রোজ কেয়ামত- বা প্রলয় দিন

রোজ কেয়ামত- বা প্রলয় দিন

একজন বহুদর্শী বিজ্ঞ বৈজ্ঞানিক সম্প্রতি সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, আমাদের পৃথিবী ধ্বংস (প্রলয় বা রোজ-কেয়ামত) হইবার দিন যত দূর মনে করি, বাস্তবিক তত দূর নয়। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া যেসব আলোচনা হইয়াছে, সেই সব লইয়াই আলোচনা করিয়া দেখা যাক।

গত অর্ধ শতাব্দী ধরিয়া ইহা লক্ষ হইতেছে যে, দক্ষিণ পোলার প্রদেশে ভাসমান তুষারের স্তূপ ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতেছে। এডমন্টের ক্যাপ্টেন স্মিতার্থ সর্বপ্রথম ৫০০ ফুট উচ্চ এক তুষার-স্তূপ দেখিতে পান। অতঃপর স্কট সাহেব ৬০০ ফুটেরও উঁচু এক বরফের পাহাড় দেখিতে পান। কিন্তু এজনেটার একজন নাবিক সমুদ্রের উপরেও হাজার ফুটের বেশি উচ্চ এক পর্বত-প্রমাণ বরফ স্তূপ আবিষ্কার করেন এবং তাহাতে সমস্ত পৃথিবী চমকিত হইয়া যায়। পরে নির্ধারিত হয় যে, এই তুষার পর্বত ৯৬১২ ফুট পুরু অর্থাৎ পৌনে দুই মাইলেরও বেশি চওড়া।

দক্ষিণ বিষুবরেখায় অতি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড তুষার-পর্বতসমূহের সংখ্যা পূর্বাপেক্ষা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে। আর এই জন্যই দক্ষিণ পোলার প্রদেশসমূহ ভয়ানক উষ্ণ হইয়া উঠিতেছে। উত্তর দিকস্থ বহু দূরের ভাসমান তুষারস্তূপসমূহ দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় অত্যধিক শীতের সৃষ্টি করিয়াছে। এখানের শৈত্যের সঙ্গে অন্য স্থানের তুলনাই হয় না। ‘বুইনস এরিস’ নামক স্থানে সম্প্রতি এক তুষার-বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। এই দেশে আর কখনও তুষার-বৃষ্টি হয় নাই।

এসবের মানে কী? প্রফেসর লুইস ও অন্যান্য বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিকের মতে আমাদের পৃথিবীতে দ্বিতীয় মহাপ্লাবন ও মহাধ্বংস অতি আসন্ন। যদি সমস্ত দুনিয়াও ধ্বংস না হয়, তাহা হইলে পৃথিবীর একাংশ যে ধ্বংস হইয়া যাইবে, তাহাতে আর সন্দেহ নাস্তি।

দক্ষিণ মেরুতে যে গগন-চুম্বী বরফের মহা আচ্ছাদন রহিয়াছে, তাহা লম্বাতে চৌদ্দ শত মাইল এবং কত শত মাইল যে পুরু তাহার ইয়ত্তাই নাই! এখন এই যে দক্ষিণ মেরুর আবহাওয়া এই রকমে ক্রমেই অসহ্য উষ্ণ হইয়া উঠিতেছে, ইহার পরিণাম কী? সকলেই জানেন বরফ গরম হইলে গলিয়া যায়। সুতরাং এখন দক্ষিণ মেরুর এই অত্যধিক উষ্ণতার দরুন সেখানের ওই সহস্র সহস্র যোজন-ব্যাপী তুষারের মহাপর্বতসমূহ ভাঙিয়া গলিয়া যাইবে, এবং আকাশ-সমান সচল হিমালয়ের মতো তরঙ্গের রাশি চতুর্দিক ধুইয়া-মুছিয়া লইয়া যাইবে। প্রথমে এই মহা-প্লাবনে আক্রান্ত হইবে পৃথিবীর ঢালু দিক অর্থাৎ দক্ষিণ মহাদেশসমূহ।

পুরাকালে আমাদের পূর্বপুরুষগণ ধূমকেতুকে ভয়ানক ভয় করিতেন, কেননা তাঁহারা জানিতেন না, ধূমকেতু কী? আমাদের পরবর্তী পিতাগণ এ সম্বন্ধে বেশি জানিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহারাও ধূমকেতুকে অত্যন্ত ভয় করিতেন ও অলক্ষুনে মনে করিতেন। কারণ, তাঁহারা মনে করিতেন এইসব ধূমকেতুর মস্তক নিরেট, সুতরাং পৃথিবীর এত নিকটে আসার দরুন যদি তাহার সহিত দৈবক্রমে পৃথিবীর সংঘর্ষ হইয়া যায়, তাহা হইলে সারা দুনিয়া ধ্বংস হইয়া যাইবে।

এখন আমরা জানিতে পারি, ধূমকেতু নিরেট শক্ত নয়, ইহা কুয়াশার মতো নীহারময়। সুতরাং যদি দৈবক্রমে এক-আধটা ধূমকেতুর পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষও হইয়া যাইত, তাহা হইলে ইহা দ্বারা পৃথিবীর কোনো অংশ গভীর গর্তও হইয়া যাইত না, বা ইহা আমাদিগকে পৃথিবীর আকর্ষণের বাহিরে ছুঁড়িয়া দিতেও সক্ষম হইত না।

কিন্তু ফ্রান্সের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত মঁসিয়ে ক্যামিলি ফামারিয়ন সাহেব এক বিভীষিকাময় সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। তাহা এই যে, ধূমকেতুর ওই যে নীহারময় পুচ্ছ তাহা বিষাক্ত গ্যাসে ভরপুর। সেইজন্য ধূমকেতু যদি একবার পৃথিবীর সংস্পর্শে আসিতে পারে, তাহা হইলে ওই বিষাক্ত গ্যাসে সমস্ত পৃথিবী এক নিমেষে প্রাণীশূন্য হইয়া যাইবে, তাহার রূপ-রস-গন্ধ চিরদিনের তরে ধুইয়া-মুছিয়া সাফ হইয়া যাইবে।

ধূমকেতুর সৃষ্টির রাসায়নিক ব্যাখ্যা এখনও সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় নাই, কিন্তু ইহা সহজে সকলে বুঝিতে পারেন যে, ধূমকেতু ইহার পুচ্ছে নিশ্চয়ই গ্যাস ভরিয়া রাখে। এই গ্যাস অনায়াসে আমাদের পৃথিবীর বাতাস হইতে যবক্ষারজান শুষিয়া লইতে পারে; এবং তাহা হইলে যেদিকে যাও সেই দিকেই মরণ আর কী! সাধে কী আমাদের পূর্বপুরুষগণ এই জিনিসটাকে এত অপছন্দ করিতেন! কথায় বলে, ‘ধূমকেতুর মতো সে এসে আমার অদৃষ্টে উদয় হল!’ পৃথিবীর অদৃষ্টেও ধূমকেতু বাস্তবিকই অলক্ষুনে ও অমঙ্গলজনক।

যাক, যদি ইহা যবক্ষারজান বাতাস হইতে শুষিয়া লয়, তাহা হইলে আমরা শুধু অক্সিজেন বা অম্লজান বাষ্পই পাইব। সত্য বটে যে, অম্লজান বাষ্প রক্তসঞ্চালন এবং মানসিক ও শারীরিক কর্মপটুতা বৃদ্ধি করে, কিন্তু তাই বলিয়া শুধু অম্লজান বাষ্প আবার ভয়ানক মারাত্মক। সুতরাং নিশ্বাস-প্রশ্বাসে শুধু উত্তেজন অম্লজান বাষ্প পাইয়া আমাদের শরীর ক্রমেই উত্তপ্ত হইয়া উঠিবে এবং ক্রমে আমরা জ্বলিয়া-পুড়িয়া ছারখার হইয়া যাইব।

কয়লা-যুগের সময় এই পৃথিবীর বাতাস কার্বনিক অ্যাসিডের দরুন ভারী ছিল। সেসময় সে-বাতাস মানুষে সহ্য করিতে পারিত না। কেবল মৎস্য ও সরীসৃপজাতীয় জীববৃন্দ স্রোতময় জলাভূমিতে ও নিশ্চল বাতাসে বাঁচিয়া ছিল। ক্রমশ উদ্ভিদ ও গাছ-গাছড়ার বিপুল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওই বিষাক্ত নিশ্চল বাতাস দূর হইয়া যাইতে লাগিল, আকাশ পরিষ্কার হইল এবং এইরূপে এই বাতাস উষ্ণ রক্তময় জীবের উপযোগী হইয়া উঠিল।

বর্তমানে মানব জাতি কয়লা খনন কার্যে ও তাহার সাহায্য গ্রহণে বিষম ব্যস্ত। এই কয়লা কখনকার জানেন কি? ইহা ওই বহু লক্ষ যুগ পূর্বের কার্বনিক অ্যাসিড-ভরা বাতাসের কালের এবং এই কয়লা সেই সময়কার গাছ-গাছড়ারই পরিণতি হইতে পারে, কেননা বনের গাছ-গাছড়াই এখনও ওই কার্বনিক অ্যাসিড শোষণ করিতে ওস্তাদ।

প্রত্যেক কয়লার চাপ ও প্রত্যেকটি দেশলাই যাহা জ্বালানো হয়, তাহা প্রত্যহ আমাদের দরকারি অম্লজান বাষ্প নিঃশেষ করিতেছে।

একজন বিখ্যাত ইংরেজ বৈজ্ঞানিক সম্প্রতি ঘোষণা করিয়াছেন যে, জগতের অম্লজান ক্রমশই নিঃশেষিত হইয়া যাইতেছে, এবং বাতাসও সেইজন্য ক্রমেই কলুষিত হইয়া উঠিতেছে, সুতরাং সেদিন আগতপ্রায় – যেদিন পৃথিবীর সমস্ত কিছু কার্বনিক অ্যাসিডময় যুগের জীবে পরিণত হইয়া যাইবে।

মানুষ ক্রমেই ক্ষুদ্র ও দুর্বল হইতে হইতে শেষে লিলিপুটিয়ানদের মতো হইয়া পড়িবে, তার পর একবারেই নেস্তানাবুদ! তারপর আদির মতোই অস্ত! অর্থাৎ প্রথমে যেমন মৎস্য আর সরীসৃপ জাতিই ছিল, পরেও তেমনই য়্যা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মহা-মৎস্য আর মহা-সরীসৃপ অবতারগণ বহাল খোশ-তবিয়তে বিরাজ করিবেন।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের খুব সরু লম্বা ঘৃণ্য সরীসৃপ জাতিও – যেমন, কেঁচো সাপ ইত্যাদি – প্রচুর পরিণামে আবার আমাদের ঢিপেয় রাজত্ব করিবে।

যদি মানবজাতি বর্তমানের এই অনিষ্টকারী কয়লার মহা-খরচা ছাড়িয়া দেয় (শুধু কয়লা জ্বালানোর জন্যই বৎসরে ১৬০০ মিলিয়ন টন অম্লজান বাষ্প নষ্ট হইতেছে।) এবং তৎপরিবর্তে ইলেকট্রিক দিয়া কয়লার কাজ চালাইয়া লয়, তাহা হইলে আমাদিগকে আবার আর এক নূতন বিপদের মুখ-গহ্বরে পড়িতে হইবে! অর্থাৎ যেদিকেই যাও, নিশ্চয়ই মরিতে হইবে। জলে কুমির, ড্যাঙায় বাঘ!

আগে হইতে আবহাওয়ার ক্রম-পরিবর্তন পরিলক্ষিত হইতেছে। বজ্রাঘাত – বিশেষ করিয়া শীতকালে বজ্রপতন – ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতেছে, আর ইহার একদম সোজা কারণ রহিয়াছে যে, পৃথিবীর আর বাতাসের ইলেকট্রিসিটি ঠোকাঠুকি দরুনই এই বজ্র উৎপাতের সৃষ্টি! তাহা হইলে কঃ পন্থা? সেই জন্যই বুঝি পান্নাময়ী আগে হইতেই গাহিয়া রাখিয়াছে, ‘মরিব মরিব সখি, নিশ্চয়ই মরিব!!’

আচ্ছা ধরুন, যদি বায়বীয় ইলেকট্রিসিটির উপরে বর্তমান অপেক্ষা শত বা সহস্র গুণ ভার চাপানো হয় তাহা হইলে আর কি বসন্তে ফুল ফুটিবে – কচি পাতা গজাইবে? আর কি তবে বর্ষার ব্যাকুল বরিষন পৃথিবীর বক্ষ সিক্ত করিবে? না, গো না! তার বদলে বজ্র-পতনই হইবে আমাদের পৃথিবীতে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। রোজ শত শত বজ্রপাতে পৃথিবী ছিন্না-ভিন্না হইয়া যাইবে। একজন ধুরন্ধর উল্কাতত্ত্ববিৎ বৈজ্ঞানিক বলিতেছেন, হাঁ হাঁ, তাহাই হইবে অবশেষে! কী ভয়ানক! আমাদের এখন উচিত যে, আমরা সবাই মিলিয়া প্রাণপণে চক্ষু বুজিয়া বিশ্বাস করি, ও-ভদ্রলোকের কথা মিথ্যা এবং তিনি ভুল বুঝিয়াছেন। ওই যে আমাদের আলোকদাতা সবিতা সুয্যিমামা – উনি শুধু যে আলো আর উষ্ণতারই সৃষ্টি করেন তা নয়, তিনি ইলেকট্রিক শক্তিরও জনক। আর এই আমাদের একমাত্র মামা যিনি প্রকৃতির এই প্রহেলিকাময় অজানা শক্তির সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য সব দিক সমঝাইয়া চলিবেন! মামা জীবতু!

বর্তমান সুয্যিমামার ক্ষমতা এত উগ্র প্রচণ্ড যে, যদি এঁর সমস্ত রশ্মি আর উগ্রতা শুধু আমাদের এই গরীব পৃথিবীর উপর আসিয়া পড়িত, তাহা হইলে মাত্র দেড়মিনিটের মধ্যেই ওই যে আগে মহা-মহা বরফ-পর্বতের কথা বলিয়াছি, সে সমস্তই গলিয়া টগবগ করিয়া ফুটিত। এবং আরও এগারো সেকেন্ড থাকিলে দুনিয়ার এত বড়ো সমুদ্র, সমস্ত শুকাইয়া ফাটিয়া চৌচির হইয়া হাঁ করিয়া থাকিত।

কিন্তু সুয্যিমামাও দিন দিন সংকুচিত হইয়া ছোটো হইয়া চলিয়াছেন। দৈনিক কতটুকু করিয়া যে তাঁহার বর-বপুর সংকোচন হইতেছে তাহা এখনও জানা যায় নাই। প্রফেসর বার্নস জোরের সঙ্গে বলেন যে, সুয্যিমামার এই সংকোচন বড়ো জোরেই চলিতেছে। এত জোরে যে আমরা তাহার একটি মোটামুটি ধারণাও করিতে পারি না। অতি অল্প কালের মধ্যেই সূর্যের উত্তাপের কমতি দেখিয়া বুঝিতে পারি যে, সত্যি সত্যিই সূর্য ছোটো হইয়া যাইতেছে কিনা।

এই রকম ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র হইতে হইতে যখন সুয্যিমামা পটল তুলিবেন, অর্থাৎ তাঁহার আর অস্তিত্বই থাকিবে না, তখন সে দুর্দশা হইবে পৃথিবীর, তাহার চিন্তাও মহা-ভয়াবহ! যত জল জমিয়া একেবারে পাথরের চেয়েও শক্ত হইয়া উঠিবে, কিন্তু দেখিতে হইবে খাসা – একেবারে হিরের টুকরোর মতন জ্বলজ্বলে!এই যে বাতাস যাহাকে এখন দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না, ইহা তখন বৃষ্টির মোটামোটা ফোঁটার মতো হইয়া ঝরিয়া পড়িবে। এইসব আবার গহ্বরে গহ্বরে জমিয়া কাচের চেয়েও স্বচ্ছ সরোবরে পরিণত হইবে, কিন্তু তাহাতে ঢেউ খেলিবে না, শুধু নির্বিকার, প্রশান্ত! কেননা তখন বাতাসই যে বহিবে না। সমস্ত পৃথিবী তখন নির্দয় শীতের প্রকোপে জমিয়া স্থির নিশ্চল হইয়া যাইবে । শুধু নীহারিকা আর অস্পষ্ট কুয়াশা!

সূর্য আস্তে আস্তে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিবে, আবার সারাদিন অমনই রক্তবর্ণ থাকিবে। ঠিক যেন আধ-নির্বাপিত একটা জ্বলন্ত গলিত লৌহপিণ্ড! দিনেই তখন সমস্ত আকাশ আরও উজ্জ্বল তারায় ভরিয়া উঠিবে! আল্লা-হু-আকবর!