রেবতীর পতিলাভ
বিষ্ণুপুরাণে রাজা রৈবত—ককুদ্মী ও তাঁর কন্যা রেবতীর একটি বিচিত্র আখ্যান আছে। সেই ছোট আখ্যানটি বিস্তারিত করে লিখছি। এই পবিত্র পুরাণকথা যে কন্যা শ্রদ্ধাসহকারে একাগ্রচিত্তে পাঠ করে তার অচিরে সর্বগুণান্বিত বাঞ্ছিত পতি লাভ হয়।
পুরাকালে কুশস্থলী নগরীতে রৈবত—ককুদ্মী নামে এক ধর্মাত্মা রাজা ছিলেন। তিনি রেবত রাজার পুত্র সেজন্য তাঁর নাম রৈবত, এবং ককুদযুক্ত বৃষ অর্থাৎ ঝুঁটিওয়ালা ষাঁড়ের তুল্য তেজস্বী সেজন্য অপর নাম ককুদ্মী। সেকালে মহত্ত্ব ও বীরত্বের নিদর্শন ছিল সিংহ, ব্যাঘ্র ও বৃষ, সেজন্য কীর্তিমান লোকের উপাধি দেওয়া হত—পুরুষসিংহ, নরশার্দুল, ভরতর্ষভ, মুনিপুংগব, ইত্যাদি।
রৈবত রাজার রেবতী নামে একটি কন্যা ছিলেন, তিনি রূপে, গুণে অতুলনা। রেবতী বড় হলে তাঁর বিবাহের জন্য রাজা পাত্রের খোঁজ নিতে লাগলেন। অনেক পাত্রের বিবরণ সংগ্রহ করে রৈবত একদিন তাঁর কন্যাকে বললেন, দেখ রেবতী, আর বিলম্ব করতে পারি না, তোমার বয়স ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। তুমি অত খুঁত ধরলে বরই জুটবে না। আমি বলি কি, তুমি কাশীরাজ তুন্দবর্ধনকে বিবাহ কর।
রেবতী ঠোঁট কুঁচকে বললেন, অত্যন্ত মোটা আর অনেক স্ত্রী। আমি সতীনের ঘর করতে পারব না।
রাজা বললেন, তবে গান্ধারপতি গণ্ডবিক্রমকে বিবাহ কর তাঁর স্ত্রী বেশী নেই।
—গণ্ডমূর্খ আর অনেক বয়স।
—আচ্ছা, ত্রিগর্ত দেশের যুবরাজ করম্বকে কেমন মনে হয়?
—কাঠির মতন রোগা।
—কোশলরাজকুমার অর্ভক?
—তবে আর কথাটি নয়, দৈতরাজ প্রহ্লাদকে বরণ কর। অমন রূপবান ধনবান বলবান আর ধর্মপ্রাণ পাত্র সমগ্র জম্বুদ্বীপে নেই।
রেবতী বললেন, উনি তো দিনরাত হরি হরি করেন, ও রকম ভক্ত লোকের সঙ্গে আমার বনবে না।
রৈবত হতাশ হয়ে বললেন, তবে তুমি নিজেই একটা পছন্দ মতন স্বামী জুটিয়ে নাও। যদি চাও তো স্বয়ংবরের আয়োজন করতে পারি, যাকে মনে ধরবে তার গলায় মালা দিও।
—কার গলায় দেব? সব সমান অপদার্থ।
এমন সময় দেবর্ষি নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন। যথাবিধি পূজা গ্রহণ করে কুশল—প্রশ্নের পর নারদ বললেন, তোমরা পিতা—পুত্রীতে কিসের বাদানুবাদ করছিলে?
রৈবত উত্তর দিলেন, আর বলবেন না দেবর্ষি। এখনকার মেয়েরা অত্যন্ত অবুঝ হয়েছে, কিছুতেই বর মনে ধরে না। আমি অনেক চেষ্টায় পাঁচটি ভাল ভাল পাত্রের সন্ধান পেয়েছি, কিন্তু রেবতী কাকেও পছন্দ করছে না। স্বয়ংবরা হতেও চায় না, বলছে সব অপদার্থ। আপনি যা হয় একটা ব্যবস্থা করুন।
নারদ বললেন, রেবতী নিতান্ত অন্যায় কথা বলে নি, আজকাল রূপে গুণে উত্তম পাত্র পাওয়া দুরূহ। চেহারা দেখে আর খবর নিয়ে স্বভাব—চরিত্র জানা যায় না। এক কাজ কর, প্রজাপতি ব্রহ্মাকে ধর, তিনিই রেবতীর বর স্থির করে দেবেন।
রাজা বললেন, ব্রহ্মার নির্বাচিত বরও হয়তো রেবতীর মনে ধরবে না।
নারদ বললেন, না ধরবে কেন? আমাদের পিতামহ বিরিঞ্চি সর্বজ্ঞ, তাঁর নির্বাচনে ভুল হবে না। আর, তোমার কন্যারও তো কোনও বিশেষ পুরুষের উপর টান নেই। আছে নাকি রেবতী?
রেবতী ঘাড় নেড়ে জানালেন যে নেই।
নারদ বললেন, তবে আর কি, অবিলম্বে ব্রহ্মলোকে যাত্রা কর। আমি এখন কুবেরের কাছে যাচ্ছি, তাঁকে বলব তোমাদের যাতায়াতের জন্য পুষ্পক রথটা পাঠিয়ে দেবেন।
রাজা করজোড়ে বললেন, দেবর্ষি, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন, নইলে ভরসা পাব না।
নারদ বললেন, বেশ, আমি শীঘ্রই কুবেরপুরী থেকে রথ নিয়ে এখানে আসব, তার পর একসঙ্গে ব্রহ্মলোকে যাওয়া যাবে।
নারদ ফিরে এলে তাঁর সঙ্গে রৈবতী—ককুদ্মী ও রেবতী পুষ্পক বিমানে ব্রহ্মলোকে যাত্রা করলেন। তখন হিমালয় এখনকার মতন উঁচু হয় নি, মাথায় সর্বদা বরফ জমে থাকত না। হিমালয়ের উত্তর দিকে সমুদ্রতুল্য বিশাল একটি হ্রদ ছিল। তাঁরা হিমালয় হেমকূট নিষধ প্রভৃতি পর্বতমালা এবং হৈমবত হরি ইলাবৃত প্রভৃতি বর্ষ অর্থাৎ বড় বড় দেশ অতিক্রম করে দুর্গম ব্রহ্মলোকে গিয়ে ব্রহ্মার সভায় উপস্থিত হলেন। সেই অলৌকিক সভার বিবরণ দেবার চেষ্টা করব না, মহাভারতে আছে যে তা অবর্ণনীয়, তার রূপ ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়।
নারদের সঙ্গে রৈবত আর রেবতী যখন ব্রহ্মসভায় প্রবেশ করলেন তখন সেখানে গীত বাদ্য নৃত্য চলছে। লোকপিতামহ ব্রহ্মা একটি উচ্চ বেদীতে রত্নময় সিংহাসনে বিরাজ করছেন তাঁর বামে ব্রহ্মাণী এবং চারি পাশে দক্ষ প্রচেতা সনৎকুমার অসিতদেবল প্রভৃতি মহাত্মা এবং আদিত্য রুদ্র বসু প্রভৃতি গণদেবতা বসে আছেন। দুই বিখ্যাত গন্ধর্ব কালোয়াত হাহা হূ হূ অতিতান—রাগে মেঘগম্ভীর কণ্ঠে গান গাইছেন, অন্য দুই গন্ধর্ব তুম্বুরু ও ডুম্বুরু দুন্দুভি অর্থাৎ দামামা বাজাচ্ছেন। তখন মৃদঙ্গ আর বাঁয়া—তবলার সৃষ্টি হয়নি। দশজন বিদ্যাধর দশটি প্রকাণ্ড বীণায় ঝংকার দিচ্ছেন এবং উর্বশী রম্ভা মেনকা ঘৃতাচী প্রভৃতি অপ্সরার দল ঘুরে ঘুরে নৃত্য করছেন। একজন মহকায় দানব একটি অজগরতুল্য রামশিঙা কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং মাঝে মাঝে তাতে ফুঁ দিয়ে প্রচণ্ড নিনাদে শ্রোতাদের আনন্দ বর্ধন করছে। সভাস্থ সকলে তন্ময় হয়ে সংগীত—রস পান করছেন এবং ভাবের আবেশে মাথা দোলাচ্ছেন।
ব্রহ্মার উদ্দেশে প্রণাম করে নারদ নিঃশব্দে সনৎকুমারের কাছে গিয়ে বসলেন। একজন বেত্রধারিণী প্রতিহারী যক্ষী ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রৈবত ও রেবতীর কাছে এল এবং ইঙ্গিত করে ডেকে নিয়ে তাঁদের সুখাসনে বসিয়ে দিলে।
একটু পরেই আব্রহ্ম—দেব—গন্ধর্ব—মানব প্রভৃতি সভাস্থ সকলে সবেগে মাথা আর হাত নেড়ে বলে উঠলেন—হা—হা—হাঃ! সাধু সাধু, অতি উত্তম! নৃত্যাগীতবাদ্য নিবৃত্ত হল। ব্রহ্মা, তখন রৈবত ও রেবতীর প্রতি প্রসন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিকটে আসবার জন্য সংকেত করলেন।
পিতা—পুত্রী সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলে ব্রহ্মা বললেন, রাজা, তোমার কন্যাটি তো দেখছি পরমা সুন্দরী, বড়ও হয়েছে, এর বিবাহ দাও নি কেন?
রৈবত বললেন, ভগবান কন্যার বিবাহের জন্যই আপনার কাছে এসেছি। আমি অনেক ভাল ভাল পাত্রের সন্ধান পেয়েছি, কিন্তু রেবতী কাকেও পছন্দ করছে না। কাশীরাজ তুন্দবর্ধন, গান্ধারপতি গণ্ডবিক্রম, ত্রিগর্তযুবরাজ কড়ম্ব, কোশলরাজকুমার অর্ভক, দৈত্যরাজ প্রহ্লাদ—
ব্রহ্মা স্মিতমুখে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।
রৈবত বললেন, আপনিও কি এঁদের সুপাত্র মনে করেন না?
ব্রহ্মা বললেন, ওরা কেউ এখন জীবিত নেই, ওদের পুত্র—পৌত্র—প্রপৌত্রাদিও গত হয়েছে।
—বলেন কি পিতামহ!
—হাঁ, সব পঞ্চত্ব পেয়েছে। তোমারও আত্মীয়—স্বজন কেউ জীবিত নেই।
মস্তকে করাঘাত করে রৈবত বললেন, হা হতোস্মি! ভগবান, আমার রাজ্যের আর সকলে কেমন আছে? মুখ্যমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে সমস্ত রেখে আপনার চরণদর্শনে এসেছি, এর মধ্যে অকস্মাৎ কোন দুর্বিপাকে আমার আত্মীয়বর্গ বিনষ্ট হল? আমার কোন পাপের এই পরিণাম?
ব্রহ্মা বললেন, মহারাজ, শান্ত হও। অকস্মাৎ বা তোমার পাপের ফলে কিছুই হয় নি, যথাবিধি কালবশে ঘটেছে। তোমার মন্ত্রী মিত্র ভৃত্য কলত্র বন্ধু প্রজা সৈন্য ধন কিছুই অবশিষ্ট নেই, কেবল তুমি আর তোমার কন্যা আছ।
আকুল হয়ে রৈবত বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না প্রভু। আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
ব্রহ্মা সহাস্যে বললেন, স্বপ্ন নয়, সবই সত্য। আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। জান তো, আমার এক অহোরাত্র হচ্ছে মানুষের ৮৬৪ কোটি বৎসর। আচ্ছা, তুমি এই সভায় কতক্ষণ এসেছ?
রৈবত একটু ভেবে বললেন, বেশীক্ষণ নয়, সওয়া দণ্ড হবে।
ব্রহ্মা বললেন, গণনা করে বল তো, আমার এই ব্রহ্মসভায় সওয়া দণ্ডে নরলোকের কত বৎসর হয়?
মাথা চুলকে রৈবত বললেন, ভগবান, আমি গণিতশাস্ত্রে চিরকালই কাঁচা। দেবর্ষি নারদ যদি কৃপা করে অঙ্কটি কষে দেন—
নারদ বললেন, হরে মুরারে! অঙ্ক টঙ্ক আমার আসে না, ও হল নীচ গ্রহবিগ্রহের কাজ। রেবতী, তুমি তো শুনেছি খুব বিদূষী, নানা বিদ্যা জান, বল না কত হয়।
রেবতী বললেন, পিতামহ ব্রহ্মার এক অহোরাত্রে অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় যদি মানুষের ৮৬৪ কোটি বৎসর হয় তবে সওয়া দণ্ডে অর্থাৎ আধ ঘণ্টায় কত বৎসর হবে—এই তো? তা হল গিয়ে ১৮ কোটি বৎসর। ভগবান, ভুল হয়নি তো?
ব্রহ্মা বললেন, না না, ঠিক হয়েছে। মহারাজ, বুঝতে পারলে? তুমি যতক্ষণ এখানে সংগীত শুনছিলে ততক্ষণে নরলোকে আঠারো কোটি বৎসর কেটে গেছে। তোমরা সত্যযুগের গোড়ায় এসেছিলে তার পর বহু চতুর্যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন যে চতুর্যুগ চলছে তারও সত্য ত্রেতা গত হয়েছে, দ্বাপরও গতপ্রায়, কলিযুগ আসন্ন।
শোকে অবসন্ন হয়ে রৈবত বললেন, ভগবান, আমার গতি কি হবে?
ব্রহ্মা উত্তর দিলেন, কি আবার হবে, তোমার ভাববার কিছু নেই। এখন ফিরে গিয়ে কন্যার বিবাহ দাও, তাহলে তুমি সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হবে। অমরাবতী তুল্য তোমার যে রাজধানী ছিল—কুশস্থলী, তার নাম এখন দ্বারকাপুরী হয়েছে, তা যাদবগণের অধিকারে আছে। পরমেশ্বর বিষ্ণু সম্প্রতি নরলোকে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং যাদববংশে জন্মগ্রহণ করে স্বকীয় অংশে বলদেবরূপে নরলীলা করছেন। সেই মায়ামানব বলদেবকে তোমার কন্যা দান কর। তিনি আর রেবতী সর্বাংশে পরস্পরের যোগ্য।
রৈবত বললেন, আপনার আদেশ শিরোধার্য, বলদেবকেই কন্যাদান করব।কিন্তু আমার গতি কি হবে প্রভু?
—আবার বলে গতি কি হবে! বৃদ্ধ হয়েছ, একমাত্র সন্তান রেবতীকে সৎপাত্রে দিচ্ছ, আর তোমার বেঁচে থেকে লাভ কি, রাজ্যেরই বা প্রয়োজন কি? তোমার রাজ্য তো রেবতীরই শ্বশুরবংশের অধিকারে আছে। মেয়ের বিবাহ দিয়ে তুমি সোজা ব্রহ্মলোকে ফিরে এস এবং সশরীরে আমার কাছে সুখে বাস কর। এর চাইতে আর কি সদগতি চাও?
রৈবত বললেন, তাই হবে প্রভু। কিন্তু দেবর্ষি নারদও আমার সঙ্গে মর্ত্যলোকে চলুন, আমি বড় অসহায় বোধ করছি।
নারদ বললেন, বেশ তো, আমি তোমার সঙ্গে যাব। কোনও চিন্তা করো না, রেবতীর বিবাহব্যাপারে আমি তোমাকে সর্বপ্রকারে সাহায্য করব।
ফেরবার সময় রৈবত ও রেবতী আকাশ থেকে দেখলেন, হিমালয়ের উত্তরে যেখানে নিম্নভূমি ছিল সেখানে অত্যুচ্চ মালভূমির উদ্ভব হয়েছে। যে জলরাশি ছিল তা শুকিয়ে বালুকাময় মরুভূমি হয়ে গেছে। হিমালয় আর ঢিপির মতন নেই, সুবিশাল অধিত্যকা আর উপত্যকায় তরঙ্গায়িত হয়েছে, শত শত চূড়া আকাশে উঠেছে, তার উপর দিক তুষারে আচ্ছন্ন, সেই তুষার সূর্যতাপে দ্রবীভূত হয়ে অসংখ্য নদীরূপে প্রবাহিত হচ্ছে। গাছপালাও আর আগের মতন নেই, জন্তুদের আকৃতিও বদলে গেছে। নারদ বুঝিয়ে দিলেন যে বিগত আঠারো কোটি বৎসরে ধীরে ধীরে এইসব প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটেছে।
পুষ্পক রথ যখন রৈবত—ককুদ্মীর ভূতপূর্ব রাজ্যের নিকটে এল তখন নারদ বললেন, মহারাজ, লোকালয়ে নেমে কাজ নেই, লোকে তোমাদের রাক্ষস মনে করে গোলযোগ বাধাতে পারে।
রৈবত আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, রাক্ষস মনে করবে কেন? কালক্রমে মানুষের বুদ্ধিও কি লোপ পেয়েছে?
নারদ বললেন, আমাকে দেখে কিছু বলবে না, কারণ আমার অণিমা প্রভৃতি যোগৈশ্বর্য আছে, ইচ্ছামত লম্বা কিংবা বেঁটে হয়ে জনসাধারণের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি। কিন্তু তোমাদের তো সে শক্তি নেই।
কিছুই বুঝতে পারছি না দেবর্ষি। আবার কি নূতন সংকট উপস্থিত হল?
—নূতন কিছু হয় নি, সবই যুগপরিবর্তনের ফল। তোমরা সত্যযুগের গোড়ায় জন্মেছ, যুগলক্ষণ অনুসারে তুমি লম্বায় একুশ হাত। মেয়েরা পুরুষের চেয়ে একটু খাটো হয়, তাই রেবতী উনিশ হাত লম্বা। কিন্তু ও এখনও ছেলেমানুষ, পরে আরও আধ হাত বাড়বে।
—আপনি কি যা—তা বলছেন! আমার এই রাজদণ্ডটি ঠিক এক হাত। এই দিয়ে আমাকে মেপে দেখুন না, আমি লম্বায় বড় জোর চার হাত হব।
—তোমার হাতের মাপে তাই হতে পার বটে, কিন্তু সে মাপ ধরছি না। কলিযুগে মানুষের হাতের যে মাপ, সকল শাস্ত্রে তাই প্রামাণিক গণ্য হয়। সেই কলিযুগীয় মাপে তুমি একুশ হাত আর রেবতী উনিশ হাত লম্বা।
—সত্যযুগে মানুষ যেমন একুশ হাত লম্বা, তেমনি ত্রেতায় চোদ্দ হাত, দ্বাপরে সাত হাত, কলিতে সাড়ে তিন হাত। এখন নরলোকে দ্বাপরের অন্তিম দশা, কলিযুগ আসন্ন, সেজন্য মানুষ খাটো হতে হতে চার হাতে দাঁড়িয়েছে, বড় জোর সওয়া চার হাত। এখানকার বেঁটে লোকরা যদি সহসা তোমাদের দেখে তবে রাক্ষস মনে করে ইট পাথর ছুড়বে। বিবাহের পূর্বে এরকম গোলযোগ হওয়া কি ভাল?
—আমাদের কি কর্তব্য আপনিই বলুন।
নারদ বললেন, নীচে ওই পাহাড়টি চিনতে পারছ?
রৈবত বললেন, হাঁ হাঁ খুব পারছি, ও তো আমারই প্রমোদগিরি, ওর উপরে নীচে অনেক উপবন আছে, রেবতী ওখানে বেড়াতে ভালবাসে।
—রাজা, তুমি কীর্তিমান। আঠারো কোটি বৎসর অতীত হয়েছে তথাপি লোকে তোমাকে ভোলে নি, তোমার নাম অনুসারে ওই পর্বতের নাম দিয়েছে রৈবতক। ওখানেই রথ নামানো হক। রেবতীর বিবাহ পর্যন্ত তুমি ওখানে গোপনে বাস কর।
একটু উত্তেজিত হয়ে রৈবত বললেন, লুকিয়ে থাকব কার ভয়ে? এ তো আমারই রাজ্য। আর, আপনিই তো বলেছেন এখানকার মানুষ অত্যন্ত ক্ষুদ্রকায়। আমি একাই সকলকে যমালয়ে পাঠিয়ে নিজ রাজ্য অধিকার করব।
নারদ বললেন, মহারাজ রৈবত—ককুদ্মী, তুমি সার্থকনামা, একগুঁয়ে ষাঁড়ের মতন কথা বলছ, তোমার বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে। সকলকে মেরে ফেললে কাকে নিয়ে রাজত্ব করবে? তোমার ভাবী জামাতার বংশ ধ্বংস হলে রেবতীর বিবাহ কি করে হবে? ওসব কুবুদ্ধি ত্যাগ কর।
রৈবত বললেন, আমার মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে গেছে। আপনি যা আজ্ঞা করবেন তাই পালন করব।
ইন্দ্রের দিব্য বিমানের একজন সারথি আছে—মাতলি। কুবেরের পুষ্পক রথ আরও উঁচু দরের, সারথির দরকার হয় না। রথটি সচেতন ও জ্ঞানবান, কথা বুঝতে পারে, বলতেও পারে। রামায়ণ উত্তরকাণ্ড দ্রষ্টব্য।
নারদ বললেন, বৎস পুষ্পক, তুমি যথাসম্ভব নিম্নমার্গে ওই রৈবতক পর্বত প্রদক্ষিণ করে ধীরে ধীরে উড়তে থাক। পুষ্পক ‘যে—আজ্ঞে’ বলে মণ্ডলাকারে চলতে লাগল। তিন ধার প্রদক্ষিণের পর নারদ বললেন, আমার সব দেখা হয়েছে, এইবারে অবতরণ কর। পুষ্পক রথ ভূমিস্পর্শ করে স্থির হল।
সকলে নামলে নারদ বললেন, পর্বতের এই পশ্চিম দিকটি বেশ নির্জন, বাসের উপযুক্ত গুহাও আছে। তোমরা এখন এখানেই থাক। আমি বরের পিতা বসুদেবের কাছে যাচ্ছি, তাঁকে পিতামহ পদ্মযোনি ব্রহ্মার ইচ্ছা জানিয়ে বিবাহের প্রস্তাব করব। তোমরা স্নানাদি সেরে আহার ও বিশ্রাম কর। পিতামহী ব্রহ্মাণী প্রচুর খাদ্যসামগ্রী দিয়েছেন, শয্যাও রথে আছে, সেসব নামিয়ে নাও। আমি রথ নিয়ে যাচ্ছি, শীঘ্রই ফিরে আসব।
নারদ চলে গেলেন। স্নান ও আহারের পর রেবতী একটি গুহায় বিছানা পেতে বললেন, পিতা, আপনি বিশ্রাম করুন, আমি একটু বেড়িয়ে আসছি। রৈবত বললেন, তা বেড়াও গে, কিন্তু ফিরতে বেশী দেরি ক’রো না যেন।
রৈবতকের পাদবর্তী উপবনে বেড়াতে বেড়াতে রেবতী নিজের অদৃষ্টের বিষয় ভাবতে লাগলেন। তাঁর আত্মীয়—স্বজনের মধ্যে শুধু পিতা আছেন, বিবাহের পর তিনিও ব্রহ্মলোকে চলে যাবেন। যিনি রেবতীর একমাত্র ভাবী অবলম্বন, সেই বলদেব কেমন লোক? ব্রহ্মা যাঁকে নির্বাচন করেছেন তিনি কুপাত্র হতে পারেন না—এ বিশ্বাস তাঁর আছে। কিন্তু নারদ যা বলেছেন সে যে বড় ভয়ানক কথা। রেবতী উনিশ হাত লম্বা, পরে আরও একটু বাড়বেন। কিন্তু তাঁর ভাবী স্বামী বলদেব যুগধর্ম অনুসারে নিশ্চয় খুব বেঁটে, বড় জোর সওয়া চার হাত, অর্থাৎ মানুষের তুলনায় যেমন বেড়াল। এমন বিসদৃশ বেমানান বেয়াড়া দম্পতির কথা রেবতী কস্মিন কালে শোনেন নি। মাকড়সা—জাতির মধ্যে দেখা যায় বটে—স্ত্রীর তুলনায় পুরুষ অত্যন্ত ক্ষুদ্র। কিন্তু তার পরিণাম বড়ই করুণ, মিলনের পরেই স্ত্রী—মাকড়সা তার ক্ষুদ্র পতিটিকে ভক্ষণ করে ফেলে। ছি ছি, রেবতীর কপালে কি এই আছে? বরকন্যার এই বিশ্রী বৈষম্যের কথা কি সর্বজ্ঞ ব্রহ্মা আর নারদের খেয়াল হয় নি? দেবতা আর দেবর্ষি হলে কি হবে, দুজনেরই ভীমরতি ধরেছে।
রেবতী একটি বকুল গাছে হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ ভাবতে লাগলেন। দুঃখে তাঁর কান্না এল। হঠাৎ পিছন দিকে মৃদু মর্মর শব্দ শুনে তিনি মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, একটি অতি ক্ষুদ্র মূর্তি হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষার নূতন মেঘের ন্যায় তার কান্তি, কাঁধ পর্যন্ত ঝোলা গোছা গোছা কালো চুল সরু ফিতের মতন সোনার পটি দিয়ে ঘেরা, তার এক পাশে একটি ময়ূরের পালক বাঁকা করে গোঁজা। পরনে বাসন্তী রঙের ধুতি, গায়েও সেই রঙের উত্তরীয়, গলায় আজানুলম্বিত বনমালা। অতি সুশ্রী সুঠাম কিশোর বিগ্রহ। রেবতী আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, কে তুমি, মানুষ না পুতুল?
সহাস্যে নমস্কার করে সেই অদ্ভূত মূর্তিটি উত্তর দিলে, আমি আপনার আজ্ঞাবহ কিংকর।
—তোমার নাম কি, পরিচয় কি? কিজন্য এখানে এসেছ?
—আমার নাম কৃষ্ণ, আমি বসুদেবের পুত্র, বলদেবের অনুজ। আপনি আমার ভাবী জ্যেষ্ঠভ্রাতৃজায়া, পূজনীয়া, বধূঠাকুরাণী, তাই প্রণাম করতে এসেছি।
অবজ্ঞা ও কৌতুক মিশ্রিত স্বরে রেবতী বললেন, আমাকে দেখে ভয় করছে না? শুনেছি তোমার দাদা নাকি একটি অবতার, নারায়ণের অংশে জন্মেছে। তুমিও অবতার নাকি?
কৃষ্ণ বললেন, আমি অত ভাগ্যবান নই, দশ অবতারের তালিকায় আমার নাম ওঠে নি। এখন আমার বার্তা শুনুন। দেবর্ষি নারদ আমার পিতার কাছে গিয়ে আপনার সঙ্গে বলদেবের বিবাহের প্রস্তাব করেছেন। পিতা পরমানন্দে সম্মত হয়েছেন। কালই বিবাহ। আমার অগ্রজ এখনই আপনার সঙ্গে আলাপ করতে আসবেন, সেই সুসংবাদ দেবার জন্য আমি তাঁর অগ্রদূত হয়ে এসেছি।
রেবতী প্রশ্ন করলেন, সম্পর্কে তুমি আমার কে হবে? শ্যালক?
কলহাস্য করে কৃষ্ণ বললেন, আপনি দেখছি নিতান্ত সেকেলে, কাকে কি বলতে হয় তাও জানেন না। পত্নীর ভ্রাতাই শ্যালক, পতির ভ্রাতাকে তা বলতে নেই। আমি আপনার দেবর। এই যে, দাদা এসে গেছেন।
রেবতী দেখলেন, তাঁর ভাবী স্বামী কৃষ্ণের চাইতে ঈষৎ লম্বা আর মোটা, রজতগিরিতুল্য শুভ্র কান্তি, চন্দনচর্চিত প্রশস্ত বক্ষ, বলিষ্ঠ বাহু, নীল চোখ, সিংহ কেশরের মতন কটা রঙের চুল মুক্তামালা দিয়ে ঘেরা, তার এক পাশে একটি সারসের পালক গোঁজা। পরনে নীল ধুতি, গায়ে নীল উত্তরীয়, গলায় মল্লিকার মালা। কাঁধে বাঁশের লাঠি, তার উপর দিকে একটি সুমার্জিত লাঙ্গলের ফলা লাগানো, অস্তগামী সূর্যের কিরণে তা ঝকমক করছে।
দীর্ঘাঙ্গী রেবতী উনিশ হাত উঁচু থেকে তার ভাবী স্বামীকে যুগবৎ সতৃষ্ণ ও বিতৃষ্ণ নয়নে ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করলেন। হা বিধাতা, এই একরত্তি পুরুষ তাঁর বর! এত সুন্দর কিন্তু এত ক্ষুদ্র! রেবতী কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিলেন এবং শিষ্টাচার স্মরণ করে নমস্কার জানালেন।
বলদেব স্মিতমুখে বললেন, ভদ্রে, আমাকে মনে ধরে?
রেবতী উত্তর দিলেন, শুনেছি আপনি একজন অবতার, নারায়ণের অংশে জন্মেছেন। আমার মতন সামান্য নারী কি আপনার যোগ্য?
বলদেব বললেন, অর্থাৎ আমিই তোমার যোগ্য নই। তুমি অতিকায় মহামানবী, আমি ক্ষুদ্রদেহ মানবক। তুমি উচ্চ তালতরু, আমি তুচ্ছ এরণ্ড। তুমি তেতলা সমান উঁচু আর আমি একটা উইঢিপি। রেবতী, তুমি ভাবছ আমি তোমার নাগাল পাব কি করে। দুশ্চিন্তা ত্যাগ কর, আমি এখনই তোমার যোগ্য হব।
এই বলে বলদেব একটু দূরে সরে দাঁড়ালেন এবং কাঁধ থেকে লাঙ্গলটি নামিয়ে তার দণ্ড ধরে বনবন করে ঘোরাতে লাগলেন। ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে দণ্ডটি লম্বা হতে লাগল। একটু পরে কৃষ্ণ বললেন, এই হয়েছে, আর ঘুরিও না দাদা। তখন বলদেব লাঙ্গলের ফলা রেবতীর কাঁধে আটকে বললেন, সুন্দরী, অপরাধ নিও না, এই লাঙ্গল আমার বাহুর প্রতিনিধি হয়ে তোমার কম্বুগ্রীবা আলিঙ্গন করছে।
রেবতী মন্ত্রমুগ্ধবৎ নিশ্চল হয়ে রইলেন। বলদেব ধীরে ধীরে লাঙ্গলদণ্ড আকর্ষণ করলেন। সলতে টেনে নিলে প্রদীপের শিখা যেমন ক্রমশ ছোট হতে থাকে, রেবতীও সেইরকম ছোট হতে লাগলেন। কৃষ্ণ সতর্ক হয়ে দেখছিলেন। বলে উঠলেন, থাম থাম, আর নয়—এঃ দাদা, তুমি বড্ড বেশী টেনে ফেলেছ!
বলদেব লাঙ্গল নামিয়ে নিলেন। তার পর নিজের হাত দিয়ে রেবতীকে মেপে বললেন, তাই তো, করেছি কি, রেবতী তিন হাত হয়ে গেছে! আচ্ছা, এখনই ঠিক করে দিচ্ছি। এই বলে তিনি রেবতীকে তুলে ধরে বললেন, প্রিয়ে, আমার অপটুতা মার্জনা কর। তুমি এই বকুলশাখা অবলম্বন করে ক্ষণকাল ঝুলতে থাক।
রেবতীর তখন ভাববার শক্তি নেই। তিনি দু হাতে গাছের ডাল ধরে ঝুলতে লাগলেন, বলদেব তাঁর দুই পা ধরে ধীরে ধীরে টানতে লাগলেন। কৃষ্ণ বললেন, আর একটু—আর একটু—এইবারে থাম, ঠিক হয়েছে।
রেবতীকে নামিয়ে নিজের পাশে দাঁড় করিয়ে বলদেব সহাস্যে বললেন, কৃষ্ণ, বর বড় না কনে বড়?
কৃষ্ণ বললেন, লম্বায় কনে সাত আঙুল ছোট, কিন্তু মর্যাদায় তোমার চাইতে ঢের বড়, কারণ ইনি আঠারো কোটি বৎসর আগে জন্মেছেন। চমৎকার মানিয়েছে। এই বলে কৃষ্ণ দুজনকে প্রণাম করলেন।
নিকটে একটি ছোট জলাশয় ছিল। রেবতীকে তার ধারে এনে যুগল মূর্তির প্রতিবিম্ব দেখিয়ে বলদেব বললেন, রেবতী, দেখ তো, এইবারে আমি তোমার যোগ্য হয়েছি কিনা। এখন মনে ধরছে কি?
রেবতী বললেন, মনে না ধরলেই বা উপায় কি! অবতার না আরও কিছু! দুই ভাই দুটি ডাকাত। তোমাদের মতলব আগে টের পেলে আমি দুজনকে টেনে লম্বা করে দিতুম।
তার পর মহাসমারোহে রেবতী—বলদেবের বিবাহ হয়ে গেল। রৈবত—ককুদ্মী বরকন্যাকে আশীর্বাদ করে নারদের সঙ্গে ব্রহ্মলোকে প্রস্থান করলেন।
১৩৫৮ (১৯৫১)