লক্ষ্য এবং উপলক্ষ্য
আমার কিছু দেবার আছে। না দিয়ে আমার শান্তি নেই। যত দিন আমি না দিয়েছি তত দিন আমার অন্তর আকুল, আমার অন্তর উদ্বেল। হয়তো শুধু এই জিনিসটি দিয়ে যাবার জন্যেই আমি জন্মেছি, মরার আগে না দিয়ে যাই তো জীবন বৃথা। কে জানে হয়তো আবার জন্মাতে হবে কেবল এই অঞ্জলি অর্পণ করবার জন্যেই, এই ভার থেকে মুক্ত হবার জন্যেই। মুক্তির যেন আর কোনো অর্থ নেই, মুক্তি বলতে বুঝি এই দায় থেকে মুক্তি। এই বোঝা আমার নামবে যেদিন সেদিন আমার কী উল্লাস, কী সোয়াস্তি!
তারপর দেখা যাবে আমার দানের ভিতর দিয়ে আমি আপনাকে দিয়ে গেছি। একখানি উপন্যাসের কি একটি কবিতার ভিতর দিয়ে আমার পরিপূর্ণ পরিচয় জানিয়ে গেছি। দৃশ্যত ওখানি একখানি উপন্যাস বা ওটি একটি কবিতা। কিন্তু অদৃশ্যত আমার আপনা।
সেইজন্যেই বলেছি, আর্ট একটা ছল, একটা উপলক্ষ্য, একটা মাধ্যম। ওর আড়ালে রয়েছে আরও একটা ব্যাপার। দেওয়া আর পাওয়া। জানা আর জানানো। যে দিচ্ছে তার নাম লেখক বা গায়ক বা চিত্রকর—এক কথায় আর্টিস্ট। কিন্তু ওই নামের অন্তরালে রয়েছে আরও একজন, সেদাতা; সেজ্ঞাপক। লেখক নামে আমি সাধারণের পরিচিত। কিন্তু ওই কি আমার পরম পরিচয়? আমি যে ওর চেয়ে অনেক বড়ো, ওর চেয়ে অনেক উঁচু। আমি যে দাতা। আমি আত্মদা। লেখাটা আমার ছল, যে ছলে আমি আপনাকে দিই।
তেমনি যিনি পাচ্ছেন তাঁর নাম পাঠক বা শ্রোতা বা দর্শক বা এক কথায় রসিক। যিনি রসের আস্বাদন করেন। যিনি উপভোক্তা। কিন্তু ওই নামের অন্তরালে আছেন আরও একজন, তিনি জ্ঞাতা; তিনি গ্রহীতা। পাঠক নামে আপনি লাইব্রেরি মহলে পরিচিত। কিন্তু ওই কি আপনার চূড়ান্ত পরিচয়? ওর চেয়ে যে আপনি অনেক বৃহৎ, অনেক মহৎ। আপনি যে গ্রহীতা। গ্রহণ করেন একজনের আত্মদান। বইখানা তো একটা উপলক্ষ্য, একটা মাধ্যম। আপনি যে জ্ঞাতা। জ্ঞাত হন একজনের অন্তর। আপনি যে অন্তরঙ্গ।
অন্তর জানাজানির ব্যাপারটা অলক্ষে। সেইটেই লক্ষ্য। বই লেখা ও বই পড়ার ব্যাপারটা সকলের নজরে। এটা উপলক্ষ্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের স্বভাব এই যে ওরা চাক্ষুষ যা দেখে তাই চরম প্রমাণ বলে ধরে নেয়। তলিয়ে দেখতে যায় না। সেইজন্যে উপলক্ষ্যকে মনে করে লক্ষ্য। লক্ষ্যের কোনো সন্ধান রাখে না। লেখা যদি লক্ষ্যভেদ না করে বা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তা হলে ওরা টেরই পায় না, কেয়ারই করে না। বলা বাহুল্য এমন লোক শুধু পাঠকদের মধ্যে নয়, লেখকদের মধ্যেও আছেন। অনেক আর্টিস্ট অন্তর দিতে জানেন না, অন্তরঙ্গ চান না। তাঁদের সম্বন্ধ অন্তরঙ্গের সঙ্গে নয়, ক্রেতা বা স্তাবকের সঙ্গে। বই খুব বিক্রি হচ্ছে, ছবির খুব সুখ্যাতি হচ্ছে। গান শুনতে রাজা-মহারাজারা আমন্ত্রণ করছেন। ব্যাস, জন্ম সার্থক।
আর্ট একজনের অন্তরবাসীকে আরেক জনের অন্তরগোচর করে। একজনের সত্য পরিচয় আরেক জনের হৃদয়ে পৌঁছে দেয়। একজনের গোপনতম বাণী আরেক জনের মনের কানে বলে। একজনের সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা দিয়ে আরেক জনের উপভোগ্য বানায়। একজনের সঞ্চিত ঐশ্বর্য নিয়ে আরেক জনের উত্তরাধিকার গড়ে।
একজন, আরেক জন, এই দুজন না থাকলে আর্ট হয় না। অন্তত একজন কল্পিত পাঠক বা দর্শক থাকা চাই, যার জন্যে লেখক লিখবে বা নর্তক নাচবে। একলব্যের দ্রোণাচার্যের মতো একজন শ্রোতার প্রতিমা বা প্রতীক সামনে রেখে সারেগামার সাধনা করতে হয়। প্রত্যেক আর্টিস্টের নিজের ভিতরেই একজন রসিক বা রসাস্বাদক থাকেন, তাঁকেই সাক্ষী করে অনেক সময় কাজ করে যেতে হয়।
একজন, আরেক জন, এই দুজন না থাকলে আর্ট হয় না, বলেছি। একবার হয়ে গেলে পরে সর্বজন তাঁর অধিকারী। সর্বজনকে আরেক জন বললে যদি গণিতশাস্ত্রের অবমাননা হয় তাহলে আরেক পক্ষ বলতে পারি। আমি এক পক্ষ, আমার পাঠকরা অপর পক্ষ। আক্ষরিক অর্থে না হলেও অপর পক্ষ হচ্ছেন আরেক জন। তাঁরা বা তিনি আমার অন্তরঙ্গ। একযোগে না হলেও এক এক করে আমার অন্তরঙ্গ। যখন লিখি তখন তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমি আত্মনিবেদন করি। যে ছলে করি তার নাম উপন্যাস বা কবিতা বা আরও তুচ্ছ ছড়া। সেই আমার আর্ট।
আমি নিজেকে একজন বলে গণেছি। কিন্তু এমন যদি হত যে আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে ‘বন্দে মাতরম’ গান রেকর্ডে দিয়েছি, গানের কোন অংশ কে গেয়েছে জানবার উপায় নেই, সবটাই সকলের গাওয়া, তাহলে আমরা ঠিক একজন হতুম না আক্ষরিক অর্থে। এক পক্ষ বললে গণিতশাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা হত। কিন্তু আর্টের বিচারে এক পক্ষও যা, একজনও তাই। তার মানে আমরা ‘বন্দে মাতরম’ গায়করা সাত-আট জন হয়েও একজন। কারণ অন্তর আমাদের একটিই। সুরও একটি। তালও একটি দৃশ্যত। আমরা বহু, কিন্তু অদৃশ্যত এক।
এই অর্থে তাজমহল একজনের সৃষ্টি। সেই একজনের নাম সকলের সুবিধার খাতিরে শাহজাহান। আসলে তাঁর নামই নেই।
যেমন নেই সাঁচি ভারহুৎ ইলোরা অজন্তার ভাস্করদের স্থপতিদের চিত্রীদের নাম। তাঁরা এক লক্ষ্যে এক উপলক্ষ্যে এক হয়েছেন। তাই তাঁরা একজন। অজন্তার বেলায় একজন, ইলোরার বেলায় একজন, তাজমহলের বেলা একজন, কোণার্কের বেলায় একজন। গণভাস্কর্য বা জনস্থাপত্য বলে যদি কিছু থাকে তবে তা একজনের সৃষ্টি। যে হিসাবে আমাদের সেই ‘বন্দে মাতরম’ গান। একজন মানে মাথা গুনতির একজন নয়। অন্তর গুনতির, সুর গুনতির, লক্ষ গুনতির একজন। মহাভারতেও বহুজনের হাত লেগেছে, রামায়ণেও বহুজনের হস্তক্ষেপ। সকলের নাম মনে রাখা যায় না বলে ব্যাস বাল্মীকির নামই গ্রন্থকারের নাম।
একজনই হোক আর বহুজনই হোক, এক পক্ষ দাতা, অপর পক্ষ গ্রহীতা; এক পক্ষ জ্ঞাপক, অপর পক্ষ জ্ঞাতা। দুই পক্ষ নিয়ে যেমন পক্ষী, তেমনি আর্ট। কিংবা দুই পাড় নিয়ে যেমন নদী, তেমনি আর্ট। উপমা দুটি জুতসই হল না, কিন্তু ওর চেয়ে সুন্দর উপমা খুঁজে পাচ্ছি কোথায়! যুগল না হলে যেমন লীলা হয় না, দুই পক্ষ না হলে তেমনি আর্ট হয় না। দুই হাত না হলে যেমন তালি বাজে না, দুই পক্ষ না হলে তেমনি বঁাশি বাজে না, বীণা বাজে না, অর্কেস্ট্রা বাজে না। দুই-এর উপরে আমি এতটা জোর দিচ্ছি এইজন্যে যে লেখকের ও পাঠকের পরস্পরের সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে সাহিত্য হয় আঁধারে ঢিল ছোড়া। আমরা প্রতিদিন আঁধারে ঢিল ছুড়ছি ও খাচ্ছি। আমাদের অধিকাংশ রচনা প্রীতি পাচ্ছে না, ব্যর্থ হচ্ছে।
লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মন জানাজানি, বছরে চারখানা করে বই লেখাটাই লক্ষ্য নয়। ওটা যে সবসময় আর্ট তাও নয়। ওটা অধিকাংশ স্থলে আর্ট নয়, ইণ্ডাস্ট্রি। ওর মূলে রয়েছে আর্থিক তাড়না, আন্তরিক প্রেরণা নয়। আন্তরিক প্রেরণা যেখানে, সেখানে চেনাশোনাটাই লক্ষ্য, আর আর্ট তার উপলক্ষ্য। অর্থের প্রশ্ন ওঠে না, তবে সামাজিক অব্যবস্থার দরুন আর্টিস্টকে তা নিতে হয়, নতুবা প্রাণহানি।
আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের যুগে সামাজিক অব্যবস্থার পেষণে আর্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজারের পণ্য। যেমন চাল ডাল মশলা মাছ মাংস ডিম শাড়ি গয়না সিঁদুর; তেমনি নাটক উপন্যাস কাব্য নাচ গান ছবি। লেখকের সঙ্গে পাঠকের যথার্থ সম্বন্ধ কোনো পক্ষেরই মনে নেই, দু-পক্ষেরই ব্যবহার এ দেশের বরপক্ষের ও কন্যাপক্ষের ব্যবহারের মতো। রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ বলছে,
কেহ বা দেখে মুখ কেহ বা দেহ,
কেহ বা ভালো বলে, বলে না কেহ।
ফুলের মালাগাছি বিকাতে আসিয়াছি
পরখ করে সবে, করে না স্নেহ।
বলা বাহুল্য কন্যাপক্ষীয়রাও বরকে পরখ করে নেন সুযোগ পেলেই। কেউ কাউকে পরখ করতে ছাড়ে না, কারণ সম্বন্ধটা হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতার।
আর্ট যেহেতু পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সেহেতু তার বিচার হচ্ছে পণ্য হিসাবে। যিনি দাম দিয়ে কিনে কৃতার্থ করবেন তিনি কেন গ্রহীতা হবেন, তিনি ক্রেতা! আর যে হতভাগ্য দাম না নিয়ে পারে না সেকোন মুখে বলবে সেদাতা! হাতেনাতে ধরা পড়ছে সেবিক্রেতা। স্বয়ং শেক্সপিয়ারের পক্ষেও প্রমাণ করা শক্ত যে তিনি বিশুদ্ধ দাতা। টলস্টয়ের প্রকাশক ও পত্নী তাঁকে দাতা হতে দিলেন না কিছুতেই, তাঁর শেষজীবনের দ্বন্দ্ব তো প্রধানত এই নিয়ে। এই দ্বন্দ্ব থেকে তাঁকে উদ্ধার করল তাঁর মৃত্যু। মৃত্যুর পরে তিনি আর বিক্রেতা নন, তিনি বিশুদ্ধ দাতা। কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি ও থাকতে চাই, এই দ্বন্দ্ব থেকে পরিত্রাণের উত্তম কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিনে। ইচ্ছা করে কোনো এক আশ্রমের বা ট্রাস্টের নামে গ্রন্থের উপস্বত্ব লিখে দিতে, কিন্তু তাতে করে লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্বন্ধ শোধরায় না।