লালবাজারে রাহাজানি – ১

এক

সেদিন সকালে খবরের কাগজের পাতায় একটা চাঞ্চল্যকর সংবাদ দেখে চমকে উঠল হিরণ। পর পর ক’দিন ধরেই এইরকম ঘটনার কথা ছাপা হচ্ছে কাগজে। কিন্তু আজকের খবরটা মারাত্মাক। আজকের কাগজে যে খবরটি ছাপা হয়েছে তা শুধু চমকপ্রদই নয়। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

হিরণ যখন কাগজের পাতার ওপর ঝুঁকে খবরটা পড়ছে, তেমন সময় মা এসে ঘরে ঢুকলেন, কীরে ! মুখহাত ধুয়েছিস? আমি এদিকে কখন থেকে চা নিয়ে বসে আছি। জুড়িয়ে জল হয়ে গেল যে।

হিরণ বলল, কাল রাতে বাপি কখন বাড়ি ফিরেছেন মা?

তুই ঘুমিয়ে পড়বার পর।

হিরণ কাগজটা মাকে দেখিয়ে বলল, খবরটা পড়ে দেখো।

মা একবার চোখ বুলিয়েই বললেন, কী দুঃসাহস!

হিরণ বাথরুমে গিয়ে ভাল করে দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর চা-টেবিলে বসে ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুট আর চা খেতে খেতে বার বার পড়ে যেতে লাগল খবরটা।

এমন সময় বাপি এসে পিছনে দাঁড়ালেন। বললেন, কীরে! আজ এত সকালে কাগজ দিয়ে গেল যে? এই তো সবে সাতটা। ও তো ন’টার আগে আসে না।

হিরণ বলল, এই ক’দিন কেন জানি না, একটু সকালসকালই কাগজ দিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। কিন্তু বাপি, কী হচ্ছে এসব তোমাদের ওখানে?

হিরণের বাবা বাসব মজুমদার একজন পদস্থ গোয়েন্দা অফিসার। বললেন, কাগজে বেরিয়েছে বুঝি?

হিরণ বলল, এই দেখো?

বাসববাবু কাগজের খবরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। খবরের শিরোনামে ছিল, লালবাজারে চুরি। গোয়েন্দারা অতিষ্ঠ। সংবাদটা ছিল এইরকম, লালবাজারের ভেতর থেকে চুরির ঠেলায় খোদ গোয়েন্দা বিভাগই অতিষ্ঠ। চোরের হাত থেকে বাঁচতে এখন মোটর বাইক, স্কুটার, এমনকী অন্যান্য মূল্যবান জিনিসও দোতলায় তুলে রাখতে হচ্ছে। গোয়েন্দা বিভাগের দোতলায় সিঁড়ির মুখ এবং একতলার সিঁড়ির পাশের খোলা জায়গাটা নানারকমের মোটর বাইকে বোঝাই। গোয়েন্দা বিভাগের এক পদস্থ অফিসার বলেন, কোনও জিনিসই আর নীচে রাখা যাচ্ছে না। চোরেরা হেডলাইট, ব্যাটারি—সবই খুলে নিচ্ছে। খুলে নেওয়া যায় এমন সব কিছুই চুরি হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে তাঁর ঘরের সামনের অত্যন্ত সুরক্ষিত বারান্দা থেকে একটি আটক করা দামি মোটর বাইকের হেডলাইট ও ব্যাটারি চুরি হয়ে যায়। সবটা পড়ে একটু গম্ভীর হয়ে যান বাসবাবু। তারপর একসময় বললেন, হ্যাঁ। বেশ কিছুদিন ধরেই এইসব উপদ্রবগুলো হচ্ছে।

হিরণ বলল, এরপর হয়তো কাগজওয়ালারা বিদ্রূপ করে সম্পাদকীয়ও লিখবে।

লিখবেই তো। আর সে লেখার হেডিং হবে, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা।

তা যদি হয়, তা হলে এই যে কাগজে সব ফাঁস হয়ে গেল, এতে সাধারণ মানুষের মনে কী প্রতিক্রিয়াটা হবে? সবাই তো বলবে, গোয়েন্দারা যদি নিজেদের ঘর নিজেরা সামলাতে না পারেন, তা হলে সাধারণ মানুষের বিপদে কী করে তাঁরা পাশে এসে দাঁড়াবেন?

মা বললেন, তাই বলে গোয়েন্দারা তো অন্তর্যামী হবেন না।

বাসববাবু বললেন, ওকথা বললে তো জনগণ শুনবে না। কেন না এই কাজের জন্যই যে আমরা মোটা টাকা মাইনে পাচ্ছি। গাড়ি চাপছি। নানারকম সুযোগ সুবিধে পাচ্ছি। এখানে আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের ব্যাপারটা এসে যাচ্ছে না? হিরণ বলল, আসলে আমার মনে হয় বাপি, তোমরা এইসব খুঁটিনাটি

ব্যাপারগুলোর দিকে গোড়ায় খুব একটা নজর দাওনি। তাই এমন হচ্ছে।

ঠিক। এবার থেকে মনে হচ্ছে কোনও কিছুই আর কিছু নয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কেন না এত বেশি ক্রিমিন্যালের আবির্ভাব হয়েছে এই শহরে যে, সবসময় চারদিক থেকে যেন ব্যতিব্যস্ত করে মারছে। আর তারই ফলে অবস্থা এখন এমনই যে কাছা দিতে গিয়ে কেঁাঁচা খুলে যাচ্ছে আমাদের। এককালে চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি এইসবগুলো হত বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরা গোয়েন্দারা যেতাম, তদন্ত করতাম। উপযুক্ত প্রমাণ বা সূত্রসন্ধান পেলে অপরাধীকে ধরতাম। কোনও কিছু না পেলে ব্যর্থ হতাম। কিন্তু এখনকার অপরাধীরা অপরাধ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এবং প্রশাসনকে বিরক্ত এবং বিভ্রান্ত করে মজা পাচ্ছে বেশি। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের চেয়েও ওরা যে অনেক বেশি শক্তিশালী আকারে ইঙ্গিতে সেই কথাটাই যেন বুঝিয়ে দিতে চাইছে।

হিরণ বলল, এটা তা হলে চুরির জন্যে চুরি নয় বলো, রসিকতার জন্যে চুরি! অবশ্যই! না হলে পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে চুরি হয়? এই তো সেদিনের  খবর। দেখেছিস নিশ্চয়ই? ওরা জানে এইসব করলেই কাগজওয়ালারা রসিয়ে রসিয়ে লিখবে আর জনসাধারণ চায়ের পেয়ালায় তুফান উড়িয়ে হাসাহাসি করবে। ধিক্কার দেবে পুলিশকে। এগুলো স্রেফ বদমায়েশি।

হিরণ বলল, আমার মনে হয় বাপি তোমার ধারণাটা যেমন ঠিক, তেমনি এও ঠিক, ওরা আসলে কোনও বড় দলের খুচরো লোক। যারা কি না চাইছে পুলিশ যদি এইসব ছিঁচকে চোরেদের ধরবার জন্যে সব সময় নিজেদের কেন্দ্রে ব্যস্ত থাকে তা হলে নিরাপদে, নিরুপদ্রবে ওরা অবাধ লুণ্ঠন, ব্যাঙ্কডাকাতি ইত্যাদি করতে পারবে।

মা বললেন, তবে যাই বলো বাপু, আমার তো মনে হয় তোমাদেরই ভেতর থেকে কোনও নিচুত্তরের দুষ্ট প্রকৃতির কেউ এইসব করছে। না হলে চোরেদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তারা যাবে লালবাজারে চুরি করতে। ধরা পড়লে মার খেয়ে মরবে তা কি তারা জানে না?

বাসববাবু বললেন, তোমার সন্দেহটাও অমূলক নয়। কেন না ভূত তো সর্ষের ভেতরেও থাকে।

এমন সময় হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠতেই বাসবাবু এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুললেন, হ্যালো! কে বলছেন?

মি. মজুমদার নাকি?

হ্যাঁ, বলছি।

আজকের কাগজে খবরটা দেখেছেন?

এইমাত্র দেখলাম।

লালবাজার অঞ্চলে রাহাজানির ঘটনাটা মনে আছে আপনার?

আপনি কে বলছেন?

আপনার একজন পুরাতন বন্ধু, কার্লস জ্যাকল।

রাগে লাল হয়ে উঠল বাসববাবুর মুখ। বললেন, তুমি জেল থেকে ছাড়া পেলে কবে?

আরে! আমি তো উমর কয়েদের আসামি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আমার। জেল খাটতে ভাল লাগল না বলে জেলভেঙে পালিয়ে এলাম। তাই ভাবলাম আমার এই শুভমুক্তির খবরটা আপনাকেই প্রথম জানানো উচিত। এবার তো মাঝেমধ্যেই দেখাসাক্ষাত হবে। তাই হঠাৎ দেখে ভূত ভেবে যাতে চমকে না ওঠেন সেইজন্যেই ফোন করে জানিয়ে দিলাম। একটা চায়ের দোকানে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎই খবরটা চোখে পড়ল। লালবাজারে চুরি! হাঃ হাঃ। আমি লালবাজার অঞ্চলে রাহাজানি করে ধরা পড়েছিলাম খড়্গপুরের গোলবাজারে। আর খোদ লালবাজারের ভেতরে আপনারই দপ্তরের মধ্যে চোরেরা দিনের পর দিন দিব্যি চুরি করে বহাল তবিয়েতে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এ কেমন রসিকতা মি. মজুমদার?

বাসববাবু কঠিন গলায় বললেন, তোমার আর কিছু

বলার আছে?

বলবার তো অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার পুনরাবির্ভাবে আপনি মোটেই সন্তুষ্ট নন। ঠিক আছে। পরে বরং একদিন একটু ভাল করে আলাপ আলোচনাটা করা যাবে। কী বলুন?

বাসববাবু সশব্দে রিসিভারট! নামিয়ে রাখলেন।

হিরণ বলল, কার ফোন বাপি?

বাসববাবু নিরুত্তর।

লোকটা কি মোস্ট ডেঞ্জারাস? না হলে তুমি অমন গম্ভীর হয়ে গেলে কেন? মা বললেন, কে ও? কোনও খুনের আসামি বুঝি?

বাসববাবু গম্ভীর মুখে বললেন, লালবাজারে রাহাজানির সেই নায়ককে তোমার মনে আছে?

সেই সাংঘাতিক লোকটা? কী যেন নাম, কার্লস জ্যাকল না কী?

হ্যাঁ। শেয়ালের মতো মুখ। হায়নার মতো চোখ। আর চিতার মতো হিংস্র।

সেই লোকটাকে তুমিই তো কোনও একটি কুখ্যাত অঞ্চল থেকে ধরে এনে জেলে ঢুকিয়েছিলে। লোকটা এত তাড়াতাড়ি জেল থেকে ছাড়া পেল কী করে? না। ছাড়া সে পায়নি। জেলভেঙে পালিয়ে এসেছে।

হিরণ বলল, কার্লস জ্যাকল! এ নাম আমি তোমার মুখে অনেকবার শুনেছি।

শুধু মজা দেখবার জন্যেই মেয়েদের মুখে অ্যাসিড বাল্ব ছুড়ে মজা দেখত লোকটা। গ্রামগঞ্জ থেকে ছেলেমেয়ে চুরি করে এনে কলকাতার ফুটপাথে ছেড়ে দিত। আর সবচেয়ে বড় কথা—।

টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল।

বাসববাবু ফোন ধরেই জিজ্ঞেস করলেন, হ্যালো! কে বলছেন? স্যার আমি লালবাজার থেকে ফোন করছি নীহার তালুকদার।

কী ব্যাপার বলো।

এই একটু আগে একটা প্যাকেট পেলাম। তাইতে মোড়কের ভেতরে একটি কাটা মুণ্ডু পাওয়া গেছে। তার কপালে লেখা আছে বাসব মজুমদার।

তুমি রসিকতা করছ না তো?

না স্যার। তবে প্রেরকের নাম দেখে বিস্মিত হয়েছি।

কী নাম তার।

কার্লস জ্যাকল।

আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। তোমরা গাড়ি পাঠাও।

মা বললেন, কোথায় যাচ্ছ?

লালবাজার। আবার সেই শয়তানের খেলা শুরু হয়ে গেছে। কত নিরীহ লোকের মাথা যে যাবে এবার তা কে জানে? আজই একজনের কাটা মুণ্ডু উপহার পাঠিয়েছে লালবাজারে।

মা শিউরে উঠলেন, কার ?

জানি না। তবে আমার নাম লেখা আছে তাতে।

হিরণ সবিস্ময়ে বলল, তোমার নাম লেখা আছে কেন বাপি? হয়তো বোঝাতে চাইছে কার্লস জ্যাকেলের পরের শিকার আমি। মা বললেন, তুমি তা হলে যাবে না, কিছুতেই যাবে না ওখানে। বাসববাবু বললেন, যেতে আমাকে হবেই। যাওয়াটাই আমার কাজ। চাকরি তো ছাড়তে পারব না। তা ছাড়া গায়ে নোংরা মাখলে যেমন যমে ছাড়ে না, তেমনি চাকরি ছেড়ে বনে গেলেও ওরা আমাকে ছেড়ে দেবে না। বরং এইখানেই আমার চ্যালেঞ্জ।

সারাজীবন ধরে শুধু চ্যালেঞ্জই নাও তোমরা, আর আমরা শাঁখাসিঁদুর খোয়াবার ভয়ে ঘরের কোণে বসে ভগবানকে ডাকি। এই ধরনের ক্রিমিন্যালদের ধরার সঙ্গে সঙ্গেই মেরে ফেলতে পার না?

বাসববাবু তৈরি হতে হতেই বললেন, গোয়েন্দা বা পুলিশের কাজ তো প্রাণ নেওয়া নয়। অপরাধীকে হাতেনাতে ধরে শাস্তি দেওয়া। এতেই তাদের আনন্দ। তার চেয়েও বেশি আনন্দ বোধহয় আমাদের মতো নিরীহ মানুষগুলোর জীবন উৎকণ্ঠায় ভরিয়ে দেওয়ায়। এই যে জেল ভেঙে পালিয়ে এল লোকটা, অকারণে প্যানিক সৃষ্টির জন্যে একজন নিরীহ মানুষের মাথা নিল, এর জন্য দায়ী কে? তোমাদের ভুল সিদ্ধান্ত আর আইনের প্রতি আনুগত্য নয় কী? কত কষ্ট করে দিনের পর দিন নিজের জীবন বিপন্ন করে কী ভাবে লোকটাকে ধরেছিলে সে কথা কি ভুলে গেছ? কার্লস জ্যাকল হল ফাঁকা মাঠের বেড়াল। একবার যখন ও বেড়া টপকে পালিয়েছে আর কখনও ওকে ধরতে পার? এখন আমার একটাই ভয়, ও তোমার না কিছু করে বসে।

বাসববাবু বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললেন, আমার ব্যাপারে এখুনি খুব বেশি চিন্তাভাবনা না করলেও চলবে। শুধু ছেলেটাকে সাবধানে রেখো। একা যেন অকারণে বেশি ঘোরাফেরা না করে। আমার ভয় ওকে নিয়ে। তোমারও ক্ষতি করতে পারে তবে থাবা যখন বাড়িয়েছে তখন প্রথম কোপটা ওরা ওকেই দেবে।

মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

একটু পরেই গাড়ি এল। বাসববাবু স্ত্রী-পুত্রকে সাবধানে থাকতে বলে দারুণ উত্তেজনা নিয়ে চলে গেলেন। একজন লোক মোড়ের মাথার চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। পুলিশের গাড়ি চলে যেতেই লোকটি দোকান থেকে বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর সিগারেটে দু’-একটা টান দিয়ে সেটা আধখাওয়া করে ফেলে দিল রাস্তায়। জুতো দিয়ে চেপে আগুনটা নিভিয়ে দিল। দিয়ে বাসববাবুর বাড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পথের বাঁকে হারিয়ে গেল সে।