লর্ড রিপণের উৎসবের জমা-খরচ
এ উৎসবে আমরা পাইলাম কি? হারাইলাম কি? যে সঞ্চয়ী লোক, সে সকল সময়ে আপনার জমা-খরচটা খতাইয়া দেখে। আমাদের জাতীয় জমা-খরচটার মধ্যে মধ্যে কৈফিয়ৎ কাটিয়া দেখা ভাল। আগে দেখা যাউক, আমাদের লাভের অঙ্কে কি?
প্রথমতঃ, আমরা এ উৎসবে লাভ করিয়াছি রাজভক্তি। অনেকে বলিবেন, আমাদের রাজভক্তি ছিল বলিয়াই, উৎসব করিয়াছি। সকলেই বুঝেন যে, ঠিক তাহা নহে ; অন্য কারণে এ উৎসব উপস্থিত হইয়াছে। উৎসবেই আমাদের রাজভক্তি বাড়িয়াছে। রাজভক্তি বড় বাঞ্ছনীয়। রাজভক্তি জাতীয় উন্নতির একটি গুরুতর কারণ। রাজভক্তির জন্য ইহা প্রয়োজনীয় নহে যে, রাজা স্বয়ং একটা ভক্তির যোগ্য মনুষ্য হইবেন। ইংলণ্ডের এলিজাবেথ্ বা প্রুষিয়ার দ্বিতীয় ফ্রেড্রিক, এতদুভয়ের কেহই ভক্তির যোগ্য ছিলেন না। এরূপ নৃশংস-চরিত্র নরনারী পৃথিবীতে দুর্লভ। কিন্তু এলিজাবেথের প্রতি জাতীয় রাজভক্তি ইংলণ্ডের উন্নতির একটা কারণ। ফ্রেড্রিকের প্রতি জাতীয় রাজভক্তি প্রুষিয়ার উন্নতির একটি কারণ।
আমাদের দ্বিতীয় লাভ, জাতীয় ঐক্য। এই বোধহয়, ঐতিহাসিক কালে প্রথম সমস্ত ভারতবর্ষ এক হইয়া একটা কাজ করিল। আমরা এই প্রথম বুঝিলাম যে, আমাদের মধ্যে ঐক্য ঘটিতে পারে। আমরা এই প্রথম বুঝিলাম, ভারতবর্ষীয়েরা একজাতি।
তৃতীয় লাভ, রাজকীয় শক্তি। রাজকীয় শক্তি কতকটা ঐক্যের ফল বটে, কিন্তু ঐক্য থাকিলেই যে শক্তি থাকে, এমত নহে। সকল সমাজেই, সমাজই রাজা। রাজা সমাজ শাসন করেন বটে, কিন্তু সে সমাজের প্রতিনিধিস্বরূপ। সমাজ রাজার উপর আবার রাজা। কেবল সমাজ রাজার দণ্ড পুরস্কারের কর্তা। যে সমাজ রাজাকে দণ্ডিত বা পুরস্কৃত করিয়া থাকে, সেই সমাজেরই রাজনৈতিক শক্তি আছে। প্রকৃত রাজদণ্ড সেই সমাজেরই হাতে। আজ, লর্ড রিপণকে সুশাসনের জন্য পুরস্কৃত করিয়া ভারতবর্ষীয় সমাজ সেই রাজদণ্ড স্বহস্তে গ্রহণ করিয়াছে। ইহাই স্বাধীনতা।
আমাদের চতুর্থ লাভ,—এটুকু কেবল বাঙ্গালার লাভ;—সমাজের কর্তৃত্ব ভূম্যাধিকারীদের হাত হইতে এই প্রথম মধ্যবিত্ত লোকের হাতে গেল। অর্থাৎ কর্তৃত্ব, ধনের হাত হইতে বুদ্ধি-বিদ্যার হাতে গেল। এখন হইতে বাঙ্গালায় ধনবানেরা আর কেহই নহেন, শিক্ষিত সম্প্রদায়ই কর্তা। ইহা সমাজের পক্ষে বিশেষ মঙ্গলকর, উন্নতির লক্ষণ, এবং উন্নতির সোপান। এখনকার নূতন সমাজ নেতৃগণের নিকট আমাদের নিবেদন, তাঁহারা সমাজ ধীরে ধীরে সুপথে চালাইলে, বিপ্লব না ঘটে।
এই গেল লাভের অঙ্ক জমা। এক্ষণে খরচটা দেখা যাউক।
আমাদের প্রথম ক্ষতি এই যে, এ উৎসবে দ্বেষক ইংরেজ-সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈরিতা বড় বাড়িয়া উঠিল। মুখে যিনি যাহা বলুন, তাঁহারা এ উৎসব কখন মার্জনা করিবেন না। তাঁহাদের সঙ্গে আর গোল মিটিবে না। ইহাতে সময়ে সময়ে আমাদিগকে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইবে।
আমাদের দ্বিতীয় ক্ষতি এই যে, কিছু “ষ্টীম” ছাড়া হইয়াছে, যে সঞ্চিত বলে সমাজ-যন্ত্র দ্রুতবেগে চলিবে, তাহার কিছু ব্যয় হইয়াছে। সেটা নিতান্ত মন্দও হয় নাই। বড় বেশী ষ্টীম জমিলে বিপ্লব উপস্থিত হয়।
আমাদের তৃতীয় ক্ষতি এই যে, গলাবাজির দৌরাত্ম্যটা বড় বাড়িয়া গেল। কথার ছড়াছড়ি বড় বেশী হইয়া গিয়াছে। সেটা কুশিক্ষা। একে ত বাঙ্গালী সহজেই কেবল বাক্য-বাহাদুর, তার উপর বক্তৃতা নামে বিলাতি মালের আমদানি হইয়াছে। সোণা বলিয়া সোহাগা বিক্রয় হইতেছে। আমাদের ভয়, পাছে আপনাদের বাক্জালে আপনারাই জড়াইয়া পড়ি, কথার কুয়াশায় আর পথ দেখিতে না পাই; তুবড়ী বাজির মত মুখে সোঁ সোঁ করিয়া ফাটিয়া যাই।
সে যাহাই হৌক, খরচের অপেক্ষা জমা যে বেশী, তাহাতে কোন সন্দেহই নাই। খরচাগুলি ছোট ছোট, লাভগুলি বড় বড়। উৎসবে আমরা মুনাফা করিয়াছি, এখন রেখে ঢেকে চালাইতে পারিলেই হয়। তবে লাভ কি, লোক্সান কি তাহা না বুঝিয়া, “বেড়ে হয়েছে! বেড়ে হয়েছে!” বলিয়া বেড়ান জাতীয় শিক্ষার পক্ষে ভাল নহে।
–‘প্রচার’, পৌষ ১২৯১, পৃ. ২১৮-২২০।