লম্বকর্ণ
রায় বংশলোচন ব্যানার্জি বাহাদুর জমিন্দার অ্যান্ড অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট বেলেঘাটা—বেঞ্চ প্রত্যহ বৈকালে খালের ধারে হাওয়া খাইতে যান। চল্লিশ পার হইয়া ইনি একটু মোটা হইয়া পড়িয়াছেন; সেজন্য ডাক্তারের উপদেশে হাঁটিয়া একসারসাইজ করেন এবং ভাত ও লুচি বর্জন করিয়া দু’বেলা কচুরি খাইয়া থাকেন।
কিছুক্ষণ পায়চারি করিয়া বংশলোচনবাবু ক্লান্ত হইয়া খালের ধারে একটা টিপির উপর রুমাল বিছাইয়া বসিয়া পড়িলেন। ঘড়ি দেখিলেন—সাড়ে—ছটা বাজিয়া গিয়াছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ। সিলোনে মনসুন পৌঁছিয়াছে। এখানেও যে—কোনও দিন হঠাৎ ঝড় জল হওয়া বিচিত্র নয়। বংশলোচন উঠিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া হাতের বর্মাচুরুটে একবার জোরে টান দিলেন। এমন সময় বোধ হইল, কে যেন পিছু হইতে তাঁর জামার প্রান্ত ধরিয়া টানিতেছে এবং মিহি সুরে বলিতেছে—হুঁ, হুঁ, হুঁ, হুঁ! ফিরিয়া দেখিলেন—একটি ছাগল।
বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছাগল। কুচকুচে কালো নধর দেহ, বড় বড় লটপটে কানের উপর কচি পটলের মত দুটি শিং বাহির হইয়াছে। বয়স বেশী নয়, এখনও অজাতশ্মশ্রু। বংশলোচন বলিলেন—’আরে এটা কোথা থেকে এল? কার পাঁঠা? কাকেও তো দেখছি না।’
ছাগল উত্তর দিল না। কাছে ঘেঁষিয়া লোলুপনেত্রে তাঁহাকে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। বংশলোচন তাহার মাথায় ঠেলা দিয়া বলিলেন—’যাঃ পালা, ভাগো হিঁয়াসে।’ ছাগল পিছনের দুপায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল এবং সামনের দু—পা মুড়িয়া ঘাড় বাঁকাইয়া রায়বাহাদুরকে ঢুঁ মারিল।
রায়বাহাদুর কৌতুক বোধ করিলেন। ফের ঠেলা দিলেন। ছাগল আবার খাড়া হইল এবং খপ করিয়া তাঁহার হাত হইতে চুরটটি কাড়িয়া লইল। আহারান্তে বলিল— ‘অর—র—র’, অর্থাৎ আর আছে?
বংশলোচনের সিগার—কেসে আর একটিমাত্র চুরুট ছিল। তিনি সেটি বাহির করিয়া দিলেন। ছাগলের মাথা ঘোরা, গা—বমি বা অপর কোনও ভাব—বৈলক্ষণ্য প্রকাশ পাইল না। দ্বিতীয় চুরুট নিঃশেষ করিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল— ‘অর—র—র?’ বংশলোচন বলিলেন—’আর নেই! তুই এইবার যা। আমিও উঠি।’
ছাগল বিশ্বাস করিল না, পকেট তল্লাশি করিতে লাগিল। বংশলোচন নিরুপায় হইয়া চামড়ার সিগার—কেসটি খুলিয়া ছাগলের সম্মুখে ধরিয়া বলিলেন—’না বিশ্বাস হয়, এই দেখ বাপু।’ ছাগল এক লম্ফে সিগার—কেস কাড়িয়া লইয়া চর্বণ আরম্ভ করিল। রায়বাহাদুর রাগিবেন কি হাসিবেন স্থির করিতে না পারিয়া বলিয়া ফেলিলেন— ‘শ—শালা।’
অন্ধকার হইয়া আসিতেছে। আর দেরি করা উচিত নয়। বংশলোচন গৃহাভিমুখে চলিলেন। ছাগল কিন্তু তাঁহার সঙ্গ ছাড়িল না। বংশলোচন বিব্রত হইলেন। কার ছাগল কি বৃত্তান্ত তিনি কিছুই জানেন না, নিকটে কোনও লোক নাই যে জিজ্ঞাসা করেন। ছাগলটাও নাছোড়বান্দা, তাড়াইলে যায় না। অগত্যা বাড়ি লইয়া যাওয়া ভিন্ন গত্যন্তর নাই। পথে যদি মালিকের সন্ধান পাই ভালই, নতুবা কাল সকালে যা হ’ক একটা ব্যবস্থা করিবেন।
বাড়ি ফিরিবার পথে বংশলোচন অনেক খোঁজ লইলেন, কিন্তু কেহই ছাগলের ইতিবৃত্ত বলিতে পারিল না। অবশেষে তিনি হতাশ হইয়া স্থির করিলেন যে আপাতত নিজেই উহাকে প্রতিপালন করিবেন।
হঠাৎ বংশলোচনের মনে একটা কাঁটা খচ করিয়া উঠিল। তাঁহার যে এখন পত্নীর সঙ্গে কলহ চলিতেছে। আজ পাঁচ দিন হইল কথা বন্ধ। ইহাদের দাম্পত্য কলহ বিনা আড়ম্বরে নিষ্পন্ন হয়। সামান্য একটা উপলক্ষ্য, দু—চারটি নাতিতীক্ষ্ন বাক্যবাণ, তার পর দিন কতক অহিংস অসহযোগ, বাক্যালাপ বন্ধ, পরিশেষে হঠাৎ একদিন সন্ধি—স্থাপন ও পুনর্মিলন। এরকম প্রায়ই হয়, বিশেষ উদবেগের কারণ নাই। কিন্তু আপাতত অবস্থাটি সুবিধাজনক নয়। গৃহিনী জন্তু—জানোয়ার মোটেই পছন্দ করেন না। বংশলোচনের একবার কুকুর পোষার শখ হইয়াছিল, কিন্তু গৃহিণীর প্রবল আপত্তিতে তাহা সফল হয় নাই। আজ একে কলহ চলিতেছে তার উপর ছাগল লইয়া গেলে আর রক্ষা থাকিবে না। একে মনসা, তায় ধুনার গন্ধ।
চলিতে চলিতে রায়বাহাদুর পত্নীর সহিত কাল্পনিক বাগযুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। একটা পাঁঠা পুষিবেন তাতে কার কি বলিবার আছে? তাঁর কি স্বাধীনভাবে একটা শখ মিটাইবার ক্ষমতা নাই? তিনি একজন মান্যগণ্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, বেলেঘাটা রোডে তাঁহার প্রকাণ্ড অট্টালিকা, বিস্তর ভূসম্পত্তি। তিনি একজন খেতাবধারী অনারারি হাকিম—পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, এক মাস পর্যন্ত জেল দিতে পারেন। তাঁহার কিসের দুঃখ, কিসের নারভসনেস? বংশলোচন বার বার মনকে প্রবোধ দিলেন—তিনি কাহারও তোয়াক্কা রাখেন না।
বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানায় যে সান্ধ্য আড্ডা বসে তাঁহাতে নিত্য বহুসংখ্যক রাজা—উজির বধ হইয়া থাকে। লাটসাহেব, সুরেন বাঁড়ুজ্যে, মোহনবাগান, পরমার্থ তত্ত্ব, প্রতিবেশী অধর—বুড়োর শ্রাদ্ধ, আলিপুরের নূতন কুমির—কোন প্রসঙ্গই বাদ যায় না। সম্প্রতি সাত দিন ধরিয়া বাঘের বিষয় আলোচিত হইতেছিল। এই সূত্রে গতকল্য বংশলোচনের শ্যালক নগেন এবং দূরসম্পর্কের ভাগিনেয় উদয়ের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হয়। অন্যান্য সভ্য অনেক কষ্টে তাহাদিগকে নিরস্ত করেন।
বংশলোচনের বৈঠকখানা ঘরটি বেশ বড় ও সুসজ্জিত, অর্থাৎ অনেকগুলি ছবি, আয়না, আলমারি, চেয়ার ইত্যাদি জিনিসপত্রে ভরতি। প্রথমেই নজরে পড়ে একটি কার্পেটে বোনা ছবি, কাল জমির উপর আসমানী রঙের বেড়াল। যুদ্ধের সময় বাজারে সাদা পশম ছিল না, সুতরাং বিড়ালটির এই দশা হইয়াছে। ছবির নীচে সর্বসাধারণের অবগতির জন্য বড় বড় ইংরেজী অক্ষরে লেখা—CAT। তার নীচে রচয়িত্রীর নাম—মানিনী দেবী। ইনিই গৃহকর্ত্রী। ঘরের অপর দিকের দেওয়ালে একটি রাধাকৃষ্ণের তৈলচিত্র। কৃষ্ণ রাধাকে লইয়া কদমতলায় দাঁড়াইয়া আছেন, একটি প্রকাণ্ড সাপ তাহাদিগকে পাক দিয়া পিষিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু রাধাকৃষ্ণের ভ্রূক্ষেপ নাই, কারণ সাপটি বাস্তবিক সাপ নয়, ওঁ—কার মাত্র। তা ছাড়া কতকগুলি মেমের ছবি আছে, তাদের আঙ্গ সিল্কের ব্রাহ্মশাড়ি এবং মাথায় কাল সুতার আলুলায়িত পরচুলা ময়দার কাই দিয়া আঁটিয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু ইহাতেও তাহাদের মুখের দুরন্ত মেম—মেম—ভাব ঢাকা পড়ে নাই, সেজন্য জোর করিয়া নাক বিঁধাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ঘরে দুটি দেওয়াল—আলমারিতে চীনেমাটির পুতুল এবং কাচের খেলনা ঠাসা। উপরের শুইবার ঘরের চারিটি আলমারি বোঝাই হইয়া যাহা বাড়তি হইয়াছে তাহাই নীচে স্থান পাইয়াছে। ইহা ভিন্ন আরও নানাপ্রকার আসবাব, যথা—রাজা—রানীর ছবি, রায়—বাহাদুরের পরিচিত ও অপরিচিত ছোট—বড় সাহেবের ফোটোগ্রাফ, গিলটির ফ্রেমে বাঁধানো আয়না, অ্যালম্যানাক, ঘড়ি, রায়বাহাদুরের সনদ, কয়েকটি অভিনন্দনপত্র ইত্যাদি আছে।
আজ যথাসময়ে আড্ডা বসিয়াছে। বংশলোচন এখনও বেড়াইয়া ফেরেন নাই। তাহার অন্তরঙ্গ বন্ধু বিনোদ উকিল ফরাশের উপর তাকিয়ায় ঠেস দিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছেন। বৃদ্ধ কেদার চাটুজ্যে মহাশয় হুঁকা হাতে ঝিমাইতেছেন। নগেন ও উদয় অতি কষ্টে ক্রোধ রুদ্ধ করিয়া ওত পাতিয়া বসিয়া আছে, একটা ছুতা পাইলেই পরস্পরকে আক্রমণ করিবে।
আর চুপ করিয়া থাকিতে না পারিয়া উদয় বলিল—’যাই বল, বাঘের মাপ কখনই ল্যাজ সুদ্ধ হ’তে পারে না। তা হ’লে মেয়েছেলেদের মাপও চুল—সুদ্ধ হবে না কেন? আমার বউ এর বিনুনিটাই তো তিনফুট হবে। তবে কি বলতে চাও, বউ আট ফুট লম্বা?’
নগেন বলিল—’দেখ উদো, তোর বউ—এর বর্ণনা আমরা মোটেই শুনতে চাই না। বাঘের কথা বলতে হয় বল।’
চাটুজ্যে মহাশয়ের তন্দ্রা ছুটিয়া গেল। বলিলেন—’আঃ হা, তোমাদের এখানে কি বাঘ ছাড়া অন্য জানোয়ার নেই?’
এমন সময় বংশলোচন ছাগল লইয়া ফিরিলেন। বিনোদবাবু বলিলেন— ‘বাহবা, বেশ পাঁঠাটি তো। কত দিয়ে কিনলে হে?’
বংশলোচন সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিলেন। বিনোদ বলিলেন—’বেওয়ারিস মাল, বেশী দিন ঘরে না রাখাই ভাল। সাবাড় করে ফেল—কাল রবিবার আছে, লাগিয়ে দাও।’
চাটুজ্যে মশাই ছাগলের পেট টিপিয়া বলিলেন—’দিব্বি পুরুষ্টু পাঁঠা। খাসা কালিয়া হবে।’
নগেন ছাগলের উরু টিপিয়া বলিল—’উহুঁ হাঁড়িকাবাব। একটু বেশী করে আদা—বাটা আর প্যাঁজ।
উদয় বলিল— ‘ওঃ, আমার বউ অ্যায়সা গুলি কাবাব করতে জানে!
নগেন ভ্রূকুটি করিয়া বলিল—’উদো, আবার?’
বংশলোচন বিরক্ত হইয়া বলিলেন—’তোমাদের কি জন্তু দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে? একটা নিরীহ অনাথ প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে, তা কেবল কালিয়া আর কাবাব!’
ছাগলের সংবাদ শুনিয়া বংশলোচনের সপ্তমবর্ষীয়া কন্যা টেঁপী এবং সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ঘেণ্টু ছুটিয়া আসিল। ঘেণ্টু বলিল—’ ও বাবা, আমি পাঁঠা খাব। পাঁঠার ম—ম—ম—’
বংশলোচন বলিলেন—যাঃ যাঃ, শুনে শুনে কেবল খাই খাই শিখছেন।’
ঘেণ্টু হাত—পা ছুড়িয়া বলিল— ‘ হ্যাঁ আমি ম—ম—ম—মেটুলি খাব।’
টেঁপী বলিল— ‘বাবা, আমি পাঁঠাকে পুষবো, একটু লাল ফিতে দাও না।’
বংশলোচন। বেশ তো একটু খাওয়া—দাওয়া করুক, তারপর নিয়ে খেলা করিস এখন।
টেঁপী। পাঁঠার নাম কি বল না?
বিনোদ বলিলেন— ‘নামের ভাবনা কি। ভাসরুক, দধিমুখ, মসীপুচ্ছ, লম্বকর্ণ—’
চাটুজ্যে বলিলেন—’লম্বকর্ণই ভাল।’
বংশলোচন কন্যাকে একটু অন্তরালে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—’টেঁপু তোর মা এখন কি করছে রে?’
টেঁপী। এক্ষুনি তো কল—ঘরে গেছে।
বংশলোচন। ঠিক জানিস? তা হ’লে এখন এক ঘণ্টা নিশ্চিন্দি। দেখ, ঝিকে বল, চট করে ঘোড়ার ভেজানো—ছোলা চাট্টি এনে এই বাইরের বারান্দায় যেন ছাগলটাকে খেতে দেয়। আর দেখ, বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাস নি যেন।
উৎসাহের আতিশয্যে টেঁপী পিতার আদেশ ভুলিয়া গেল। ছাগলের গলায় লাল ফিতা বাঁধিয়া টানিতে টানিতে অন্দরমহলে লইয়া গিয়া বলিল—’ও মা, শীগগির এস, লম্বকর্ণ দেখবে এস।’
মানিনী মুখ মুছিতে মুছিতে স্নানের ঘর হইতে বাহির হইয়া বলিলেন—’আ মর ওটাকে কে আনলে? দূর দূর—ও ঝি, ও বাতাসী, শীগগির ছাগলটাকে বার করে দে, ঝাঁটা মার।’
টেঁপী বলিল—’বা রে, ওকে তো বাবা এনেছে, আমি পুষব।’
ঘেন্টু বলিল—’ ঘোড়া ঘোড়া খেলব।’
মানিনী বলিলেন—’খেলা বার ক’রে দিচ্ছি। ভদ্দর লোকে আবার ছাগল পোষে। বেরো বেরো—ও দরওয়ান, ও চুকন্দর সিং—’
‘হুজৌর’ বলিয়া হাঁক দিয়া চুকন্দর সিং হাজির হইল! শীর্ণ, খর্বাকৃতি বৃদ্ধ, গালপাট্টা দাঁড়ি, পাকানো গোঁফ, জাঁকালো গলা এবং ততোধিক জাঁকালো নাম—ইহারই জোরে সে চোট্টা এবং ডাকুর আক্রমণ হইতে দেউড়ি রক্ষা করে।
অন্দরের মধ্যে হট্টগোল শুনিয়া রায়বাহাদুর বুঝিলেন যুদ্ধ অনিবার্য। মনে মনে তাল ঠুকিয়া বাড়ির ভিতরে আসিলেন। গৃহিণী তাঁহার প্রতি দৃকপাত না করিয়া দারোয়ানকে বলিলেন—’ছাগলটাকে আভি নিকাল দেও, একদম ফটকের বাইরে। নেই তো এক্ষুনি ছিষ্টি নোংরা করেগা।’
চুকন্দর বলিল—’বহুত আচ্ছা।’
বংশলোচন পালটা হুকুম দিলেন—’দেখো চুকন্দর সিং। এই বকরি গেটের বাইরে যাগা তো তোমরা নোকরি ভি যাগা।’
চকুন্দর বলিল—’বহুত আচ্ছা।’
মানিনী স্বামীর প্রতি একটি অগ্নিময় নয়নবাণ হানিয়া বলিলেন—’হ্যাঁলা টেঁপী হতচ্ছাড়ী, রাত্তির হয়ে গেল—গিলতে হবে না? থাকিস তুই ছাগল নিয়ে, কাল যাচ্ছি আমি হাটখোলায়।’ হাটখোলায় গৃহিণীর পিত্রালয়।
বংশলোচন বলিলেন—’টেঁপু, ঝিকে ব’লে দে, বৈঠকখানা—ঘরে আমার শোবার বিছানা করে দেবে। আমি সিঁড়ি ভাঙতে পারি না। আর দেখ ঠাকুরকে বল আমি মাংস খাব না। শুধু খানকতক কচুরি একটু ডাল আর পটলভাজা।’
পুরাকালে বড়লোকদের বাড়িতে একটি করিয়া গোসাঘর থাকিত। ক্রুদ্ধা আর্যনারীগণ সেখানে আশ্রয় লইতেন। কিন্তু আর্যপুত্রদের জন্য সে—রকম কোনও পাকা বন্দোবস্ত ছিল না। অগত্যা তাঁহারা এক পত্নীর সহিত মতান্তর হইলে অপর এক পত্নীর দ্বারস্থ হইতেন। আজকাল খরচপত্র বাড়িয়া যাওয়ায় এই সকল সুন্দর প্রাচীন প্রথা লোপ পাইয়াছে। এখন মেয়েদের ব্যবস্থা শুইবার ঘরের মেঝের উপর মাদুর অথবা তেমন তেমন হইলে বাপের বাড়ি। আর ভদ্রলোকদের একমাত্র আশ্রয় বৈঠকখানা।
আহারান্তে বংশলোচন বৈঠকখানা—ঘরে একাকী শয়ন করিলেন। অন্ধকারে তাঁর ঘুম হয় না, এজন্য ঘরের এক কোণে পিলসুজের উপর একটা রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলিতেছে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করিয়া বংশলোচন উঠিয়া ইলেকট্রিক লাইট জ্বালিলেন এবং একখানি গীতা লইয়া পড়িতে বসিলেন। এই গীতাটি তার দুঃসময়ের সম্বল, পত্নীর সহিত অসহযোগ হইলে তিনি এটি লইয়া নাড়াচাড়া করেন এবং সংসারের অনিত্যতা উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করেন। কর্মযোগ পড়িতে পড়িতে বংশলোচন ভাবিতে লাগিলেন—তিনি কী এমন অন্যায় কাজ করিয়াছেন যার জন্য মানিনী এরূপ ব্যবহার করেন? বাপের বাড়ি যাবেন—ইস, ভারী তেজ! তিনি ফিরাইয়া আনিবার নামটি করিবেন না, যখন গরজ হইবে আপনিই ফিরিবে। গৃহিণী শখ করিয়া যে—সব জঞ্জাল ঘরে পোরেন তা তো বংশলোচন নীরবে বরদাস্ত করেন। এই তো সেদিন পনেরোটা জলচৌকি তেইশটা বঁটি এবং আড়াই শ টাকার খাগড়াই বাসন কেনা হইয়াছে, আর দোষ হইল কেবল ছাগলের বেলা? হুঃ! যতো সব—। বংশলোচন গীতাখানি সরাইয়া রাখিয়া আলোর সুইচ বন্ধ করিলেন এবং ক্ষণকাল পরে নাসিকাধ্বনি করিতে লাগিলেন।
লম্বকর্ণ বারান্দায় শুইয়া রোমন্থন করিতেছিল। দুইটা বর্মা চুরুট খাইয়া তাহার ঘুম চটিয়া গিয়াছে। রাত্রি একটা আন্দাজ জোরে হাওয়া উঠিল। ঠাণ্ডা লাগায় সে বিরক্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল। বৈঠকখানা—ঘর হইতে মিটমিটে আলো দেখা যাইতেছে। লম্বকর্ণ তাহার বন্ধন রজ্জু চিবাইয়া কাটিয়া ফেলিল এবং দরজা খোলা পাইয়া নিঃশব্দে বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল।
আবার তাহার ক্ষুধা পাইয়াছে। ঘরের চারিদিকে ঘুরিয়া একবার তদারক করিয়া লইল। ফরাশের এক কোণে একগোছা খবরের কাগজ রহিয়াছে। চিবাইয়া দেখিল, অত্যন্ত নীরস। অগত্যা সে গীতার তিন অধ্যায় উদরস্থ করিল। গীতা খাইয়া গলা শুকাইয়া গেল। একটা উঁচু তেপায়ার উপর এক কুঁজা জল আছে, কিন্তু তাহা নাগাল পাওয়া যায় না। লম্বকর্ণ তখন প্রদীপের কাছে গিয়া রেড়ির তেল চাখিয়া দেখিল, বেশ সুস্বাদু। চকচক করিয়া সবটা খাইল। প্রদীপ নিবিল।
বংশলোচন স্বপ্ন দেখিতেছেন—সন্ধিস্থাপন হইয়া গিয়াছে। হঠাৎ পাশ ফিরিতে তাঁহার একটা নরম গরম স্পন্দনশীল স্পর্শ অনুভব হইল। নিদ্রাবিজড়িত স্বরে বলিলেন—’কখন এলে?’ উত্তর পাইলেন—’হুঁ, হুঁ, হুঁ, হুঁ।’
হুলস্থূল কাণ্ড। চোর—চোর—বাঘ হ্যায়—এই চুকন্দর সিং—জলদি আও— নগেন— উদো—শীগগির আয়—মেরে ফেললে—
চুকন্দর তাঁর মুঙ্গেরী বন্দুকে বারুদ ভরিতে লাগিল। নগেন ও উদয় লাঠি ছাতা টেনিস ব্যাট যা পাইল তাই লইয়া ছুটিল। মানিনী ব্যাকুল হইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে নামিয়া আসিলেন। বংশলোচন ক্রমে প্রকৃতিস্থ হইলেন। লম্বকর্ণ দু এক ঘা মার খাইয়া ব্যা ব্যা করিতে লাগিল। বংশলোচন ভাবিলেন বাঘ বরঞ্চ ছিল ভাল। মানিনী ভাবলেন, ঠিক হয়েছে।
ভোরবেলা বংশলোচন চুকন্দরকে পাড়ায় খোঁজ লইতে বলিলেন—কোনও ভালা আদমী ছাগল পুষিতে রাজী আছে কি না। যে—সে লোককে তিনি ছাগল দিবেন না। এমন লোক চাই যে যত্ন করিয়া প্রতিপালন করিবে, টাকার লোভে বেচিবে না, মাংসের লোভে মারিবে না।
আটটা বাজিয়াছে। বংশলোচন বর্হিবাটীর বারান্দায় চেয়ারে বসিয়া আছেন, নাপিত কামাইয়া দিতেছে। বিনোদবাবু ও নগেন অমৃতবাজারে ড্যালহাউসী ভার্সস মোহনবাগান পড়িতেছেন। উদয় ল্যাংড়া আমের দর করিতেছে। এমন সময় চুকন্দর আসিয়া সেলাম করিয়া বলিল—’লাটুবাবু, আয়ে হেঁ।’
তিনজন সহচরের সহিত লাটুবাবু বারান্দায় আসিয়া নমস্কার করিলেন। তাঁহাদের প্রত্যেকের বেশভূষা প্রায় একই প্রকার—ঘাড়ের চুল আমূল ছাঁটা, মাথার উপর পর্বতাকার তেড়ি, রগের কাছে দু—গোছা চুল ফণা ধরিয়া আছে। হাতে রিস্ট—ওয়াচ, গায়ে আগুলফ—লম্বিত পাতলা পাঞ্জাবি, তার ভিতর দিয়া গোলাপী গেঞ্জির আভা দেখা যাইতেছে। পায়ে লপেটা, কানে অর্ধদগ্ধ সিগারেট।
বংশলোচন বলিলেন— ‘আপনাদের কোত্থেকে আসা হচ্ছে?’
লাটুবাবু বলিলেন—’আমরা বেলেঘাটা কেরাসিন ব্যাণ্ড। ব্যাণ্ড—মাস্টার লটবর লন্দী—অধীন। লোকে লাটুবাবু ব’লে ডাকে। শুনলুম আপনি একটি পাঁঠা বিলিয়ে দেবেন, তাই সঠিক খবর লিতে এসেছি।’
বিনোদ বলিলেন—’আপনারা বুঝি কানেস্তারা বাজান?’
লাটু। ক্যানেস্তারা কি মশায়? দস্তুরমত কলসাট। এই ইনি লবীন লিয়োগী ক্ল্যারিয়নেট —এই লরহরি লাগ ফুলোট—এই লবকুমার লন্দন ব্যায়লা। তা ছাড়া কর্লেট, পিকলু, হারমোনিয়া, ঢোল, কত্তাল সব নিয়ে উলিশজন আছি। বর্মা অয়েল কোম্পানির ডিপোয় আমরা কাজ করি। ছোট—সাহেবের সেদিন বে হ’ল, ফিষ্টি দিলে, আমরা বাজালুম, সাহেব খুশী হয়ে টাইটিল দিলে—কেরাসিন ব্যাণ্ড।
বংশলোচন। দেখুন আমার একটি ছাগল আছে, সেটি আপনাকে দিতে পারি, কিন্তু—
লাটু। আমরা হলুম উলিশটি প্রালী, একটা পাঁঠায় কি হবে মশায়? কি বল হে লরহরি?
নরহরি। লস্যি, লস্যি।
বংশলোচন। আমি এই শর্তে দিতে পারি যে ছাগলটিকে আপনি যত্ন ক’রে মানুষ করবেন, বেচতে পারবেন না, মারতে পারবেন না।
লাটু। এ যে আপনি লতুন কথা বলছেন মশায়। ভদ্দর নোকে কখনও ছাগল পোষে?
নরহরি। পাঁঠী লয় যে দুধ দেবে।
নবীন। পাখি লয় যে পড়বে।
নবকুমার। ভেড়া লয় যে কম্বল হবে।
বংশলোচন। সে যাই হোক। বাজে কথা বলবার আমার সময় নেই। নেবেন কি না বলুন।
লাটুবাবু ঘাড় চুলকাইতে লাগিলেন। নরহরি বলিলেন—’লিয়ে লাও হে লাটুবাবু লিয়ে লাও। ভদ্দর নোক বলছেন অত ক’রে।’
বংশলোচন। কিন্তু মনে থাকে যেন, বেচতে পারবে না, কাটতে পারবে না।
লাটু। সে আপনি ভাববেন না। লাটু লন্দীর কথার লড়চড় লেই।
লম্বকর্ণকে লইয়া বেলেঘাটা কেরাসিন ব্যাণ্ড চলিয়া গেল। বংশলোচন বিমর্ষচিত্তে বলিলেন—’ব্যাটাদের দিয়ে ভরসা হচ্ছে না!’ বিনোদ আশ্বাস দিয়া বলিলেন—’ভেবো না হে, তোমার পাঠাঁ গন্ধর্বলোকে বাস করবে। ফাঁকে পড়লুম আমরা।’
সন্ধ্যার আড্ডা বসিয়াছে। আজও বাঘের গল্প চলিতেছে। চাটুজ্যে মহাশয় বলিতেছেন, ‘—সেটা তোমাদের ভুল ধারণা। বাঘ ব’লে একটা ভিন্ন জানোয়ার নেই। ও একটা অবস্থার ফের, আরসোলা হ’তে যেমন কাঁচপোকা। আজই তোমরা ডারউইন শিখেছ— আমাদের ওসব ছেলেবেলা থেকেই জানা আছে। আমাদের রায়বাহাদুর ছাগলটা বিদেয় ক’রে খুব ভাল কাজ করেছেন। কেটে খেয়ে ফেলতেন তো কথাই ছিল না, কিন্তু বাড়িতে রেখে বাড়তে দেওয়া—উঁহু।’
বংশলোচন একখানি নূতন গীতা লইয়া নিবিষ্টচিত্তে অধ্যয়ন করিতেছেন—নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ, অর্থাৎ কিনা, আত্মা একবার হইয়া আর যে হইবে না তা নয়। অজো নিত্যঃ—অজো কিনা ছাগলং। ছাগলটা যখন বিদায় হইয়াছে, তখন আজ সন্ধিস্থাপনা হইলেও হইতে পারে।
বিনোদ বংশলোচনকে বলিলেন— ‘হে কৌন্তেয়, তুমি শ্রীভগবানকে একটু থামিয়ে রেখে একবার চাটুজ্যে মশায়ের কথাটা শোন। মনে বল পাবে।’
উদয় বলল—’আমি সেবার যখন সিমলেয় যাই—’
নগেন। মিছে কথা বলিস নি উদো। তোর দৌড় আমার জানা আছে, লিলুয়া অবধি।
উদয়। বাঃ! আমার দাদাশ্বশুর যে সিমলেয় থাকতেন। বউ তো সেখানেই বড় হয়। তাইতো রং অত—
নগেন। খবরদার উদো।
চাটুজ্যে। যা বলছিলুম শোন। আমাদের মজিলপুরের চরণ ঘোষের এক ছাগল ছিল, তার নাম ভুটে। ব্যাটা খেয়ে খেয়ে হ’ল ইয়া লাশ, ইয়া সিং, ইয়া দাড়ি। একদিন চরণের বাড়িতে ভোজ—লুচি, পাঁঠার কালিয়া, এইসব। আঁচাবার সময় দেখি, ভুটে পাঁঠার মাংস খাচ্ছে। বললুম—দেখছ কি চরণ, এখুনি ছাগলটাকে বিদেয় কর—কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ঘর কর, প্রাণে ভয় নেই? চরণ শুনলে না। গরিবের কথা বাসী হ’লে ফলে। তার পরদিন থেকে ভুটে নিরুদ্দেশ। খোঁজ—খোঁজ কোথা গেল। এক বচ্ছর পরে মশায় সেই ছাগল সোঁদরবনে পাওয়া গেল। শিং নেই বললেই হয়, দাড়ি প্রায় খসে গেছে, মুখ একেবারে হাঁড়ি, বর্ণ হয়েছে যেন কাঁচা হলুদ, আর তার ওপর দেখা দিয়েছে মশায়—আঁজি—আঁজি ডোরা—ডোরা। ডাকা হ’ল—ভুটে, ভুটে! ভুটে বললে—হালুম। লোকজন দূর থেকে নমস্কার করে ফিরে এল।
‘লাটুবাবু আয়ে হেঁ।’
সপারিষদ লাটুবাবু প্রবেশ করিলেন। লম্বকর্ণও সঙ্গে আছে। বিনোদ বলিলেন—’কি ব্যাণ্ড মাস্টার, আবার কি মনে করে?’
লাটুবাবুর আর সে লাবণ্য নাই। চুল উশক খুশক চোখ বসিয়া গিয়াছে, জামা ছিঁড়িয়া গিয়াছে। সজলনয়নে হাঁউমাউ করিয়া বলিলেন—’সর্বনাশ হয়েছে মশায়, ধনে—প্রাণে মেরেছে। ও হোঃ হোঃ হোঃ।’
নরহরি বলিলেন— ‘আঃ কি কর লাটুবাবু একটু স্থির হও। হুজুর যখন রয়েছেন তখন একটা বিহিত করবেনই।’
বংশলোচন ভীত হইয়া বলিলেন—’কি হয়েছে—ব্যাপার কি?’
লাটু। মশাই, ওই পাঁঠাটা—
চাটুজ্যে বলিলেন—’হুঁ, বলেছিলুম কি না?’
লাটু। ঢোলের চামড়া কেটেছে, ব্যায়লার তাঁত খেয়েছে, হারমোনিয়ার চাবি সমস্ত চিবিয়েছে। আর—আর—আমার পাঞ্জাবির পকেট কেটে লব্বই টাকার লোট—ও হো হো!
নরহরি। গিলে ফেলেছে। পাঁঠা নয় হুজুর, সাক্ষাৎ শয়তান। সর্বস্ব গেছে, লাটুর প্রাণটি কেবল আপনার ভরসায় এখনও ধুক—পুক করছে।
বংশলোচন। ফ্যাসাদে ফেললে দেখছি।
নরহরি। দোহাই হুজুর, লাটুর দশাটা একবার দেখুন, একটা ব্যবস্থা ক’রে দিন—বেচারা মারা যায়।
বংশলোচন ভাবিয়া বলিলেন—’একটা জোলাপ দিলে হয় না?’
লাটুবাবু উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলিলেন—’মশায়, এই কি আপনার বিবেচনা হ’ল? মরছি টাকার শোকে, আর আপনি বলছেন জোলাপ খেতে?’
বংশলোচন। আরে তুমি খাবে কেন, ছাগলটাকে দিতে বলছি।
নরহরি। হায় হায়, হুজুর এখনও ছাগল চিনলেন না! কোন কালে হজম ক’রে ফেলেছে। লোট তো লোট—ব্যায়লার তাঁত, ঢোলের চামড়া, হারমোনিয়ার চাবি, মায় ইস্টিলের কত্তাল।
বিনোদ। লাটুবাবুর মাথাটি কেবল আস্ত রেখেছে।
বংশলোচন বলিলেন—’যা হবার তা তো হয়েছে। এখন বিনোদ, তুমি একটা খেসারত ঠিক করে দাও। বেচারার লোকসান যাতে না হয়, আমার ওপর বেশী জুলুমও না হয়। ছাগলটা বাড়িতেই থাকুক, কাল যা হয় করা যাবে।’
অনেক দরদস্তুরের পর একশ টাকায় রফা হইল। বংশলোচন বেশী কষাকষি করিতে দিলেন না। লাটুবাবুর দল টাকা লইয়া চলিয়া গেল।
লম্বকর্ণ ফিরিয়াছে শুনিয়া টেঁপী ছুটিয়া আসিল। বিনোদ বলিলেন—’ও টেঁপুরানী শীগগির গিয়ে তোমার মাকে বলো কাল আমরা এখানে খাব—লুচি, পোলাও, মাংস—’
টেঁপী। বাবা আর মাংস খায় না।
বিনোদ। বল কি! হ্যাঁ হে বংশু, প্রেমটা এক পাঁঠা থেকে বিশ্ব পাঁঠায় পৌঁছেছে না কি? আচ্ছা, তুমি না খাও আমরা আছি। যাও তো টেঁপু, মাকে বল সব যোগাড় করতে।
টেঁপী। সে এখন হচ্ছে না। মা—বাবার ঝগড়া চলছে, কথাটি নেই।
বংশলোচন ধমক দিয়া বলিলেন—’হ্যাঁ হ্যাঁ—কথাটি নেই—তুই সব জানিস। যাঃ যাঃ, ভারি জ্যাঠা হয়েছিস।’
টেঁপী। বা—রে, আমি বুঝি টের পাই না? তবে কেন মা খালি—খালি আমাকে বলে— টেঁপী, পাখাটা মেরামত করতে হবে— টেঁপী, এ মাসে আরও দু—শ টাকা চাই। তোমাকে বলে না কেন?
বংশলোচন। থাম থাম বকিস নি।
বিনোদ। হে রায়বাহাদুর, কন্যাকে বেশী ঘাঁটিও না। অনেক কথা ফাঁস করে দেবে। অবস্থাটা সঙ্গিন হয়েছে বল?
বংশলোচন। আরে এতদিন তো সব মিটে যেত, ওই ছাগলটাই মুশকিল বাধালে।
বিনোদ। ব্যাটা ঘরভেদী বিভীষণ। তোমারই বা অত মায়া কেন? খেতে না পার বিদেয় করে দাও। জলে বাস কর, কুমিরের সঙ্গে বিবাদ ক’রো না।
বংশলোচন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন— ‘দেখি কাল যা হয় করা যাবে।’
এ রাত্রিও বংশলোচন বৈঠকখানায় বিরহশয়নে যাপন করিলেন। ছাগলটা আস্তাবলে বাঁধা ছিল, উপদ্রব করিবার সুবিধা পায় নাই।
পরদিন বৈকাল সাড়ে পাঁচটার সময় বংশলোচন বেড়াইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া একবার এদিক—ওদিক চাহিয়া দেখিলেন, কেহ তাঁকে লক্ষ্য করিতেছে কি না। গৃহিণী ও ছেলেমেয়েরা উপরে আছে। ঝি—চাকর অন্দরে কাজকর্মে ব্যস্ত। চুকন্দর সিং তার ঘরে বসিয়া আটা সানিতেছে। লম্বকর্ণ আস্তাবলের কাছে বাঁধা আছে এবং দড়ির সীমার মধ্যে যথাসম্ভব লম্ফ—ঝম্ফ করিতেছে। বংশলোচন দড়ি হাতে করিয়া ছাগল লইয়া আস্তে আস্তে বাহির হইলেন।
পাছে পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হয় সেজন্য বংশলোচন সোজা রাস্তায় না গিয়া গলি—ঘুঁজির ভিতর দিয়া চলিলেন। পথে এক ঠোঙা জিলিপি কিনিয়া পকেটে রাখিলেন। ক্রমে লোকালয় হইতে দূরে আসিয়া জনশূন্য খাল—ধারে পৌঁছিলেন।
আজ তিনি স্বহস্তে লম্বকর্ণকে বিসর্জন দিবেন, যেখানে পাইয়াছিলেন আবার এইখানেই ছাড়িয়া দিবেন—যা থাকে তার কপালে। যথাস্থানে আসিয়া বংশলোচন জিলিপির ঠোঙাটি ছাগলকে খাইতে দিলেন। পকেট হইতে এক টুকরো কাগজ বাহির করিয়া তাহাতে লিখিলেন—
এই ছাগল বেলেঘাটা খালের ধারে কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম। প্রতিপালন করিতে না পারায় আবার সেইখানেই ছাড়িয়া দিলাম। আল্লা কালী যিশুর দিব্য ইহাকে কেহ মারিবেন না।
লেখার পর কাগজ ভাঁজ করিয়া ছোট টিনের কৌটায় ভরিয়া লম্বকর্ণের গলায় ভাল করিয়া বাঁধিয়া দিলেন। তারপর বংশলোচন শেষবার ছাগলের গায়ে হাত বুলাইয়া আস্তে আস্তে সরিয়া পড়িলেন। লম্বকর্ণ তখন আহারে ব্যস্ত।
দূরে আসিয়াও বংশলোচন বার বার পিছু ফিরিয়া দেখিতে লাগিলেন। লম্বকর্ণ আহার শেষ করিয়া এদিক—ওদিক চাহিতেছে। যদি তাঁহাকে দেখিয়া ফেলে এখনি পশ্চাদ্ধাবন করিবে। এদিকে আকাশের অবস্থাও ভাল নয়। বংশলোচন জোরে জোরে চলিতে লাগিলেন।
আর পারা যায় না, হাঁফ ধরিতেছে। পথের ধারে একটা তেঁতুলগাছের তলায় বংশলোচন বসিয়া পড়িলেন। লম্বকর্ণকে আর দেখা যায় না। এইবার তাহার মুক্তি—আর কিছুদিন দেরি করিলে জড়ভরতের অবস্থা হইত। এই হতভাগা কৃষ্ণের জীবকে আশ্রয় দিতে গিয়া তিনি নাকাল হইয়াছেন। গৃহিণী তাঁহার উপর মর্মান্তিক রুষ্ট, আত্মীয়স্বজন তাহাকে খাইবার জন্য হাঁ করিয়া আছে—তিনি একা কাঁহাতক সামলাইবেন? হায় রে সত্যযুগ, যখন শিবি রাজা শরণাগত কপোতের জন্য প্রাণ দিতে গিয়াছিলেন— মহিষীর ক্রোধ, সভাসদবর্গের বেয়াদবি কিছুই তাঁহাকে ভোগ করিতে হয় নাই।
দ্রুম দুদ্দুড় দুড়ু দড়ড়ড় ড়! আকাশে কে ঢেঁটরা পিটিতেছে? বংশলোচন চমকিত হইয়া উপরে চাহিয়া দেখিলেন, অন্তরীক্ষের গম্বুজে এক পোঁচ সীসা—রঙের অস্তর মাখাইয়া দিয়াছে। দূরে এক ঝাঁক সাদা বক জোরে পাখা চালাইয়া পলাইতেছে। সমস্ত চুপ—গাছের পাতাটি নড়িতেছে না। আসন্ন দুর্যোগের ভয়ে স্থাবর জঙ্গম হতভম্ব হইয়া গিয়াছে। বংশলোচন উঠিলেন, কিন্তু আবার বসিয়া পড়িলেন। জোরে হাঁটার ফলে তাঁর বুক ধড়ফড় করিতেছিল।
সহসা আকাশ চিড় খাইয়া ফাটিয়া গেল। এক ঝলক বিদ্যুৎ —কড় কড় কড়াৎ—ফাটা আকাশ আবার বেমালুম জুড়িয়া গেল। ঈশানকোণ হইতে একটা ঝাপসা পর্দা তাড়া করিয়া আসিতেছে। তাহার পিছনে যা—কিছু সমস্ত মুছিয়া গিয়াছে, সামনেও আর দেরি নাই। ওই এল, ওই এল! গাছপালা শিহরিয়া উঠিল, লম্বা—লম্বা তালগাছগুলো প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়া আপত্তি জানাইল। কাকের দল আর্তনাদ করিয়া উড়িবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ঝাপটা খাইয়া আবার গাছের ডাল আঁকড়াইয়া ধরিল। প্রচণ্ড ঝড়, প্রচণ্ডতর বৃষ্টি। যেন এই নগণ্য উইঢিবি—এই ক্ষুদ্র কলিকাতা শহরকে ডুবাইবার জন্য স্বর্গের তেত্রিশ কোটি দেবতা সার বাঁধিয়া বড় বড় ভৃঙ্গার হইতে তোড়ে জল ঢালিতেছেন। মোটা নিরেট জলধারা, তাহার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ফোঁটা। সমস্ত শূন্য ভরাট হইয়া গিয়াছে।
মান—ইজ্জত কাপড়—চোপড় সবই গিয়াছে, এখন প্রাণটা রক্ষা পাইলে হয়। হা রে হতভাগা ছাগল, কি কুক্ষণে—
বংশালোচনের চোখের সামনে একটা উগ্র বেগনী আলো খেলিয়া গেল—সঙ্গে সঙ্গে আকাশের সঞ্চিত বিশ কোটি ভোল্ট ইলেকট্রিসিটি অদূরবর্তী একটা নারিকেল গাছের ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করিয়া বিকট নাদে ভূগর্ভে প্রবেশ করিল।
রাশি রাশি সরিষার ফুল। জগৎ লুপ্ত, তুমি নাই, আমি নাই। বংশলোচন সংজ্ঞা হারাইয়াছেন।
বৃষ্টি থামিয়াছে কিন্তু এখনো সোঁ সোঁ করিয়া হাওয়া চলিতেছে। ছেঁড়া মেঘের পর্দা ঠেলিয়া দেবতারা দু—চারটা মিটমিটে তারার লণ্ঠন লইয়া নীচের অবস্থা তদারক করিতেছেন।
বংশলোচন কর্দম—শয্যায় শুইয়া ধীরে ধীরে সংজ্ঞা লাভ করিলেন। তিনি কে? রায় বাহাদুর। কোথায়? খালের নিকট। ও কিসের শব্দ? সোনা—ব্যাং। তাঁর নষ্ট স্মৃতি ফিরিয়া আসিয়াছে। ছাগলটা?
মানুষের স্বর কানে আসিতেছে। কে তাঁকে ডাকিতেছে? ‘মামা—জামাইবাবু—বংশু আছ? —হজৌর—’
অদূরে একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। জনকতক লোক লণ্ঠন লইয়া ইতস্তত ঘুরিতেছে এবং তাঁহাকে ডাকিতেছে। একটি পরিচিত নারীকণ্ঠে ক্রন্দনধ্বনি উঠিল।
রায়বাহাদুর চাঙ্গা হইয়া বলিলেন—’এই যে আমি এখানে আছি—ভয় নেই—’
মানিনী বলিলেন—’আজ আর দোতলায় উঠে কাজ নেই। ও ঝি, এই বৈঠকখানা ঘরেই বড় ক’রে বিছানা ক’রে দে তো। আর দেখ, আমার বালিশটাও দিয়ে যা। আঃ চাটুজ্যে মিনসে নড়ে না। ও কি—সে হবে না,—এই গরম লুচি ক—খানি খেতেই হবে, মাথা খাও। তোমার সেই বোতলটায় কি আছে—তাই একটু চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দেব নাকি?’
‘হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ—’
বংশলোচন লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন—’অ্যাঁ, ওটা আবার এসেছে? নিয়ে আয় তো লাঠিটা—’
মানিনী বলিলেন,—’আহা কর কি, মেরো না। ও বেচারা বৃষ্টি থামতেই ফিরে এসে তোমার খবর দিয়েছে। তাইতেই তোমায় ফিরে পেলুম। ওঃ, হরি মধুসূদন।’
লম্বকর্ণ বাড়িতেই রহিয়া গেল, এবং দিন দিন শশিকলার ন্যায় বাড়িতে লাগিল। ক্রমে তাহার আধ হাত দাড়ি গজাইল। রায়বাহাদুর আর বড় একটা খোঁজ খবর করেন না, তিনি এখন ইলেকশন লইয়া ব্যস্ত। মানিনী লম্বকর্ণের শিং কেমিক্যাল সোনা দিয়া বাঁধাইয়া দিয়াছেন। তাহার জন্য সাবান ও ফিনাইল ব্যবস্থা হইয়াছে, কিন্তু বিশেষ ফল হয় নাই। লোকে দূর হইতে তাহাকে বিদ্রূপ করে। লম্বকর্ণ গম্ভীরভাবে সমস্ত শুনিয়া যায়, নিতান্ত বাড়াবাড়ি করিলে বলে—ব—ব—ব—অর্থাৎ যত ইচ্ছা হয় বকিয়া যাও, আমি ও—সব গ্রাহ্য করি না।
ভারতবর্ষ, কাত্তিক ১৩৩১ (১৯২৪)