লালবাজারে রাহাজানি – ১০

দশ

কার্লস জ্যাকল ঘরে ঢুকেই বলল, মংপুর ওইরকম হাল কে করেছে? রিয়া ওর মূর্তি দেখে কাঁপতে লাগল ভয়ে। বলল, আমরা।

আমরা মানে? আর কে ছিল?

রিয়া সভয়ে মুখটা নামিয়ে নিল।

বুঝেছি, সেই শয়তানের বাচ্চাটা। ওটাকে আমি জ্যান্ত কবর দেব।

রিয়া বলল, ওর তো কোনও দোষ নেই। তোমার মংপুই তো বাড়ির ভেতর ঢুকে বেয়াদপি আরম্ভ করেছিল। আমরা তার প্রতিফল হাতে হাতে দিয়েছি।

আর আমি তার প্রতিদান মুখে মুখে দেব। তোর এই সুন্দর মুখে যখন অ্যাসিডের বোতলটা উপুড় করে দেব তখন যা দেখতে লাগবে না তোকে। আমি কম করেও একশোটা মেয়ের মুখে অ্যাসিড ঢেলেছি। আসলে কারণ কী জানিস, সুন্দর মুখ আমি সহ্য করতে পারি না। আমি চাই সবার মুখই আমার মতন কুৎসিত হোক। ভগবান আমাকে যেমন কুৎসিত করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তেমনি তাঁর সৃষ্টিতেও সব কিছুই কুৎসিত হয়ে যাক। ভগবানকে পেলে তার মুখেও আমি অ্যাসিড ঢেলে দিতাম।

রিয়া বলল, তার মানে আপনি ভগবান বিশ্বাস করেন?

আরক্ত চোখে কার্লস জ্যাকল বলল, একটু একটু। তবে

ভগবানকে ভয় পাই না। কেন না তিনি কখনও আমার সঙ্গে থাকেন না।

তা হলে আপনার গলায় ওই যিশুক্রশটা রেখেছেন কেন? ফর শো।

এমন সময় যে লোক দু’জন রিয়াকে এনে এখানে রেখেছিল তারা চাপা গলায় ফিস ফিস করে কী যেন বলতেই, চলে গেল কার্লস জ্যাকল।

অল্পবয়সি বামনাকৃতি একজন দরজার কাছে পাহারায় রইল। দরজার পাশেও ছোট্ট একটি জানলা। রিয়া সেখান দিয়ে উঁকি মেরে দেখল বামনটিকে। বামনটিও রিয়ার মুখের আকর্ষণে বার বার তাকাতে লাগল।

রিয়া কাছে ডাকল বামনকে, এই শোনো।

কী? বামন এগিয়ে এসে বলল,

নাম কী তোমার?

আমার নাম বেঁটে বাঁটুল।

তুমি বাঙালি?

হ্যাঁ। তোমার বাড়ি কোথায়?

মছলন্দপুর নাম শুনেছ? ওইখানে। আমার ঘরবাড়ি সবই এখন এখানে। আমি একা। কেউ নেই আমার।

এদের হয়ে কাজ করছ কতদিন?

তা ধরো না কেন বছর দশেক।

এইসব খারাপ লোকেদের সঙ্গে কাজ করে নিজের জীবনকে নষ্ট করছ, যদি ধরা পড় ফল কী হবে জানো?

কী হবে? কিচ্ছু হবে না। ধরা পড়লে খুব জোর দু’-চার বছর জেল হবে। তার বেশি কিছু নয়। আমরা তো চুনোপুঁটি। পেটের দায়ে চাকরি করছি। তা ছাড়া আমাকে ধরতে এলে পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে পালাব আমি।

তুমি যখন একা, তখন পেটের দায়ে এই কাজই বা করছ কেন? ভাল কাজ করতে পারো না? তা হলে তো পায়ের ফাঁক দিয়ে পালাতে হয় না।

আমি খারাপ কাজটা কী করছি? তুমি ঘরে আছ, আমি বাইরে থেকে তোমাকে পাহারা দিচ্ছি। এর বেশি তো কিছু নয়।

এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যেতেই বামন বলল, চুপ। আর কোনও কথা বোলো না আমার সঙ্গে। জানলা বন্ধ করো।

রিয়া জানলা বন্ধ করে পিছিয়ে এল।

একটু পরেই দেখল একজন লোক একটা শালপাতার ঠোঙায় গোটাকতক কচুরি আর একটা মিষ্টি রেখে চলে গেল।

রিয়ার খিদে পেয়েছিল খুব। সে খাবার খেয়ে, কলসি থেকে জল পান করে জানলা খুলে আবার ডাকল, এই।

বামন কাছে এসে বলল, কী বলছ?

রিয়া বলল, আমাকে কেমন দেখতে বলো তো?

বামন সরল হেসে বলল, খুব সুন্দর দেখতে।

কার্লস জ্যাকল কি সত্যিই আমার এই মুখটাকে অ্যাসিড ঢেলে পুড়িয়ে দেবে? বামন চুপ করে থেকে বলল, ওর অসাধ্য কিছুই নেই। তবে আমাদের ডলফিনসাহেবের আদেশ না-পাওয়া পর্যন্ত কিছুই করবে না ও।

ডলফিনসাহেব! তিনি আবার কে?

আমাদের বিগ বস। অর্থাৎ গড ফাদার যাকে বলে।

ও নাম তো শুনিনি কখনও?

উনি গভীর জলের মাছ। ওনার নির্দেশেই সব কিছু হয়। কিন্তু সন্ত্রাসের নাম কার্লস জ্যাকল। এই যে এত খুন, জখম, ব্যাঙ্কডাকাতি সবই হচ্ছে ওনার পরিকল্পনায়। নিজে উনি মঞ্চে আসেন না। তবে সকলকে মদত দেন। রিয়া বলল, শোনো, আমার এই সুন্দর মুখটা যদি পুড়িয়ে দেয় ওরা, তা হলে কী হবে বলো তো? তাই বলি তুমি এক কাজ করো না ভাই—।

বামন ভয়ে ভয়ে বলল, কী কাজ?

আমাকে এখান থেকে পালিয়ে যাবার একটা উপায় বলে দাও না।

তারপরে আমার অবস্থা কী হবে জানো? তা ছাড়া পালিয়ে তুমি যাবে কোথায়? ওরা ঠিক তোমাকে খুঁজে বার করবে।

রিয়া বলল, আরে পালিয়ে কি আমি একা যাব? তোমাকেও সঙ্গে নেব। তুমিও তো যাবে আমার সঙ্গে।

আমি যাব তোমার সঙ্গে?

নিশ্চয়ই। আমি একা যাব কেন? আমি কি এখানকার পথঘাট কিছু চিনি? পালিয়ে গেলে হবে কী, আমারও মুখ পুড়বে না, তুমিও প্রাণে মরবে না। এই তো পাশেই রেলপথ, চলো না আমরা দু’জনে ট্রেনে চেপে কোথাও পালিয়ে যাই।

বামন এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল একবার। তারপর বলল, শোনো, আমারও যে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না তা নয়। কিন্তু সেরকম সঙ্গী পাইনি বলে যাইনি। তা ছাড়া এরাও শুনছি বেশিদিন থাকবে না এখানে। বাসব মজুমদার নামে যে পুলিশ অফিসার আছে তাকে আর অন্য দু’জনকে খুন করেই ওরা চলে যাবে। বিহারের দলমা পাহাড়ের কোলে ডিমনা লেকের কাছে কোথায় যেন পাঁচ তারা হোটেল করেছে ওরা সেইখানে যাবে। নাম দিয়েছে লালমহল।

তাই না কি? তবে তো ভালই হল। ওরা যদি বিহারে যায়, আমরা যাব উত্তরপ্রদেশে। কিছু টাকা-পয়সা হাতিয়ে আমাকে নিয়ে পালাও না তুমি। তোমার মা-বাবা যদি পুলিশে খবর দিয়ে থাকেন, পুলিশ যদি পিছনে লাগে আমাদের?

আমার মা-বাবাই নেই তো পুলিশে খবর দেবে কে? আমি তো বাসব মজুমদারের বাড়ি কাজ করি।

তুমি মিথ্যে কথা বলছ। কাজের মেয়ের চেহারা তোমার নয়।

বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? আচ্ছা, আমার যদি মা থাকত তা হলে কী আমি এতক্ষণ তাদের জন্যে একবারও কাঁদতাম না? আমার চোখে কি একটুও জল দেখেছ? তবে আমার মুখ পুড়িয়ে দেবে শুনে আমি দারুণ ভয়ে পেয়ে গেছি।

বামন বলল, না না, তোমার এমন সুন্দর মুখ কখনও নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া এইভাবে বেঁচে থাকতে ভালও লাগছে না আমার। ডলফিনসাহেবের গোডাউনে বেশ ছিলাম। কিন্তু এই কার্লস জ্যাকলটা ফিরে আসার পর থেকেই হতচ্ছাড়া জায়গায় ডিউটি পড়েছে আমার। বাসব মজুমদার খুন না-হওয়া পর্যন্ত ওরা এখানে থাকবে। শুধু বাসব মজুমদার নয়, ওর ছেলেটাও নোটিশে আছে ওদের।

রিয়া বলল, ওর অপরাধ?

আমরা আদার ব্যাপারী। অত খোঁজে আমাদের দরকার কী?

রিয়া বলল, ঠিক বলেছ। এখন আমাদের আসল কাজ হল এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া। তুমি সেই ব্যবস্থাই করো। তুমি গোলাগুলি ছুড়তে পার তো? বামন হেসে বলল, কী যে বল। এই দ্যাখো একটা পয়েন্ট থ্রি এইট রিভলভার। যা তা জিনিস নয়। এটা সব সময় আমার সঙ্গে থাকে।

রিয়া বলল, ঠিক আছে। তবুও তুমি আমাকে ধারালো ছোরা একটা এনে দেবে। পালাতে গিয়ে যদি কোনও বিপদ হয় তা হলে নিজেকে রক্ষা করতে পারব। আমাকে কেউ মারতে এলে তুমি রুখবে, তোমাকে কেউ মারতে এলে আমি রুখব।

বামন বলল, ভারী মজার ব্যাপার তো। যাক, তোমাকে নিয়ে আমি পালাবই।

কেউ আমাকে রুখতে পারবে না। তবে এখনই নয়, সন্ধের পর। এখন গেলে জানতে পারবে ওরা। তুমি জানলা বন্ধ করে চুপচাপ থাকো। আমি সব ব্যবস্থা করছি। তোমার নামটা তো আমার জানা হল না।

রিয়া বলল, আমার আবার নাম। আমার নাম খুকুমণি।

বাঃ, বাঃ। কী সুন্দর নাম। কিন্তু খুকুমণি, তুমি আমাকে ফেলে পালাবে না তো? তা হলে কিন্তু মনে আমি খুব দুঃখু পাব।

ছিঃ ছিঃ। কী যে বলো, আমাকে তা হলে দেখবে কে? আমার বুঝি কেউ আছে?

তা ঠিক, তা ঠিক। আমি বরং কোথাও একটা দোকানটোকান দেখে কাজকর্ম জুটিয়ে নিয়ে চালিয়ে নেব দু’জনের, কী বলো?

তবে? তোমার মতন সুন্দর মানুষ কি হয়?

কী বললে? আমি সুন্দর? সবাই আমাকে বেঁটেবাঁটুল বলে, আর তুমি আমাকে সুন্দর বলছ?

নিশ্চয়ই। যার মন সুন্দর, তার সবই সুন্দর। চেহারাটাই কী সব? যে অন্যের ভাল করতে চায় তার ভালই হয়। তুমি যখন আমার ভাল করতে চেয়েছ তোমার ভাল তখন হবেই।

বামন বলল, আমি তোমার জন্যে জীবন দিয়ে দেব খুকুমণি। তুমি চুপ করে

বসে থাকো, আমি এখুনি একবার এলুম বলে।

বামন চলে গেল দরজায় তালা দিয়ে।

রিয়া বুঝল টোপ গিলেছে বামনটা। একে দিয়েই কাজ হবে।

খানিক বাদেই বামন আবার ফিরে এল। তার হাতে এক প্যাকেট ভাল ভাল খাবার। বলল, নাও। তুমি পেট ভরে এগুলো খেয়ে নাও দেখি, আর এই টাকাগুলো তোমার কাছে রেখে দাও। আমি আরও টাকা নিয়ে আসছি। অনেক টাকা লাগবে তো আমাদের।

কিন্তু আমার ছোরা? আমার যে একটা ধারালো ছোরা চাই।

বামন বলল, সে ব্যবস্থা হবে।

রিয়া বলল, তা হলে ঠিক সন্ধের সময়। মনে থাকবে?

মনে থাকবে না মানে? এই সুযোগ কখনও ছাড়ি? দরকার হলে কার্লস জ্যাকলকেও আমি খতম করে দেব। শত্রুর শেষ আমি রাখব না।

রিয়া অভিনয় করল, খবরদার ও কাজ করতে যেয়ো না। কার্লস জ্যাকলকে মারতে গিয়ে যদি তুমি মরো, তা হলে কিন্তু এই জগতে আমার আর কেউ থাকবে না।

বামন বলল, আচ্ছা, আচ্ছা। সে দেখা যাবে। তুমি ততক্ষণে মনে মনে ঠিক করো আমরা কোথায় যাব। কেন না দূরের পথঘাট আমি চিনি না।

রিয়া বলল, আমি চিনি। আমি অনেকবার চিত্তরঞ্জনে গেছি। প্রথমে আমরা সেইখানেই চলে যাব। তারপর সেখানে গিয়ে ঠিক করব কোথায় কোন দূরদেশে যাওয়া যায়।

বামন বলল, আর কোনও কথা নয়। আমি শুধু তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থাটা পাকা করে আসি। সন্ধে হলেই লোডশেডিং হবে আর সেই সুযোগে আমরাও পালাব।

রিয়া জানলার পাল্লা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল। পা-টা জখম তাই। না হলে মুক্তি পেলে ছোটা কাকে বলে দেখিয়ে দিত। তবু কোনওরকমে একবার যদি পালাতে পারে এখান থেকে সেই আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল ও।

সন্ধের পরই লোডশেডিং হয়ে গেল। ইতিমধ্যেই এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে রিয়া মনে মনে অনেকরকম পরিকল্পনা করে ফেলেছে। কিন্তু বামনটা আসছে না কেন? তার কোনও সাড়াশব্দও নেই। কী হল তার?

অনেক পরে রিয়া জানালাটা একবার ফাঁক করতেই দেখল অন্য একজন লোক বসে আছে সেখানে। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল ওর। বোকাটা নিশ্চয়ই কার্লস জ্যাকলকে কোনওভাবে টেক্কা দিতে গিয়ে গোলমাল বাধিয়ে বসে আছে। নইলে তো এমন হবার কথা নয়। অথচ বুদ্ধি করে একটা ছোরা যদি আগে ভাগে দিয়ে যেত ও, তা হলে যেভাবেই হোক একটু কৌশলে ওই লোকটাকে জখম করে পালাতে পারত। কিন্তু এখন আর তা হবার নয়। রিয়ার চোখে যেন জল এসে গেল।

অন্ধকার ক্রমশ ঘন হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পায়ের ব্যথাও। হাতে একটা ইঞ্জেকশানও করেছে ওরা। সেখানেও ব্যথা লাগছে। কিন্তু জীবন যেখানে বিপন্ন সেখানে এসব ব্যথা কিছুই নয়। এত অন্ধকার, অথচ একটা চিমনির ব্যবস্থাও করল না ওরা। তার ওপর কী সাংঘাতিক কুটকুটে মশা। যেখানে কামড়াচ্ছে সেখানটাই ফুলে উঠছে।

এইভাবে অনেকক্ষণ অতিবাহিত হবার পর রিয়ার মাথায় একটা পরিকল্পনা এল। অন্ধকার হাতড়ে জলের কলসিটা নিয়ে সে সরে এসে দাঁড়াল দরজার একপাশে। তারপর আচমকা একটা চিৎকার দিতেই যে লোকটি পাহারায় ছিল সে ছুটে এল, ক্যা হুয়া? কাহে চিল্লাতা?

রিয়া বলল, কী একটা কামড়ে দিল আমার পায়ে।

লোকটি দরজা খুলে যেই না টর্চ ফেলে দেখতে গেল ভেতরটা, অমনি রিয়া সেই জলপূর্ণ কলসির বাড়ি তার মাথায় বসিয়ে দিল এক ঘা। দিয়েই বাইরে এসে শেকল তুলে দিল দরজাতে।

লোকটি তখন ভীষণ চিৎকার করছে। আর লাথি মেরে ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করছে দরজাটা।

রিয়া দেখল মহা বিপদ। এখুনি তো লোকজন ছুটে আসবে এই হাঁক ডাকে। সে তখনই মন স্থির করে এদিক ওদিক তাকিয়েই ছাদের এক কোণে একটা মরচে ধরা শাবল দেখতে পেল। শাবলটা কুড়িয়েই সে সশব্দে খুলে দিল দরজার শেকলটা।

লোকটি তেমনিই চেঁচাতে চেঁচাতে ভিজে জামাকাপড়ে বেরিয়ে এল, আরে ভাগারে ভাগারে ভাগা। পাকড়ো… পাকড়ো…

আর চেঁচাতে হল না, রিয়া শাবলের বাড়ি সজোরে এক ঘা দিতেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল লোকটা।

ও তখন কোনদিক দিয়ে যে পালাবে কিছুই ঠিক করতে পারল না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে বিপদ। আবার ছাদের আলশে ধরেও লাফিয়ে পড়া যায় না! এই বাড়ির পাশেই ছাদ আছে। কিন্তু উচ্চতা যা তাতে সেখানেও লাফিয়ে পড়া অসম্ভব। এখানে ঘিঞ্জি গলির ভেতর গায়ে গায়ে বাড়ি। কোনও গাছপালার ডাল ঝুঁকে নেই যে সেটা ধরে পালাবে। ততক্ষণে লোকটির রিভলভার ও টর্চ ও হাতে নিয়েছে। এদিকে সিঁড়িতেও ধুপধাপ শব্দ। পালানোর রাস্তা একদম নেই দেখে রিয়া ছুটে এসে সিঁড়ির দরজায় শেকল দিল। এইভাবে কিছু সময়ও যদি লোকগুলোকে আটকে রাখা যায় তো মন্দ কী?

ওরা এসে ধাক্কা মারতে লাগল দরজায়। আর রিয়া আলশের কাছে এসে পাশের ছাদেই লাফিয়ে পড়বার মন করল। এমন সময় হঠাৎই সে দেখতে পেল একটা লম্বা দড়ি পিলারের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় নীচের দিকে ঝুলছে। এ নিশ্চয়ই বামনটার কাজ। এইভাবেই ওদের পালাবার পথ সুগম করে রেখেছিল সে, কিন্তু কোনওকারণে সেই সুযোগ আর পেল না বেচারি। ও আর একটুও সময় নষ্ট না করে, সেই দড়ি ধরেই ঝুলে পড়ল। তারপর সুড়সুড় করে নেমে এল পাশের ছাদে। সেখান থেকেও ওই একই কায়দায় গলির মুখে।

পথ যে কোন দিকে তা সে জানে না। গলি থেকে বড় রাস্তায় যেই পৌঁছল, অমনি কোথা থেকে যেন বামনটা তুড়ক তুণ্ডুক করে লাফাতে লাফাতে এসে হাজির। বলল, এ কি খুকুমণি! কোথায় যাচ্ছ তুমি?

আমি তোমাকেই খুঁজতে বেরিয়েছিলাম।

কী আশ্চর্য! তুমি ওই ঘর থেকে বেরোলে কী করে? রিয়া সব বলল।

বামন বলল, কাজটা তুমি ভাল করোনি খুকুমনি। এখন আর কিছুই করা যাবে না। আমি ভেবেছিলাম একটু বেশি রাতে তোমাকে নিয়ে পালাব। কিন্তু তুমি তো আমাকে বলেছিল সন্ধের পর।

কী করব। হঠাৎ একটা কাজের জন্যে ডলফিনসাহেবের লোকেরা আমাকে ধরে নিয়ে গেল যে। আমি এক ধরনের প্রচণ্ড শক্তিশালী বোমা তৈরি করতে পারি। সেটা রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ফাটানো যায়। সেই বোমা তৈরির কাজে আমাকে যেতে হয়েছিল।

রিয়া বলল, উঃ। কী সাংঘাতিক।

তুমি ভয় পাচ্ছ খুকুমণি? কী করব, এদের দলে এই তো আমার কাজ। ছোটবেলা থেকে এরা আমাকে চুরি করে এনে এই কাজই শিখিয়েছে। আমার চেহারা এমন মর্কটের মতো হলে কী হয়, এই সব কাজে আমি কিন্তু সিদ্ধহস্ত। তেমনি অব্যর্থ আমার হাতের টিপ। ওদের নির্দেশে ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে কত খুন করেছি আমি তার ঠিক নেই। এসব কাজ আমি করতে চাই না। তোমাকে নিয়ে পালিয়ে গেলে আর এসব করব না আমি। তোমার গা ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি আমি।

রিয়া চোখদুটো বড় বড় করে বলল, ওই বোমার সাহায্যে কাকে মারবে ওরা? শুনলাম ফোর জিরো নাইন টু’র একটা হেভি ওয়েটের ট্রাক নিয়ে বস নিজেই গেছেন আজ বাসব মজুমদারের মোকাবিলায়। বড় ধরনের একটা দুর্ঘটনা ঘটাবার পরিকল্পনা আছে। শুধু তাই নয়, উড়ো টেলিফোনে পুলিশকে ডাকিয়ে এনে ওই ঘাঁটির ভেতর ঢুকিয়ে সব কিছু উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনাও হয়েছে।

রিয়া বলল, তুমি কী? মানুষের এমন সর্বনাশ কেউ করতে পারে?

বামন এবার হেসে বলল, তা হলে শোনো, আমি যখন তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার ঠিক করেছি ঠিক সেই সময় ওরা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল বলে আমি কী করেছি, জানো? রাগের মাথায় আমি এমন বোমা তৈরি করেছি যার ভেতরে ধুলো ছাড়া কিছুই নেই।

রিয়া উল্লিসিত হয়ে বলল, সত্যি বলছ তুমি?

তবে না তো কী? আমি চাই ওরা সবাই এবার ধরা পড়ুক। ওরা ধরা নাপড়লে পৃথিবীর কোথাও গিয়ে আমরা শান্তিতে থাকতে পারব না। এখন কার্লস জ্যাকলটাকে একটু শিক্ষা দিতে হবে। কেন না বস বারণ করা সত্ত্বেও ও ঠিক করেছিল আজ রাতের মধ্যেই তোমাদের তিনজনের গলা কেটে মুণ্ডুগুলো তোমাদের বাড়ির সামনে রেখে আসবে। তাই…

রিয়া বিস্মিত হয়ে বলল, আমাদের তিনজনের? আমি তো একা। আর দু’জন কোথায়?

তোমাদের আরও একটা ছেলে আর মেয়েকে তো এইখানেই অন্য একটা বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে ওরা।

কোথায়? কোনখানে? শিগগির চলো, আগে তাদের উদ্ধার করি। আর দেরি হলে যদি ওদের মেরে ফেলে?

বামন বলল, তুমি কোথায় যাবে? তুমি গেলে বিপদ। আমিই বরং যাই। কার্লস জ্যাকলের মুখোমুখি হলে আমি অবস্থাটা সামাল দিতে পারব। কিন্তু তোমাকে দেখলেই ওরা সন্দেহ করবে আমাকে।

আমি তা হলে কোথায় থাকব?

এসো তুমি আমার সঙ্গে।

অন্ধকার গলিপথে খানিকটা গিয়ে একটা জীর্ণ পুরাতন বাড়ির কাছে এসে বামনটা বলল, এর পেছনে ড্রেনের ধারে তুমি লুকিয়ে থাকো। আমি না-আসা পর্যন্ত কোথাও যেয়ো না যেন।

রিয়া বলল, আচ্ছা।

বামনটা একটু পরেই ঘুরে এসে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে খুকুমণি। ওরা তো এখানে নেই।

তা হলে ? তা হলে কী হবে?

এতক্ষণে ওদের ধড়গুলো বোধহয় হাইড্রেনের নীচে।

রিয়া যেন চোখেমুখে অন্ধকার দেখল। এমন সময় হঠাৎ কাদের পদশব্দ শোনা গেল। আর সেই সঙ্গে, এই তো, এই তো এরা এখানে। পালাবে কোথায় বাছাধন।

জোড়া জোড়া টর্চের আলো এসে পড়েছে তখন ওদের ওপর।

কার্লস জ্যাকল।

হ্যাঁ কার্লস জ্যাকলও ছিল ওদের দলে। শক্ত হাতে বামনটার গলা টিপে ধরে কার্লস বলল, বিশ্বাসঘাতক! তোর গায়ে গরম তেল ঢেলে পুড়িয়ে মারব আজ। কী বোমা করে এসেছিস তুই? বলেই এক আছাড়।

বামনটা আর্তনাদ করে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলির গর্জন ডিস্যুম।