমি বলব এর জন্য মানুষই দায়ী। আমরা সৎ থাকব কি না বা আমরা আইনশৃঙ্খলাগুলো মেনে চলব কি না সে তো আমরাই ঠিক করব। যাক চা খাবেন?
কিন্তু ওই কাটা মুণ্ডু?
ওটা নেহাতই উড়ো খবর।
সাংবাদিকরা হেসে বললেন, কার্লস জ্যাকলকে চেনেন?
বাসববাবু স্নান হয়ে গেলেন। বললেন, না চেনবার কী আছে? আমি নিজে তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে জেলের ঘানি টানতে পাঠিয়েছি তাকে। তিনি এখন কোন জেলে আছেন জানতে পারি কি?
বাসববাবু বললেন, তা ঠিক বলতে পারব না।
আজ কয়েকদিন হল জেলপলাতক হয়ে এই শহরেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। উনিই আমাদের ফোন করে জানিয়েছেন তাঁর দেওয়া উপহার সেই নরমুণ্ডুর কথা। একবার দেখান না স্যার একটা ফটো তুলি।
বাসববাবু বললেন, কার্লস জ্যাকল জেল ভেঙে পালিয়েছে আপনারা ঠিক জানেন?
আপনিও জানেন।
বাসববাবু বললেন, শুনুন ওই রকম একটা ফোন আমরাও পেয়েছি। জেল কর্তৃপক্ষও এতক্ষণে এই সংবাদ পুলিশকে নিশ্চয়ই জানিয়েছে বা জানাবে। কিন্তু যতক্ষণ না সরকারিভাবে আমরা কোনও রিপোর্ট পাচ্ছি, ততক্ষণ সাংবাদিকদের কাছে কী করে মুখ খুলি বলুন।
মুখ আপনাদের খুলতে হবে না। কাল সকালে কাগজ খুললে সবাই তা জেনে যাবে।
বাসববাবু সাংবাদিকদের মুখের দিকে তাকালেন।
সাংবাদিকরা বললেন, পুলিশ ছাড়া আমরা অনেক সূত্র থেকেই খবর পাই। জেল কর্তৃপক্ষই আমাদের জানিয়েছেন। আর জানিয়েছে স্বয়ং কার্লস জ্যাকল।
না হলে ওই কাটা মুণ্ডের কথা আমরা কি জানতে পারতাম?
বাসুববাবু বললেন, সব কিছু জেনেই যখন এসেছেন তখন আর কিছু লুকোব না। তবে মশাই, যা লিখবেন একটু বুঝেশুনে। অযথা মানুষকে উত্তেজিত করবেন না। আসলে সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজেও দেখিনি এখনও। ফোনে খবর পেয়ে এই সবে আসছি।
একটু পরেই রঞ্জনবাবু এবং আরও কয়েকজন অফিসার ঘরে এসে ঢুকলেন।
যাই হোক, ব্যাপারটা আর চাপা রইল না। কাটা মুণ্ডটা যেখানে রাখা ছিল সেইখানে গিয়ে সকলেই দেখলেন, মৃতের কপালে একটি পিনগেঁথা কাগজে নাম লেখা আছে বাসব মজুমদার। কী ভয়ংকর সেই দৃশ্য। চোখে দেখা যায় না। বাসববাবু এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন।
একজন সাংবাদিক বললেন, লোকটা কী সাংঘাতিক।
আর একজন সমবেদনার সুরে বললেন, আপনার ভয় করছে না স্যার? করছে না তা কী করে বলি? কেউ কাউকে মারব মনে করলে তাকে কি রোখা যায়? কাজেই সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়?
এখন তা হলে কী করবেন?
চিড়িয়াখানা থেকে হঠাৎ করে পালিয়ে যাওয়া কোনও জন্তুকে যেমন আবার ধরে এনে খাঁচায় পোরে, ঠিক সেই ভাবেই কার্লস জ্যাকলকেও খুঁজে বার করে আবার পুরতে হবে হাজতে।
কাজটা কি খুব একটা সহজ হবে?
না। এ হচ্ছে সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন। উত্তরটা জানা আছে। শুধু প্রসেসটা ঠিকমতো করে নিয়ে হবে। অপরাধী আমাদের পরিচিত। অপরাধও প্রমাণিত। শুধু খোঁজার ব্যাপারটা নিখুঁতভাবে চালিয়ে যেতে হবে আমাদের। আর বিশেষ করে আত্মরক্ষার ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে হবে আমাকে।
সাংবাদিকরা ফটো তুলে বিদায় নিলেন।
অফিসাররা বসলেন গোপন বৈঠকে। অনেক অনুসন্ধানের পর তাঁরা জানতে পারলেন একজন অচেনা পুলিশ অফিসার আজ সকালে এসেছিলেন এখানে। সঙ্গে তাঁর একজন বেয়ারাও ছিল। এছাড়া আর কোনও আগন্তুকের পাদস্পর্শই হয়নি। এই অফিসারকে আগে কখনও দেখেনি কেউ। তবে তাঁর সাজপোশাক দেখে সকলে সমীহ করে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তিনি যদি সত্যিকারের পুলিশ অফিসার না হন তা হলে—
যারা দেখেছিল তারা বলল, উচ্চতায় প্রায় ছ’ফুটের ওপর। গায়ের রং কালো। চাপদাড়ি। মাথায় টুপি। তবে মুখের দিকটা কালো হলেও হাতের আঙুলগুলো ফর্সা।
বাসববাবু বললেন, আর বলবার দরকার নেই। কার্লস জ্যাকল !
এত সাহস লোকটার? একেবারে পুলিশের ছদ্মবেশে এসে ঢুকে পড়ল! নীহারবাবু বললেন, সেটার ব্যাপারে কীভাবে এগনো যাবে সে বিষয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা করেছেন স্যার?
না। তবে একটা ব্যাপারে আমি তোমার একটু সাহায্য চাই।
বলুন, কী করতে পারি?
আচ্ছা, তোমার দিদিমা তো কাশীবাস করেছেন,
তোমাদের একটা বাড়িও আছে সেখানে, তাই না?
বাড়িটা আমাদের না। ডা. দীপঙ্কর ঘোষের বাড়ি।
আমি যদি কিছু দিনের জন্যে ওই বাড়ির একটা ঘর চাই দিতে পারবে? এ আর এমন কী? বাড়িটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে।
তা হলে আমি আশা করতে পারি?
নিশ্চয়ই। কিন্তু এই সময়ে আপনার বেনারসে চলে যাওয়াটা কী ঠিক হবে?
মোটেই না। আমি আমার জন্যে বলছি না। ভাবছি ছেলেটাকে সরিয়ে দেব এখান থেকে। ওর মা-ও যাবে। কিন্তু খুব সাবধান। কাকপক্ষীতেও যেন জানতে না পারে একথা। এমনকী হিরণ বা ওর মা-ও জানবে না ওরা কোথায় যাচ্ছে। দু’–একটা মাস। তার ভেতরে ওই শয়তানটার হেস্তনেস্ত একটা করবই আমরা। ঠিক এই সময়ে ওদের এখানে রাখা খুব একটা যুক্তিপূর্ণ বলে মনে করছি না। তার কারণ এখানে থাকলে কার্লস জ্যাকলের এক একবারের ফোনের চমক ওদের ভয় পাইয়ে দেবে। ওরা যত ভয় পাবে আমিও ততই দমে যাব। কিন্তু আমি যদি একা থাকি তা হলে ভাবনাচিন্তা করে একটা কিছু করবার সুবিধে হবে আমার।
এটা অবশ্য মন্দ যুক্তি নয়। ঠিক আছে, আমি গোপনে সব কিছুরই ব্যবস্থা করছি। আশা করছি ট্রেনের টিকিটও পেয়ে যাব।
বাসববাবু জলের গেলাসে চুমুক দিয়ে বললেন, চলো, কার্লস জ্যাকলের পুরনো পাড়া খিদিরপুর গার্ডেনরিচ আর ওয়াটগঞ্জের দিক থেকে একটু ঘুরে আসি।
নীহারবাবু, রঞ্জনবাবু এবং বাসববাবু তিনজনেই যথারীতি তৈরি হয়ে সাদা পোশাকে একেবারে সম্পূর্ণ অন্য রকম চেহারায় বেরিয়ে পড়লেন অফিস থেকে। বেলা তখন দশটা। সারাটা দিনের এখনও কত বাকি।
হিরণ ছাদে বসে গভীর মনোযোগে কী একটা বই পড়ছিল। এমন সময় পাশের বাড়ির ছাদে ওরই বয়সি ফুটফুটে একটি ফ্রকপরা মেয়ে একটা পলিথিনের বালতিতে করে কতকগুলো ভিজে জামাকাপড় রোদ্দুরে শুকোতে দিতে এল। মেয়েটির নাম স্বপ্না। হিরণ এ বছর মাধ্যমিক দেবে। ও দেবে পরের বছর। হিরণকে ওইভাবে এক মনে বই পড়তে দেখে স্বপ্না আলশের কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে বলল, কী বই পড়ছ হিরণদা, অত মন দিয়ে?
হিরণ ওর দিকে চোখ মেলে বলল, ‘লালবাজারে রাহাজানি’। স্বপ্না হেসে বলল, ওই নামে আবার বই হয় নাকি?
বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখো।
স্বপ্না বই দেখে হেসে বলল, যাঃ। এটা তো পাণ্ডব গোয়েন্দা।
হলেই বা! খুব শিগগিরই এই নামে একটা বই বেরোবে। যার নায়ক কার্লস নিশ্চয়ই। নায়িকার নাম হবে স্বপ্না বোস।
জ্যাকল নামে এক জেলভাঙা কয়েদি। তার গোয়েন্দা হবেন হিরণ মজুমদার। সে বইতে কোনও নায়িকা থাকবে না?
সে বই লিখবে কে?
ভাবছি পাণ্ডব গোয়েন্দার লেখককে দিয়েই লেখাব।
তোমার যত সব উদ্ভট চিন্তা। তা হঠাৎ লালবাজারে রাহাজানির কথাটা মনে এল কেন? তা ছাড়া তুমি তো সচরাচর স্কুল কামাই করো না, আজ হঠাৎ ঘরে যে?
আজ সকালে খুব একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে গেছে।
স্বপ্না কৌতূহলী হয়ে বলল, কীরকম শুনি তবু একটু?
তুই আয় না দুপুরবেলা আমাদের বাড়ি, সব বলব।
আজ আমার একটুও সময় নেই। চিত্তরঞ্জন থেকে আমার মামাতো বোন এসেছে। ওকে ছেড়ে যাই কী করে বলো?
বেশ তো, ওকে নিয়েই চলে আয়।
আজ হবে না।
এমন সময় ওবাড়ির সিঁড়ির দরজায় একটি ফুটফুটে কিশোরীর মুখ উঁকি দিয়েই আড়াল হয়ে গেল। হিরণ পলকের দেখাতেই খুশি হল। কী সুন্দর মেয়েটি, সোনার প্রতিমা যেন। বলল, ও বুঝি?
স্বপ্না বলল, ও মানে।
এই মাত্র সিঁড়ির দরজায় কে যেন একজন উঁকি দিয়েই নীচে নেমে গেল।
তুমি নিশ্চয়ই রিয়ার কথা বলছ। আমার মামাতো বোন। ছাদে আসছিল। আসলে তোমাকে দেখে লজ্জায় নেমে গেছে। ও না ভীষণ লাজুক। হিরণ বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, তাই নাকি? আজকের দিনে এমন মেয়েও আছে?
কেউ না থাক, রিয়া আছে। আসলে ওকে দেখতে তো খুব সুন্দর। সামনে এসে দাঁড়ালে অনেকেই ওকে দেখে চোখের পাতা ফেলতে ভুলে যায়। তাই ওর এত লজ্জা।
হিরণ কিছুক্ষণ স্বপ্নার দিকে চেয়ে রইল একভাবে। তারপর বলল, বেশ। সময় মতো আসিস তা হলে। বলে আবার গল্পের বইতে মনোনিবেশ করল। এমন সময় স্বপ্নার গলা শুনতে পেল, আয় না। চলে আয়, লজ্জা কী? ও আমাদের হিরণদা। খুব ভাল ছেলে।
স্বপ্নার ডাকে সিঁড়ির দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রিয়া। তারপর অভ্যস্থ হাতে স্বপ্নার কাজের সহযোগিতা করল।
হিরণ বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে দেখতে লাগল রিয়াকে।
একসময় বই মুড়ে আলশের ধারে এসে দাঁড়িয়ে বলল, এই তোমার মামাতো বোন রিয়া?
স্বপ্না বলল, হ্যা। প্রায় ছ’-সাত বছর পরে এল। এর আগেও তুমি ওকে দেখেছ। তখন অবশ্য ও আরও ছোট ছিল।
আমিও সাত বছরের ছিলাম। তুইও ছ’ বছরের ছিলি। কাজেই সেই সময় ওরও বয়স তো তাই। ও কি তোরই সঙ্গে পরীক্ষা দেবে? হ্যাঁ, আমরা দু’জনেই আগামী বছর মাধ্যমিক দেব। হিরণ বলল, ওরা কোথায় যেন থাকে?
চিত্তরঞ্জনে।
চিত্তরঞ্জন শুনেছি খুব ভাল জায়গা। চিত্তরঞ্জনের কোথায় থাকে ওরা? এতক্ষণে রিয়া মুখ খুলল। স্বপ্নাকে বলল, ওকে জিজ্ঞেস কর, ও কি
চিত্তরঞ্জনে গেছে কখনও? বললে চিনতে পারবে?
বলল, না। তা অবশ্য পারব না। আমি যাইনি কখনও। তবে আমার বাপি কয়েকবার গেছেন সরকারি কাজে সুন্দর পাহাড়িতে।
রিয়া এবার সরাসরি হিরণকে বলল, আমরা উত্তর সুন্দর পাহাড়িতে থাকি। ওই জন্যই বোধহয় তোমাকে এত সুন্দর দেখতে।
রিয়া বলল, যারা সুন্দরপাহাড়ির বাইরে থাকে তারাও তো দেখছি কম সুন্দর নয়।
এমন সময় মা উঠলেন ছাদে। হিরণকে গল্প করতে দেখে বললেন, ওমা, তুই এখানে? আমি তো ভরে মরি। চারদিক খোঁজাখুঁজি করছি। তারপর হঠাৎ নজর পড়ল রিয়ার দিকে। স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বললেন, তোর সেই মামাতো বোনটা না? কত বড় হয়ে গেছে রে? কবে এল?
স্বপ্না বলল, কাল রাত্তিরে।
কার সঙ্গে এল? ওর মা এসেছে?
মা-বাবা সবাই এসেছেন। ওনারা অবশ্য আজ বিকেলেই চলে যাবেন। ও থাকবে।
তা বেশ বেশ। মা নীচে গেলেন।
হিরণ আর রইল না ওপরে। ধীরে ধীরে নেমে এল নীচে। মনটা ওরও আজ ভাল নেই। কেন না খবরের কাগজ খুললেই যা সব দেখছে তাতে সাধারণ মানুষ থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী কারও কোনও নিরাপত্তাই আর নেই। কে যে কখন একটা খবর হয়ে যাবে তা কে জানে? বিশেষ করে ওই শয়তান লোকটা সত্যিই যদি বাপির কোনও ক্ষতি করে এই আশঙ্কাতেই ও মনমরা হয়ে গেল। কী দুঃসাহস। জলজ্যান্ত একজন মানুষকে খুন করে দিব্যি ওর বাপির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে গেল। হিরণের মনে হচ্ছে ও যদি ওর বাপির মতন হত তা হলে এই মূহূর্তে ওই দুষ্কৃতীকে খুঁজে বার করে ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে নিত ওর। কিন্তু বাপি কেন যে তা করেন না তা ও কিছুতেই বুঝতে পারে না। কথায় আছে শত্রুর শেষ রাখতে নেই। একথা যে কতখানি সত্য তা আজ মর্মেমর্মে বুঝতে পারছে ও। কিন্তু বাপি কেন বোঝেন না?
দুপুরে স্নান-খাওয়ার পর সবে একটু শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে এমন সময় স্বপ্না ও রিয়া এসে হই হই করে ওর ঘরে ঢুকল। ওদের মায়েরাও এসেছেন। হিরণের মায়ের সঙ্গে পাশের ঘরে গল্পে মাতলেন তাঁরা। স্বপ্না আর রিয়া এসে বিরক্ত করতে শুরু করল হিরণকে।
স্বপ্না বলল, এ কী! আর ক’মাস বাদে যে ছেলে মাধ্যমিক দেবে সে কিনা এই ভরদুপুরে ঘুমোতে শুয়েছে?
হিরণ উঠে বসে বলল, না না। দিবানিদ্রা আমার ধাতে সয় না। এমনি একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলাম আর কী।
রিয়া আর স্বপ্না দু’জনেই এসে খাটের ওপর ওর বিছানায় বসল।
স্বপ্না বলল, এই হচ্ছে হিরণের ঘর। কেমন সুন্দর সাজানো-গোছানো বল দেখি?
তুই এটাকে ঘর বলছিস স্বপ্না? আমি তো স্টুডিয়ো বলতে যাচ্ছিলাম।
হিরণদার বাবা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের একজন বড় অফিসার। তাঁর ছেলের ঘর, কেন হবে না বল ?
সেটাই বড় কথা নয়, ঘর সাজানোটা হচ্ছে রুচির ব্যাপার।
হিরণ বলল, এই ঘরে যা কিছু দেখছ সবই আমার মায়ের পরিকল্পনায়। স্বপ্না হলল, সে যাই হোক। কিন্তু হিরণদা, তুমি তো স্কুল কামাই করে ঘরে থাকবার ছেলে নও।
হিরণ বলল, আমি কখনও অপ্রয়োজনে স্কুল কামাই করি না। খুব একটা জরুরি কাজ না থাকলে বা শরীর খারাপ না হলে রোজই আমি স্কুলে যাই। তবে আজ সকালে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে যে ভীষণ একটা দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছি আমরা।
কী রকম?
হিরণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। একবার স্বপ্নার দিকে তাকাল। একবার দেখল রিয়াকে। ঢল ঢল কচি কিশোরীর মুখদুটোতে কৌতূহল ফুটে উঠেছে যেন। হিরণ বলল, আমাদের সকলেরই জীবন বিপন্ন।
স্বপ্না অবাক হয়ে বলল, সে কী! তোমার বাবা অতবড় একজন গোয়েন্দা
অফিসার, আর তুমি এই কথা বলছ?
হিরণ বলল, শুনবে? কিন্তু কথা দাও কাউকে এসব কথা বলবে না?
স্বপ্না-রিয়া দু’জনেই বলল, কথা দিলাম।
হিরণ তখন এক এক করে সব কথা খুলে বলল ওদের।
ওরা সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। বলল, তা হলে তো যে কোনও মুহূর্তে প্রতিশোধ নেবার জন্যে ওরা এসে হাজির হতে পারে এখানে।
তাই চুপচাপ শুয়েছিলাম। আর ভাবছিলাম কত কিছু।
রিয়া বলল, কিন্তু এইভাবে কতদিন ঘরে বসে থাকবে?
জানি না। তবে আগামী দু’–একটা দিন হয়তো যাব না। তার মধ্যে আশা করি কিছু একটা হয়ে যাবে। যতক্ষণ না কিছু হয় ততক্ষণ ঘরেই পড়াশোনা করি।
স্বপ্না বলল, ঘরের পড়াশোনা মানে তো গল্পের বই।
হিরণ বলল, তখন পড়ছিলাম বলে? আরে না না।
গল্পের বই পড়ি সময় কাটাবার জন্যে। স্কুলের বই পড়তে আমি কিন্তু একদম ফাঁকি দিই না।
রিয়া হঠাৎ বলল, আচ্ছা হিরণদা, তুমি ওই কার্লস জ্যাকল না, কী যেন নাম বললে, যতদিন না লোকটা ধরা পড়ে ততদিনের জন্যে তুমি দূরে কোথায় চলে যেতে পার না?
কোথায় যাব? কার কাছে যাব? কেউ তো নেই আমাদের।
ধরো না কেন, আমাদের সুন্দর পাহাড়িতেই যদি যাও?
হিরণ হেসে বলল, তা হলে তো খুব ভালই হয়, তবে কি না জেনেশুনে অকারণে তোমাদের শান্তির নীড়ে অশান্তির বীজ পুঁতে আসব কেন? অশান্তির বীজ!
তা নয়তো কী? কার্লস জ্যাকলের নজর এড়িয়ে আমি বাঁচব কোথায়? জলের তলায় লুকোলে ও সেখানে থেকেও খুঁজে বার করে আনবে আমাকে। লোকটা এতবড় শয়তান যে অত কড়া প্রহরা সত্ত্বেও সকলের নজর এড়িয়ে একটা কাটা মুণ্ডু ঠিক গিয়ে রেখে তো এল।
তাতে কী?
তাতে কী মানে? আমার ওপর বদলা নিতে গিয়ে তোমাকেই তুলে নিয়ে যাবে যখন, তুমি কী করবে?
এত সস্তা নাকি? ছুঁয়ে দেখুক না একবার আমাকে।
স্বপ্না বলল, তুই যে দেশলাই কাঠির বারুদের মতো ফস করে উঠলি। ব্যাপারটা কী? তোর সেই লজ্জা কোথায় গেল?
রিয়া বলল, হিরণদাকে দেখে ওর কথা শুনে কেন জানি না আমার আড়ষ্ট ভাবটা কেটে গেছে। শুধু তাই নয়, আমার কী মনে হচ্ছে জানিস, কেউ হিরণদার গায়ে হাত দিতে এলে তার দুটো হাতই কেটে দিই।
বলিস কীরে ! খুব সাহস দেখছি।
আজকাল সাহসী না হলে বাঁচার উপায় আছে? মেয়েরা যদি মেয়েই হয়, আর ঘোমটা টানা বউ হয় তা হলে কিন্তু অশেষ দুর্গতি তাদের।
হিরণ বলল, আমি কিন্তু এই ব্যাপারে এক মত। সরকার এক সময় আইন করে বাঙালির হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিলেন! কিন্তু সেই দিন আসছে যেদিন আবার আইন করে সকলকেই আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র নিতে বাধ্য করা হবে। বিশেষ করে মেয়েদের।
রিয়া হ্যান্ডসেক করবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল হিরণের দিকে।
হিরণ ওর হাতে হাত মেলাল। আর ঠিক তেমনি সময় টেলিফোন বেজে উঠল তার মতো করে। ক্রিরিরিং… ক্রিরিরিং—। হিরণ ছুটে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে কানের কাছে ধরে অভ্যস্ত গলায় বলল, হ্যালো।
কে হিরণ নাকি?
বলছি। আপনি কে?
তুমি আজ স্কুলে গেলে না কেন?
আমি আর কখনও স্কুলে যাব না।
না, না। স্কুলে যাবে, লেখাপড়া শিখবে। পাস করে কলেজে ভরতি হবে। তবে না? তোমার বাবা কিন্তু খুব ভয় পেয়ে গেছেন। আমি বলি ভয় কী? মরতে তো একদিন হবেই। দু’দিন আগে, না হয় পরে।
হিরণ উত্তেজিত গলায় বলল, কিন্তু আপনি কে? আপনার নাম বলছেন না কেন?
আরে আমি কি তোমার বাবার মতন সি আই ডি অফিসার, যে নাম বললেই তুমি চিনবে। আমি একটা ফালতু লোক।
তা হলে তুমি বিদেয় হও। বলেই সশব্দে নামিয়ে রাখল রিসিভারটা।
মা পাশের ঘর থেকে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, কে ফোন করেছিল রে?
সেই শয়তান লোকটা নয় তো? কী বলল সে?
পরিচয় দিল না। শুধু জানতে চাইল আমি স্কুলে যাইনি কেন?
শিউরে উঠলেন মা, সে কী!
স্বপ্না ও রিয়ার মা পাশেই ছিলেন। বললেন, কী ঝামেলা বাবা। আবার ছেলেপুলের ওপর নজর দেওয়া কেন?
ওকে আমি পই পই করে বলেছিলাম শয়তানটাকে ধরেই শেষ করে দিতে। কিন্তু কেন যে শুনল না ও আমার কথা।
এমন সময় প্রচণ্ড শব্দে একটা বোমা ফাটল বাইরের দরজার কাছে। পরক্ষণেই একটা গুলির শব্দ। কে যেন আর্তনাদ করে উঠল, আ-আ-আ। ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল চারদিক। হিরণ দরজা খুলে দেখতে যাচ্ছিল। স্বপ্না আর রিয়া দু’দিক থেকে দুটো হাত টেনে ধরল ওর।
মা বললেন, যাচ্ছিস কোথায়? এই অবস্থায় কেউ বাইরে যায়?
বাইরে তখন প্রচণ্ড হট্টগোল।
হিরণ বলল, আমাকে বাইরে যেতে না দাও ছাদে উঠে দেখতে দাও অন্তত। দরজার সামনে বোমা, গুলি। কী থেকে কী হল দেখতে হবে না?
অতএব সবাই ছাদে উঠল। ছাদে উঠে যে দৃশ্য দেখল, সেই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেল সকলেই। দেখল ডোরা কাটা লুঙ্গিপরা নিম্নশ্রেণীর এক মুসলমান যুবক পথের ওপর উপুড় হয়ে ছটফট করছে। তাকে ঘিরে জনতার ভিড়। এই যুবকই বাড়ির সামনে বোমা ফাটিয়েছিল। কিন্তু ওর কী হল? হিরণের মনে হল নীচে নেমে এসে একবার ভাল করে সার্চ করে দেখে লোকটিকে। কিন্তু না। তা সে করল না। এ কাজের জন্যে বাপি তো আছেন।